১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে পেটের ব্যথা নিয়ে সি এম আর আই হাসপাতালে আসা এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। অভিযোগ অপারেশনের জন্য যে টাকা চেয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা দিতে না পারায়, তার চিকিৎসা করা হয়নি। এলাকার লোকজন হাসপাতালে ভাঙ্গচুর চালান, হাসপাতালের কর্মীদের মারধোর করেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী, যিনি আবার রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বটেন, ২০১৭-র ২২ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। টিভি আর খবরের কাগজের দৌলতে রাজ্যবাসী জানেন কিভাবে সেই বৈঠকে মমতা ব্যানার্জী অ্যাপেলো, বেলভিউ, সি এম আর আই, আমরি, রুবি, মেডিকা হাসপাতাল এবং কে পি সি মেডিকাল কলেজের কর্তাদের নাজেহাল করেন। তার পরপরই, এক নতুন বিল পাশ করানো হয়। বামফ্রন্ট সরকার ২০১০-এর ২৯ জুলাই যে বিল ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড রেগুলেশন)’ পাশ করিয়েছিল, তাকে আরও কঠোর করে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসায় লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছেন মমতা। মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্য: তিনি বেসরকারি উদ্যোগের বিরোধী নন তবে সকলের থেকেই নৈতিকতা কাম্য।
২০১১-এ মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসার পর একের পর এক উদ্যোগ ঘোষিত হয়েছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। এই প্রবন্ধে আমরা সেই সব ঘোষণা ও বাস্তব নিয়ে আলোচনা করব, বর্তমান সমস্যায় ঢোকার আগে।
২০১১-এ নতুন তৃণমূল সরকার গঠনের সময় স্বাস্থ্য দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী নিজের হাতে রাখেন আরও অনেকগুলো মন্ত্রকের সাথে। কিছু মানুষ আশংকা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে তিনি স্বাস্থ্যে কতটা নজর দিতে পারবেন, আবার কিছু মানুষ ভেবেছিলেন স্বাস্থ্য দপ্তর যখন মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে রেখেছেন তখন সরকারি নীতি-নির্ধারণে স্বাস্থ্য যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে।
শুরুটা হয় ধুমধাম করেই। কালীঘাট থেকে মহাকরণে যাতায়াতের পথে সরকারি হাসপাতালগুলোর একেকটায় একেক দিন হঠাৎ করে ঢুকে পরতেন মুখ্যমন্ত্রী, পেছনে প্রেস। তাঁর প্রথম শিকার—বাঙ্গুর ইন্সটিটিউট অফ নিউরোলজির প্রধান ডা শ্যামাপদ গরাই, তাঁর দোষ—তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রেস নিয়ে হাসপাতালে না ঘুরে তাঁর ঘরে এসে কথা বলতে বলেছিলেন। ডা গরাইকে সাসপেন্ড করা হয়, শোকজ করা হয়—তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দেন।
তারপর থেকে সরকারি চিকিৎসাক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ, আদেশ-নির্দেশ সংখ্যায় কম নয়। আসুন দেখা যাক ঘোষণা কী কী হয়েছে আর বাস্তবটা কেমন।
• ২০১২-র ফেব্রুয়ারী মাসে সরকারি ডাক্তারদের জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে জেনেরিক প্রেসক্রিপশন শুরু করা হয় কলকাতা মেডিকাল কলেজ, আর জি কর মেডিকাল কলেজ ও ন্যাশানাল মেডিকাল কলেজে, তারপর অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে। বিষয়টা নতুন নয়, ২০০২-এ মেডিকাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-র কোড অফ এথিক্স-এ ডাক্তারদের জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার কথা বলা হয়েছিল। ২০০৫-এ পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন সরকার সরকারি ডাক্তারদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রাইব করার নির্দেশ দেন। তাতে কোন ফল হয়নি। এইবার কারা সরকারি নির্দেশ মানছেন না, তার ওপর কড়া নজরদারী চালানো হতে থাকে।
জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন অবশ্যইএকটা ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু অধিকাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে পাওয়া যায় না। জেনেরিক প্রেসক্রিপশনে রোগী কোন ব্রান্ডের ওষুধ পাবেন তা নির্ভর করে ওষুধের দোকানীর ওপর, দোকানীর যে ব্র্যান্ডে লাভ বেশি সাধারণত সেই ব্র্যান্ড পান রোগী। সমস্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ জেনেরিক নামে উৎপাদিত না হলে জেনেরিক প্রেসক্রিপশন-এর লাভ মানুষ পেতে পারেন না। রাজ্য সরকার বলবে ওষুধ-শিল্প তো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে নয়। কিন্তু রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল তো স্বাস্থ্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে, পশ্চিমবঙ্গের ড্রাগ কন্ট্রোল তো ড্রাগ এন্ড কসমেটিকস আইন মেনে ব্র্যান্ড নামে ওষুধের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতেই পারে, কেন না আইনে কেবল জেনেরিক নামে লাইসেন্স দেওয়ার কথাই বলা আছে। তাছাড়া কিছু রুগ্ন ওষুধ কারখানা রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বহু বছর ধরে, সেগুলোতে তো জেনেরিক নামে অত্যাবশ্যক ওষুধ তৈরি করাই যায়।
• বিগত সরকার ও বর্তমান সরকার দুই-এরই মাথাব্যথার একটা বড় কারণ ছিল ও আছে—শিশুমৃত্যু, বিশেষত হাসপাতালে শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য ডা ত্রিদিব বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এক উচ্চস্তরীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। ২০১১-র আগে অসুস্থ নবজাতকদের সঘন চিকিৎসার জন্য সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এস এন সি ইউ) ছিল ৬টা। ২০১৫-র ৩১শে মার্চের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে এস এন সি ইউ-র সংখ্যা ৪৫। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে অসুস্থ নবজাতকদের স্থিতিশীল করার জন্য সিক নিওনেটাল স্টেবিলাইজিং ইউনিট স্থাপিত হয়েছে ৩১শে মার্চ, ২০১৫ অবধি ২৮৫। আরও ২২ টা স্থাপিত হওয়ার কথা।
শিশুমৃত্যু কমানোর জন্য এসএনসিইউ ভালো হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলোতে ডাক্তার ও নার্স বাড়ন্ত। কলকাতার বাইরে এক পুরোনো মেডিকাল কলেজের এসএনসিইউ-তে বেশ কয়েক মাস কাজ করেছেন এমন একজন ডাক্তারের কাছে জানা—সেখান থেকে কোনও অসুস্থ বাচ্চাকেই ফেরানো হয় না, ফলে এসএনসিইউ-তে বাচ্চার সংখ্যা হয় প্রায় ৭০, দেখার জন্য মেডিকাল অফিসার ২ জন, নার্স—মর্নিং ও ডে শিফটে ৩ জন, নাইট শিফটে ২ জন। নার্সদের ৯০% সময় যায় ২ ঘন্টা ছাড়া ছাড়া বাচ্চাদের খাওয়াতে। ওয়ার্মার চলে, কিন্তু তার দিকে খেয়াল রাখার সময় মেলে না—কোথাও হয়তো ওয়ার্মার বন্ধ হয়ে বাচ্চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, কোথাও বেশি গরমে ফোস্কা...। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোনা যায় পরিকাঠামোও পর্যাপ্ত নয়—ঘর আছে তো যন্ত্রপাতি নেই, যন্ত্র আছে তো যথোপযুক্ত ঘর নেই, এসএনসিইউ-র নামে যে ডাক্তারদের নেওয়া হচ্ছে তাঁদের অন্য কাজে লাগানো হচ্ছে।
ডা ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন টাস্ক ফোর্সের কৃতিত্ব যদি হয় এসএনসিইউ-গুলো, তাহলেও আরও কৃতিত্ব রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নবজাতরোগবিদদের অন্যতম ডা অরুণ সিংহকে এস এস কে এম থেকে সাগর দত্ত মেডিকাল কলেজে ট্রান্সফার করা, যেখানে নবজাতক-চিকিৎসার কোনও পরিকাঠামোই নেই। ডা সিংহ-এর অপরাধ ছিল—তিনি কাজের সময় এক কর্তাব্যক্তির অন্যায় আবদার মেনে নেননি। শেষ অবধি ডা সিংহ রাজ্য ছেড়ে দিল্লীবাসী হয়েছেন কাজের সূত্রে।
• আরেকটা উচ্চস্তরীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয় ডা সুব্রত মৈত্রের নেতৃত্বে। এঁদের কাজ দ্বিতীয় স্তরের হাসপাতাল অর্থাৎ জেলা ও মহকুমা হাসপাতাল, স্টেট জেনেরাল হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করা।
এই টাস্ক ফোর্সে কো-অপ্টেড সদস্য হিসেবে ছিলেন আমার এক সহকর্মী। টাস্ক ফোর্স শতাধিক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিদর্শন করে, বিভিন্ন সুপারিশও দেয়। বন্ধুর কাছ থেকে শোনা—অনেক জায়গায় পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে কিন্তু লোকবল না থাকায় সেগুলো কাজে লাগছে না। আবার পরিকাঠামোই তৈরি নেই অনেক জায়গায়। ডা সুব্রত মৈত্র-র মৃত্যুর পর আগের টাস্ক ফোর্স বিলুপ্ত হয়েছে। তাঁদের সুপারিশগুলোর কী হবে জানা নেই।
• ডিসেম্বর, ২০১৫-এ রাজ্যে চালু সি সি ইউ (করোনারী কেয়ার ইউনিট)-এর সংখ্যা ৩৫, চালু এইচ ডি ইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট)-এর সংখ্যা ১৭।
• ১১ই ডিসেম্বর, ২০১২ থেকে ডিসেম্বর, ২০১৫-র মধ্যে ১০৮টা সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান স্থাপন করা হয়, আরও ৮টা দোকান স্থাপন করার কথা। এগুলো থেকে রোগীরা ১৪২টা অত্যাবশ্যক ওষুধ ৪৮ থেকে ৭৭.২% কম দামে কিনতে পারেন।
ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলোর কিছু ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই স্বীকার করা উচিত—এইগুলোর চাপে পশ্চিমবঙ্গের ওষুধের দোকানিদের সংগঠন বিসিডিএ (বেঙ্গল কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্টস’ এসোশিয়েসন) বাধ্য হয়েছে এমআরপি-র চেয়ে কমে ওষুধ বিক্রি করতে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতে ব্যবহার্য স্টেন্ট, হার্টব্লকে ব্যবহার্য পেস-মেকার-এর দাম প্রায় কুড়ি হাজার টাকা করে কমে গেছে, অসাধু ডাক্তারদের কমিশন খাওয়া কমেছে। কিন্তু ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের বিরুদ্ধেও বলার আছে—যে ১৪২টা অত্যাবশ্যক ওষুধের কথা বলা হয়েছে, আসলে কিন্তু ওষুধের সংখ্যা ১৩৩টা, বাকী ৯টার পুনরাবৃত্তি আছে। এই ১৩৩টার মধ্যেও আবার একই ওষুধের বিভিন্ন রূপ আলাদা আলাদা তালিকাভুক্ত হয়েছে, ব্যাপারটা এরকম—অ্যামোক্সিসিলিন-এর ৫০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল, ২৫০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল, ১২৫ মিলিগ্রাম বড়ি ও সিরাপ—মোট ৪ বার তালিকাভুক্ত হয়েছে অ্যামোক্সিসিলিন। তালিকা ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি আসলে কাজের ওষুধের সংখ্যা ৯০টা। এই ৯০টা ওষুধের মধ্যে আবার ৬৮টাই কেবল ভারতের ২০১১-র জাতীয় অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকাভুক্ত। জাতীয় তালিকায় ওষুধের সংখ্যা ৩৪৮টা অর্থাৎ ২৮০টা অত্যাবশ্যক ওষুধ আপনি এসব দোকানে পাবেনই না। দামে ছাড় দেওয়া হচ্ছে একেক দোকানে একেক রকম। কমদামের ব্র্যান্ডেড জেনেরিক না রেখে, দামি ব্র্যান্ডেড জেনেরিক রাখা হচ্ছে যাতে ছাড় দিয়েও বেশি লাভ করা যায়।
• এর পাশাপাশি আছে ন্যায্য মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রকাশনা ‘হেলথ অন দি মার্চ’-এর ২০১২-’১৩-র নথি থেকে জানা গেছিল—৮৪ টা ব্লক প্রাইমারী স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় প্যাথোলজিকাল পরীক্ষা ও এক্স-রের ব্যবস্থা হয়েছে পিপিপি মডেলে। ২২টা সিটি স্ক্যান মেশিন ও ৮টা এমআরআই মেশিন বসেছে। এগুলোর মধ্যে কিছু অবশ্য বামফ্রন্টের আমলেই চালু করা হয়েছিল।
• যে সব হাসপাতালে ব্যবস্থা ছিল না, সে রকম ৭৫টা সরকারি হাসপাতালে ফেয়ার প্রাইস ডায়াগনোস্টিক সেন্টার খোলা হয়েছে। আরও ২০টা খোলার পরিকল্পনা। বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা জোগাড় করে সরকার মেশিন কিনছে, পরিচালনা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান, ন্যায্য মূল্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা—প্যাথোলজি, রেডিওলজি, ডিজিটাল এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান এবং ন্যায্য মূল্যে ডায়ালিসিস পরিষেবা—মানুষের স্বার্থে যে পরিষেবাগুলোকে প্রচার করা হচ্ছে সে সবগুলোই প্রাইভেট-পাব্লিক পার্টনারশিপ অর্থাৎ সরকারি পরিকাঠামো ব্যবহার করে স্বাস্থ্য-ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোটা। নতুন করে ডিজিটাল এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান এবং ন্যায্য মূল্যে ডায়ালিসিস পরিষেবা শুরু করা তো আরও ভয়ংকর। সেখানে স্বাস্থ্য দপ্তর মেশিন বসাচ্ছে, ‘অপারেট আর ম্যানেজ’ করছে বেসরকারি মালিক। সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য যোজনা কমিশনের উচ্চ-স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ ছিল বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ছাড়া সাধারণ ভাবে পিপিপি-র বিরুদ্ধে।
• এখন রাজ্যে মেডিকাল কলেজের সংখ্যা ১৭—সরকারি কলেজ—মেডিকাল কলেজ, এন আর এস, আর কি কর, ন্যাশানাল, এস এস কে এম, বাঁকুড়া সম্মিলনী, বর্ধমান, নর্থ বেঙ্গল, মেদিনীপুর, মালদা, বহরমপুর, কামারহাটির সাগর দত্ত, কল্যাণী, জোকা ই এস আই; বেসরকারি —যাদবপুরে কে পি সি, হলদিয়া, দুর্গাপুর। এম বি বি এস-এ সিটের সংখ্যা ২৫০০। পিপিপি মডেলে ৩ টে মেডিকাল কলেজ খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কুচবিহার, নদীয়া জেলার ধুবুলিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গরে। এর জন্য ‘এক্সপ্রেসন অফ ইন্টারেস্ট’ (আগ্রহ-প্রকাশ) আহ্বান করা হয়েছে। ।
নতুন যে মেডিকাল কলেজ স্থাপন করার কথা বলা হচ্ছে সেগুলো হয় বেসরকারি না হলে পিপিপি। সরকারি মেডিকাল কলেজে সাড়ে ৪ বছর ডাক্তারী পড়তে খরচ হয় ৪০,৫০০ টাকা। বেসরকারি কলেজে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ভর্তি হলে প্রায় ৫ লাখ, কলেজের প্রবেশিকা দিয়ে ভর্তি হলে প্রায় ২২ লাখ, এনআরআই কোটায় ৫৫ লাখ—অর্থাৎ বেসরকারি মেডিকাল কলেজ স্থাপনের পেছনে মুনাফাই প্রধান উদ্দেশ্য। সরকারি মেডিকাল কলেজে সিট বাড়ানো হলেও লেকচার থিয়েটার, ল্যাবরেটরী, হস্টেল, শিক্ষক কোন কিছুই বাড়ানো হয় নি। নতুন সরকারি মেডিকাল কলেজ খোলা হয়েছে পরিকাঠামো না বানিয়েই। সরকার যে পরিকল্পনা করছে পিপিপি মডেলে মেডিকাল কলেজ খোলার—বেশি টাকা দিয়ে যারা ডাক্তার হবে, তাদের সরকার কোন কাজে লাগাবে? আমাদের স্থির বিশ্বাস—কর্পোরেট হাসপাতালগুলোকে ডাক্তার জোগানোর জন্যই এই মেডিকাল কলেজ খোলার আয়োজন।
মেডিকাল পাঠক্রমেও কোনও পরিবর্তন হয় নি। প্রান্তিক মানুষজনের স্বাস্থ্যসমস্যা সেখানে গুরুত্ব পায় না। যেমন ২০১২-র সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মোট ২৩০৩৫ জন সাপের কামড় খান, মারা যান ৩২৮ জন। অথচ ডাক্তারদের সর্পদংশনে এভিএস চিকিৎসা শেখানো হয় না। পাশকরা ডাক্তাররা পেশাগত রোগ নির্ণয় করতে, চিকিৎসা করতে অক্ষম। নতুন মেডিকাল গ্রাজুয়েটরা অনেকেই ডায়রিয়া বা সর্দিকাশির মতো সাধারণ রোগগুলোর চিকিৎসায় দক্ষ নন, অথচ তাঁরা বিরল রোগগুলো সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।
রাষ্ট্রীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন-এর টাস্ক ফোর্স অনেকদিন আগেই ঘোষণা করেছে অধিকাংশ সাধারণ অসুখবিসুখের জন্য ডাক্তার লাগে না, প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মীই যথেষ্ট। সরকার যে ডাক্তাররা-নার্সরা পাশ করে বেরোচ্ছেন প্রতি বছর, তাঁদের চাকরি দিন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও সরকারি হাসপাতালের শূন্য পদগুলোকে পূরণ করুক। আর যে গ্রামীণ চিকিৎসকরা গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রেখেছেন বহু বছর ধরে, তাঁদের বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। ডা সুব্রত মৈত্র কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী গ্রামীণ চিকিৎসকদের বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিং-এর কথা মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেছিলেন এক বছরেরও বেশি সময় আগে। তাও শুরু হয়নি আজও।
• ৭ টা স্বাস্থ্য জেলা হয়েছে—বিষ্ণুপুর, ঝাড়গ্রাম, নন্দীগ্রাম, ডায়মন্ড হারবার, আসানসোল, রামপুরহাট ও বসিরহাট।
নতুন স্বাস্থ্য জেলা করে লাভ কি হয়েছে আমাদের জানা নেই!
• জুলাই, ২০১৬-র শেষ অবধি ৩২টা মাল্টিস্পেশালিটি/ সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।
২০১২-’১৩-র পরিসংখ্যান বলে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ থাকেন, সেখানে পাশকরা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের চিকিৎসক ১৩১১৭ জন এবং শয্যাসংখ্যা ১৬,৮৬২, অথচ শহরাঞ্চলে ডাক্তারের সংখ্যা ৩৯৩৪৯ জন এবং শয্যার সংখ্যা ৯২,১০০ ।
২০১৪-র পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন ডাক্তার-পিছু জনসংখ্যা ১৬৫১, একজন নার্স-পিছু জনসংখ্যা ১৪০৭। সবধরনের ডাক্তার ধরলে গ্রামে একজন ডাক্তার-পিছু ৫১১২ জন মানুষ, শহরাঞ্চলে ৬৭৫ জন। আসলে গ্রামে আরও কমসংখ্যক ডাক্তারকে পাওয়া যায়, গ্রামের সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাঁদের পোস্টিং তাঁদের অনেকেই সপ্তাহে ২-৩দিন গ্রামে থাকেন, বাকী দিন শহরে প্র্যাকটিস করেন। গ্রামাঞ্চলে যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকেন তাঁরা আবার গ্রামীণ সমাজ-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ হাসপাতাল, মহকুমা ও জেলা হাসপাতালে ডাক্তারদের ধরে রাখতে পারছেন না—এ কথা মন্ত্রী-আমলারা নিজমুখে স্বীকার করছেন। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি বা ডিপ্লোমাধারীদের কোর্সে ভর্তি হওয়ার সময় সরকারি পরিষেবায় বাধ্যতামূলক ভাবে কিছু সময় কাজ করার বন্ডে সই করতে হতো অনেক দিন আগে থেকেই। গত বছর নতুন মাল্টিস্পেশালিটি/ সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালগুলোর ডাক্তারের অভাব মেটাতে বন্ড কার্যকর করা শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতেও অভাব মিটছে কই? তাই নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ডাক্তার তুলে এনে নতুন হাসপাতালগুলো চালানোর চেষ্টা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে জেনেরাল ফিজিশিয়ানদের দিয়ে বিশেষজ্ঞের কাজ করানো হচ্ছে। ফলে আগে থেকে চালু সরকারি হাসপাতালগুলোর কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
কুলোকে বলে অ্যাপেলো গ্রুপের সরকারের কুনজরে পড়ার কারণ অন্য। নতুন মাল্টিস্পেশালিটি/ সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালগুলো পি পি পি মডেলে চালানোর জন্য সরকারে বোঝাপড়া হয়েছিল অ্যাপেলো গ্রুপের সঙ্গে। কোনও কারণে অ্যাপেলো সেই বোঝাপড়া থেকে সরে আসে। তারই ফল ভুগছে এখন তারা।
• ২০০৮ থেকে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় পরিবারের ৫ জন পিছু বছরে ৩০ হাজার টাকা অবধি হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসার খরচ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে এই পরিষেবা পাওয়া যেত। ২০১৩ থেকে জেলা হাসপাতাল ও মেডিকাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার অন্তর্গত করা শুরু হয়। এখন রাজ্যের ৪৩৮টা সরকারি হাসপাতাল এবং ৭১৪টা প্রাইভেট হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে আর এস বি পরিষেবা এখন পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৮-এর ১লা এপ্রিল থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা চালু হয়েছে। কিন্তু অনেক গরীব মানুষই এখনও RSBY কার্ড পাননি। এই যোজনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগও প্রচুর। কার্ড পুনর্নবীকরণের জন্য টাকা লাগে না, টাকা নেওয়া হচ্ছে। বিমায় যে সব প্যাকেজ আছে, সেই প্যাকেজে চিকিৎসা করে কার্ড থেকে টাকা কাটার পর অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে রোগীর কাছ থেকে। ছোট কোনও অপারেশন করে বড় অপারেশন দেখিয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিং হোম। কোনও কোনও জেলায় বিমা র টাকা পেতে বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিং হোমের ডাক্তাররা প্রয়োজন ছাড়াই মহিলাদের হিস্টেরেক্টমি অপারেশন করে দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে RSBY কার্ডের সুবিধা পেতে গেলে সুপারিন্টেন্ডেন্টের অনুমতি নিতে হয়, অনুমতি-পত্রে সই করানোর জন্য দালাল আছে...।
• ২০১৪-র ৯ই জানুয়ারী জারী হওয়া এক সরকারি মেমোরান্ডামে বলা হয়েছিল যে সরকারি হাসপাতালে আউটডোর ও ইন্ডোরের ফ্রি বেডগুলোতে বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ সরবরাহ করা হবে। বলা হয়েছিল প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকাও প্রস্তুত আছে। আমরা যে তালিকা খুঁজে পেয়েছি, বাম সরকারের আমলের শেষে তৈরি, তাতে ওষুধগুলোকে জীবনদায়ী, অত্যাবশ্যক ক, খ, গ এবং বাঞ্ছনীয়—এই ভাবে চিহ্নিত করা ছিল। জীবনদায়ী ওষুধের সংখ্যা ৪৮, অত্যাবশ্যক ক ৬৭, অত্যাবশ্যক খ ৬৮ এবং অত্যাবশ্যক গ ৫৬টা।
• ৩রা মার্চ, ২০১৪-এ জারী হওয়া এক আদেশে বলা হয়েছিল এখন থেকে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের লেখা ওষুধের পুরো কোর্স পাওয়া যাবে। এত দিন আউটডোরের ফার্মাসি থেকে দিন তিনেকের ওষুধ পাওয়া যেত।
সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ দেওয়ার ৯ই জানুয়ারী, ২০১৪-র মেমোরান্ডাম ও পুরো কোর্সের ওষুধ দেওয়ার ৩রা মার্চ, ২০১৪-র আদেশ অনেক সরকারি হাসপাতালে পৌঁছায়ই নি বলে জানা যায়।
৯ই জানুয়ারীর মেমোরান্ডামে প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি (Standard Treatment Guidelines)-র কথা বলা হয়েছে। এমন বিধি তৈরি আছে কেবল প্রাথমিক স্তরের চিকিৎসার জন্য, এও বাম জমানার শেষে তৈরি , তাও তা বহুল-প্রচারিত নয়।
• এসবের মাস কয়েক পর সরকার অবশ্য ৬০০ ওষুধ ও চিকিৎসা-সরঞ্জামের এক তালিকা বার করে, মানুষের সে সব বিনামূল্যে পাওয়ার কথা।
• ২০১৪-র ২২শে অক্টোবরের কথা—মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করলেনঃ এখন থেকে এ পি এল-বি পি এল নিরবিশেষে সমস্ত মানুষ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ভর্তি, চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ-পত্র পাবেন।
আমরা ভাবলাম বিনা আয়াসে বুঝি ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর দাবী বাস্তবায়িত হয়ে গেল। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবনের আমলাদের মাথায় হাত! এতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলানো হয়েছে, সরকার বিনা পয়সায় ওষুধ দিলে সেখান থেকে কে ওষুধ কিনবে?! পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনা পয়সায় হলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র/ হাসপাতালে খোলা পিপিপি মডেলের ল্যাবরেটরী, সিটি স্ক্যান-এম আর আই সেন্টারগুলোর কি হবে?
পরের দিন সংশোধিত ঘোষণাঃ মেডিকাল কলেজ/ সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল ছাড়া সব সরকারি হাসপাতালে সব বেড ফ্রি বেড হবে, বেড-ভাড়া লাগবে না। চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি খরচ যাতে সেই ওষুধ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনা পয়সায় পাওয়া স্বপ্নই থেকে গেল!
• ২০১৫-র শেষে মুখ্যমন্ত্রী আবার কল্পতরু হলেন। সরকারি হাসপাতালে সবই এখন বিনামূল্যে।
সমস্ত চিকিৎসা বিনামূল্যে হবে শুনে মনে হতে পারে, ‘এই তো! আমাদের সবার জন্যে স্বাস্থ্যের স্বপ্ন সত্যি হল বুঝি।’ কিন্তু আসল ছবিটা কিন্তু সেরকম দাঁড়াচ্ছে না। সব বিনামূল্যে পাওয়া যাবে ঘোষণা হয়ে গেলেও অনেক কিছুই কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না, সব ওষুধ মিলছে না, অপারেশন, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপির জন্যে রোগীদের লম্বা ডেট দেওয়া হচ্ছে, পেসমেকার, স্টেন্ট, প্রস্থেসিস যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া না যাওয়ার কারণে রোগীদের ঘোরানো হচ্ছে। পরিকাঠামো, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা না বাড়িয়ে সব বিনামূল্যে পাওয়া যাবে ঘোষণা করে দেওয়ায় চিকিৎসার মান ক্রমশ নেমেই চলেছে, কোথাও বাচ্চা পুড়ে যাচ্ছে ওয়ার্মারে, কোথাও পেশেন্ট পার্টি ডাক্তার-নার্স পেটাচ্ছে। আসলে যেটা নেই-ই সেটা ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে বলে ঘোষণা করে দেওয়ার ফল ভুগছেন রোগী ডাক্তার কর্মচারী সকলেই।
এবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ৮ই মার্চ, ২০১৭-এ পাশ হওয়া The West Bengal Clinical Establishments (Registrations, Regulations and Transparency) Bill, 2017 –এর প্রসঙ্গে আসি। এই বিলে রাজ্যপাল সই করেন ১৬ই মার্চ ও তা নতুন আইনে পরিণত হয়। এই আইনে বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতালে কড়া লাগাম পরানোর প্রয়াস আছে।
বলা হয়েছেঃ—
১) সমস্ত ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্টকে নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে এবং যথাযথ লাইসেন্স নিয়ে চলতে হবে।
২) নিয়ম মেনে না চললে অর্থদন্ড এবং লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
৩) পথ-দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এসিড আক্রমণ বা ধর্ষিতাকে চিকিৎসার খরচ দিতে না পারলেও চিকিৎসা করতে হবে। পরে ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট এই খরচ পুনরুদ্ধার করতে পারে।
৪) পয়সা দিতে না পারলে মৃতদেহ আটকে রাখা যাবে না। পরে ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট এই খরচ পুনরুদ্ধার করতে পারে।
৫) সব ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্টে একটা করে অভিযোগ জানানোর কেন্দ্র ও সহায়তাকেন্দ্র রাখতেই হবে।
৬) ই-প্রেসক্রিপশন ও ইলেক্ট্রনিক মেডিকাল রেকর্ড রক্ষণ শুরু করতে হবে।
৭) রোগীর ছুটির সময় সমস্ত মেডিকাল রেকর্ড তাকে দিয়ে দিতে হবে।
৮) পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বেড ভাড়া, অপারেশন থিয়েটার, আই সি ইউ, ভেন্টিলেশন, ইমপ্ল্যান্টেশন এবং ডাক্তারের ফি নির্দিষ্ট রাখতে হবে।
৯) প্যাকেজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া যাবে না।
১০) রোগীকে চিকিৎসার ও প্যাকেজের যথাযথ আন্দাজ আগে দিয়ে দিতে হবে। শেষ বিল যেন সেই আন্দাজের এক নির্দিষ্ট শতাংশ হারের বেশি না হয়। এই হার সরকার ঠিক করে দেবে।
১১) বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া একই পরীক্ষা বা চিকিৎসা পদ্ধতি বারবার করা যাবে না।
১২) হাসপাতালে ১০০-র বেশি বেড থাকলে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান রাখতে হবে।
১৩) যেসব হাসপাতাল সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে তাদের আউটডোর চিকিৎসার ২০% ও ইন্ডোর চিকিৎসার ১০% বিনামূল্যে দিতে হবে।
১৪) যারা সরকারি সহায়তা নেয়নি তারা কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি-র অংশ হিসেবে বিনামূল্যে চিকিৎসা করতে পারে।
১৫) রোগীর আত্মীয়-পরিজনের অনুমতি ছাড়া রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখা যাবে না।
১৬) রোগীকে জরুরী এবং জীবনদায়ী দিতে অস্বীকার করা যাবে না। ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্টের অধিকার থাকবে খরচ পুনরুদ্ধার করার।
১৭) এইচ আই ভি পজিটিভ রোগীদের সঙ্গে ভেদভাব করা যাবে না।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরী বডি তৈরি করা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য। এই বডিতে সংখ্যাধিক সদস্য অ-ডাক্তার। এই বডির সিদ্ধান্তকে কোন সিভিল কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এঁরাই সিদ্ধান্ত নেবে চিকিৎসায় গাফিলতি হয়েছে কিনা, ভুল চিকিৎসা হয়েছে কিনা। তেমন হলে শাস্তি দেবেন এঁরা।
এই আইনের বিপক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যে কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার, পুরসভা, পঞ্চায়েত, ইত্যাদি দ্বারা পরিচালিত হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এই আইনের আওতার বাইরে থাকবে। কিন্তু বেসরকারি নার্সিংহোম বা কর্পোরেট হাসপাতালে যান কারা? সমাজের উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষ, কখনও সখনও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ ঘটিবাটি বিক্রি করে। এই সংখ্যালঘু মানুষদের জন্য সরকারের মাথাব্যথা, অথচ সংখ্যাগুরু খেটেখাওয়া মানুষ যে পরিষেবা নেন, সেই সরকারি পরিষেবা দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছে।
যাঁদের হাতে চিকিৎসায় গাফিলতি বা ভুল নির্ণয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা বিচার করবেন কিসের ভিত্তিতে? প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি বা Standard Treatment Protocol কোথায়?
আর দেশের বিচারব্যবস্থারও ওপরে যেন স্থান রেগুলেটরী বডির, এদের সিদ্ধান্তকে কোন সিভিল কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। অসাংবিধানিক এই ধারার জন্যই বোধহয় রাজ্যের নতুন আইন বাতিল হয়ে যাবে।
শেষ কথা
চিকিৎসা-পরিষেবার সমস্যাগুলো অনেক গভীরে, ছোটখাট চমক-লাগানো সংস্কারে কিছু হওয়ার নয়।
চাই সবার জন্য স্বাস্থ্য, রাষ্ট্র সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেবে এমন একটা ব্যবস্থা। সেখানে সমস্ত ডাক্তার হবেন রাষ্ট্রের নিযুক্ত, আপনার রোগ হলে কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন তা হবে পূর্ব-নির্ধারিত, তিনি ওষুধ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখবেন প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি মেনে, কোন বিশেষজ্ঞের কাছে বা হাসপাতালে ভর্তির জন্য তিনি পাঠাবেন তাও পূর্ব-নির্ধারিত, কোনও ধাপেই আপনাকে পয়সা দিতে হবে না। কর থেকে সংগৃহীত অর্থে চলবে সমস্ত চিকিৎসা-পরিষেবা।
এমনটা স্বপ্ন মনে হলেও স্বপ্ন নয়। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে প্রায় অর্ধেক ভূমি এমন দেখা যায়, যেখানে সবার জন্য স্বাস্থ্য বাস্তব। সবক’টা সমাজতান্ত্রিক দেশ এমন কিন্তু নয়, পুঁজিবাদী দেশ, আমাদের মতো বা আমাদের থেকেও পিছিয়ে থাকা দেশ—অনেক দেশেই সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব নেয়।
একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়—পয়সাওয়ালাদের জন্যে একরকম, আর গরীবদের জন্যে আরেকরকম, এই দুই ব্যবস্থা পাশাপাশি চললে যুক্তিসম্মত চিকিৎসা কেউই পান না। কেউ পান প্রয়োজনের অতিরিক্ত, আর কেউ পান ছিটেফোঁটা ফ্রির মাল। প্রভাবশালী মানুষদের চিকিৎসাব্যবস্থা গরীবদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার শাঁস শুষে খায়। এর সমাধান সম্ভব তখনই, যখন দেশে একটাই ব্যবস্থা থাকবে সবার জন্যে, যেখানে পয়সা থাকার উপর নির্ভর করবে না রোগী কিরকম চিকিৎসা পাবেন, আর যার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে সরকার, কোন মুনাফাখোর স্বাস্থ্য-বিক্রেতা নয়।
আসুন আমরাও স্বাস্থ্য-পরিষেবার রাষ্ট্রীয়করণের দাবীতে সোচ্চার হই।