১৮৯৭ সালে রাশিয়ার তাতারস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় মেয়েদের প্রথম আধুনিক স্কুল। ১৯০৮ সালে স্কুলটিতে পড়তে আসে মধ্য রাশিয়ার নিঝনি নভগ্রোদ প্রদেশের মেয়ে রায়হানা। তাদের উচ্ছৃঙ্খল মেয়েকে মানুষ করার জন্য বাবা-মাই তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তো সেই রায়হানা পরবর্তীতে অনেকগুলো চিঠি লেখেন তার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষকে, যার একটিতে ভাস্বর হয়ে আছে নীচের কথাগুলোঃ ‘’আপনি আমাদের দিকে দিন-রাত খেয়াল রেখেছেন…আমাদের প্রতি প্রদর্শন করেছেন পিতামাতার থেকেও বেশী দয়া…আমি খুবই কৃতজ্ঞ! আমি জানি, যা দিয়েছেন, তার এক-দশমাংশও ফিরিয়ে দিতে পারবো না।“
কথাগুলো মুখলিসা বুবিকে নিয়ে, যিনি ১৮৬৯ সনে তাতারস্থানের রাজধানী কাযান থেকে ৩২০ কিলো দূরের একটি সাধারণ গ্রামে জন্মগ্রহন করেও পুরো রাশিয়ার ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছেন, পুনর্জাগরনের যুগে মুসলিম জ্ঞান ও ঐতিহ্যের দীপশিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছেন। জার দ্বিতীয় আলেক্সান্ডারের “গ্রেট রিফর্ম” এর মন্ত্র “প্রগতি শুধু সম্ভবই না, এটা রয়েছে হাতের নাগালেই” দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তাতার সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে উঠে জাদিদ গোষ্ঠী, যারা উন্নয়নের জন্য ইসলামিক শিক্ষাকে পুনর্জীবিত করার জন্য সক্রিয় হন। সেই প্রচেষ্টার ফসল হিসেবেই জাদিদ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মি মুখলিসা বুবি গড়ে তোলেন স্কুলটি।
১৯১৭ সালের জাগরণকালে রাশিয়ার তাতারস্তানে গড়ে তোলা হয় মুসলিম স্পিরিচুয়াল অ্যাসেম্বলি। অষ্টাদশ শতাব্দীর রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথেরিনের দেখানো পথ অনুসরণ করে মুসলিমদের জীবনকে এভাবে ধর্মীয় আইনের অধীনে সুগঠিত করার প্রয়াস নেয়া হয়। সেই অ্যাসেম্বলির একটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন মুখলিসা বুবি, কারণ এটা ছিল কোন মুসলিম নারীর বিচারক হওয়ার প্রথম ঘটনা। অবশ্য এই নির্বাচনকে একটি বড় ধরণের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভুল প্রমাণ করতে অচিরেই উঠেপড়ে লাগে কিছু মানুষ। কিন্তু সব বিরোধিতা ও অসহযোগীতা মুখলিসার দৃঢ় মনোভাবের কাছে উড়ে যায়।
পরবর্তী বিশটি বছর মুখলিসা বুবির কার্যস্থল ছিল ডিপার্টমেন্ট অব ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার্স যারা যারা কাজ করতো বিবাহবিচ্ছেদ, যৌতুক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তান হেফাজত ও অন্যান্য মেয়েলি অভিযোগ নিয়ে। মুখলিসার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা যেন পরিপূর্ণতা পেল বিচারপতির কাজটিতে। তিনি তার অধীনস্ত সকল মোল্লা ও ইমাম (স্থানীয় ধর্ম নেতা ) কে নারীদের অধিকার সমুন্নত রাখতে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন। বিশেষ করে, বিবাহিত পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন মুখলিসা। তার তদারকি ও নেতৃত্বে ‘স্প্রিচুয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান অব মুসলিমস’ একটি আদর্শ বিবাহ চুক্তির খসড়া প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম নারীদের বহুবিবাহজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা করে। এই চুক্তিটি শরীয়া আইনের অধীনেই হয়েছিল যেখানে বিবাহের শর্তাবলী এবং ব্যত্যয়গুলো বিয়ের কনেকে জোরে জোরে ও সহজবোধ্য ভাষায় পড়ে শোনানোর বাধ্যবাধকতা রাখা হয়। কোন পুরুষ যদি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই দ্বিতীয় বিয়ে করে, মদ বা জুয়ার নেশায় নিমজ্জিত হয়, যৌনরোগে আক্রান্ত হয়, পুরুষত্বহীন হয়ে পড়ে বা সাংসারিক খরচাদি মেটাতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে সংক্ষুদ্ধ স্ত্রীটি যেন তার স্বামীর বিরুদ্ধে সরাসরি ও স্বাধীনভাবে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন শুরু করতে, সেই সুযোগ আদর্শ বিবাহ চুক্তিটিতে রাখা হয়েছিল। মেয়েদের জন্য মুখলিসার এই সংগ্রামকে নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত করেছে তার নিজের জীবন। , নিজের মোল্লা স্বামীর সাথে কিছুতেই বনিবনা হচ্ছিল না। অথচ প্রায় বিশ বছর তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিচ্ছেদ কার্যকর করতে, অনিচ্ছা সত্বেও করতে হয়েছে স্বামীর ঘর।
একজন দৃঢ়চেতা ও ন্যায্য বিচারক হিসেবে মুখলিসার সুনাম দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাশিয়ায়। সর্বত্র তার ডাক পড়তে থাকে পারিবারিক বিচারকার্য সমাধায়। অথচ খ্যাতির মোহ চুল পরিমাণ স্পর্শ করতে পারেনি মুখলিসাকে, তিনি অবিচল থাকেন তার দায়িত্বে। ১৯২০-২২ এর পোভোলঝাই দুর্ভিক্ষে যখন ভলগা এলাকার প্রায় পঞ্চাশ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে, মুখলিসা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট মুখপাত্র প্রাভদায় একটা চিঠি লিখেন নিজের সাক্ষরে, যার ভাষ্য ছিল যে মেয়েরা রক্ষা পেয়েছে এই দুর্ভিক্ষের হাত হতে, তাদের যেন বিবাহবিচ্ছেদ ও নতুন বিয়ের অধিকার থেকে কোনভাবেই বঞ্চিত না করা হয়, কারণ এই মেয়েদের অনেকেরই স্বামীকে দুর্ভিক্ষের পর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মুখলিসা বাল্য বিবাহ ও ভাইয়ের বিধবা বিবাহ – নারীদের জন্য অসন্মানজনক এ দুটো প্রথা প্রতিরোধেও ব্যাপক সংগ্রাম করেন।
মুখলিসা বুবি নারীদের উন্নয়নে প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছেন, কিন্তু ধর্মীয় শরীয়াহ্ থেকে বের হয়ে নয়। তিনি মোল্লা ও ইমামদের আহবান জানাতেন তারা যেন এলাকার নারীদের মসজিদে যেতে ও ধর্মোপদেশ শুনতে উৎসাহিত করে। মুখলিসা মনে করতেন, মেয়েদের প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমেই বেঁচে থাকবে ধর্মীয় জ্ঞান ও অনুশাসনগুলো। মুখলিসা তার মা ও দাদির মত আবিস্তা বা মহিলা শিক্ষকদের অভাব খুব বোধ করতেন। এই আবিস্তাদের মজলিসে মেয়েরা দলে দলে জড়ো হত। সেখানে কবিতা বা স্ত্রোত্র পাঠ হত, পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হত, আইনি উপদেশ বিনিময় হত। তার ভাষায়ঃ “আমাদের মা ও দাদীরা আমাদের পবিত্র ধর্মটিকে রক্ষা করতে পেরেছিল অনেক বাঁধাবিপত্তি সয়ে, তার কারণ হল, তারা ধর্মটির শিক্ষা ছড়িয়ে দিত অন্যদের মাঝে এবং নিজেরাও শিখতো প্রতিনিয়ত।“
মজার বিষয় হল, কমিউনিস্ট শাসনের গোড়ার দিকে মুখলিসার নারী আন্দোলনকে পূর্ণ সহযোগীতা ও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। লেনিনের কাছে মুসলিমরা ছিলেন পশ্চিমা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সারা বিশ্বের অগ্রদূত। কিন্তু ১৯২২ সালে স্ট্যালিন লেনিনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর সেই মুসলিমরাই প্রতিক্রিয়াশীল ও বুর্জোয়া হিসেবে চিহ্নিত হন। তাদের অটোমানদের ঘনিষ্ঠ মনে করা হত। মুসলিম মসজিদ, সমিতি, স্কুল, সুফি সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হতে থাকলে এক পর্যায়ে মুখলিসার স্কুলটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। অচিরে শরীয়া কোর্টও ভেঙে দেয়া হয় এবং মুখলিসাকে বিচারপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হল। তাতারস্থানকে বিপ্লবের বড় শত্রু ঘোষনা দিয়ে মোল্লা ও ইমামদের উপর চলে গ্রেফতার, বন্দি ও নির্বাসন।
১৯৩৭ সালে মুসলিম স্বায়ত্বশাসন বিলোপ করার মাধ্যমে জনজীবন থেকে ইসলামকে উৎখাতের প্রচেষ্টা চুড়ান্ত রূপ পায়। সেই বছরই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সদস্য সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় মুখলিসাকে। বিদেশী গোয়েন্দাদের সাথে সংযোগ রাখার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। মামলাটি ছিল সম্পূর্ণ সাজানো ও মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্ত এই মামলার অধীনেই মুখলিসা বুবিকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ফাঁসিকাষ্ঠে।
অন্যান্য দেশে যখন মুসলিম নারীদের অধিকার সংরক্ষনের কাজটি আরো কয়েক দশক পরে শুরু হয়েছিল, মুখলিসা সেই বিপ্লবের যুগেই কাজটিকে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিকরণের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ মুখলিসাকে থামিয়ে দিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত ন্যায্য আদালতকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু সোভিয়ে ইউনিয়নের পতনের পর মুখলিসা বুবির গৌরবময় পুনরুত্থান ঘটেছে; ২০১৪ সালে কাজানের ইসলামিক কালচার মিউজিয়াম মুখলিসা বুবির জীবন ও কর্মের উপর একটি স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র খুলেছে। তার নামে পুরুষ্কারের প্রবর্তনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, তাকে নিয়ে নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে। সারা রাশিয়ায় এখন তাকে শ্রদ্ধা করা হয় একজন শিক্ষক, বিচারক ও সমাজ-সংস্কারক নেতা হিসেবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।