হুমায়ূনেরই প্রিয় ছিল গানটাঃ উইড়া যায়রে পঙ্খিরে তার, পইড়া থাকে ছায়া। হুমায়ূন আর ছায়া ফেলবেন না, মায়া ফেলবেন। মায়াই তাঁর ছায়া। মায়ার পাখি হয়ে এসেছিলেন, মানুষের মনে মায়াই বুনে গেছেন। যা ছুঁয়েছেন, মায়ার স্পর্শে তাই সুন্দর হয়ে ফুটেছে।
আমরা যারা শহর-নিমশহরে মানুষ; আমাদের শৈশব-কৈশোরটা কোনোভাবেই পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার মতো হওয়ার নয়। তরুণ অপুর কলকাতা যাত্রার গল্প আমাদের নয়। আমাদের উদাস দুপুর, আমাদের অকারণ মন খারাপের কথা কেউ তো বলেনি। আমাদের অস্বচ্ছল সংসারের ‘এইসব দিনরাত্রি’তে কত ছোটো ছোটো অনুভূতির ফুল ফোটে আর ঝরে, কে তা খেয়াল করে? এইসব মৃদু মানুষের মৃদু জীবনের ‘নন্দিত নরকে’র কথা বলবেন কোন ঈশ্বর? কে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের মায়াকে আমাদেরই একজন হয়ে আমাদেরই মতো করে আমাদেরই ভাষায় প্রকাশ করবেন? নগর-উপনগর আর মফস্বলে আমরা ক্ষুদ্র-তুচ্ছ-সামান্য হয়ে ছিলাম। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের তুলে নিয়ে তাঁর জগত সাজালেন, মনের আয়নায় বড় করে দেখালেন। আজ সেই আয়নাখানা হারিয়ে গেল। মায়ার পাখি উড়াল দিল।
আমাদের বেড়ে ওঠার একেকটি অধ্যায়ের হাতে, টেবিলে, বালিশের নীচে, ব্যাগের ভেতর হুমায়ূনের একেকটা বই। মন খারাপের বিকাল, জ্বরতাপিত রাত, নিঃসঙ্গ দুপুর, নিশিবৃষ্টির ক্ষণ, মন দেওয়া-নেওয়ার লগ্নগুলোর স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে হুমায়ূনের একেকটা বই। হুমায়ূনের খোকা, আনিস, পরী, নীলা, রুনু, রাবেয়া ও মন্টুদের সঙ্গ পেয়ে আমরা বড় হয়ে উঠি। তাঁর উপন্যাসের বাবা-মা, ভাই-বোনদের মধ্যে আমরা আমাদের বাবা-মা-ভাই-বোনদের আবিষ্কার করে আপ্লুত হয়ে যাই। পাড়ার মাস্তানটি তাঁর কাহিনীতে ভালবাসার ধন হয়ে ওঠে। হুমায়ূনের মায়ার ছোঁয়ায় সবই কত মানবিক কত চেনা। এভাবে হুমায়ূন আমাদের গত তিন-চার দশকের জীবনীর অংশ হয়ে ওঠেন।
নব্বই দশকের শুরুতে আমাদের ম্যাট্রিকের সময় হুমায়ূন একবার আমাদের শহরে এলেন। ভোরবেলা দেখা করবার সময় পাওয়া গেল। স্থানীয় পর্যটনের মোটেলে উঠেছেন। শীতের ভোরে সেখানে গিয়ে দেখি, শার্ট-প্যান্ট-জুতা পরে সিগারেট জ্বালিয়ে মোটেলের বারান্দায় পায়চারি করছেন। হাঁটছেন, আর শীতের কুয়াশা বারে বারে তাঁকে ঢেকে ফেলছে। সেই কুয়াশা ফুঁড়ে আবার তিনি বেরিয়ে আসছেন। আজ তাঁর জীবনের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, চিরটাকালই ভেতরের মানুষটা কুয়াশাঘেরা হয়েই ছিলেন। মৃত্যুতে সেই কুয়াশা যেন আরো ঘন হয়ে এল, ব্যক্তিমানুষটা সেই কুয়াশার ভেতরে আরো বেশি করে যেন ঢুকে যাচ্ছেন; আর ফিরছেন না।
দুই.
একাত্তরের পরের জঙ্গম সময়ে ঠাণ্ডা নিরুচ্চার বেদনার ধাক্কা নিয়ে এলেন হুমায়ূন আহমেদ। কোথায় পেলেন এই গল্প? এই গল্পের কোথাও বোঝার উপায় নাই, দেশ-ভূগোল-মন থ্যাঁতলানো একটা যুদ্ধসময় পার করে করেও ত্বরাতে পারছে না নতুন দেশটা। আবার আবহটা যেন তেমনই বুক ভেঙ্গে দেওয়া। এরকম সময়ে লোকে মায়াকভস্কি চায়, গোর্কি-নেরুদা-নাজিম হিকমতকে চায়। কেননা বিপ্লব শেষ হয়নি, সোনার বাংলার সাধ তখনো মেটেনি। মুক্তিযুদ্ধের অল্প কিছু পরেই একাত্তরের সাতকোটি মানুষের সাতকোটি গল্প হঠাৎ মুখ বুঁজে ফেলল। এরকম সময়ে এক সামান্য পরিবারের তৎসামান্য আলেখ্য বলতে বসলেন হুমায়ূন আহমেদ। নন্দিত নরকের জন্ম হলো।
সংগ্রামের উত্তাপ তখনো শুকায়নি। জাসদ-সর্বহারা-রীবাহিনীর যুগ। দুঃশাসন-নৈরাজ্য-অনাহারের দিন। সেটাও একরকম নন্দিত নরক। কিন্তু হুমায়ুনের সেই নরকে উত্তাপ নেই। ঠাণ্ডা-স্যাঁতসেঁতে দিশাহীন এক পরিবেশে মৃদু মানুষেরা জীবন অতিবাহিত করছে। সেইসব সামান্য মানুষদের স্বপ্নহীনতা দিয়েই তাঁর শুরু। ছোটো ছোটো কেরানিপ্রতিম স্বপ্ন তারা দেখে বটে, সেও স্বপ্নহীনতার ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ভালবাসবার জন্যই। তারা ইতিহাস গড়বে না। তারা কেবল একটু ভাল করে জীবনের আস্বাদন চায়। হঠাৎ কোনো সসংবাদে দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু দিনশেষে তারা অতি সাধারণ। অসাধারণ কিছুই ঘটে না তাদের জীবনে। মামুলি খুটখাটে ভরা তাদের কর্মকাণ্ড। সব আহাদ সব সুখসাধ বিসর্জনে গেলেও শান্ত মনে পরের দিনটি শুরু করার অধ্যাবসায়ে কোনো কমতি নেই তাদের। শেষাবধি তারা পারিবারিক-সাংসারিক-অযান্ত্রিক। তারা সীমা ডিঙায় না, বিদ্রোহ করে না। নিজের ভেতরের দেব ও দানবকে অনায়াসেই নিস্তেজ করে রাখতে তারা পারঙ্গম।
সারা জীবন এইসব অযান্ত্রিক মৃদু মানুষদের নিস্তেজ জীবনের বিস্তারিত দেখিয়ে যেতে যেতে তাদের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এইসব মানুষেরা জানে, তাঁদের ঈশ্বর তাঁদের স্বর্গে বা নরকে কোথাও পাঠাবেন না। এই পার্থিবতাতেই তিনি তাঁদের রাখবেন এবং ভালবাসবেন। সেই ঈশ্বর তাদের একের পর এক আয়না যুগিয়ে গেছেন। সেই আয়না সামান্য মায়াবী অধিকটা দুনিয়াবি। মায়ার এই মিশেলের জন্যই আয়না তাদের আত্মদহনে ঠেলে না। তাদের চেতনের আকুতি, অচেতনের বিকার এই আয়নার শুশ্রুষা পায়। এইভাবে তিনি এবং তাঁর চরিত্ররা একই মানস-আবহের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন। এইভাবে তাঁর সাহিত্যে সত্তর-আশি দশকের ঢাকাই মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য সংরতি হয়ে আছে স্মৃতিপুঞ্জের আকারে। স্মৃতির ছবিতে কথায় ঘটনায় যেমন সন-তারিখ দাগানো থাকে না, তেমনি হুমায়ূনের চরিত্ররাও সময়হীন এক মায়াপুরীর বাসিন্দা।
আশির দশকে এই মধ্যবিত্ত বড় স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে। ঘর-সংসার-চাকুরি-প্রেম এবং হঠাৎ গরিমার মধ্যে নিজেকে দেখবার সাধ ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। এদের কথা পশ্চিমবঙ্গের নিমাই-শংকর-সুনীল-শীর্ষেন্দুরা কোনোদিন বলেননি। বলবার কথাও নয়। মহান কথাশিল্পীরা চিরটাকাল এদের শ্লেষভরা রসকষে উপো করে মানবতার প্রবাহ খুঁজেছেন আরো তলার মানুষের জীবনে। অথচ এরা আছে, একটু একটু করে জীবন গোছাচ্ছে, জগৎ-সংসারের মধ্যে আরো ঘন হয়ে লেপটে থাকতে চাচ্ছে। এই বিরাট মধ্যবিত্ত সমাজের সাংসারিক আর অলীক আকাংখার বিশ্বাসী জীবনীকার তিনি। চরিত্রদের থেকে নিজেকে বেশি বড় করে দেখেননি, তাদের থেকে বেশি দূরেও যাননি।
এই মহিমাহীন মধ্যবিত্তের মনেই তো হিমুর মতো বাঁধনছেঁড়া দীনতামুক্ত অকপট তরুণের প্রতি আসক্তি জন্মে। নৈতিকতার দেহবন্ধনী আর অসামর্থ্যরে শাঁসানিতে আটক বাসনা ও বিকারের নিদান পাবার মিসির আলীকে দরকার হয়। হিমুর অ-যুক্তির উচ্ছ্বাস আর মিসির আলীর যুক্তির স্থিরশীতলতায় মধ্যবিত্তের আÍদর্শন হয়। নাগরিক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের আত্মা পরম কিছুর জন্য ক্ষুধার্ত হয়। পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রদের দেখি নানারকম অতীন্দ্রীয়বাদী ঘোরে ভুগতে। হুমায়ূন সে পথে নেন না পাঠককে, হিমু আর মিসির আলীর মতো মানবিক সেক্যুলার চরিত্রের সঙ্গ দিয়ে তাদের আত্মিক তৃষ্ণা মেটাবার উপায় করেন।
ষাটের দশকের মধ্যবিত্তের তেমন আত্মিক সংকটের দেখা পাওয়া যায় না সেসময়ের উপন্যাসে। সবই তখন জাতীয় সমাজের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক ল্য খুঁজছে। কিছু অস্তিত্ববাদী নড়াচড়া কারো কারো মধ্যে দেখা দিলেও তা ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য উপভোগ কিংবা তদানুযায়ী জীবনযাপনের পার্শ্বফল। তখনো তাদের গ্রাম আছে, সমাজ আছে, ঐতিহ্য আছে; ফলে শূন্যতা কম। কিন্তু যুদ্ধ পেরুনো সমাজ এক ধাক্কায় সাবালক হয়ে মাটি-ভবন কামড়ে থাকবার উপায় খুঁজতে হয়রান। গ্রাম দূরে চলে গেছে, পরিবারের বাঁধন আলগা হচ্ছে, সংস্কৃতির রস পানসে লাগছে, ভবিষ্যত ভরসা দিচ্ছে না। আশির দশকে এসে এই নগরজীবন বিচ্ছিন্নতার দেখা পায়। এই বিচ্ছিন্নতার ঘের কাটাতে পারে এমন কোনো বড় প্রেরণাও তখন সমাজে অনুপস্থিত। বিশেষ করে উঠতি তরুণ-তরুণীর মনের তৃষ্ণা মেটাবার কিছু ছিল না। হুমায়ুনের সামাজিক আখ্যানের ভেতরে এই নাগরিক চাপা-হাহাকারের উদযাপন হয় না। তাই হিমু আর মিসির আলী চরিত্র তাদের মনের তলাকার ফাপর আর গুমরের মানবিক বিহিতের দায়িত্ব নেয়। বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত এক রসের জন্ম হয়। বাদবাকিটা অসম্ভব প্রতিভাধর এক রসরাজের রসের খেলা, ভাষা আর বাক্যের লীলা।
কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর চরিত্ররা বেশি ভাবে না, কেবল কথা বলে আর কাজ করে। কিন্তু এতটুকুতেই তাদের অন্তরাত্মার খবর পাওয়া যায়। তাদের নানারকম ইচ্ছা হয়, খামখেয়াল হয়, আর তারা সেসব করে ফেলে কিংবা করতে পারে না। এদের মনের তলায় অন্য মন যেন নেই, তারা একমনা একটানা মৃদু মানুষের মৃদু জীবন কাটিয়ে দেয়। হুমায়ূন অবলীলায় কয়েকটি বাক্যে এদের জীবনটা এঁকে ফেলেন।
এরই মধ্যে নব্বই সাল আসে। সত্তরের ধুঁকতে থাকা অনিশ্চয়তা, আশির সামলে নিয়ে গোছগাছে মন দেওয়ার পর নব্বইয়ে সে মুক্ত হতে চায়। যে সেনাশাসনের ধাঁচার মধ্যে সাবেকি জীবনধারা, অন্তর্মূখী সময়, বাধো বাধো নাগরিকতা একধরনের স্থিতির মধ্যে ছিল; বিশ্বায়িত গণতন্ত্র আর মুক্তবাজারের যুগল ডানায় এবার তা উড়তে শুরু করে। বহিরাগত বাসনা আর ভেতরগত তাড়নার তোড়ে পুরনো জগত, পুরনো ঘরগেরস্থালী, পুরনো দেহমন এত সাততাড়াতাড়ি বদলাতে শুরু করে, হুমায়ূনীয় আয়নায় সেই ছবি ততটা ধরা পড়ে না। মৃদু মানুষদের অনেকেই প্রবল হওয়া শুরু করে, অনেকে তাল সামলাতে না পেরে ভাসতে থাকে, তরুণদের সামনে আসে নতুন উত্তেজনা। কেনাকাটার হাত খোলা, মেলামেশায় শরীরখোলা, যোগাযোগে অজড়িত থাকার এই নতুন পরিবেশে হুমায়ূনের আনিস, সাবেত, পরী, নীলারা এক পাশে সরে যায় তাদের কোমল ইনোসেন্সসহ। তিনি তখন আরো পেছনে তাকাতে শুরু করেন, আরো আগের গল্প বনুতে থাকেন। চক্র পূর্ণ হয়, মৃদু মানুষের ঈশ্বর আরো একা হতে শুরু করেন।
তিন.
অবশেষে একদিন মৃত্যু আসে। আর মধ্যবিত্ত তার হারানো মন আর সময়ের স্মৃতিপুঞ্জসমেত হুমায়ূনকে কবর দিতে যায়। ফিরে আসার সময় তাদের খেয়াল হয়, তাদের প্রথম যৌবন থেকে প্রতিটি যৌবনাগত নতুন যুবক-যুবতী হুমায়ূনি জ্যোছনার কুহক-ধরায় ধরা ছিল। সেই সময় সেইসব মানুষ আর সেইসব কল্পনা অবসিত হলে পরে, হুমায়ূনের সাহিত্যিক জীবনীর আজ প্রথম দিন। ইহকাল শেষে হুমায়ূন সাহিত্যের মহাকালে বাস করা শুরু করলেন। সেই কাল ইতিমধ্যে তাঁর সাহিত্যে দাঁত বসানো শুরু করে দিয়েছে। দেখা যাক...