আসামে যা ঘটে গেল তা আমাদের কাছে কেমন এক হঠাৎ হিংসার মতো চমক নিয়ে এলো। আদতে শুধু আসাম নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত সম্পর্কেই দেশের বাকি অংশ বড়ো কম জানে, জানতে চায়। সাম্প্রতিক হিংসার প্রেক্ষাপটে অপার বাংলার এই অংশটি নিয়ে এবারের বুলবুলভাজায় রইল এক গুচ্ছ লেখা।
শান্তির আদর্শ
“শান্তির দ্বীপ” কথাটি বহুচর্চিত। এই রাজনৈতিক উপমাটি চালু করেছিলেন ভারতীয় শাসকশ্রেণির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এরমধ্যে বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক গরিমা খুঁজে পান অনেকেই। শান্তির এই পরিমণ্ডলকে বরাকের গৌরব হিসেবে দেখাতে পিছিয়ে থাকেন না বামপন্থী বলে পরিচিত একাংশ বুদ্ধিজীবীরাও। এই শান্তি আসলে কীসের ইঙ্গিত বহন করে তা আমরা তলিয়ে দেখতে চাই না। আমরা কায়মনোবাক্যে কামনা করি এই শান্তি সম্প্রীতি যেন অটুট থাকে আবহমান কাল ধরে। শাসক শ্রেণির প্রতিভূর ছুঁড়ে দেওয়া এই উপমাটি কী এমনই নিরীহ যে নিরীহ ছা-পোষা সাধারণ বরাকবাসীকে একেই আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে হবে?
মতাদর্শগত কাঠামো
আমাদের উপনিবেশিক অতীত আমাদের সভ্য হয়ে ওঠার বাসনাকে চাগিয়ে দিয়ে সভ্য করে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত উপনিবেশিক প্রভুদের গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়ে তুলে। এই অধিপত্যবাদী কাঠামোই পুরুষত্বের বিপরীতে গুণহীন ক্লীবত্বের মতাদর্শ গড়ে তুলে নারীত্বকে পুরুষত্বের অধীনে সামিল করে নেয়। অর্থাৎ এমন একটি মতাদর্শগত কাঠামো যেখানে আধিপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই কোন গুণকে বিচার করার বাতাবরণ সৃষ্টি হয় – বিপরীতটি হয় হারিয়ে যায় নতুবা বিপদজনক হিসেবে বিবেচিত হয়। শাসক শ্রেনির জারি করা “শান্তির দ্বীপ” উপমাটি এরকমই এক আধিপত্যবাদী মতাদর্শ থেকে উদ্ভূত যেখানে শোষিতের অশান্ত হয়ে ওঠার ধারণাকে নাকচ করে তাদেরকেও সহাবস্থানের এই অমোঘ শান্তির কাঠামোয় সামিল করে নেয়। বৌদ্ধিক চর্চার দৌড় এই কাঠামোর গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় শোষিতের দৃষ্টিকোণ থেকে শান্তির প্রশ্নটিকে দেখতে চায় না বা দেখার সাহস করে না। সাহস করে না এই কারণে যে এই মতাদর্শগত কাঠামোটি এই বোদ্ধাদেরও সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেয়।
শান্তির মাহাত্ম্য
তাহলে এই “শান্তির দ্বীপ” কথাটির মাহাত্ম্যটা কী? এর সোজাসাপটা মাহাত্ম্য এই যে বরাক উপত্যকায় শাসক শ্রেণির দল এবং দিল্লি-দিসপুরের হুকুম তামিল করা রাজনৈতিক নেতৃত্বরা কখনওই কিন্তু তেমন কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি, তাদের অপ্রতিরোধ্য স্রোতে সামান্য প্রতিস্রোতের হাওয়া লেগেছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ‘জরুরি অবস্থা বিরোধী’ আন্দোলনের পরবর্তী ১৯৭৭-এর নির্বাচনে। কেন এই অপ্রতিরোধ্য গতি তা বিচার করার জন্য বরাকের বুদ্ধিজীবীদের যুক্তির কাঠামো কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তা দেখে নিতে হবে। সাম্প্রতিক ভারতে যে দু’টি বিষয়ের উপর সবচাইতে বেশি চর্চা হয়েছে ও হচ্ছে তা হলো – জাতপাত ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। এই দু’টি বিষয়ের উপর আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করলেই আমরা “শান্তির দ্বীপ” প্রসঙ্গের উপর অনেকখানি আলোকপাত করতে পারব।]
যুক্তির কাঠামো
বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও পশ্চিমবাংলাকে দেখিয়ে বড়াই করে বলতেন ‘বাঙালির মধ্যে জাতপাত নেই’। কীভাবে তাঁরা বুঝলেন যে সেখানে জাতপাতের বিভাজন নেই – কারণ বিহারে ভূমিহার-রাজপুত-ঠাকুর-দলিত-যাদব-কুর্মী ইত্যাদির মধ্যে সহিংস সংঘাত লেগেই থাকে, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় অপার শান্তি। সেখানে যেমন রণবীর সেনা রয়েছে – তেমনি রয়েছে দলিত সেনা – পশ্চিমবাংলায় তো তেমন নেই। তাঁরা সম্পত্তি-সম্পর্ক বিচার করার দিকে না গিয়ে বহিরঙ্গের শান্তি-অশান্তির রূপ দিয়ে জাতপাতের বিচার করলেন। বিহারে উচ্চবর্ণের জমির মালিক সরাসরি জমির সাথে যুক্ত থেকে সস্তায় শ্রম শোষণকে সুনিশ্চিত করতে শারীরিক নিগ্রহ চালাত। দলিতরা তার প্রতিরোধ করলে কিংবা যে কোন শ্রেণি সংগ্রাম সেখানে শুরু থেকেই হিংসাত্মক রূপ নেয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই সম্পত্তি সম্পর্কের খানিকটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে – কিন্তু তা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। পশ্চিমবাংলায় বর্ণহিন্দু আধিপত্য যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই বিরাজ করছিল তা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। সাচার প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর “পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িকতা নেই” এই দাবিও যে ঠুনকো তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া গরীব মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার হিংসাত্মক রূপ পরিগ্রহ করার প্রয়োজন পড়ে না, কারণ বর্ণহিন্দু আধিপত্য যেখানে শান্তির বাতাবরণেই সবচাইতে সুরক্ষিত থাকে সেখানে অশান্তি ডেকে আনা আধিপত্যের পায়ে কুড়োল মারার সামিল। বরাক উপত্যকার ক্ষেত্রেও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যাগত ভারসাম্যের চিত্রটি বাদ দিলে শান্তির এই একই যুক্তি ক্রিয়াশীল থাকে।
রাজনীতি ও মতাদর্শ সম্পর্ক
উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের সম্পর্ক, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক পরস্পর সম্পৃক্ত। সম্পত্তির সরাসরি মালিকানা তা কৃষি-অকৃষি যে কোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিংবা সরকারী দপ্তর ও প্রশাসনের মাধ্যমে সম্পত্তির অমলাতান্ত্রিক মালিকানার হিসেবে সংখ্যালঘু বর্ণহিন্দু আধিপত্য প্রশ্নাতীত। নীতি নির্ধারণে বর্ণহিন্দুদের সংখ্যাধিক্য তাদের আধিপত্যকে বজায় রেখেছে এবং নিম্নবর্ণীয়দের কায়িক শ্রমশক্তি শোষণের উপযোগী পিরামিডাকৃতি শ্রম বিভাজনের কাঠামোর চূড়ায় তাদের অবস্থান রয়েছে। অনুরূপভাবে মতাদর্শ – মূল্যবোধ গড়ে তোলার সকল প্রতিষ্ঠানও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় লোকায়ত প্রাক-ব্রাহ্মণ্যবাদী বস্তুবাদী মতাদর্শ ক্রমশঃ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বর্ণবাদী মতাদর্শের অধীনস্ত হয়ে পড়েছে। মতাদর্শের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে ‘পারস্যে’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “...যে বাস্তবের পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়োজাহাজ – অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক উড়ো জাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’। কঠ উপনিষদ থেকে গীতায় উদ্ধৃতি – ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ – হত্যা করলেও তাকে সত্যি হত্যা করা যায় না। কাকে? পরমাত্মাকে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, “ যে-দার্শনিক তত্ত্বের উড়োজাহাজ অর্জুনের কৃপাকাতর অনেক ধ্যানধারণার এমনই ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে গেলো যেখানে বাস্তব পৃথিবীর সত্তা অস্পষ্ট, তার অস্তিত্বের দাবি বিলয়ের মহাশূন্যে বিলীন – ধ্যানধারণার সেই উর্ধ্বলোকই দার্শনিকদের ভাষায় ভাববাদ ...”। সেখান থেকে মারেই বা কে, মরেই বা কে! কঠোর শ্রমই বা কে করে – তার শ্রমশক্তিকে শোষণই বা কে করে। এই দর্শনের বিশ্বাসেই এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অজ্ঞানের ঘোর, পাওনা-গণ্ডা নিয়ে সোরগোল পাকানো – এসবই নেহাত বেকুবের লক্ষণ। এই বিশ্বাসই দ্বিজ-শূদ্রে বিভক্ত এই সমাজ আদর্শের ভিত। কোশাম্বী ভারতীয় বর্ণকে বর্ণণা করেছেন অনগ্রসর পণ্য উৎপাদনী ব্যবস্থায় একধরণের শ্রেণি হিসাবে, সামাজিক সচেতনতা নির্মাণে এমন এক ধর্মীয় পদ্ধতি হিসাবে যেখানে প্রকৃত উৎপাদকরা ন্যূনতম বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত থেকে বঞ্চিত হয়”। এই ন্যূনতম বলপ্রয়োগের পরিস্থিতির নামই শান্তি। এই শান্তির কাঠামোর বাইরে যারা রইল – তারাই অ-হিন্দু। মতাদর্শগত স্তরে এই অ-হিন্দুদের উপর বলপ্রয়োগের সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে, কারণ বর্ণবাদী মতাদর্শ দিয়ে তাদের আচ্ছন্ন করে রাখা যায় না, তারা তাদের পাওনা-গণ্ডার দাবি করেই ফেলে এবং তাতেই তাদের উপর নেমে আসে আক্রমণের খড়গ। এই আক্রমণকে বৈধতা দিতেই নানাধরনের অপপ্রচার চালানো হয়। হিন্দুত্ববাদীরা যেমন নাগরিক ও সম্প্রদায়গত বহুত্ববাদকে খণ্ডন করে এক সমসত্তাবিশিষ্ট রাজনৈতিক শক্তি কায়েম করতে চায়, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ করে মুসলমানদেরও এধরনের এক সমসত্তা হিসেবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু বাস্তবে অন্যান্য দেশের মত ভারতীয় ইসলামও নাগরিক ও সম্প্রদায়গত বহুত্ববাদ রয়েছে, যদিও ধর্ম হিসেবে ইসলাম সম্প্রদায়গত বৈষম্য ও শ্রম-বিভাজনকে বৈধতা দেওয়ার বিপরীতে সাম্যের কথা বলে। এই সমসত্তার ধারণা ও আধিপত্যের কাঠামো যতক্ষণ অটুট থাকে ততক্ষণ শান্তির উপমাটি খুব যুৎসইভাবে রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই কাঠামোতে ইতিমধ্যে বেশ জোরালো আঘাত পড়েছে। সাচার ও রঙ্গনাথ কমিশনের সুপারিশের পর মুসলিমরাও সংরক্ষণের দাবির সপক্ষে সাংবিধানিক বৈধতা পেয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাতে শঙ্কিত হয়ে উঠছে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ হিন্দুত্ববাদীদের সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে আরও একধাপ অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে শান্তির বারি বর্ষণ করার প্রতি যে বেশি আকর্ষণ বোধ করছেন তা প্রতিক্রিয়ার সাথে আপসকামী ও দুর্ভাগ্যজনক।
অর্থনীতিবাদের গাড্ডা
তবে এই আচরণ যে প্রতিক্রিয়ার সাথে আপসের ও আধিপত্যবাদের পক্ষে যায় তা তাদের উপলব্ধিতেই আসে না, বরঞ্চ তাঁরা ভাবেন যে শান্তির জন্য এই কামনা সমাজের কল্যাণেই। তাঁরা মনে করেন যে অর্থনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের দাবিতে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করা সম্ভব। আজকের উদার আর্থিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক অসাম্য যখন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষের মনের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে, তখন এই ধরনের ধারণা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আরও জাঁকিয়ে বসছে। জনগোষ্ঠীগত সমতার প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে গরীব-মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই যে দানা বাঁধতে পারে না – এই সত্যকে তাঁরা দেখতে পান না। অর্থনৈতিক প্রশ্নকে অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার জন্যই এই বিভ্রান্তি ঘটে – মার্কস যাকে আখ্যায়িত করেছেন অর্থনীতিবাদ হিসেবে। রাজনীতিকে অর্থনীতি থেকে আলাদা করা বা অর্থনীতিকে ইতিহাসের আলোকে বিচার না করাই আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি কিংবা তার নব্য রূপ উদারবাদী অর্থনীতির গ্রহণযোগ্যতার মুল চাবিকাঠি। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ অর্থনীতিবাদের এই ফাঁদে পা দিয়েছেন। ফলে তাঁরাও জনগোষ্ঠীগত অধিকারের প্রশ্নকে আড়ালে রেখে তথাকথিত শান্তি বজায় রাখার পক্ষে ওকালতি করেন, কারণ তাঁরা মনে করেন যে শান্তির পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠে এবং তা দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে মোকাবিলা করা যেতে পারে। তাদের এই ধারণা যে ভ্রান্ত বরাকের সাম্প্রতিক ঘটনা তাই প্রমাণ করল।
সাম্প্রতিককালে বরাক উপত্যকার উন্নয়নের প্রশ্নে, অর্থনৈতিক-নাগরিক ও মানবিক অধিকারের প্রশ্নে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠছে। হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদ তাতে শঙ্কিত হয়ে উঠাই স্বাভাবিক ছিল। তাদের এই শঙ্কা দূর করার এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল হাই-প্রোফাইল ভিন-ধর্মী বিয়ের ঘটনা। প্রগতিশীল শক্তি তাদের এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে খাট করে দেখল এবং এর সক্রিয় প্রতিরোধের বদলে নিষ্ক্রিয় শান্তির পক্ষে ওকালতি করল। তাদের এই অবস্থান এই বোধ থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে অর্থনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সম্প্রদায়গত ও শ্রেণিগত যে ঐক্য গরে উঠেছে হিন্দুত্ববাদের সক্রিয় বিরোধিতা এই ঐক্যকে বিনষ্ট করতে পারে। তাদের এই ভূমিকা যে সুবিধাবাদের নামান্তর ও বাস্তববোধ বর্জিত তা আবারও প্রমাণ হলো। আর্থিক সংকটের ফলে নড়বড়ে আধিপত্যবাদী কাঠামোয় কোণঠাসা হতে থাকা হিন্দুত্ববাদী শক্তি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল। আমরা যদি অতিসত্বর এই অর্থনীতিবাদী মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি তাহলে পরাজয়ের গ্লানি আমাদেরকে আরও বহুদিন বহন করে বেড়াতে হবে।
সংকট, বিশৃঙ্খলা ও পরিবর্তন
বিশ্ব-পুঁজিবাদী সংকট ও ভারতীয় উদারবাদী অর্থনীতির কুফলের পরিণতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে এবং তা হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের কাঠামোকেও দুর্বল করে তুলছে। কিন্তু এই অর্থনীতিতে লাভবান একাংশ উচ্চশ্রেণি-বর্ণের লোকের সমর্থনে ও ক্রমবর্ধমান বেকার যুবকদের বিপথে পরিচালিত করে এক আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ যে গণ-সমাজের উপর জাঁকিয়ে বসতে পারে না তা হলফ করে বলা যায় না। আধিপত্যকামী শক্তির শান্তির শ্রুতলিপিকে মান্যতা দিয়ে এই আগ্রাসনকে মোকাবিলা করা যায় না, বিশেষ করে আজকের পরিস্থিতিতে যখন মধ্যপন্থার জায়গা ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সুতরাং আমাদেরকে এর মোকাবিলা করতে হবে এক সম্পূর্ণ র্যাডিক্যাল অবস্থান থেকে।
‘রুমি কাণ্ডে’ যে এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবার তীব্র অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটেরও প্রতিফলন এই শ্লীল-অশ্লীল, ঔচিত্য-অনৌচিত্য, হিংসা-ভালবাসা, অন্তর্ঘাত-সম্মুখ সমর ইত্যাদি মহাকাব্যিক গুণে ভরপুর এই কুনাট্য। শাসক শ্রেণির অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা যে আগামী দিনে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটবে তা হলফ করে বলা যায়। অর্থনৈতিক সংকট থেকে এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কীভাবে উদ্ভব ঘটে তা সাধারণ পাঠকের জন্য একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক। রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হয় মতাদর্শগতভাবে মোহাচ্ছন্ন ও শাসকীয় অর্থনৈতিক নীতিতে পরিচালিত শাসিতের প্রচ্ছন্ন সম্মতির বলে অথবা শাসিতরা যদি অসম্মতি প্রকাশ করে তাহলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সম্মতি আদায় করে। প্রথম অবস্থা বজায় রাখার জন্য আর্থ-সামাজিক অসাম্যকে একটি সহ্যের সীমার মধ্যে ধরে রাখা প্রয়োজন, প্রয়োজন শ্রমশক্তি লুণ্ঠনের এক নমনীয় কাঠামো। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট অসাম্যের তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সামাজিক ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে। আর্থিক সংকটে জর্জরিত মানুষ বিদ্রোহ করতে চাইলে – শাসক শ্রেণি দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই দিশেহারা অবস্থাতেই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই যে কোন অবস্থার দ্বিমুখী গতি সম্ভব। তাই এক্ষেত্রেও এই বিশৃঙ্খলার নব্য-উপনিবেশিক পরিণতি হিন্দুত্ববাদী–আক্রমণাত্মক-শৃঙ্খলার দিকে যাওয়ার প্রবণতা যেমনি থাকবে – ঠিক তেমনি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সমাজ গড়ার প্রবণতাও থাকবে। এই দ্বিতীয় পথকে উন্মোচিত করার জন্যই হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে ও সমান-অধিকার, সমান-মর্যাদার দাবিতে তীব্র ও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের লড়াই গড়ে তুলতে হবে। ‘সাম্প্রদায়িকতা শান্তি বিনষ্ট করে – তাই বর্জনীয়’ – এধরনের প্রচারের মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখা যাবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও বাস্তবকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে শান্তির বারি ছিটিয়ে দেওয়ার একধরনের ক্লীব অবস্থান নিয়েছেন।
র্যাডিক্যাল অবস্থান
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে র্যাডিক্যাল অবস্থান সুনিশ্চিত হবে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সমান-অধিকার, সমান-মর্যাদার নীতির ভিত্তিতে জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের দাবিতে জোরদার অন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। সংখ্যালঘু তোষণের হিন্দুত্ববাদী প্রচারকে জোরালোভাবে খণ্ডন করে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ভাষিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্নকে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস পাঠের বিপরীতে দলিত-নিপীড়িতের সংগ্রামের ইতিহাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। নমঃশূদ্রদের আন্দোলন – কৈবর্ত বিদ্রোহ – সিধু-কানুহ, বিরসা মুণ্ডার বিদ্রোহ – নাথ পন্থের ইতিহাস – তেভাগা – নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস এবং সর্বোপরি বরাক-বাংলাদেশের ভাষা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসকে সামনে এনে পরিচিতির সংগ্রামকে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। অর্থনৈতিক অধিকার – গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শোষিতের ক্ষমতায়নের প্রশ্নকে যুগপৎভাবে পরিচালিত না করে অসাম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার দিকে এককদমও অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বরাকের বুদ্ধিজীবীরা যত তাড়াতাড়ি এই বাস্তব সত্য উপলব্ধি করতে পারেন ততই মঙ্গল। শোষণ – বঞ্চনা – অনুন্নয়নের কাঠামো বজায় রেখে তথাকথিত ‘শান্তির দ্বীপের’ চেয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভবিষ্যতের প্রকৃত শান্তির আশায় অশান্ত বরাক হাজারো গুণ কাম্য।
লেখাটি 'অরুণোদয়ের পথে' পূর্বপ্রকাশিত।