ইশকুল-টিশকুলের হাল হকিকৎ কেমন? আঁখো-দেখি-হাল নিয়ে তৃতীয় সংখ্যা লিখলেন শমীক মুখোপাধ্যায়।
এ বিষয়ে আমরা আরও লেখা প্রকাশ করতে চাই। আপনি নিজেও লিখে ফেলুন না, আপনার অভিজ্ঞতা?
----------------------------------------------------------------
আগের এক্সট্রা কোচ শেষ করার মুখে গ্যাঁড়া যখন লিখেছিল, সর্বোপরি সে খুশি, কেউ বোধ হয় আড়াল থেকে খিল্লি করেছিল। সেই খিল্লির পরিণামে গ্যাঁড়াকে আজ লিখতে বসতে হল এক্সট্রা কোচ টু।
সেই যখন থেকে মায়াপাতায় স্কুল নিয়ে কচকচানি বেশ চাগিয়ে উঠেছে, তখন থেকেই ঘুরে ফিরে একটা কথা উঠে আসছে, কেন আমরা এই ডিজাইনার স্কুলগুলোর পেছনে ছুটছি? হাজার হাজার টাকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছি? কী এমন ক্ষতি হত, যদি আমরা যে সব স্কুলগুলোতে বেড়ে উঠেছি, সেই সব স্কুলেই নিজেদের আত্মজ-আত্মজাদের ভর্তি করতাম? খুব কি পিছিয়ে পড়ত তারা? খুব কি ছিনিমিনি খেলা হত তাদের জীবন নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে?
অন্যদের কথা জানা নেই, গ্যাঁড়া তার নিজের কথা বলতে পারে। বাবার ছিল বদলির চাকরি, পচ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলার গাঁয়েগঞ্জে স্কুল পাল্টে পাল্টে লেখাপড়া হয়েছিল গ্যাঁড়ার। স্মৃতিগুলো, সত্যি বলতে কি, খুব একটা সুখের নয়। মাঝে চার বছর এক মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়টুকু বাদ দিলে। সেই সময়কার আর পাঁচটা ছেলেপুলের মতই গ্যাঁড়া বেড়ে উঠেছিল তার মতন করে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, তার বেড়ে ওঠায়, তার মূল্যবোধ তৈরি হয়ে ওঠার দিনগুলোয়, ... আজ যখন পেছন ফিরে চায় গ্যাঁড়া ..., তার স্কুলগুলোর কোনও হাতই দেখতে পায় না। স্কুল গ্যাঁড়াকে বিশেষ কিছুই দিতে পারে নি। কেবল টিভিতে দেখেছে, মাধ্যমিকে, উচ্চ মাধ্যমিকে যারা ফাস-সেকেন হত, তাদের স্কুলের স্যার দিদিমণির বড়মুখ করে বলতেন, তাঁরা কত যত্ন করে ওমুককে তৈরি করেছেন, স্কুল আওয়ার্সের পরেও তাকে আলাদা করে কোচিং দিয়েছেন স্কুলের মধ্যেই। তার বাবা প্রফেসর, মা দিদিমণি, সাথে প্রাইভেট টিউটর তো আছেনই।
গ্যাঁড়া, বেচারা মফস্সলের ছেলে, কোনওদিন মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করা ছেলেপুলে নিজের চোখে দ্যাখে নি, তাই সেই সব ছেলের মেয়ের জীবনে স্কুলের অবদান সে শুনত টিভিতে, রেডিওতে, খবরের কাগজে পড়ত, অনেকটা রূপকথার গল্পের মতন করে। সে নিজে ছিল, সেই ধরণের সব স্কুল থেকে অনেক, অনেক দূরে।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠা। হ্যাঁ, স্কুলের স্যারেরা অবশ্যই সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু স্কুলের চৌহদ্দিতে নয়, তাঁদের বাড়িতে, আলাদা মাসমাইনের বিনিময়ে। সেইভাবেই জয়েন্ট পাওয়া। স্কুল তো শুধুমাত্র সার্টিফিকেট পাবার জন্য নাম-লেখানোর জায়গা!
শেষ যে স্কুল থেকে গ্যাঁড়া উমা দেয়, আর তারপরে যে-কলেজে গ্যাঁড়া চার বছর পড়ে, দুটোই ছিল সরকারি স্কুল-কলেজ। না, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্থান নয়, সত্যিকারের সরকারি স্কুল কলেজ। সেই কলেজ থেকে চার বছর বাদে গ্যাঁড়া যখন বেরোল, তখন গ্যাঁড়ার মন থেকে পড়াশোনার ইচ্ছে একেবারে উবে গেছে। আশু চাকরি বাকরি পাবার কোনও সম্ভাবনাও নেই।
এই সময়ে, সম্পূর্ণ ফাঁকতালে, গ্যাঁড়া চান্স পায় আইআইটি খড়গপুরে, একটা এক বছরের পিজি ডিপ্লোমা কোর্স করার। আইআইটির দুয়োরাণীর ছেলে তারা, সিংদরজার বাইরে ছিল তাদের ক্লাসঘর, কেবল কনভোকেশনের দিন ডাকা হয়েছিল তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে, কিন্তু ঐ একটা বছরে গ্যাঁড়া যা শিখতে পেরেছিল, তাই দিয়েই গ্যাঁড়া এখনও করে খাচ্ছে। ঐ একটা বছর, তার পুরনো ছাত্রজীবনের সমস্ত না-পাওয়ার যন্ত্রণা সব ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল। সেই দিন গ্যাঁড়া বুঝতে পেরেছিল, হেলাফেলার ইস্কুল কলেজ আর দেশের নামকরা ইস্কুল কলেজে কী তফাৎ! ঐ আইআইটিতে আসা পর্যন্ত কোনও হার্ডলে গ্যাঁড়া তার কোনও স্কুল কলেজের অবদান মনে করতে পারে না, কিন্তু ঐ আইআইটির অবদান, একটা বছরের জন্য, গ্যাঁড়া এ জীবনেও ভুলবে না।
আত্মজা, নিজের শরীরেরই রক্তমাংসের টুকরো বই তো নয়! তো, তাকে কেন সেরা স্কুলে ভর্তি করাবার চেষ্টা করবে না গ্যাঁড়া গেঁড়ি? নিজেদের স্কুল নিয়ে তারা কেউই সুখী ছিল না, অন্তত মেয়েটা যেন এমন কথা বলবার সুযোগ না পায় কখনও। কে না জানে, ডিপিএস নয়ডা দিল্লি এনসিআর অঞ্চলের অন্যতম সেরা স্কুল? প্রথম দশটার মধ্যে? পৃথিবীর তিন নম্বর ডিপিএস?
আস্তে আস্তে বোঝা যায় স্কুল কেমন, কেমন তার ঠাটবাট। না, বাবা মায়ের স্যালারি জানতে চায় নি একবারও, কিন্তু তারা ছেলে মেয়েদের নিয়েছে যে বেছে বেছে সেই রকম ঘর থেকেই, সেটা বুঝতে পেরে গ্যাঁড়ার মনে অল্প হলেও আত্মধিক্কার জেগেছিল। কিন্তু কম্প্রোমাইজেশনের সেই তো শুরু।
গরমের ছুটিতে, নার্সারীর বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছিল। এটা-সেটার সঙ্গে, ওয়াচ ইয়োর মাম্মা টু কুক, হেল্প ইয়োর মাম্মা টু গেট হার ভেজিটেব্লস, হোল্ড ইয়োর স্পুন ইন ইয়োর রাইট হ্যান্ড অ্যান্ড ট্রাই টু ইট ইয়োরসেলফ, ইত্যাদির সাথে এটাও ছিল, হেল্প ইয়োর পাপা ওয়াশ হিজ কার।
অর্থাৎ, এটা ধরেই নেওয়া হচ্ছে, পাপার একটা "কার' আছেই। স্ট্যাটাস সিম্বলটা আস্তে আস্তে ইনডিউস করিয়ে দেওয়া হল।
সারা বছর ধরে বাচ্চাদের চেনানো হল বিভিন্ন ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যাল। কীভাবে? না, মা-বাবাকে সেই সব ফেস্টিভ্যালের কহানি শোনাতে হবে বাচ্চাদের, বাচ্চারা পরদিন "ফ্যান্সি ড্রেসে' এসে সেই ফেস্টিভ্যাল নিয়ে দু লাইন বলবে। টিচারের কোনওই দায়িত্ব নেই।
তাতেও ক্ষোভ ছিল না। মা বাবা শেখালোই না হয়, মেয়ে না-হয় গেরুয়া পাঞ্জাবী পরে পনেরোই আগস্ট গিয়ে ইন্ডিয়ার হ্যাপি বার্থডে মানিয়ে এল, কিন্তু ...
সারা বছর ধরে গ্যাঁড়া দেখে গেল, বৈশাখী আছে, রথযাত্রা আছে, দুর্গাপুজো আছে, দিওয়ালি আছে, গুরুপরব আছে, এমনকী ক্রিসমাসও আছে; কিন্তু ঈদ নেই, মিলাদ উল নবী নেই, ফতেহা দোয়াজ দহম নেই, রমজান নেই। একেবারে নেই। সূক্ষভাবে বাড়িয়ে তোলা হল মাঝখানের ফাঁকটা।
এই করতে করতে কেটে গেল প্রায় প্রথম বছরটা। তারপরে এল সেই সময়, যে-কারণে আজকের এই এক্সট্রা কোচ লিখতে বসা।
স্কুলে হবে অ্যানুয়াল ফাংশন। তার জন্যে একটা কনসেন্ট ফর্ম পাঠানো হল সমস্ত পেরেন্টসদের কাছে। আপনি এই মর্মে সই করে দিন যে, পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটা জুড়ে, যতদিন অ্যানুয়াল ফাংশনের জন্য বাচ্চাদের প্র্যাকটিস অথবা রিহার্সাল চলবে, আপনি সমস্ত রকমভাবে কোঅপারেট করবেন, আপনার কোনও আপত্তি থাকবে না উইকএন্ডেও যদি রিহার্সালের শিডিউল পড়ে। উইকএন্ডে স্কুল বাস দেওয়া হবে না, সেক্ষেত্রে আপনাকে বাচ্চাকে দিয়ে যেতে এবং নিয়ে যেতে হবে, ইত্যাদি প্রভৃতি।
গ্যাঁড়াদের সোসাইটিতে আরো কিছু বড় বাচ্চা আছে, যারা আগে থেকেই এই স্কুলে পড়ছে, তাদেরই একজনের মা একটা ঘরোয়া ক্রেশ চালান, যেখানে ভূতো দুপুরে এসে থাকে। তিনি আরো জানালেন, শুধু উইকেন্ড নয়, উইকডে-তেও স্কুল শেষ হবার পরে ওদের রিহার্সাল করায়, ফেরার জন্য বাস দেয় না, গিয়ে নিয়ে আসতে হয়।
এইবার হল মুশকিল। গ্যাঁড়া তো বেঁকে বসল। গ্যাঁড়া গেঁড়ি দুজনেই চাকরি করে। শনি-রবিবারটা বাদ দিলে কারুরই ছুটি নেই। আর ভূতোর স্কুলটাও খুব একটা কাছে নয়। উইকএন্ডে ভূতোকে নিয়ে যেতে আসতে হলে তাও হয় তো সম্ভব হবে, কিন্তু উইকডে-তে তো একেবারে সম্ভব নয়! দরকার নেই এমন রিহার্সাল করে।
গেঁড়ি অতএব, শেষ ফেমিনাইন জোর খাটালো। সেন্টি, চোখের জল, দোষারোপ ইত্যাদির পরে ঠিক হল ভূতোর ক্লাসটিচারকে ফোন করে গ্যাঁড়া সব জানবে। তারপরে কনসেন্ট ফর্মে সই করবে। এদিকে ভূতোকে নাকি তার ক্লাসটিচার রোজই তাড়া লগাচ্ছে কনসেন্ট ফর্মে সাইন করিয়ে নিয়ে আসার জন্য। চার বছরের একটা বাচ্চার ওপর কত ধরণের চাপ!
গৌরী ম্যামকে ফোন করা হল। ম্যাম বললেন, চিন্তার কিছু নেই, আমরা কেবল দু একটা শনিবারেই রিহার্সাল করাব। উইকডেজে প্রতিদিনই ও স্কুলবাসেই ফিরবে। নো চিন্তা। এমনকী রবিবারেও কোনও রিহার্সাল থাকবে না।
অতএব, নিমরাজি হল গ্যাঁড়া। গেঁড়ি "জিতে-গেছি' মনোভাব নিয়ে দুবার কলার নাচিয়ে গেল গ্যাঁড়ার সামনে।
যে বেস্পতিবার ফাংশান, তার আগের সপ্তাহের শুক্রবার এল বোমাটা। গ্যাঁড়া যথারীতি রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরতেই গেঁড়ি বেশ চোর-চোর মুখ করে গ্যাঁড়ার হাতে একটা কাগজ তুলে দিল। স্কুল থেকে সার্কুলার পাঠিয়েছে। ফাংশনের রিহার্সাল আরো জোরদার হবে সোমবার থেকে। সোমবার আর মঙ্গলবার দুপুর দুটোর সময়ে আপনাকে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে আসতে হবে। স্কুলবাস চলবে না। বুধবার ছুটি।
প্রতিটা স্টেটমেন্টই চোখে জ্বালা ধরানোর মত, ওয়ার্কিং কাপ্লদের জন্য। দুপুর দুটোর সময়ে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়িতে রেখে এসে আবার আপিসে আসা মানে, অর্ধেক দিন নষ্ট। নেহাৎ গ্যাঁড়ার অফিস নয়ডাতেই, তাই গ্যাঁড়াকেই নিতে হল এই গুরুভার।
কিন্তু সুধী পাঠক, সুশ্রী পাঠিকা, ধৈর্য ধরুন। সার্কুলারটা সেখানেই শেষ নয়। তাতে আরও লেখা আছে, আপনার কন্যা হার্ট ডান্স করিতেছে, এতদুপলক্ষ্যে আপনি বিগলিতচিত্তে নিম্নলিখিত জিনিসগুলি দোকান থেকে কিনে ফেলুন। ব্রাইড রেড কালারের লিপস্টিক, ডার্ক রেড কালারের আই শ্যাডো, শিমারিং রেড কালারের ... ঐ গালে যেটা ঘষে, রুজ বোধ হয়, সোনালি রংয়ের গ্লিটারিং পাউডার, আর সোনালী রংয়ের বেলি শু। অনুষ্ঠানের আগের দিন মেয়েকে শ্যাম্পু করিয়ে রাখবেন। অনুষ্ঠানের দিন সকাল সাতটার সময়ে মেয়েকে ফুল মেকাপ করিয়ে স্কুলে জমা করিয়ে দিয়ে আপনারা আবার বাড়ি ফিরে যাবেন। আপনাদের এϾট্র বেলা সাড়ে এগারোটায়। ও হ্যাঁ, সমস্ত মেকাপ কিট মেয়ের সঙ্গেই স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন (অতি অবশ্যই তার থেকে দু চারটে জিনিস হারাবে)।
ছেলেদের জন্য অন্যরকম লিস্ট ছিল, যেটা পড়েই গ্যাঁড়ার ঝাঁট জ্বলে গেল। চুলে জেল লাগিয়ে স্পাইক মতন করে রাখতে হবে, তার ওপরে ঐ গোল্ডেন অভ্রকুচি ছড়িয়ে দিতে হবে। ভাগ্যিস গ্যাঁড়ার বাচ্চাটা মেয়ে! এই ধরণের সাজপোষাক গ্যাঁড়া একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না।
গ্যাঁড়া অনেক কিছু বলবে ভেবেছিল, কিন্তু কনসেন্ট ফর্মে সই করে ফেলেছে, অতএব, গিলে ফেলতেই হল। না গিললে আবার সেই অশ্রুজল, ভূতোর নামে সেন্টি এবং দোষারোপ পুনরাবৃত্তি হত। গৃহশান্তি বজায় রাখাটাও একটা বড় ব্যাপার।
অতএব, শনিবার বিকেলে বেরনো হল মেকাপ এবং "বেলি শু' কিনতে। টার্মটা গ্যাঁড়া গেঁড়ি প্রথম শুনছে। বেলি বটম প্যান্ট শুনেছে, কিন্তু বেলি শু কী জিনিস, কেউই জানে না। প্রতিবেশিনীদের জিজ্ঞেস করে গেঁড়ি যা বুঝল, জিনিসটা পাম শু বা নিউকাট শু-এর মতই কিছু একটা জিনিস।
গ্যাঁড়দের পাড়াতেই বেশ বড়সড় সেক্টর ফোর মার্কেট। লিপস্টিক রুজ পমেটম আইশ্যডো অভ্রকুচি সব জোগাড় হয়ে গেল, কিন্তু সেই সোনালি বেলি শু আর পাওয়া গেল না। খিদেয় পেট চন্চন্ করছে, সেই সময়ে এক জুতোর দোকানে ঢুকে একটা জুতো দেখে মনে হল এইটা সোনালী বেলি শু হলেও হতে পারে।
দোকানদার দাম হাঁকল, আড়াইশো টাকা।
পাগল না সিপিয়েম? এই রকমই জুতো পঞ্চাশ একশো টাকায় হাটে বিক্কিরি হয়, ঐ তো আজই ইন্দিরাপুরমে হাট বসেছে, ওখানেই পেয়ে যাবো, দেখে আসি।
হায়, হাটে ঘোরাই সার হল, বেলি শু পাওয়া গেল, সোনালী রঙেও পাওয়া গেল, কিন্তু ভূতোর সাইজে নেই। একশো টাকা দাম ছিল, বড়দের জুতো। অন্যদিকে আরো একটা হাট দেখা হল, কিন্তু সেই জুতো আর পাওয়া গেল না।
গ্যাঁড়া বলল, ঠিক আছে, কাল নয়ডায় দু জায়গায় হাট বসে, দেখে আসব। ওখানে পাবোই পাবো।
রবিবার গ্যাঁড়া নয়ডার এই সেক্টর থেকে ঐ সেক্টর পর্যন্ত চষে ফেলল, যত হাট, যত জুতোর দোকান জানা ছিল, দেখে ফেলল, কিন্তু ভূতোর সাইজে ঐ গোল্ডেন বেলি শু পাওয়া গেল না। রেগেমেগে গ্যাঁড়া ফিরে এল, দরকার নেই ওর ফাংশান করে। এ কী হ্যারাসমেন্ট? চারশো টাকার তেল পুড়ে গেল একটা একশো টাকার জুতো খুঁজতে গিয়ে!
অতএব, পাঁচন খাবার মত মুখ করে আড়াইশো টাকা দিয়ে সোমবার সন্ধ্যেয় গেঁড়িই গিয়ে কিনে আনল সেই একমেবাদ্বিতীয়ম বেলি শু। তার আগে দিনের বেলায় সেই ক্লাসটিচার গৌরী ম্যামকে ফোনও করেছিল গেঁড়ি, জুতো পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তিনি বলেছিলেন, লাজপত নগর মার্কেট তো আপনার বাড়ির খুব কাছেই, ওখানে চলে যান না, পেয়ে যাবেন। এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন, জুতো তো পরেও আপনার মেয়ে পরতে পারবে! ... প্রথমত লাজপত নগর মোটেই গ্যাঁড়াদের বাড়ির কাছে নয়, বেশ দূরে, এক শহরে থাকলেই যদি সবকিছু "কাছে' হয়ে যায়, তা হলে আইজিআই এয়ারপোর্টও গ্যাঁড়ার বাড়ির কাছে। দ্বিতীয়ত ক্লাসটিচার মহিলা এমনভাবে ব্যাপারটা নিলেন যেন, কয়েকঘন্টার জন্য কাজে লাগা একটা জুতো কিনে কী হবে, পয়সা নষ্ট, এইরকমই হয় তো ভূতোর মা ভাবছে, সেই টোনটা গেঁড়ির কাছে বেশ ইনসাল্টিং লেগেছিল।
আর সত্যিই সে জুতো এমন কোনও মহান কোয়ালিটির ছিল না যার জন্য খরচা করে লাজপত নগর গিয়ে আরও খরচা করে সেই রকম জুতো কিনে আনতে হত। গ্যাঁড়ার পাড়ায় সে জুতোর দাম যদি আড়াইশো হয়, তবে লাজপত নগরে সে জুতো মিনিমাম চারশো টাকা নিত। কিন্তু সে-কথা ক্লাসটিচার ম্যাডামকে কে বোঝাবে! অতএব, শুধু মেয়ের মুখ চেয়েই সে অপমান হজম করতে হল এবং সেই দোকান থেকে আড়াইশো টাকা দিয়ে সেই বিখ্যাত বেলি-শু কিনতে হল।
এর পর দুদিন ধরে সেই দুপুরবেলা স্কুলে যাওয়া, ভূতোকে নিয়ে ফেরৎ আসা, বাড়ি এসে ক্রেশে ভূতোকে জমা করা এবং ফের বিকেল সাড়ে তিনটের সময়ে অফিস যাওয়া। গ্যাঁড়া কিছুতেই বুঝে পেল না, এই স্পেশাল দিনগুলোর জন্যেই যদি স্কুল বাসের সাপোর্ট না দেয়, তা হলে আর পুরো মাসের টাকা কেন দিতে হয়! ভূতোর স্কুলটা সত্যিই ভূতোর বাড়ি থেকে এতটা দূরে, যেতে আসতেই এক এক পিঠে চল্লিশ মিনিট লেগে যায়। পেট্রলের খরচাটা না-হয় বাচ্চার সেন্টির কসম খেয়ে বাদই দেওয়া গেল।
বৃহস্পতিবার, আবারও একটি ওয়ার্কিং ডে-তে স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান। সকাল সোয়া ছটার মধ্যে ফুল মেকাপ করিয়ে ভূতোকে নিয়ে গ্যাঁড়া পৌঁছল ইস্কুলে। তখনও দিল্লিতে বেশ ঠান্ডা। ইস্কুলে পৌঁছে দেখা গেল ম্যাডামরা নাম ধরে ধরে বাচ্চাকে ডেকে ড্রেসের সেট ধরিয়ে দিচ্ছেন। বাকিটা বাবা/মায়ের দায়িত্ব সেই ফুল ড্রেস সেট নিজের নিজের বাচ্চাকে পরিয়ে দেওয়া।
সকাল সাতটা। বাচ্চারা খেয়েদেয়েও আসে নি ভালো করে। একজন ম্যাম হাঁকলেন, বাচ্চোঁ কে লিয়ে রিফ্রেশমেন্ট লা দেনা। দ্বিতীয় ম্যাম অন্য কাউকে একই জিনিস হেঁকে দিলেন। তারপরে ব্যাপারটা কোথায় গেল গ্যাঁড়া আর জানতে পারল না, সে তখন সেফটিপিন দিয়ে ভূতোর প্যান্ট আটকাতে ব্যস্ত, শুধু দেখল যে বাচ্চাদের জন্য রিফ্রেশমেন্ট আর এল না। জামা-প্যান্ট-মোজা-জুতো সব পরানো হলে পরে জানলা দিয়ে দেখা গেল বাইরের ছোট্ট পার্কে সব ম্যামেরা গোগ্রাসে চা-সমোসা খাচ্ছেন।
বাচ্চাদের খাবারের তখনো কোনও খবর নেই। ভূতোর হাতে টিফিনবাক্স ধরিয়ে দিয়ে গ্যাঁড়াকে তখনকার মত বিদায় নিতে হল।
আবার আসা গেল বেলা সাড়ে এগারোটায়। অনুষ্ঠান শুরু হল নির্ধারিত সময়ের থেকে আধঘণ্টা লেটে। একটি খিচুড়ি কনসেপ্ট, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং আসন্ন কমনওয়েলথ গেম্স নিয়ে দেড় ঘন্টার ডান্স ড্রামা, যাতে ভূতোর পারফর্মেন্স ছিল দশ মিনিটের। দর্শকদের চেয়ারগুলো এত দূরে যে কোনও বাচ্চার জুতোই আলাদা করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না, এমনিতেই বাচ্চাগুলো সব কুটি-কুটি সাইজের।
ফাংশান ভালো হল, কিন্তু বিশাল কিছু ভালো হল না, হয় তো কদিনের হ্যারাসমেন্টে গ্যাঁড়ার মনে যথেষ্ট বিষ জমা হয়ে গেছিল বলেই ভালো লাগে নি, মোটের ওপর, "তেমন কিছু লাগে নি'।
তো, এরপরে আর বেশি কিছু লেখার বাকি নেই, এর সাথে সাথেই শেষ হল নতুন স্কুলে ভূতোর প্রথম বছর। এখন আগামী কদিন নাম-কা-ওয়াস্তে ক্লাস হয়ে টয়ে পুরো মার্চ জুড়ে ছুটি পড়ে যাবে।
ও হ্যাঁ, ইতিমধ্যে আরো একটি সার্কুলার এসেছিল। বাচ্চাদের গ্রুপ ফটো তোলা হবে, আর সেই ফটোর এক এক কপি সমস্ত বাচ্চাদের বাড়িতে সরবরাহ করা হবে। তার জন্য যেন অতি অবশ্যই সোমবারের মধ্যে পঞ্চাশ টাকা জমা দেওয়া হয়।
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কী সাইজের ফটো তোলা হবে, আর জানার চেষ্টা করে নি গ্যাঁড়া, চুপচাপ টাকাটা দিয়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছে।
আবার এপ্রিল থেকে শুরু হবে আরেকটা বছর। আবার সার্কুলার আসবে, আজ এই ফ্যান্সি ড্রেস, কাল ঐ ফেস্টিভাল, তারপর দিন বাস আসবে না কারণ স্কুলে আগে ছুটি হবে, তারপরে বছর ঘুরলে আবারও অ্যানুয়াল ফাংশান। বাপ্ রে বাপ্! সে বছর আবার কী চাইবে, কে জানে!
তো, এই হচ্ছে দিল্লির "নামী' স্কুলে বাচ্চাকে পড়ানোর অভিজ্ঞতা। শুধু দাও, দাও, দাও।
সেই নার্সারী থেকে শুরু ... ৯৭৮৬;
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০