এক
অনেকগুলো রাশিয়ান শব্দ শিখেছিলাম। দু’চারটে ছোট ছোট বাক্যও বলতে শুরু করেছিলাম। মুখের ভেতরে জিভের ডগায় শব্দগুলো বসিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় আমার শরীরে এক রকম পুলক তৈরি হত। টের পেতাম অজানা একটা সুখ আমার শরীরকে দৃঢ় করে তুলছে। আমাদের বাক্যবিন্যাসে অনভ্যস্ত ওই শব্দগুলো বারে বারে উচ্চারণ করতে আমার ভালো লাগত। স্বীকার করতে লজ্জা নেই – একটু যেন যৌন উত্তেজনাও হত।
রাশিয়ান এক্সপার্টদের হস্টেলের জন্য কারখানার হিসেবনিকেশের দপ্তর ছেড়ে কেয়ার-টেকারের কাজটা আমি করব কিনা জানতে চাইলে উত্তেজনায় প্রথমে আমি কিছুই বলতে পারিনি। আহা, আমার সেই স্বপ্নের দেশের মানুষগুলোকে আমি কত কাছাকাছি পাব। ওদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাব। মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারির দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ওরা এই শিল্পনগরীতে এসেছে। এতদিন কারখানায় আসাযাওয়ার পথে ওদের হস্টেলটা দেখতাম। একজন দুজন রাশিয়ানকে দেখতাম। আমার বুকের ভেতরে শিরশির করত। এরা সেই মহান দেশের নাগরিক। আমার স্বপ্নের দেশ। ইউনিয়ান অফ সোভিয়ত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক।
আমাদের পাড়ার শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারে সোভিয়েত দেশ পত্রিকা রাখা হত। সোভিয়েত নারীও। আমি লাইব্রেরিয়ান শিশিরকাকুকে বলে আমার মায়ের জন্য পুরনো সোভিয়েত নারী বাড়িতে নিয়ে আসতাম। সেখানে সোয়েটারের ডিজাইন, মহান অক্টোবর বিপ্লবে বীরগতিপ্রাপ্ত শহীদদের মায়ের অবদান, লেবু জারানো, গোলরুটির গল্প থাকত। আস্ত্রাখান টুপি, গালোশ, সামোভার – এসব শব্দ শিখছিলাম। ইভান, পাভেল, ভানিয়া, কাতিয়া – এসব ছিল চরিত্রদের নাম। গোগ্রাসে গিলতাম।
লাইব্রেরিতে সোভিয়েত দেশ খুব একটা কেউ পড়ত না। বরং ‘কালনাগিনীর প্রতিহিংসা’ কিংবা ‘মরণগুহার ভয়ংকর’ খোঁজ করেও পাওয়া যেত না। আমার কিন্তু সোভিয়েত দেশ ভালো লাগত। কী মসৃণ ঝকঝকে কাগজ, কী সুন্দর রঙিন ছবি। তখন অন্য কোনও পত্রিকায় রঙিন ছবি প্রায় দেখাই যেত না। নতুন পত্রিকা এলেই আমি প্রথমে পৃষ্ঠা খুলে গন্ধ শুঁকতাম। কাগজ থেকে, অক্ষর থেকে রাশিয়ার বাতাস ফুসফুস ভরে টেনে নিতাম। বুকের ভেতরটা বিশ্বাসে ভরে উঠত। মনে হত আমার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে লেনিনগ্রাদ, মস্কো, বাকু, আজারবাইজান, তাসখন্দের বাতাস। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম পৃথিবীর ভেতরে শ্রেষ্ঠ দেশ হচ্ছে ইউ এস এস আর। পত্রিকায় এক একজন লেখকের নাম খুঁজে পাই, লাইব্রেরি থেকে তাদের বই খুঁজে নিয়ে পড়ি। বাংলায় অনুবাদ। তুর্গেনিভ, গোগোল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি। নিকোলাই অস্ত্রয়েভস্কির ‘ইস্পাত’ পড়ে তো দু’রাত ঘুমই হল না। আমারও ইচ্ছে করত মাতৃভূমি না বলে আমাদের দেশকে পিতৃভূমি বলে ডাকতে। সেই লেনিনগ্রাদ থেকে ভারখায়ানস্ক – পৃথিবীর আদ্ধেকটা জুড়ে তো ওরাই রয়েছে। যুদ্ধ হলে শুধু একটা বোতাম টিপবে, আমেরিকা ফিনিশ।
এম এ এম সিতে আমি পাঁচ বছর চাকরি করেছিলাম। তখন সেই শিল্পনগরীতে যারা এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত, তাদের এক ধরণের কুলীনকুলসর্বস্বতা ছিল। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারণ করার সময় কন্ঠ থেকে ঝরে পড়ত নিয়ন্ত্রিত আভিজাত্য। অন্যান্য সেক্টরের মানুষদের চোখে স্পষ্টই টের পেতাম সম্ভ্রম, ঈর্ষা, হয়তো বেদনাও। ঘাড়ের রোঁয়া ফুলে উঠত আমার। ভাগ্যিস চাকরিটা এখানেই পেয়েছিলাম। রিজিওন্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তখনও এন আই টি হয়নি। এত প্রাইভেট কলেজ ছিল না। কোপার্নিকাস মার্গের কোয়ার্টারে মাকে নিয়ে থাকি। মামড়া মোড়ের ও দিকটায় শালের জঙ্গল। কম্যুনিটি হলে পথের পাঁচালি, পঁচিশে বৈশাখে ডাকঘর। জি টি রোডে ডিভিসি মোড়ের কাছে ঘন অরণ্য। পুরনো কোনও মন্দিরের গল্প একদিন কলিগের মুখে শুনলাম। বললাম – চল নিয়োগী, একদিন দেখে আসি। চারু নিয়োগী আমাকে ডাকাতের ভয় দেখাল।
লোহা এবং ইস্পাত শিল্পের জন্য দুর্গাপুর ছিল আদর্শ জায়গা। শ্রমিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আকরিক, জ্বালানি – এ সবই ছিল সমাধানযোগ্য। এই বিশাল কর্মকান্ড অনবরত সচল রাখার জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন কাঁচামাল আর জ্বলানির সরবরাহ। আকরিক সংগ্রহের জন্য চাই আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থা। মাইনিং-এর স্বয়ং সম্পূর্ণ পরিকাঠামো ছিল আমাদের। যন্ত্রপাতি বানানো, সারানো এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের কারখানায় এসেছিল। তখন নতুন ভারত গড়ার লক্ষ্যে বন্ধুত্বের হাত সবার আগে বাড়িয়ে দিয়েছিল যে দেশ, তার নাম সোভিয়েত রাশিয়া। ওদের দেখলেই আমার শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের কথা মনে পড়ত। সোভিয়েত দেশ পত্রিকা, পুশকিনের কবিতা, গোগোলের ‘ওভারকোট’ গল্পের কথা। রাতের আকাশে তাকালে চাঁদ কিংবা তারা নয়, আমার মনে পড়ত গাগারিনের নাম। যেদিন এক্সপার্ট হস্টেলে ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব পেলাম, মনে হল আমিও বোধহয় পৃথিবীর টান অগ্রাহ্য করে মুক্তিবেগ অর্জন করেছি।
মাত্র দু’বছর ছিলাম হস্টেল তদারকিতে। অনেকগুলো রাশিয়ান শব্দ শিখেছিলাম। বচন এবং কালভেদে ক্রিয়াপদের তারতম্য বুঝতে শুরু করেছিলাম। ছোট ছোট বাক্য বলতে পারি। হসন্ত এবং ৎ-প্রধান ওদের শব্দগুলো নিয়ে মুখের ভেতরে নাড়াচাড়া করার সময় এক রকম বিশ্বাস ও সুখমেশানো লালায় শব্দগুলো পিচ্ছিল হতে থাকে। শব্দগুলো গিলে ফেলি। শব্দগুলো আমি হজম করতে চাই। শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে যাক আ বে ভে গে দে। বর্ণমালার অক্ষরসমূহ। বিশ্বকর্মানগরে কী দুরন্ত কর্মকান্ড চলে দিনরাত। ওদিকে স্টিল প্ল্যান্টের কাজ, এদিকে মাইনিং-এর উপযোগী, সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরি। আরও উন্নত যন্ত্র তৈরির নকশা, তৈরি যন্ত্রের পরীক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ, সেগুলো চালানোর ট্রেনিং। সে এক দুরন্ত সময়। সমস্ত ভারতবর্ষের নজর আমাদের এই শিল্পনগরীর দিকে। আশপাশের কোলিয়ারি থেকে রোজ টন টন কয়লা ঢুকছে। রাতে ফার্নেসের আলো দেখা যায় কতদূর থেকে। আকাশ আগুনের আভায় হলদে হয়ে থাকে। লোহা গলে তরল আগুন হয়ে গড়িয়ে যায় লাভাস্রোতের মত।
আমাদের ব্যাপার আলাদা। কী সুন্দর আমাদের কারখানা, অফিস-বিল্ডিং। অফিসের চারপাশে কী চমৎকার ফুলের বেড। দেখাশনা করার জন্য মালি রয়েছে। সারা বছর ওরা ফুল ফোটায়। অফিসের বাইরে কী অসাধারণ নক্শা করা আমাদের কর্পোরেশনের মনোগ্রাম। কী দারুণ ক্যালেন্ডার হয় আমাদের। এম এ এম সি’র ক্যালেন্ডারের জন্য সবাই হামলে পড়ে। কারও ঘরের দেয়ালে আমাদের ক্যালেন্ডারের শোভা যেন তার টুপিতে আরও একটা পালক গুঁজে দেয়। আমি বাঁকুড়ার সোনামুখীর ছেলে, এখানকার গরম গায়েই লাগত না। কোপার্নিকাস মার্গ থেকে এসে অফিসে ঢোকার সময় ওই প্রতীক চিহ্নের দিকে তাকালে বুকের ভেতরেও যেন ওই রকম একটা খাঁজকাটা চাকা ঘুরত। চাকা বয়ে আনত সুসময়ের বাতাস, চারদিকে সুলক্ষণ দেখতে পেতাম। সন্ধেবেলা ফার্নেসের-আভায়-উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকালে মনে হত স্বয়ং বিশ্বকর্মার মুকুট থেকে দিব্যজ্যোতির প্রকাশ যেন ওই আলোকবিভা। হঠাৎ মনে পড়ত দারোফা মানে পথ, কাক ভাস্ জাবুৎ মানে তোমার নাম কী।
আমার পলিটেকনিক ডিগ্রির সুবাদে একটা সরকারি চাকরির ইন্টারভিউ-এ ডাক পেয়েছিলাম। বেশ উঁচু পদ ছিল সেটা। সেখানেও, হয়তো এই এম এ এম সি’র অভিজ্ঞতাবাবদ ভালো নম্বর যোগ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইন্টারভিউ বোর্ডের তিনজনই বোধহয় অবাক হয়েছিল আমাকে এখানে দেখে। চাকরিটা পেলে আমি করব কি না – ওরা জানতে চেয়েছিল। আমার কোনও উপায় ছিল না। আমার বিধবা মায়ের চোখের জল, দধিমুখ্যা গ্রাম থেকে আমার গার্জিয়ান মেজোকাকার সংশয় ও সতর্কবার্তা এবং সরকারি চাকরির দিকে মধ্যবিত্ত মানসিকতাজাত বিশ্বাস – দারোফা, পুশকিন, গাগারিন, আমাদের কর্পোরেশনের সেই বিখ্যাত প্রতীকচিহ্ন থেকে আমাকে উপড়ে নিল। আমি রাতে লুকিয়ে কাঁদলেও ইন্টারভিউ বোর্ডে হাসি হাসি মুখে বলেছিলাম – উইথ প্লেজার, স্যার। তখনই মনে পড়েছিল ডিজাইনের দিমিত্রিভ বলেছিল আমাকে একটা ইংলিশ টু রাশিয়ান ডিকশনারি উপহার দেবে। ইন্টারপ্রেটর শেভচেঙ্কোর বউ একদিন প্রচুর মদ খেয়ে আমার গলা জড়িয়ে বলেছিল – মিশ্রা, ইয়া তেব্যা ল্যুভল্যু। আমি বোকা বোকা মুখে শেভচেঙ্কোর দিকে তাকালে সে আমাকে চোখ টিপে বলেছিল এই বাক্যের অর্থ আমাকেই বুঝে নিতে হবে।
দুই
আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি পেটমোটা ব্রাউন পেপারের বড় এনভেলাপের ভেতরে অত টাকা রয়েছে। আমি তখন শিলিগুড়ির ডিভিশনাল অফিসে। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রশাসক হিসেবে ডিভিশনে তো বটেই, মহাকরণে আমার দপ্তরের মন্ত্রীর সুনজরে আছি – এ রকম খবর আমার কাছে ছিল। মন্ত্রীর খাস লোক – এই প্রচারে আমার লাজুক হাসির একটা সস্নেহ প্রশ্রয় ও সম্মতি ছিল। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে আমি অফিসে ওয়ার্ক-অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, ওদিকে চুনোপুটি থেকে রাঘববোয়াল ঠিকাদারদের কন্ট্রোলে রাখছিলাম।
ফাইল সই করতে করতে হঠাৎ কোনও দিন জানালা দিয়ে বাইরের লাল কৃষ্ণচূড়ায় ভরে থাকা গাছের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে শিশিরকাকুর কথা। ইস্পাত, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ব্রাদার্স কারামাজভ, ওভারকোট, অক্টোবর বিপ্লব, সোভিয়েত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে মনে হয় তা হলে আমেরিকাই জিতল। ভেঙে গেল শক্তির সমূহ ঐক্য। পেরেস্ত্রৈকা ... গর্বাচেভের সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। মুক্ত বাতাস ছুটে এল। আগল খুলে দিতেই ভেঙে পড়ল সোভিয়েত।
বাড়িতে আমার টেবিলের ওপর থেকে ব্রাউন খাম নিয়ে সেটার মোটা পেটের ওপর অনীতা তীক্ষ্ণ নখ বসিয়ে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল। নোটের বান্ডিল নিয়ে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠল আমার বউ। অনীতার তীক্ষ্ণ নখ বসে যাচ্ছিল আমার মুখোশের ওপর। কতদূর বুঝতে পারে মূর্খ মেয়েছেলে। অনীতা কি জানে সোভিয়েত দেশের সেই পৃষ্ঠাগুলোর গন্ধ এখনও আমার নাকে আসে। অনীতা কি জানে সোভিয়েত ভেঙে গেলে আমি ভিখারি হয়ে গেছি। মুক্ত হাওয়ায় রতনবাহাদুর মোক্তান, লাল্টু প্রামানিক আমাকে ব্রাউন খাম দিয়ে বলে – স্যার, এটা ব্যাগে রেখে দিন। বাড়িতে গিয়ে খুলবেন। রতনবাহাদুর কার্শিয়াং-এ ডাওহিলে আমার মেয়ের ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লাল্টু প্রামানিকের ইন্ডিকায় হলং ঘুরে এলাম। হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল-সাফারি। লাল্টু পিঠটাকে কেন্নোর মত গোল করে বলে আমার মত অফিসার বাপের জন্মে দ্যাখেনি। হাঃ, মুক্ত হাওয়া।
দুর্গাপুরে অফিস ট্যুরে গিয়ে দেখলাম শহরটা কত পালটে গেছে। ডিভিসি মোড়ের সেই শালের জঙ্গল উধাও। সিটি সেন্টার ঝলমল করছে। একটু এগোলেই কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এটা এখণ শিল্পনগরী, না কি কোনও শিক্ষাচর্চার পীঠস্থান – গোলমাল হয়ে যায়। ড্রাইভারকে এম এ এম সি’র কথা বললে মনে হল যেন বিভ্রান্ত। কোনও এক ট্যুরিস্ট যেন নেই-এক-দুর্গের কথা জানতে চেয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে দেখতাম এম এ এম সি’র অবস্থা খুব খারাপ। দুর্গাপুরে পৌঁছে প্রথমেই মনে পড়েছিল আমার পুরনো কোম্পানির সেই প্রতীক চিহ্নের কথা। একটা দাঁতওয়ালা চাকা, যেটা ঘুরলেই ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে ম্যাগনেটাইট, হেমাটাইট। যৌগ ভেঙে যেতে থাকে। পুড়তে পুড়তে তার আসল রসটুকু শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়ে স্রোতের মত বইতে থাকে। ইস্পাতনগরীর আকাশ স্বর্ণাভ হয়ে ওঠে। মাটির সাত পরত নীচে লুকিয়ে থাকা সেই ঐশ্বর্যের সম্ভার তো আমরাই স্রোতধারায় বইয়ে এনেছি মাটির পৃথিবীতে। আমাদের কোম্পানি ছিল যজ্ঞের পুরোহিত। লৌহ-সভ্যতার ভগীরথ। ড্রাইভারকে হেসে পথ বলে দিতেই সে ম্লান হাসল।
গোটা কতক ফুলগাছ এখনও কোনও মতে বেঁচে আছে। মরতে মরতে এখনও ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে চলেছে। আমার মনে হল দুটো শ্মশানচাঁপা ফুটে আছে। যা ছিল অমরাবতী, এক্ষণ যেন প্রেতলোক। জীবনের সাড়া নেই কোথাও। কোথায় গেল প্রাণস্পন্দনে মুখর আমাদের সেই ক্যান্টিনের কোলাহল। কোথায় গেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, এস্টাব্লিশ্মেন্টের লোকজন, প্ল্যান্টের লোকজন। মৃতদের শহরে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
অফিসে ঢোকার মুখে ডানদিকের দেয়ালে সেই বিখ্যাত প্রতীক চিহ্ন কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। কেমন করে মাটির নীচ থেকে উঠে আসবে গাঢ় ধূসর ম্যাগনেটাইট, উজ্জ্বল হলুদ হেমাটাইট, কোন যন্ত্রে আরও নিখুঁত, আরও বেশি করে, আরও কম পরিশ্রমে, কম খরচে মাইনিং-এর কাজ হবে – সেই সব যন্ত্রশিল্পীরা আজ কোথায় হারিয়ে গেল।
খাঁজকাটা চাকাটার দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ নিজেকে মনে হল চেকভের সেই ‘একজন কেরানির মৃত্যু’ গল্পের কেরানি। মনে হল কমিউন মিথ্যে, পিতৃভূমির লড়াই-এ লালফৌজের বীরত্বের গল্প মিথ্যে। আমার ছেলেবেলায় সোভিয়েত দেশ নামে কোনও পত্রিকা ছিল না। কোনও দিন কোনও এক্সপার্ট এসে আমাদের শেখায়নি কোন অস্ত্র দিয়ে, কেমন করে খুঁড়ে আনতে হয় আকরিক লোহা। থেমে গেছে খাঁজকাটা দাঁতওয়ালা চাকা। পেটমোটা বাদামি খাম উড়ছে পৃথিবীজুড়ে। ভেঙে পড়ছে শক্তির সমূহ ঐক্য।
দুজন সিকিওরিটির লোক গেটের সামনে পাহারা দিচ্ছে। ওদের সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। বুঝতে পারলাম, এখনও যে সব সামান্য কল-কব্জা অবশিষ্ট আছে, ওরা সেগুলো পাহারা দিচ্ছে।
খুব সামান্য সময়ের জন্য এই ঘোরের ভেতরে আমি ছিলাম। তার পরই আবার আমার গদিওয়ালা নরম চেয়ারে ফিরে এলাম। দক্ষ প্রশাসক, একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার প্রভাত মিশ্র। সেবার ভূমিকম্পের পর মহাকরণে আমাদের মন্ত্রী জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন। মিটিং-এর শেষে মন্ত্রী একবার আমার কাঁধে স্নেহের হাত রেখে কথা বলেছিলেন। পটাপট ছবি উঠেছিল। সেই ছবির দৌলতে আমার বাড়বাড়ন্ত। এসব গল্প খুব দ্রুত ডালপালা ছড়ায়। আমাদের দপ্তরের সচিব পর্যন্ত ফোন করে আমার সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর নিত। মন্ত্রীমশাই আদতে বাঁকুড়ার লোক হওয়ায় এমন জনশ্রুতিও প্রচার পায় যে, তিনি আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি স্মিতমুখে তাঁর দিকে তাকাই।
তিন
রিটায়ারমেন্টের পর আমার শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ছিল। কেমন যেন জবুথবু টাইপের হয়ে পড়ছিলাম। আগের সেই কাজকর্মের ব্যস্ততা নেই, তবু অসম্ভব ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে। আমার বউ অনীতা খুব স্বাস্থ্য সচেতন। দিব্যি টাইট রেখেছে তার ফিগার। পুরুষ মানুষের শরীর, অন্তর্জলিতে না যাওয়া পর্যন্ত কামনাবাসনার শেষ হতে চায় না। অথচ আমার শরীর যেন শীতঘুমে যাওয়া এক কুন্ডলীপাকানো সাপ। অনীতা অবশ্য আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট। তা হলেও তো পঞ্চাশ হল প্রায়। কিন্তু অনীতা সাজতে জানে। নিয়মিত জিমে যাওয়ার ফলে তার শরীরের গ্রন্থি ও পেশির ঔদ্ধত্য অমলিন। শরীরের খিদে ভালো। কিন্তু আমার আজকাল শুধু ঘুম পায়। শরীরজুড়ে অবসাদ। অনীতা দারুণ সেজে শপিং-এ যায়। আমি ওর সামনে পেছনে ক্লিভেজ দেখি, তবু ঘুম পায়। রাত একটু ঘন হয়ে এলে ব্যালকনির বেতের চেয়ারে বসে সোডা মিশিয়ে হুইস্কির গ্লাসে আস্তে আস্তে চুমুক দিই। এ অভ্যাস আমাকে ধরিয়েছিল কালিম্পং-এর ঠিকাদার যোশেফ মোক্তান। তার সুবাদেই স্কচের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে সাঁতার কেটেছি। এখন আর অতটা পারি না। দেশি মতেই আচমন সারি। কলকাতায় হাইল্যান্ড পার্কে একটা, শিলিগুড়ির উত্তরায়ণে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছি। আরও পারতাম, ভিজিলেন্সের ভয়ে পারিনি। মন্ত্রীমশাইয়ের কি আর আমার কাঁধে হাত রাখার কথা মনে আছে।
দেখেছ, সাপটা কেমন ফোঁস করে উঠল।
বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিলাম, বিজ্ঞাপনটা দেখাতেই আমার দিকে তাকিয়ে অনীতা হেসে বলল। অপমানের এক রকম ঘন ছায়া বিছানায় ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ শীত করে উঠল আমার।
কী ভাবে যে এসব বিজ্ঞাপন দেখায়। বাড়িতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে থাকলে বাবামায়ের সামনে ... কী রকম অস্বস্তিকর বলো।
আজকালকার জেনারেশন অনেক অ্যাডভানসড্। এসব ওদের কাছে জলভাত। স্কুলের সিলেবাসে পর্যন্ত সেক্স এডুকেশন এসে গেছে।
ঠিকই বলেছ। আমাদের তিতলি, তোমার হয়তো মনে নেই, টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখালে চট করে চ্যানেল পালটে দিত। আমরাই কিছু বুঝতাম না। সে রকম বাজে ছেলের পাল্লায় পড়লে সর্বনাশ হয়ে যেত।
একটু বাদেই বিজ্ঞাপনটা আবার ফিরে এল। এটা আজকাল খুব দেখাচ্ছে। এক ফোঁটা তেলের স্পর্শে কুঁকড়েমুকড়ে থাকা সাপ কেমন ভয়ংকরভাবে ফোঁস করে উঠছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনীতা মুখে ক্রিম ঘষছে। স্বচ্ছ নাইটির ভেতর দিয়ে অনীতার বাট-ক্লিভেজ স্পষ্ট বোঝা যায়। আয়নার ভেতরে ফ্রন্ট-ক্লিভেজ। পাশ ফিরে শুয়ে এক মিনিটের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমনোর আগে শুধু মনে করার চেষ্টা করেছিলাম আয়নায় অনীতার ঠোঁটের পাশে কি মৃদু ভেঙে যাওয়া রেখা ছিল। থাক, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
রিটায়ার্ড ফৌজি অফিসার রামজি বসাকের সঙ্গে আমার আলাপ ভোরবেলা মাঠে দৌড়তে গিয়ে। নীল ট্র্যাকস্যুট, নাইকের সাদা স্পোর্টস শু, পেল্লায় মোচ – ভদ্রলোক মাঠের পাশে বকুলতলায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসেছিলেন। আমি একপাক হালকা পায়ে দৌড়ে এসে গরমকালের কুকুরের মত জিভ বার করে হাঁপাচ্ছিলাম। ব্রিদিং একটু নর্মাল হলে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।
কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা কথা বলব ?
বলুন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখলাম। এই কমপ্লেক্সে বোধহয় নতুন এসেছে। এর আগে দেখিনি।
আপনি জগিং করবেন না। যাতে ঘাম ঝরে, এভাবে একটু জোর কদমে হাঁটুন। আমাদের মত উমরের লোকদের জগিং করা ঠিক হবে না।
আপনি ...
আমি রামজি বসাক। এ সিক্স। ছেলের কাছে এসেছি। ফৌজিতে ছিলাম। কার্গিল অপারেশনে ছিলাম। অ্যাকচুয়ালি রামগোপাল বসাক, ব্যারাকে সবাই রামজি বলে ডাকত। একটু পুণ্য করে নিত।
আমি প্রথমে নমস্কার করতে গিয়েছিলাম। লোকটা তার হাত বাড়ালে আমি আধা নমস্কার আধা হ্যান্ডশেক করলাম। তারপর থেকে রামজির সঙ্গে আমার খুব জমে গেল। যুদ্ধের গল্প, ডিফেন্স-এ পুকুরচুরির গল্প, সিনিয়ার জুনিয়ারদের ভেতরে প্রায় ব্রাহ্মণ শূদ্রের মত আচারব্যবহার, সিনিয়ার অফিসারদের বউ-এর সঙ্গে জুনিয়ার অফিসারদের ফষ্টিনষ্টি। ফৌজিদের লাইফ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। লোকটা জমিয়ে গল্প বলতে পারত। আর, আদিরসঘেঁষা রসিকতাগুলো বলার সময় তার আহ্লাদ যেন উপচে পড়ত। দেশের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল বাহিনিতেও এ রকম দুর্নীতি হয় জেনে আমার ভেতরটা বেশ স্নিগ্ধ হয়ে উঠত।
এ ভাবেই একদিন এসে পড়েছিল কামশীতল নারী ও অক্ষম পুরুষদের গল্প। এসেছিল চিনদেশের মানুষদের বিশ্বাস, ভায়াগ্রা, বাঘের চর্বি-গলানো তেল, পরিপূর্ণ সুখলাভের তরিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। রামজি তখন আমাকে মিশিরজি বলে ডাকত – বলেছিল নিয়মিত যৌনতা ও পরিমিত মদ্যপানই দীর্ঘজীবন সুস্থ থাকার রহস্য। শরীর ও মন ফিট রাখার গুপ্তকথা। কিন্তু সে আমাকে দু’হাতের আঙুল দিয়ে মৈথুন-মুদ্রা দেখিয়ে বলেছিল নিয়মিত যৌনতা বলতে শুধু সেটা নয়, সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার ভেতরে যেন সেটা থাকে। ওটাই আসল ভাইটাল ফোর্স।
রামজি বোধহয় আমার দৈন্যদশা টের পেয়েছিল। শীতঘুমে চলে যাওয়া আমার এই শরীর, আমার আড়ষ্টতা নিশ্চয় সে বুঝতে পেরেছিল। ক্যান্টনমেন্টে কর্নেল চৌধুরির বউ-এর সঙ্গে জুনিয়ার অফিসার রাঠোরের এক বিছানায় রাত্রিযাপন, রাজাবাদশাদের অনন্ত ভোগবাসনা, সুবেদার মেজর দীপক কাপুরের সমকামিতা – এসব গল্প বলে সে নিশ্চয় আমাকে জাগাতে চাইত।
তারপর রামজি একদিন আমাকে এক ফোঁটা ম্যাজিক তেলের কথা বলল। ঘুমিয়ে থাকা সাপ কেমন ফোঁস করে ওঠে। পরিপূর্ণ বিষের থলি নিয়ে ছোবল মারবে বলে কেমন তার চমৎকার উত্থান হয়। আমি তো জানি, টিভিতে রোজ যখন বিজ্ঞাপন দেখায়, অনীতা না থাকলে আমি সাপটাকে ভালো করে দেখি। ওর চলন, ওর গ্রেস, ওর ফণা তোলার ভঙ্গি – সব লক্ষ করি। চুপ করে রইলাম। রামজি বোধহয় সেটাই সম্মতির লক্ষণ ভেবেছিল। পরদিন সন্ধেবেলা পার্কের বেঞ্চে বসে রামজি আমার হাতে প্যাকেটসহ একটা শিশি দিল।
ভিতরে লিট্রেচার আছে। ভাল করে পড়ে ইউজ করবেন। কাল আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এসে আপনার স্টোরি শুনব।
কোথায় যাচ্ছেন ?
আমার ছেলে তো শিল্পনিগমের বড়া অফিসার। দুর্গাপুরে ওদের একটা মিটিং আছে। আমিও যাব। আমার ছোটভাই থাকে। সি এম ই আর আই-এর ইঞ্জিনিয়ার। দেখা করে আসব।
কীসের মিটিং ?
দুর্গাপুর শুনেই আমার বুকের ভেতরে কেমন খলবল করে উঠল। যেন পচা ডোবায় বর্ষার নতুন জল পড়েছে। কইমাছগুলো লাফাচ্ছে।
পুরানা একটা বন্ধ কারখানা, এম এ এম সি -- আবার খুলবে। কথাবার্তা চলছিল। ফাইন্যাল পলিসি, কুছ কন্ডিশন – এসব নিয়েই মিটিং। ছেলে বলছিল।
রামজির হাত থেকে তেলের শিশিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম। অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে ম্যাজিক তেলের শিশি। আমার শরীরের সমস্ত পেশিজুড়ে মোচড় দিচ্ছে খরিস, চিতি, ময়াল। আমি এঁকেবেঁকে ছুটছি বাড়ির দিকে। রামগোপাল বসাক নিশ্চয় অবাক হয়ে পেছন থেকে আমাকে দেখছে। ও কী করে জানবে আমার গুপ্তকথা, পুনরুত্থানের রহস্য। ও তো সোভিয়েত দেশ পড়েনি, ননী ভৌমিকের নামও শোনেনি। আমার বুকের ভেতরে একটা খাঁজকাটা দাঁতওয়ালা চাকা ঘুরতে শুরু করেছে।
অনীতা রান্নাঘরে ছিল। আমি ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রান্নাঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিলাম। চাকাটা ঘুরছে। এখন মাইনিং শুরু হবে। অনীতার শরীরের সাত পরত নীচে যাব বলে আমি ওকে দুরন্ত বিদ্ধ করেছি। এখন গভীর থেকে উঠে আসবে ম্যাগনেটাইট, হেমাটাইট। এখন লাভাস্রোত বইবে। অসম্ভব সুখে শীৎকার করে উঠছে মাটি। ফণা দুলিয়ে বিষ ঢালতে ঢালতে আমি হয়তো বলতে চেয়েছিলাম – আই লাভ ইউ অনীতা, কিন্তু হিসহিস করে আমি বলতে থাকি – ইয়া তেব্যা ল্যুভল্যু, ইয়া তেব্যা ল্যুভল্যু ...
এ সবই হল রাশিয়ান কলকব্জার কেরামতি। এর কাছে কোথায় লাগে জাপানী তেল।
( গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশিত বিপুল দাসের গল্পসংকলন 'বর্ণসংকর' থেকে সংগৃহীত গল্প , কৃষ্ণাশিস, ২০১২ পুজোসংখ্যায় পূর্বপ্রকাশিত)