এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • লা জবাব দিল্লী - ১১

    শমীক মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২১ জুন ২০০৯ | ৭৯০ বার পঠিত
  • দিল্লি : ২০০৯

    দেখতে দেখতে ছ'বছর পূর্ণ হয়ে গেল গ্যাঁড়ার, দিল্লিবাসের। শুরু হয়েছিল নয়ডা কুড়ি সেক্টরের এক সহৃদয় ব্যক্তির চিলেকোঠার ঘরে, দু হাজার তিন সালের মে মাসের এক মনোরম গ্রীষ্মের দুপুরে। এই ছবছরে আরও ছবার গ্রীষ্ম এল, এল বসন্ত। নতুন চোখে দেখা দিল্লি নয়ডা গুরগাঁও শহর চোখের সামনেই দেখতে দেখতে কত তাড়াতাড়ি পাল্টে গেল। কত হাজারে হাজারে লোক এল। কত নতুন নতুন সিগন্যাল বসল রাস্তার মোড়ে, কত সিগন্যাল চিরতরে হারিয়ে গেল নবনির্মিত ফ্লাইওভারের তলায়! ফেসলিফ্‌ট হচ্ছে রাজধানীর, সাজো সাজো রব পড়েছে দিল্লির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, তৈরি হতে হবে ২০১০ সালের কমনওয়েল্‌থ গেম্‌সের জন্য। চেনাজানা আনাচকানাচগুলো দেখতে দেখতে নতুন রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসছে নীল হলুদ বোর্ডের আড়াল থেকে।

    গ্যাঁড়া যখন এসেছিল, তখনও আইটিও-র ব্রিজে জ্যাম হত, অফিস টাইমে জ্যাম হত নিজামুদ্দিন ব্রিজে, কি প্রগতি ময়দানের সামনের ভৈরোঁ রোডেও। কিন্তু আজকের জ্যাম যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, সেই জিনিস আজ থেকে ছ বছর আগেও দেখা যেত না। তখনও পথে চলবার জন্য একটু হলেও ফাঁকা রাস্তা পাওয়া যেত। রবিবারে হাওয়ায় উড়ে পৌঁছে যাওয়া যেত দিল্লির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। চওড়া চওড়া রাস্তাগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকত লং ড্রাইভের জন্য। কিন্তু আজ, চারচাকার গাড়ি কেনার রীতিমতো তিন বছর পরে, কোথাও বেরোতে হলে গ্যাঁড়া গাড়ি বের করার আগে দুবার ভাবে।

    হবে না কেন? কোন এক সমীক্ষায় যেন বলছে, দিল্লির রাস্তায় প্রতি মাসে অন্তত হাজারখানেক করে নতুন গাড়ি বাড়ছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার তো সেই অর্থে বাড়তে পারছে না। তাই বাড়ছে জ্যাম, বাম্পার টু বাম্পার। দিল্লির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। দিল্লির অপ্রতুল পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট সিস্টেমের প্রতি ধন্যবাদ, আজ প্রাইভেট গাড়ি কেবল দিল্লিতে যে সংখ্যায় আছে, তা কলকাতা এবং মুম্বইয়ের যুগ্ম প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। এবং এই সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। বাড়ছে লোকসংখ্যা। দিল্লি ভরে গেছে, ভরে গেছে নয়ডাও। নতুন উপনিবেশ হিসেবে উঠে আসছে ফরিদাবাদ, গাজিয়াবাদ, গুরগাঁও ছাড়িয়ে মানেসার, রেওয়াড়ি, হাপুড় প্রভৃতি জায়গা। সকালবেলা অফিস টাইমে গেঁড়িকে মাত্র সতেরো কিলোমিটার দূরত্বের অফিস পাড়ি দিতে হয় দেড় ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে, যা সাধারণভাবে কুড়ি মিনিট থেকে আধঘন্টার রাস্তা।

    যেখানেই যাও, থিকথিক করছে মানুষ আর মানুষ। অপরিসীম প্রাণের জোয়ারে ভাসছে, বানভাসি হয়ে যাচ্ছে সুবিশাল ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন। কমে যাচ্ছে গাড়ি দাঁড় করানোর স্পেস, একদিন যে সিএনজি আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল দিল্লির অতিমাত্রায় দূষিত আবহাওয়ার ওপর, আজ আর সেই আশীর্বাদের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। বিপুল পরিমাণ প্রাইভেট গাড়ি, তারা তো চলে পেট্রল বা ডিজেলেই, চলার থেকে থামে বেশি, অবিরত উড়িয়ে চলে ধোঁয়া, আর জ্যামে ফেঁসে অসহায় গালিগালাজে ভরিয়ে তোলে দিল্লির হাওয়া, তাদের তুলনায় পরিবেশবান্ধব সিএনজি গ্যাসে চলা পাবলিক বাস ট্যাক্সির সংখ্যা আর কতটুকু? সিএনজি ফিলিং স্টেশনই বা দিল্লিতে কটা মাত্র? যে কোনও উইকডে-তে কোনও সিএনজি স্টেশনের সামনে দিয়ে গেলে দেখতে পাবেন অন্তত দেড় দুই কিলোমিটার লম্বা লাইন, অটোর, বাসের, ট্যাক্সির।

    তাই দিল্লি পাল্টাচ্ছে। গাড়ি তো কমানো যাবে না, লোক আসাও ঠেকানো যাবে না, তাই চেষ্টা চলছে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উন্নতির। রাস্তায় নামার বেদনা যতটা সম্ভব লাঘব করা যায় আর কি।

    যেমন, ফ্লাইওভার। পাল্টাতে থাকা দিল্লির এক পরিচয়পত্রবিশেষ। দিনে দিনে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে থাকা একের পর এক সিগন্যালের রক্তচক্ষু থেকে আমজনতাকে বাঁচাতে এরা ক্রমশ বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে দিল্লি এনসিআরের আনাচেকানাচে। একেকটা জায়গা ছিল, যেখানে এসে পড়লে গাড়ি আর এগোতে চাইত না। গ্যাঁড়া যখন এসেছিল প্রথম। নয়ডা মোড়ে তখন ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলছে। লাজপত নগরের ফ্লাইওভার তখনও শুরু হয় নি। ধৌলা কুয়াঁ হয়ে গুরগাঁও যাবার রাস্তা পেরোতে তখন দেড় ঘন্টা লাগত, ফ্লাইওভার বানাবার ব্লু-প্রিন্টও তখন তৈরি হয় নি। সব, সব শুরু হল, আর তৈরি হল গ্যাঁড়ার চোখের সামনে, এই সেদিন। আজ ধৌলা কুয়াঁ থেকে গুরগাঁও যেতে লাগে কুড়ি মিনিট মাত্র। পাঁচ-ছটা ফ্লাইওভার মাত্র এক দুই বছরের মধ্যে সেই দু:স্বপ্নের রাস্তাকে পুরোপুরি স্বপ্নের রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে।

    ২০০৩ এর শেষদিকে, তখন দিল্লি সরকার চিন্তাভাবনা করছে, ২০১০ এর কমনওয়েল্‌থ গেম্‌সের জন্য দিল্লিকে কী কীভাবে তৈরি করা যেতে পারে। দিল্লি মেট্রোর অনুমতিপত্রে তখন সবে শেষ সইটা পড়েছে, নিযুক্ত হয়ে গেছেন শ্রীধরণ, যাঁর পরিচয় আজ আর নতুন করে দেবার কিছু নেই। গ্যাঁড়া তখন পূর্ব দিল্লির প্রান্তে এক সোসাইটি অ্যাপার্টমেন্টের এক ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে। সেই পাড়ার মত দিল্লির অনেক পাড়াতেই তখন গুজব ছড়িয়ে যেত, তাদের পাড়াতেই নাকি মেট্রোর স্টেশন হচ্ছে। সেই গুজবের ওপর ভিত্তি করে মকান-মালিকরা স্পেকুলেশনে বসে যেত, মেট্রো হলে পরে তাদের প্রপার্টির রেট কতটা এসক্যালেট করবে। গুজবের ভিত্তি কিছুই না, সদ্যনির্মিত দিল্লি মেট্রো কর্পোরেশনের কর্মীদের দিল্লির ইতিউতি সাইনবোর্ড লাগিয়ে মাটি খুঁড়ে "সয়েল টেস্টিং'। টেস্ট করে তারা বোঝার চেষ্টা করত, কোথা দিয়ে মেট্রোর ফ্লাইওভার হবে, কোথায় স্টেশন হবে ইত্যাদি। সেই মাটি খোঁড়া দেখেই গুজব ছড়াত। অথচ আলটিমেটলি যখন চাঁদনি চকের তলা দিয়ে সুরঙ্গ কেটে মেট্রো পাড়ি দিল সে¾ট্রাল সেক্রেটারিয়েট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, চাঁদনি চকের লোকজন টেরটিও পেল না, তাদের বাড়ির নিচ দিয়েই মেট্রোর লাইন পাতা হল।

    দিল্লির মেট্রো। দেখতে দেখতে ডানা মেলে দিল। সাফল্যের এক অপূর্ব খতিয়ান। আজ দিল্লির বিভিন্ন রুটে নিয়মিত পাড়ি দিয়ে চলেছে মেট্রোর ঝকঝকে আধুনিক রেক। আর গুজব নয়, গ্যাঁড়ার বর্তমান বাসস্থানের সামনে সত্যিই তৈরি হয়ে চলেছে প্রোপোজ্‌ড মেট্রো স্টেশন। আশা করা যায় আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্যাঁড়ার বাড়ির সামনে দিয়ে উড়ে যাবে মেট্রো। কনট প্লেস তখন মাত্র কুড়ি মিনিটের দূরত্ব হবে, এয়ারপোর্ট হবে মেরেকেটে একঘন্টা। কনট প্লেসের স্টেশনটার নাম রাজীব চক। এখান থেকে তৈরি হচ্ছে মেট্রো এক্সপ্রেস লাইন, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। কাজ শেষ হলে পরে এই রাজীব চক স্টেশনেই আপনার লাগেজ ব্যাগেজ চেক-ইন হয়ে চলে যাবে এরোপ্লেনের পেটে। আপনাকে আর এয়ারপোর্ট পর্যন্ত লাগেজ বইতে হবে না।

    ছোটবেলা থেকে কলকাতা মেট্রোর গল্প শুনে আর দেখে গ্যাঁড়ার শিশুমনে একটা ধারণা হয়ে গেছিল, মেট্রো মানে বোধ হয় মাটির নিচে। সেইজন্য পরের দিকে, নব্বইয়ের গোড়ার দিকে যখন মেট্রো চ্যানেল চালু হল টিভিতে, গ্যাঁড়ার ধারণা ছিল মাটির নিচে একটা টিভি চ্যানেলের স্টুডিও খুলেছে, অথবা মাটির নিচ থেকে এই চ্যানেলের সম্প্রসারণ হয়, কিংবা ঐ রকম কিছু একটা। তার পরে মেট্রোপলিটান কথাটার প্রকৃত অর্থ বুঝে ফেলা এবং কলকাতা শহরে গিয়ে মেট্রো সিনেমা দেখে ফেলার পরেও বহুদিন এই মেট্রো = মাটির নিচে হ্যালুটা গ্যাঁড়াকে ছেড়ে যায় নি। দিল্লির মেট্রো রেল সার্ভিস অবশ্য মাটির ওপর নিচ মিশিয়ে। এমনকি কাশ্মীরি গেট আর রাজীব চকে মাটির নিচেই দুটো আলাদা লেভেলে মেট্রো চলে, আলাদা রুটে। আর্কিটেকচার, টেকনোলজি, সময়ানুবর্তিতা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই, কলকাতার অনেক পরে হবার দরুণ, কলকাতা মেট্রোর থেকে অনেক অনেক বেশি এগিয়ে।

    কিন্তু জনগণেশের ভিড় ছাড়বে কেন? গ্যাঁড়ার বাড়ির সবচেয়ে কাছের মেট্রো স্টেশন, এই মুহুর্তে, দিলশাদ গার্ডেন। ইতিমধ্যেই তা সর্বাধিক ভিড়াক্রান্ত স্টেশনের তকমা অর্জন করেছে। অফিস টাইমে মেট্রোর তরফ থেকে এক রকমের ধাক্কা পুলিশের বন্দোবস্ত করা থাকে বিশেষ কিছু স্টেশনে, যেমন কাশ্মীরি গেট। তারা মেট্রো ট্রেনের দরজা খুললেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের প্রায় ধাক্কা মেরে ঠেসেঠুসে ঢোকায় কামরার ভেতর, মানে যতক্ষণ ঢোকানো যায় আর কি! ক্যাপাসিটির বাইরে চলে গেলে বাকিদের ট্রেনে ওঠা থেকে নিবৃত্ত করাও এর কাজ, এবং দেখা, যে ট্রেনের দরজা ঠিকমত বন্ধ হল কিনা। মেট্রো চালু হওয়ায় আশা করা হয়েছিল যে, রাস্তার ওপর দিয়ে চলা যানবাহনের চাপ অন্তত কিছুটা কমাতে পারবে এই মেট্রো। কিন্তু কোথায় কী? রাস্তায় গাড়ি তো কমেই নি, বরং মেট্রোও হয়ে উঠেছে একইরকম বিভীষিকাময়, বিশেষত, মেয়েদের জন্যে। দিল্লি এমনিতেই মেয়েদের মানুষ হিসেবে ইজ্জত দেয় না, মেট্রোতে মহিলাদের সিটে তাও মহিলাদের বসতে দেওয়া হয়, দিল্লির বাসের মত ছোকরারা লেডিজ সিটে বসে আরামে সফর অন্তত করে না, কিন্তু সেটুকু জায়গাও যখন ফুরিয়ে যায়, তখন তো ভিড়ের ধাক্কাধাক্কি কলকাতার বাসেও যেমন, দিল্লির মেট্রোতেও তেমন। তফাৎ শুধু এটুকুই, মেট্রোর কামরা থাকে বাতানুকূল।

    বদলাচ্ছে দিল্লির বাসও। চিরাচরিত অ্যালুমিনিয়ামের বডির হলুদ সবুজ ডিটিসি বাস বদলে এখন রাস্তা ছেয়ে যাচ্ছে সবুজ রংয়ের টাটা স্টারবাস, হাই ক্যাপাসিটি, লো ফ্লোর। আসলে, লো ফ্লোরটা বাদ দিলে এই নতুন বাস আদপেই হাই ক্যাপাসিটি নয়। দাঁড়াবার জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই, আর সুবিশাল সাইজের জন্য সমস্ত রাস্তায় সমান গতিতে চলতেও পারে না এই বাস। এর চেয়ে আগের ডিটিসি বাসে বেশি লোক যেতে পারত, বাস যেতও জোরে, গায়ে হাওয়া লাগত, কিন্তু এই বাসের দরজা বন্ধ না হলে বাস চলতে পারে না। জুন মাসের গরমে নতুন হাই ক্যাপ বাসের ভেতরে বসার জায়গা না পেলে সে সফর যথেষ্ট বেদনাদায়ক।

    আসন্ন কমনওয়েল্‌থ গেম্‌সের কথা মাথায় রেখে দিল্লিতে নেমেছে বেশ কিছু এসি বাসও। ঐ একই মডেলের হাই ক্যাপাসিটি লো ফ্লোর বাস, কেবল রংটা চেরি রেড। নির্দিষ্ট কিছু রুটে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য চালানো হয় এই এসি বাস। দিল্লির জনসংখ্যা আর গরমকালের তাপমাত্রার কথা মাথায় রাখলে এর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য, ধর্তব্যে আসে না।

    অনেক কিছু পাল্টাচ্ছে। রাস্তায় পড়ছে নতুন ম্যাস্টিক অ্যাসফল্টের প্রলেপ, উন্নত হচ্ছে সিগন্যালিং সিস্টেম, গড়ে উঠছে ফ্লাইওভারের পর ফ্লাইওভার, দেশের তামাম ভিআইপিদের বাস এই শহরে, তাই বাজেটের কমতি হয় না কোনও উন্নয়নমূলক কাজের জন্যই, কিন্তু আসল জিনিসটা? মানুষগুলো?

    তারা বদলায় না। বিয়েশাদিতে পয়সা বৈভবের বিকট দেখনদারি, মেয়েদের প্রতি স্বভাবজাত অভব্যতা, সুযোগ পেলেই টাকা পয়সা ঝেড়ে দেবার অনবদ্য অভ্যেস, এসব যেমন ছিল, তেমনি আছে। প্রিপেড অটো বুথ হয়েছে, কিন্তু তাতে করে সাধারণ মানুষের প্রথমবার দিল্লিতে পা রাখার পরমুহুর্তের হয়রানি এতটুকু কমে নি। বিদেশিরাও এমনকি, এ শহরে এতটুকু নিরাপদ নয়। ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ, তবু শহরের রাজপথে ভিখিরির, এবং ভিখিরির ছদ্মবেশে ছিনতাইবাজের কমতি নেই। রাত আটটার পরে এখনও এই শহরে মেয়েরা একা পাবলিক বাসে চড়তে ভয় পায়। লেডিজ সিটে জোয়ান পুরুষ বসে থাকলেও তাকে উঠে যাবার অনুরোধ করতে সাহস পায় না নবাগতা নাগরিক।

    তা, কী আর করা যাবে! ইট-কাঠ-কংক্রীট-শ্যাওলা-ময়লা দিয়ে শহরের মানচিত্র পাল্টে দেওয়া যায়, মানুষের মন পাল্টানো তো মুখের কথা নয়। আর তা ছাড়া, খারাপ লোক কোন শহরটায় বা না থাকে? দিল্লিতে না-হয় একটু বেশিই থাকে। ভালো মানুষজনও তো থাকে প্রচুর। তা ছাড়া, শহরটাকে ভালোবাসার ব্যাপারে গ্যাঁড়ার তো বিশেষ কোনও চাপ নেই, যদিও গেঁড়ির আজও মন বসে নি এ মহানগরে। কে না জানে, সুপ্রাচীনকালে অধ্যাপক বৈ চক্রবর্তী বলে গেছিলেন, দিল্লিকে ভালোবাসতে গেলে প্রথম শর্ত, পুরুষ হতে হবে।

    তা এমন শর্ত কঠোর ভাবে মানা যাক বা না-ই যাক, অনেক মেয়েই আছে, যারা দিল্লিকে ভালোবেসেও ফেলেছে। ঐ যে গ্যাঁড়া প্রথম পর্বেই লিখেছিল, দিল্লিকে অপছন্দ করার যদি হাজারটা কারণ থাকে, তা হলে পছন্দ করার আছে এক হাজার একটা। তো, এই অপছন্দ পছন্দ মিলেমিশেই একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া। গ্যাঁড়ার মেয়ে ভূতো এখন দিল্লির বুকেই বড় হচ্ছে, হয় তো তার পুরো বড় হওয়াটাও ঘটবে এখানেই। বাংলাকে সেভাবে চিনবে না, অনুভব করবে না। গ্যাঁড়া গেঁড়ির মধ্যে বছরে একবার দুবার বাড়ি যেতে চাওয়ার যে আকুলিবিকুলি, গিয়ে পড়তে পারলে আরও কিছুদিন থেকে আসার যে ব্যর্থ ইচ্ছে মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কেটে উঠেই মিলিয়ে যায় বাস্তবের রাজধানী এক্সপ্রেসের কামরায়, হয় তো সেই আকুলিবিকুলি, সেই বুড়বুড়ি ভূতোও একদিন অনুভব করবে, হয় তো অন্যভাবে, যদি উচ্চশিক্ষা বা চাকরি বা বিবাহসূত্রে সে পাড়ি জমায় দিল্লি থেকে আরও বহুদূরের কোনও শহরে, যেখান থেকে চাইলেই বাবা মায়ের কাছে চলে আসা যায় না। কেবল যোগাযোগ রাখা যায় গুগল চ্যাট আর স্কাইপের মাধ্যমে, নয় তো এসটিডি, সপ্তাহে একবার। আকর্ষণগুলো ছড়িয়ে যায়, কিন্তু রয়ে যায় অদৃশ্যভাবে। এক শহর থেকে অন্য শহরে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এইভাবেই ছড়িয়ে পড়ে মানুষ। সেদিনও যদি গুরুচন্ডা৯ বেঁচে থাকে, গ্যাঁড়ার মেয়ে যদি সেদিনও বাংলা ভাষাকে অন্তত মনে রাখতে পারে, হয় তো অন্য কোনও শহর নিয়ে লিখতে বসবে বুলবুলভাজা।

    সে যাই হোক, আপাতত গ্যাঁড়ার এই দিল্লির কিস্‌সা এখানেই খতম। অনেক গল্প করা হল, করা হল না আরও অনেক অনেক বেশি গল্প। আবার কোনও সন্ধ্যেয় বসা যাবে একদিন, মুড়ি চানাচুর নিয়ে।

    আপাতত নটেগাছকে এইখানেই মুড়নো যাক।

    (অউর নেহী চলেগা, এইবার থামেগা, ও হিরো, অব রুক্‌ জাইও)

    জুন ১১, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২১ জুন ২০০৯ | ৭৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন