সকাল থেকেই আকাশের মুখ কালো হয়েছিল। সজল মেঘের ছায়ায় ঢাকা পড়েছিল গোটা শহর। লকডাউনের নিয়ম শিথিল হয়ে আসায় পথে মানুষজনের আনাগোনা বেড়েছে। দু-চারটি দোকান-পাট আবার নতুন করে জেগে উঠেছে শীতের বরফ গলে যাওয়ার পর মাথা তোলা লাইকেনের দলের মত। নতুন আশার আলো নতুন করে সবুজের স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে তাদের গায়ে। এই কয়মাসের অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আবার নবীন সূর্যের মুখ দেখার প্রত্যাশী এখন এই পথের পাশের ছোট ছোট দোকানগুলো।
এমন এক একটা জোলো দিন এই গরমের শহরে সাময়িক হলেও একটু স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে। সমুদ্রের দিক থেকে ভেজা হাওয়া দখল নেয় গরম হাওয়ার রাজত্বের। আকাশের কালো মেঘের প্রতিচ্ছবি মাখা অপার সমুদ্রটাকে ভারী মায়াময় মনেহয়। আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় রাস্তায় মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। অবিশ্যি এইসময় এমনিই রাস্তায় মানুষ কম। সকাল থেকে আমাদের বারান্দা থেকে দৃশ্যমান রাস্তার অংশটুকুকে একেবারে প্রাণহীন মনে হচ্ছে।
মঞ্জুশ্রী আর শুভকে বললাম যে এই বর্ষার মধ্যে যাস না।
আজকেই ওদের সেই এন জি ও-তে যাওয়ার কথা ছিল। জয়দা কাল রাত জেগে সব প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ইন্সটল করে সেই ‘আলিবর্দী খাঁ’র ল্যাপটপকে যুগোপযোগী করে তুলেছিল। সকালে ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান ছিল দুজনের।
কিন্তু এমন নীল নবঘন ‘গ্রীষ্ম' গগনে তিল ঠাঁই আর নেই দেখে দুজনকেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়েছিলাম যে আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। কিন্তু শাস্ত্রে বলেছে যে গরীবের কথা বাসী হলে কাজে দেয়। আমার কথাকে সির্ফ পাত্তা না দিয়ে দুজনে এই মিনিট দশেক আগে বেড়িয়েই পড়ল।
আর এখন আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি।
“ইশ্, ছেলেমেয়েদুটো ভিজবে রে!” জয়দা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আমি একটা মোড়ায় বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে এইসব চিন্তা করছিলাম। বৃষ্টি পড়লেই, যেখানেই থাকি, মনটা কেমন যেন বেগুনী আর চায়ের জন্য আকুল হয়ে ওঠে। এখন যদিও ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য চিন্তা হচ্ছিল, তবুও বৃষ্টির ফোঁটা পড়া মাত্র বেগুনীর চিন্তাটা তেড়েফুঁড়ে উঠল।
“জয়দা, রবিকে বল না, গরম গরম বেগুনী ভাজতে।” জয়দাকে দেখে মনের ইচ্ছেটা প্রকাশ করেই ফেললাম।
জয়দা আমার হ্যাংলামোর এহেন লজ্জাজনক আত্মপ্রকাশ দেখে আমার দিকে কটাক্ষ হেনে বলল, “ছ্যা! এই তোর বন্ধুপ্রীতি! ছেলেটা ঝড়জলে ভিজছে - আর তুই কিনা খাইখাই করছিস! এখন বেগুনী খেলে ধম্মে সইবে?”
“এহ! ঝড়জলে ভিজছে যে তাতে সন্দেহ নেই - সাথে নার্গিস আছে - তবে ছবির নাম ‘মাদার ইন্ডিয়া’ না হয়ে ‘শ্রী ৪২০’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী - সেটা খেয়াল রেখো।” বলে গুনগুন করে ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’ ভাঁজতে ভাঁজতে রবি অন্বেষণে উঠে গেলাম।
শুভ আর মঞ্জুশ্রী ভিজে চুপচুপে হয়ে যখন ঘরে ফিরল তখন বেলা প্রায় বারোটা। মঞ্জুশ্রীকে আমাদের সাথেই লাঞ্চ করে নিতে বলেছিলাম সকালেই। বর্ষার দিনে খিচুড়ি আর ডিমভাজা খাওয়ার কথা প্রজ্ঞাপারমিতা না বেদ কোথাও একটা লেখা আছে। তাই আমরা শাস্ত্রবাক্য মেনেই চলি। বর্ষার দিনে এক রবি ঠাকুরের ‘এমন ঘন ঘোর বরিষায়’ এর সাথে আর এক রবি ঠাকুরের গরম গরম খিচুড়ির শিল্পভাবনা একেবারে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
মুচমুচে বেগুনীতে সুখের কামড় দিয়ে শুভ বলল, “আহ... কী শান্তি!”
“শান্তি নয় রে! বল সমুখে শান্তি পারাবার।” এক থালা খিচুড়ি নিজের দিকে টেনে নিয়ে মন্তব্য করল মঞ্জুশ্রী।
“তোদের আসল কাজ হল?” জয়দা জিজ্ঞেস করল।
“হুঁ। তোমাকে ছানাগুলো ‘নান্রি’ বলেছে। আর তোমার এই গুণধর চেলাকে আর যাই দাও - বাইক চালাতে দিও না।” মঞ্জুশ্রী এক চামচ ঘি নিয়ে সেটা খিচুড়ির মধ্যে ছড়াতে ছড়াতে বলল।
“কেন রে? উল্টেছিস নাকি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম শুভকে।
শুভ সবে মাথা নেড়ে ঘোর আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। মঞ্জুশ্রী কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল, “পুরো পপাত চ! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। মাথায় আলু হয়ে আছে আমার! ভাগ্যিস চলন্ত অবস্থায় উল্টোয়নি - নইলে আমাদের দেখতে এই দেবভোগ্য খিচুড়ি ছেড়ে হসপিটালে যেতে হত এতক্ষণে তোমাদের!”
“আহা। ঠিক আছে। এইসব বাধা-বিপত্তি এসেছে বলেই না কার্যসিদ্ধি হল!” জয়দাকে শুভর পক্ষ নিতে দেখে শুভ অবধি খাওয়া ফেলে কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
জয়দা তাই দেখে বলল, “আহা কথায় বলে না! - মাথায় আঘাত কার্যসিদ্ধি যদি না কর উহ্! সেদিন মঞ্জুশ্রীই তো গান শুনিয়ে গেল - দিন ফুরালে জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেবে আনি… সুতরাং ভাল কাজের জন্য মাভৈঃ বানীর ভরসা নিয়ে নেমে পড় জাস্ট। অল মীনস উইল বি উইথ ইয়ু।”
--------
“সাতশো তেষট্টি সালের এক বসন্তের সকাল। অবশ্য এখানে সারা বছরই শৈত্য। এই সময় শুধু মাটির উপরের পাতলা বরফের চাদরটি ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে তুষার চাপা পড়ে থেকে ঘাস গুল্মের দল তাদের সবুজ রঙ হারিয়ে ফেলে। বরফের স্তূপ সরে গিয়ে সূর্যের আলো যখন তাদের আবার স্পর্শ করে - ওই ঘাস গুল্মের দীর্ঘ তমসা কেটে গিয়ে ভোর আসে, নতুন করে। সুবিশাল এই তিব্বত সাম্রাজ্যের প্রায় সবখানেই গাছপালাদের এখন নতুন করে সবুজের ছোঁয়া পাওয়ার সময়। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ‘রাসা' নগরীও তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রায় দেড়শো বছর বয়স হতে চলল এই নগরীর। প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভূপ্রকৃতির জন্য এই সুবিশাল তিব্বতের অধিকাংশ স্থানই বসবাসে অযোগ্য। চতুর্দিকে পর্বতের মাঝে এই একফালি সমতল উপত্যকার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ইয়ার্লুং সাংপো নদী। এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলেই বাস ছিল ইয়ার্লুং উপজাতির। ইয়ার্লুংরা শক্তি বৃদ্ধি করে যখন আশপাশের উপজাতিদের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে এনে ফেলল - তখন প্রয়োজন পড়ল যাযাবর পশুপালক জীবন পরিবর্তণ করে একটু সুষ্ঠু স্থায়ী আবাসভূমির। ইয়ার্লুংদের রাজা স্রোংচান গামপো তাই আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে তাদের রাজধানী সরিয়ে আনেন এই ‘রাসা’ নগরীতে। নির্মাণ হয় ওই রাজপ্রাসাদের।
রাজপ্রাসাদটি নগরের মাঝে এক উঁচু পাহাড়ের শিখরে হওয়ায় অনেক দূর থেকে দৃষ্টির গোচরে আসে। আঙুল তুলে সেদিকে নির্দেশ করে এই ‘রাসা’ নগরীর সৃষ্টির কথা বলছিলেন ভিক্ষু জ্ঞানেন্দ্র। জ্ঞানেন্দ্রর জন্ম এখানেই। তিব্বতের বর্তমান সম্রাট ঠিস্রোং দেচেনের রাজসভার এক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকর্ষণ ও জ্ঞানের অভীপ্সা তাকে নিয়ে গেছিল ভারতবর্ষে - বুদ্ধগয়ায়। তারপর নেপালে কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে এসেছিলেন ‘রাসা’তে। রাজার কাছে এক গোপন ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। এই আপামর তিব্বতি মানুষকে আদিম সংস্কার থেকে বের করে আনার জন্য রাজা ঠিস্রোং দেচেন পরিকল্পনা করছিলেন বৌদ্ধধর্ম - যা কি না এখনও অবধি তিব্বতের রাজ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারিত করার। একটি বিহার তৈরী করার ইচ্ছা তার। যেখানে ভারতবর্ষ, চীন থেকে বিভিন্ন পুঁথির তিব্বতি অনুবাদ রক্ষিত থাকবে। মানুষ পড়তে পারবে। জানতে পারবে। কিন্তু এই অশিক্ষা, কুসংস্কারের অন্ধকারে থাকা এই দেশে কার হাতে সেই দায়িত্ব দেবেন! তার সৎ মা, চীন দেশের রাজকুমারী জিন চেং উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খোটান থেকে একদল বৌদ্ধসন্ন্যাসীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন তিব্বতে। কিন্তু তারপর সেই প্রবল মহামারী শুরু হল। মায়ের মৃত্যু ঘটল। বৌদ্ধসন্ন্যাসীদের মাধ্যমে বিদেশী ধর্মের প্রবেশকেই এই মহামারীর কারণ ভেবে দেশের মানুষ তাদের বহিষ্কার করে দিল দেশ থেকে। মায়ের সেই অপূর্ণ সাধকে বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যগ্র তিনি। কিন্তু এদেশে ওই প্রাচীন বোন ধর্মালম্বী পুরোহিতদের তন্ত্রমন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন ধর্মমত প্রচার করার সাহস কারো নেই। এমনকি সম্রাট স্বয়ং ভয় পান তাদের আইনের পাশে বাঁধতে। তাই জ্ঞানেন্দ্র যখন ভারতবর্ষ থেকে এক সুপণ্ডিত মানুষকে এখানে নিয়ে আসার প্রস্তাব রাখলেন, রাজা একবাক্যে সমর্থন করলেন তাকে।
জ্ঞানেন্দ্র আজ বহু পথশ্রমের পর উপস্থিত হয়েছেন ‘রাসা’ নগরীর উপকণ্ঠে। আর কিছুক্ষণ পথ চললেই নগরে প্রবেশ করবেন তারা। আচার্য শান্তরক্ষিত নেপালে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিব্বতরাজের আমন্ত্রণ বার্তা নিয়ে পৌঁছন জ্ঞানেন্দ্র। আচার্য অজানার ডাকে হিমালয়ের দুর্গম গিরিপথে পা বাড়ান - নতুন দেশের পথে। জ্ঞানেন্দ্র এই এতদিনের পথ চলার সূত্রে মানুষটিকে যত জেনেছেন, তত আশ্চর্য হয়েছেন তার প্রজ্ঞা দেখে। জগৎ, জীবন সম্পর্কে এমন গভীরভাবে কেউ কী করে ভাবতে পারেন! কীভাবে হয় এই উপলব্ধি! আজ নগরীর দ্বারে এসে যখন তারা পৌঁছেছেন, আচার্যের চোখমুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। যে ভগবান তথাগতকে হৃদয়ে ধারণ করে এত বছর বেঁচে আছেন তিনি, সেই অপার করুণাময়ের বাণী, শিক্ষা নতুন অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার মনে। ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন সেই মুহূর্তের।
নগরে প্রবেশমাত্র রাজার নির্দেশ পেলেন জ্ঞানেন্দ্র। আচার্যকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে নয়, হেন খাং মন্দিরে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন রাজা। জ্ঞানেন্দ্র একটু আশ্চর্য হলেন। তবে কি এর মধ্যে রাজার মত বদলাল? এই পথশ্রমের ফল কি তবে শূন্য?”
জয়দা নিজের খাতা খুলে পড়ছিল। খিচুড়ির সৎকার করে আমরা ঘরে এসে বসেছিলাম। এর মধ্যে মঞ্জুশ্রী জয়দাকে ধরল, “সেদিন সেই জ্ঞানেন্দ্র রাজার কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিলেন শান্তরক্ষিতকে নিয়ে আসার জন্য। তারপর কী হল?”
জয়দা গম্ভীর ভাবে, “তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল।” বলে মোবাইল খুলে খুটুর খুটুর করতে লাগল। আমি বুঝলাম ভদ্রলোক আজ গল্পের মুডে নেই। মঞ্জুশ্রীও এরকম বেয়াড়া ইয়ার্কি শুনে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে খাটের উপর খিচুড়ি ঘুম দেওয়ার চেষ্টায় রত শুভর ঝুলন্ত ঠ্যাঙের তলায় সুড়ুসুড়ি দিতে লাগল।
আমি বললাম, “সেদিন যে তিব্বত নিয়ে কীসব লিখছিলে খানিক - সেটাই পড়ে শোনাও না!” জয়দাকে লাইনে ফিরিয়ে আনার কিছু কিছু মুষ্টিযোগ আমার জানা যে একেবারে নেই তা নয় - এও তাই। তার গোপন সাহিত্যচর্চার কথাকে ডিক্লাসিফায়েড করে দিলেই সে সলজ্জভাবে সেইসব লেখালিখি পড়েও শোনায়। তারপর তার থেকে গল্প টেনে নিয়ে যাওয়ার দায় কিছুটা আমাদের উপরেও বর্বরতায় তো, নাকি!
জয়দা আমাকে অব্যর্থ প্রমাণ করে দিয়ে বার তিনেক ‘হেঁ হেঁ, আবার ওসব বললি কেন’ মার্কা হাবভাব করে খাতাটা খুলেই ফেলল।
পড়া শেষ হতেই মঞ্জুশ্রী বলল, “তোমার লেখা বন্ধ করাটা অপরাধ। এটা পুরোটা লিখবে। পাবলিশার খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
“ওরে বাবা! বই ফই লেখার ধৈর্য নেই, ভাই। তার চেয়ে তোদের গল্প শুনিয়েই বেশ আছি।” জয়দা হাত তুলে বলল।
“তাই বা বলছ কই? শান্তরক্ষিতের কী হল? সব শ্যামলালের ঘাড় দিয়ে চালালে হবে!” মঞ্জুশ্রী জবাব দিল।
“বেশ। শান্তরক্ষিতের এই হেন খাং মন্দিরে কোয়ারেন্টাইন্ড থাকার কথা জানা গেছে ওই জ্ঞানেন্দ্রর লেখা থেকেই। জ্ঞানেন্দ্রর আসল নাম ছিল ‘বা সালনাং’। আগেই বলেছি তোদের। বা সালনাং -এর লিপিবদ্ধ করা কিছু ঘটনার সংকলনই হল ‘টেস্টামেন্ট অফ বা’।”
“যেটা ওই স্যাম খুঁজে বের করেছে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ওটা ‘টেস্টামেন্ট অফ বা’ এর প্রাচীনতম সংস্করনের একটা পাতা বলতে পারিস। তিব্বতের রচিত ইতিহাসকে মোটামুটি দুটি গোত্রে ভাগ করা যায়। এই আমি যে সময়ের কথা বলছি অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগ - সেসময় ঠিস্রোং দেচেন যুদ্ধ করে চীনকে একেবারে পর্যুদস্ত করে দিয়েছেন। চীনের অনেকখানি ঢুকে পড়েছে তিব্বত সাম্রাজ্যের ভিতর। ডুনহুয়াং অঞ্চলের এক গুহাতে তিব্বতিরা সঞ্চিত করে রেখেছিল অনেক লিপিবদ্ধ ইতিহাস। অবিশ্যি তারা কোন মহৎ উদ্দেশ্যে এসব রেখেগেছিল - তা হয়ত নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপীয়রা সিল্ক রুট বা রেশম পথ নিয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। রেশম পথের কথা জানিস তো?” জয়দা আমাদের জ্ঞান গম্যিকে যে একেবারেই ভরসা করে না - তা বলা বাহুল্য।
“হ্যাঁ - যে রাস্তা দিয়ে চীনেরা সিল্কের ব্যবসা করত। পূব থেকে পশ্চিমে।” আমি বললাম।
“ঠিক। খ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকেই ওই পথ দিয়ে পূর্বে চীনদেশ থেকে পশ্চিমে পারস্যদেশ অবধি বিস্তৃত এই পথ ধরে যুগে যুগে কত মানুষ গেছে এসেছে, বাণিজ্য তো হয়েছেই - সেটাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল - কিন্তু তার সাথে হয়েছে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, ধর্মবিস্তারও। এই সিল্ক রুট ধরেই হ্যাং রাজাদের সময় চীনে প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছয়।”
“তিব্বতকে স্কিপ করে সোজা চীনদেশে কী করে পৌঁছে গেল বৌদ্ধ ধর্ম?”
“চীন অনেক প্রাচীন সভ্যতা। মানে রীতিমত ‘সভ্যতা' যাকে বলে। সব দিক থেকেই। তাই ভারতবর্ষ থেকে বাণিজ্যের পথ ধরে সেখানে পৌঁছনো অনেক স্বাভাবিক - বর্বর অশিক্ষিত তিব্বতি উপজাতিদের কাছে পৌঁছনোর তুলনায়। কীভাবে পৌঁছল সে কথা পরে নাহয় বলব। আপাতত রেশম পথে ফিরে আসি। তাকলামাকান মরুভূমির মধ্যে পথ হারালে নাহলে বেজায় বিপদ।”
“তাকলামাকান! সেটা সেই পামীরের কাছে না?” মঞ্জুশ্রী জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ। পামীর মালভূমির পূর্বে - গা ঘেঁষে এই বিশাল মরুভূমি। আরও পূর্বে যেখানে তাকলামাকান মরুভূমির শুরু - ঠিক সেইখানে অবস্থিত ডুনহুয়াং। বিস্তীর্ণ মরুভূমি পার হওয়ার আগে পথিকের বিশ্রামের জায়গা। তাই যুগে যুগে যে সমস্ত পথিক এই পথে গেছেন তাদের অনেকেই লিখে গেছেন এই পথের বিভিন্ন স্থানের কথা। বলাবাহুল্য ডুনহুয়াং-ও বাদ পড়েনি। এই সমস্ত কাহিনীই ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এবং পুরাতত্ত্ববিদদের আকর্ষন করে রেশম পথের ব্যাপারে। স্থানীয় চৈনিকদের সাহায্যে তারা অনেক দুর্মূল্য পুঁথি উদ্ধার করে ভারতবর্ষে এবং ইউরোপে চালান করে। স্যার অরেল স্টেইন ছিলেন এদের মধ্যে একজন। ডুনহুয়াং-এ সতেরো নম্বর গুহা থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁথি পাওয়া যায়। চীন এবং তিব্বতের প্রাচীন হাতে লেখা বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি। স্টেইন এই পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ চালান করে দেন ভারতের আরকিওলজিকাল সার্ভের অফিসে - তারপর সেখান থেকে সোজা ইংলন্ডে। অরেল স্টেইনের উদ্ধার করা এইসব পুঁথিপত্র সযত্নে রক্ষিত আছে ব্রিটিশ লাইব্রেরীর ‘স্টেইন কালেকশনে’। সে যাই হোক, এই যে সতেরো নম্বর গুহা থেকে এইসব পুঁথিপত্র স্টেইন সাহেব উদ্ধার করেন - সেটাকে বলা হয় ‘লাইব্রেরী কেভ’। একাদশ শতাব্দীতে পাঁচিল গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই লাইব্রেরী কেভ।”
“কেন?”
“সেটার সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন যে এই গুহাটিকে সমস্ত বাতিল পুঁথিপত্রর স্টোররুম হিসাবে সম্ভবতঃ ব্যবহার করা হত। তাই একসময় যখন গুহাটি ভর্তি হয়ে যায় তখন এটিকে পাঁচিল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিল হয়ত।”
“কিন্তু, বাতিল বইপত্র হলে সেসব তো ফেলে দিলেই হত - এত কাণ্ড করে জমিয়ে রেখে দিল কেন?” মঞ্জুশ্রী বলল।
“ঠিকই বলেছিস। তবে এইসমস্ত পুঁথির সাথে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক ছিল। ধার্মিক বইপত্র ফেলে দিতে হয়ত ভয় ছিল মানুষের মনে। তাই সেসব যাতে বিধর্মীর হাতে না পড়ে - সেইজন্য ভর্তি হয়ে যেতেই পাথরের পাঁচিল তুলে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল গুহামুখ। এই নিয়ে বিস্তর মতামত আছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে। তবে এটা প্রথমে বাকি গুহাগুলির সাথে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমদিকে ওয়াং ইয়াংলু নামে এক চৈনিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ষোল নম্বর গুহাটির সংরক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি হঠাৎ একদিন ষোল নম্বর গুহার দেওয়ালে একটি গোপন দরজা খুঁজে পান। সেই দরজা খুলতেই সোজা গিয়ে পড়েন হাজার হাজার পুঁথির মাঝে। প্রায় হাজার বছরের ঘুম ভেঙে বিংশ শতাব্দীর মানুষের চোখের সামনে খুলে গেল সতেরো নম্বর গুহার দরজা।”
(ক্রমশঃ)
স্যার অরেল স্টেইনের তোলা সতেরো নম্বর গুহার চিত্র।
উফ! ডুনহুয়াং-এ সতেরো নম্বর গুহা থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁথি সম্পর্কে একটু আভাস আর দুর্লভ একটি ছবি দিয়ে এইখানে এই পর্ব শেষ করা কী ঠিক হলো? পাঠককে এতো সাসপেন্সে রাখা বোধহয় উচিত নয়! :(
তারপর??
না... এই মুহুর্তে তো আমার প্ল্যানে ইনি নেই... :)