কী জানেন, এই সরু লম্বা নীল টেবিলটায় শুয়ে থাকতে থাকতে আমি দেখছি, জলভর্তি কাচের গ্লাসে বিকেলের আলো পড়ে কতরকমের রং হচ্ছে - লাল, বেগনি, কমলা, হলুদ, খয়েরি – আর আমার একটুও ভয় করছে না। কেমন সুন্দর সমস্ত আলো আর রং। ওই তো দূরে চেয়ারে দীপালি বসে আছে। আমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছে অবিনাশ ক্লিনিকে। আমি তো ভয় পাই, তাই। দীপালিকে ছাড়া আমি কোথাও যাই না। হারুদাদা বলে গেছে ডাক্তার আসছে, সেও তো প্রায় দেড় ঘন্টা হলো, হলো না? দীপালি উসখুস করছে। ছ’টার আগে প্রতিদিন সাজগোজ সেরে ফেলতে হয় ওকে। আজ শনিবার। কাস্টমারের ভিড় থাকে। আমার কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। শুধু একমাস হলো গলার বাঁদিকে খুব চুলকোয়। তাই দীপালি হারুদাদাকে ফোন করল। হারুদাদা অবিনাশ ক্লিনিকের সব কাজ করে। সব মানে স-ব। মেয়েদের ইনজেকশনের তারিখ বলে দেয়, ডাক্তারবাবুদের চা আনে, কেউ রাস্তা ভুল করে চলে এলে তার নাম ঠিকানা লিখে রাখে। তবু আমার হারুদাদাকে ভালো লাগে না। কেমন ঘোলা ঘোলা চোখ, আর দীপালিকে ডাকতে গেলেই আমার পেছনে চাঁটি মেরে যায়। ছোটবেলায় করত সে একরকম। এখন তো বড় হয়েছি। দীপালি ওকে বকে না। আজ আবার সে বলে গেছে, এই ডাক্তারটা নাকি বড় বড় ইনজেকশন দেয়। দীপালি চোখ টিপেছে আমার দিকে তাকিয়ে। বুঝে গেছি বদমাশটা মিছিমিছিই আমায় ভয় দেখাচ্ছে। মোটকা সোটকা একজন মাঝবয়সী ডাক্তার এলো যখন, বড় কাঁটা অল্প পাঁচ ছাড়িয়েছে আর ছোট কাঁটা চারের ঘরে। আমায় ঘড়ি দেখতে আর যোগ-বিয়োগ করতে শিখিয়েছে দীপালি। ও অনেক লেখাপড়া জানে। দশ ক্লাস অবধি পড়েছে। একের পর আরো নয় ঘর!
দীপালি দেববর্মা অনেক দূর থেকে কোলকাতায় এসেছিল। গোমতী থেকে। ওখানে প্রথমে প্লেন, তারপর বাসে চেপে যেতে হয়। ওকে ওদের স্কুলের বন্ধু পলাশের দাদা নিয়ে এসেছিল বারো বছর আগে। এখন ওর বয়স সাতাশ। মানে তখন, পঁচিশ – না না – পনেরো ছিল। আমার বয়স আট বছর। দীপালি বলে, একদিন ভোরবেলায়, আশ্বিন মাসে, ও নিচে নেমেছিল পটি করতে। আমাদের তো ঘরগুলো সব পরপর, কিন্তু হিসি আর হাগুর একটাই জায়গা। এই বিল্ডিঙের নিচের তলায় একদম কোণের দিকে। দেখে কী, আমি গুটলি হয়ে একা শুয়ে আছি। আর হিমের মধ্যে কাঁপছি। তখনই আমায় তুলে এনেছিল। আমার সবই মনে আছে। কিন্তু কিছু বলি না। দীপালি একটা বাদামি নাইটির ওপর সবুজ সুতির ওড়না চড়িয়েছিল। এখন রক্ত বেরোলে ওই ওড়না ছেঁড়াটা নেয়। ক্লিনিক থেকে মাত্র কটা ওই সাদা সাদা ন্যাপকিনগুলো দেয়। তাতে আমাদের দুজনের কুলোয় না। দীপালির ঘরে প্রায় রোজই খদ্দের আসে। দীপালিকে বড় সুন্দর দেখতে। টকটকে ফর্সা বুক, নরম নরম হাত। যেদিন খদ্দের থাকে না, আমরা অনেক অনেক গল্প করি। বরাবর এমনটাই হয়ে আসছে। আমাদের দেওয়ালে চারজনের ছবি লাগানো আছে। আমি চারজনকেই চিনি। একটা আদ্যা মা, একটা নেতাজি, একটা মাধুরী দীক্ষিত, আরেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীপালির ট্রাঙ্কে আরও একটা ছোট্ট মতো ছবি আছে। আমি জানি ওটা কার। পলাশের। আমাকে কেউ বলেনি। কিন্তু জানি। একদিন দুপুরবেলা খাটের ওপর ছবিটা পড়েছিল, আর আমি রাগ করে একটু চিবিয়ে ফেলেছিলাম। দীপালি কী মারই মেরেছিল। ওই একদিনই। আর কখখনও না। তারপর নিজেই একঘন্টা কাঁদলো। দীপালি ওর মা বাবার কথা একেবারে বলে না। গোমতীর কারো কথাই বলে না প্রায়। কেবল একজন দিদিমণির কথা বলে – তার নাম মায়া। উনি দীপালিকে খুব ভালোবাসতেন। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন, ঘি ভাত রান্না করে খাওয়াতেন। সেইসব গান দীপালি গায়। মাঝে মাঝে। বিশেষ করে ওই শুভাশিস এলে। শুভাশিসকে একটানা দু’বছর হলো দেখছি, মাসে সাধারণত একবার আসে। শুরুর দিকে, মাইনে পেয়ে। আমার জন্য ক্রিমবিস্কুট আনে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। আর টাকা দেওয়ার পর আমাদের একটা-দুটো করে কবিতা শুনিয়ে চলে যায়। আমি আর দীপালি তখন খুব হাসি।
গলার বাঁদিকে চুলকোনোটা হঠাৎ হলো। ওই লোকটা চলে যাওয়ার তিন চারদিনের মাথায়। আমি চুলকোনোর চেষ্টা করি খালি। কবে একটা নখ লেগে রক্ত বেরিয়ে গেলো। দীপালি বোরোলিন লাগিয়ে দেয়। একটু আরাম পাই। কিন্তু মলম উঠে গেলে আবার যে কে সেই। দীপালি ভাবে সেরে যাবে। এমন তো এখানে হয়। একবার একটা লোক দীপালির হিসুর জায়গায় বিড়ির ছেঁকা দিয়েছিল। আমি ঘরে ঢুকে দেখি দীপালি কাতরাচ্ছে। উঠতে পারছে না। মঞ্জুমাসি মেয়েদের ডাক্তার ডেকে আনলো। অনেকদিন মলম লাগাতে লাগাতে তবে কমলো। সেসময় ও বাথরুম করতে গিয়ে কাঁদত বলে আমি দরজার বাইরেটায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমিও ভাবলাম সেইরকমই, এও কমে যাবে। লোহার চেন গলায় বসে যাওয়া বৈ আর কিছু তো না। আমায় কুড়িয়ে পাওয়ার এক বছর পর দীপালি যখন আমার প্রথম জন্মদিন করলো, এই বাড়ির সব মেয়েকে গুজিয়া আর খাস্তা নিমকি খাইয়েছিল। আমি আর দীপালি দুজনেই গুজিয়া খেতে হেব্বি ভালোবাসি। দীপালি শনিবার-শনিবার আদ্যা মা-র পায়ে দেয়, তারপর তুলেই টপাটপ দু’জনে খেয়ে নিই। এই চেনটা হারুদাদা এনে দিয়েছিল ওই জন্মদিনে। দীপালিকে বলেছিল- ঘরে খদ্দের ঢুকলে অনুকে বাইরে বেঁধে রাখবি। দীপালি বাঁধেনা। কোনওদিনও না। এমনিই আমি বারান্দায় বা সিঁড়িতে অথবা দালানে বসে থাকি। ওহ বলা হয়নি, আমার ডাকনাম অনু, দীপালি দিয়েছে। আর কে আছে আমাদের, দীপালির অনু আর অনুর দীপালি ছাড়া!
মোটা ডাক্তার অনেকক্ষণ কথা বলছিল দীপালির সাথে। আমায় পরীক্ষা করার আগে। দীপালি কী এত সব বলছে! ফিসফিস করে কথা চলছে। আমি কান খাড়া রেখেও শুনতে পাচ্ছি না। যে যাই বলুক, আমি কিন্তু জানি দীপালি লোকটাকে তাড়িয়ে দিতেই চেয়েছিল। শুধু পুজোর সিজিন, লোকটা মঞ্জুমাসির কাছে অর্ধেক টাকা অ্যাডভান্স করে গেছে; ফেরানো যেত না। অন্য মেয়েদের ঘরও তো খালি নেই। আর এবারেই দীপালির মাসিকের তারিখ এগোলো পাঁচদিন। ওই বয়স্ক হিন্দুস্থানি লোকটা দীপালির চুড়িদারের দড়ি ধরে টানছিল। আমি তো ঘরের বাইরেই ছিলাম। দুটো পাল্লার মাঝের অল্প ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম একটু একটু। লোকটা দেখলো দীপালির নিচে সবুজ ওড়না ছেঁড়া, লোকটা ওর চুলের মুঠি ধরে গালে কামড় দিল, তারপর দরজা খুলে আমাকে টেনে নিয়ে এলো ঘরে, আলমারির নিচে পড়ে থাকা চেনটা গলায় খুব জোরে বাঁধলো, আর অন্যদিকটা খাটের ছত্রীতে। লোকটা মোট ছ’মিনিট সময় নিল। বারোটা ছাব্বিশ থেকে বারোটা বত্তিরিশ। দীপালি কিন্তু আমায় ছেড়ে যায়নি। সমস্তক্ষণ বসেছিল মেঝেয়, খাটের পায়া আঁকড়ে ধরে। আমরা দুজনেই ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। লোকটা প্রচণ্ড বেগে আমার পেটে একটা লাথি মেরে বলল- সালি কুত্তি; তারপর কয়েকটা একশ’ টাকার নোট নিচে ফেলে বেরিয়ে গেলো। সমস্ত রাত আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে আদ্যা মা-র ছবির নিচে বসেছিলাম। ভোরের দিকে খিদে পেলে দু’পায়ে ভর দিয়ে ঠাকুরের প্লেটের গুজিয়ে তুলে খেলাম। অন্যদিন হলে দীপালি বকতো, আজ পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল খালি।
কিন্তু আমি জানি দীপালি আর কাউকে এসব বলবে না। যেমন পলাশের দাদার কথাও বলেনি, বলেনা কখনও। মোটা ডাক্তারের পাশে হারুদাদা এসে দাঁড়িয়েছে। হাত নেড়ে নেড়ে বলছে কী যেন। আমি মাথা এলিয়ে শুয়ে আছি রুগী দেখার নীল টেবিলে। মোটা ডাক্তার আমার গলা পরীক্ষা করছে। ওর হাত দীপালির মতো নরম নয়। ম্যাগট কী জিনিস? ডাক্তার বিড়বিড় করে বলছে আপন মনে। মাথামুণ্ডু বুঝছি না। ওফফফ, হারুদাদা সত্যিই বিরাট ছুঁচ, কাঁচি, সন্না, কতো কী আনছে এক এক করে!
ড্রেসিংটা করে যেতে হবে রে দীপালি। অ্যানটিবায়োটিক ইনজেকশন চলবে এখন। তুই কি পারবি?
দীপালি কিছু বলছে না। হারুর দিকে তাকালো একবার। হারু বলল, ও ভাববেন না স্যার, আমি ব্যবস্থা করে দেবো এক হপ্তার ভেতর।
কিন্তু আমি যে দীপালিকে ছাড়া একা একা থাকতে পারিনা – আমার যে ভয় করে – খুব ভয় – অন্ধকারগুলো গিলে খেতে আসে – ফাঁকা ঘরে চোখ বুজলেই দেখতে পাই একজোড়া ঘোলাটে চোখ – গতবার বড়দিনে দীপালিকে একরাতের জন্য বুকিং করে নিয়ে গেল লোকাল থানার ওসি – আমি আলতো ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম সবুজ মাঠের মাঝখানটায় একটা একতলা বাড়ি – শকুন্তলা বালিকা বিদ্যালয় – ক্লাসঘরে গোলাপি সুতির শাড়ি পরা মায়া আন্টির সাথে দীপালি গান গাইছে – মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও – আমি বসে আছি হাই বেঞ্চির ওপর – দীনতা আর মলিনতা মানে কী দীপালি? আমাকে কি ওরা হাসপাতালে নিয়ে যাবে?
একটানা তিনদিন ড্রেসিং চলল। দুপুরের দিকগুলোয়। প্রথমে সাদা বোতল থেকে জল ঢেলে ঢেলে ধোয়া, দীপালির ভুরু তোলার সন্নার মতো একটা জিনিস দিয়ে খুঁটে খুঁটে পরিষ্কার করা, তারপর মলম, তার ওপর তুলো আর গজ কাপড়। দীপালি নাকে ওড়না জড়িয়ে এইসব করছে। চতুর্থদিন দুপুরবেলা আমাকে আবার অবিনাশ ক্লিনিকে নিয়ে এলো। আবার সেই মোটা ডাক্তার আসবে বুঝি? কিন্তু হারু তো একটা মাল তোলার গাড়ি থেকে নামছে। দীপালিকে বলছে- কর্পোরেশনের লোক এসে গেছে, বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না, তাড়াতাড়ি কর। আরো দু’জন ছেলে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে, হাফপ্যান্ট পরা। আমাকে চ্যাংদোলা করে গাড়ির সাথে আটকানো খাঁচার ভেতর তুলতে চাইছে। ওদের মধ্যে যে ছেলেটা বেশি লম্বা-চওড়া, আমার পা ধরে টানছে খালি। আমি সাদা ওড়নার খুঁট চেপে ধরে আছি দাঁত দিয়ে। হারামী কুত্তি, চল – পাশের ছেলেটা বলল। দীপালি সাদা ওড়নাটা খুলে দিল গা থেকে। আমি কাপড়ের টুকরো মুখে নিয়ে খাঁচার ভেতর থেকে দেখছি বিকেল হয়ে এসেছে, দীপালি সাজতে যাবে এইবার, গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছে, অবিনাশ ক্লিনিক লাগোয়া লাভলি বিউটি পার্লারের সামনে ভিড় জমিয়েছে আমাদেরই নিচের তলার পাঁচছ’জন মেয়ে, সার দেওয়া হলুদ ট্যাক্সি, জনা চারেক ড্রাইভার খৈনি ডলছে হাতের তালুতে। আমার ডাকনাম অনু, আর ভালো নাম অনুপ্রেরণা দেববর্মা। দীপালির দেওয়া। আর কে আছে আমাদের, দীপালির অনু আর অনুর দীপালি ছাড়া! দীপালি বলেছে, আদ্যা মা-র লাল ভাঁড়ে প্লেনের টিকিটের মতো টাকা জমলে একদিন আমরা শকুন্তলা বালিকা বিদ্যালয়ে যাবো।
.........