। স্রোংচান গামপো - ১ ।
“মঞ্জুশ্রী” বলেই শুভর দুই কর্ণমূল একেবারে বেগুনী হয়ে গেল! জয়দা বলল, “অ্যাঁ! সে তো ছেলেদের নাম!”
সন্দেহ আমাদের ছিলই। যে ছেলে সকাল নটার সময় এক চোখ খুলে মোবাইলে সময় দেখে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে ‘আর পাঁচ মিনিট পর ডেকে দিস তো’ বলে পাশ ফিরত, সে নাকি গত একসপ্তাহ যাবৎ মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছে! সকাল সাড়ে ছটায় অ্যালার্ম দিয়ে উঠে ব্রাশ-টাশ করে রেডি। তারপর ঊটি যাওয়ার আগে ‘ডেকাথলন' থেকে দুশো পঁচিশ টাকা দিয়ে কেনা ট্র্যাক প্যান্ট পরে পায়ে স্নিকার গলিয়ে মুখে মাস্ক এঁটে বেরিয়ে পড়ছে।
জয়দা ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ’ মানুষ। তার মতে সকাল বেলা হল নন-ফিকশন বই পড়ার আদর্শ সময়। নিজেকে বলে ‘পল্লবগ্রাহী'। সেদিনও ‘তিব্বত' বা ‘মার্ক্সবাদ' এরকম কিছু একটা গম্ভীর বই নিয়েই বাইরের ঘরের সোফায় লম্বা হয়েছিল। শুভ ‘বাই ডুড’ বলে বেরিয়ে যেতেই জয়দা সোফা ছেড়ে ঘরে ঢুকল। আমি তখনও চাদরের তলায়। ঘুম ভেঙে হাই তুলছিলাম। কিন্তু শুভকে অমন সেজেগুজে সাত সকালে বেরিয়ে দেখে হাইটা ‘হা' হয়ে মাঝপথে আটকে গেছিল। জয়দা আমায় ‘হাঁ' করে থাকতে দেখে বলল, “অমন হাঁ করে থাকলে হবে? ছেলে সেজেগুজে গেল কোথায়? খোঁজ নাও… ”
আমি বললাম, “ও খোঁজ নিয়ে লাভ নেই। টেম্পোরারি ভুত। মাথায় চেপেছে হয়ত। কাল থেকে আবার ঘুমুবে। মিলিয়ে নিও…”
কিন্তু কথাটা মিলল না।
আমি যে শুভকে হাড়ে হাড়ে চিনি বলে একটা গর্ব ছিল - সেটা চুরমার হয়ে গেল যখন আমার ‘হা' বা জয়দার ‘হাহা' কোনও কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে শুভ পরপর তিনদিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে হ্যাট্রিক করে ফেলল।
অগত্যা তাকে জিগ্যেস করতেই হল, “কী রে, খুব যে সকাল সকাল মর্ণিং ওয়াকে যাচ্ছিস! এদিকে সেদিন ভোরবেলায় উঠে মহাবলিপুরম যাব বললাম, গেলি না!” ভাবলাম জানুয়ারি মাসে মহাবলিপুরমের প্ল্যানটা শুভর জন্য ক্যান্সেল হয়েছিল - সে কথাটা তুলে শুভর ইমোশনে একটু ঘা দেওয়া গেল।
কিন্তু শুভ পা থেকে স্নিকারটা খুলে খাটের তলায় একটা ব্যাক-কিক করে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘কবে?’
‘ভুলেই গেছিস? জানুয়ারি মাসে…’
‘ওহ, এসব মহামারী-টারী ঠিক হোক, আবার যাওয়া যাবে। ওখানে সূর্যোদয় দেখে আনন্দ ভবনে ব্রেকফাস্ট করে ব্যাক করব।’
‘কী হয়েছে ভাই তোর? নিজে মুখে ভোরবেলা বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছিস…’
শুভ তোয়ালে কাঁধে ফেলে বাথরুমের দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘শরীর ঠিক রাখার উপায় হল ভোরবেলায় ওঠা। তুই পড়ে পড়ে ঘুমোসনা। কাল থেকে আমার সাথে হাঁটতে চল। ক্যাম্পাসের মধ্যেই দিব্যি জায়গা…’
আমরা যাকে বলে হতবাক। জয়দা ফিক ফিক করে হাসছে। শুভ দরজা খুলে মুখ বের করে, ‘আচ্ছা, আমার সাথে যেতে হবে না। ঘরের মধ্যেই না হয় একটু যোগা করে নিস।’ বলে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
অবশেষে সপ্তম দিনে শুভর মর্নিং ওয়াক রহস্য ভেদ হল। আমার অস্ট্রেলিয়ান ক্লায়েন্টের সাথে কল ছিল সকাল ছটার সময়। আধঘন্টা ধরে বার সাতেক ‘ইয়েস’, তিন-চার বার ‘নো’ আর সব শেষে ‘উইল গেট ব্যাক টু ইউ’ বলে যখন ল্যাপটপ বন্ধ করে আবার চাদরের তলায় সেঁধোতে যাচ্ছি, মূর্তিমান শুভ ‘নাকোশ' (ডাক্তারি ‘মাস্ক'এর বাংলা - জয়দার সৃষ্টি) পরে দরজা দিয়ে ভ্যানিশ হলেন। আমি পরিকল্পনা পাল্টে পিছু নিলাম। যা সন্দেহ করছিলাম ঠিক তাই। উপরের তলার গার্লস পিজির যে বাঙালি মেয়েটা আমাদের আপিসেরই অন্য বিল্ডিঙে কাজ করে, তার সাথে ‘হাই' করে লিফটে উঠলেন আমাদের ভদ্রলোক।
অতঃপর এই বিচারসভা বসেছে। শনিবারের সকালে রবি ঠাকুরের ব্রেড-বাটার পেটে চালান করার আগে একটা ফয়সালা করার আশু দরকার।
“প্রেম করছিস, কর! তা বলে, আমাদের জানাবি না? আমরা কি তোর পর?” জয়দা অভিমান ভরে বলল।
“কে প্রেম করছে? ধুর… যতসব!” শুভ স্বীকার করবেই না।
“বলিস না। তবে দাদা হিসাবে উপদেশ দিচ্ছি একটা।” জয়দা গম্ভীর।
শুভ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
“বাইরে যতক্ষণ থাকবি, ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে পারবিনা জানি - সে কথা বলছিও না, কিন্তু মুখের মাস্কটা পরেই থাকিস… মহামারীর সময়…”
শুভ কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। তারপর, “উফ! তোমরা না! ইনকরিজিবল!” বলে ডাইনিং হলের দিকে চলে গেল।
জয়দা এমনিতে ব্রেড পছন্দ করেনা। কিন্তু খিদে পেলে সবই চলে। পাঁউরুটিতে কামড় দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, “দ্যাখ ভাই শুভ। আমরা হলাম তোর আপনজন।”
“অমন আপনজন থাকার থেকে একা থাকা ভাল।”
“একা কি কেউ থাকে রে! বুদ্ধদেব কী বলেছেন? সমাজে আমরা কেউ একা নই। সকলেই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে আছি। - প্রেম পত্র লিখতে হলে বলিস, ভাল ইন্টেলেকচুয়াল কোটেশন জোগাড় করে দেব।” বুঝলাম জয়দা আজ মুডে আছে।
“তা নামটা কী?” আমিও একটু খোঁচালাম শুভকে। শুভও কর্ণমূল বেগুনী করে বলল, ‘মঞ্জুশ্রী।" জয়দা বলল, “সে তো ছেলেদের নাম রে!”
“মঞ্জুশ্রী আবার ছেলেদের নাম কী করে হয়? দিব্যি মেয়েদের নাম… বনশ্রী, দেবশ্রী, রূপশ্রী - সব হতে পারে - আর মঞ্জুশ্রী হতে পারে না?” শুভ দেখলাম গায়ে নিয়ে নিয়েছে কথাটা।
জয়দা মিটিমিটি হেসে বলল, “মঞ্জুশ্রী মানে কী জানিস?”
এবার আমাদের মাথা চুলকনোর পালা।
জয়দা আমাদের মাথা চুলকনোর বহর দেখে বলল, “জানিস না তো! মঞ্জুশ্রী হলেন বোধিসত্ত্বের এক রূপ। সামন্তভদ্র বা অবলোকিতেশ্বরের মত। মহাযানী বৌদ্ধদের কাছে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের দেবতা হিসাবে মঞ্জুশ্রী স্থান পেয়েছে। গলায় বাঘনখ, হাতে তলোয়ার। রূপবান রাজপুত্র। হাতের ওই তলোয়ার থেকে জ্ঞানের আলও বিচ্ছুরিত হয়ে সব অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়। অন্যহাতে প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথি অথবা বরাভয় মুদ্রা।”
“যাহ, তাহলে যে মঞ্জুশ্রী মেয়েদের নাম রাখা হয়! আমাদের সাথে স্কুলেও তো একজন পড়ত!” আমি বললাম।
“জানে না, তাই। সে অবিশ্যি অ্যাভনের কবি তো বলেইছেন, নামে কিবা যায় আসে! যাক গে, একটা গল্প বলি শোন।”
জয়দার গল্প শোনার জন্য আমরা সবসময় তৈরী।
“বল। তবে গল্প-টল্প হয়ে যাওয়ার পর একটা জরুরী কথা আছে। হেল্প চাই।” শুভর মুখে কথা এবং হাসি দুই ফুটেছে দেখলাম। কর্ণমূল স্বাভাবিক রঙে ফিরে এসেছে।
“এনিটাইম। আচ্ছা, গল্পটা বলি। ইতিহাস বইতে জুয়্যাং জ্যাং-এর কথা পড়েছিলিস - মনে আছে?”
এরকম নামের কারোর কথা তো মনে পড়ছে না! আমি আর শুভ দুজনেই মাথা নাড়াই।
“পড়েছিস। অবিশ্যি তাকে অন্য নামেই পড়েছিস তোরা। হিউএন সাংকে মনে নেই?”
“হ্যাঁ" আমরা সমস্বরে বলি।
“এই তো সিলেবাসের মধ্যের কোশ্চেন পেয়ে গেছিস। গুড। হিউএন সাঙের নামের আসল উচ্চারণ হল - জুয়্যান জ্যাং। পশ্চিমী ঐতিহসিকরা তার নামের রোমানিকরণ করার সময় বোধহয় পাল্টে করে দেন ‘হিউএন সাং’। যাই হোক, তিনি কবে ভারতবর্ষে এসেছিলেন, মনে আছে?”
“পালদের সময় না? মানে সপ্তম শতাব্দী নাগাদ।” আবছা মনে পড়ল যেন।
“উঁহু। পালরা আর একটু পরে। জুয়্যাং জ্যাং ভারতে পৌঁছন সম্ভবতঃ ছশো তিরিশ সালে। তখন বাংলায় মহারাজ শশাঙ্কদেবের রাজত্বের শেষের দিক। একাই লড়ে যাচ্ছেন একদিকে হর্ষবর্ধন আর অন্যদিকে ভাস্করবর্মনের সাথে। কিছু বছর পরেই শুরু হবে প্রায় একশো বছর ব্যাপী মাৎস্যন্যায়। তারপর গোপাল রাজা হয়ে শুরু করবেন পালবংশের। সুতরাং তার দেরী আছে ঢের। জুয়্যাং জ্যাং ভারতে প্রায় সতেরো বছর ছিলেন। নালন্দাতেও ছিলেন অনেকদিন। একদিন রাতে ঘুমচ্ছেন। হঠাৎ স্বপ্ন দেখলেন যে নালন্দা মহাবিহার ভেঙে পড়ছে। কেউ কোথাও নেই। তিনি একা। তিনি উদ্বেগে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করছেন। এমন সময় এক অন্ধকার ঘরের মধ্যে হঠাৎ দেখলেন সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মঞ্জুশ্রী। সেই উজ্জ্বল রাজপুত্রের বেশ যেন কিছুটা ম্লান। আঙুল তুলে সেই বিষাদ প্রতিম রাজকুমার বাইরের দিকে কিছু নির্দেশ করেন। জুয়্যাং জ্যাং তাকিয়ে দেখেন এক আগুলের বলয় ঘিরে ফেলেছে গোটা মহাবিহারকে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। মঞ্জুশ্রী ধীরে ধীরে পুড়ে খাক হতে থাকা মহাবিহারের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে যান।”
“বাপরে! কীসব স্বপ্ন! এসব জানা গেল কী করে? নাকি লোকমুখে গল্প?” আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
জয়দা চিনি বেশি খায়। চিনির কৌটো থেকে এক চামচ আরো চিনি নিয়ে নিজের কাপে মেশাতে মেশাতে বলল, “গল্প কেন হবে? ভদ্রলোক নিজে লিখে গেছেন। ‘গ্রেট ট্যাং রেকর্ডস অন দ্য ওয়েস্টার্ন রিজিওন’ - এই বইতে।”
“ট্যাং? অরেঞ্জ?” যে কোনও খাদ্যদ্রব্য সাধারণত শুভর সিলেবাসের মধ্যেই পড়ে!
“সুবিশাল চৈনিক সাম্রাজ্যকে তুই একেবারে অরেঞ্জ ড্রিঙ্ক বানিয়ে দিলি? তোর কপালে মোমো চাউমিন কিচ্ছু জুটবেনা।”
“মোমো জুটবেনা কেন? সে তো তিব্বতি। তিব্বতিদের তো কিছু বলিনি।” শুভ খাবারের ব্যাপারে বরাবরই লজিকাল।
“তিব্বতিদের কিছু বলিসনি বটে। কিন্তু তিব্বতিদের রাজার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে তো বললি!”
“মানে?” জয়দার কথায় এবার আমিও গুগলি খেলাম।
“এতদিন ধরে তো এত গল্প শুনছিস। দেখি কেমন মনে আছে! তিব্বতের প্রথম রাজার নাম?” জয়দা ক্যুইজের ভঙ্গিতে বলল।
“কাঠি আংপো! এই না, মানে ঞাটি চানপো।” তাড়াহুড়োয় ভুলভাল বলে আবার শুধরে নিই।
“গুড। আর আকাশ থেকে অলৌকিক বাক্স নেমে এলো কার হাতে?” পরের প্রশ্ন। লক্ষ্য শুভ।
সে ঘাবড়ে গিয়ে দুবার আমতা আমতা করে বলল, “ধুর। এত মনে রাখা যায়?”
“আমি বলব?” আমি হাত তুলি। নামটা মনে ছিল আমার।
“বল।" জয়দা শুভর দিকে ‘কিস্যু-হবেনা' মার্কা একটা দৃষ্টি হেনে আমায় বলতে বলল।
“থোরি ঞানচান।”
“কারেক্ট! এই থোরি ঞানচানের কাছে বাক্স যখন পৌঁছল তারপর দৈববাণীতে কী বলা হয়?” জয়দার প্রশ্নের বিরতি নেই।
“কোন এক ভবিষ্যতের রাজা পড়তে পারবে।” শুভ দেখলাম এটা মনে রেখেছে।
“বাহ। হ্যাঁ। বলেছিল যে পরবর্তী পঞ্চম রাজার সময় এসবের অর্থোদ্ধার হবে - এখন সিন্দুকে তুলে রাখো। সেই পঞ্চম রাজাই হলেন তিব্বতের প্রথম ‘সম্রাট' - স্রোংচান গামপো। শুধুমাত্র ইয়ার্লুং উপজাতির একজন দলপতি মাত্র নন। তিব্বত সাম্রাজ্যর প্রতিষ্ঠা হয় তার হাতে। তিব্বতিরা তাকে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের অবতার হিসাবে মানে। তিব্বতের অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকা মানুষের কাছে জ্ঞানের প্রথম আলো পৌঁছয় তার হাত ধরে। সেই স্রোংচান গামপোর শ্বশুরবাড়ি হল ট্যাং রাজবংশ। আর নিজের বোনের বিয়েও দেন তিনি ট্যাং রাজার সাথে। তবে সে বিয়ে কিন্তু মোটেও সহজ হয়নি!”
“কেন?”
“সেটা লম্বা কাহিনী। চল বারান্দায় গিয়ে বসি। ব্রেকফাস্টের পর একটা বিড়ি না খেলে ঠিক আমেজ আসে না!”
আমাদের আট তলার উপরের বারান্দাটা দিব্যি। সুন্দর হাওয়া আসে। ওল্ড মহাবলিপুরম রোডের একটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ভিউ পাওয়া যায়। এখন শুনশান রাস্তা-ঘাট। রোদ্দুর খাঁ খাঁ করছে। শুভ দা ওর পেটোয়া ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে বসল। আমি নীচে বসে রেলিঙে হেলান দিলাম। শুভ একটা মোড়ায় বসে বলল, “বল এবার।”
জয়দা এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেট শুদ্ধু হাতটা মাথার ওপর রেখে বলা শুরু করল।
“ঐতিহাসিকরা বলছেন ষষ্ঠ শতাব্দী অবধি তিব্বতে ছোট বড় অনেকগুলি জনজাতি নিজের নিজের মত করে নিজেদের অঞ্চলে রাজত্ব চালাত। ইয়ার্লুং রাও ছিল এদের মধ্যে। পশুচারণ ছিল মূল জীবিকা। এক জায়গার ঘাস শেষ হয়ে গেলে দলবল নিয়ে পাড়ি জমাত আবার নতুন জায়গায়। ব্রহ্মপুত্রের ধার ধরে তাদের জীবন বয়ে চলত নিজের খাতে। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ইয়ার্লুংদের রাজা নাম্রি স্রোংচান। ধর ওই ছশো সালের আশেপাশে। তখন অবিশ্যি ইয়ার্লুংরা ব্রহ্মপুত্রের ঊর্বর মাটিতে চাষ আবাদ শুরু করেছে। গম, যব এইসব - ওখানে যা হয়। নাম্রি স্রোংচান উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজা। তার পূর্বপুরুষরা যে একটা উপজাতির ‘সর্দার' হয়েই খুশি থেকে গেছে, সেটা নাম্রির খুশির জন্য সাফিশিয়েন্ট মনে হল না। দলের যোদ্ধাদের নিয়ে হামলা চালালেন অন্যান্য উপজাতিদের উপর। লড়াই হল। নাম্রি জিতলেন। ইয়ার্লুংরা ক্ষমতা বৃদ্ধি করল। উপজাতির সর্দার থেকে সত্যিকারের মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বতের অধিপতি হয়ে উঠলেন নাম্রি। দূত পাঠালেন চিনে। সেখানে তখন সুই রাজবংশের রাজত্ব। শোনা যায় সেখান থেকে নাকি ওষুধপত্র সম্পর্কে জ্ঞান আসে তিব্বতে। গাছপালা দিয়ে ওষুধ তৈরীর বিদ্যে তিব্বতিরা পায় নাম্রির কল্যাণেই।”
“তাহলে নাম্রিকেই তো তিব্বতের প্রথম সম্রাট বলা যায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“বলা যেতেই পারত। কিন্তু রাজবংশে বিশ্বাসঘাতকের অভাব হয়না। নাম্রির এক সেনাপতি বিষ খাওয়াল রাজাকে। সেনা অভ্যুত্থান ঘটল!”
“উরেব্বাস! ক্যু-ডেটা! পুষ্যমিত্র শুঙ্গর ভাই নাকি?”
“হাহা। সেরকমই বটে! তবে এর ভাগ্য শুঙ্গর মত অত ভাল ছিল না! এই ক্যু-ডেটার সমস্ত প্রচেষ্টা একা হাতে রুখে দিলেন সদ্য-মৃত রাজা নাম্রির নাবালক ছেলে ঠিদে স্রোংচান। মাত্র তেরো বছর বয়সে সিংহাসনে বসলেন। নাম নিলেন স্রোংচান গামপো। অনেকে বলেন যে এই ‘গামপো' ওর উপাধি। ধর্মপরায়নতার জন্য নাকি প্রাপ্ত। সে যাই হোক, স্রোংচান গামপো রাজা হয়ে মন দিলেন নাম্রি তিব্বত সাম্রাজ্যের যে বীজ রোপণ করে গেছিলেন, সেই বীজকে বৃক্ষে পরিণত করতে। সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটতে লাগল। বাড়তে লাগল সেনা বাহিনী। সেনা অভিযান করে পশ্চিম, উত্তর তিব্বতের জনজাতিদের নিয়ে এলেন ইয়ার্লুংদের অধীনে। সম্ভবতঃ ছশো সতেরো বা আঠেরো সাল নাগাদ স্রোংচান গামপো রাজা হন। ছশো তিরিশ সালের মধ্যে তিব্বত সাম্রাজ্য গিয়ে কড়া নাড়ল চিনের দোরগোড়ায়।”
(চিত্রঃ সম্রাট স্রোংচান গামপো)
“ছশো তিরিশ? মানে হিউএন সাং ভারতে এলেন?” শুভ বলল।
“ঠিক। পুরো সময়টা একবার চিন্তা কর। পরিব্রাজক হিউএন সাং বা জুয়্যাং জ্যাং পা রাখলেন ভারতের মাটিতে। এদিকে নালন্দার নাম যশ সারা পৃথিবী জুড়ে। বাংলায় রাজা শশাঙ্ক। কামরূপে ভাস্করবর্মন। ওদিকে কান্যকুব্জে শিলাদিত্য হর্ষবর্ধন। আর দক্ষিণে নর্মদার নীচে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী। সবাই নিজের নিজের রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত। আর মাথার ওপরের হিমালয় পার হলেই তিব্বত। সেখানেও আর এক প্রবল পরাক্রমশালী রাজা স্রোংচান গামপো। বিস্তার করে চলেছেন তিব্বত সাম্রাজ্যের। শুধু তো সাম্রাজ্য বিস্তার নয় - শিক্ষা এবং জ্ঞানের আলো নিয়ে আসছেন নিরক্ষর তিব্বতি মানুষদের মাঝে।”
“উফ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে তো! চারিদিকে সব হেভিওয়েট রাজাদের রাজত্ব চলছে! এরা তো এইট নাইন টেন তিন ক্লাস জুড়ে আমাদেরও জ্ঞানের আলো দেওয়ার নাম করে কাঁদিয়ে এসেছে!” শুভ ফুট কাটল।
“হাহা। তা যা বলেছিস! আসলে ইতিহাসটা আমারও তখন হেব্বি খারাপ লাগত। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখেছি আমাদের যেভাবে পড়ানো হত - এটা ওই পদ্ধতির ত্রুটি। আদতে ইতিহাসের মত বিষয় হয় না! কত রোমাঞ্চকর গল্প বল তো!”
(ক্রমশঃ)
ফের শুভর নারকেল মাথার প্রশ্ন, তিব্বত সাম্রাজ্যের বিস্তার, তথা দেশে দেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের সাথে সাথে ভান্তেরা পথে দস্যু মোকাবেলায় নাকি খালি হাতে আত্নরক্ষার কৌশল রপ্ত করেন?
আর এভাবেই নাকি অহিংসা বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের সাথে সাথে যোগ ব্যয়াম, কুনফু, কারাটি, মার্শাল আর্ট ইত্যাদির বিস্তার ঘটে?
হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে ঠিক জানিনা। জয়দা কে জিজ্ঞেস করে বলব।
সৈকত দা,
ইউকি কাকু বলছেন, "শাওলিন কুন ফু " নামক মার্শাল আর্টের চর্চা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে চীনের হুনান প্রদেশের শাওলিন বৌদ্ধ মন্দিরে চর্চা করার হতো, সেখানে আবার "বুদ্ধাভদ্র" নামে এক ভারতীয় ভান্তের কথাও জানা যায়, কুন ফু পরে জাপানেও বিস্তার লাভ করে, ইত্যাদি।
জয়দার কাছ থেকে ক্রমে আরও জানার আশা রাখি। উড়ুক।
ইউকি লিংক:
*বান্যন ফস্কে গেল, উইকি হবে। ধন্যবাদ
বেশ। জয়দাকে জানিয়ে দেব। তারপর দেখি, কী বলে... :)