২০১৪'র ২৩শে অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছিলেন যে সমস্ত সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিকিৎসা ও ওষুধ-পত্র বিনামূল্যে পাওয়া যাবে।
আর পয়লা জুলাই ২০১৯এ চিকিৎসক দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করলেন সরকারি হাসপাতালে নার্সিং হোম এর মত পরিষেবা পাওয়া যাবে এবার।
এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ড এ ১৬টি বেড ছিল, তাতে নেতা-মন্ত্রীরা ভর্তি হতেন, অন্যরা পয়সা দিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতেন। উডবার্ন ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ করা হচ্ছে। সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা তবে নয়াদিল্লির এমস এর পেয়িং ওয়ার্ড এর মত।
এখানে চিকিৎসা পাবেন তারাই যাদের ব্যয় ভার বহন করার সামর্থ্য রয়েছে।
মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছেন নির্দিষ্ট কিছু মেডিকেল কলেজ এবং যেটা হাসপাতালগুলিতে একই রকম ব্যবস্থা করা হবে। যেখানে সামর্থ্যবান রোগীরা ভর্তি হবেন। এ থেকে আয় এর ৭৫ শতাংশ হাসপাতালে র উন্নয়নের জন্য খরচ করা হবে আর ২৫ শতাংশ চিকিৎসক ও অন্যান্য চিকিৎসা কর্মীদের উৎসাহ ভাতা হিসেবে দেওয়া হবে।
অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলোতে পাশাপাশি দু'রকমের চিকিৎসা চলবে গরিব মানুষদের জন্য বিনামূল্যে আর সচ্ছল মানুষদের জন্য পয়সার বিনিময়ে। এমনটা কি বাঞ্ছনীয়?
ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে ১৯৪৮এ সরকার সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব নেয়, শুরু হয় ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা।
সে সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ধনীদের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন সরকার গরিবদের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব নিক, ধনীরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিজেরাই নিতে পারবে, নিজেদের জন্য হাসপাতাল নিজেরাই চালাতে পারবে। সেই প্রস্তাবে রাজি হননি ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী এনুরিন বিভান। তার বক্তব্য ছিল পাশাপাশি দুটো ব্যবস্থা চললে প্রভাবশালী ধনীদের ব্যবস্থা গরিবদের ব্যবস্থা থেকে শাঁস শুষে নেবে।
কি রকম বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে পশ্চিমবঙ্গে আজ? ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাফি করাতে বললেন, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে হবে, কিন্তু হয়তো তিন মাস পরে। অপারেশনে কোন ইমপ্ল্যান্ট লাগবে, সেই ইমপ্ল্যান্ট ডাক্তার বাইরে থেকে কেনাতে পারবেন না, এক মাস বাদে ইমপ্ল্যান্ট সরবরাহ হলে অপারেশন হবে। তবু বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছেন অনেক গরিব মানুষই।
আমার মূল ক্লিনিক হাওড়া জেলার উলুবেরিয়া মহকুমায়, রোগীরা প্রায় সবাই শ্রমজীবী মানুষ।১৯৯৫ থেকে ২০১৪ অব্দি আমার মাত্র দুজন রোগী হার্টের অপারেশন করাতে পেরেছিলেন, বাকিদের ওষুধ পত্র দিয়ে চালিয়ে যেতে হয়েছে। ২০১৪র পরে যাদের প্রয়োজন তাঁদের মেডিকেল কলেজে পাঠালে এনজিওপ্লাস্টি হয়েছে, জনা দুয়েকের বাইপাস অপারেশনও।
২০০৮ থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা আছে। প্রথমে এই বীমায় তালিকাভুক্ত থাকতো বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম গুলো। পরে সরকারি হাসপাতাল ও তালিকাভুক্ত হলো। আর এস বি ওয়াই-এর কার্ড থেকে অর্থ কাটা হতে থাকলো বিনামূল্যের সরকারি হাসপাতালেও। বলতে পারেন আর এস বি ওয়াই-এর টাকা তো সরকার দেয়। হ্যাঁ ঠিকই, সরকার দেয় আমাদের করের টাকা, বীমা কোম্পানির ঘর ঘুরিয়ে না এসে, সে টাকা সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নত করতে ব্যবহার করলেই হয়।
২০১৭ থেকে রাজ্যের নিজস্ব স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প স্বাস্থ্য সাথী। আর এস বি ওয়াই-এ অর্থের পরিমাণ ছিল পরিবার পিছু বছরে ৩০০০০, স্বাস্থ্যসাথী তে বছরে ৫ লাখ। বেসরকারি হাসপাতালে পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালেও স্বাস্থ্য সাথী চলছে। চিকিৎসা করে বেসরকারি বীমা কোম্পানির কাছ থেকে টাকা রোজগার করছে সরকারি হাসপাতাল ও।
এবার বিনামূল্যের সরকারি হাসপাতালে পাশাপাশি চলবে পয়সা দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা। এমনটা সবার জন্য স্বাস্থ্যের ধারনার পরিপন্থী নয় কি?
সবার জন্য স্বাস্থ্য বা ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার এর মানে হলো কোন জন সমুদয় তার প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাবেন তার প্রয়োজন অনুযায়ী, তার খরচ করার ক্ষমতার ওপর পাওয়া নির্ভর করবে না। সবাই সমমানের পরিষেবা পাবেন। কোন ভেদ ভাব থাকবে না। সমস্ত অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেবে দেশের সরকার।
পাশাপাশি নার্সিংহোম এর মত চিকিৎসা চললে সবাই সমমানের চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন কি?
চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীরা সরকারি হাসপাতালের ভেতরকার নার্সিংহোমে কাজ করে যদি উৎসাহ ভাতা পান, তাহলে সেই নার্সিংহোমে ভালো করে কাজ করার ব্যাপারেই তারা উৎসাহিত হবেন নাকি?
বাংলার সরকার যত ই জনপ্রিয়তার মোড়কে পরিষেবায় পরিবর্তন আনুক না কেন, আসলে সে পরিবর্তনগুলো ধনীদের ই স্বার্থে।
১। হাসপাতলে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলা হল। যে দোকান চালাতে গেলে বড় ব্যবসায়ী হতেই হবে। তাদের হাতে তুলে দেয়া হলো সরকারি হাসপাতালের রোগীদের খদ্দের হিসেবে। রোগীরা বাইরে যে দামে ওষুধ কিনতেন তার চেয়ে অনেকটা কম দামে ওষুধ কিনতে পারলেন। একেক জন রোগীর কাছ থেকে দোকানী কম লাভ রাখল, কিন্তু কয়েকশো কয়েক হাজার খদ্দের পেয়ে লাভ হলো অনেক বেশি। সরকার কি ওষুধ দিতে পারত না, শ্রীনাথ রেড্ডি র হাই লেভেল এক্সপার্ট গ্রুপ অন ইউনিভার্সাল হেলথ কভেরেজ হিসেব করে ২০১১ তে ই দেখিয়েছিল জিডিপির মাত্র ০.৫ পারসেন্ট খরচ করলেই সরকার সমস্ত নাগরিককে তার প্রয়োজন মত অত্যাবশ্যক ওষুধ সরবরাহ করতে পারে বিনামূল্যে।
২। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ পশ্চিমবঙ্গে আনার কারিগর ছিল বামফ্রন্ট সরকার। সরকার হাসপাতলে জায়গা দিত, রোগীরূপী খদ্দের দিত, কিন্তু পুঁজি লাগাতো ব্যবসায়ীরা। তৃণমূল সরকার কি করছে? সরকার নিজের বিভিন্ন ফান্ডের টাকা থেকে মেশিন কিনছে--সিটি স্ক্যান, এম আর আই, ডিজিটাল এক্সরে, ডায়ালিসিসের যন্ত্রপাতি। আর চালিয়ে লাভ করার সুযোগ দিচ্ছে ব্যবসায়ীকে, ব্যবসায়ী কে আর পুঁজি লাগাতে হচ্ছে না, কর্মী নিয়োগ করলেই হল। সরকারি হাসপাতালের রোগীর বিনামূল্যে সিটি স্ক্যান, এম আর আই, ডিজিটাল এক্সরে বা ডায়ালিসিস হচ্ছে সরকারের পয়সায় কেনা মেশিনে। আর পরীক্ষা বা চিকিৎসা বাবদ সরকার ব্যবসায়ীকে খরচ ধরে দিচ্ছে। এমন টা বোধহয় বামফ্রন্টের ও মাথায় আসেনি।
৩। রাজ্যে ৪৩ টা সাদা নীল বাড়ি বানিয়েছে রাজ্য সরকার- সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। সুপার স্পেশালিটি মানে নিউরোলজি, কার্ডিওলজি, এন্ডোক্রিনলজি, নেফ্রলজি, নিউরো সার্জারি, কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি, ইউরো সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি, ইত্যাদি। হাসপাতালগুলোতে স্পেশালিটিই নেই ঠিকঠাক, তো সুপার স্পেশালিটি!! পাশের স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা মহকুমা হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালে র কর্মীদের তুলে কাজ চালানো হচ্ছে এই সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলোতে। ৪৩ টার মধ্যে সবচেয়ে ভালো চলে যে হাসপাতাল টা সেই সালবনি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল কে সরকার তুলে দিচ্ছিল জিন্দাল গোষ্ঠীর হাতে। ডাক্তারদের যুক্ত মঞ্চ এবং স্থানীয় মানুষ এর বিরোধিতায় হস্তান্তর এখন স্তিমিত।
২০১৯ এর চিকিৎসক দিবস নতুন চমক আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর। এই প্রয়াস যে জনমুখী হবে না তা শুরুতেই বলা যায়। আর কি কি উদ্দেশ্য এই প্রকল্পের পেছনে তা হয়তো ক্রমশ প্রকাশ্য।