The culture of all oppressed is the culture of resistance
Thus all artists coming from an oppressed people must represent resistance in their art form.
Kwame Ture
বুকের ভেতর ছোট্ট একটা ধস। আজম খান আর নেই। এই 'নেই' কি নতুন? অনেক দিনই তিনি তো ছিলেন না বললেই চলে। রোগশয্যায় কোমায় চলে যাওয়ারও আগে, বহু দিন ধরে গানের বাজারের বাজারিরা তো তাঁকে একরকম 'কোমা'র মধ্যেই রেখেছিল। তিনি গান বাঁধতেন, কিন্তু কেউ সেধে প্রকাশের গরজ দেখাত না। তিনি সেই বুক তোলপাড় করা আজম খানই ছিলেন, তবু টিভি বা কনসার্টে গাওয়ার ডাক কমে গিয়েছিল। রক্তমাংসের মানুষটি মরে যাওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর সাংস্কৃতিক মৃত্যুর পরিবেশ। তাঁর দিন সত্যিই ফুরিয়ে আসছিল।
সময় বদলে যাচ্ছিল, মন বদলে যাচ্ছিল, রাজধানী-শহর-মফস্বল সব বদলে যাচ্ছিল। বদলে যাচ্ছিল পপগানের জনপ্রিয়তার ব্যাকরণ। এই যুগ ডিজিটাল, এই মন লিকুইড, এর চাওয়া পিচ্ছিল, এর প্রেম অস্থির। সত্তর বা আশির দশকের সেই রোখা মন, চোখা গায়কি, বুনো আবেগের ভাষায় আর সাড়া দেয় না আজকের তরুণ। তাদের মনের পর্দায় এখন অন্য ছায়া, অন্য ছবি, অন্য সুর। কানে আইপড লাগানো রং করা চুলের বাহারি তরুণী কিংবা কোমরঢিলা জিন্স আর ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডেড তরুণ মনে আজম খান কতটা সাড়া তুলবেন আর? তিনি তো আর লিকুইড মডার্নিটির তারুণ্যের ভাবভঙ্গি বোঝেন না। তাঁর দিন ছিল সত্তর দশকের অশান্ত ও প্রতিবাদী চৈতন্যে গড়া। দেশায়ত আধুনিকতার সেই যুগে শহুরে তারুণ্য একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাবকালচার গড়ে নিয়েছিল। তখনও নাগরিকতার ঠাটবাট থেকে তারা দূরে ছিল, দূরে ছিল পণ্যাসক্ত ভোগবাদীতা থেকেও। সেই দিন, সেই মন যত ফুরাচ্ছিল, ততই তাঁর দিনও বুঝিবা ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া তারুণ্য অশান্ত ও হতাশ হয়ে উঠেছিল। আজম খানের গান তখন তাদের ভাষা দিচ্ছিল, জাগিয়ে রাখছিল। তিনিই ঢাকার তরুণদের চিৎকার করে মনের কথা বলার ভাষা ও ভঙ্গি দিয়েছিলেন। তাঁর পুরুষালী গলা ও ঢং তাঁকে পুরুষ-তারুণ্যের জ্ঞনায়কঞ্চ করে তুলেছিল। সনাতন বাংলা গানের পুতুপুতু সুরেলা আমেজ ভেঙেচুরে শিরায় শিরায় রাগি ছন্দের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাবা তাঁকে বলেছিলেন, 'যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।' তিনি কথা রেখেছিলেন। গেরিলা যোদ্ধার বেশ আর ছাড়েননি, কেবল রাইফেল-গ্রেনেড ফেলে গিটার তুলে নিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আহত কিন্তু প্রতিবাদী বাংলাদেশের তরুণদের প্রতীক। সত্যিই সেই দিন কি আর নেই, সেই তরুণেরাও কি হারিয়ে গেছে? তারা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তাদের মনের পিপাসা মেটাবার দায়িত্ব গানের বাজারিরা আর নিচ্ছেন না। কালচার ইন্ডাস্ট্রি এখন ফাঁকা আবেগ আর মোহরতিবাসনার প্রজননক্ষেত্র হয়ে তারুণ্যের দাহিকাশক্তি নি:শেষ করে ফেলছে। এসব দেখেই দেখেই আজম খানের মনে সংশয় জেগেছিল, 'আমার গান এক সময় মানুষকে জাগাইছে হয়ত, তখন ছিল যুদ্ধের পরবর্তী সময়, মানুষের মধ্যে দরকার ছিল যুদ্ধের চেতনা। এখনকার তরুণদের কাছে আমার গান কী সেটা বুঝলে বুঝবেন আমি আসলে কী করছি। ... আমার গান এখনকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তরকে জাগায় কিনা।'
(আজ তাঁর স্মরণে অনেক অনুষ্ঠান হলো টিভি চ্যানেলগুলোতে। একটিতে তিনি শিল্পী আসিফের উপস্থাপনায় দুর্বল শরীরে আসিফের কাঁধে ভর দিয়ে গান গাইছিলেন। শেষ গান হিসেবে গাইলেন, ?'রেল লাইনের ওই বস্তিতে!' গাইতে গাইতে এক্কেবারে হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাড়ি মেরে যতবার হায় বলছিলেন, মনে হচ্ছিল সেটা তার কলিজা চেরা হাহাকার। শেষ কলিতে এসে 'হায় আমার বাংলাদেশ' বলার পরেই বললেন ?, 'হায় আমার ভাঙ্গা দেশ'। তার চোখ দিয়ে তখন অঝোরে অশ্রু ঝরছিল। ঠোঁটে তবু সেই বিনয়। গানটা শেষ হলো না, শেষ হলো এই কথা দিয়ে, এত যুদ্ধ করলাম, এত কিছু করলাম। তাইলে ক্যান এই...বলে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর ক্রোধ দেখেছি, শিশুর মতো কান্নাও দেখলাম। দেখতে হলো।')
এখন নতুন মিডিয়া এসেছে, এসেছে নতুন মেজাজের নতুন গান। এসেছে ফেসবুক আর ইন্টারনেটের বিশ্বায়িত হাওয়া। এখনকার শিল্পী মানে সেলিব্রিটি, তার গলা বা রূপ, ফ্যাশন বা ঝোঁক, প্রেম বা বিলাস- এগুলোই আলোচ্য। সবই যেন শরীরকেন্দ্রিক। গান এখন ক্যারিয়ারের অংশ। আজম খানের একটা বড় মন ছিল, সেই মনে দু:খ-হতাশা-বিচ্ছিন্নতার বেদনা আর রোখ ছিল। ক্যারিয়ার কী জিনিস, তা তিনি জানতেন না। তাঁর গানে আমাদের সত্তর-আশি দশক জীবন্তভাবে ধরা আছে।
দুই.
লেবানিজ কবি খলিল জিব্রান লিখেছিলেন, 'বিদায়ের সময়ই মানুষ বুঝতে পারে তার সত্যিকার ভালোবাসা'। আজম খানের বিদায়ের লগ্নে তাই বুঝতে পারি, তিনি কী ছিলেন। সাংস্কৃতিক এলিটরা তাঁকে নেননি, শিল্পবাদী বুর্জোয়া সংস্কৃতির কাছেও তিনি 'রাস্তার ছেলেই' ছিলেন। এবং রাস্তা থেকে যা উঠে আসে, মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণা থেকে যা জাত হয়, তার মধ্যে প্রতিরোধী উপাদান থেকেই যায়। 'ব্ল্যাক পাওয়ার' মতবাদের প্রবক্তা, ত্রিনিদাদীয়-মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ কওয়ামে তুরে মনে করতেন, সকল নিপীড়িতের সংস্কৃতি হলো প্রতিরোধের সংস্কৃতি...তাই নিপীড়িত জনগণ থেকে উঠে আসা শিল্পীকে অবশ্যই তার শিল্পের আদলে প্রতিরোধের আদলকে ধারণ করতে হয়'। একাত্তরের বেহাত বিপ্লবের বিপ্লবী, হায় বাংলাদেশের হাহাকার জাগানো আজম খানকে তাই প্রতিরোধী চেতনার শিল্পী হিসেবেই ভাবতে হবে। তাঁকে 'গুরু' বলা হয়, কিন্তু তিনি তার থেকেও বেশি কিছু ছিলেন। সত্তর আর আশির দশকের রাগি কিন্তু সরল যুবকদের দুঃখ, হতাশা, ক্রোধ আর প্রেমযাতনাকে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন তাদের ভালোবাসার মানুষ।
তাঁর গানের এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল একেবারে মর্ম ছুঁয়ে যাওয়ার। যখন টান দিতেন 'হায় আমার বাংলাদেশ' বলে, সত্যিই যেন বাংলাদেশের হাহাকারটা বুকে মোচড় দিত। কিংবা ডাকতেন 'ওরে সালেকা ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে' বলে, আপ্লুত হতো মন। সুললিত বাংলা আধুনিক গানের ভদ্রসভায় তাঁর এই 'সালেকা মালেকা ফুলবানু'দের মনে হতে পারত অভব্য, রুচিহীন, জলো। তাঁর জাদুকরি গায়কিতে নিম্নবর্গীয় সালেকা-মালেকাদের প্রতি টান বোধ করত মধ্যবিত্ত তরুণ মন। পপ ঢঙের উঁচু গলার রুখা সুরের গানে যেমন সহজাত তিনি, তেমনি আবিষ্ট গলায় মৃদু সুরে গাইতেন, 'হৃদয় সাগর মরুভূমি, মৌসুমি' অথবা 'সারা রাত জেগে জেগে, কত কথা আমি ভাবি'। আজম খান অজস্র তরুণের কৈশোর আর তারুণ্যের সুবাসিত মনকে ছুঁতে পেরেছিলেন। আমাদের অনেকেরই প্রথম জাগরণের সঙ্গী ছিলেন তিনি। স্যাঁতসেঁতে ভেজা মনকে তিনি তাঁর গ্রীষ্মের দুপুরের রোদের মতো সুরে তপ্ত করে দিতে পারতেন। উচ্চবর্গীয় জলসায় তিনি এক বিদ্রোহী। এ দিক থেকে তাঁর স্বভাবটা ছিল কাজী নজরুলের মতো কোমল ও কঠিন এবং নিঃসঙ্গ এককের। অনেক বড় ও প্রতিভাবান শিল্পী আসবেন, আসছেন, কিন্তু এরকম কোমল-কঠিন স্বচ্ছ মানুষ সহসাই আসবেন না। সেই দিনও নেই, সেই সমাজও নেই।
তিন.
বিরানব্বাই-তিরানব্বই সালের কথা। বগুড়াকে তখন মফস্বলই বলা যায়। সেই শহরে নতুন এক সুপার মার্কেট হলো। তার মধ্যিখানে বসল নতুন এক গানের দোকান। গানের ক্যাসেট তো মিলতই, পছন্দমতো রেকর্ডও করানো যেত। পকেট খরচ জমিয়ে জমিয়ে গান রেকর্ড করিয়ে আনতাম সেই আলতাফ আলী সুপার মার্কেটের ময়না রেকর্ডিং সেন্টার থেকে। আজম খানের কয়েকখানা সংকলন তো শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধু সুমনের হাতে তখন নতুন গিটার উঠেছে। দুপুরের আগে আগে বসতাম গিয়ে শুকনো করতোয়ার পাড়ে, স্টেশন ক্লাবের পেছনে। সুমন গাইত, 'হারিয়ে গেছে, ফিরে পা-আ-আ-বে না'। গিটারের ঝিন ঝিন বাজনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমবেত গলার কোরাস দুপুরের হলুদ রোদকেও যেন কাঁপাত। সেই কাঁপনে আজম খান নামক কোনো এক ঝাঁকড়া চুলের বিপ্লবী বেশের গায়কের সঙ্গে মিশে যেতাম। তিনিও তো আমাদেরই মতো আবেগি আর সরল; কখনো অভিমানী কখনো রাগি। গান তো কানে বাজে না আসলে, বাজে মনে। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে মনের ভেতর বারে বারে বেজে চলেছেন তিনি।
প্রিয় মানুষের মৃত্যু মানে, তাঁকে নিয়ে যত স্মৃতি, যত আবেগ, তারও একধরনের মৃত্যু। আজম খানের মৃত্যুতে আমাদের কয়েক প্রজন্মের প্রথম তারুণ্যের মনের একটি ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। মানুষটি সেই ঘরে আর বসত করবেন না। সেসময়ে বদলে যাওয়া মানুষেরাও তাঁদের ফেলে আসা চৈতন্যের জন্য একটা অপরাধ-মেশানো দু:খবোধ করবেন। তারা আজম খানকে সেই সত্তর-আশির দশকের আবহেই ফেলে এসেছেন, আর নিজেরা প্রবেশ করেছেন নয়া-উপনিবেশিক বিলবোর্ড সংস্কৃতির যুগে। তবু তাঁর গানগুলো ফিরে এসে প্রশ্ন করবে, শূন্যতার বোধকে আরো বাড়িয়ে দেবে। সেই বোধ নিয়েই জুন মাসের এই প্রখর রোদের দিনে রোদের মতো মানুষটিকে আমাদের বিদায় জানাতে হচ্ছে।
অভিনন্দন আজম খান, আপনার অর্জনের জন্য। বিদায় আজম খান, আমাদের অনেক আবেগ আপনার সঙ্গে গেল, আপনার অনেক গান আমাদের কাছে গচ্ছিত রইল।