এই বাঁদুরে ঘটনা থেকে অর্থনীতিবিদ স্টিভেন লেভিট আর তার সাংবাদিক সঙ্গী স্টিভেন ডাবনার খুব অনুপ্রাণিত হয়েছেন, আর তাদের বইতে লিখেছেন (আরো অনেক অনেক খবরের কাগজে, ইন্টারনেটে লিখেছেন আর সাক্ষাৎকারে বলেছেন) যে এর থেকে প্রমাণ হয় মানুষের টাকার ব্যবহার এক ন্যাচারাল বা প্রকৃতি-প্রদত্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ টাকার ব্যবহার আর নানা জিনিষকে বিনিময়ের সামগ্রী হিসেবে ভাবতে পারাটা মানুষের একচেটিয়া নয়, প্রকৃতিতেও এই ব্যাপারটা আছে। তার মানে যাকে আমরা এতদিন মানুষের সামাজিক বৈশিষ্ট্য বলে ভাবতাম, তার আসলে একটা জৈবিক ভিত্তি আছে, যেটা এই ব্যবহারকে অনড়, স্বাভাবিক আর ধ্রুব বলে প্রমাণ করে।
লেভিট আর ডাবনার-এর এই গবেষণাগারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্ত টানার এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়, এরকম ভূরি-ভূরি উদ্ভট (যার ডিকশনারিতে মানে হল Freak) উদাহরণ ব্যবহার করে তারা তাদের ২০০৫ সালের বই ফ্রিকোনমিক্স লিখেছেন। তারপর তারা আরো গাদা-গাদা উদাহরণ সমাজে আর প্রকৃতিতে খুঁজে পেয়ে ২০০৯ সালে আবার একটা বই লেখেন, যার নাম সুপারফ্রিকোনমিক্স (যার মানে হল মহা-উদ্ভট অর্থনীতি)। দুটো বইয়েরই প্রতিপাদ্য এক, বিভিন্ন উপায়ে দেখানো যে মানুষ জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ লাভ-ক্ষতির হিসেব করে ফ্যালে, আর ইনসেন্টিভ, মানে উদ্দীপনায় সাড়া দেয়। আর শুধু তা-ই নয়, মানুষের এমনধারা ব্যবহার কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক ব্যাপার নয়, বরং এটা একেবারেই জৈবিক, প্রাকৃতিক ব্যাপার।
কি কান্ড, আর বছরের পর বছর একদল বোকা লোক সেই মান্ধাতার আমলের এক দাড়িওয়ালা জার্মান বুড়োর পাল্লায় পরে বেচারা ক্যাপিটালিস্ম্কে কি গালাগালিটাই না দিয়ে চলেছে! মানুষ প্রকৃতির নিয়মে নানা উদ্দীপনায় সাড়া দেয়, সে উদ্দীপনা নিজের ভোগ হতে পারে, আবার একটু মুনাফাও হতে পারে। তা এর মধ্যে আর পুঁজিওয়ালা দের কি দোষ? একটু উল্টে-পাল্টে ভেবে-চিন্তে দেখা যাক বিষয়টাকে। কিথ চেন নামের এক ব্যবহারিক অর্থনীতিবিদ আর তার সঙ্গী-সাথীরা মিলে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগারে বাঁদরের ব্যবহার লক্ষ্য করেন আর তার থেকে মানুষের ব্যবহারের প্রাকৃতিক ভিত্তি খোঁজেন। একদল ক্যাপুচিন বাঁদরকে বহু পরিশ্রম করে আর বহু সময় ব্যয় করে তারা রূপোর চাকতি চিনিয়েছেন, সেগুলোর হাত-বদল হলে যে তার বদলে অন্য জিনিষ পাওয়া যাবে সেটা বারবার করে দেখিয়ে দেখিয়ে শিখিয়েছেন। তারপর দেখা গেল বাঁদররা ঐ চাকতিগুলোকে নিয়ে তার বদলে আঙ্গুর বা জেলি পেতে অভ্যস্ত হয়েছে। এমনকি চাকতিগুলো চুরি করা, বা সেটা দিয়ে সেক্স পাওয়াও দেখা গেল। এখেকে কি প্রমাণ হল? যে টাকার ব্যবহার, টাকার বিনিময়মূল্য প্রকৃতিতেও আছে? আর বেশ্যাবৃত্তিও এক প্রাকৃতিক ব্যাপার? এই প্রশ্নগুলো আমাদের মত কিছু সন্দেহবাতিক মানুষের, যারা আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়-র পাতায় বেরোনো বিশ্বাসী লেখকের লেভিট-বন্দনা (আবাপ, ২০।১২।২০০৯) পড়েই লেভিট-ডাবনারদের বাহবা দিয়ে উঠতে পারে না, বরং আরো বেশি করে নিজের সন্দেহ দূর করার চেষ্টায় জুটে যায়।
সত্যিই কি ইয়েল-এর ল্যাবরেটরির ক্যাপুচিন বাঁদরের দল মানুষের টাকা আর বিনিময়-সংক্রান্ত ব্যবহারকে "প্রাকৃতিক' ভিত্তি দিয়ে দেয়? এটা মেনে নিতে হলে, তাহলে এটাও মানতে হয় যে বাঁদরের ল্যাবরেটরির পরিবেশ আর মানুষের সমাজ, যেখানে টাকা আর জিনিষ আদান-প্রদান হয়, সেদুটো সমান। ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশকে ঠিক কিভাবে মানুষের সমাজ বলে চালানো যায় তার উত্তর মেলা মুশকিল।
আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে ল্যাবরেটরি মানুষের সমাজের যোগ্য তুলনা, তাহলে আরো একটা প্রশ্ন ওঠে। কিথ চেন এন্ড কোং-দের মাসের পর মাস পরিশ্রম করতে হল কেন বাঁদরগুলোর পেছনে? ওদের তো ধৈর্য্য ধরে শেখাতে হল টাকার ব্যবহার। মানুষ ঠিক যেমনভাবে কাগজের টুকরো বা গোল-গোল ধাতুর চাকতিকে টাকা বলে বিশ্বাস করে, সেই একইরকম বিশ্বাস তো ঐ বাঁদরদের মধ্যে পয়দা করে দিতে হল মানুষ গবেষককেই। তাহলে এটা আবার কোনদেশি ন্যাচারাল ঘটনা রইল? আমিই আমার কুকুরকে শেখালাম যে কালু বলে ডাকলে তোমাকেই মিন করা হয়, তারপর সে যখন সাড়া দিতে শিখে নিল, তখন আমি বলতে পারি কি যে এই তো আমার কুকুরের কালু নামটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার?
আরো একটা কথা এখানে এসে পড়বে। বাঁদরগুলো ঐ রূপোর চাকতিগুলো দিয়ে আঙ্গুর বা জেলি নিয়ে আসতে শিখেছিল, কারণ শুধু ঐ দুটো জিনিষেরই বিনিময়ের জন্যে মানুষ গবেষকরা ব্যবস্থা করেছিল। কথা হচ্ছে, বাঁদরের টাকা চাকতি কেন? কেন আঙ্গুর নয়? কেন বাঁদরকে আঙ্গুরের বদলে জেলি কিনতে শেখানো হয়নি? মানুষের সমাজে আজকে টাকা বলতে আমরা যা বুঝি তার ইতিহাস বেশ লম্বা আর ইন্টারেস্টিং। আজকালকার এই কাগজের টাকা, যাকে বলা হয় Fiat Money, তার মূলে তো বিশ্বাস। কাগজের টুকরোগুলোর নিজস্ব কোনো দাম নেই, তার বদলে যা কেনা যায় সেটাই তার দাম। আর এই বিশ্বাস-ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে পড়ে সরকারে দরকার, যার সীলমোহর এই বিশ্বাসকে বয়ে বেড়াবে। তো বাঁদরকে ধরে-বেঁধে শিখিয়ে-পড়িয়ে এই মানুষের সামাজিক বিশ্বাসের একটুকরো পাঠ দেওয়া হল, আর সেটা হয়ে দাঁড়াল এক প্রাকৃতিক ঘটনা!
তর্ক উঠতে পারে, তাহলে দাম বাড়ার সাথে চাহিদা কমে যাবার মত অর্থনৈতিক ব্যাপার যা মানুষের সমাজে হামেশাই চলে, সেটাও যে ঐ বাঁদরেরা দেখিয়ে দিল, তার ব্যাখ্যা কি হবে? এই ব্যবহারও তো বাঁদরদের শেখানো হয়েছে। তাদের বারবার করে দেখানো হয়েছে যে একই সংখ্যক চাকতি দিয়ে আর একই পরিমাণ জিনিষ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক নীতির প্রাকৃতিক ভিত্তি কিভাবে প্রমাণ হল? আর চাকতির বদলে সেক্স, সেটার কি ব্যাখ্যা হবে? সেটা তো এটাই দেখায় যে বেশ্যাবৃত্তি প্রকৃতিতেও রয়েছে। তাই কি? আগেই বলেছি যে গবেষণাগারের খাঁচায় পোরা বাঁদরের শেখানো-পড়ানো ব্যবহারকে প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি বলে ধরে নেওয়ার মধ্যে গোলমাল আছে। যদি বলা হয়, চাকতি দিয়ে সেক্স কেনাটা তো শেখানো হয়নি। ঠিক কথা। কিন্তু "কেনা'-টা তো শেখানোই। চাকতি দিলে বদলে কিছু পাওয়া যায়, এটা তো বিলক্ষণ শেখানো হয়েছে ওদের। সেই কিছুকে বাঁদররা নিজের পছন্দমত ভেবে নিয়েছে। এতে এটা হয়তো প্রমাণ হয় যে কোনো একধরণের ক্রিয়া শেখালে তার সাধারণ বিধিটা বাঁদরগুলো শিখে নিতে পারে। অর্থাৎ চাকতির বিনিময়ে আঙ্গুর পাওয়া যায় এটা শেখালেই ওরা বুঝে যায় যে ঐ চাকতি দিয়ে যেকোনো জিনিষ-ই পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা প্রমাণ হয় না যে মানুষের সমাজের বেশ্যাবৃত্তি প্রকৃতির নিয়ম। Commodification তো একটা বিশ্বাস, যা বিনিময়ের ধারণার সাথে জড়িয়ে আছে। বিনিময়ের ধারণা যদি বাঁদরদের শেখানো যায়, তারা যে Commodification শিখে নিতে পারবে এর মধ্যে বাঁদরের মস্তিষ্কের ক্ষমতা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাঁদের উৎসাহিত হবার কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে অর্থনীতিবিদদের জন্যে কিছু আছে কি, কষ্টকল্পনা ছাড়া?
যদি একথা মেনেও নেওয়া হয় যে, এই গবেষণা প্রমাণ করে যে মানুষের উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া আর বিনিময়ের জন্যে টাকার ব্যবহার ন্যাচারাল ব্যাপার, তাহলে এটা মানতে হবে যে মানুষ তার ভাষা, ইতিহাস, ভূগোল আর সামাজিক আদান-প্রদান সবকিছুর প্রভাবে যেভাবে শব্দের অর্থ নির্মাণ করে, বাঁদর, বা অন্য সব না-মানুষ জীবও সেকাজ একইভাবে করে। ফলে, ইনসেন্টিভ বা উদ্দীপনা, টাকা, চাহিদা-যোগান, কিংবা সর্বোপরি বেশ্যাবৃত্তি এই সব বলতে মানুষ যা বোঝে, না-মানুষেও তা-ই বোঝে। তা নাহলে মানুষের সামাজিক চর্চা কিকরে না-মানুষের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি বলে ধরে নেওয়া সম্ভব?
অর্থনৈতিক ব্যবহারকে সামাজিক না বলে তার জৈবিক শিকড় আছে বলে দেখানোর এই মরীয়া চেষ্টা কেন এইসব ব্যবহারিক অর্থনীতিবিদদের? অর্থনীতিকে বিজ্ঞান বলে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যে, ক্যাপিটালিস্ট ব্যবস্থায় ভোগ আর মুনাফার বাজারি-আদর্শকে চিরন্তন বলে চালানোর জন্যে, নাকি আধুনিকতার সন্তান এই নিওক্লাসিকাল অর্থনীতির নিজেকে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সমর্থক বলে প্রমাণ করার জন্যে, নাকি এর সবকটাই?
আর শেষে যদি এটাও মেনে নেওয়া হয় যে এভাবেই সামাজিক অভ্যেসের বায়োলজিকাল ভিত্তি পাওয়া যায়, তাতেই বা কি প্রমাণ হয়? যে যা কিছু প্রকৃতিতে ঘটে সব কিছুকেই মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই? সেসবই ধ্রুব আর স্বাভাবিক? প্রকৃতি বলতে এখানে তো মানুষের বাইরে জন্তু-জানোয়ারকে বোঝাচ্ছে, তা সেই জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিলে আমাদের পুঁজিবাদী সামাজিক বাস্তবের দশা যা দাঁড়াবে তার দায় নেওয়া যাবে তো? লেভিট-ডাবনার আর তাঁদের স্তাবকেরা শুনছেন?