এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গায়ত্রী স্পিভাকদের নিয়ে আমরা কী করি?

    Sourav Chattopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ এপ্রিল ২০২৫ | ৯৬ বার পঠিত
  • একবাক্যের উত্তর: একটেরে রাজনীতির শ্লোগানশানিত শাঁখের করাতে মাথা কাটা যাওয়া থেকে বাঁচতে সাহায্য নিই গায়ত্রী স্পিভাকদের থেকে। প্রশ্ন সহজ, উত্তরও জানা হল।  

    একটু খুলে বলার চেষ্টা করছি। খেয়াল করি, আজ নয়, বেশ কয়েক দশক হল ছাত্র থেকে গবেষক – পেশাদার বিদ্যাচর্চাজীবির গোপন বাসনা অ্যাক্টিভিস্টের সিংহচর্ম। তেমনি অ্যাক্টিভিস্টেরও গোপন সাধ গবেষকের গরিমা। আর আছেন ডিজিটাল সাংবাদিক। তাঁর মূল প্রত্যাশা হল এই দুই চরিত্র হররোজ নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গরমাগরম মন্তব্য করে যাবেন। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে মুক্তিকামী মন্তব্য না পাওয়া গেলেই গবেষক বা অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে যাবেন সুবিধেবাদী।

    এঁরা বাদে সত্যিসত্যিই গোটা দুই বন্দুক নিয়ে মুক্তি আনার চেষ্টা চালান যাঁরা, তাঁদের কুর্নিশ জানানো ছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমার। বলার থাকতে পারে না। তাঁদের মাথা কোনো শৌখিন শাঁখের করাতে কাটে না, রাষ্ট্রের গিলোটিনে কাটে। কিন্তু গোটা দুই উক্তি, স্লোগান বা বইপত্রের জোরে মুক্তির দাবী করি যারা, পরিবর্তন চাওয়াটুকুই যাদের কাছে বিদ্রোহের সামিল, সেই আমরা একরকম শাঁখের করাতের মুখে হরবখত পড়ি। শাঁখের করাত মানে “আসতে যেতে কাটছে মাথা/ কারুর কারুর খুলছে বরাত”। আর আমরা মানে, কয়েক প্রজন্ম ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের সাংস্কৃতিক মুনাফা কমবেশি ঘরে তুলেছি যারা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির হালহকিকত নিয়ে ভাবতে বসি যারা, নানা কিসিমের মতবাদের উত্থান বা পতনে বিষন্ন বা প্রসন্ন হই যারা। স্লোগানসর্বস্বতার উৎস সন্ধানে উৎসাহী যারা। মূর্ত বাস্তবকে বিমূর্ত তাত্ত্বিক আলোচনার স্তরে নিয়ে যাওয়ার সুবিধে ও ক্ষমতা ভোগ করি যারা। পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখার ফুরসত পাই যারা, স্বপ্নের নিশান সত্যিই বুকে দোলা লাগাল বলে মনে হয় যাদের, আবিল চোখে, প্রত্যয়ী চোয়ালে কোনো এক পক্ষের হয়ে গলা ফাটিয়ে পথে বা আজকাল ফেসবুকে নামি যারা, আবার সেই পক্ষের অনিবার্য স্খলনে প্রতারিত বোধ করি যারা। ক্ষেত্রবিশেষে নিজের আন্তরিকতাকে প্রতিক্রিয়াশীল ঠাউরে সন্দেহ করার মত ভাষাশিক্ষা জুটেছে যাদের কপালে, সেই আমরা তো সত্যিই ভাবি মাঝেমধ্যে, হোয়াট ওয়েন্ট রং? বিপ্লব দীর্ঘজীবী হল না কেন? কেন সেদিনের মুক্তিকামী জনতা আজ রক্তকামী? বা উল্টোটা? কেন আজকের ফিসফাস পাল্টে যেতে পারে আগামীর কোনো প্রচণ্ড চিৎকারে? কেন আজকের প্রতিবাদী কন্ঠ কাল সর্বংসহা? 

    গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকদের নিয়ে এই আমরাই নিরলস তর্ক করি। মুক্তির দাবি, আজাদির স্লোগানে অটুট-আস্থা নিজের উত্তেজিত যুবক-মনের সঙ্গে তর্ক করি। বলে বসি, স্লোগান যথেষ্ট নয়। স্পষ্ট করেই বলে দিতে পারি: “Revolution did not last in the absence of subjects trained in the practice of freedom”। তর্ক করি সাহিত্যের নিবিষ্ট শিক্ষকের সঙ্গে। তাঁকে বলতে পারি, “literature as such cannot open doors”। সাহিত্য এককভাবে আমাদের কিছুই বলে না। বলি, মানবিকীবিদ্যা কী শেখায়? অপরের অবস্থান থেকে বিচার করতে শেখায়। প্রাণবিজ্ঞান বা প্রকৃতিবিজ্ঞান এই শিক্ষা দেয় না। কিন্তু তাই বলে বিখ্যাত মনীষীর কথা মেনে নিই না। তর্ক করি, শিক্ষা অন্তর্নিহিত কিছুর বিকাশ নয়। শিক্ষার নিরিখ “uncoercive rearrangement of desires”। নন্দিত ডিসিপ্লিনের নরকে গিয়ে পড়ে কিছু তামাদি বুলির পুনরুক্তিই একমাত্র ভবিতব্য।

    কলেজের জেনারেল বডি মিটিংয়ে প্রথমবার অংশ নেওয়া তৃপ্ত জুনিয়রের বাঘমারি আবেগে ঠেস মেরে বলি, “everybody talks about politics, but sometimes I feel like asking Shakespeare's question: When you call spirits from the vasty deep, will they come? That’s the problem with literary folks who want to be political”। তেমনি, ডিকলোনিয়াল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা কমরেডদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে তোলা স্লোগানের সঙ্গে তর্ক করি, জোর গলায় সওয়াল করি “training the imagination for epistemological performance”-এর পক্ষে। ভেঙে ভেঙে বলি affirmative sabotage-এর কথা। মনে রাখি, অভিজ্ঞতা বিশুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ নয়। মনে রাখি, অহং নিরঙ্কুশ, নিরালম্ব নয়। মনে রাখি ডিসিপ্লিন সত্য নয়। নানাবিধ আইডেন্টিটির ধুয়‌‌ো তুলে রাজনৈতিক উচ্চাসন দাবী করেন যাঁরা, তাঁদের কলার ধরে মনে করাই, “trying to step beyond identity is what keeps politics ethical”। রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের দাবীতে মুখর সহনাগরিকের শত্রু হয়ে যাই, যেই বলি “it is just that there be law, law alone is not justice”। বিনির্মাণ না অবিনির্মাণ - উপসর্গসংক্রান্ত তর্কে লিটল ম্যাগাজিনে তরজা চালানো তৎসমবিশারদদের এড়িয়ে গিয়ে মনে মনে আউরে নিই  “in order to know, you have to be trained in how to construct an object of knowledge”। মনে রাখি গণতান্ত্রিক পাঠের আসল শক্তি আসলে ভাষার স্বাতন্ত্র্যের অধিকারে নয়, লেখকের সঙ্গে একাত্মবোধ করাতেও নয়। নিজেকে নিলম্বিত (suspend) করে উদ্দিষ্ট পাঠকের অবস্থান কল্পনা করাই সম্ভবত গণতান্ত্রিক পাঠের ভিত্তি। ভাবতে বসি, অপরাশক্তির অর্থ কী?

    সমর সেন প্রতিষ্ঠিত, তিমির বসুর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত নিতান্ত সাদামাটা, কৃশতনু ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায় গায়ত্রী স্পিভাকের নিরন্তর তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধগুলি পড়ে এইসব চিন্তা করি আমরা। এ ছাড়া কী করি? তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার চেষ্টা করি। সদ্ব্যবহার আশা করি। মনে করি, সদ্ব্যবহারেই তাঁর পরিচয়। বা পরিচয়েই তাঁর সদ্ব্যবহার। আরও অনেক কিছু করি। তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন ….. ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্ক খেলি, কলকাতাবাসী হলে তৎক্ষণাৎ বিনয়াবনত হয়ে পড়ি। দিল্লীবাসী হলে তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া গরম করি। টুইটারে খোঁজ নিই, কোন রাজনৈতিক প্রসঙ্গে তিনি কবে চুপ ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিপাত যাক কেন বলেন না তিনি, না আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর থেকে তিনি ঠিক কি চান তাই ভেবে অস্থির হই। অন্তত হোলবার্গ পুরস্কার কেন ঠিক নোবেলের সঙ্গে তুলনীয় নয় তা নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্যটুকু অবশ্যই করি। আমরা এসব করি। ঠিকই করি। কেন করব না? দেশের জন্য গায়ত্রী কী করেছেন বা হিন্দুদের স্বার্থের কী হল ইত্যাদি প্রশ্ন তো তুলি না। আমরা অন্তত ওদের মত নই!
    (InScript.me-তে প্রকাশিত। সংশোধিত ও পরিমার্জিত।)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন