। অলৌকিক বাক্স-রহস্য ।
আমার এক দাদা বলত, গরম ফুলকো লুচি শোভিত থালার কাছে পৃথিবীর যেকোনো ভাস্কর্য হার মানতে বাধ্য!
এই দক্ষিণে স্বপাকের বন্দোবস্ত না থাকলে অমন ভাস্কর্য দেখার সৌভাগ্য মেলেনা। শ্বেতবর্ণা লুচির বদলে শ্যামাঙ্গিনী পুরিতেই মন মজাতে হয়। অবিশ্যি আমাদের রবি ঠাকুর শিল্পী মানুষ। তার স্নেহস্পর্শে শ্যমবর্ণা পুরি একেবারে কৃষ্ণকলি হয়ে ওঠে। নরম তুলতুলে। থালার উপর তারাও একেবারে খাজুরাহোর ভাস্কর্যস্বরূপ। সাথে চানার একটা তরকারি বানাত আগে। অমন কোমলকান্তি পুরির সাথে এরকম অনাচার দেখে শুভর ততোধিক কোমল হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠল। একদিন পাঁজি-পুঁথি দেখে রবি ঠাকুরকে ‘খামোশ-টামোশ' বলে হাতা খুন্তি নিয়ে নিজেই নেমে পড়ল। বিধাতা যেমন যত্ন নিয়ে ‘এমা ওয়াটসন’ কিংবা ‘ক্যাটরিনা কাইফ’কে গড়েছেন, সেরকম যত্ন নিয়ে শুভ তৈরী করল আলু চচ্চড়ি। কালো জিরে আর কাঁচালঙ্কা সহ। হাল্কা ঝোল। তার উপরে তেলের একটা মৃদু আস্তরণ। শুভ মন্দ রাঁধে না। পুরো বিষয়টা রবি ঠাকুরকে বাধ্যতামূলক ভাবে দেখানো এবং শেখানো হয়েছিল। সেই থেকে পুরির সাথে চানাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হল।
তাই জয়দার ওইসব ধর্মতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বকবকানি থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা যখন ডাইনিং টেবিলে ল্যান্ড করলাম, তখন প্লেটের উপর গোল ফুলকো পুরির ভাস্কর্য এবং আলু-চচ্চরির মোহময়তা মিলেমিশে আমাদের প্রায় নির্বাণোত্তর শূন্য অবস্থায় নিয়ে চলে গেছিল। ফিরে আসতে হল জয়দার কথা শুনে। তিনি নির্বিকার। ফোলা পুরির মধ্যে আঙুল দিয়ে ফুটো করে ভুস করে খানিকটা গরম হাওয়া বের করে বলল, “তোরা সব হ্যাঙলা!”
আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে একটা গোটা পুরি আলু-চচ্চড়ি পেঁচিয়ে মুখে চালান করে দিয়ে বললাম, “হ্যাংলামির কী দেখলে? প্রকৃতির নিয়মে একজন মানুষ এক থালা পুরি আলু-চচ্চড়ির প্রেমে পড়েছেন! এতে দোষটা কোথায়?”
শুভ নীরব। ও খাওয়ার সময় সমালোচনা গায়ে মাখে না।
জয়দা বলল, “প্রেমই বটে! একেবারে নিকষিত হেম… বুদ্ধদেব বলেছিলেন কী জানিস?”
আবার বুদ্ধদেব! খাওয়ার সময়ও মুক্তি নেই। একটা কাঁচালঙ্কা দাঁতে কেটে বললাম, “কী?"
“দুপুর বারোটার পর নো খাওয়া দাওয়া। লিক্যুইড চলতে পারে। সলিড নৈব নৈব চ!”
“এখন তো সবে দশটা বাজে!”
“দুপুরে মুর্গীর ঝোলটা তাহলে খাবিনা?”
“মুর্গী? আজ মুর্গী?” শুভর মুখে কথা ফুটল এতক্ষণে। সাথে একটা দিব্য হাসি।
রবি ঠাকুর “হাঁ, ভাইনা” বলে সম্মতি দিল।
আমি জয়দাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওনলি লিক্যুইড? মানুষ বাঁচবে কী করে?”
“সেটাই তো অ্যাজেন্ডা ছিল মহাসাংঘিকদের।”
“মহা সাংঘাতিক কারা?” শুভর প্লেট ফাঁকা। আটখানা পুরি জাস্ট উবে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে। বাটি থেকে আঙুল দিয়ে ঝোল চাটতে চাটতে বলল।
“সাংঘাতিক না রে অলম্বুষ! সাংঘিক। মহাসাংঘিক। যারা বৈশালীর দ্বিতীয় বৌদ্ধ-সংগীতি ছেড়ে চলে গেছিল। তাদের সিধা বক্তব্য ছিল যে এতসব কঠিন নিয়ম মানতে পারব না। স্থবিরবাদীরা সে কথা মানবে কেন? তখন ওরা আলাদা হয়ে গিয়ে নিজেদের একটা আলাদা সংগীতি আয়োজন করে। স্বাভাবিকভাবেই জগতে তোর মত ফাঁকিবাজের সংখ্যা প্রচুর। যারা সকাল বিকেল রাত খাই খাই করে, নিয়ম-টিয়ম অত মেনে চলতে কষ্ট হয়। ফলে ওদের আয়োজন করা সংগীতি হিট হয়ে যায়। প্রায় হাজার দশেক মানুষ যোগ দেয়।”
“হাজার দশেক!?” আমার অবাক হওয়ার পালা।
“ইয়েস। মার্কেটিং, প্রোমোশন কীরকম করেছিল ভাব! তখন তো আর ফেসবুক লিঙ্কড-ইন ছিল না! যাই হোক, এই বিশাল মাপের সংগীতি যখন হিট হয়ে গেল - দলছাড়া বৌদ্ধরা নিজেদেরকে ‘মহাসাংঘিক' বলে নাম দিল। যদিও স্থবিরবাদীদের পিছনে রাজার হাত ছিল বলে শুরুর দিকে ওরা বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। মৌর্যরা ছিলেন স্থবিরবাদী। ফলে অশোক নিজের ছেলে ‘মহেন্দ্র'কে সিংহলে পাঠান এই স্থবিরবাদের প্রচারের জন্যই। এখনো শ্রীলংকাতে মূলতঃ স্থবিরবাদী বৌদ্ধধর্মেরই উপাসনা হয়।”
“আর তিব্বতে?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“তিব্বতে গেল মহাযান।”
“মানে এই ‘মহাসাংঘিক'রা?"
“উম, বলতে পারিস। অবিশ্যি যখন তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম পা ফেলল তখন মহাসাংঘিকরা হয়ে উঠেছেন মহাযানী।”
“মানে, শুধু নিজের নয় - জগতের নির্বাণ?”
“হ্যাঁ। তবে 'অত কঠিন নিয়ম মানবনা' থেকে - ‘জগতের নির্বাণ’ অবধি চিন্তাধারা পৌঁছতে লেগে গেছে শ’তিনেক বছর। অশোকের সময় আর একটি সংগীতি আয়োজিত হয়েছিল। সেখানে এই ‘মহাসাংঘিক'রা বিশেষ পাত্তা পায়নি। ফলে মহাযানী টেক্সটে ওই তৃতীয় বৌদ্ধ-মহাসংগীতির কথা উল্লেখই করা হয়না। ওটাকে স্কিপ করে ওরা সোজা চলে আসে চতুর্থতে। সম্রাট কনিষ্কর সময় যেটা আয়োজিত হয়েছিল জলন্ধরে।”
“জলন্ধর? মানে, পাঞ্জাব?”
“হ্যাঁ। তবে অনেকে বলেন যে এটা কাশ্মীরে হয়েছিল। শ্রীনগরের কাছে। যাই হোক, মোট কথা কনিষ্কর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আচার্য বসুবন্ধুর সভাপতিত্বে এই কাউন্সিল আয়োজিত হয়। কনিষ্ক ছিলেন এই মহাসাঙ্ঘিকদের পৃষ্ঠপোষক।”
“কনিষ্ক কীভাবে মহাসাংঘিকদের পছন্দ করলেন? তুমি যে বললে রাজারা স্থবিরবাদীদেরই স্বীকার করতেন?” আমার মাথায় প্রশ্ন এলো।
“গুড কোশ্চেন। যে সব রাজারা মহাসাঙ্ঘিকদের পাত্তা দিতেন না, তারা ছিলেন ভারতবর্ষের রাজা। যেমন মৌর্যরা। তারা থেরবাদী ছিলেন এবং থেরবাদীদেরকেই মেনে নিয়েছিলেন। মহাসাংঘিকরা এটা বুঝতে পেরেছিল। সে কারণে তারা সরে যায় ভারতের পশ্চিম দিকে। যেখানে বিদেশিদের আনাগোনা বেশী ছিল। শক, যবন, পহলব -এরা ওই সময় ওইদিকে রাজত্ব শুরু করে। যেহেতু এরা বিদেশী, এদের স্থবিরবাদ নিয়ে কোনো ধারনাই নেই - সেই কারণে এদের দলে টানা সুবিধা হল বেশী। কুষাণরাও বহিরাগত। তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে সমস্যা হয়নি মহাসাংঘিকদের।”
“আচ্ছা, সেই কারণেই ফোর্থ কাউন্সিলে এরা বেশী পাত্তা পেল?”
“হ্যাঁ। মনে করা হয় যে, এই চতুর্থ সংগীতিতেই জন্ম হয় ‘মহাযান’এর। মহাসাংঘিকরা নিজেদের মধ্যে ‘গোকুলিক’ আর ‘একব্যোহারিক’ নামে দুই দলে ভাগ হয়েছিল। মহাযান মত এই দুই দলকে এক করে দিল। আর ব্যাকফুটে ঠেলে দিল ‘স্থবিরবাদী’দের।”
“তাহলে এই মহাযান গেল তিব্বত?”
“হ্যাঁ। সেটা অবিশ্যি আরও কিছুদিন পরে। তিব্বতে তখনও বোনপোদের কাল।”
“বোনপো?” শুভ থালা রেখে এসে ফ্রিজ থেকে একটা চকোলেট বের করে মুখে দিয়েছে। খাবার পর নাকি একটু মধুরেণ সমাপয়েৎ নাহলে ওর পেট ভরলেও মন ভরে না। এখানে এই সময় আর মিষ্টি কোথায় পাবে, তাই অনলাইনে গ্রোসারির সাথে অর্ডার করা চকোলেটই ভরসা।
“বোন ধর্মালম্বী মানুষ। তাদের বোনপোই বলা হত।”
“তিব্বতের সেই প্রাচীন ধর্ম?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“হ্যাঁ - তবে বোন ধর্ম একইরকম ছিল না। সময়ের সাথে পাল্টেছে। পরবর্তীকালে, অর্থাৎ যখন বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করল তখনও বৌদ্ধদের সাথে কম্পিটিশন দেওয়ার জন্য নিজেদের ধর্মগ্রন্থ তৈরী করেন বোন পুরোহিতরা। সেসবই অবিশ্যি বিভিন্ন বৌদ্ধ সূত্রর অক্ষম পরিবর্তিত রূপ ছিল। যেমন বৌদ্ধদের বীজমন্ত্র ‘ওঁ মনি পদ্মে হুঁ’ কে বোনরা বিকৃত করে ‘জুঃ-এম-পদ-নি-মো’ করেছিল। অবিশ্যি এ সবই বৌদ্ধদের লিখিত ইতিহাস থেকে পাওয়া - তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যও এসব বলে থাকতে পারে। আমাদের সেসব ঐতিহাসিক বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। আমাদের কাজ গল্প শোনা। তা এই বোন ধর্মকে বোনপোরা তিন ভাগে ভাগ করেছেন - প্রাচীন বোন, সনাতন বোন এবং নব্য বোন। অন্যদিকে বৌদ্ধরা কালবিভাগ করেছেন অন্যভাবে - বন্য, বিকৃত এবং সংশোধিত। প্রথমদিকে এই বোনধর্মের আচার ব্যবহারের সাথে হিন্দু ধর্মের বা প্রিসাইসলি বলতে গেলে শৈবদের কিছু আচার-ধর্মের মিল লক্ষ্য করা যায়। সংশোধিত পর্যায়ে এসে বোন ধর্মর প্রক্রিয়া অনুকরণ করেছে বৌদ্ধধর্মকে।”
“আচ্ছা, এই বোন ধর্মের উৎস কী? মানে বৌদ্ধধর্ম তো গৌতম বুদ্ধের থেকে এসেছে…”
“শেনরাব মি বো। বোন ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী এই ভদ্রলোকই বোন ধর্মের প্রবর্তক। অবিশ্যি এ সব লোককথা। আমাদের পুরাণের মত। সত্যাসত্য বিচারের প্রয়োজন নেই। বলা হয়, প্রায় ষোলহাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শেনরাব মি বো-র জন্ম। তিনি নাকি দশহাজার বছর বেঁচে ছিলেন…”
“দ-শ-হা-জা-র!”
“হ্যাঁ। দশ হাজার শুনে অত বড় হাঁ করছিস? আমাদের দ্বাপর যুগে মুনি ঋষিরা তো অমন দশহাজার বছর শুধু তপস্যাই করতেন। বাঁচতেন কদিন সেকথা আর না ভাবাই ভাল।”
“উফ! এরা গাঁজা দিতে দিতে কোথায় নিয়ে গেছে!”
“সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? তুই যদি বলিস কশ্যপ মুনি শুভর মত একটা লোক ছিল। যে লুচি দেখলে লঙ জাম্প দিত - তাহলে কি একশো বছর পরে মানুষ তার কথা মানবে? বল, তিনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন, শুধু ফলাহারে দিন কাটাতেন, কপালের উপর তিন নম্বর চোখ ছিল - তবেই লোকে মনে রাখবে তাকে। যা অস্বাভাবিক, আনিউজুয়াল - সেটাই মনে থাকে মানুষের। সেই কারণেই শেনরাব মি বোও বেঁচে ছিলেন দশ হাজার বছর।”
“আচ্ছা, বেশ। শেনরাব মি বো তারপর কী করলেন?”
“মি বোর জন্ম হয় এলমো লুং রিং বলে কোনও জায়গায়। সে জায়গা যে কোথায় তা বলা মুশকিল - তবে মনে করা হয় তিব্বতের পশ্চিমে কোথাও। মানে, কাশ্মীর বা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের কোথাও। সে যেখানেই হোক - এই এলমো লুং গ্রিং-এর মধ্যে এক পৌরাণিক পবিত্র স্থান তাক্জিগ্। এই তাক্জিগ্-এর ঠিক মধ্যিখানে ছিল পিরামিড আকৃতির 'ইয়ং দ্রুং গুজেক’ পর্বত। এখানেই কোথাও জন্ম মি বোর।”
“ওখান থেকে তিব্বতে কী করে এলেন তিনি?”
“এক ঘোড়া চোরকে ধাওয়া করে! এক দুষ্টু দানো শেনরাব মি বোর ঘোড়া চুরি করে পালায়। মি বো তাকে ধাওয়া করে এসে পড়েন তিব্বতে। তিব্বতে এসে ঘোড়া উদ্ধার করার জন্য সেই দৈত্য ছাড়াও আরও অনেক অপদেবতাদের নিজের ঐশ্বরিক ক্ষমতার দ্বারা বশে আনেন। এমনকি মি বোর ক্ষমতা দেখে তিব্বতের দেবতারাও নাকি সারেন্ডার করে দেন। মি বোর আশ্রয়ে যারা আসে তারাই বোন ধর্মী হিসাবে পরিচিত হন। আর এভাবেই বোন ধর্মের সূচনা হয় তিব্বতে!”
“মানে, ঘোড়া চোর ধরতে গিয়ে নতুন ধর্ম প্রচার করে ফেলল!”
“ভাব তবে! বৌদ্ধ ধর্মে শাক্যমুনি বুদ্ধের যেমন জায়গা, বোনপোদের কাছে শেনরাব মি বোও তেমনি। এই বোন ধর্মই তিব্বতে ছিল হাজার হাজার বছর ধরে। তিব্বতের রাজারাও এই ধর্মই মেনে চলতেন। রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেওয়ার জন্য সব রাজকর্মচারীরা বছরে একবার সমবেত হতেন। সাথে নিয়ে আসা হত কুকুর ভেড়া বাঁদর ইত্যাদি প্রাণীদের। এরপর এক নারকীয় ব্যাপার চলত। এই সব প্রাণীদের হাত পা ভেঙে দেওয়া হত প্রথমে। তারপর তাদের বলি দেওয়া হত। সেখানেই থামত না। বলির পর তাদের পেট থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে দেহগুলি খণ্ড খণ্ড করে পুঁতে ফেলা হত।”
“কী ভয়ংকর! কেন?”
“রাজকর্মচারীদের ভয় দেখানোর জন্য। এইসব করার পর বোন পুরোহিতরা বলতেন কেউ যদি রাজার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে দেবতারা সেই বিশ্বাসঘাতককে ঠিক এইভাবে শাস্তি দেবেন।”
“আর লোকে বিশ্বাস করত?”
“সে আর আমি কী করে জানব? নিশ্চয়ই করত! তারা তো আর তোর মত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেনি। অশিক্ষিত লোক। পুরোহিত সর্ব-শক্তিমান। সে যা বলছে মানতে হত।”
“কী সাংঘাতিক ধর্ম!”
“সব ধর্মই এরকম ছিল। বিশেষ করে প্রাচীন ধর্মগুলি। হিন্দু ধর্মেও পশুবলি ছিল। ব্রাহ্মণরা রাজার চেয়েও বেশী ক্ষমতাবান ছিল। তখন সাধারণ শিক্ষার চেয়ে ধর্ম শিক্ষাই হত। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি - নালন্দা, বিক্রমশীল, ওদন্তপুরী - সবই বৌদ্ধ মহাবিহার। কনভেন্ট স্কুলের মত। অন্য ধর্মের মানুষের পাঠ নেওয়ার অধিকার আছে - কিন্তু প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে প্রাধান্য দেবে বেশী। অবশ্য নালন্দা বা বিক্রমশীলে পদার্থবিদ্যা থেকে গণিত বা জ্যোতির্বিদ্যা অবধি সব কিছুই পড়ানো হত। আরও প্রাচীন কালে যখন পাঠযোগ্য বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি, গণিতচর্চা শুরু হয়নি - তখন মানুষ ধর্মশাস্ত্রকেই পাঠ করত। সুতরাং প্রাচীনকালে তিব্বতের এই ট্রাইবাল ধর্মের বীভৎসতার কথা ভেবে লাভ নেই। বরং এখন মানুষ এই বিজ্ঞানের যুগে ধর্মের নামে যে মারামারিগুলো করে সেটা হল নোংরামি। ধর্ম শব্দটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে 'ধারণ করা’ সেটা মানুষ আক্ষরিক অর্থে নিয়ে অস্ত্র ধারণ করে কাটাকাটি করতে নেমে পড়েছে - এটাই যা দুঃখের।” জয়দা একটু চুপ করে। বোতল থেকে এক ঢোক জল খায়।
(Tonpa Shenrab life story, 19th-century painting, Rubin Museum of Art Source: Wikipedia)
আমি বলি, “তাহলে তিব্বতের রাজারা মানে ঞাট্রি চানপো থেকে শুরু করে সবাই বোনপো ছিল?”
“হ্যাঁ। স্রোংচেন গামপো অবধি।”
“তাহলে স্রোংচেন গামপো বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বতে নিয়ে আসেন?”
“ঠিক। তবে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের পদার্পণ ঘটে আরও পাঁচ পুরুষ আগে। অবিশ্যি ধর্ম হিসাবে নয়।”
“মানে?"
“এর একটা মজার গল্প আছে।”
“বল।”
“তিব্বতের রাজা তখন ল্হাথো থোরি ঞাংচান।”
“বাপরে! কী নাম! শুনে প্রাণ আনচান করছে!” শুভ এতক্ষণ চুপচাপই ছিল। শুনছিল কি না জানিনা। এতক্ষণে ফুট কাটল।
“করুক! চকোলেট ভাগ না দিয়ে খেলে অমন অনেক কিছু করবে।” জয়দাও কম যায় না। তারপর আবার গল্পে ফিরে গেল, “এই রাজা যে প্রাসাদে বাস করতেন তার নাম ছিল ইয়াম্বু ল্হাখাং। অবিশ্যি প্রাসাদ শুনলে যা মনে হয়, সেরকম কিছু না। তিব্বতে প্রথম স্থায়ী বাড়ি তৈরী হয় স্রোংচেন গামপোর সময়। সুতরাং এ প্রাসাদ যে কী প্রাসাদ বুঝে নে। তবে সে যাই হোক, তার এক পিস ছাদ ছিল। সেই ছাদেই ঘটল সেই কাণ্ড!”
“কী কাণ্ড?”
“আকাশ থেকে নেমে এল এক রাত্রে বড়-বড় বড়-বড় গোল গোল চোখ।” বলে গেয়ে উঠল জয়দা।
“মানে স্পেসশিপ?” আমি হাঁ।
“না, তা ঠিক নয়। তবে একটা বাক্স। মেড অফ গোল্ড!”
“স্বর্ণ-পেটিকা? আকাশ থেকে?” শুভ জানলা দিয়ে একবার রোদ-জ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বোধহয় চারটে দাঁড়কাক ছাড়া কিছু দেখতে না পেয়ে মুখ ব্যাজার করে ফেলল।
“ইয়েস। রাজা উৎসাহিত হয়ে বাক্স খুললেন। নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে অনেক ধন রত্ন থাকবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি।”
“তবে? কী ছিল?”
“সেই পাগলা দাশুর মত। এক খান কাগজ - এক পিঠে লেখা ‘অতি কৌতূহল ভাল নয়’ আর অন্যদিকে ‘কাঁচকলা খাও’।” বলে জয়দা একটু হেসে নিলো।
“ধুর। বল না!”
“সত্যি তাই। কাগজ। অবিশ্যি ‘কাঁচকলা খাও’ লেখা কাগজ নয়। ‘কারন্ড্যব্যূহ সূত্র’ এবং ‘শত উপদেশ গাথা’ নামে দুটি পুঁথি আর ‘ওঁ মনি পদ্মে হুঁ’ মন্ত্র। কিন্তু রাজা তো নিরক্ষর! এসব সংস্কৃতে লেখা পুঁথি পড়বে কে? গোটা দেশে কেউ পড়তে জানে না। এইসব ভেবে রাজা তরোয়াল দিয়ে মাথা চুলকচ্ছেন এই সময় দৈববাণী হল - অমন মাথা চুলকিও না, বাপু। নিরেট মাথায় ঘষা খেয়ে তরোয়ালটা ভোঁতা হয়ে যাবে। বরং যা পেয়েছ, সযত্নে রেখে দাও। এর অর্থোদ্ধার করতে পারবে তোমারই বংশধর - পাঁচ পুরুষ পর। সেই শুনে রাজা ঞাংচান বাক্সটি সযত্নে রেখে দিলেন।”
“তা এই বাক্স-রহস্য ভেদ হল কবে?”
“স্রোংচেন গামপোর সময়। সে কথা পরে শুনিস। আগে বাক্সর কথা শেষ করি।”
“বাক্সর গল্প বাকি আছে?”
“গল্প বাকি নেই। বাকি আছে সত্যি ঘটনা। এসব যা বললাম সে তো বৌদ্ধ ইতিহাস রচয়িতাদের ঊর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। গে লোচাবা বলেছেন অন্য কথা। তিনি বলেছেন যে এই পুঁথিগুলি ভারত থেকে নিয়ে এসেছিলেন পণ্ডিত বুদ্ধিরক্ষিত এবং লিথেসে।”
“এরা কারা?”
“এরা কারা ঠিক জানা যায় না। তবে নাম শুনে যা মনে হয় বুদ্ধিরক্ষিত ভারতের মানুষ। কোনও বৌদ্ধ পণ্ডিত। আর লিথেসে সম্ভবতঃ নেপালি। কারণ ঐতিহাসিকরা বলছেন এই 'কারন্ড্যব্যূহ সূত্র’ নেপালেই খুব পপুলার ছিল সেসময়ে। মোটকথা এদের হাত ধরে ঐ বৌদ্ধ পুঁথি তিব্বতে পৌঁছয়। এবং ঘটনাটি ল্হাথো থোরি ঞাংচানের সময় ঘটে বলে পরবর্তী বৌদ্ধ ধর্মের মানুষরা ল্হাথো থোরি ঞাংচানকে ‘সামন্তভদ্রে'র অবতার হিসাবে গণ্য করেন। রাজাকে ঐশ্বরিকতা প্রদান করে তাকে স্মরণীয় করে রাখা আর কি!”
“কিন্তু, সামন্তভদ্র কে?”
“সব কি আজকেই শুনে ফেলবি? এই নে…” বলে ঘরে ঢুকল শুভ। কখন বেরিয়ে গেছিল খেয়ালই করি নি। হাতে চকোলেটের প্যাকেট। মুখে হর্ষবর্ধনের মত দানশীল হাসি। প্যাকেটটা জয়দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এ নাও। চকোলেট আমি এনেছি বলে শুধু আমার নয়। চাইলেই ফ্রিজ খুলে খেতে পার।” বুঝলাম ছেলের অভিমান হয়েছে।
(ক্রমশঃ)
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম এলো তাহলে! এ গল্পের কাছে নিজামুদ্দিনের দিল্লি বিজয় কিচ্ছা কিছুই না!
তারপর?
পৃনশ্চঃ
“আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, একজন আরেকজনের পরিপূরক, অর্থাৎ সমাজে কেউ আমরা একা নই” , গৌতম বুদ্ধ।।
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা, ২০২০
:)