বেড়াতে ভালোবাসি এটা বুঝে উঠতে আমার জীবনের চব্বিশটি বসন্ত কেটে গিয়েছিলো। ছোটো বেলায় বিশেষ বিশেষ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অথবা আমার পিতৃদেবের নিশ্চিন্ত গৃহকোণ'টি ছেড়ে না বেরোনোর অভিপ্রায়ে জ্ঞান হওয়ার আগে একবার পুরী, জ্ঞান হওয়ার হওয়ার পরে আরএকবার পুরী ও হরিদ্বার -দেহরাদুন-লখনৌ বেড়ানো হয়েছিলো।
আমার মাতৃদেবী বেড়ানোর ব্যাপারে বড়ই আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু স্বাবলম্বী গৃহিণী না হওয়ায় তাঁর এই সদিচ্ছে খুব একটা পূরণ হয়নি তখন। বড় হওয়ার পর আমি যখন এই রইবো না আর বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে মার্কা ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম, এই মাতৃদেবীই যৎপরোনাস্তি ভীত হয়েছিলেন এই চিন্তায় যে মেয়ে "একা একা" বেড়াতে যাবে এ আবার কি? না একা একা বেড়ানোয় আমার বিশেষ আগ্রহ কোনোদিনই ছিলোনা। আমি মনের মানুষ অথবা প্রিয় মানুষদের দলবল নিয়ে বেড়াতে ভালোবাসি। একা একা বেড়ানোয় আমার সুখ হয় না তেমন, মানে সুন্দর কিছু দেখলাম সেটা অন্তত আর একজননের সাথে ভাগ করে নিতে না পারলে আমার শান্তি হয়না। কিন্তু সব সময় বেড়ানোর সুযোগ সব্বার থাকেনা। বেছে নিলাম এমন একটি পেশা যেখানে আমায় খুব খুব ঘুরতে হত। আজ্ঞে হ্যাঁ, বেচুবিবির চাকরি। সারা কলকাতা চষে বেড়ানোর পাশাপাশি সুযোগ হলো আমার দেশ-গ্রাম ভালো করে ঘুরে দেখার। এক এক দিনের যাত্রায় বাস, লোকাল ট্রেন, ট্রেকার, ভ্যানো, ডিঙি নৌকো সমস্ত কিছুই থাকতো। একপাল ছাগল ভেড়া, দেহাতি কলকলানো মানুষজনের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে ভালোই দিন কাটছিলো আমার। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার মুখে কোনো স্টেশনের ফুট ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে আকাশে রঙের হোলিখেলা দেখতে দেখতে কতদিন ট্রেন ধরে উঠতে পারিনি। প্রচুর মানুষ পরামর্শ দিতেন এই চরকিবাজির জীবন ছেড়ে নিশ্চিত কোনো চাকরি খুঁজে নিয়ে দশটা-পাঁচটার ঠাণ্ডা ঘরের জীবন কাটাতে। "মেয়ে" মানুষের এসব কি মানায়? বলে উঠতে পারতাম না, ঠাণ্ডা ঘরে একমাত্র মৃত্যুর পরের অবকাশ কাটাবো আমি, তার আগে নয়।
অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা, ভাবনাচিন্তার পর যখন ভ্রমণ সহায়কের পেশা বেছে নিলাম তখনও অনেকে ভেবেছিলেন পারবোনা। কোনো পরিচিত তাঁর বন্ধুদের কাছে কোনো মুহূর্তে বলেও ফেলেছিলেন "ও আর কি করবে, ওর নামে হবে, আসল কাজ ওর বয়ফ্রেন্ডই করবে দেখিস"। কাজ শুরু করার পর আমায় মাথায় ঘুরছিলো একটু আলাদা কিছু করার। সেই আলাদা কাজ করতে গিয়ে কয়েকটি বিশেষ জিনিস স্পষ্ট দেখতে পেলাম যা এতদিন দেখেও দেখিনি বা এড়িয়ে গেছি।
১. বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা আমাদের দেশে খুবই কম। অন্যান্য সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মত তাঁদের মতামত নেওয়া হয় না তেমন, জানানো হয়। ব্যাগ গুছোতে হবে, বাবা মা বাচ্চাদের পোশাক, প্রয়োজনীয় জিনিস তো তাঁদেরই ব্যবস্থা করতে হবে৷ আর স্বনির্ভর না হলে তো নিজের কোনো ইচ্ছারই কোনো মর্যাদা নেই, তায় বেড়ানো।
২. মহিলারা চাইলেও একা বা বন্ধুদের সাথে কোথাও যেতে পারেন না। বর-শ্বশুর-শাশুড়ি-বাবা-মা-ভাই-দাদা-প্রতিবেশী- সেজো ঠাকুমার বড় ননদের পিসতুতো জামাইয়ের আপত্তি ইত্যাদি বহু প্রতিবন্ধকতা। সাথে গোদের উপর বিষফোঁড়া তাঁদের নিজেদের মনের জোরের অভাব। ইউনিভার্সিটি টপার, কলেজের ত্রাস প্রিন্সিপাল, ডাকসাইটে অফিস অ্যাডমিন ম্যাডাম, অজস্র মানুষের প্রাণ রক্ষা করা ডাক্তারও ভাবেন "আমি কি পারবো?" "বাড়ি থেকে ছাড়বে?"!
৩. একটা বয়সের পর মহিলাদের বন্ধুত্ব কফিশপ, শপিং, বাচ্চার স্কুল, স্কুল কলেজের স্টাফ রুমেই আটকে থেকে যায়। পুরুষের মত চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে চল ভাই কোথাও ঘুরে আসি, বস লাইফ ঝালাপালা করে দিচ্ছে এটা বলতে পারার আরেকজন মহিলার অভাব। আরেকজন পুরুষ কে বলাই যায়, কিন্তু যদি ধরে নিই ব্যক্তিগত সুবিধার্থে একজন মহিলা আরোও এক বা বহু মহিলার সাথেই কোথাও বেড়াতে যেতে চাইবেন তাহলে সেই আরও এক জন পাওয়াই ভারি মুশকিল। সুতরাং বেড়াতে যেতে চাইলে সেই বর-বয়ফ্রেন্ড বা বাবা মা'ই ভরসা।
৪. সামাজিক চাপ একটা ভয়াবহ জিনিস ৭০% মহিলাদের জন্য (স্বাবলম্বী)। যতই তাঁরা পাঁচ অঙ্কের মাস মাইনা পান না কেন, সংসার ছেড়ে (বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই) নিজের আনন্দের জন্য বেড়াতে যাচ্ছেন এটা শুনলে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে পৃথিবী রসাতলে যাওয়ার আতঙ্ক নেমে আসে। কতটা স্বার্থপর হলে স্ত্রী তাঁর স্বামী, সংসার বা একজন মা তাঁর সন্তানকে ফেলে একা একা বেড়াতে যেতে পারেন! তা সে যতই সন্তান ১৫-১৬ বছরের হোক না কেন? মহিলারা নিজেদেরই একজন স্বতন্ত্র মানুষ ভেবে উঠতে শেখেন না এই সামাজিক চাপ এর চোটে।
৫. সোলো ট্রাভেল ব্যাপারটা ইউরোপ আমেরিকায় যতটা প্রসিদ্ধ ততটা এ দেশে নয়, আবার এ বঙ্গে আরও কম। পরিসংখ্যান বলছে আমেরিকান ভ্রমনার্থীদের মধ্যে ৭২% মহিলা সোলো ট্রাভেলে আগ্রহী ও নিয়মিত ভ্রমণ করেন। সেখানে আমাদের দেশে মাত্র সমস্ত ভ্রমনার্থীদের মধ্যে মাত্র ৪০% মহিলা সোলো ট্রাভেলার হতে আগ্রহী, আবার এই ৪০% মধ্যে ৬৬% পাঞ্জাবী মহিলা, তার পরেই আসেন তেলেঙ্গানার মহিলারা। সোলো ট্রাভেলার ওমেন ইন ইন্ডিয়া স্ট্যাটিসটিক্স দিয়ে গুগল সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন৷ অথচ বেড়ানোর জন্য আজ থেকে নয় বাঙালীর সুনাম সেই ভারতীয় রেল চালু হওয়ার সময় থেকে। হতেই পারে কেউ পছন্দই করেন না আমার মত একা বেড়ানোতে, কিন্তু অনেকেই করেন, যেতে পারেন না। কেন? সেই রেখেছো মা বাঙালী করে, মানুষ করোনি। অবশ্যই এর সাথে আগের পয়েন্ট গুলিতে কিছুটা বলেছি।
৬. এই ৭২% মহিলার বক্তব্য একা বা অন্য মহিলাদের সাথে বেড়াতে গেলে নিজের সাথে যে সময়টুকু কাটানো যায় বা যেভাবে কাটানো যায় তা পরিবারের বা প্রেমিকের সাথে গেলে সম্ভব নয়। বা এই স্বাচ্ছন্দ্য ও পাওয়া যায়না।
৭. সুরক্ষার চিন্তা মানুষের আগুন আবিষ্কার করার আগে থেকেই। আজ পর্যন্ত কত কোটি খবর খবরের কাগজের পাঁচ নম্বর পাতার এক কোনে পড়ে থেকে মরে যায় যে পরিবার-স্বামী (পড়ুন পুরুষ) সুরক্ষায় বেড়াতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন বা মৃত। রাস্তায় বেরোলে দুর্ঘটনার শিকার পুরুষ মানুষের হয়না? পুরুষ সঙ্গীর সাথে থাকা মহিলার হয় না? বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশীরভাগ মানুষের মাথায় প্রথম কাজ করে সেই জায়গার রাজনৈতিক ও আবহাওয়া জনিত স্থিরতা। মহিলাদের জন্মগতভাবে এই সুরক্ষার চিন্তা থাকায় তাঁরা এ বিষয়ে আরও সচেতন। ধরে নিন আপনি বেড়াতে যাচ্ছেন আফ্রিকার এমন একটি দেশে যেখানে চুরি-ছিনতাই অপহরণ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আবার কেউ যাচ্ছেন এক্সোটিক ইয়োরোপ ট্যুরে। কার সুরক্ষা বেশী? এখানে নারী পুরুষ ভেদাভেদ নেই। একজন মহিলা হিসেবে আমি কখনই কাউকে পরামর্শ দেবো না রাতের দিল্লী ঘুরে বেড়াতে, একা তো দূর, এক দল বন্ধুর সাথেও নয়। কিন্তু সেটা যদি মুম্বাই হয় আমার কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না, একা হলেও নয়। এখানেই আসে একজন মানুষের সুরক্ষাজনিত স্বাভাবিক ধারণা অথবা ইনসন্টিংক্ট। বাকি দুর্ঘটনা তো বাড়ির ছাদ মাথায় ভেঙে পড়েও হয়।
৮. পিতৃতান্ত্রিক সমাজ একজন মহিলার তাঁর প্রেমিকের সাথে বেড়াতে যাওয়ায় হাজার প্রশ্ন তোলে, শারীরিক বা মানসিক সম্পর্ক (প্রেমজ) নেই এমন একজন বন্ধু পুরুষের সাথে বেড়ানো কি চোখে দেখে তা আরও স্পষ্ট হয়েছিলো আমার এক সরকারী চাকুরে গ্রেড ওয়ান অফিসার বন্ধুর কথায়। "বেড়াতে যেতে চাই, আমার ছোটবেলার বন্ধুর সাথে, কিন্তু মা বলছে বরের পার্মিশন নিয়েছি কি না। জানিস এর সাথে নার্সারি থেকে এক সাথে পড়েছি, মা একে নিজের ছেলের মতই দেখতেন"। সেখানে কেউ যদি এই সমস্ত উত্তরের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য শুধু মাত্র মহিলাদের সাথেই বেড়াতে যেতে চান?
৯. এক দল মেয়ে নিয়ে বেড়াতে যাবো শুনে যখন কোনো প্রতিবেশিনী জেঠিমা আমার মা কে বলেন "তোমার মেয়ের বাপু বড্ড সাহস, কেমন একা একা বেড়াতে যাচ্ছে!" অথচ আমার বাবার মৃতদেহ আমি হাসপাতাল থেকে একা একা নিয়ে আসার সময়ে কিন্তু ইনি এনার স্বামী কে পাঠান নি আমায় সঙ্গ দিতে।
১০. শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, সামাজিক সুরক্ষার অধিকারের মতই নিজের মত করে ভালো থাকাটা যে মহিলাদেরও অধিকার এটা মহিলারা নিজেরাই অনেক সময় বুঝে উঠতে চান না বা পারেন না। ফলতঃ পড়ে থাকে শুধুই হাহাকার। আজ আমি "মেয়ে মানুষ" বলে...
আসলে এই তালিকাটা শেষ করে উঠতে পারা মুশকিলের আমার কাছে। সংযোজন হতে থাকবে, হতেই থাকবে। আমি মনে করি না ঘরে বসে কেক কেটে বা পার্টি করে, শপিং মলে কিছু বিশেষ ছাড়, পার্লারে কিছু বিশেষ ইভেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে নারী দিবস পালন করা যায়। নারীদের জন্য বছরের প্রত্যেকটা দিনই সমান। প্রতিটা দিন সমান লড়াইয়ের, সমান ভাবে বাঁচার। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে যখন নিজের শিক্ষার অধিকার নিজে বুঝে নিয়েছেন, নিজের পেশাগত যোগ্যতায় কারো থেকে কম নন, কারোর চেয়ে এক বিন্দু কম প্ররিশ্রম করেননি উলটে প্রতি মূহুর্তে আপনাকে প্রমাণ দিয়ে যেতে হয়েছে নারী বলে আপনি মেধায়, দক্ষতায় কম নন তখন নিজের ভালো লাগা, মুক্তির স্বাদ টুকু বলি কেনো দেবেন কারোও কথা ভেবে? জীবন বিশাল বড়। বুড়ো বয়েসে অচল অবস্থায় শুয়ে আক্ষেপ করবেন না অ্যালবামের পাতা ওল্টাবেন আপনার পছন্দ। নিজেকে ভালোবাসা স্বার্থপরতা নয় এটা বুঝতে বুঝতেই জীবন অতিক্রান্ত করে দেবেন? নিজেকে ভালো রাখতে না পারলে যে পৃথিবীর কাউকে ভালো রাখার ক্ষমতা কারোরই নেই।
তথ্যসূত্রঃ-
https://solotravelerworld.com/about/solo-travel-statistics-data/
স্বাতীর ১০টি পয়েন্টেই একমত , দ্বিমতের কিছু নাই।
কিন্তু লেখাটি খুব স্টেরিওটাইপ, নিরস, সরি।