“I see trees of green, red roses too
I see them bloom for me and you
And I think to myself, what a wonderful world…”
হলদিপুর গ্রামের একটা প্রাচুর্যহীন উঠোনে ছোটোখাটো চেহারার ফর্সারং তরুণীটি আইয়ের পাশে বসে গম ভাঙছিল l আই বলছিল- ওরকম নয়, আরো জোরে জোরে ভাঙতে হয়! মেয়েটা চেষ্টা করছিল যতখানি সম্ভব নিপুণভাবে কাজটুকু করা যায় l কিন্তু আইকে সন্তুষ্ট করতে পারছিল না l আসলে মেয়েটি কখনই চায়নি তার জীবনটা ‘চাক্কি পিষতে পিষতে’ অতিবাহিত হয়ে যাক l সে কিছু একটা হয়ে উঠতে চেয়েছিল l চেয়েছিল বম্বে এসে পড়াশোনা করতে ও কাজের জগত খুঁজে নিতে l মেয়েটা বম্বে এসেছিল l তৎকালীন বম্বে মিউনিসিপ্যালিটির কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে ট্রেনি নার্স হিসেবে কাজও করতে শুরু করেছিল l সময়টা সত্তর দশকের এক্কেবারে প্রথমদিক l সন্দীপ সরদেশাই নামে জনৈক জুনিয়র ডাক্তার তখন হাসপাতাল সংলগ্ন হোস্টেলে থেকে, এমডি এন্ট্রান্সের জন্য পড়াশোনা করছে l কর্ণাটক থেকে আসা ওই নার্সটিকে ভালো লেগে গিয়েছিল তার l তারপর পারস্পরিক চেনাশোনা ও বিয়ের সিদ্ধান্ত l এ পর্যন্ত গল্পটা প্রেমের l মানে সিনেমায় যেমন হয়, চারপাশে যেমনটা দেখে থাকি আমরা l কিন্তু কোনো কোনো গল্পের সঙ্গে এক না-গল্প মিশে থাকে, যা ক্রমে পাল্টে দিতে পারে রাষ্ট্রের বস্তাপচা বেশকিছু ধ্যানধারণাকে l সেসব না-গল্প খুঁজতেই সাংবাদিক পিঙ্কি বিরানি একদিন বেরিয়ে পড়েছিলেন কেইএম হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উদ্দেশে, যেখানে হলদিপুর গ্রামের পাঁচ ফুটিয়া মেয়েটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল লাগাতার বিয়াল্লিশটা বছর l এই মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় ২০১১ সালের মার্চ মাসের একটা দুপুরবেলা l ‘জড়বস্তুর মতো’ পড়ে থাকা মেয়েটির পরোক্ষ নিষ্কৃতিমৃত্যুর আবেদন খারিজের খবরটা হঠাৎই চোখে পড়েছিল কোলকাতাস্থিত একটি স্বল্পখ্যাত হাসপাতালের রেস্টরুমে ফেলে রাখা সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায়, যে প্রতিষ্ঠানে আমি সে সময় কর্মরত ছিলাম, যখন আমার ও অরুণা শানবাগের, মানে ওই কেইএম হাসপাতালেরর ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ক্রমশ গুটিয়ে যাওয়া মেয়েটির ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল দু’হাজার কিলোমিটারের সামান্য কিছু বেশি l
হ্যাঁ, এভাবেও ভালোবাসা যায় l
স্তব্ধতার ১১ ঘন্টা:
অধিকাংশ হাসপাতালেই ঘরের অপ্রতুলতার কারণে নার্সদের নৈমিত্তিক পোশাক বদলানোর জন্য পৃথক ও স্বাধীন কোনো কামরা থাকে না l আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে কেইএম হাসপাতালেও বলা বাহুল্য, ছিল না l বেসমেন্টে একটি পরিত্যক্ত ঘর ছিল, বেশ বড়সর, যেখানে পশুদের সার্জারি করা হত, নার্স মেয়েরা সেটিকে তাদের চেঞ্জিং রুম বানিয়ে নেয় l রোজকার মতো সেদিনও ডিউটির পর বিকেলবেলা ইউনিফর্ম বদলাচ্ছিল অরুণা l হাসপাতালের সুইপার সোহনলাল ভর্তা বাল্মীকির বেশ কিছুদিন যাবৎ নজর ছিল অরুণার ওপর l তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল নানাভাবে l কখনও ডেকে কথা বলে, কখনও কানের দুল চুরি করে l অরুণা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চুরির অভিযোগ জানিয়েছিল বাল্মীকির বিরুদ্ধে l ক্ষিপ্ত সোহনলাল প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করে তখন থেকেই l অবশেষে ১৯৭৩ এর ২৭ শে নভেম্বর সন্ধেবেলা সে অরুণাকে বাগে পায় l বেসমেন্টের ঘর থেকেই একটা লম্বা মোটা ধাতব চেন জোগাড় করে l কুকুরের চেন l তারপর লুকিয়ে থাকে ওই ঘরের কোণে l অরুণা এলে আচমকা আক্রমণ করে তাকে l গলায় কুকুরের চেনটা পেঁচিয়ে ধরে l সোহনলালের উচ্চতা খুব বেশি ছিল না, কিন্তু চেহারা পেশীবহুল ছিল l রোগা মেয়েটা প্রাণপণ চেষ্টা চালায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার, প্রতিরোধ করার l পারে না l সোহনলাল ধর্ষণে উদ্যত হয় l কিন্তু অরুণা তখন রজঃস্বলা l সোহনলাল তার পায়ুধর্ষণ করে l এই অযৌন অত্যাচার ও পশ্য়াচার (সডোমি অর্থে) প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি সময় ধরে চলে l অরুণা জ্ঞান হারায় l সোহনলাল অরুণার বেতের ব্যাগ থেকে একটা সোনার চেন, সামান্য কিছু টাকা ও পরনের গোলাপি শাড়িটা নিয়ে ঘর ছেড়ে পালায় ও পরেরদিন সকালে অন্যান্য দিনের মতোই নির্বিকার চিত্তে কাজে আসে l কুকুরের চেন দিয়ে বাঁধার ফলে অরুণার traumatic brain injury বা আঘাতজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে l ব্রেনে অক্সিজেন ও রক্ত সরবরাহ কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় বা সেরিব্রাল অ্যানক্সিয়া হয়, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে- AHI বা anoxic hypoxic injury l এই পরিস্থিতিতে তিন থেকে চার মিনিটের বেশি সময় মানুষ একটানা থাকলে তার তৎক্ষণাত মৃত্যু ঘটতে পারে l এক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিকে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হয় আর মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ ফিরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হয় l নাহলে রোগী কোমাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে l অথবা ভেজিটেটিভ স্টেটে চলে যায় l কিন্তু কোনো এমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট নেওয়াই অরুণার ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয়নি l কারণ ঘটনাস্থলে সে অর্ধচেতন অবস্থায় একটানা ১১ ঘন্টা পড়ে থাকে l পরদিন, ২৮ এ নভেম্বর সকালে ডিউটি-রত আরেক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ও অন্য এক নার্স অরুণার রক্তাক্ত দেহ খুঁজে পায় ওই ঘরেই l মেয়েটা উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়েছিল l পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ l চিবুকের নিচে বমি, লালা l মুখে-গলায় আঘাতের চিহ্ন l নিম্নভাগে ক্রমশ শুকিয়ে আসা চাপ চাপ রক্ত l খুব ক্ষীণ একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছিল গলা থেকে l
রুদ্ধতার ৪২ বছর:
পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট মানে কিন্তু ‘কোমা’ বা complete unconsciousness নয়, বরং আংশিক-চেতন বলা যেতে পারে l জড় অবস্থায় বা ভেজিটেটিভ স্টেটে রোগী চার সপ্তাহের বেশি সময় থাকলে তাকে পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট বলা হয় l ১৯৪০ সালে এই অবস্থাটিকে apallic syndrome নামে চিহ্নিত করেন এক বিজ্ঞানী l প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ অরুণার ধর্ষণের মাত্র এক বছর আগে, একজন স্কটিশ ও একজন আমেরিকান স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, চার সপ্তাহের অধিককালব্যাপী এই অর্ধচেতন অবস্থাটিকে PVS নামে ব্যাখ্যা করেন এবং গবেষণার পর জানান চিকিৎসার দ্বারা এই পরিস্থিতিতেও রোগীর শরীরকে ‘জীবিত’ রাখা সম্ভব l PVS এর লক্ষণগুলো সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক l ১) রোগী চোখের পলক ফেলতে সক্ষম হয় ২) খাইয়ে দিলে খাবার গিলতে পারে ৩) দৃষ্টি স্থির থাকে বা বস্তুর চলাফেরা সামান্য অনুসরণ করতে পারে অথবা লক্ষ্য ছাড়াই চোখের গতি দ্রুত বদলাতে থাকে ৪) ঘুম ও জেগে থাকার চক্রাকার অবস্থা চলতে থাকে বা রোগী সম্পূর্ণভাবে জাগ্রত অবস্থায় থেকে যায় ৫) একাধিক আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যেমন দাঁতে দাঁত ঘষা, গোঁ গোঁ বা ঘড়ঘড় শব্দ করা, হঠাৎ হেসে বা কেঁদে ওঠা, প্রচণ্ড চীত্কার করা- কোনোরকম বাহ্যিক কারণ বা external stimuli ছাড়াই l ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে তিনজন ডাক্তারের যে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়, তার বয়ান অনুযায়ী- অরুণার ক্ষেত্রে জীবদ্দশার বিভিন্ন অবস্থায় প্রায় সবকটি লক্ষণ দেখা গিয়েছিল l তাদের পরীক্ষা ও রিপোর্ট অনুযায়ী: কখনও অরুণা কেবলই হাসত - অথবা পলক ফেললে মনে হত সাড়া দিতে চাইছে - ক্রমে সেইসব নার্স, যারা স্বেচ্ছায় অরুণার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিল, তাদের ভুল ভাঙে - তারা বোঝে অরুণা আসলে কিছুই দেখছে না, শুনছে না - অরুণার তীব্র চিৎকার অন্যান্য ওয়ার্ড থেকে শোনা যেত - মাঝে মাঝে কেবল একনাগাড়ে জল পড়ত চোখের কোল বেয়ে - অরুণা মলমূত্র বিছানাতেই ত্যাগ করত - অরুণার দাঁত একে একে ক্ষয়ে যাচ্ছিল - হাড় এতটাই ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছিল যে ন্যূনতম আঘাতেও ভেঙে যেতে পারত - অরুণার দুটি কব্জি ও দুটি হাঁটুই বরাবরের জন্য আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল - হাতের আঙুলের বিকৃতি ঘটছিল, ফলত নখ বেশি বেড়ে গিয়ে থাকলে তালুতে গেঁথে যেতে পারত ও সেখানে আলসার দেখা দিতে পারত - নার্সদের নিয়মিত শুশ্রুষা করতে হত এসবের - তারা এতটাই নিষ্ঠার সঙ্গে অরুণার সেবা করত যে ৪২ বছর বিছানায় অতিবাহিত করার পরেও তার শরীরে কোনো বেডসোর চোখে পড়েনি, এমনকি কোনো ফ্রাকচার-ও না l
অরুণার পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে পিঙ্কি বিরানি তাকে নিজের লেখা বই ‘অরুনা’জ স্টোরি’ ‘দেখাতে’ যায় l আর ষাটের জন্মদিনে গিয়ে দেখে অরুণার একটা দাঁত ভেঙে বিছানায় পড়ে আছে, এবং মুখ থেকে অনবরত একটা ক্ষীণ শব্দ বেরিয়ে আসছে l ডাক্তারি শাস্ত্রে PVS-এর চিকিৎসা আপাতত সীমাবদ্ধ l কিছু anidepressant বা dopaminergic ওষুধ, সার্জিকাল মেথড হিসাবে deep brain stimulation, physiotherapy, আর stimulation technique- মূলত এই l প্রসঙ্গত, অরুণার ক্ষেত্রে গলা খাবার, জল, আর সামান্য কিছু ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে জানা যায় না l
২৮ শে নভেম্বর ১৯৭৩ এর পর সোহনলালের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস করে অরুণার সহকর্মী নার্সরা l তাকে কোর্টে তোলা হয় l চুরি ও খুনের চেষ্টার অপরাধে বাল্মীকির সাত বছরের জেল হয় l সমগ্র ঘটনায় কোথাও ধর্ষণের ব্যাপারটাকে তুলে ধরা হয়না, কারণ ডাক্তারি পরীক্ষায় অরুনার যোনি অক্ষত পাওয়া গিয়েছিল l এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে কেবল penile penetration into the vagina-কেই ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে l ১৯৮০ সালে সোহনলাল জেল থেকে ছাড়া পায় l ইতিমধ্যে সাত বছর কেইএম হাসপাতালের একটি বিছানা দখল করে আছে বলে, কর্তৃপক্ষ তার আত্মীয়দের ডেকে অরুণাকে সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করে l বিপক্ষে দাঁড়ায় সমস্ত নার্স, তারা আন্দোলন করে, বিক্ষোভ দেখায়, ফলত পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় হাসপাতাল l অরুণার মৃত্যু-পরবর্তী রিপোর্টে পাওয়া গিয়েছিল, সম্ভবত ২০১১ সালে সোহনলাল বাল্মীকি মারা গেছে l সে খবর ভুয়ো প্রমাণ করে সম্প্রতি একটি মারাঠি সংবাদপত্রের সংবাদ প্রতিনিধিরা উত্তর প্রদেশের হাপুর জেলায় সোহনলাল-কে খুঁজে বার করল l তার বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে l ৪২ বছর আগেকার ঘটনা নিয়ে কথা বলতে সে স্বভাবতই অত্যন্ত অনিচ্ছুক l তবে আশার কথা এই যে, হাপুর-এর ডিস্ট্রিক ম্যাজিসট্রেট জানিয়েছেন, মুম্বই পুলিশ কোনোরকম সাহায্য চাইলে তাঁরা অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন l
এদিকে ’৭৩ সালে সন্দীপ তখন জুনিয়র ডাক্তার ও পড়ুয়া l সে সকাল বিকেল এসে বসে থাকত অরুণার পাশে l অরুণা একদিন সাড়া দেবে এই আকাঙ্ক্ষায় তাকে বই পড়ে শোনাত, গল্প বলত l কয়েক মাস পর ডিন তাকে ডেকে পাঠান ও এ সমস্ত ঘটনা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ আসে l কেমন আছেন সন্দীপ, আমরা জানিনা l শুধু চিনি তাঁর প্রথম যৌবনের সেই প্রেমিকা অরুণা শানবাগকে, যার নাম আজ বিশ্বের দীর্ঘতম PVS-case হিসেবে সারা পৃথিবী জেনে গেছে l
ইউথেনেশিয়া ও রাষ্ট্র:
শব্দটা ‘মারসি কিলিং’ l বাংলা করলে দাঁড়ায়- করুণাজাত হত্যা l সমাজ ও সংস্কৃতির শুরুতেই কোথাও এই ভাবনাটা গেঁথে আছে, যে ব্যাপারটা মৃত্যু কম, হত্যা বেশি l বরং ‘ডায়িং উইথ ডিগনিটি’ কথাটা শুনতে ভালো l ডিসেম্বর ২০০৯-এ পিঙ্কি বিরানি অরুণার জন্য তার নিকটতম বন্ধু হিসেবে পরোক্ষ নিষ্কৃতিমৃত্যুর আবেদন জানান l এর আগে, ভারতীয় আইনে ইউথেনেশিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল না l ২০১১-র ৭ই মার্চ দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যেখানে জানানো হয়, আবেদনকারীর সংশ্লিষ্ট উচ্চ-আদালত দুটি অপরিবর্তনীয় ক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে পরোক্ষ নিষ্কৃতিমৃত্যুর অনুমতি দিতে পারে l এক- কোমা বা মস্তিষ্ক-মৃত্যুর ক্ষেত্রে হার্ট-লাং মেশিন বন্ধ করা যেতে পারে; দুই- পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ-এর ক্ষেত্রে একটু একটু করে খাদ্য বা পুষ্টির মাত্রা কমিয়ে একেবারে খাওয়ানো বন্ধ করা যেতে পারে l গত ৪২ বছর যারা অরুণার সংস্পর্শে থেকেছে ও দেখভাল করেছে, আদালত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাদের ওপর ছেড়ে দেয় l সেইসব নার্স ও অন্যান্য কর্মীরা অরুণাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় l তারা চায় না অরুণার ন্যূনতম লাইফ সাপোর্ট, মানে ওই খাবার ও জলটুকু বন্ধ করা হোক l ফলত আদালত পিঙ্কির আবেদন খারিজ করে l যদিও ডাক্তারদের একটা বড় অংশ ২০১১ সালেও এই নিষ্কৃতিমৃত্যুর পক্ষেই ছিল l অরুণার মৃত্যু-পরবর্তী পর্যায়ে ম্যাক্স হেলথকেয়ারে কর্মরত ডাঃ রোহতগি টিভি-পর্দায় বললেন- অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে চিকিত্সার চতুর্থ নীতি ইকুয়ালিটি বা সাম্য; যদি কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে একজন রোগীর প্রতি অতিরিক্ত চিকিত্সার অর্থ ব্যয় করা হতে থাকে যা অন্য কারো প্রাপ্য, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে l (If you see the economics, our fourth ethical principle of medicine as a whole is equality… If one person is actually taking up a lot of economics of care of the other, then you have to question.)
এ কথা কে না জানে, ভারতবর্ষ কেন, গোটা পৃথিবীতেই চিকিৎসা-সাম্য ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে l ব্যক্তির আর্থসামাজিক অবস্থানের সাথে সাথে চিকিৎসালাভের অধিকার, মানবতার অধিকার, সবই বদলে বদলে যায় l সে যাক l ওই একইদিনে ভারতে অ্যাকটিভ ইউথেনেশিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত l জানানো হয়- কোনো রোগী রোগযন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না বলে ডাক্তার যদি তাকে লেথাল ড্রাগের ইনজেকশন প্রয়োগ করে, তাকে আত্মহত্যায় সহায়তার অপরাধে আইপিসি-৩০৬ অনুযায়ী অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে l অথচ রোগযন্ত্রণা ব্যাপারটা ভীষণরকম সাবজেক্টিভ l রোগী কষ্ট সহ্য করতে অক্ষম কিনা, তার সিদ্ধান্ত একমাত্র নিতে পারে সে নিজেই l ডাক্তার বা কাউনসেলর-রা এ ব্যাপারে তাকে শারীরিক ও মানসিক সহায়তা দিতে পারে মাত্র l টার্মিনাল ম্যালিগনেন্সির কথাই ধরা যাক- একটা ফুলেফেঁপে ওঠা টিউমর যাকে বাদ দিয়ে রোগীর ব্যথার অনুভব কমানো যায় মাত্র, কিন্তু রোগ সারানো যায় না l এমন চিকিত্সা palliative care নামে অভিহিত l মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৬ সালে palliative treatment এর জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ফার্মাসিস্ট, সাইকোলজিস্ট-দের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র শাখা তৈরি হয়, যাদের কাজ রোগের লক্ষণের চিকিত্সা করা, যেখানে রোগ সারবে না এমনটা নির্ধারিত হয়ে গেছে l এ দেশেও এমন বেশ কিছু ইউনিট চালু হয়েছে l আইনে বলা হলো- অপরিবর্তনীয় পরিস্থিতিতে রোগীর কাছের মানুষেরা চাইলে, লাইফ সাপোর্ট তুলে নেওয়া যেতে পারে l টার্মিনাল ম্যালিগনেন্সি বোধ করি এখনও পর্যন্ত একপ্রকার অপরিবর্তনীয় পরিস্থিতি l তাহলে দু’ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানগত প্রভেদ ছাড়া সামাজিক কোনো তফাৎ আছে কী? বোধ হয় আছে l তা হলো, রোগীর কনসেন্ট-এ l অর্থাৎ রোগী সম্মতি জানাতে অক্ষম হলে পরিবার বা প্রিয়জন আপিল করতেই পারে, কিন্তু রোগী নিজে ডাক্তারের সহায়তায় মৃত্যু-ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা আত্মহত্যা-সম l বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ওয়াশিংটন, অরিগন-এর মতো কিছু দেশ ইতিমধ্যে অ্যাকটিভ ইউথেনেশিয়া-কে বৈধ হিসাবে গ্রহণ করেছে l এই মুহূর্তে প্যাসিভ ইউথেনেশিয়া মাত্রই কিন্তু ‘নন-ভলেনটারি’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- রোগী এখানে জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা জানাতে অক্ষম l প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গুজারিশ’ ছবিতে আমরা দেখেছিলাম ইথান ম্যাসকারিনাস নামে কোয়াড্রেপ্লেজিয়া বা আঘাতজনিত সার্বিক পক্ষাঘাতে ভোগা একজন মানুষকে, যে ১৪ বছর আদ্যন্ত শয্যাশায়ী থাকার পর আদালতে অ্যাকটিভ ইউথেনেশিয়ার জন্য আবেদন জানায় l বলা বাহুল্য কোর্ট তাকে অনুমতি দেয় না, ও শেষমেষ ইথান তার নিজের ফেয়ারওয়েল পার্টিতে প্রেমিকা, ডাক্তারবন্ধু ও অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষীর সান্নিধ্যে নিজেই মৃত্যুকে বেছে নেয় l
অরুণার নিষ্কৃতিমৃত্যুর আবেদনের সময় দুটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল l এক, শারীরিক অপারগতার কারণে তাকে জীবন্মৃত বলা হয়েছিল, এবং দুই, তার চিৎকার ও অস্থিরতাকে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল l প্রসঙ্গত, কোমা বা পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট-এর ক্ষেত্রে রোগীর ব্যথার অনুভব নিয়ে সারা পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও ধন্দে l অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্রেফ হার্ট রেট বা ব্লাড প্রেসারের তারতম্য দেখে তাকে গিনিপিগের মতো খাইয়ে দেওয়া হয় পেইনকিলার বা সিডেটিভ l অরুণার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল l ফলত তার হাসি-কান্না-গোঙানির অভিব্যক্তির সাথে বাহ্যিক বা শারীরিক যোগ যে ছিলই এমনটা পরীক্ষিত বা প্রমাণিত নয় l পরীক্ষকদের মতে- কোনো ঘটনাতেই সে প্রতিক্রিয়া জানানোর মতো অবস্থায় ছিল না! তবে কোন যন্ত্রণা থেকে অব্যহতির জন্য অরুণা বা তার মতো বেশকিছু মানুষের প্রিয়জনের পরোক্ষ নিষ্কৃতিমৃত্যুর আবেদন? শায়িতের অজান্তে, কাদের যন্ত্রণা-মুক্তির জন্য? রোগীর? তার পরিপার্শ্বের? চিকিৎসাবিজ্ঞানের অক্ষমতার? নাকি গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার পঙ্গু অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর, যা একজন রোগী স্রেফ ‘সুস্থ হবে না’ ঘোষণা করে, অন্য রোগীকে পরিষেবা দেওয়ার পথকে সুগম করতে চায়?
অরুণার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটল বার্ধক্য ও ফুসফুসের সংক্রমণজনিত কারণে, যেমনটা বহু ‘সুস্থ’ ব্যক্তিরই ঘটে থাকে l বেঁচে থাকলে ২০১৫-র ১লা জুন তার বয়স হত ৬৭ l
পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট এবং ভিন্নতর ভাষার সন্ধান :
কেইএম হাসপাতালের প্রাক্তন মেট্রন দুর্গা মেহেতা-কে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রশ্ন করা হল, কেন তিনি ও তাঁর অন্যান্য নার্সরা চাননি অরুণাকে নিষ্কৃতিমৃত্যু দেওয়া হোক l উত্তরে তিনি টিভির পর্দায় জানালেন- আমাদের অধিকার মানুষকে বাঁচানোর, হত্যা করার নয় l অরুণা আমাদেরই একজন ছিল l তুমি নিশ্চয় চাইবে না তোমার কোনো প্রিয়জনকে এভাবে হত্যা করা হোক l (We have right to give life to anybody, not the right to kill anybody. She was one of us. You don’t want your family member to be killed.) এ আবেগসর্বস্ব বক্তব্যের সাথে একমত হওয়া কোনো যুক্তিনির্ভর মানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয় l তবে, অরুণার শায়িত শরীরের সাথে আবেগ ব্যতিরেকে আরও টুকরো টুকরো কিছু বাস্তবতা জড়িয়ে ছিল l নার্সরা জানান- অনেক বছর আগে জন্মদিনে একবার অরুণাকে মাছের টুকরো ভেঙে খাওয়ানো হয়েছিল l অরুণা নাকি সেদিন খুশি হয়েছিল খুব l তার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠেছিল l বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল আপাত-ভাষাহীন চোখ l মনে পড়ে যাচ্ছে ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ ছবির আনন্দভাই-এর কথা, যে একমাত্র মুন্নার প্রশ্নের উত্তরেই ‘পলক ঝপককে’ জবাব দিত, আর বাকিদের কাছে সে ছিল স্রেফ একটা ‘কেস’ l
প্রাথমিকভাবে একজন PVS রোগীর নল মারফত জল ও পুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো লাইফ সাপোর্টের দরকার পড়ে না, কারণ তার হার্ট-লাং-গ্যাস্ট্রিকট্র্যাক্ট একেবারে অ-কার্যকরী হয়ে যায় এমনটা নয় l ধর্ষণের ঘটনার পর টানা ৩৭ বছর অরুণাকে মুখেই খাওয়ানো হত l ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে ম্যালেরিয়া বা ওই জাতীয় কোনো জ্বরের কারণে সে যখন আরো দুর্বল হয়ে পড়ে, কেবল তখনই তাকে খাওয়ানোর জন্য রাইলস টিউব ব্যবহার করা হয় l তিনজন ডাক্তারের তৈরি মেডিকেল রিপোর্টে শারীরিক, মানসিক ও স্নায়বিক পরীক্ষায় অরুণা সম্পর্কে বলা হয়েছিল- ‘intact consciousness without awareness’. অক্ষরগতভাবে এই consciousness এবং awareness-এর পার্থক্য চেতন ও চেতনার যা তফাৎ- কেবল সেটুকুই, তবে নিউরোসাইকিয়াট্রি-র প্রেক্ষিতে দুটো বিষয় ভিন্ন ও স্বতন্ত্র l রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, ঘরে বহু মানুষের সমাগমে অরুণা বিব্রত হত, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত গোঙানি বা চিৎকারের মতো শব্দ l তারা চলে গেলে আবার সে শান্ত সুমতি বালিকাটি l এমনকি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ডাক্তারি পরীক্ষার সময় মেডিকেল টিমের উপস্থিতিকে অরুণা যে সহজভাবে নেয়নি তাও বোঝা গিয়েছিল তার ন্যূনতম প্রতিক্রিয়ায় l আবার, ঘরে ভক্তিগীতি বাজালে তার ভালো লাগত বলে জানিয়েছিল নার্সরা, যেমন সে মাছ খেতে ভালোবাসতো, যেমন তার ভালো লাগতো প্রতি বছর নতুন নতুন নার্সিং-এর ছাত্রীদের সাথে আলাপ করতে! তথাকথিত মানসিক ও স্নায়বিক বৈকল্যের এ ভালোবাসার-মন্দবাসার ভাষা এখনও আমাদের বোধগম্যতার বাইরে l আসলে আমরা লিঙ্গুইসটিক্স-এর সেই সনাতন স্ট্রাকচারে আটকে আছি, যেখানে ধূসর রং বলতে আমাদের সামনে ঘুঘু পাখির পালকের মতো কিছু নির্দিষ্ট ‘সিম্বল’ ভেসে ওঠে, আমরা ভুলে যাই there are many shades of grey between black and white. হয়তো কোনো একদিন মনোবিজ্ঞান উন্নততর হলে আমরা ক্রমশ পড়তে শিখব এইসব বিকল্প ও সমান্তরাল যাপনের অনুভূতি আর অভিব্যক্তিকে l ততদিন পর্যন্ত একজন আংশিক চেতনা বিশিষ্ট মানুষকে জীবন্মৃত বলে চালিয়ে যাব- এ সরলীকরণ বোধ করি কাম্য নয় l অরুণা যা ছিল তাকে জীবিতই বলা যায় l শুধু জীবন বলতে আমাদের যে কনসেপ্ট, এ যাপন তার থেকে ভিন্নতর l
[তথ্য সংগৃহীত, মতামত ব্যক্তিগত]