সহৃদয় পাঠক, যিনি আমার এই ব্যক্তিগত গদ্যটি এখন এই মুহূর্তে পড়তে বসলেন, আপনি কি নেশা ভাং করেন? আমার ধারণা অতি অবশ্যই করেন। নেশা এমনই এক টান যার পাল্লায় না পড়ে উপায় নেই। গানের নেশা, গল্পের নেশা, নাচের নেশা, সুরের নেশা, তালের নেশা, ছবির নেশা, কবিতার নেশা, সিনেমার নেশা, নাটকের নেশা আপনার কি নেই? আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, নক্ষত্র, পাহাড়, সমতল, দিগন্ত এদের পাল্লায় পড়ে আপনি কি ঘন্টার পর ঘন্টা কিচ্ছুটি না করে নিজের ভেতর ঢুকে পড়ে, বুঁদ হয়ে সময় কাটান নি? সূর্যোদয়ের মদ, সূর্যাস্তের গাঁজা আপনি কখনো স্পর্শ করেননি বললে আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। অনন্ত রাত্রির কোকেন কখনো কি শোঁকেন নি? এখন মোদ্দা কথাটা হল গিয়ে আপনার সময় নেই। আপনার মাথার ওপর বাঘের মত বস রয়েছে, আপনার বেডরুমে কুমিরের মত হাঁ করে বসে আছে সংসারের হাজার দায়িত্ব।এমনই এক ড্রাগনের সময়ে আমরা বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি, যেখানে আমাদের নেশাগুলিকে অর্থাৎ আমাদের গোটা পৃথিবীটাকেই আমাদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এমনই ফাঁদে আমরা পড়েছি যে আমাদের হাত পা তো বটেই এমন কি বুদ্ধিবৃত্তি থেকে আরম্ভ করে অনুভূতিগুলিকে পর্যন্ত শিকল টিকল জড়িয়ে বেঁধে মোটা জংধরা তালা লাগিয়ে চাবি দিয়ে সে চাবি আমরা নিজেরাই গিলে নিয়েছি, এবং ভুলে গেছি। ভাবুন মশাই সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত এমনই আপনার জীবন যে আপনার নিজের ইচ্ছে মত কিস্যু করার উপায় নেই। আপনার সময় আপনি বিক্রি করে দিয়েছেন। নিজেই করেছেন, এবং এত কম মূল্যে করেছেন (আমি শুধু আর্থিক মূল্যের কথা বলছিনা) যে সর্বক্ষণ আপনার নিজেকে দেখে নিজেরই লজ্জা লাগে। এই রকম একটা সময়ে আপনি কি করবেন? আপনি কিনবেন। কী কিনবেন? নেশা কিনবেন। আর সেই সব নেশা হবে নকল নেশা। পৃথিবীর নেশার মত, মানুষের নেশার মত তারা আপনার আত্মার উন্নতি ঘটাবে না। বরং প্রভাবিত করবে আপনার শরীরকে, আপনার মাথায়, রক্তে, স্নায়ুতন্ত্রে কিছুক্ষণের জন্য এমন রমরমা ছড়াবে যে আপনার মনে হবে আপনি মুক্ত। আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। কিছুক্ষণের জন্যেই আপনার এই যে সর্বক্ষণের দাসত্ব সেটা আপনি ভুলে থাকবেন।একসময়ে আপনার শরীর বিদ্রোহ করবে। আর আপনিও আপনার নেশা থেকে সটান আপনার যন্ত্রণার মধ্যে আছড়ে পড়বেন।আছড়ে পড়বেন সেই জন্য যন্ত্রণা আরো বাড়বে। কিন্তু আপনার মনে আছে সেই ইউফোরিক অবস্থাটা, ফলে আপনি আবার নেশা করতে বাধ্য হবেন, এবং আবার আছাড় খাবেন। এই যে ভয়ংকর লুপ সেটা চলতে থাকবে। আপনার শরীর মন উভয়েই দুর্বল হয়ে পড়বে। আপনি নিজেও সেটা বুঝতে পারবেন। তখন এসে হাজির হবে অপরাধবোধ।আর যেহেতু আপনি সবচেয়ে দুর্বল আপনার নিজের কাছে, সেই জন্য, শুধুমাত্র সেই জন্যেই, আপনি আপনার এই অপরাধবোধের ভারটা চাপাবেন তাদের ওপর যারা বয়সে, পদমর্যাদায়, অথবা শুধুমাত্র আপনার ভাবনায়, আপনার থেকে ছোটো। তাদের ওপর যাদের আপনি ছোটো মনে করেন। আপনি জোর গলায় ফতোয়া জারি করবেন, মেয়েরা মদ গাঁজা সিগারেট খাবে না। আপনি ছাত্রছাত্রীদের একসঙ্গে আনন্দ করতে দেখলে পুলিশে খবর দেবেন। আপনি স্লোগান দেবেন “মদ গাঁজা চরস বন্ধ, তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ?” কবিদের মদ খেয়ে চিৎকার করে কবিতা আবৃত্তি করতে দেখলে, শিল্পীদের গাঁজায় ধুর হয়ে রঙ নিয়ে রাস্তা রঙ করতে দেখলে, আপনার গালিব, শক্তি, র্যাঁবো, পাবলো পিকাসো কাউকেই মনে পড়বে না, মনে হবে এদের হোক ক্যালানো। ইতিমধ্যে আপনার বয়স বেড়েছে, এবং যে ভয়ংকর লুপে আপনি পড়েছেন, তার ফলে আপনার বয়স বাদে অন্য কিছুই বিশেষ বাড়েনি। আপনার শরীর আর দেয় না, ফলে আপনি কৃত্রিম নেশাটাও ধরুন আর করতে পারেন না। ফলে আপনি আরো চেঁচাবেন বব ডিলনকে বলবেন বদ গাঁজাখোর,জন লেননকে বলবেন মাতাল, কবির সুমনকে বলবেন মাওবাদী, লিওনার্দ কোহেনকে বলবেন মাগীবাজ। নোংরামিটাও একটা নেশা। এটা আপনি বুঝবেন না, কিন্তু এই সর্বগ্রাসী নেশাটি আপনাকে টুঁটি চেপে পাকড়াও করবে। দল বেঁধে ঘেউ ঘেউ করতে যে কি মজা, তা তো আপনার পাড়ার কুকুরগুলি আপনাকে প্রত্যেক রাতে দেখিয়েই দিয়েছে। খিস্তি করার আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেশামুক্ত পৃথিবীর দিকে আরো দশ পা এগিয়ে যাবেন। এর ফলে সবথেকে বেশি সুবিধা হবে তাদের যাদের কাছে আপনি নিজেকে বিক্রি করেছেন। বুঝতে পারছেন? সুবিধা হবে ধনতন্ত্রের। এই মাও মাকুদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে, অথবা এদের সঙ্গে নেশা করে ফেলে যদি আপনি একদিন হঠাৎ বুঝতে পেরে যান কে বা কারা আপনাকে বেঁধে রেখেছে, পঙ্গু করে রেখেছে আপনার চেতনাকে, আপনার গোটা জীবনটাকেই, তবে তো তাদের সর্বনাশ। আপনি যদি একদিন আপনি সত্যি কি চান বুঝে ফেলে সমস্ত বাঁধন দুঃস্বপ্নের মত ঝেড়ে ফেলে অনুভব করেন মাথার চারিদিকে হরিণের দৌড়ে আসার মত বৃষ্টির শব্দ, যদি মেতে ওঠেন স্বাধীনতার নেশায়? যদি বলেন না। যদি বলেন আপনি আর নিজেকে, নিজের সময়কে বিক্রি করবেন না, কারোর কাছে? তাহলে স্যার, ম্যাডাম আপনাকে বলছি শুনুন। আপনারা প্রত্যেকে যদি এটা করেন, তাহলে গোটা মেশিনারিটাই বিকল হয়ে যাবে। সেই যন্তরমন্তর থেকে তখন বেরোবে অন্যরকম মন্ত্র। যেমন ধরুন- “দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান”। এবারএকটা গল্প শুনুন। কিছুদিন আগেই এক নেশার আড্ডায় এক শিল্পী আমায় এই গল্পটা বলে। বৌদ্ধ গল্প। বুদ্ধের কাছে এক শিষ্য এসেছে একটা প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্ন খুবই গম্ভীর।
-ধর্ম কী?
বুদ্ধ মৃদু হেসে বললেন ধরো তুমি হাঁটতে হাঁটতে একটা নদী পর্যন্ত এলে। নদীর পাড়ে একটা নৌকা বাঁধা রয়েছে তোমাকে অন্যপারে যেতে হবে। তুমি কী করবে?
শিষ্য উত্তর দিলো সে নৌকাটা খুলে নিয়ে নদীটা পেরোবে।
বুদ্ধ উত্তর দিলেন ওই নৌকাটা হল ধর্ম।
শিষ্য মাথা নেড়ে চলে যাচ্ছে, তিনি আবার তাকে ডাকলেন।
দাঁড়াও গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। প্রশ্নটা হল নদীটা পার হওয়ার পর তুমি কী করবে? নৌকাটা কাঁধে করে চলবে? না নৌকাটা নদীর পাড়েই রেখে চলে যাবে?
এইখানে গল্পটা শেষ। এইবার যে নৌকাগুলো কাঁধে করে চলছি সেগুলোকে যদি একদিন আমরা সবাই নামিয়ে রাখি? তাহলে কি একটা মস্ত বড়ো ভুল চিরতরে শেষ হয়ে যায় না? আর একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। এটাও এরকমই একটা আড্ডায় শোনা। এটা একটা জেন গল্প। ওদের গল্প গুলো প্রায় প্রত্যেকটাই পাহাড়ে হয়।
একবার সেইরকম এক পাহাড়ি পথে এক জেন গুরু এবং তাঁর শিষ্য চলেছেন। শিষ্য দেখতে পেলো একটু দূরে পথের মাঝখানে একটা বড়ো পাথর পড়ে রয়েছে। সে ভাবলো ওই পাথরটায় গুরুর পায়ে লাগতে পারে, সেইজন্য সে তাড়াতাড়ি গিয়ে পাথরটা সরিয়ে রাস্তার ধারে নিয়ে গিয়ে রেখে দিলো। গুরু যেন বা একটু অসন্তুষ্ট হয়েই শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন-
কেন সরালে?
শিষ্য আবার সেই পাথরটা রাস্তার ধার থেকে নিয়ে এসে ঠিক যেখানে ছিলো সেখানেই রেখে দিলো। গুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কৌতুকমিশ্রিত স্বরে বললেন –
আবার সরালে?
বলুন তো, সারাদিন ধরে আমরা কার পাথর, কোথায় সরাচ্ছি? আর সেসব সরিয়ে লাভটাই বা কী? মেহের আলির সেই চিৎকার মনে পড়ে সব ঝুটা হ্যায়। সমস্তটাই আসলে অদ্ভূত একটা ফাঁকি। আর এই ফাঁকিটা যারা তৈরি করেছে তারা অভাবনীয় সুখে রয়েছে। কারণ নিজেরা সুখে (সুখে, আনন্দে নয়) থাকার জন্যেই এই ফাঁকিটা তারা তৈরি করেছে। হতাশ হয়ে পড়লেন নাকি? খুবই স্বাভাবিক। আমার কথাবার্তা শুনলেই দেখেছি লোকজন হতাশ হয়ে পড়ে। আমার এক বান্ধবী সেদিন বললো তুই বড্ডো ফ্যাটালিস্টিক। বলে ঘাড় ঘুরিয়ে গর্বিত পদক্ষেপে অফিস চলে গেল। মাইরি বলছি বিশ্বাস করুন, আপনাকে হতাশায় ঠেলে দেওয়ার জন্যে এই লেখা নয়। আর নেশা ভাং করতে আমি আপনাকে বারণ করছি না। আমি বলছি বন্ধু নিজের ভাবনাটা নিজে ভাবুন। মার্ক্সিজম, নিহিলিজম, ফ্যাটালিজম এইসব কোনো ইজমের পাল্লায় পড়বেন না। আর যদি দোহাই দিতেই হয় তবে জোর গলায় বলুন দেখি আপনি উত্তর আধুনিক। সত্যিই তো আপনি আধুনিকতাকেও পেরিয়ে এসেছেন। যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই সময়টাই হ্যাঁ আর না এর মধ্যের অঞ্চলটায় অবস্থিত। মার্ক্সিজম, মাওইজম সমস্ত ইজমের ফাঁকি ধরা পড়ে গেছে সেইজন্যেই তো যতরকম গোলযোগ। কী ভাবছেন? বাজে বকছি তো? সব ফাঁকি বলতে বলতে আমিও আপনাকে ফাঁকি দিচ্ছি। মশাই নেশাটা যে ফাঁকি সেটা বুঝুন। নেশা যখন করবেন, তখন সব কিছু ভুলে যাবেন, তা না হয় হল, কিন্তু এই ভুলে যাওয়াটা যে মিথ্যে সে বিষয়ে সচেতন থাকুন। আজ আউট হয়ে গিয়ে আপনি ট্রেনের সামনে চলে যাবেন দুঃখ হয়েছে বলে?অথবা কারোর ওপর রাগ হয়েছে বলে দৌড়ে গিয়ে তাকে ক্যালাবেন? কাউকে পছন্দ করেন না, তাকে বিরক্ত করবেন? করতেই পারেন, কারণ তখন তো আপনি মুক্ত, আপনার কোনো পিছুটান নাকি নেই।কিন্তু এই যে মুক্তি, এটা তো মিথ্যে মুক্তি। আসলে তো আর তাই হয় না। নেশা করুন, কিন্তু ভাবনাটা থামাবেন না। আপনাকে চুপিচুপি জানাই, আপনার ভাবনা যখন মুক্ত তখন আপনি কি কি ভাবতে পারেন আপনি নিজেও জানেন না।এমনও হতে পারে আপনি ভাবতে ভাবতে সত্যিকারের ফাঁকিগুলো ধরে ফেললেন। আবিষ্কার করে ফেললেন
রোজ হাড়ভাঙা খাটুনির পর কেন আপনাকে নেশা করতে বসতেই হয়। আপনার জীবনের অর্থহীনতাটা আসলে সত্যি কোথায়? নেশার অভ্যাসে? না অন্য কিছুতে? আপনি কি আসলে স্বাধীন হতে চান না? নেশার বিরোধিতা আমি করছি না। আমি বলতে চাইছি স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই কর্তব্য আসে। আমরা নেশা করতেই পারি, কিন্তু তার ফলে কারোর ক্ষতি করার কোনো অধিকার আমাদের জন্মায় না। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে ভালো আর খারাপ দুটো দিক থাকে। এক দোতারাবাদককে আমি চিনতাম, সে ছিলো এক বিখ্যাত মাতাল। মদ খাওয়ার পরেই সে ভয়ংকর রেগে যেত, আর রেগে গিয়ে যাকে তাকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার গাড়ির দিকে ছুটে যাওয়া ছিলো তার কয়েকটা প্রিয় অভ্যাসের মধ্যে একটা। যত্রতত্র হিসি করতে গিয়ে মাতাল অবস্থায় মার খেয়েছে এরকম ঘটনাও তার জীবনে ঘটেছে। সে আমাকে একটা গল্প বলেছিলো-
একবার এক মাতাল, মদ খেয়ে একেবারে আউট, গা থেকে, মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে, সে একটা বাসে উঠেছে। বাসে উঠে দাঁড়িয়েছে এক ভদ্রলোকের পাশে। সে ভদ্রলোক আবার একটু নীতিবাগিশ। মাতালটা উঠে তাঁর গায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়ে পাশটাতেই দাঁড়ানোয়, তিনি বেশ একটু নাক কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করে একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। ভেবেছেন তাতে সে ব্যাটা একটু সমঝে যাবে। কিন্তু সে দেখেন তাঁর আরো কাছে সরে এসে ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ এগিয়ে জিজ্ঞেস করেছে-
দাদ্দা ও দ্দাদা
জড়ানো গলা। তিনি কঠিন স্বরে বলেছেন -কী?
মাতালটা জড়িয়ে জড়িয়ে উত্তর দিয়েছে-
দ্দাদা আমি ক্কি ব্বাসে উঠেছি?
ভদ্রলোক অত্যন্ত রেগে গিয়ে এককথায় না জবাব দিয়ে একটু বেশি শব্দ খরচ করে ফেলেছেন-
কি মুশকিলে পড়া গেলো তো। ভদ্রলোক আর রাস্তায় হাঁটতে পারবেনা এদের জ্বালায়। হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি বাসে উঠেছেন।
কড়া গলা কথা গুলো বলে তিনি ভেবেছেন, বেশ একটা মুখের মত জবাব দেওয়া গেছে। হঠাৎ টের পান, আবার ঘাড়ের কাছে সেই মাতালটা মুখ বাড়িয়েছে, আর যা গন্ধ।
-দ্দাদা ও দ্দাদা
- আবার কী? বলে ফেলুন?
- আপনি ককি আমাকে চেচেনেন?
কী আস্পর্ধা, ভেবেছেন তিনি। আরো রেগে গেছেন,বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছেন-
আপনার মত মাতালকে আমি চিনতে যাবো কোন দুঃখে?
মাতালটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছে- ওঃচেনেন না? তাহলে কি করে বুঝলেন আআমিই ববাসে উঠেছি??
আরেকটা কথা না বললে গল্পটা শেষ হবেনা। সেটা হল মন্দ লোকে বলে যে দোতারাবাদক আমাকে গল্পটা বলেছিলো গল্পটা সেই ঘটিয়েছিলো। সে একদিন মদ ছেড়ে দিলো, এবং বললো, মদ যখন খেতাম তখন আমি ছিলাম দুরকম। এখন আমি অন্যরকম। সত্যিই সে অন্যরকম হয়ে গেল। সেই আমাকে বলেছিলো- দেখ, নেশার ভালো দিকটা খুবই ভালো, কিন্তু খারাপ দিকটা এতটাই খারাপ যে আমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।আমার বক্তব্য হচ্ছে, সে কিন্তু ফাঁকিটা বুঝতে পেরেছিলো, এবং ফাঁকিটা ধরতে পেরেই সে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। নেশা কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু নেশার আড়ালেও আমরা যেন কোনো অপরাধ না করি। কিন্তু নেশা করে আর কি ই বা করা যায়? আচ্ছা এই যে চারিদিকে বড় বড় জায়গায় এত ঘটা করে, বিভিন্ন ইজমের ওপর সিম্পোসিয়াম হয়, দেশ বিদেশ থেকে উদো বুধো রা আসেন, ক্যামেরার সামনে পেপার পড়ে ফেরত চলে যান। এই সিম্পোসিয়ামের আসল মানেটা কেউ জানেন? প্লেটোর সিম্পোসিয়াম পড়ে দেখুন, টের পাবেন সিম্পোসিয়াম আদতে পানশালা, যেখানে মদের গ্লাসের ওপরে বিভিন্ন তত্ত্বের ঝড় ওঠে। দেখবেন কিকরে প্রেম নিয়ে আলোচনা করতে করতে প্লেটো সেখানে মিশিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতির ধারণা, নাটকের ধারণা, সৌন্দর্য্যের ধারণা, অসৌন্দর্য্যের ধারণা। বাঙালী বলে নিজেদের দাবি করেন, লোকগান শোনেন নিশ্চয়ই? বাউল ফকিরদের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাত হয়। না জয়দেবের মাইকসর্বস্ব মেলায় নয়, তাদের আখড়ায় গিয়ে দেখবেন কিভাবে ছিলিমের ধোঁয়ায় ওড়ে বাউলের জীবনবোধ। মূহুর্তে শুরু হয় তত্ত্বালোচনা, মূহুর্তে মুখে মুখে গড়ে ওঠে নতুন গান।বাংলা কাওয়ালি শুনেছেন?
গান আমার ঈশকের গাঁজা
খাইলে হয় প্রাণ তাজা
না খাইলে পাই সাজা
বাঁচে না প্রাণ।
খাজাবাবা খাজাবাবা
মারহাবা মারহাবা
গেয়েছিলেন নবির গুণগান।
আর আপনি আমি? আমরা অত বড়ো বড়ো জিনিস পারি না। আমাদের গলা দিয়ে গান বেরোয় না। তত্ত্ব সামলাতে আমরা হিমশিম খাই, নেশা করে আসর সরগরম করে তোলা আমাদের কর্তব্য নয়।তবে আমরাও ভালোবাসি এই ক্ষণিকের আনন্দ। আমাদের দায়িত্ব আছে, কাজের মধ্যে আমরা বিশ্রীভাবে ফেঁসে আছি। তাও মাঝে মাঝে আমরা একটু আধটু নেশা করি। নেশা করে কী করবো বুঝে উঠতে পারিনা, চেঁচাই লাফাই, যা ইচ্ছে তাই করি। কিন্তু ইচ্ছেটা যে কী?যাই হোক। আমাদের মাথায় রাখতে হবে আমাদের ইচ্ছে যেন অন্যের ক্ষতি না করে। আমাদের আলোচনার বিষয় যেন পারিপার্শ্বিককে নোংরা না করে তোলে।ক্ষণিকের নেশাতেই আমরা যদি স্বাধীনই হই, তবে আমরা সেই স্বাধীনতার সময়টুকুতে যেন গিয়ে দাঁড়াই, প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে।আমরা তাদের আরো ভালো করে দেখতে শিখবো, চিনতে শিখবো, তাদের নিয়ে মুক্তমনে ভাবতে শিখবো। তাদের প্রতি ঘৃণা নয়, তাদের ভালোবাসাই যেন আমাদের আচরণে মুখ্য হয়ে ওঠে। ফাঁকিটা ধরে ফেললেই তো ফাঁকিটা আর নেই। সচেতনতাই স্বাধীনতা। Freedom is the drug...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।