
পুণ্যব্রত গুণ লেখকের গ্রাহক হোন
১১ ই জুন থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা ধর্মঘটে। ১২ ই জুন সারা রাজ্যে সিনিয়র ডাক্তার রা সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের আউটডোর এবং প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রেখেছেন ১২ ঘন্টার জন্য। ১৪ ই জুন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ থেকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অবধি পথ চলেছেন প্রায় ১০০০০ সিনিয়র ডাক্তার শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ। ওই দিনই ডাক্তাররা হরতাল করেছেন নয়াদিল্লি এ আই আই এম এস এ, চন্ডিগড় এ পি জি আই তে। বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে মহারাষ্ট্রে বিহারে ত্রিপুরায় এমনকি পাকিস্তান ও নেপালে। আগামীকাল ১৭ ই জুন সকাল ছয়টা থেকে থেকে ১৮ ই জুন সকাল ছয়টা অবধি সারাদেশে ডাক্তারদের জরুরী পরিষেবা ছাড়া সমস্ত রকম কাজ বন্ধের ডাক দিয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ডাক্তারদের সংগঠন আই এম এ।
এত কিছুর দরকার ছিল না। ১০ তারিখ রাতে ৮৫ বছর বয়স্ক ১ স্ট্রোকের রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দুই লরি ভরে প্রায় ২০০ লোক হামলা করে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর। দুজন জুনিয়র ডাক্তার আহত হন, ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায় এবং ডাক্তার যশ টেকওয়ানি। জুনিয়ার ডাক্তাররা কাজ বন্ধ করে দেন, ইমারজেন্সির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন, তাদের দাবি মুখ্যমন্ত্রী আসুন এসে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিন, ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা্র প্রতিশ্রুতি দিন।
এগিয়ে এলেন সিনিয়র ডাক্তার রা। হিংসার ঘটনা এই তো প্রথম নয়। ২০১৭ ফেব্রুয়ারীতে টাউনহল খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট কে তুলোধোনা করার পর রাজ্যে ১ নতুন ক্লিনিক্যাল এস্তব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট চালু হয়েছিল। বলা হয়েছিল বেসরকারি হাসপাতাল গুলি র রোগী শোষণ বন্ধ করার জন্য, সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নাকি এই আইন। কিন্তু আইনের বলে যে রেগুলেটরি কমিশন তৈরি হলো তার শীর্ষে রইলেন বেসরকারি হাসপাতালে র ডাক্তাররা। আর বেসরকারি হাসপাতাল কে নিয়ন্ত্রণ করার বদলে কমিশন ভিক্টিমাইজ করতে লাগলো ব্যক্তি ডাক্তারদের। পাশাপাশি ডাক্তার ও চিকিৎসা কর্মীদের ওপর আক্রমণের ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ডাক্তারদের যুক্ত মঞ্চ জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টর স পরিসংখ্যান বলে গত আড়াই বছরে হিংসার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২৩৫ টি। এর মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে চকচকে নীল সাদা রং হয়েছে, ভেতরে যথেষ্ট সংখ্যায় ডাক্তার নেই, চিকিৎসা কর্মী নেই, যন্ত্রপাতি নেই। সরকারের প্রচার আছে সরকারি হাসপাতাল এ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায়। পরিকাঠামোর অভাবে মানুষ যখন চিকিৎসা পান না স্বভাবতই তারা ক্ষুব্ধ হন। ক্ষোভের কারণ সরকার কিন্তু সরকারকে তো হাতের সামনে পাওয়া যায় না। হাতের সামনে যাদের পাওয়া যায় সেই ডাক্তার নার্স আর চিকিৎসা কর্মীদের ওপর ক্ষোভ উগরে দেন তারা। হিংসার ঘটনা গুলো বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর পরিজনের ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে হামলা চালায় শাসকদলের আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীরা। আলিপুরদুয়ার এবং কলকাতার দুটি ঘটনায় দেখা গেছে পুলিশ অফিসার ডাক্তার কে আক্রমণ করছেন। ২০০৯ থেকে এই ধরনের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাজ্যে একটা আইন আছে। অথচ ২৩৫ এর মধ্যে মাত্র ৫ টি তে অপরাধী কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাও জামিনযোগ্য ধারায় মামলা করায় তারা ছাড়া পেয়ে যায়। সিএমআরআই হাসপাতালে ডাক্তার পেটানো য় অভিযুক্ত যাদবপুর থানার ওসি পুলক দত্তের বিরুদ্ধে এফ আই আর ই দায়ের করা যায়নি। অন্য রাজ্য থেকে আসা প্রশিক্ষণার্থী ডাক্তার কে পুলিশের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ভয় দেখানো হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী এলেন না। তিনি গেলেন নীলরতন সরকার হাসপাতালের এক কিলোমিটারের মধ্যেই বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আর বাইপাসের ধারে আইটিসি র হোটেল উদ্বোধন করতে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে হাসপাতলে এলেন দুই প্রতিমন্ত্রী। আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তাররা সন্তুষ্ট হল না, কেননা মুখ্যমন্ত্রী তো কেবল মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও।
নীলরতন সরকারের জুনিয়র ডাক্তারদের সমর্থনে কাজ বন্ধ করলেন বাংলার সমস্ত মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডাক্তাররা। তবু সরকারের টনক নড়লো না।
সিনিয়র ডাক্তারদের রাজ্যব্যাপী আউটডোর ধর্মঘটে ও মুখ্যমন্ত্রীর টনক নড়লো না। ১৩ তারিখ এন আর এস হাসপাতালে না গিয়ে তিনি বাড়ি থেকে নবান্ন যাওয়ার পথে গেলেন এসএসকেএম-এ। জুনিয়র ডাক্তারদের ভয় দেখালেন-কাজে যোগ না দিলে ইন্টার্নশিপ ইনকমপ্লিট থেকে যাবে, চার ঘন্টার মধ্যে কাজে যোগ না দিলে হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে, পরিষেবা চালু রাখার জন্য প্রয়োগ করা হবে এসেনশিয়াল সার্ভিসেস মেনটেনেন্স অ্যাক্ট বা এসমা। তিনি বললেন বহিরাগতরা আন্দোলন করছে। ডাক্তাররা সাম্প্রদায়িক, রোগীর পদবি দেখে তারা চিকিৎসা করে।
মুখ্যমন্ত্রী ভুলে গেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্রদের সংগ্রামের ইতিহাসের কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বাধীনতার পর নানা গণআন্দোলনে, আশির দশকের অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের ঐতিহ্য যাদের, তাদের কি এসমার ভয় দেখিয়ে বিরত করা যায়!?
রাজ্যে ডাক্তারি পাঠক্রমে ভর্তির জন্য এখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেই, সারাদেশে অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অন্য রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রী বাংলায় আসতে পারেন, বাংলার ছাত্র ছাত্রী অন্য রাজ্যে পড়তে যেতে পারেন। আর দেশে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার অধিকার তো আমাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।
ডাক্তারি পাশ করার পর পেশার শুরুতে ডাক্তারদের হিপোক্রেটিক ওথ নিতে হয়। জাতি ধর্ম বর্ন শ্রেণি নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে সমান চিকিৎসা দেওয়ার শপথ।
মুখ্যমন্ত্রীর এসএসকেএম ভ্রমণের ফল ফলল অবিলম্বে। আন্দোলনরত ডাক্তাররা ইমারজেন্সি ছেড়ে একাডেমিক বিল্ডিং এর ঢুকলেন, সাধারণ সভা করলেন, বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করলেন একাডেমিক বিল্ডিং এর সামনে। বিক্ষোভে এবার যোগ দিলেন বিভিন্ন বিভাগের প্রধানসহ শিক্ষকেরা, যোগ দিলেন কর্তব্যরত নার্স এবং নার্সিং ছাত্রীরা। অন্যান্য কলেজেও আন্দোলন তীব্রতর হলো। নতুন দাবি ডাক্তারি পেশা কে অপমান করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী কে ক্ষমা চাইতে হবে।
১৩ তারিখ রাতে পদত্যাগপত্র পেশ করলেন এন আর এস মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল। তারপর পদত্যাগের জোয়ার নামল, এসএসকেএম, মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, আর জি কর, নর্থ বেঙ্গল, মালদা, মুর্শিদাবাদ।।।
আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে আছি এই বার্তা দিতে সিনিয়র ডাক্তারদের যুক্ত মঞ্চ ১৪ তারিখ সকাল ১১ টা থেকে এন আর এস এ অবস্থানের ডাক দিয়েছিল, বিকেল সাড়ে চারটে মিছিলে র।১৯৮৩র অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের আন্দোলনের সময় আমি সদ্য ইন্টার্ন। তারপর অনেক গণ আন্দোলন দেখেছি, কিছুতে অংশ নিয়েছি। ২০০৭ এর নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতার মিছিলের সঙ্গে তুলনীয় ১৪ ই জুন এর মিছিল। মিছিলের শুরু যখন ন্যাশনালে পৌঁছে গেছে শেষ তখনো এন আর এস থেকে বেরোতে পারেনি। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী মানবাধিকার কর্মী সাধারণ মানুষ দলে দলে যোগ দিয়েছেন সিনিয়র ডাক্তার জুনিয়র ডাক্তারদের এই মিছিলে।
সেদিন বিকেলে নতুন উদ্যোগ শুরু হল সরকারের তরফে। ৫ জন ডাক্তার যারা আন্দোলনের মঞ্চে আসেন নি মিছিলে পথ হাঁটেননি তারা নবান্নে গেলেন মধ্যস্থতার জন্য। বার্তা পাঠানো হলো মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের ৪ জন প্রতিনিধির সঙ্গে বসবেন। এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এন আর এস এর জুনিয়া্র ডাক্তাররা। তাদের পক্ষে শেষ বার্তা সমস্যার সমাধান করতে তারা রাজি আছে কিন্তু তারা নবান্নে যাবে না। মুখ্যমন্ত্রী যদি এন আর এস এ আসতে রাজি না হন তাহলে সমঝোতা বৈঠক হোক নিরপেক্ষ কোন জায়গায়।
সিনিয়র ডাক্তার রা সমস্যার সমাধান চান কেননা রোগীর চিকিৎসা করা রোগীর যন্ত্রণা কমানো জীবন বাঁচানো আমাদের পেশা। পেশার স্বার্থে ই সমস্যা সমাধান হওয়া জরুরী।
সেভ দ্য সেভিয়ার। ডাক্তার রোগী বাঁচাবেন কিন্তু হামলার হাত থেকে ডাক্তার কে বাচাবেন কে?
আগামীকালের আই এম এর ডাকা ধর্মঘটের লক্ষ্য সারা দেশব্যাপী ডাক্তারের উপর হামলা বন্ধ করার জন্য একটা আইন। কেমন করে তা সম্ভব তা আমার জানা নেই। কেননা স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দুটিই রাজ্যের বিষয়, তাতে কেন্দ্রীয় আইন সম্ভব কিনা তা আইন বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
তবু পশ্চিমবাংলার ডাক্তারদের সর্ববৃহৎ সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর ফোরাম আই এম এ র উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।
কিন্তু আই এম এর জাতীয় সভাপতি ডাক্তার শান্তনু সেনের ভূমিকা নিন্দনীয়। তিনি আবার রাজ্য আই এম এর সম্পাদক ও বটেন, রাজ্যের শাসক দলের রাজ্যসভার সাংসদ ও। রাজ্যে ২০০৯ থেকে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেয়ার সার্ভিস পারসন এন্ড মেডিকেয়ার ইনস্টিটিউটস প্রিভেনশন অফ ভায়োলেন্স এক্ট আছে। শান্তনু বাবু নিজের রাজ্যে নিজের দলের প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে পারেননি ২৩৫ টি ঘটনায় এই আইন প্রয়োগ করার জন্য। যদি পারতেন তাহলে হয়তো এন আর এস এর ঘটনা নাও ঘটতে পারতো।
রাজ্য আই এম এর সভাপতি আবার রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল এর সভাপতি ও। তৃণমূলের মন্ত্রী ডাক্তার নির্মল মাজি ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিল সভাপতি হিসেবে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন কাজে যোগ না দিলে ইন্টার্নদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে না। নির্মল বাবুর এই এক্তিয়ার আছে কিনা তা অবশ্য আইন বিশারদরা বলতে পারবেন। কেননা গত বছর ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিল এর নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি হওয়ায় হাই কোর্ট স্থগিতাদেশ দেয়।
সম্মানজনক সমাধান ছাড়া ডাক্তারদের আন্দোলনের পথ থেকে সরানো যাবে না। তারা আন্দোলন করবেন সমস্ত জরুরী পরিষেবা বজায় রেখেই। যদি আউটডোর বন্ধ করতে হয় তাহলে শুরু হবে প্যারালাল আউটডোর। আর মুখ্যমন্ত্রী যদি ভাবেন দমন-পীড়ন করে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ভাঙবেন তাহলে সিনিয়র ডাক্তাররা অভূতপূর্ব প্রত্যাঘাত করবেন। প্রায় ৯০০ শিক্ষক চিকিৎসকের পদত্যাগ থেকে রাজ্য প্রশাসনের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
গুরুচণ্ডা৯ | unkwn.***.*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৫:১৬48836
শেখর | unkwn.***.*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৬:৪০48837
Sumit Roy | unkwn.***.*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৭:৪৯48838
Ekak | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০২:১৬48841
PT | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০২:১৯48842
প্রতিভা সরকার | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০২:৩৫48839
pi | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০২:৪১48843
pi | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০২:৪৪48844
আনন্দবাজার, 17 June 2019 | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০৪:০২48840
মানিক | unkwn.***.*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০৫:৪৭48845
sm | unkwn.***.*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০৬:০৬48847
PT | unkwn.***.*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০৬:০৬48846