অপরাধ? অপরাধ গুরুতর। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, এবং দেশদ্রোহিতা। অন্তত অভিযোগের বয়ান অনুযায়ী, সেই রকমই।
কী করেছিলেন আরিফ? ... কী করে আবার! দুয়ে দুয়ে চার করতে পারছেন না? সেই ড্যানিশ কার্টুনিস্টের নাম শোনেন নি? প্রফেট মোহাম্মদের কার্টুন এঁকে যিনি আপন প্রাণটা খোয়াতে বসেছিলেন? মকবুল ফিদা হুসেনের নাম শোনেন নি? ইনিও তো ছবি আঁকেন! নিজের দেশে ফিরতে পারেন না কেন? আরিফের অপরাধও সেই পর্যায়েরই। রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা। আবার যে-সে ধর্ম নয়, ইসলাম ধর্মের "ভাবাবেগে', তাও, খোদ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বসে, যার জন্ম হয়েছিল একটা ভাষাকে ভালোবেসে, এখন দিন কাটে ধর্মকে ভালোবেসে। বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিকগুলির মধ্যে একটা হল "প্রথম আলো'। সেখানে নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন আরিফ। মিডিয়া হাউসের যে ধরণের টার্ম্স অ্যান্ড কন্ডিশন্স থাকে, সে-সব মেনেই, যেমন, আরিফ যতদিন প্রথম আলোয় কাজ করবেন, ততদিন তিনি অন্য কোনও পত্রিকায় তাঁর আঁকা দিতে পারবেন না ইত্যাদি। ২০০৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রথম আলোর "আলপিন' নামক ম্যাগাজিনে আরিফের একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়। গণ্ডগোলের সূত্রপাত হয় তার পর থেকে। মৌলবাদীরা, সব সময়েই সব দেশেই ছুতোর অপেক্ষায় বসে থাকেন ওঁত পেতে, বাংলাদেশও সে ব্যাপারে এমন কিছু ব্যতিক্রমী রাষ্ট্র নয়। বায়তুল মোকার্রম নামে ঢাকার সর্ববৃহৎ মসজিদের মোল্লারা নবী মোহম্মদের অবমাননার দায়ে প্রকাশ্যে পোড়ালেন আলপিনের সেই সংখ্যা, এবং কার্টুন আঁকা ও প্রকাশ করার দায়ে প্রথম আলোর সম্পাদক ও আরিফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের করার ও চরম শাস্তি ঘোষণা করার দাবি জানালেন। মিডিয়া হাউসের টার্ম্স অ্যান্ড কন্ডিশন্স অনুযায়ী সংবাদপত্রে প্রকাশিত যে কোনও খবর, প্রবন্ধ, ছবি বা কার্টুন সম্পূর্ণভাবে সেই সংবাদপত্রের সম্পত্তি এবং সেই সংক্রান্ত যে কোনও বিতর্ক বা অবমাননার দায় পত্রিকার ওপরে, বা আরও ছোটো করে বলতে গেলে, পত্রিকার সম্পাদকের ওপরেই বর্তায়। প্রথম আলোর সম্পাদক, মতিউর রহমান সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবগত ছিলেন। তড়িঘড়ি তিনি ক্ষমা চেয়ে প্রথম আলোয় বিবৃতি দেন এবং সেটা ছাপা হয় পত্রিকার সম্পাদকীয়র কলামে। কলামে লেখা ছিল এর পর থেকে আরিফের আর কোনও কার্টুন প্রথম আলোয় ছাপা হবে না। মতিউর রহমান বায়তুল মোকার্রমের কাছে ব্যক্তিগতভাবেও ক্ষমা চান। বায়তুল মোকার্রম, কেবলমাত্র এতেই পরম সন্তোষের সাথে ক্ষমা করে দেয় সম্পাদককে, এবং তাদের "হিটলিস্ট' থেকে বাদ দিয়ে দেয় মতিউর রহমানের নাম। ক্ষমা পায় না কার্টুনিস্ট আরিফ। বাংলাদেশ একটি ইসলামিক দেশ। ইসলামের অবমাননা কোনওভাবেই ক্ষমা পায় না রাষ্ট্রের চোখে। মৌলবাদী অসংখ্য সংগঠন রাষ্ট্রের হয়ে সেই চোখ আর কানের কাজ করে দেয়। সিআইডি আসে আরিফের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডে সিআইডির দফতরে। চলে জিজ্ঞাসাবাদ। বার বার ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন আসে, আরিফ কার নির্দেশে, বা বুদ্ধিতে ঐ কার্টুনটি আঁকতে প্ররোচিত হয়। বলাই বাহুল্য, প্রতিবারেই আরিফ জানায় যে আর কেউ না, সে নিজেই নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতার মাধ্যমে কার্টুনটি আঁকে, তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজে সম্বোধন প্রথাকে নিয়ে সামান্য মস্করা করা, ইসলাম ধর্মকে আঘাত দেবার কোনওরকম দুরভিসন্ধিই যে তার ছিল না, এবং এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য সে বারবার ক্ষমা চাইতেও প্রস্তুত। প্রসঙ্গত, সিআইডির হেফাজতে থাকাকালীন আরিফের ওপর কোনওরকম বাজে ব্যবহার বা মারধোরের ঘটনা ঘটে নি। বরং এক গোয়েন্দা অফিসার অনুরোধ করে সেইখানে সেই অবস্থাতেই আরিফকে দিয়ে একটা কার্টুন আঁকিয়ে নেন, স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিজের কাছে রেখে দেবার জন্য। আরিফের জবানিতে : ""... আমাকে তেজগাঁ থানায় হস্তান্তর করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার আগে একজন গোয়েন্দা অফিসার আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন। তার কম্পিউটারে দেখালেন আমার পুরস্কার পাওয়া কার্টুনগুলো। বললেন তার ভাই নাকি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালে চাকুরি করেন, তার কাছ থেকেই তিনি এগুলো সংগ্রহ করেছেন। এরপর আমাকে অনুরোধ করলেন একটা কার্টুন এঁকে দিতে। আমি একটু বিব্রত হলাম। বললাম আমার মানসিক অবস্থা কার্টুন আঁকার মত নয়। উনি পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন যা খুশি একটা কিছু এঁকে দিতে, উনি সেটা স্মৃতি হিসেবে রাখতে চান। অগত্যা আঁকলাম। একজন তরুণ ম্লান মুখে বসে আছে, আর অন্য একজন তার সঙ্গে কথা বলছে। ঠিক কার্টুন নয়, স্কেচ। ... উনি খুব প্রশংসা করলেন সেটার। আমার স্বাক্ষর নিলেন।'' |