এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • তিব্বতে তথাগত (পর্ব - ১৬)

    সৈকত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২০ জুন ২০২০ | ১৮৭৪ বার পঠিত
  • “কেন? কী হল আবার?”

    “কী হল জানার আগে জানা দরকার কেন হল। শান্তরক্ষিত যখন তিব্বতে পৌঁছেছেন তার মাত্র শখানেক বছর আগে তিব্বতে সৃষ্টি হয়েছে বর্ণমালার। শুরু হয়েছে কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুবাদও। কিন্তু খাপছাড়া ভাবে কিছু কাহিনী শুনলেও বৌদ্ধদর্শন তিব্বতিদের কাছে তখনও অধরা। তাই শান্তরক্ষিত তিব্বতিদের কাছে জটিল দার্শনিক মতবাদের বদলে বৌদ্ধধর্মের একদম প্রাথমিক ক্রিয়াগুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বুদ্ধদেবের নৈতিক শিক্ষাসমূহের প্রচারকে স্বাভাবিকভাবেই ভাল চোখে দেখলেন না আদিম বোন ধর্মালম্বীরা। তার উপর ঠিক সেইসময় দেশজুড়ে ঘনিয়ে এলো মহামারীর করাল ছায়া। একাংশে শুরু হল দুর্ভিক্ষও। বোন ধর্মের পুরোহিতরা সব মানুষকে গিয়ে বোঝাতে লাগলেন যে এই বিদেশী ধর্মর জন্যই এই অবস্থা। তিব্বতের আদি দেব-দানব-রক্ষ-যক্ষ সকলে খেপে উঠেছে। এই বিদেশী ধর্মকে সমূলে বিনাশ না করতে পারলে তাদের রোষে গোটা তিব্বত ধ্বংস হয়ে যাবে। আচার্যের দিকে প্রাণনাশের হুমকিও ধেয়ে এলো। বিচলিত এবং বিরক্ত আচার্য সম্রাটের কাছে গিয়ে এর সমাধান প্রার্থনা করলেন। কিন্তু দেশের একটা বড় অংশের মানুষের বিরোধিতা সত্ত্বেও যদি সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন বৌদ্ধধর্ম প্রচার বন্ধ না করেন তাহলে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশংকা। বিবেচক রাজা বিপদের গন্ধ ঠিকই পেলেন। তিনি আচার্যকে অনুরোধ জানালেন নেপালে ফিরে যাওয়ার। পরিস্থিতি শান্ত হলে তিনি আবার আহ্বান জানাবেন - কথা দিলেন।”

    “আচার্য আবার ফিরে চললেন নেপালে?” মঞ্জুশ্রীর গলায় উৎকণ্ঠা।

    “অগত্যা! রাজার অনুরোধ আর আদেশ প্রায় একই পর্যায়ে পড়ে। আর এরকম পরিস্থিতিতে সেখানে থাকার কোন অর্থও হয়না। তাই শান্তরক্ষিত ফিরে চললেন নেপালে। কিন্তু যাওয়ার আগে সম্রাটকে এক পরামর্শ দিয়ে গেলেন।”

    “কী?”

    “আচার্য সেখানকার সমগ্র পরিস্থিতি দেখে বুঝেছিলেন এই একেবারে অশিক্ষিত মানুষদের মন থেকে ওই বোন ধর্মের সংস্কার সরিয়ে বুদ্ধের বাণী প্রবেশ করানোর জন্য কৌশল দরকার। তিনি নিজে পণ্ডিত জ্ঞানী দার্শনিক। কিন্তু এই কৌশল তার আয়ত্তের বাইরে। রাজাকে বললেন, আমি কথা দিয়েছি যে আপনার পাশে থাকব। সে কথার কোন নড়চড় হবেনা। কিন্তু আমার একার পক্ষে এই কার্য সম্পাদন করা মুশকিল। রাজা বললেন, তাহলে উপায়? আচার্য বললেন, ভারতবর্ষে এমন একজন মহান ব্যক্তিকে আমি চিনি যে একমাত্র এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কে তিনি? শান্তরক্ষিত বললেন, মহান তান্ত্রিক এবং পরম বৌদ্ধ পদ্মসম্ভব।”

    “তান্ত্রিক! কী সাংঘাতিক!” শুভ লাফিয়ে ওঠে প্রায়।

    “এই শুনেই অত লাফালে চলবে! তাহলে ভদ্রলোকের জীবন বৃত্তান্ত শুনলে কী করবি?”

    “কেন? সাংঘাতিক রোমহর্ষক বুঝি?” আমি জিজ্ঞেস করি।

    “সাংঘাতিক বলে সাংঘাতিক! তিব্বতি ধর্মপুস্তক অনুসারে ভদ্রলোক অজর অমর।”

    “অশ্বত্থামার মত?”

    “বলতে পারিস। এখনও আছেন কোথাও। সাধনা করছেন। প্রয়োজন হলেই এসে দেখা দেবেন। বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয় যখন জন্ম নেবেন এ পৃথিবীতে - তখন নাকি তার সাথে মিলে এই জগতের উদ্ধারের কাজে আবার নিয়োজিত হবেন।”

    “তা ইনি কোথাকার মানুষ? ভারতবর্ষের?”

    “হ্যাঁ। তবে এখনকার ম্যাপের হিসাবে দেখলে পাকিস্তানের। সোয়াট উপত্যকার নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস। ওখানে উড্ডিয়ান রাজ্যের রাজকুমার।”

    “সব রাজকুমাররাই এমন সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে যান কেন বলত? আমি হলে তো সাতমহলা প্রাসাদে সাতশো দাসদাসী আর…” শুভ বোধহয় মঞ্জুশ্রীর দিকে তাকিয়েই সাত রাণীর ব্যাপারটা চেপে গেল।

    “সবাই তো আর তোর মত ভোগবাদী নয়। তবে ইনি অর্থাৎ পদ্মসম্ভব কিন্তু অতটাও ত্যাগী ছিলেন না। তবে সেই অবধি পৌঁছনোর আগে তার অলৌকিক জন্মবৃত্তান্তটা শুনে নে। উড্ডিয়ান দেশে এক সুরম্য হ্রদ ছিল। তার নাম দানকোশ। সেই হ্রদের মধ্যে এক ছোট্ট দ্বীপে একদিন এক রঙিন পদ্মফুল ফুটল। পদ্মের মাঝে একটি ছোট ছেলে। বয়স আট। এক হাতে বজ্র আর অন্য হাতে একটি পদ্মফুল নিয়ে সেই বালকের আবির্ভাব। উড্ডিয়ানের রাজা ইন্দ্রবোধি নিঃসন্তান ছিলেন। অনেক পূজা অর্চনা করেও যখন কোন ফল হল না রাজা মনের দুঃখে বেড়াতে বের হলেন। সাথে মন্ত্রী কৃষ্ণধর। বেড়াতে বেড়াতে এই হ্রদের তীরে গিয়ে দেখতে পেলেন ওই আট বছরের জ্ঞানী বালককে। রাজা তাকে সাথে করে নিয়ে ফিরলেন প্রাসাদে। এবং নিজের পালিত সন্তান হিসাবে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন তাকে। পদ্মফুলের মধ্যে স্বয়ম্ভূ সেই বালকের নাম হল ‘পদ্মসম্ভব’। অনেক বৌদ্ধ বইতে ‘পদ্মকার’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।”

    “এ তো একেবারে রূপকথা। তারপর কী হল?” মঞ্জুশ্রী বলল।

    “ক্রমে পদ্মসম্ভব রাজা হলেন। শুভর কথা মত সাতমহলা প্রাসাদে সাতশো দাসদাসী নিয়ে পরম সুখে জীবন চলতে লাগল। যথা সময়ে প্রভাদরী নামে এক রাজকণ্যের সাথে বিয়েও হল। দিব্যি ছিলেন খোশ মেজাজে সিংহাসনখানা চেপে - একদিন সকালে হঠাৎ খেয়াল হল এই রাজা হয়ে থেকে সংসারের উপকার কিছু করা হচ্ছে না। পালক পিতা ইন্দ্রবোধির কাছে গিয়ে বললেন, হে পিতা - পৃথিবী আমারে চায় - রেখো না বেঁধে আমায়। অনুমতি কর, বিবাগী হই। কিন্তু কার বাপ আর সন্তানকে, হোক সে পালিত, অমন করে সন্ন্যাসী হতে অনুমতি দেয়! ইন্দ্রবোধিও দিলেন না। পদ্মসম্ভবও নাছোড়। শেষে ইচ্ছে করে ত্রিশূল দিয়ে এক মন্ত্রীর ছেলেকে খুন করলেন।”

    “সন্ন্যাসী হবার জন্য মানুষ খুন!”

    “হ্যাঁ। ধার্মিক ইন্দ্রবোধি ছেলের এমন অনৈতিক কাজ দেখে বুকে পাথর রেখে তাকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করলেন। পদ্মসম্ভব তো এটাই চাইছিলেন। দেশ বিদেশ ঘুরে অনেক তান্ত্রিক কার্যকলাপ শিখে হাজির হলেন সাহরে।”

    “সেই শান্তরক্ষিতের সাহর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    “হ্যাঁ। ঠিক ধরেছিস। এবং মজার ব্যাপার হল ওখানে গিয়ে বিয়ে করে বসলেন। কাকে জানিস?”

    “কাকে?”

    “শান্তরক্ষিতের এক বোনকে। তার নাম মন্দরবা।”

    “মানে আচার্য শান্তরক্ষিত এই পদ্মসম্ভবের শালা?”

    “হ্যাঁ। সেই জন্যই ভগ্নীপতিকে দিয়ে কার্য সিদ্ধির জন্য ঠিস্রোং দেচেনের কাছে রেকমেন্ড করেছিলেন। পদ্মসম্ভবের তান্ত্রিক ইন্দ্রজালের কথা অবিশ্যি গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। সাহরে এসে যখন বাস করছেন তখন একদিন রাজকুমারী মন্দরবা এসে হাজির হলেন তার কাছে। পদ্মসম্ভব বললেন, কী চাই? মন্দরবা বললে, তন্ত্রসাধনা শিখতে চাই। পদ্মসম্ভব জবাব দিলেন, কিন্তু সে পথ তো বড় ভয়ঙ্কর - প্রাণ যেতে পারে - ভয় নেই? মন্দরবা উত্তর দিলেন, গুরু ভরসা। আমার ভয় নেই। ব্যাস, মন্দরবা পদ্মসম্ভবের সাথে যুক্ত হলেন সাধনসঙ্গিনী হিসাবে। গোপনে। রাজার কানে গেলে রক্ষা নেই। কিন্তু রাজার কান তো আর মাত্র দুটো নয় - চরের মুখে খবর পেলেন রাজকুমারীর এমন মতিভ্রমের কথা। রেগে অগ্নিশর্মা রাজা হুকুম করলেন, ধরে আন ব্যাটা তান্ত্রিককে। পদ্মসম্ভবকে গ্রেফতার করা হল। প্রাণদণ্ড দিলেন রাজা। আগুনে পুড়িয়ে মারার বন্দোবস্ত করা হল। কিন্তু পদ্মসম্ভব হাসিমুখে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করামাত্র সে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড প্রস্রবণে পরিণত হল। রাজা ভয় পেয়ে রাজত্ব আর রাজকন্যা দুইই ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। কিন্তু পদ্মসম্ভব বললেন, তোমার ও রাজত্বে আমার লোভ নেই। তবে বলছই যখন রাজকন্যাকে গ্রহণ করছি।”

    জয়দাকে মাঝপথে থামিয়ে মঞ্জুশ্রী বলে উঠল, “আচ্ছা, জয়দা একটা প্রশ্ন মাথায় এলো। এই যে তান্ত্রিক পদ্মসম্ভবের কথা বলছ। বুদ্ধধর্মের মধ্যে তন্ত্র এলো কীভাবে? বুদ্ধদেব তো ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্পূর্ন বিপরীতে গিয়ে তার এই ধর্মের সূচনা করেন। আর তন্ত্র মূলত ছিল হিন্দুধর্মের অংশ। তাহলে…”

    “খুব ভাল প্রশ্ন। কিন্তু এর সরাসরি এক কথায় জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। বিস্তারিতভাবে অনেক কিছু বলতে হয়। কিন্তু সেসব দার্শনিক কচকচির মধ্যে না গিয়ে বরং সংক্ষেপে ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম দিয়ে তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। তুই যে বললি তন্ত্র হিন্দুধর্মের অংশ ছিল এটা একদিক থেকে ঠিক আবার ভুলও। তন্ত্র বিষয়টা একটা ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যাপার। তান্ত্রিক সাধকদের নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া আছে। তারা সেসব পালন করে সিদ্ধি লাভের চেষ্টা করতে থাকে। হ্যাঁ, বৌদ্ধধর্মের আগে এদেশে হিন্দুধর্ম ছাড়া আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তান্ত্রিক প্রক্রিয়া সব হিন্দুধর্ম ঘেঁষা ছিল। বুদ্ধদেব যখন ধর্ম প্রচার করলেন, সে ধর্মের রূপ প্রচলিত হিন্দু ধর্মের থেকে প্রায় একশো আশি ডিগ্রি বিপরীতে ছিল। নির্দিষ্ট নিয়মাবলী, অনুশাসন, উপাসনা - এই সব ছিল সে ধর্মের ভিত্তি। কিন্তু মুশকিল হল এইসব অভ্যাস সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমজনতার মনস্তত্ত্ব তখনও যেমন ছিল এখনও সেরকমই আছে। তারা কোন বিষয় নিয়ে তলিয়ে ভাবে না। আশপাশের মানুষকে দেখে বা চটকদারিতা দেখে আকৃষ্ট হয়ে জীবন যাপন করে। সুতরাং তাদের কাছে বুদ্ধের বাণী প্রাথমিকভাবে আকর্ষণীয় মনে হলেও সময়ের সাথে যখন দেখা গেল এই ধর্মে দেবদেবীর মূর্তি নেই, পুজো করার মন্ত্র নেই, বরং সাধারণ জীবনকে সঠিকভাবে যাপন করার উপদেশ আছে - মানুষ ওই মূর্ততার অভাবকে মেনে নিতে পারল না। বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে মানুষের ধর্ম হওয়ার পথ থেকে সরে যেতে থাকল। পরবর্তীকালে মহাযানীরা এই ফাঁকটা বুঝতে পারেন। অসঙ্গ, নাগার্জ্জুন প্রমুখ দার্শনিকরা বৌদ্ধধর্মের সাথে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মিলমিশ ঘটিয়ে একটা সর্বজনগ্রাহ্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এবং তাদের প্রচারিত যোগাচার, মাধ্যমক ইত্যাদি দর্শনের ফল হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মে মধ্যে মন্ত্র, মুদ্রা এবং মণ্ডল - এই তিনটি বিষয় যুক্ত হয়। তার সাথে সময়ের সাথে আরও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি ইত্যাদি বৌদ্ধ ধর্মে প্রবিষ্ট হয় এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের জন্ম হয়।”

    “তাহলে মহাযানীরাই তন্ত্র সাধনা করত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    “না। মহাযানী মতবাদ আসলে একটি উঁচুমানের দর্শন। সে দর্শন সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। তাই মহাযানী পণ্ডিতরা আমজনতার জন্য একটি সহজ রাস্তা বের করেন। সেই সহজ রাস্তাটিই এইসব তন্ত্রমন্ত্রর পথ নেয়। একে মন্ত্রযানও বলা হয়ে থাকে। মন্ত্রযান থেকেই ক্রমে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব। কিন্তু ঠিক কবে বা কে করেছিল সেটা সঠিকভাবে জানা যায়না। ওই সপ্তম অষ্টম শতাব্দীর সময় ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে বজ্রযান সৃষ্টি হয়।”

    “কত যান! এই ‘বজ্রযান’টা আবার কী?” শুভ বকের মত মুণ্ডু বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।

    “এক কথায় বললে বৌদ্ধধর্মের আর একটি যান, যেখানে তন্ত্রই প্রধান। এই বজ্রযানের সূচনা পদ্মসম্ভবের সমসাময়িক। অনেকে মনে করেন যে পদ্মসম্ভব তিব্বতে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের যে ফর্মটা প্রচার করেন সেটাই বজ্রযান হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সেই গল্পে আমরা একটু পরে আসছি। তার আগে জানা দরকার বজ্রযান জিনিসটা আদতে কী? মহাযানী বৌদ্ধদের একাংশ যখন মহাযানকে সাধারণের উপাসনার উপযোগী করে তোলার জন্য হিন্দু তন্ত্রের মন্ত্র, মুদ্রা এবং মণ্ডলকে বৌদ্ধ ধর্মে প্রবেশ করাতে থাকলেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন তান্ত্রিক দেবদেবী, তন্ত্রের ছয় অভিচার - শান্তিকরন, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচ্চাটণ এবং মারণ এবং পঞ্চ’ম'কার - মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন বৌদ্ধধর্মে যুক্ত হল। অবিশ্যি এইসব ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্য এখানে পৃথক হল। ব্যক্তিগত লিপ্সা চরিতার্থ করার বদলে বোধিচিত্ত লাভের জন্য এদের ব্যবহার নির্দিষ্ট করা হল। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সম্বলিত বৌদ্ধধর্মের যে ধারা তাকেই বজ্রযান বলা হয়ে থাকে। আরও পরে এই বজ্রযানও আরও সহজবোধ্য করার জন্য সহজযানের উদ্ভব হয় আমাদের বাংলাতে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তোরা চর্যাপদ পড়েছিস তো - সেই চর্যাপদ এই সহজযানীদেরই লেখা।”

    “আচ্ছা, জয়দা তাহলে ফেলুদার গল্পে সেই যে যমন্তকের কথা পড়েছিলাম - সেটা কি বজ্রযানীদের দেবতা?” জয়দার কথা শুনে আমার ফেলুদার গল্পের কথা মনে পড়ছিল। তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।

    “একদম ঠিক। ফেলুদার দুটো গল্পে দুটো প্রাচীন দেবতার কথা আছে - গ্যাংটকে গণ্ডগোলে এই যমন্তক আর শেয়াল দেবতা রহস্যে - কী?” ক্যুইজ মাস্টারের মত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অডিয়েন্সের দিকে।

    আমরাও খপাৎ করে সেটা লুফে নিয়ে তিনজনেই প্রায় একসাথে বলে উঠলাম, “আনুবিস!”

    “বাপ রে! সব ফেলুদা বিশেষজ্ঞ তো দেখছি! তাহলে বল তো, এই দুই দেবতার মধ্যে মিল কী?” জয়দার গুগলি এবার।

    আমি আর শুভ এবার একটু চাপে পড়ে মুখচাওয়াচায়ি করছি - এমন সময় মঞ্জুশ্রী ভ্রু জোড়াকে ধনুকের মত বাঁকিয়ে একটু ভেবে কপাল চুলকোতে চুলকোতে বলল, “দুজনেই কি মৃত্যুর দেবতা?” জয়দার মুখের হাসি দেখেই বুঝলাম যে মেয়ে ফুলমার্কস পেয়েছে।

    “ঠিক। আনুবিস ছিল প্রাচীন মিশরের মৃত্যুর দেবতা। আর যমন্তক হল বজ্রযানীদের কাছে মৃত্যুর দেবতা। একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করেছিস? যমন্তক নামটা?”

    “যম থেকে যমন্তক?” আমি বলে উঠলাম।

    “এই তো মগজে পুষ্টি যাচ্ছে। হিন্দু দেব দেবী থেকেই যে বৌদ্ধ দেবদেবীর উৎপত্তি - তার একটি প্রমাণ। ‘যম-এর সাথে ‘অন্তক’ অর্থাৎ খতম জুড়ে দিয়েছে। আরও একটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট আছে। সেটা অবিশ্যি শুভর জানা দরকার - বিশেষ করে।” বলে একটা ছোট্ট পজ দিয়ে চোখের মধ্যে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে বলল, “যমন্তক হল বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর ক্রোধোন্মত্ত রূপ। সুতরাং সাধু সাবধান - বেশী চটিও না।”

    মঞ্জুশ্রী এটা শুনে বোধহয় ব্যাপারটা কেমন হবে সেটা বোঝার জন্যই বারদুয়েক মুখটা প্রচন্ডরকম ভেংচে ক্রোধোন্মত্ত হওয়ার একটা প্রয়াস করল। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে শুভকে “সমঝে চলিস - বুঝলি?” মার্কা লুক দিয়ে জয়দাকে বলল, “কিন্তু সেই মঞ্জুশ্রীর তো রাজপুত্রর মত রূপ। রাগলে এতগুলো মাথা, হাত, পা গজায় কীকরে?”
    “সেই টেকনিকটা তুই শিখতে চাস? অবিশ্যি আমিও জানিনা। তবে এই দেবদেবীদের রূপ পরে ধীরে ধীরে ইম্প্রোভাইজ করেছে তান্ত্রিক সাধকেরা। তাদের প্রবল উৎসাহে আরাধ্য দেবদেবীদের পূজাকে একটা মস্ত ব্যাপার হিসাবে দেখানোর জন্যই বোধহয় ইচ্ছে মত অনেকগুলো করে হাত, পা, মাথা সব গজিয়ে দিয়েছে। শুধু যমন্তক কেন, তারাদেবীরও এমন অনেক রূপ দেখা যায়। সে যাই হোক। আমরা পদ্মসম্ভবের কথা থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম। ফেরা যাক সে পথে।”



    (চিত্রঃ গুরু পদ্মসম্ভব) 

    (ক্রমশঃ)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২০ জুন ২০২০ | ১৮৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২০ জুন ২০২০ ১৬:৫০94483
  • ভক্তিবাদ টিকিয়ে রাখতে কতো মূর্তি, পূজা, মন্ত্র, আচার, তীর্থ আর কিচ্ছার প্রয়োজন পড়ে। 

    অফটপিকে, "লাফিং বুদ্ধা" বুঝি এসবেরই ফস্কা গেরো। 

    মন দিয়ে পড়ছি। তারপর?     

  • :|: | 174.255.***.*** | ২১ জুন ২০২০ ০৩:৪৩94500
  • দুদ্দান্তো!
    পরের পর্ব আসতে যেন দেরী না হয় ... নইলে ...
    ইতি,
    ওম মণিপদ্মে হুম হুম হুমকি!
  • Atoz | 151.14.***.*** | ২১ জুন ২০২০ ০৫:০১94501
  • এই তো! এসে গ্যাছেন পদ্মবাবু!
    বিভূতিভূষণের "মেঘমল্লার" গল্পেও আছে পদ্মসম্ভবের শিষ্যদের পাল্লায় পড়ে দেশটার কী হাল হল, এরা তন্ত্র ফন্ত্র দিয়ে নানা ঝামেলা ঘটিয়ে বেড়ায়। ঃ-)
  • Atoz | 151.14.***.*** | ২১ জুন ২০২০ ০৫:০৬94502
  • পদ্মসম্ভবের প্রসঙ্গে এই প্রভাদরী আর মন্দরবার কথা শুনে মনে হচ্ছে রাণী মন্দোদরী দুই ভাগ হয়ে দৌড়ে এসেছিলেন দুই নামে। ঃ-)
  • গবু | 2402:3a80:a93:2f11:9243:3e30:28d7:***:*** | ২২ জুন ২০২০ ০১:৫১94525
  • কাঁপাকাপি হচ্ছে, ডি লা গ্র্যান্ডি!!

    দৌড়ক!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন