শংকর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে প্রথম দেখা ভূপালে ১৯৮৫-র জুলাইয়ে, সেদিন জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন আন্দোলনরত গ্যাসপীড়িত কয়েক জন। তাঁর কথা, তাঁর আন্দোলনের কথা শুনেছি অবশ্য আরও কয়েক বছর আগে—দল্লী-রাজহরার ঠিকাদারী লোহা খনিশ্রমিকরা যে স্বাস্থ্য-আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাতে প্রথম যে তিনজন চিকিৎসক যোগ দেন তাঁদের মধ্যে বিনায়ক সেন, আশীষ কুন্ডুর সঙ্গে ছিলেন মেডিকাল কলেজে আমার অগ্রজ পবিত্র গুহ। ১৯৮৩-তে শহীদ হাসপাতাল যখন উদবোধন হল, তাতেও গিয়েছিলেন আমার কিছু বন্ধু। স্বপ্ন দেখতাম শহীদ হাসপাতালের মত কোনও কর্মসূচীতে কাজ করব। শহীদ হাসপাতালেই কাজ করার সুযোগ পেলাম ১৯৮৬-তে। ছিলাম ১৯৯৪ অবধি আট বছর। তার পরেও যেখানে কাজ করেছি চেষ্টা চালিয়েছি শহীদ হাসপাতালের শিক্ষাগুলোকে অনুসরণ করার আমি ও আমার সহকর্মীরা।
এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম শংকরের (শংকর তাঁর আসল নাম নয়, আসল নাম ধীরেশ), বাবা হেরম্ব কুমার, মা কল্যাণী। আসামের নওগাঁও জেলার যমুনামুখ গ্রামে বাবার কর্মস্থলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা, আসামের সুন্দর প্রকৃতি তাঁকে প্রকৃতিপ্রেমী করে তোলে। আর আসানসোলের সাঁকতোরিয়া কয়লাখনি অঞ্চলে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে থেকে মাধ্যমিকের পড়াশুনা, যেখানে খনিশ্রমিকদের জীবন কাছ থেকে দেখে তিনি বুঝতে শেখেন কেমন করে বড়লোক আরও বড়লোক, গরীব আরও গরীব হয়। জলপাইগুড়িতে আই এস সি পড়ার সময় তিনি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন, হয়ে ওঠেন ছাত্র ফেডারেশনের একনিষ্ঠ কর্মী। ১৯৫৯-এর বাংলাজোড়া খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ তাঁকে ভাসিয়ে নেয়। কুশল ছাত্রসংগঠক হিসেবে তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান। রাজনীতিতে মেতে থাকায় আই এস সি-র ফল ভালো হয়নি। তাও পারিবারিক সুপারিশে উত্তরবঙ্গের ইঞ্জিয়ারিং কলেজে তিনি সীট পান। এই অন্যায়কে মেনে নিতে না পেরে তাঁর ঘর ছাড়া।
১৯৬১-তে তিনি পৌঁছলেন নবনির্মিত ইস্পাত শহর ভিলাইয়ে। তখনও ১৮ বছর বয়স হয়নি। কিছু দিন অপেক্ষা করতে হল। তাঁর পর প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণান্তে ইস্পাত কারখানার কোক ওভেন বিভাগে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে যোগদান। কাজ করার পাশাপাশি একদিকে তিনি দুর্গ কলেজে বিজ্ঞানে স্নাতকপাঠ নিতে থাকেন, অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমার পড়াশুনা করতে থাকেন। এই পর্যায়ে একদিকে তাঁকে দেখা যায় ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক রূপে, অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে। কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙ্গনের পথ ধরে তিনি সি পি আই এম, পরে সি পি আই এম এল-এর সংস্পর্শে আসেন। যদিও গণ আন্দোলন গণ সংগঠন বর্জনের প্রশ্নে সি পি আই এম এল-এর পার্টি লাইনের বিরোধিতা করায় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। এই সময়ে কোক ওভেন বিভাগে প্রথম সার্থক শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করে প্রশাসনের বিষ নজরে পড়েন তিনি, পুলিশ তাঁর পিছনে পড়ে।
শুরু হয় ধীরেশের আত্মগোপনকারী জীবনের। কখনও ফেরিওয়ালা, জেলে বা ছাগল-ব্যবসায়ী, কখনও কৃষিশ্রমিক, বাঁধনির্মাণ-শ্রমিক হিসেবে তাঁর দিন কাটতে থাকে। সঙ্গে তিনি শ্রমজীবী মানুষদের অধিকার-অর্জনের আন্দোলনে সংগঠিত করতে থাকেন। অবশেষে তিনি কাজ করতে থাকেন ভিলাই ইস্পাত কারখানার কোয়ার্জাইট খনি দানীটোলায়। এখানে তিনি নাম নেন ‘শংকরলাল ঠাকুর’। বিয়ে করেন সহকর্মী শ্রমিক সিয়ারামের কন্যা আশাকে। আভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থার দিনগুলোতে তাঁর দু’বছর কাটে রায়পুর জেলে মিসা-য় বন্দী হয়ে।
দানীটোলা থেকে কিছু দূরে লোহাখনি শহর দল্লী-রাজহরা। তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড় এলাকার দুর্গ জেলায় অবস্থিত এই শহর দল্লী ও রাজহরা দুই লোহাখনির নামে। এখানকার প্রায় দশ হাজার ঠিকাদারী শ্রমিক খনিতে পাথর ভাঙ্গা আর ট্রাকে পাথর লোড করার কাজ করতেন। অবর্ণনীয় দুর্দশায় তাঁদের দিন কাটত। আই এন টি ইউ সি ও এ আই টি ইউ সি—দুই শ্রমিক ইউনিয়নে তাঁরা বিভক্ত ছিলেন। ১৯৭৭-এ জরুরী অবস্থার অবসানে দুই ইউনিয়ন-সম্পাদিত এক অন্যায় বোনাস-সমঝোতার বিরোধিতা করে তাঁরা ইউনিয়ন দুটি থেকে বেরিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের নেতা খুঁজছেন তাঁরা, অন্য ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের জঙ্গী মেজাজ দেখে কাছে ঘেঁষার সাহস পেল না। নিয়োগী সবে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। শ্রমিকদের এক প্রতিনিধিমন্ডলী নিয়োগীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানাতে দানীটোলা গেলেন। তাঁদের অনুরোধে নিয়োগী দল্লী-রাজহরা এলেন। ১৯৭৭ থেকে আমৃত্যু দল্লী-রাজহরা ছিল শংকর গুহ নিয়োগীর শ্রমিক আন্দোলন-সংক্রান্ত, সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলন-সংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তার পরীক্ষাগার।
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ নামে নতুন ইউনিয়ন গড়ে উঠল। প্রথম লড়াই জয়যুক্ত হল। দ্বিতীয় লড়াই idle wages (শ্রমিককে মালিক কাজ দিতে না পারলে যে বেতন দেওয়া উচিত) ও ঘর মেরামতের জন্য ভাতার দাবীতে। মালিক দাবী মেনে না নিলে শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেন। ধর্মঘট ভাঙ্গতে রাতের অন্ধকারে দু’জীপ পুলিশ আসে। একটি জীপ ইউনিয়ন অফিস থেকে নিয়োগীকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে শ্রমিকরা অন্য জীপের পুলিশদের আটক করে নেতার মুক্তির দাবী জানাতে থাকে। ২রা জুন প্রথম দফায় গুলি চালিয়েও পুলিশরা নিজেদের মুক্ত করতে পারে না। ৩রা জুন আরও বড় পুলিশ বাহিনী আবার গুলি চালায়। এক মহিলা শ্রমিক ও এক বালক সহ এগারো জন শহীদ হন। ধর্মঘট চলতেই থাকে। প্রশাসন বাধ্য হয় নিয়োগীকে মুক্তি দিতে, ঠিকাদার ও ইস্পাত কারখানার কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় শ্রমিকদের দাবী মেনে নিতে।
এবার শুরু নতুন ধারার শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরীর কাজ। এ যাবৎ ট্রেড ইউনিয়ন বলতে লোকে বুঝত শ্রমিকদের আর্থিক দাবী-দাওয়া আদায়ের সংগঠনকে, যা বেতনবৃদ্ধি-বোনাস-ছুটি-চার্জশিটের জবাব ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন করার সংগঠন। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক-জীবনের এক-তৃতীয়াংশ, আট ঘন্টার সংগঠন, যে আট ঘন্টা শ্রমিক কলে-কারখানায় কাটান।
নিয়োগী শ্রমিকদের খন্ড-বিখন্ড মানুষ হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে, যে মানুষ উৎপাদনের কাজ ছাড়াও পরিবারে-সমাজে থাকে—খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা, নিজের অবসর বিনোদন, সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য যাকে ভাবতে হয়, যাকে সম্পর্ক রাখতে হয় সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে। নিয়োগীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন ইউনিয়নের কর্মসূচীতে সামিল হল আর্থিক দাবীর লড়াইয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-পরিবেশ-ইতিহাস চেতনা-নারী মুক্তি-সমাজের অন্যান্য শোষিত অংশের মুক্তি, নিপীড়িত জাতিসত্ত্বার মুক্তির মত বিষয়গুলি।
সুস্বাস্থ্যের জন্য শ্রমিকদের লড়াইয়ের শুরু ১৯৭৭-এই। ইউনিয়ন তৈরী হওয়ার কয়েক মাস পরেই, ১৯৭৭-এর ডিসেম্বরে ইউনিয়নের এক উপাধ্যক্ষা কুসুম বাই স্থানীয় ভিলাই ইস্পাত কারখানার হাসপাতালে প্রসবের সময় ডাক্তার-নার্সদের অবহেলায় প্রাণ হারান। ঠিকাদারী শ্রমিকদের জামা-কাপড় পাহাড়ির লাল ধূলোয় রাঙ্গা, তাঁরা তাঁদের শরীরে হাত লাগাতে ঘৃণা করতেন। অন্য কোথাও হলে হাসপাতালে ভাঙ্গচুর হত, এখানে দশ হাজার শ্রমিক হাসপাতালের সামনে জমায়েত হয়ে শপথ নিলেন—নিজেদের মাতৃভবন গড়ে তোলার যাতে আর কোনও মা-বোনকে সন্তান জন্মের সময় প্রাণ হারাতে না হয়।
দল্লী-রাজহরার শ্রমিকবস্তিগুলোতে পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল না, জঞ্জাল সাফাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৮১-র ১৫ই আগস্ট শ্রমিকরা শুরু করলেন ‘স্বাস্থ্য কে লিয়ে সংঘর্ষ করো’ (স্বাস্থ্যের জন্য সংগ্রাম কর) অভিযান। মনে রাখবেন যখন শ্রমিকরা এই আন্দোলনের পথে পা বাড়াচ্ছেন তখন কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কোনও চিকিৎসক নেই। (প্রথম দফায় চিকিৎসকরা যোগ দেন ১৯৮১-তে।) শ্রমিকরা তাঁদের বস্তির জঞ্জাল খনির লোহাপাথর পরিবহনের এগারোটা ট্রাকে ভরে নিয়ে চললেন মাইন্স-ম্যানেজারের বাড়ীতে, মাইন্স ম্যানেজারকে বলা হল বস্তির জঞ্জাল সাফাইএর ব্যবস্থা না হলে রোজ শ্রমিক-বস্তির জঞ্জাল তাঁর বাড়ীর সামনে ফেলে আসা হবে। কর্তৃপক্ষ জঞ্জাল সাফাইএর ব্যবস্থা করতে বাধ্য হল।
১৯৮১-তেই তিনজন সমাজ-পরিবর্তনকামী বাঙ্গালী তরুণ ডাক্তার যোগ দিলেন স্বাস্থ্য-আন্দোলনে। তাঁরা পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতন করার প্রয়াস চালাতেন, সাথে সাথে ছোটখাট চিকিৎসাও করতেন। শ্রমিকদের মধ্যে উদ্দীপনা এল, প্রায় দু’শ জন শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাস্থ্য-কমিটির স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার জন্য নাম লেখালেন। কমিটির কিছুজন একটি ডিস্পেন্সারী চালানোর দায়িত্ব নিলেন, বাকীরা দায়িত্ব নিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল গড়ে তোলার।
১৯৮২-র ২৬শে জানুয়ারী থেকে ইউনিয়নের গ্যারেজ ঘরে শুরু হল শহীদ ডিস্পেন্সারী, ১৯৮৩-র শহীদ দিবসে ১৯৭৭-এর শহীদদের স্মৃতিতে উদবোধন করা হল শহীদ হাসপাতালের। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের নেতা শ্রমিক শ্রেণী, তার দৃঢ. মিত্র কৃষক। দল্লী রাজহরার খনিশ্রমিক এলাকার অসংগঠিত শ্রমিক, গ্রামের গরীব কৃষকদের উপহার দিলেন এই হাসপাতাল, হাসপাতালের উদবোধন করলেন এলাকার সবচেয়ে বয়স্ক শ্রমিক ও সবচেয়ে বয়স্ক কৃষক।
দল্লী-রাজহরার শ্রমিকরা যখন স্বাস্থ্যের জন্য সংগ্রাম শুরু করেছেন, তখন দেশের আন্যান্য প্রান্তে চলছিল ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার, যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার পক্ষে আন্দোলন, স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবীতে আন্দোলন। যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসাপ্রণালীর বড় মাপের প্রয়োগের প্রথম পরীক্ষাগার হয়ে উঠল শহীদ হাসপাতাল।
পাশাপাশি মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য, রোগের আর্থসামাজিক কারণগুলি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য, মানুষের হাতে রোগ-প্রতিরোধ ও রোগ-চিকিৎসার সাধারণ প্রযুক্তিগুলি তুলে দেওয়ার জন্য নানান প্রয়াস নেওয়া হতে থাকল।
আমি যখন কাজে যোগ দিই তখন ছিল ১৫ বেডের একতলা হাসপাতাল, ১৯৮৮-তে দোতলা তৈরী হল, ১৯৯১-তে দোতলার দুটি ওয়ার্ড চালু হওয়ার পর বেডের সংখ্যা বেড়ে হল ৪৫। আধুনিক প্যাথোলজি ল্যাবরেটরী গড়ে তোলা হল, এক্স-রে মেশিন এল, আধুনিক অপারেশন থিয়েটার গড়ে তোলা হল। সব কিছুই কিন্তু হল বাইরের কোন অনুদান না নিয়ে, নিয়োগীর অনুপ্রেরণায় শ্রমিকরা দেখতে ও দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁদের ক্ষমতা কতটা। একেকটা করে অর্থনৈতিক আন্দোলনে জয়ের পর শ্রমিকরা চাঁদা দিতে থাকেন হাসপাতালের একেকটি কাজের জন্য।
শংকর গুহ নিয়োগী তাঁর আন্দোলনে এক নতুন ধারণার অবতারণা করেন—‘সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতি’, তাঁর সংগঠনের স্লোগান ছিল ‘নির্মাণকে লিয়ে সংঘর্ষ, সংঘর্ষকে লিয়ে নির্মাণ’। নির্মাণের জন্য সংগ্রাম—শোষণমুক্ত সাম্যময় নতুন সমাজের জন্য সংগ্রাম। সংগ্রামের জন্য নির্মাণ—এই সংগ্রাম চলাকালীন ছোট ছোট নির্মাণ-কাজের মধ্যে দিয়ে নতুন সমাজের স্বপ্নের একেকটি টুকরোকে সাকার করে তোলা, যা দেখে নতুন নতুন মানুষ ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামে যুক্ত হতে অনুপ্রেরণা পান। এই ধারণা প্রয়োগের অন্যতম স্থান ছিল শহীদ হাসপাতাল।
সমাজে শ্রেণীবিভাজনের প্রতিফলন ঘটে যে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে, সেখানে সবার ওপরে থাকেন কোন প্রশাসক, তাঁর নীচে চিকিৎসকরা, তারপর যথাক্রমে সেবিকারা, অন্যান্য কর্মীরা, সবার শেষে সাফাই কর্মীরা। শহীদ হাসপাতালে এরকম কোন hierarchy ছিল না। সেখানে সমস্ত কর্মীই প্রশাসক, দুসপ্তাহ ছাড়া সপ্তাহের এক নির্দিষ্ট দিনে সবাই মিলে বসে তাঁরা নীতিগত বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতেন, সেখানে বোঝাই যাবে না কে চিকিৎসক আর কে সাফাই কর্মী। পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের কাজের জায়গায় আমরা এই ধারণার প্রয়োগ করে চলেছি। আমাদের স্বপ্নের সমাজে ডাক্তারের সঙ্গে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পর্ক, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে রোগীদের সম্পর্ক কেমন হবে তার নমুনা দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা আমাদের কর্মসূচীতে। অনুপ্রাণিত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ডাক্তাররা আমাদের কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে কেমন করে আন্দোলনের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা যায় তাও দেখিয়েছিল শহীদ হাসপাতাল ও শংকর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বাধীন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। হাসপাতালের প্রচার আন্দোলনে এক বড় জায়গা নিয়েছিল ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। ডায়রিয়ার কারণ হিসেবে দূষিত জলের ভূমিকা, ডায়রিয়ার প্রতিরোধে শুদ্ধ জলের প্রয়োজনীয়্তার প্রচার এলাকার মানুষকে সচেতন করে, সচেতন মানুষদের নিয়ে পানীয় জলে দাবীতে আন্দোলনে নামে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ ও ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। রাজ্য প্রশাসন ও ভিলাই ইস্পাত কারখানা ১৯৮৯-এ দল্লী-রাজহরা ও তার আশে-পাশের গ্রামগুলিতে ১৭৯টি নলকূপ বসাতে বাধ্য হয়।
শহীদ হাসপাতালের পরোক্ষ চাপে ডোন্ডী-লোহারা বিধানসভা ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। দল্লী-রাজহরাস্থিত ভিলাই ইস্পাত কারখানার বড় হাসপাতালে নানান ধরনের বিশেষজ্ঞ থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা হত না সেখানে, রোগীদের যেতে হত ৮৪ কিলোমিটার দূরের দুর্গ জেলা হাসপাতালে বা ৯১ কিলোমিটার দূরের ভিলাই ইস্পাত কারখানার প্রধান হাসপাতালে। শহীদ হাসপাতালের জেনেরাল ফিজিশিয়ানরা শল্য-চিকিৎসার মত বিশেষজ্ঞ পরিষেবা দিতে থাকায় তার উপর চাপ তৈরী হয়, সে হাসপাতাল বিশেষজ্ঞ পরিষেবা দিতে বাধ্য হয়।
এছাড়া শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য আন্দোলনগুলির পাশে দাঁড়ানো তো আছেই। লাল-সবুজ (ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার পতাকার রং শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর প্রতীক) পরিবারের কোন সংগঠন আন্দোলনে নামলে সে সংগঠনের সমস্ত সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সমস্ত চিকিৎসার দায়িত্ব নিত শহীদ হাসপাতাল।
শহীদ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি বলতে পারি কেবল পেশাদার হিসেবে আমরা সেখানে কাজ করিনি, আমরা ছিলাম এক বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের কর্মীও, সেভাবেই আমাদের গড়ে তুলেছিলেন নিয়োগী। তিনি আমাদের বুঝিয়েছিলেন সমাজ পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবীদের কাজ মেহনতী মানুষদের নেতৃত্ব দেওয়া নয়, আমাদের কাজ সমাজবিজ্ঞানের কথাগুলি তাঁদের কাজে পৌঁছে দেওয়া, যে বিজ্ঞানে আমরা প্রশিক্ষিত (আমাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান) সেই বিজ্ঞানকে জনবোধ্য করে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া।
বামপন্থী অন্যান্য যেকোন সংগঠন তাঁর ডাক্তারদের ব্যবহার করে অন্যভাবে—ডাক্তার ভাল রোজগার করবেন সংগঠনকে মোটা লেভি দেবেন, সংগঠনের হয়ে মাঝে-মধ্যে চিকিৎসা শিবির করবেন, সংগঠনের সদস্যদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবেন—এটুকুই। স্বাস্থ্য যে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মত আন্দোলনের বিষয়, সেই আন্দোলনে যে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা সংগঠকের ভূমিকা পালন করতে পারেন তা তাঁদের মাথায় থাকে না। এঁদের চেয়ে ব্যতিক্রমী ছিলেন শংকর গুহ নিয়োগী।
তাই ভিলাইএর মিল মালিকদের নিযুক্ত হত্যাকারী গুলি করে তাঁকে হত্যা করার ২১ বছর পরেও তিনি হারিয়ে যান না। ১৯৮৩-তে শহীদ হাসপাতালের উদবোধনে ইন্দো-জাপান স্টীলের শ্রমিকরা যে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প গড়ে তুলেছিলেন তা বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালেরপ নিয়ে কম খরচে শল্য চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৯৫-এ কানোরিয়া জুট মিলের শ্রমিকরা ছত্তিশগড়ের স্বাস্থ্য আন্দোলনের অনুসরণে যে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র আরম্ভ করেন তা কম খরচে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার মডেল কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক পরিচালনার মডেল হিসেবে গড়ে ওঠে। শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ একই ধরনের স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালান হাওড়ার বাউড়িয়া ও বাইনান, বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়, সুন্দরবনের জেমসপুরে; স্বাস্থ্য সচেতনতার কর্মসূচী চালান, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাহিনী গড়ে তোলেন পশ্চিমবঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে, মেহনতী মানুষের ন্যায্য আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। একই ধারায় গড়ে ওঠে উত্তর ২৪ পরগনায় সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল ও জনসেবা ক্লিনিক, বাঁকুড়ায় আমাদের হাসপাতাল, পুরুলিয়ায় ভালোপাহাড় স্বাস্থ্য কেন্দ্র…। বাণিজ্যিক নয়, মানবিক স্বাস্থ্য পরিষেবার খোঁজে প্রকাশিত হয় ‘স্বাস্থ্যের বৃত্তে’। আর এসবের মধ্যে মৃত্যুতেও অমর হয়ে থাকেন শংকর গুহ নিয়োগী।
('স্বাস্থ্যের বৃত্তে' পত্রিকার অক্টোবর-নভেম্বর, ২০১২ সংখ্যায় আজ প্রকাশিত)