এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • "সলওয়া জুডুম' ঃ দ্য এম্পায়ার স্ট্রাইক্‌স ব্যাক?

    রঞ্জন রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৭ মে ২০০৯ | ৭৯৩ বার পঠিত
  • উনিশ'শ আটষট্টির শেষের দিকে স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকায় একট ছোট্ট খবর বেরিয়ে ছিলো এই মর্মে, যে, বস্তারের রাজধানী জগদলপুরে দেখা গেছে নকশাল পোস্টার। আর, এই পোস্টার লাগিয়েছে যে বদমাসরা, পুলিস তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে খবরটি বেরোয়নি তা হল ঐ পোস্টারগুলো লাগিয়েছিলেন ইস্পাতনগরী ভিলাই থেকে আসা দুই বাঙালী যুবক। পরবর্তীকালে এঁরা ধরা পড়ে যান। মুচলেকা দিয়ে একজন বেরিয়ে আসেন। আর একজন মাসখানেক বাদে জামিন পেয়ে ভিলাই ফিরে আসেন। স্থানীয় প্রশাসন তখন এই ঘটনাকে গুটিকয় বাঙালীর "" জওয়ানী কী জোশ'' এর বেশি পাত্তা দেয় নি।

    পরবর্তীকালে জানা যাবে, যে, মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসা যুবকটির নাম শঙ্কর গুহ নিয়োগী আর একমাস পরে ছাড়া পাওয়া যুবকটির নাম যোগীন্দ্রনাথ রায় বা যোগী রায়। ঐ মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে এরপর সদ্য সিপিএম থেকে বেরিয়ে নকশালবাড়ির লাইনে সংগঠন গড়তে চাওয়া এই দুই বন্ধুর মতান্তর থেকে মনান্তর হয়। বীরভূমের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের ছেলে যোগীরায় ভিলাইয়ে ১৯৭০ এর এপ্রিল মাসে লেনিনের জন্মদিনে ভিলাই ইস্পাত কারখানার আরামের চাকরিটি ছেড়ে সিপিআই( এম- এল) নামক রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। আর ওনার অভিযোগে গুহনিয়োগী এম-এল দল থেকে বিতাড়িত হন।

    পরবর্তীতে এই দুজনের জীবন দুটি খাতে বয়ে যায়। যোগীরায় এক বছর পর বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রাক্কালে চিরিমিরি কয়লাখনি এলাকায় খনিমজুর দের ও আদিবাসীদের নিয়ে সংগঠন গড়তে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৫এর পর ছাড়া পেয়ে আস্তে আস্তে বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বীরভূমের গাঁয়ে ফিরে যান। প্রৌঢ় যোগী রায় এখনও সেখানেই সম্মানিত সাদামাটা নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করেন।

    আর শঙ্করগুহনিয়োগীর জীবন বয়ে গেল অন্যভাবে। জলপাইগুড়ি থেকে ভিলাইয়ে আসা বিধবা মায়ের এই একমাত্র ছেলে কিছুদিন রাজাড়ার ক্যাপটিভ মাইনস্‌ এর মজদুরদের মাঝে আত্মগোপন করে রইলেন। ছত্তীশগড়ি ভাষা শিখে ঐ সমাজের এক মহিলা আশা সাহুকে বিয়ে করলেন। নিজেকে শংকরলাল সাহু বলে পরিচয় দিতেন। তৈরি হল ছত্তিশগড়ি মুক্তিমোর্চা, যার জঙ্গী মজদুর আন্দোলন ক্রমে ক্রমে এক আলাদা ইতিহাস গড়লো। বিখ্যাত সেতারবাদক বুধাদিত্য মুখার্জীর বাবা বিমলেন্দু মুখার্জী তখন ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের ক্যাপ্টিভ মাইনস এর জেনারেল ম্যানেজার। আন্দোলনরত মজদুররা বিমলেন্দুবাবুকে ঘেরাও করে প্রায় বন্দী করে রাখে। পরের দিন বিরাট পুলিস বাহিনী এসে ওনাকে মুক্ত করে । কিন্তু শংকর গুহ নিয়োগীকে রাত্তিরে শোয়া অবস্থায় মজদুরদের মধ্যে থেকে গ্রেফতার করতে চাইলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ছ'জন মজদুর গুলিতে মারা যায়। মন্ত্রীরা এসে আলোচনায় বসতে চান। এভাবে ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা জন্ম নিলো। দিন দিন ওদের সদস্যসংখ্যা বাড়তে লাগলো। কোলকাতা থেকে পাশ করা ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণ (আমাদের সময়ের প্রেসিডেন্সী কলেজের স্ট্যাটিস্টিক্স এর বিখ্যাত অধ্যাপক ড: অতীন্দ্রমোহন গুণের ছেলে) রাজাড়ায় শহীদী হাসপাতাল শুরু করে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু করলেন। সরল হিন্দিতে দু'টাকা দামে বই লিখে মেহনতী মানুষের সবচেয়ে বেশি যে অসুখগুলো হয় ( যেমন যক্ষ্মা, আন্ত্রিক জ্বর,) এসবের প্রতিষেধক ব্যবস্থা , অল্প পয়সায় ভিটামিন ও পুষ্টিকর পথ্যের ব্যবস্থা এইসব নিয়ে জনসাধারণকে শিক্ষিত করতে লাগলেন (গুহ নিয়োগী মারা যাবার পর আজকাল আন্দুল-মৌরিতে করছেন)।

    শংকর গুহ নিয়োগী নিজের ফোকাস ছোট করে ছত্তীশগড়ে সীমাবদ্ধ করলেন। নকশালদের আন্দোলনে তখন ভাঁটার টান। শংকর খেয়াল করলেন যে বনজ এবং খনিজ সম্পদে ধনী ছত্তীশ্‌গড় মধ্যপ্রদেশের প্রায় সাতাশ শতাংশ রাজস্বের উৎস। কিন্তু এর বেশির ভাগ ব্যয় হয় ভোপাল-ইন্দোর এলাকার উন্নয়নে। ছত্তীশগড় থাকে উপেক্ষিত। একটা লেখায় বললেন কিভাবে ছত্তীশগড় আলাদা রাজ্য হলে আর্থিক দিক থেকে অনেকখানি স্বনির্ভর হয়ে বিকাশের রাস্তায় পা' বাড়াতে পারে আর তাতে নেতৃত্ব দেবে পিছিয়ে থাকা জনজাতি ও অন্য ভূমিপুত্রেরা। উনি খেয়াল করেছিলেন যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও অন্যান্য উচ্চবর্ণের লোকেরা মূলত: উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে এসেছেন। মধ্যপ্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী রবিশংকর শুক্ল এবং পরবর্তী কালে ছেলে শ্যামাচরণ ও বিদ্যাচরণের রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারে বিশেষ প্রভাব থাকলেও এরা নিজের নিজের কন্‌স্‌টিটুয়েন্সিটুকু বাদ দিলে ছত্তীশগড়ের বিকাশের জন্যে বিশেষ কিছু করেননি।

    যাহোক, সেই সময়টায় ট্র্যাডিশনাল মজদুর আন্দোলনের বাইরে এক নতুন ধারার জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সবার নজর কাড়লো। সারা দেশের বিভিন্ন পকেটেই। থানে-মুম্বাই বলয়ে দত্তাসামন্ত, ভিলাইয়ে শংকর গুহনিয়োগী আর কিছুটা সীমিত ভাবে ধানবাদের কয়লাখনি অঞ্চলে অরুণ কুমার রায়। প্রথম দিকে সবাই হতভম্ব! মালিকপক্ষ তো বটেই, পুরোনো ট্রেড ইউনিয়নরাও। একের পর এক কারখানায় শ্রমিকেরা দলে দলে পুরনো ধরনের ইউনিয়ন ছেড়ে নতুনদের পতাকার নীচে আসছেন। ফিয়েট কারখানার শ্রমিকেরা তো চাঁদা করে নাকি দত্তাসামন্তকে একটি গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন। একধরণের বীরপূজা ও গৌরবগাথা নির্মাণের দিন এল।

    তারপর যা হবার তাইই হল। আঘাত প্রত্যাশিতই ছিল। আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন থানে এলাকার প্রাক্তন সাংসদ দত্তাসামন্ত। কিছুদিন পরে ভিলাইয়ে নিজেদের অফিসঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় সুপারি নেয়া আততায়ীদের জানলা দিয়ে ছোঁড়া গুলিতে নিহত হলেন শংকর গুহ নিয়োগীও। সিমপ্লেক্স কারখানার মালিক শাহ পরিবারের চন্দ্রকান্ত শাহ ও ভাড়াটে আততায়ী পল্টন মাল্লা কয়েকবছর আত্মগোপন করে থাকার পর পুলিসের জালে ধরা পড়লো। নিম্ন আদালত এদের প্রাণদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি দিলেও হাইকোর্ট পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে এদের মুক্তি দিলো।

    প্রশাসন কিছুদিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আপাতত: রায়পুর-বিলাসপুর- ভিলাইয়ের মজদুর আন্দোলন শান্ত। কিছু লক আউট, কিছু ছাঁটাই মাঝে মধ্যেই হয়। ট্রেড ইউনিয়্‌ন কাউন্সিলের মে দিবস পালন বা কখনও সখনও ধর্ণা, মিছিল এগুলো সরকারি কর্মচারি-ব্যাংক- শিক্ষক এইসব সার্ভিস সেক্টরের মধ্যেই টিম টিম করে আছে। কিন্তু হামলা এলো অন্য দিক থেকে। নব্বইয়ের দশক থেকে দক্ষিণ বস্তার অঞ্চলে নকশালপন্থীদের সশস্ত্র অভ্যূত্থান প্রশাসনকে যাকে বলে caught on the wrong foot.

    বস্তারের নকশাল আন্দোলন

    ছত্তীশগড়ের বস্তার জেলা (ইদানীং দুটো জেলা হয়েছে) আয়তনে প্রায় কেরালার মত বা একটু বড়। এদের দক্ষিণপূবে উড়িষ্যার কোরাপুট জেলা আর দক্ষিণে অন্ধ্র- প্রদেশের শ্রীকাকুলাম, দক্ষিণ-পশ্চিমে মহারাষ্টের চান্দা-গড়চিরোলী জেলা গুলো। এ'সবগুলো পুরোনো নকশালএলাকা। গত কয়েক দশক ধরে এই এলাকাগুলোতে জনযুদ্ধ গ্রুপ খুবই সক্রিয় ছিলো। অন্ধ্র প্রদেশে পুলিসের তাড়া খেয়ে ছোট ছোট দলে বস্তার এলাকায় ঢুকে পড়া দলগুলো বস্তারের আদিবাসীদের মধ্যে হিন্টারল্যান্ড তৈরি করে কাজ করছিলো। ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা তূষের আগুন কখন দাবানল হয়ে উঠলো আগে থেকে কেউ আঁচ করতে পারেন নি।

    কলকাতার নকশালদমনে খ্যাতিপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার রণজিত গুপ্ত নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন যে সত্তর-আশির দশকের নকশালরা ছিল স্বপ্নদর্শী বুদ্ধিজীবি। একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার গুরুত্ব নিয়ে কোন সামরিক চিন্তাভাবনা ছাড়াই বালখিল্য ঢংয়ে ওরা ময়দানে নেমেছিল। ফলে পুলিশি দাওয়াই দিয়েই ওদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। কিন্তু আশির দশকের পরবর্তী প্রজন্মের নকশালরা , বিশেষকরে অন্ধ্র গ্রুপ একদম আলাদা। ওদের নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন হবে। মনে হয় ঐ পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসার অতিশয়োক্তি করেন নি। রণকৌশল পাল্টে গেছে। বস্তারে নকশালদের হাতে একে-৪৭, হাথগোলা। বুবি ট্র্যাপ ওরা বহুদিন সফল ভাবে প্রয়োগ করেছে। আর-ডি এক্স দিয়ে পুলিশের জীপ উড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশের দলকে পাহাড়-জংগলের রাস্তায় আলাদা করে ভাগ করে নিয়ে অ্যামবুশ করছে। পরিকল্পিত ভাবে দশগুণ ফায়ার-পাওয়ার নিয়ে এসে ঘেরাও করে থানা বা পুলিশ-ফাঁড়ির ওপর হামলা করছে। এগুলোর সাথে তুলনা করলে ১৯৬৮তে কেরালার পালঘাটে এক মাস্টারমশাই কুন্নিক্কল নারায়ণন, তাঁর স্ত্রী মন্দাকিনী ও অষ্টাদশী মেয়ে অজিতার একটি পুলিশ ওয়ারলেস স্টেশনে হামলা চালিয়ে এক সেপাইকে মারা প্রহসনই বটে। ( মা-বাবা গত হয়েছেন, মাঝবয়েসি অজিতা আজ আর হিংসার পথে স্থায়ী সমাধানে বিশ্বাসী ন'ন।)

    দক্ষিণ বস্তার ডিভিশনাল কমিটি স্বতন্ত্র আদিবাসী রাজ্যের দাবি তুলেছে। ওদের ভাষা "" হাল্বী'' হিন্দি বা ছত্তীশগড়ি থেকে আলাদা। বরং তেলুগুর সাথে মেলে। তাই মূল ছত্তীশগড়ি এলাকার বদলে অন্ধ্র গ্রুপের ""ঘুসপেট'' বেশি কার্যকরী হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে বিখ্যাত লেখক নারায়ণ সান্যাল সম্ভবত: CPWD এর ইঞ্জিনিয়র হিসেবে বস্তারে ছিলেন। সেই অনুভব থেকে লেখা (ওনার আঁকা ছবিসহ) দু'ভল্যুমের "" দন্ডকশবরী'' বেশ প্রামাণ্য বই। আমার বিশবছর আগে সামান্য উঁকি মেরে দেখা বস্তার তার থেকে খুব আলাদা নয়। বস্তারের মূল নিবাসী মারিয়া- মুরিয়া-বাইসন মারিয়া, এরা সব ছত্তীশগড়ের মুখ্য আদিবাসী গোঁড় জাতিরই উপজাতি। প্রধানত: শিকার আর ফল-কন্দ আহরণই এদের জীবনযাপনের মুখ্য আধার। সকাল হতেই এরা ছোট ছোট দলে বেরোয় শিকারের সন্ধানে। রান্নাবান্নার ব্যপারটা বেশ প্রিমিটিভ ধরণের। সেঁকে-পুড়িয়ে- ঝলসে ব্যপারটাই বেশি। এদের ভাষা হল ""হাল্বী''। ঠিক হিন্দি বা ছত্তীশগড়ির উপভাষা নয়, বরং সীমানা পেরিয়ে তেলুগু আদিবাসীদের কথ্যভাষার সংগে মিলটা বেশি। এদের ইকনমি হল বার্টার-ঘেঁষা। কাপড় আর নুনের বদলে অনেকরকম বন্য উপজ ( মাইনর ফরেস্ট প্রোডাকট্‌স) এর বিনিময়। ওদের দেশি পানীয় হল সালপি, শালপাতার ঠোঙা থেকে চুক্‌চুক করে খায়। অনেকটা বঙ্গদেশের পচুই মদের সঙ্গে মেলে।

    বস্তারের রাজধানী জগদলপুরের রাজপরিবার ভঞ্জদেওরা সম্ভবত: উড়িষ্যার ঢেংকানল থেকে এসেছিলেন। ১৯৬৪-৬৫র সময় ওদের তৎকালীন জনপ্রিয় রাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেও তদানীন্তন মধ্যপ্রদেশ সরকারের আদেশ মানতে অস্বীকার করায় পুলিশ আসে। বিশাল মারিয়া আদিবাসী সমাবেশের ওপর গুলি চলে। প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনুগত আদিবাসীদের কম্যান্ড দেয়া অবস্থায় প্রবীরচন্দ্র পুলিশের গুলিতে মারা যান। অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ির বাবা সাংবাদিক তরুণ কুমার ভাদুড়ি সেসময় পূজোসংখ্যা আনন্দবাজারে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আজও জগদলপুরের রাজপরিবারের দশহরা উৎসব এবং তার জুলুস নানা জায়গা থেকে ট্যুরিষ্টদের টেনে আনে।

    বছর কুড়ি আগে জগদলপুর গিয়ে দেখি বস্তারের রাজপ্রাসাদ কিছু সরকারি দপ্তর আর পুলিসের ঘাঁটিতে বদলে গেছে। মন্দিরের আরতি আর হলের গায়ে কাঠের স্তম্ভ আর তার প্রাচীন কারুকৃতি মন দিয়ে দেখে গেলাম প্রাসাদের সামনে জমায়েতের জায়গা আর যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজা গুলি খেয়ে ঢলে পড়েছিলেন সেই জায়গাটা দেখতে। গিয়ে দেখি বারান্দা জুড়ে বালির বস্তাব থাকে থাকে সাজানো আর তার পেছনে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দুই গোর্খা সৈনিক। আমরা পায়চারি করে ফিরে আসি আর তাদের নীরব সতর্ক চোখ আমাদের অনুসরণ করে চলে।

    আজকে বস্তার বদলে গেছে রণাঙ্গনে। কোন পুলিস বা অর্ধসৈনিক দলের জোয়ান একা বেরোয় না। পুলিস কনভয়ের সঙ্গে চলে অ্যান্টি মাইন বস্তারবন্দ্‌ গাড়ি। তবু ঘটনা ঘটে। দেশের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছুটে যায়। রাতের অন্ধকারে কয়েকশ' গেরিলা ঘিরে ফেলে থানা। স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নেয়া শ'খানেক পুলিস ঘুমোয় ছাতে বসানো এলএমজি আর জোরালো সার্চ লাইটের পেছনে অতন্দ্র গার্ডের ভরসায়। কিন্তু ভোরের হাওয়ায় গার্ডের চোখ লেগে আসে আর অতর্কিতে হামলা করে কয়েকশ' সশস্ত্র আদিবাসী। প্রায় জনা-পঞ্চাশের মত সশস্ত্র পুলিশ ও অর্ধসৈনিক ফোর্সের সেপাই কচুকাটা হয়। দু'দিন আগে এস পি অংকিত গর্গের কনভয় পাহাড়ে সার্চ করতে গিয়ে ল্যান্ডমাইন ও ফায়রের সম্মুখীন হয়। দক্ষিণ বস্তারের গায়ে লাগা প্রতিবেশী রাজ্য উড়িষ্যার কোরাপুট জেলায় দিনেদুপুরে মাওবাদীরা জেলাসদরে কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে অনেক বন্দীকে। সেও বেশিদিন আগের কথা নয়। কোন সন্দেহ নেই, আজকের বস্তারের মাওবাদীরা ফায়ার-পাওয়ারের মাপকাঠিতে দেখলে সত্তরের দশকের নকশালবাদীদের তুলনায় অনেক উন্নত, অনেক বেশি শক্তিশালী।

    এম্পায়ার স্ট্রাইকস্‌ ব্যাক্‌

    একটা সময়ের পর দিল্লি সরকার ছত্তীশগড়ের সরকারের মনে হল ""ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটি পাবে আজ এখনি''। আয়োজিত হল নকশাল-প্রভাবিত গায়ে-গায়ে লাগা রাজ্যগুলোর মন্ত্রী-আমলা- পুলিস অফিসারদের বৈঠক। এল কয়েক কোটি টাকার বাজেট। এল হেলিকপটার। এল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিস, নাগা ব্যাটালিয়ন, সাঁজোয়া গাড়ি, মাইন ডিটেকটর। মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা পালা করে নক্‌শালদের হিংসা ছেড়ে বিকাশের মুখ্য ধারায় ফিরে আসতে আবেদন জানালেন। বুদ্ধিজীবিরা বললেন-- নকশাল সমস্যাকে কেবল
    ল' অ্যান্ড অর্ডার এর সমস্যা হিসেবে দেখাটা ভুল হবে, এটি মূলত: আর্থ- সামাজিক সমস্যা।

    কিন্তু কে শোনে কার কথা! না নয়- মণ তেল পুড়বে, না তো রাধা নাচবে!

    সরকার পাঞ্জাবের খলিস্তানি উগ্রবাদ দমনে খ্যাতিপ্রাপ্ত পুলিস অফিসার কে পি এস গিলকে "বিশেষ উপদেষ্টা' করে কিছুদিন রায়পুরে অফিস-বাংলো দিয়ে বসালেন। ট্রেজারি থেকে পয়সা বেরুল। ছত্তীশগড়ের পুলিস অফিসারদের আঁতে ঘা' লাগলো। নকশালরা হামলা তীব্রতর করলো। ক'মাস বাদের গিলসায়েব আপনা মুলুকে ফেরত গেলেন। কিন্তু ছত্তীশগড়ের সরকার বসে রইলেন না। ওরা নিহত পুলিশদের শহীদের সম্মান দিয়ে তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে রাশি ও অন্য সুবিধে ঘোষণা করলেন। তারপর টাডার চেয়েও কড়া ""ছত্তীশগড় জনসুরক্ষা অধিনিয়ম'' তৈরি করলেন, তাতে পুলিশের মনোবল ভাঙে এমন কোন কিছু এই অধিনিয়মের আওতায় আসবে এবং শাস্তিযোগ্য হবে।

    এইবার ঘটল এক আজব ঘটনা। রায়পুর শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে হার্টের ব্যামোর চিকিৎসা করাতে আসা এক বছর পঁয়ষট্টির বাঙালী ভদ্রলোককে পুলিস রাতের বেলা বাড়িথেকে তুলে নিল। ভদ্রলোকের নাম নারায়ণ সান্যাল। তারপর তার কোন খোঁজখবর নেই। ছোটভাই মাধব বিলাসপুরের হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের রিট দাখিল করায় রায়পুরের পুলিস এমনি কোন লোককে আটকে রাখার বা তুলে নেয়ার ব্যাপারটা ঝেড়ে অস্বীকার করলো। শেষে কোর্টের চাপে বল্লো যে ঐ নারায়ণ সান্যাল হার্ডকোর নকশাল নেতা। ওদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। উনিই নাকি কোরাপুট জেলভাঙার মাস্টারমাইন্ড? তবে ওনার নামে কেস আছে অন্ধ্র্‌প্রদেশে, তাই ওখানকার পুলিস রায়পুরে এসে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল নারায়ণ সান্যলকে অন্ধ্র থেকে এনে প্রথমে রায়পুর তারপরে বিলাসপুর সেন্টল জেলে রাখা হয়েছে , যদিও ছত্তীশগড় রাজ্যে ওনার বিরুদ্ধে কোন কেস নেই। কিন্তু বাঙালীর কপাল!

    পিছনে পিছনেই এল পরের ঘটনা। বিনায়ক সেনের গ্রেপ্তারি। ছত্তীশগড়ের পিপলস্‌ ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ্‌ এর সেক্রেটারি বিনায়ক সেন একজন নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার। ভেলোরের গোল্ড মেডালিস্ট। কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। ""রূপান্তর'' নামে একটি এনজিও বানিয়ে জনস্বাস্থ্য ও গরীবের এম্‌পাওয়ারমেন্ট নিয়ে রায়পুরকে ঘাঁটি করে বহুদিন ধরে সুলভে হেল্‌থ ও চিকিৎসার কাজ চালাচ্ছিলেন-প্রায় বিশবছর ধরে। আগের সরকারের কাছেও ওনার নামে কোন নেগেটিভ ইমেজ ছিল না। কিন্তু ওই! খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল এঁড়ে গরু কিনে। যেই না উনি মানবাধিকার উল্লংঘন আর পুলিসের অত্যাচার এসব নিয়ে সিডি বানিয়ে ফেল্লেন আর ফলস্‌ এনকাউন্টার ও নকশাল্‌দের ফলস্‌ সারেন্ডার -- এসব নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করলেন, অমনি গ্রেফতার।

    অপরাধ: এক,ওনার এইসব কাজকম্মো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলায় রত পুলিসবাহিনীর মনোবলের ক্ষতি করবে , ফলে ""জনসুরক্ষা অধিনিয়ম' এর আওতায় আসে। দুই,এসবের আড়ালে উনি একজন হার্ডকোর নকশালাইট। উনি জেলে নকশালনেতা নারায়ণ সান্যালের কাছে কাগজপত্তর- চিঠি এইসব পৌঁছে দিতেন। ক'দিন আগে কোলকাতা থেকে আসা পীযুষ গুহ নামক নকশালদের ক্যুরিয়ার ধরা পড়ায় তার থেকে নাকি এসব ফাঁস হয়েছে। বিনায়কের স্ত্রী ও এনজিও কাজকম্মের সঙ্গী ইলিনা সেন জানিয়েছেন এসব বাজে কথা। বিনায়ক ডাক্তার হিসেবে জেলে যেতেন, সেইসুবাদে নারায়ণের চিকিৎসা করেছেন। বাড়িতে ও কম্পুতে ওনাদের অনুপস্থিতে তালাভেঙ্গে যেসব জব্দ করা হয়েছে তাতে বিনাবিচারে আটক বন্দীদের মুক্তি, পুলিসি অত্যাচার এইসব নিয়ে পি ইউ সি এল এর বিভিন্ন দস্তাবেজ আছে। তাকেই পুলিস নকশাল সাহিত্য বলে চালাচ্ছে।

    শুরু হল বিনায়কের মুক্তি চেয়ে আন্দোলন। তাতে ডাক্তাররা ছাড়াও অমর্ত্য সেন, নোয়াম চ্‌মস্কি থেকে শুরু করে প্রায় বাইশজন লোবেল লরিয়েট ছত্তিশ্‌গড়ের সরকারকে চিঠি লিখেছেন। স্বামী অগ্নিবেশ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যসচিব ও বিলাসপুরের গুরু ঘাসীদাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য্য শরৎচন্দ্র বেহার--কে না প্রতিবাদ করেছেন? গত মাসে প্রতিবাদী ডকুমেন্টারি ফিল্মনির্মাতা আনন্দ পটবর্ধন, লেখক অরুন্ধতী রায় এরা জনা পঞ্চাশ সাথী নিয়ে জেল ও আদালতের বাইরে সত্যাগ্রহ করলেন। তাতে বোধহয় জজসাহেব চটে গেলেন। সরকারী সাক্ষীরা অনেকে হোস্টাইল হয়েছে , তাতে কি? বিনায়কের বেল হোল না। শেষমেষ বিনায়ক নিজে মহামান্য আদালতকে বল্লেন যে ওনার হার্টের প্রবলেম নিয়ে মেডিক্যাল রিপোর্ট শুদ্ধু কয়েকমাস আগে আবেদন দেয়া হয়েছে-- অন্তত: চিকিৎসার জন্যে ওকে প্যারোলে ছাড়া হোক। মহামহিম কেন খেয়াল করছেন না? এবার জজ, আনন্দ পটবর্ধনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেদম চটলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের মত শুনানী মূল্‌তুবী করে উঠে গেলেন। সাধারণ লোক বিনায়কের মুক্তি নিয়ে নি:স্পৃহ। ভাবে যা রটে তার কিছু তো ঘটে। গত মাসেই তো সার্চ করে ফেরার সময় চিন্তামারা গুহার কাছে নকশালদের হামলায় এক সি আর পি ডেপুটি কম্যান্ডান্ট সহ দশজন ভগবানকে প্যারে হয়ে গেলেন। সাধারণ নির্বাচনের সময় অন্তত: গোটা আঠেরো আক্রমণ হল, মারা গেল জনাচল্লিশেক। তাতে পুলিশ আধা-সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে পোলিং ডিউটি করতে আসা ছাপোষা সরকারী কর্মচারী ও আছেন। সরকার একটু কঠোর না চলবে কি করে?

    মানবাধিকার? সিভিল রাইটস্‌? আরে দাদা, আপনি অনেক বড় বড় কথা বলছেন। লেখাপড়া জানা বাঙালীরা এমনি কিছু উদ্ভট কথা বলে থাকে। আমরা জানি যে সময়মত ভাত না পেলে বা ঘরগেরস্থি ছন্নছাড়া করে রাখলে বৌকে দুই থাপ্পড় লাগানো স্বামীর অধিকার, সেটা বৌ ও জানে। কথা না শুনলে, খালি খেলে বেড়ালে, মুখে মুখে তর্ক করলে ছেলেমেয়েদের পেটানো বাপ-মায়ের যুগ্ম অধিকার। ক্লাসে বিরক্ত করলে, পড়া না করে আসলে, বিদ্যার্থী পেটানো মাস্টারের অধিকার। আর গুন্ডা-ক্রিমিনাল-আতংকবাদী ও নক্‌শালদের ঠ্যাঙানো পুলিশের অধিকার। আপনারা অন্য সব অধিকার বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এইসব কথা তুলে অরাজকতা ছড়াতে চান। দেখুন না, রেলের বা বাসের দেয়ালে "ধুম্রপান করিবেন না' কবে থেকে লেখা হচ্ছে, কোন শালা শোনে? যেই একশ' টাকা অর্থদন্ড শুরু হল; অমনি দেখুন, খাল্লাস! আমজনতা আসলে বংশদন্ড চেনে,সুভাষিতাবলী কেউ শোনে না। সেই যে ইন্দিরাজী জরুরী-অবস্থা'র সময় গান্ধীজির দন্ডটি ধার করে জনতার পেছনে ভরে দিয়েছিলেন, তাতেই তো গোটা দেশ একদিনে ডিসিপ্লিন শিখে গেছলো। তা নকশালদের লাইনে আনতে একটা -দুটো ডাক্তার না হয় কদিন জেলে রইলো, কি আসে যায়!

    অতএব?

    রমন সরকার টস্‌ সে মস্‌ নহী হোনে ওয়ালে। ছত্তীশগড়ের আই জি বিশ্বরঞ্জন আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভর্সিটিতে "হিউম্যান রাইটস' নিয়ে বক্তৃতা দিতে। সেখানে একটি গ্রুপ, নেতৃত্বে এক মহিলা, নলিনী সুন্দর, আই জি ভদ্রলোককে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন যে সলওয়া জুড়ুম আন্দোলনের নামে ৬৪৪ গ্রামের লোকজনকে অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছে কেন? আর বিনায়ক সেন শুধু নয়, টি অজয় নামে একজন ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারকেও ক'মাস ধরে বিনাবিচারে রাখা হয়েছে। এ'নিয়ে বাদানুবাদ্‌ শ্লোগান শাউটিং সব হয়। নলিনী সুন্দররা এর ভিডিও তুলে সার্কুলেট করেন। সি জি নেট নামে ছত্তীশগড়ের খবর ও আনুষঙ্গিক নিয়ে যে ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে তাতে পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ হয়। টি অজয় ছাড়া পেয়ে যান। এদিকে মানবাধিকার কর্মীদের প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি দল যায় সলওয়া জুড়ুমের অধ্যয়ন করতে। মাওবাদীরা তাদের ওপরও গুলি ছোঁড়ে। ফলে তাদের রিপোর্টে থাকে দু'পক্ষেরই অমানবিকতার খতিয়ান। কিন্তু সব কথা বলা হলেও সুপ্রিম কোর্ট এটা পষ্ট করেই বলেছে যে ল' অ্যান্ড অর্ডার রক্ষার দায় সরকারের। সে দায়িত্ব এড়িয়ে নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া কোন মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

    আসুন, ব্যাপারটা একটু খুঁটিয়ে দেখি।
    হাল্বী ভাষায় ""সলওয়া জুড়ুম '' মানে ""এস, শান্তিতে থাকি''।
    যা হচ্ছিল, বাইরে থেকে আসা সিআর্পিএফ, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের নাগা ব্যাটালিয়ান সবাই যখন পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে ছোট ছোট ঝুপড়ির মত ঘরওলা পাড়ায় ঢোকে তখন ওদের চোখে সবাই মাওবাদী। প্রায় প্যারানয়েড এই শান্তিরক্ষকেরা যাকে তাকে তোলে, ঠ্যাঙায়, মাওবাদীদের আস্তানা জানতে চায়। এরা চলে গেলে আসে মাওবাদীদলমের সশস্ত্র গেরিলারা। ওরা চায় অন্ন-বস্ত্র-পানীয়। রাতের আশ্রয়। সন্দেহের চোখে দেখে সবাইকে যাদেরই ঘরে বেশিক্ষণ ছিল পুলিস বা খানিকক্ষণ কথা বলেছিল। ওদেরও জীবন অনিশ্চিত, লাইফ স্প্যান কয়েকবছর বা এক দশক। ফলে সরপ্‌ঞ্চ বা কাউকে সন্দেহ করলে "তৎকাল- কোটায়' বিচার করে প্রায়ই মেরে ফেলে। আর আজকাল লড়াইটা বড় হিংস্র হয়ে উঠেছে। তাই প্রাণদন্ডও দেয়া হয় নৃশংস ভাবে। কখনও চোখ উপড়ে, কখনও হাত-পা কেটে, হয়তো উদাহরণ সৃষ্টির জন্যে , যাতে কেউ খোচরগিরির দু:সাহস না করে। আদিবাসীরা মানে ঐ মারিয়া-মুরিয়ারা এখন যায় কোথায়? শুরু হল সলওয়া জুড়ুম। অর্থাৎ এরা দুই যুযূধানপক্ষকেই বললো-- বাবাঠাকুরেরা! আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও। আমরা না নকশালের, না সরকারের। আমরা আমাদের, যেমন ছিলাম তাই থাকবো। আমাদের ভালো কাউকেই করতে হবে না, ঢের হয়েছে।

    এত সোজা? ম্যায়নে কমলি কো ছোড় দিয়া, পর কমলি মুঝকো ছোড়তি নহী। সরকারপক্ষ এটাকে নকশালবিরোধী জঙ্গী আন্দোলনে দাঁড় করাতে চাইলো। ওদের কিছু জওয়ান ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে হাতে বন্দুক ধরিয়ে গালভরা নাম দিল-- স্পেশাল পোলিস অফিসার বা এস্‌ পি ও। ছোঁড়াগুলো হাতে বন্দুক পেয়ে ভাবলো আমরা কি হনু রে! ফলে কখনও বন্দুক দিয়ে এর তার পাঁঠা-খাসি শিকার করে , আবার কিছু ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটায়। ফলে অধিকাংশ জায়গায় এই এস পি ও আর নকশাল দলম্‌ লড়ছে মুখোমুখি। গাঁয়ের লোক যায় কোথায়? একপক্ষ আসলে কিছু লোকের পাঁঠা-মুরগী ভোগে যায়, কটা লোকের ঘরদোর ভাঙে, কয়েকজনের হাত-পা ভাঙে, ক'জনের জান। সবাই যায় গাঁ ছেড়ে। সরকার বল্লে- বেশ, তোমাদের জন্যে থাকা-খাওয়া-শোয়ার ব্যবস্থা করছি। তৈরি হল শান্তিশিবির। পাহারায় রইলেন পুলিস ও এস পি ও। কিন্তু প্রকৃতির সন্তান মারিয়া-মুরিয়াদের কি আর শিবিরে আটকে রাখা যায়। এরা হাঁপিয়ে ওঠে। ফিরতে চাইলে সন্দেহ করা হয়, এরা নকশালদের গুপ্তচর। এরা ভাবে তবু তো সুরক্ষা পাচ্ছি।
    কোথায় সুরক্ষা? রাত্রে চারদিকে ঘেরাবন্দী করে হানা দেয় সশস্ত্র নকশালীদলম। পাইকারী হারে গুলি চলে, হাতবোমা ফাটে। ওরা চলে গেলে হতাশ পুলিস বাহিনী এদের ধরে ঠ্যাঙায়, প্রলোভন দেখিয়ে তৈরি করতে চায়"" আত্মসমর্পণের'' সাজানো গল্প। এছাড়া আছে বেয়াড়াদের তুলে নিয়ে মেরে ফেলে ফল্‌স্‌ এনকাউন্টারের গল্প।

    সেদিন আমার একজন বন্ধু যার মামাবাড়ি বস্তারে, আমার এই লেখার খসড়া পড়ে মুচকি হাসলো। দাদা, আপনি বড্ড কেতাবি। শুনুন, আগে আমার ক'টি প্রশ্নের জবাব দিন।
    এক, নকশালবাড়িতে নকশালরা নেই কেন? কানু সান্যাল-জঙ্গল সাঁওতালেরা বা আপনার কোলকাতার অসীম চ্যাটার্জিরা এখন কি করছেন? দুই,বস্তারের অবুঝমাড় বা বঙ্গের লালগড় --এমনিসব এলাকায় নকশালদের বাড়বাড়ন্ত কেন?
    আমি আমতা-আমতা করি।-- মানে,পাহাড়-জঙ্গল-টেরেন, মানে গেরিলাযুদ্ধের হিন্টারল্যান্ড, মানে--।
    --থাক, আর তোতলাতে হবে না। শুনুন, আসল সমস্যা হল উন্নয়ন। আপনাদেরই কোন কবি লিখেছেন না? "ক্ষুধাতুর শিশুরা তো চায়না স্বরাজ, চায় দুমুঠো ভাত একটু নুন।' এইটেও যেখানে নেই সেখানে কি করবে? আরে, একটা গল্প শুনুন। অবুঝমাড় এলাকা থেকে বছর চার আগে দুটি মেয়ে কোন ট্রাক-ড্রাইভারের সঙ্গে যায় হরিয়ানায়, নগদ রোজগারের সন্ধানে। একবছর পরে একটি মেয়ে গাঁয়ে ফিরে আসে। পুলিস ব্যাটাচ্ছেলেরা সেই ড্রাইভারকে না ধরে অই কমবয়েসি মেয়েটিকে ধরে মেয়েপাচারের কেস দিয়ে জেলে পুরে দেয়। আজ অব্দি মেয়েটির জামিন হয়নি। কেন? ঐ অবুঝমাড় এলাকায় একহাজার লোকের মধ্যে মাত্র দুজন মুখিয়ার জমির পাট্টা আছে। প্রায় পাঁচশ' একর' করে। বাকিদের কাগজে-কলমে কোন জমিই নেই। তাই জামিন করাতে কাগজ কোথায় পাবে? যাও সেই মুখিয়ার কাছে, নগদ হাজারটাকা নিয়ে। সে এই মেয়েটি কোথায় পাবে? কাজেই এখানে নকশালের চাষ হবে নাতো কি হবে? আর এই দলমের ছেলে মেয়ে গুলো? আপনার সরকার এদের জন্যে জঙ্গল-পাহাড়ের মধ্যে এমন স্কুল-কলেজের বন্দোবস্ত করতে পারেনি যে এরা পড়বে। এদের কোন রোজগারপাতি নেই। দলমে জয়েন করলো, দু'বেলা গরম-ভাত , জংলীশাকপাতা আর লংকাপোড়া - পেঁয়াজকুচি দিয়ে ঠেসে খাওয়া জুটবেই। শিকার পেলে তো মোচ্ছব। জামাজুতো কিনতে হবে না। হাতে বন্দুক। ফলে গাঁয়ে ইজ্জত। বাপ-দাদার বয়সী লোকেরা মাথা নোয়ায়। তারপর আছে সেক্স।

    ---মানে? কি যা তা বলছ?

    -- নাক সিঁটকাবেন না। আপনার মধ্যবিত্ত ভিক্টোরীয় রুচিতে ওদের নীতিবোধকে মাপার চেষ্টা করবেন না। ওদের দৈনন্দিন জীবনটাকে বুঝুন আগে।ওদের হল "" ভোজনং যত্র-তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে''। জীবনে আছে অনিশ্চয়তা। দলমে যোগ দেবার পর ওদের বাকি জীবনের গড় আয়ু পাঁচ থেকে সাত-আট বছর। আজ কী জিন্দগি তো জী লে। আর গাছপালাঢাকা দুর্গম পাহাড়ী পথে ওদের চলতে হয় অনবরত, বেশ কয়েক মাইল। খাওয়া আর ঘুমের জোগাড় হয়ে গেলে আর কি এন্টারমেন্ট সম্ভব? পার্ক, লেক, সিনেমা, কবি-সম্মেলন? বইয়ের দোকান? কফিহাউস? --হাসালেন মশাই। শুধু সেক্স,--সহজ সুলভ এবং সুন্দর।ওদের আছে নিজেদের মত করে নৈতিক ও শোভন আচরণবিধি। কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা ঘোটুল প্রথার মধ্যে দিয়ে জীবনসাথী বেছে নেয়। পণ দেয়া-নেয়ার প্রশ্ন নেই। বাগদত্তা মেয়েটি চুলে লাগাবে কাঠের কাঁকই। স্বামী ছাড়া কেউ কাঁধে হাত রাখতে পারে না। তাই যৌনতা ওদের জীবনে খুবই স্বাভাবিক। আপনাদের ""ইন্টু-মিন্টু'' নয়। তাই সলওয়া-জুড়ুম বা "আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও' আন্দোলন সরকারের হাতের ছোঁয়ায় হয়ে গেল "চ্যালেঞ্জ নিবি না, শালা!' আন্দোলন। একদল কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে নকশালরা দিল হাতে অস্ত্র, আর উন্মুক্ত জীবনযাপনের গ্যারান্টি,-- গরীবের রাজ প্রতিষ্ঠা করার নামে। আর এক দলকে সরকার দিল হাতে হাতিয়ার এবং যা-খুশি-তাই করার গ্যারান্টি-- সরকারের অনুমোদিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার নামে। তাই আজ বস্তারে আদিবাসীরাই আদিবাসীদের মুখোমুখি। একদিকে অ্যামবুশ আর জন-আদালতের নামে ক্যাঙারু কোর্ট, আর একদিকে ফলস্‌ এনকাউন্টার ও আত্মসমর্পণের খেল। একদিকে স্বচ্ছন্দ যৌনতা আর একদিকে রেপ।

    একদিকে বিজেপি সরকারের সাথে কংগ্রেসি নেতা মহেন্দ্র কর্মা ---সলওয়া জুড়ুম নকশালদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের স্বত:স্ফুর্ত বিদ্রোহ, আর একদিকে সিপিআইয়ের মনীষ কুঞ্জাম---- সলওয়া জুড়ুম আদিবাসীকে আদিবাসীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার সরকারের খেল।
    "" তুমি কার পাশে,নকশালদের?
    না? তবে কি সরকারের?
    --- আমি কোন দিকেই নেই।
    আমি কাঁদি সেই আদিবাসী বুড়োর জন্যে,
    যে কুড়িয়ে আনতো ফল-পাক্‌ড়,
    শিকার করতো ময়ুর, শুয়োর আর মেঠো ইঁদুর।
    আজকে যার জ্বলে গেছে খোড়োচাল, ভেঙে গেছে মাটির দেয়াল।
    ভ্‌গ্নস্তুপের পাশে বসে ও বোবাচোখে তাকিয়ে আছে নির্মেঘ আকাশের দিকে।''

    মে ১৭, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৭ মে ২০০৯ | ৭৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন