।। বিবর্তনের কাঠামোয় সমকামিতা ।।
(দ্বিতীয় পর্ব)
মহিলা বোনোবোদের ৭৫% রতিক্রিয়া মহিলাদের সাথেই হয়। একজনের ভগাঙ্কুর (ক্লিটোরিস) অন্যের ভগাঙ্কুরের সাথে ঘর্ষণের মাধ্যমে। এটা মিশনারী আসনে বা অন্ততঃ একে অপরের মুখোমুখি হয়ে করলে সুবিধাজনক হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রাণীজগতে মিশনারি আসনের ব্যবহার শুধু বোনোবো আর মানুষরাই করে, বিরল কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আর সমস্ত প্রাণীই ধেনুকাসন অর্থাৎ ডগি জাতীয় আসনে রতিক্রিয়া করে, একে অপরের দিকে মুখ না রেখে।
সম্ভবতঃ ভগাঙ্কুরভিত্তিক মিলনের সুবিধার জন্য বোনোবোদের মধ্যে মিশনারি আসনের উদ্ভব হয়েছে। অন্ততঃ বোনোবোদের সমকামিতার সাথে মুখোমুখি রতিক্রিয়ার একটা যোগ আছে। মানুষের মিশনারী আসনের সাথে সমকামিতার কোনো যোগ আছে কিনা জানা নেই। মানুষের মধ্যে এটি এসে থাকতে পারে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং ভাববিনিময়কে গভীর করার জন্য। একাধিক কারণ থাকতে পারে, তবে সেই বিশদে যাচ্ছি না। ফিরে আসা যাক মানুষের সমকামিতার আলোচনায়।
সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ইতিহাসটা খুঁজতে গেলে অনেক লজ্জাজনক অধ্যায় চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবটাই সুন্দর নয়। অতীতে যখনই সমকামিতার সাথে শরীরের কোনো অংশের সম্পর্ক পাওয়া গেছে- তা জিনই হোক, মস্তিষ্কই হোক, যৌনাঙ্গই হোক- সেই সম্পর্কটাকে সমকামিতার 'চিকিৎসা'র জন্য অনেক বিজ্ঞানীর ব্যবহার করেছেন। ইউজিন স্টিনাচ (Eugen Steinach), যিনি এন্ডোক্রিনোলোজির প্রাণপুরুষদের একজন, বিংশ শতকের শুরুতে পরীক্ষা করে দেখেন পুরুষ শূকরের অণ্ডকোষ নারী শূকরে প্রতিস্থাপন করলে নারী শূকর পুরুষের মত যৌন আচরণ করে। উনি সমকামী পুরুষদের অণ্ডকোষকে বিষমকামীদের অণ্ডকোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে দেখান যে এভাবে সমকামিতার চিকিৎসা করা যায়! এই নিয়ে ওনার পেপার আছে! এই পদ্ধতিতে অনেক সমকামী পুরুষের ‘চিকিৎসা’ও হয়েছে! ভদ্রলোকের কিন্তু অনেক অবদান আছে আধুনিক হরমোন চিকিৎসার ক্ষেত্রে। নোবেল পুরস্কারের জন্য পাঁচবার মনোনীত হয়েছেন।
আরেকটা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল- লোবোটোমি- মস্তিষ্কের সামনের কিছু অংশ কেটেকুটে বাদ দেয়া। শুধু সমকামিতা নয়, বিভিন্ন রকমের মানসিক রোগ সারানোর জন্য। এতে রোগীদের ক্ষতিই বেশি হয়েছিল। কিছু মনোরোগী উপকার পেলেও বাকিদের পরিণতি হয় পঙ্গুত্ব, আত্মহত্যা, মৃত্যু ও নানারকম জটিলতা। আবিষ্কর্তা অ্যান্টোনিও এগাস মোনিজ (António Egas Moniz) নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন!
অর্থাৎ ধর্মের হাতে সমকামীরা নিষ্পেষিত ছিলই, বিজ্ঞানের হাতেও কম লাঞ্ছনা হয়নি। সেজন্য ভবিষ্যতে যখনই কেউ সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজেছেন, তাঁদেরকে সমকামী মানুষেরা সন্দেহের চোখেই দেখেছেন। কারণ প্রথমদিকে গবেষণাগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল সমকামীদের বিষমকামীতে রূপান্তর। আর চার দশক আগেও যেখানে সমকামীরা পাশ্চাত্যদেশে ঘৃণার পাত্র ছিল, তখন খুব অল্পসংখ্যক সমকামী মানুষই গবেষণার বিষয় হবার জন্য এগিয়ে আসতেন।
যাইহোক ১৯৯১ সালে সমকামিতার সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক প্রমাণ করে দেখান ব্রিটিশ আমেরিকান বিজ্ঞানী সাইমন লাভে (Simon LeVay)। অগ্ৰমস্তিষ্কের একটি কোষকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস, যার নাম INAH3- এটি পুরুষদের বড়, মহিলাদের ছোট হয়। অর্থাৎ এটি লিঙ্গানুসারী বা sexually dimorphic। আবার বিষমকামী পুরুষের ক্ষেত্রে এটি বড় হয়, সমকামী পুরুষের ছোট হয়। গবেষণার জন্য সমকামী পুরুষের মস্তিষ্ক উনি কিভাবে পেয়েছিলেন? আটের দশকের এইডস মহামারীতে আমেরিকার অনেক সমকামী মানুষ মারা যান। এঁদের যৌনাভিমুখের (sexual orientation) তথ্য চিকিৎসকদের কাছে ছিল। এঁদের অনেকের এবং এইডসে মৃত অনেক বিষমকামী মানুষের মস্তিষ্কের কাটাছেঁড়া (autopsy) করে তিনি এই গবেষণা করেন। লাভে নিজে সমকামী এবং এইডসে নিজের প্রেমিককে হারান এবং এই গবেষণা অনেকটাই সেই ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ছিল।
তার আগে কি কেউ মস্তিষ্কের সাথে সমকামিতাকে যোগ করেনি? করেছে। আটের দশকে। স্বাব এবং হফম্যান (Swaab and Hopffman) দেখিয়েছিলেন অগ্ৰমস্তিষ্কের অন্য একটি নিউক্লিয়াস (SCN বা suprachiasmatic nucleus) সমকামী পুরুষদের বড় হয়। কিন্তু এই গবেষণা অনেক সমকামী মানুষ ভালভাবে নেন নি। আসলে মস্তিষ্কের সাথে সমকামিতার সম্পর্ক আবিষ্কার হলেই সমকামী মানুষদের ভয় থাকত যে এটিকে ব্যবহার করা হবে সমকামিতাকে মনোরোগ হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য। সাইমন লাভের গবেষণা সমকামী সমাজে গৃহীত হয়েছিল কারণ উনি নিজে সমকামী। আর নয়ের দশকে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সমকামবিদ্বেষ এবং সমকামীদের অসহায়তাবোধ কমে এসেছিল, তাই সমকামীদের মধ্যে অনেক কম ভয় ছিল "চিকিৎসা"র খপ্পরে পড়ার। স্বাব এবং হফম্যানের উদ্দেশ্যও খারাপ ছিল না। পরে দেখা গিয়েছিল যে দুটি গবেষণার ফলাফল একে অপরের ইঙ্গিত দেয়, কারণ INAH3 বড় হলে SCNএর জায়গাটা কমে আসে।
সাইমন লাভের গবেষণাতে কিছু ত্রুটি অবশ্য ছিল- ছোট স্যাম্পেল সাইজ ছিল- এছাড়া এইডস থেকে মস্তিষ্ক প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে পরবর্তী আরো অনেক গবেষণায় মস্তিষ্ক ও সমকামিতার সম্পর্ক পাওয়া গেছে (কমেন্টে পেপারগুলোর নাম দিচ্ছি)।
মনে করা হয় গর্ভাবস্থায় এন্ডোক্রাইনের তারতম্য থেকেই মস্তিষ্কের এই পার্থক্যগুলি হয়। শরীরের যেসব অঞ্চলে গর্ভাবস্থার এন্ডোক্রাইনের তারতম্যজনিত পার্থক্য আসতে পারে সেসব অঞ্চলে সত্যি কিছু পার্থক্য দেখা যায় সমকামী ও বিষমকামীদের মধ্যে। যেমন, ১) তর্জনী আর অনামিকার দৈর্ঘ্যের অনুপাত বেশীর দিকে হলে পুরুষদের সমকামী ও মহিলাদের বিষমকামী হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ২) হাত পায়ের দীর্ঘাস্থিগুলোর দৈর্ঘ্য সমকামী পুরুষদের মধ্যে বিষমকামী পুরুষদের থেকে কিছু কম হয় আর সমকামী মহিলাদের মধ্যে বিষমকামী মহিলাদের থেকে কিছু বেশি। ৩) মস্তিষ্কের anterior commissure সমকামী পুরুষদের মধ্যে বিষমকামী পুরুষদের থেকে কিছুটা বড় হয়, ৪) SCN, ৫) INAH3 নিয়ে আগেই বলেছি। ৬) কানের ভেতরে otoacoustic emissions বিষমকামী মহিলাদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে কম frequency ও amplitude এ হয়। ৭) চুলের ঘূর্ণি সাধারণত ঘড়ির কাঁটার দিকে হয়, তবে সমকামীদের মধ্যে উল্টোদিকে হবার প্রবণতা বেশি হয়, বিষমকামীদের কম।
ডানহাতি বাঁহাতি হওয়া, জন্মক্রম আর সমকামিতার সম্পর্কের কথা আগের পর্বে বলেছি। ডানহাতি পুরুষ সন্তানদের মধ্যে দেখা যায় যত বেশি সহোদর দাদা (সহোদর হতে হবে, সম ঔরসজাত না হলেও চলবে) তত সমকামী হবার সম্ভাবনা বেশি। অনুমিত হয় মায়ের গর্ভে anti-NLGN4Y antibodies বেশি ক্ষরণ হয় যত বেশি পুরুষ সন্তান সে ধারণ করে। বাঁহাতিদের মধ্যে এই সম্পর্ক দেখা যায় না।
যদিও এর সঙ্গে শারীরবিজ্ঞানের সম্পর্ক নেই, অনেক সংস্কৃতিতে দেখা যায়, প্রথম দুই পুরুষ সন্তানের পরে কনিষ্ঠতর পুরুষ সন্তানদের মাধ্যমে নাতি নাতনি অনেকে চায় না (সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা কমানোর জন্য)। কেরলের নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণরা তাই প্রথম দুটি পুরুষ সন্তান ছাড়া অন্য কারো বৈধ বিবাহ দিত না, বাকিরা নায়ার মহিলাদের সঙ্গে "সম্বন্ধম" প্রথার মাধ্যমে যৌনসুখ উপভোগ করত, এবং সন্তান প্রজনন করলেও সেই সন্তান মাতৃক্রমে বংশপরিচয় পেত, পিতৃক্রমে নয়। এইভাবে নায়ার মহিলাদের মাতৃকুল (matrilocality) সৃষ্টি হত। সমস্ত পুরুষ সন্তানকে প্রজনন করতে না দেয়ার প্রবণতা লাদাখের বৌদ্ধদের মধ্যেও দেখা যায় এবং সেখানে সন্ন্যাস গ্ৰহণের প্রবণতা বেশি।
পরের পর্বে দেখব রূপান্তরকামিতার সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক আর চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসের আরেকটি লজ্জাজনক ঘটনা।
(চলবে)
তথ্যসূত্র: মূলতঃ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান বিহেভিওরাল বায়োলোজির অনলাইন লেকচার কালেকশন থেকে সংগৃহীত। ( Lecturer: Dr Robert Sapolsky)। ইউটিউব লিংক :https://www.youtube.com/playlist?list=PL848F2368C90DDC3Dযাঁরা মস্তিষ্ক ও সমকামিতার সম্পর্ক নিয়ে আরো বিশদে পড়তে চান তারা কিছু পেপার রেফার করতে পারেন:
56
LeVay S. 2011Gay, straight, and the reason why. The science of sexual orientation. New York, NY: Oxford University Press. Google Scholar
57
Wilson JD, George FW, Griffin JE. 1981The hormonal control of sexual development. Science 211, 1278–1284. (doi:10.1126/science.7010602) Crossref, PubMed, ISI, Google Scholar
58
Balthazart J. 2011Minireview: hormones and human sexual orientation. Endocrinology 152, 2937–2947. (doi:10.1210/en.2011-0277). Crossref, PubMed, ISI, Google Scholar
59
Balthazart J. 2012Brain development and sexual orientation. Charleston, SC: Morgan & Claypool Life Sciences. Crossref, Google Scholar
60
LeVay S. 1991A difference in hypothalamic structure between heterosexual and homosexual men. Science 253, 1034–1037. (doi:10.1126/science.1887219) Crossref, PubMed, ISI, Google Scholar
61
Byne W, Tobet S, Mattiace LA, Lasco MS, Kemether E, Edgar MA, Morgello S, Buchsbaum MS, Jones LB. 2001The interstitial nuclei of the human anterior hypothalamus: an investigation of variation with sex, sexual orientation, and HIV status. Horm. Behav. 40, 86–92. (doi:10.1006/hbeh.2001.1680) Crossref, PubMed, ISI, Google Scholar
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।