[ বিধিসম্মত সতর্কীকরণ : এ লিখন ব্যক্তি-আমি কেন্দ্রিক । ব্যক্তি-আমিকে বাদ দিয়ে কোনও সম/আলোচনা সম্ভব বলে আমি মনে করি না ।]
“Allah! I have done it, after Rabindranath I have done it”.- কবীর সুমন, ২০.৮.১২, কলামন্দির
৯২ থেকে ১২। জীবন চলিয়া গেছে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। সুমন আছে, আমি আছি। জীবন দু-ভাগে বিভক্ত। Pre suman আর post suman। আমি আমার জীবনের কথা বলছি। আমি বাংলা গানের জীবনের কথাও বলছি। আমার এই কমেন্ট-কে তত্ত্ব দ্বারা ডিফেন্ড করার কোনো দায় আমার নেই, উপলব্ধি তো উপলব্ধিই হয়। আর জীবন জীবনই।
তখন আমাদের গণসঙ্গীত পর্ব শেষ হয়নি, যখন হাতে ক্যাসেটটা এসেছিল। তোমাকে চাই। বারাসাত তখনও নেহাতই মফস্বল, যেখানে তখন সিনেমা হলগুলো ছাড়া কোনো গানের প্রোগ্রামের জায়গা নেই। মানে যেগুলো আছে, সেগুলো ধর্তব্য নয়। বাস্তবিকই পায়রা ওড়ানো জায়গা সে সব, তখন আমাদের দৌড় শুরু হলো। সুমনের পিছু পিছু । আমাদের উচ্চফলনশীল উচ্চকন্ঠী রাজ-দাদারা কখনও আমাদের ল্যাল্যাপনা দেখে কখনও ক্ষীণ হাস্য করেন, কখনো হুতাশ করেন, “এর চেয়ে কত ভাল ছিল...” আমরা তাঁদের হতাশা প্রকাশ শেষ হওয়ার আগেই গেয়ে দিতাম, ‘কত কবি মরে গেল চুপি চুপি একা একা, সব আমাদের জন্যে’..
তখনো আমাদের ওই ‘পালাবার পথে ধুলো ওড়াবার দঙ্গলে আমিও ছিলাম একজন, আজ ভীরুতার মুখে লাথি মেরে লাল ঝান্ডা ওঠাই’ পর্বটা চলছে। আর ওদিকে তখন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে সুমন রাজ। যে রাজত্ব নিষ্কণ্টক নয়, কিন্তু নিশ্চিত। যাঁর রাজত্বে আশ্রয় নিচ্ছেন অঞ্জন দত্ত, কাজী কামাল নাসের, মৌসুমী ভৌমিকরা। এবং আরও অনেকে যাঁরা শেষ পর্যন্ত ‘প্রভৃতি’র তালিকায় জায়গা করেছেন। আর সুমন রাজত্বের কিছু প্রজা, প্রথমেই ‘হাম মার দম’ ভেবে নিজেদের আলাদা করে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়েছিলেন, যেমন নচিকেতা চক্রবর্তী। পারেন নি। তেমন চাননি, তাই আজও চাঁদ হয়ে আলো ছড়িয়ে চলেছেন শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা মিত্ররা। সুমন আসলে বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। ফলে স্রোত এসেছিল দুর্নিবার. স্বভাবতই ঢুকে পড়েছিল বেনো জল। একদম যে-কেউ রা, গলায় গীটার ঝুলিয়ে নেমে পড়ছিলেন, আর সুমন তাঁদের পিঠ চাপড়েও দিচ্ছিলেন, কেননা তিনি একটা আন্দোলন চেয়েছিলেন, বদ্ধ জলায় একটা হেলদোল চাইছিলেন। সুমন, তাঁর অবিশ্বাস্য দক্ষতায় লিখতে থাকলেন, গাইতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন। সুমনের গান, বাড়ি বসে শোনা আর লাইভ কনসার্ট শোনা দুটো পৃথক অভিজ্ঞতা, যার স্বাদ তখনো পায়নি আপামর বাঙালি।
মঞ্চের এক পাশে সিন্থেসাইজার, আর এক পাশে গিটার, জিন্স পরা লোকটা ঢুকছে আর হল ফেটে পড়ছে হাততালিতে, এতে, পামর বাঙালি, যারাই সংখ্যায় বেশি, তাদের কোষ্ঠ কঠিন হল, তাদের মুখ ভ্যাটকালো, আর তাদেরই ছেলে-মেয়ে, ভাইপো-ভাইঝিরা দশ বছর যেতে না যেতেই চন্দ্রবিন্দুতে হল্লা মাচালো, লাজুক- লাজুক মুখে মা-টিও সঙ্গে গেলেন, ভুলেই গিয়েছিলেন স্বামীর সেই তর্জন, ওসব সুমন-ফুমন অনেক দেকিচি? সে যাক, সুমনের গানটা বাংলার ভূমিতে হতে পারল বলে ধুতি-পাঞ্জাবি-হারমোনিয়ামের বাইরে একটা অন্য গানের ভুবন তৈরী হলো, একটা অন্য শোনার কান তৈরী হল, যেটাকেও একই সঙ্গে লালন করছিলেন সুমন, নিজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলে চলেছিলেন হিমাংশু দত্তর কথা, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কথা, বাংলা গানের বহু সুরকার এবং লিরিসিস্টদের নাম আজ আম বাঙালি জানে স্রেফ সুমনের দৌলতে। এই সবের মধ্যে সুমন তাঁর প্রোগ্রামে নিজের সিগনেচার রেখে চলেছেন, ঔদ্ধত্যের, বেপরোয়াত্বের, যা কখনো কখনো মাত্রাহীন হযেছে, নিন্দিতও হয়েছে। সুমন বিয়ে ভেঙেছেন, ধর্ম বদলেছেন, ভিনধর্মী শিল্পীকে বিয়ে করেছেন। কলকাতা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সুমন ঠিক, সুমন ভুল, এটা সুমনের ব্যক্তিগত, ব্যক্তিগত কি সামাজিক, সামাজিক কি মূর্খ, মূর্খ কি বড়, ইত্যাদি শতধায়, সহস্রধারায়। সুমন গাইছেন, সুমনের রাজনৈতিক মত থাকছে, বদলাচ্ছে, ভাঙছে, পুনর্গঠিত হচ্ছে, কিন্তু রাজনীতিহীন হচ্ছেন না তিনি। সুমনকে লোকে সেলাম ঠুকছে, জুতো দেখাচ্ছে, প্রণাম করছে, খিস্তি করছে, কিন্তু করছে। সুমন অবধারিত ভাবেই বেঁচে থাকছেন। যেমনটা সুমন তাঁর প্রোগ্রামগুলোতে; আম বাঙালি জেনে বা না-জেনে, বুঝে বা না-বুঝে ঠিক তেমনটা হয়ে যাচ্ছে। সুমনের আরও উত্তরসূরী হচ্ছে, পল্লব-শিলাজিতরা গাইছে। শিলাজিত বাংলা গানে সাউন্ডস্কেপের নয়া দিগন্ত খুলে দিল। ব্যান্ড হল। অনেক ব্যান্ড হল। রক এল। কেউ কেউ সুমনকে এড়িয়ে মনিদা মনিদা বলে গলা ভাঙল। ভাবল না যে, সুমন না থাকলে মহীনের ঘোড়াগুলি পুনরাবিষ্কৃত হতই না। ইতিহাসক্রমের বিমুখতা বাস্তবিকই বাঙালির বড় প্রিয়।
২০ বছরে কিছু পাল্টালো কি? সেদিন একটা বড় কাগজ জনমত নির্ধারণের চেষ্টা করত, আজ করে অনেকগুলো গণমাধ্যম। জনতা কি পুরোটাই এর পিছনে দৌড়ে বেড়ায়? না। একটুও কি প্রভাবিত হয় না? হয় নিশ্চয়। তবু, বয়স আমার, তোমার এবং সবার মুখের রেখায় ত্রিকোণমিতি শেখায়, এস, আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ত্রিকোণগুলোর কৌণিক পরিমাপগুলো করার চেষ্টা করি, পুরোটা সম্ভব হবে না জেনেও।
চিনি আর বোঝার চেষ্টা করি মম চিত্তে শিলাদিত্যের স্রষ্টাকে.. হ্যাঁ, ওটাই আমার এখনকার রিং টোন। আজ বিশে আগস্ট, দুহাজার বারো। আঠারো বছর আগে, সুমনের জন্যে কোমরে রিভলভার তুলেছিলাম, ব্যস্ত মফস্বলের দিন দুপুরে, ওরা সুমনকে মারবে বলেছিলো, আমাদের অর্গানাইজ করা সুমনের প্রোগ্রামে। ছ ঘরা। দেশি। খুব রিস্কি। সুমন জানতেন না। আজও জানেন না।
তখনো আমাদের স্বপ্ন দেখার কাল শেষ হয়নি, যদিও জেনে যাচ্ছি যে এ রাজনীতির গোলকধাঁধা থেকে বিপ্লব বেরবে না। কিন্তু তবু স্বপ্ন দেখছি, কেন না জেনে গেছি, ‘অন্ধকারের তবু আছে সীমানা’।
তারপর কালস্রোতে ভেসে গেছে যৌবন-জীবনের অনেকটা, বেশ কিছু ধন এবং অনেক মান ও । তবু স্বপ্ন দেখি। এই আকালেও। দেখি, কাগজ দিয়ে তৈরী ফুলে, পরাগরেণু আপনি জাগে..
আজও বেঁচে আছি। খুব রিস্কি এই বেঁচেবর্তে থাকা।
রবীন্দ্রনাথের পর সুমনের মত লিরিসিস্ট বা সুরকার হয়নি ভাইটি। বোনটিও।
পিরিয়ড।