এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • তিব্বতে তথাগত (পর্ব - ১১)

    সৈকত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৬ মে ২০২০ | ২৭২৪ বার পঠিত
  • “কী হয়েছিল?”
    “সেটা জানার আগে জানতে হবে আচার্য শান্তরক্ষিত তিব্বত গেলেন কেন? শুনতে ইন্টারেস্টেড?” জয়দা সবার মুখের দিকে তাকালেন। এখন ঘড়িতে সবে আটটা। দশটার আগে আপিসের জন্য লগ-ইন করার মানেই নেই। সুতরাং গল্প শুনতে কী ক্ষতি?
    “বল। বল…” সবাই একবাক্যে রাজি।
    জয়দা রবি ঠাকুরকে হাঁক দিয়ে আর এক রাউন্ড চা’এর ফরমায়েশ করে আয়েশ করে বসে বলতে শুরু করল -
    “স্রোংচান গামপো তার রাজত্বকালে রাজ্য বিস্তার, ছোট-খাটো তিব্বতি উপজাতিদের একসাথে নিজের ছত্রছায়ায় এনে আক্ষরিক অর্থে তিব্বত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং চীনের পিছনে কাঠি করা ছাড়া যে দুটো ঠিকঠাক কাজ করেছিলেন সেগুলো হল - এক, তোনমি সম্ভোটকে দিয়ে তিব্বতি লিপি নির্মাণ এবং দুই, তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের সূত্রপাত। কিন্তু এই দুটো কাজই কাজের কাজ হতে হতেও হল না একটাই কারণে। লিপিশিক্ষা এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ এই দুইই রাজবাড়ীর প্রাচীর টপকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। সেই জন্য তিব্বত-রাজ এবং অমাত্যবর্গ জ্ঞানের আলোর স্পর্শ পেলেও, দেশের সাধারণ মানুষ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। রাজ-শিক্ষাকে লোক শিক্ষায় পরিণত করতে প্রয়োজন ছিল এমন একজন উত্তরসূরির যে স্রোংচানের মৃত্যুর পর এই শিক্ষাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ছশো ঊনপঞ্চাশ সালে স্রোংচানের মৃত্যুর পর তার নাতি মাংস্রোং মাংচান রাজা হলেন যখন, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সাথে পেলেন গার তোংচেনকে। গার ছিল অত্যন্ত ক্ষমতালোভী এবং ধূর্ত। সম্রাট মাংস্রোং তার পিতামহের মত অমন প্রতিভাশালী শাসক ছিলেন না। ফলে রাজার উপরে মন্ত্রী গার তোংচেন সমস্ত ক্ষমতা দখল করে দেশের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে। ছশো ছিয়াত্তর সালে সম্রাট মাংস্রোনের মৃত্যুর পর মাত্র ছয় বছর বয়সে রাজা হন ঠিদু সোংচেন। মসনদে নাবালক রাজা, মন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা - এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই রাজধানী থেকে দূরবর্তী প্রদেশগুলিতে অরাজকতা শুরুর সম্ভাবনা তৈরী হয়। এখানেও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটল না। পশ্চিমের ঝ্যাংঝুয়াং অঞ্চল বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল। গার তোংচেন সেনা পাঠিয়ে সেই বিদ্রোহ দমন করলেন। দেশে গার তোংচেন এবং তার ছেলে গার ত্রিংরিং-এর প্রভাব আরো বৃদ্ধি পেতে লাগল।”
    “বাপের নামও ‘গার’ ছেলের নামও ‘গার’ - তাহলে শ্বশুরের নাম নিশ্চয়ই ‘বিস্কুট’ ছিল?” গল্পের মাঝে বাধা দিয়ে বলল শুভ। ফুট কাটা স্বভাব। তবে আজ জয়দা রাগ করল না। হেসে বলল, “আসলে ওদের বংশের নাম ছিল ‘গার’ - খেয়াল রাখিস ইংরিজি বানানটা ‘M’ দিয়ে শুরু হয়। গার বংশ উত্তর তিব্বতের। এখনও এই বংশ-নামের মানুষ আছে। যাই হোক, এর মধ্যে মাংচানের রাজত্বকালে তোনমি সম্ভোট চীন গেছিলেন। শান্তি প্রস্তাব নিয়ে। চীনের সাথে শান্তি চুক্তি হয় একটা। কিন্তু যুদ্ধবাজ গার সেসবকে পাত্তা না দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল চীনের সাথে। ট্যাং সাম্রাজ্যের অধীনস্থ বেশ কিছু কেল্লা দখল করে নিলো তিব্বতি সেনা। ট্যাং রাজারাও আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে দু একবার - কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী তিব্বতি সেনাবাহিনীর কাছে জাস্ট উড়ে গেছে। এতসব যুদ্ধ জয়ের ফলে ‘গার’দের প্রতিপত্তি যখন প্রচন্ডরকম বাড়তে শুরু করেছে রাজা ঠিদু সোংচেন প্রমাদ গুনলেন। এতদিনে তার রাজনীতি বোঝার বুদ্ধি হয়েছে। বুঝতে পারলেন যে মন্ত্রীর ক্ষমতা যদি এভাবে বৃদ্ধি পায় - তাহলে রাজার হাত থেকে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারটা জাস্ট সময়ের অপেক্ষা। গার ত্রিংরিং তখন উত্তর তিব্বতে। রাজা দেখলেন এই সুযোগ। নিজের বিশ্বস্ত লোকেদের কাজে লাগিয়ে রাজসভায় গার ত্রিংরিং-এর সমর্থকদের গ্রেফতার করলেন। আর নিজে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হাজির হলেন উত্তর তিব্বতে। স্বয়ং সম্রাটকে দেখে গার ত্রিংরিং বিনাযুদ্ধে অস্ত্র নামিয়ে রাখলেন। ট্যাং-দের ইতিহাসে লেখা আছে যে গার ত্রিংরিং আত্মহত্যা করেন। মোদ্দা কথা হল, সম্রাটের হাতে ক্ষমতা ফিরে এলো। এর মধ্যে তুর্কিদের সাথে চুক্তি হয়েছে মৈত্রীর। ঠিদু নিজের বোনের বিয়ে দিয়েছেন ‘অজ' রাজ্যের রাজার সাথে। এই সব কূটনৈতিক সম্পর্ক আসলে তিব্বতের সবচেয়ে বড় শত্রু চীনকে ঠেকানোর জন্য। শুধু ঠেকিয়ে রাখা বললে হয়ত ভুল হবে - পশ্চিমের সাথে বাণিজ্যর যে রাস্তা - সেই তারিম অববাহিকাকে নিজেদের দখলে রাখার লড়াইএর জন্যও এইসব মৈত্রী স্থাপন। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক কৌশলের দিক থেকে সম্রাট ঠিদু সোংচেন বোধহয় স্রোংচেন গামপোর থেকেও বড় সম্রাট ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিব্বতের ইতিহাস তাকে মনে রাখেনি। চৈনিক ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন লেখা থেকে তার কথা মূলতঃ জানতে পারি আমরা।”
    “কেন? তিব্বত তাকে মনে রাখল না কেন?” রবি ঠাকুরের দিয়ে যাওয়া চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে সেটা দাঁত দিয়ে কামড়ে প্রশ্ন করল মঞ্জুশ্রী।
    “এত খুব অবশ্যম্ভাবী। ঠিদুর এই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে কোথাও দেখলি যে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে কিছু করেছিলেন?”
    “না।”
    “একটা ছোট বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করা ছাড়া ধর্ম প্রসারের জন্য কিছু করেন নি। তাই প্রচণ্ড শক্তিশালী কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিব্বতের বৌদ্ধ ইতিহাসে তার জায়গা প্রায় হয়নি বললেই চলে! সবই কপাল!” বলে জয়দা একও চুমুকে নিজের চা-টা শেষ করে দিল। তারপর আবার বলল, “এমনকি সম্রাট ঠিদু সোংচেন নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বহু লড়াই করেছেন। আর সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ হারান তিনি। দক্ষিণ তিব্বতে নেপালের সীমানায় এক বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে। সাতশো চার সালে। তার ছেলে মে আগছোমের তখন সদ্যজাত। সিংহাসনে কে বসবে সেই নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে গেল। শোনা যায় ঠিদু সোংচেনের অপর এক ছেলে বা ভাই নাকি রাজা হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঠিদু সোংচেনের মা রাজমাতা ত্রিমালাই সেসব একা হাতে সামলে নেন। সদ্যজাত মে আগছোমকেই নতুন রাজা ঘোষণা করা হয়। মে আগছোম অবিশ্যি উপাধি। আসল নাম ছিল ঠিদে চুগতান। শিশু ঠিদে চুগতানকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতেই রেখে দেন ঠাকুমা ত্রিমালাই। সাতশো দশ সালে ছয়-সাত বছরের ঠিদের বিয়েও দিয়ে দেন তিনি।”
    “অ্যাঁ! কচি ছেলের বিয়ে!”
    “হ্যাঁ। কার সাথে জানিস?”
    “কার সাথে?”
    “ওয়েনচেংকে মনে আছে?”
    “ট্যাং রাজকুমারী?”
    “হ্যাঁ। ওয়েনচেঙের ভাইএর মেয়ের সাথে। রাজকুমারী জিনচেং।”
    “এই তো, চীনের সাথে মারামারি করছিল। আবার বিয়ে হয়ে গেল!”
    “হল। এবং ইনিও ওয়েনচেঙের মতই চীন থেকে এসে বৌদ্ধধর্মের প্রসারকাজ শুরু করলেন। যদিও এবারও তা তিব্বতের সাধারণ মানুষের জন্য হল না। বরং বেশ কিছু বিত্তশালী পরিবার শুধু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেন। খোটান থেকে বেশ কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আমন্ত্রণ জানান এক মঠ বানানর পরিকল্পনা করে। কিন্তু কপাল খারাপ। অষ্টম শতাব্দীর চতুর্থ দশকে তিব্বতে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। মহামারী হয়। সেই প্লেগের কবলে মৃত্যু হয় রাণী জিনচেঙের। রাণীর মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই মঠ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং স্থানীয় বোন ধর্মালম্বীরা এসব বিদেশী ধর্মের প্রচারই যে মহামারীর কারণ - সেটা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে খোটান থেকে আসা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেশ ছাড়া করেন।”
    “রাজা কিছু বললেন না?”
    “রাজা তো ব্যস্ত যুদ্ধ করতে। মে আগছোমের সময় তিব্বত সাম্রাজ্য এক বিশাল আকার ধারণ করে! সম্ভবতঃ আমাদের লাদাখ, কাশ্মীরের কিছু অংশ, অধুনা পাকিস্তানের বেশ খানিকটা তিব্বতের অধীনে চলে আসে। তারপর তিব্বত গিলিগিট বালুচিস্তান অভিযান চালায়। সেখানকার রাজাও মে আগছোমের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। মে আগছোমের নজর বরাবর পশ্চিমের দিকে ছিল। আরবদের সাথে বন্ধুত্ব করেন। যুগ্ম ভাবে যুদ্ধ চালান চীনের বিরুদ্ধে। টালাসে এক প্রবল যুদ্ধে চীনকে পরাস্ত করে এই যৌথ বাহিনী। এবং এই যুদ্ধে পরাজয়ের সাথে সাথে ট্যাং রাজারা পশ্চিমের দুনিয়াতে নিজেদের অধিকার হারায়। আর এই সমগ্র অঞ্চল বাণিজ্যের জন্য সুগম হয়ে যায় তিব্বতিদের কাছে। রাজা হিসাবে মে আগছোমও তার বাবার মতই রাজ্যবিস্তারের দিকেই নজর দিয়েছিলেন প্রধানত। হয়ত সমগ্র তিব্বত সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়তে পারত আরও পশ্চিমে যদি না সাতশো তিপ্পান্ন সালে একদিন দুই পারিষদের হাতে খুন না হয়ে যেতেন!”
    “খুন!" মঞ্জুশ্রী চমকে উঠে বলল।
    “হ্যাঁ। সেই এক ক্ষমতা দখলের লোভ। ল্যাং এবং বেল নামে রাজা মে আগছোমের দুই পারিষদ সিংহাসন দখলের অভিসন্ধি করছিল অনেকদিন ধরেই। রাজার আরও কিছু সভাসদও তাদের দলে যোগদান করে। অবশেষে একদিন সুযোগ বুঝে তারা মে আগছোমকে হত্যা করে গদি দখল করল।”
    “অ্যাঁ? তিব্বতের মসনদ হাতছাড়া হয়ে গেল?” শুভকেই মনে হল গদিচ্যুত করা হয়েছে!
    “হল। তিব্বতের রাজবংশে প্রথমবারের জন্য সিংহাসন বেহাত হল। এর আগেও সিংহাসন নিয়ে টানাটানি হয়েছে অনেক। মহামন্ত্রী গার এবং তার স্বজাতিরা চক্রান্ত করেছে, মে আগছোমের রাজ্যাভিষেকের সময়ও বিস্তর গোলমাল হয়েছে - কিন্তু সিংহাসন কখনো বেহাত হয়নি। এবার এই বিশ্বাসঘাতকের দল একেবারে সেই কাজটাই করে দেখাল। অবিশ্যি তারা যেটা ভুল করেছিল সেটা হল রাজার নাবালক পুত্রকে ছেড়ে দিয়ে। নাবালক হলেও স্রোংচান গামপো, ঠিদু সোংচেন, মে আগছোমের রক্ত তার ধমনী দিয়ে বইছে। এত সহজে ওই হকের পাওনা ছেড়ে দেবে? মে আগছোমের অনুগত সভাসদ, মন্ত্রীদের এক জোট করল সে। পরিকল্পনা করল দীর্ঘ দুই বছর ধরে। তারপর সাতশো পঞ্চান্ন সালের এক গ্রীষ্মের সকালে ল্যাং এবং বেল কে হত্যা করে মসনদ পুনর্দখল করা হল। সেখানে রাজা হয়ে বসলেন মে আগছোমের সেই তেরো বছরের ছেলে ঠিস্রোং দেচেন।”
    “বাপরে! এসব নিয়ে সিনেমা হতে পারে তো!” আমি বললাম।
    “সবে তো ট্রেলার দেখলি। পিকচার আভই বাকি হ্যাঁয় দোস্তোঁ। ঠিস্রোং দেচেন হলেন তিব্বতের সেই রাজা যিনি রাজপ্রাসাদের বাইরে সকল প্রজার মাঝে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হন। রাণী জেনচেং-এর অপূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টা করেন। এবং সে কাজে যথেষ্ট সফল হন বলেই তিব্বতের ধর্মীয় ইতিহাস তাকে আজও মনে রেখেছে। শুধু তাইই নয় এক বোধিসত্ত্বের অবতার হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কার জানিস?”
    “কার?"
    আমাদের জিজ্ঞাসা চিহ্ন মার্কা মুখগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে হেসে একজনের দিকেই তাকিয়ে বলল, “মঞ্জুশ্রীর”।
    শুভ অমনি চিৎকার করে বলল, “আবার!” আর মঞ্জুশ্রী একেবারে হেসে গড়াগড়ি। ওকে আগের গল্পগুলো এই কদিনে জয়দা যতটা সম্ভব সামারি করে শুনিয়ে দিয়েছে। আমাদেরও একবার করে রিক্যাপ হয়ে গেছে।
    “আবার মানে কী?” জয়দা বলল।
    “এই তো সেদিন বললে চীনের কোন এক রাজা ‘কুং ফু’ না ‘হোয়াং হো’ তাকে ‘মঞ্জুশ্রী'র অবতার হিসাবে দেগে দিয়েছিল। আবার এ কেন?”
    মঞ্জুশ্রী এবার হাসি থামিয়ে বলল, “আহা, জয়দা একজন দুজনকে ‘শুভ’র অবতার হিসাবেও দেখানো যায় কি না দেখো না!”
    “এই রে! না না। সে খুবই ‘অশুভ’ ব্যাপার হবে তাহলে!” জয়দাও শুভর লেগপুলিং-এর এই মোক্ষম সুযোগের সৎব্যবহার করে নেয়। মঞ্জুশ্রী আর এক রাউন্ড হেসে গড়িয়ে যায়।
    “আচ্ছা, ঠিস্রোং দেচেন তো রাজা হলেন।” জয়দা আবার গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল, “কিন্তু তার আগের দুবছরের মধ্যে ল্যাং আর বেল মিলে দেশে বৌদ্ধ ধর্মকে নিষিদ্ধ করার জন্য আইন পাশ করিয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য - এইসব বিদেশি ধর্ম মোটেই তিব্বতের মানুষদের জন্য কাজের নয়। তার উপর এসবের জন্য এখানকার দেবদেবীরা কুপিত হয়ে যাচ্ছেন। মহামারী ইত্যাদির মাধ্যমে তার ফল হাতে নাতে দেখাই যাচ্ছে। ঠিস্রোং দেচেন রাজা হয়ে প্রথমেই একটু দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একে তো সিংহাসনের টানাটানি নিয়ে এত ঝামেলা, তার উপর দেশের গদি টালমাটাল দেখে বিদেশিরাও বসে নেই। চীনের ট্যাং-রা চীন-তিব্বত সীমান্ত বরাবর সামরিক অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু অঞ্চল নিজেদের দখলে করে নিয়েছে। আবার এক মন্ত্রী মাশাং যে বোন ধর্মের এক পুরোহিতও বটে - বৌদ্ধধর্ম নিষিদ্ধ আইনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। ওই যে বলছিলাম না, রাজা রাজনৈতিক প্রধান হলে কী হবে! ধর্ম বড় আফিম! ধর্মীয় প্রধানের কথায় মানুষ একেবারে প্রাণ দিতে অবধি তৈরী হয়ে যায়। দেড় হাজার বছর আগেও ছিল - এই যুগেও আছে - গোটা বিশ্ব জুড়ে। এই মাশাং ছিলেন সেরকম একজন বোন পুরোহিত। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচণ্ড বিদ্বেষী। নাবালক রাজাকে ওভারপাওয়ার করে একেবারে তাণ্ডব শুরু করল। আগের সম্রাটদের তৈরী বৌদ্ধ মন্দিরগুলি থেকে অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, শাক্যমনি বুদ্ধ - সকলের মূর্তি সরিয়ে ফেলে সেই মন্দিরগুলিকে একেবারে কশাইখানা বানানোর নির্দেশ দিল। অহিংস ধর্মের প্রবর্তক তথাগতর মন্দিরে সকাল সন্ধ্যা বইতে লাগল রক্তধারা, ‘ওঁ মনি পদ্মে হুম’ মন্ত্রোধ্বনির পরিবর্তে মন্দিরগাত্রে প্রতিধ্বনি শোনা যেতে লাগল পশুদের মৃত্যুকালীন আর্তনাদের।”
    “এহ! কীসব কাণ্ড!” শুভ মন্তব্য করল।
    “ঠিস্রোং দেচেন ছেলেবেলা থেকেই মনে প্রাণে পরম বৌদ্ধ। এসব দেখে আর সহ্য হল না! এদিকে মাশাংকে সরাসরি বাধা দেওয়া মানেই সংঘাত। তার ফল হতে পারে আবার এক গুপ্ত হত্যা! তাহলে উপায়? রাজা নিজের দলের বৌদ্ধ মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করলেন। বিস্তর আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত হল এক ঢিলে দুই পাখি মারার। মাশাংকে নিকেশ করা এবং বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্মরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু কীভাবে?”

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৬ মে ২০২০ | ২৭২৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শঙ্খ | 103.242.***.*** | ২৬ মে ২০২০ ১৯:১৭93730
  • বাহ, জমেছে
  • Atoz | 151.14.***.*** | ২৬ মে ২০২০ ২২:০৬93738
  • এই লেখাটা অতিশয় চমৎকার হচ্ছে।
  • বিপ্লব রহমান | ২৭ মে ২০২০ ১১:১৩93760
  • দুর্দান্ত! সত্যিই  থ্রিলার সিনেমার মতো। 

    #

    সৈকত দা,  লেখায় প্যারাগুলোর মাঝে লাইন স্পেস দিন, তাহলে অনলাইন পাঠে চোখের আরাম হয়, চণ্ডালের আব্দার।  :)          

  • সৈকত ভট্টাচার্য | ২৭ মে ২০২০ ১১:২০93764
  • হ্যাঁ হ্যাঁ। কপি পেস্ট করার সময় সব ঘেঁটে যায়। পরের বার থেকে খেয়াল রাখব। 

  • মৈত্রেয়ী চৌধুরী | 202.142.***.*** | ২৮ মে ২০২০ ০১:৫৪93795
  • আজ ই লেখা টি প্রথম দেখলাম এবং গোগ্রাসে গিললাম। পড়তে খুব ভালো লাগছে। বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্র্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    একটি পরামর্শ না দিয়ে পারছি না। তিব্বতী নামগুলো প্রচলিত উচ্চারণে দিলে ভালো হতো। যেমন প্রথম তিব্বতী লিপিকার থোমি সামভোটা নামেই সবিশেষ পরিচিত। এ বিষয়ে আপনি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির বা কলকাতা ইউনিভার্সিটির তিব্বতী ভাষাবিদ দের সাথে কথা বলতে পারেন। 

  • সৈকত ভট্টাচার্য | ২৮ মে ২০২০ ১৪:৫৩93805
  • অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য। আমি মূলতঃ ইংরিজি বানান দেখে বাংলা বানান লিখছি। তাই হয়ত বানানের হেরফের। 

  • মৈত্রেয়ী চৌধুরী | 202.142.***.*** | ২৯ মে ২০২০ ০৪:০০93817
  • আমি আমার পরিচিত তিব্বতী শিক্ষকদের এমনটাই উচ্চারণ করতে শুনেছি, যদিও আমি নিজে ভাষাটাকে আয়ত্ত করতে পারিনি। আপনার উত্তরের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন