একটি নাটকের কাহিনি
আবুল মনসুর আহমদ হুজুর কেবলা নামে একটি স্যাটায়ার গল্প লিখেছিলেন উনিশ শ সাতচল্লিশ সালের আগে। গল্পটি নাটক আকারেও বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চস্থ হয়ে আসছে বহুকাল আগে থেকেই। স্নাতক ক্লাশে পাঠ্যও বটে। কখনো আবুল মনসুর আহমদকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয় নি। তাঁর ঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয় নি। এটাই স্বাভাবিক। গভীরভাবে ইসলামধর্মবিশ্বাসী লেখক ও ডানপন্থী রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ পরবর্তী জীবনে আদর্শিক দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পন্থারই সমর্থক ছিলেন। গল্পটির লিংক নীচে দেওয়া হল। পড়ে দেখুন।
সাতক্ষীরার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গত ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালিগঞ্জের ফতেপুর হাইস্কুলে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রখ্যাত এই ‘হুজুর কেবলা’ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। নাটকটিতে মহানবী (সাঃ) হযরত মুহাম্মদ সম্পর্কে কটুক্তি করা হয়েছে এই অভিযোগ এনে স্থানীয় দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয় ২৯ মার্চ। সংবাদটি রচনা করেন স্থানীয় সংবাদদাতা মিজানুর রহমান। তার বাড়ি সাতক্ষীরার ফতেহপুরে। পিতা মাওলানা আজিজুর রহমান।
এই সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় যথাযথ তদন্ত ও সত্যতা যাচাই না করেই কালিগঞ্জ থানার সাবেক ওসি ফরিদউদ্দিন অতি উৎসাহী হয়ে ৩০ মার্চ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে থানায় একটি মামলা রেকর্ড করে এবং ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেজোয়ান হারুন, সহকারী প্রধান শিক্ষক মিতা রানী হাজরাকে বাড়ি থেকে স্কুলে ডেকে এনে গ্রেফতার করে। এরপর দুটো হামলা ঘটে দুটি গ্রামে।
প্রথম হামলা — স্থান ফতেপুর গ্রাম
এদিকে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনার পরও শনিবার সকাল ১১টার দিকে কৃষ্ণনগর, বালিয়াডাঙ্গা ও রামনগর গ্রাম থেকে কয়েক হাজার মানুষ লাঠি-শাবল নিয়ে হামলে পড়ে ফতেপুর গ্রামে। কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ হামলা চালিয়ে ভাংচুর, লুটপাট ও অংগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটালেও সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরা ছিল একেবারেই নির্বিকার। ফতেপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী কয়েক হাজার লোক ওই গ্রামে হামলা চালায় এবং প্রথম দফায় দুই স্কুল শিক্ষকের বাড়িসহ আটটি বসত বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। প্রধান শিক্ষক রোজোয়ান হারুনের বাড়িটির পুড়িয়ে দিলে তাঁর ঘরের মধ্যে পবিত্র কোরআন শরীফের একটি কপিও পুড়ে যায় বলে জানান সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক।
দ্বিতীয় হামলা — চাকদা গ্রাম
ফতেপুর গ্রামে অব্যাহত হামলা ও তান্ডবের পর রবিবার ফতেপুর গ্রামবাসী এলাকায় শান্তি মিছিল ও প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ফতেপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে চাকদহা গ্রামে একই ইস্যুকে পুঁজি করে এই হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়। হামলায় অংশ নেয়া অধিকাংশ ব্যক্তির ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
চাকদা গ্রামে সেই ঘটনা — (দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে)
রবিবার দুপুরে বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে শ্যামাপদের স্ত্রী ললিতা সরদার (৪৫) ও পাশের গ্রামের ফজর আলির স্ত্রী আনুরা (৪০)এর মধ্যে কথা হয় ফতেপুরের হামলার ঘটনা নিয়ে। ফতেপুরের নিরীহ গ্রামবাসীর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া অন্যায় হয়েছে এমন মন্তব্যে নাখোশ হয় আনুরা বেগম। নবীজি সম্পর্কে কটূক্তি করেছে ললিতা এমন প্রচারে বিকাল থেকেই এই সরদার পরিবারের বাড়ির সামনে লোক জড়ো হতে থাকে। সন্ধ্যার কিছু আগে স্থানীয় নাজিমগঞ্জ বাজার কমিটির সভাপতি ফিরোজ কবীর কাজল, স্থানীয় ইউপি মেম্বারসহ সকলে ললিতার বাড়িতে বসে তাকে এধরনের কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইতে চাপ প্রয়োগ করে। সমঝোতা বৈঠকে উত্তেজিত হয়ে ওঠে বাইরের গ্রাম থেকে আসা ২ শতাধিক যুবক ও ক্যাডার। তারা লাথি মেরে তাদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জড়ো হতে থাকে, এসব বাড়ি থেকে প্রায় ৫শ’ গজ দূরের চৌরাস্তায়।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানে প্রায় ৩০ সদস্যের পুলিশ রাখা হয়। সন্ধ্যার পর প্রায় ৭টার দিকে মোবাইলের মাধ্যমে ডেকে আনা হয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক হাজার কিশোর যুবককে। পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে থাকা এসকল বহিরাগতরা আধাঘণ্টার মধ্যেই চিৎকার দিতে দিতে জড়ো হয় এসকল বাড়ির সামনে। পুলিশের উপস্থিতিতে তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে বাড়ির মধ্যে। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যরা ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদ আশ্র্রয়ের জন্য ছুটতে থাকলে শুরু হয় লুটপাট। দরজা জানালা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান কাপড়সহ জমির দলিল, মূল্যবান কাগজপত্র সব কিছু লুট করতে থাকে দলবদ্ধ ভাবে। ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা সুজিতের স্ত্রীর কানের দুল খুলে নেয়। ললিতার হাতে থাকা সোনার গয়নার কৌটা কেড়ে নেয় তারা কৃষ্ণপদ, শ্যামাপদ, রন সরকার, সুধীর সরদার, নিরঞ্জন, শিবু, ভবরঞ্জন, জগদীশ, বিশ্বজিতসহ ১০টি পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে সর্বস্ব লুট করা হয়। লুটের মালামাল নিরাপদ স্থানে রেখে এসে তারা পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় শ্যামাপদ সরদারের পাকা ঘরে। এ সময় পুড়িয়ে দেয়া হয় কৃষ্ণপদের ৩টি, শ্যামাপদের ২টি, রনসরকারের ৩টি ও সুধীর সরদারের ১টি বসতঘর। পুলিশের উস্থিতিতে প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে এই নারকীয় তাণ্ডব চললেও পুলিশ ছিল নির্বিকার ও নীরব দর্শক।
আগুন নেভাতে বাধা ধর্মীয় ইস্যুকে পুঁজি করে চাকদহা গ্রামে ধর্মান্ধদের হামলা ও অগ্নিসংযোগের তাণ্ডবে পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদ্যের নমনীয়তার কারণে আগুন নেভাতে যাওয়া অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যরা এলাকায় ঢুকতে পারেনি। আগুনের লেলিহান শিখায় ৮টি বাড়ি পুড়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত হামলাকারীরা অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যদের ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। রাতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, এডিশনাল ডিআইজি, র্যাব সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন।
এর পরে--
এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটার পরেও আশ্চর্য নীরবতা অবলম্বন করে দেশের মিডিয়া। শুধু দৈনিক জনকণ্ঠই গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিতভাবে ঘটনাটির খবর প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাজধানীর সড়ক অবরোধ করলে তখন অন্যান্য মিডিয়া খবরটি প্রকাশ করতে শুরু করে। তাদের খবর প্রকাশের ঢংটি এমনভাবে প্রকাশিত হয় যেন সাতক্ষীরার ঘটনাটি অতি সাধারণ এবং সেটার জন্য সড়ক অবরোধ করে যানবহন চলাচলের অসুবিধা ঘটনার কোনো মানে হয় না।
যারা নিয়মিত কলাম লেখেন—সেই নামী বুদ্ধিজীবী-কলমজীবীদের অধিকাংশই সাতক্ষীরা-ট্রাজেডিতে হাত গুটিয়ে থাকেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ মৌলবাদীদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে চুপ করে বসে আছে। আর বিএনপি সংখ্যালঘুদের কোনো দ্বায়িত্ব কোনোকালেই বহন করে নি। এখনও করছে না। জামাতের পত্রিকা সংগ্রাম ও নয়াদীগন্ত প্রকারন্তরে ক্ষতিগ্রস্থদের কটুক্তিকারী হিসাবে অভিযুক্ত করে তাদের শাস্তি দাবী করেছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান দেশের নানা বিষয়ে সোচ্চার হলেও এ বিষয়ে টু শব্দ করেন নি। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিছু লেখেন নি। লেখেননি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সদাবাক বদরুদ্দিন উমর এটার পিছনে শ্রেণীদ্বন্দ্বের কারণ খুজে দেখার চেষ্টা করছেন হয়তো। পেলে হয়তো লিখতেও পারেন। না পেলে লিখবেন না। আনু মুহাম্মদ তিনিও নীরব। হুমায়ূন আহমদ নিউ ইয়র্কে অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায় অনেকগুলো বই লিখছেন। সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছে—হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে তিনি বিজি।
ফেসবুক, ব্লগসহ অন্তর্জালের উদ্ধীপ্ত সচেতন তরুণদের মধ্যেও দুএকজনের ছাড়া সাতক্ষীরার ঘটনাটি নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদমূলক লেখা বা পোস্ট প্রকাশিত হতে দেখা যায় না। অথচ এই তরুণ লেখক- বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও বিদেশের যে কোনো ধরনের ছোটোখাটো নির্যাতন-নীপিড়ন-বর্বরতার প্রতিবাদে এককভাবে--জোটবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
সাতক্ষীরায় সব কিছু শান্ত হয়ে আসবে। এই ঘটনা ভুলে সবাই ভুলে যাবে। ভুলিয়ে দেওয়ার সকল আয়োজন চলছে। এরপরে আবারও সাতক্ষীরার বদলে হয়তো ঝিনাইদাহে ঘটবে। কুড়িগ্রামে ঘটবে। অথবা নরসিংদীতে, ভোলায়, হবিগঞ্জে বা যে কোনো স্থানেই ঘটতে পারে। তারও ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। এই দাঙ্গার প্রধান টার্গেটই ছিল সংখ্যালঘুরা। একাত্তরে পাকিবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যই ছিল এই সংখ্যালঘুদের নির্মুল করা। স্বাধীন বাংলাদেশেও বিরানব্বইতে, ছিয়ানব্বইতে, দুই হাজার এক সালে নির্বাচনোত্তর সহিংসার শিকার হয় এই সংখ্যালঘুরা। এগুলো করেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি, খালেদার বিএনপি, গোলাম আযমের জামাতে ইসলামী এবং হাসিনার আওয়ামী লীগ তেমন সোচ্চার হয় নি-- চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করেছে। প্রকারন্তরে তাদের এই চুপ করে থাকাটাই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে শক্তিশালী করে। চিনাপন্থী রাজনীতিকদের সমর্থন সবসময়ই বিএনপি-জামাতের দিকে। আর প্রগতিশীল বামদের শক্তি ক্রমশ কমছে। তাদের কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভরসা কমছে।
কিন্তু প্রকৃত ভরসা আছে -
প্রকৃতই বাংলাদেশের আপামর মানুষ সম্প্রীতির সহজ মানুষ। তারা অতীতে সকল প্রকার দাঙ্গা ফেসাদকে রুখে দাঁড়িয়েছে। একাত্তরের গণহত্যাকে রক্ত দিয়ে ঠেকিয়েছে। বুক দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাঁচিয়েছে। এবারও বাঁচাবে। ভবিষ্যতেও বাঁচাবে। এই ভরসাই আমাদের বাঁচতে শেখায়। সেই সহজ মানুষের দিকেই চেয়ে আছি। আর কারো দিকে নয়।
সংযুক্তঃ ১. আবুল মনসুর আহমদের হুজুর কেবলা গল্পটি পড়ুন। লিংক
হুজুর কেবলা
২. দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদনটির লিংক--
দৈনিক জনকণ্ঠ
৩. সাতক্ষীরা ঘটনাটির ভিডিও ক্লিপের লিংক-- ভিডিও
৪. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা : ভিন্ন অধ্যায়