অমলকান্তি রোদ্দুর হয়ে উঠতে চেয়েছিল একদিন, রোদ্দুর- জানলার শার্সির বাধা ভেঙে হই হই করে ঢুকে পড়তে পারে এক ঝাঁক পাখির মতো, রোদ্দুর- কাঁধে এসে নামলে ভিনদেশি বাউলের অন্তঃকরণ ঝলমলে হয়ে ওঠে... রোদ্দুর আর এইসব চেনা অচেনা কাব্যকথা আমরা সবাই জানি। যে গল্পটুকু জানি না, তাও সেই রোদ্দুরেরই। রোদ্দুর আর মৌবনী। মৌবনী আর মফঃস্বল। মৌবনীর মফঃস্বল। সকাল, দুপুর, বেলা গড়িয়ে জলকে যায়- মৌবনীদের পাড়ায় পাড়ায়- প্রেম আসে- প্রেম পায়- ঘুম আসে- ঘুম পায়- রাত নামে- স্তব্ধতার গান নিয়ে- জাগে, জাগে রাত- আরো একটা ভোর হবে বলে।
শহর কোলকাতা থেকে অনতিদূরে মৌবনীদের সবুজ-মেরুন দোতলা বাড়ি। এর আগে যদিও লাল-হলুদ ছিল। প্রমিতা ওপারের মেয়ে, তায় তার ঢাকা নিবাসী মাসতুতো বোনের ছেলে এখানে থেকে এমবিএ পড়ছিল কিছুদিন। বাপের বাড়ির সদস্য পেয়ে শ্রীমতীদের মনের জোর বেড়ে গেলে গৃহশান্তির জন্য পুরুষমানুষকে অনেককিছুই করে ফেলতে হয় যা তাদের নীতিবিরুদ্ধ। তবে ওই, রাখে বাবা অদ্বৈতানন্দ তো মারে কে! মানে, মৌবনী সবে এমএসডব্লু শেষ করে চাকরিতে ঢুকবে ঢুকবে, ওমনি তার ভালোবাসাবাসি হলো বিভাসের সাথে। এ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। কেজি স্কুল থেকে আজ পর্যন্ত এই নিয়ে মৌবনী দুটি ছেলে ও একটি মেয়ের হাত ধরে বাড়ি এলো। প্রমিতা প্রথমবার সোনার বোতাম গড়ালেন, দ্বিতীয়বার সাদা পাথর দেওয়া আংটি ও তৃতীয়বার মানে অধ্যাপিকা বান্ধবীটির বেলায় পত্রপাঠ বাড়ি থেকে বার করে দিলেন। মাস্টার্স-এর সময়টায় মৌবনী পেয়িং গেস্ট থাকছিল যোধপুর পার্কের একটা ফ্ল্যাটে। কাজের সুবাদে তাদের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটিতে নিয়মিত আসত বিভাস। এভাবেই একদিন মুখোমুখি-চৌকাঠ পেরিয়ে তেলরং-ক্যানভাস সমেত হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া মৌবনীর হৃদয়ে। প্রতিমার অবিশ্যি ছেলেটির পেশা টেশা দেখার চেয়ে পুলকের কারণ এই ছিল যে, সে পুরুষ। বিভাসের মা ছন্দা আবার কোন এক অদ্বৈতানন্দের দীক্ষিতা। তিনি পুত্র ও বাবাজী সমেত মৌবনীর বাড়িতে- এলেন দেখলেন জয় করলেন। কারণ এই বাবাজী কথায় কথায় ফস করে বলে বসলেন, প্রমিতার শুভ রং নাকি সবুজ। নিদেনপক্ষে লাল ঘেঁষা কিছু হলেও চলবে। কিন্তু হলুদ নৈব নৈব চ। মৌবনী তার যুবাকালে পুলিশের গুলি খাওয়া কমুনিস্টো বাবা এবং এই আজন্ম মন্ত্রঃপূত ছাই খাওয়া বৃদ্ধভাম বাবার মোলাকাত নিয়ে বেশ চাপেই ছিল। কিন্তু সেটুকুও উতরে গেল লালঘেঁষা সবুজের অপার মহিমায়। অতিথিরা বিদেয় হলে রঞ্জন ন্যূনতম বিলম্ব না করে বাড়ি রং করার প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন। প্রমিতার নিমরাজি হওয়ার সুযোগ ছিল না, তবে মনের মধ্যে খুঁতখুঁত একটা থেকেই গিয়েছিল। সেটা ভিন্ন বিষয়ে। বিভাস জানিয়েছে, সে এক্ষুনি বিয়ে করতে নারাজ। তবে সে আর মৌবনী একসাথে থাকবে তাদের বিডন স্ট্রিটের পুরনো বাড়িতে। আর কী আশ্চর্য, মৌবনীও তাতে অবলীলায় সায় দিয়েছে। প্রমিতার স্থির বিশ্বাস, এই একগুঁয়েমির জেনেটিক ট্রেট মেয়ে তার বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে, কিচ্ছুতেই তাঁর কাছ থেকে নয়। কী আর করা! আপাতত বোতাম আর আংটি গচ্ছিত থাক ব্যাঙ্কের লকারে। বিভাসের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ছন্দা বছরের বেশিরভাগ সময়টাই বোস্টনে কাটান, তাঁর মেয়ে জামাইয়ের সাথে। কারণ বিভাস জীবনযাপনে চূড়ান্ত বোহেমিয়ান। স্বামীর মৃত্যুর পর বিভাসের এই বহির্মুখিনতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা ওঁর পক্ষে বেশ অসুবিধজনক হয়ে পড়ছিল। ছেলে কখন আসে, কখন খায়, কখন আঁকে, কখন নিদ্রা যায়, কার সাথে শান্তিনিকেতন ঘোরে আর কাকে নিয়েই বা বেডরুমে ঢোকে- গোটা ব্যাপারটাই বড্ড গোলমেলে। প্রমিতা এত কিছু জানেন না। তবে মৌবনীকে বিয়ে করলে বিভাসের যে কিছুটা মতিস্থির হবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত! আরে তাঁর জিন-ও কি কিছুটা হলেও মেয়ে পায়নি? পুজোর মরশুমে ছন্দা কোলকাতায় আসেন। বিভাসও চেষ্টা করে ওই সময়ে কয়েকটা দিন বাড়িতে থাকার। রান্নার মেয়েটি ছুটি নেয় বলে তিনি ছেলের জন্য পরম মমতায় এটা সেটা বানিয়ে ফেলেন। মাত্র একটা মাসের তো ব্যাপার। তবু যদি ছেলেটার সান্নিধ্যে থাকা যায়। ছন্দা যারপরনাই ভালো রাঁধেন। মৌবনীও এতোটাই মুগ্ধ যে তার ডিজাইনার নোটবুকে গিটারের কর্ড ছাড়াও জায়গা করে নিয়েছে ছন্দার বানানো বিবিধ রেসিপি।
বংদের সাথে কেরালাইটদের রসনায় ও রাজনীতিতে জব্বর মিল। এখানে আসার পর তিন-তিনটে মাস ঘরদোর গোছাতে আর নতুন কাজের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে খাওয়াতেই কেটে গেল। ফলত ত্রিবন্দ্রমের অলিগলি রাজপথ ঘুরে দেখার সুযোগ মিলল না এখনও। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে কুড়ি মিনিটের অটোরিকশা দূরত্বে, তাদের এক কামরার ফ্ল্যাট। তার আর মধুপলের। ভি.জি.মধুপল, মৌবনীর বর্তমান সহকর্মী, রুমমেট, এবং সম্ভবত প্রেমিকও। মধুপল কেরলীয় বংশোদ্ভূত, যদিও তার কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবন দিল্লি কেন্দ্রিক। তাই তেলুগু আর ইংরেজির সাথে সাথে মধুপল হিন্দিতেও সাবলীল। এই বাঙালি মেয়েটির সাথে দেখা না হলে হয়ত দিল্লিতেই পাকাপাকিভাবে থেকে যেত সে, কলেজের পার্ট টাইম চাকরি আর মালয়ালম কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে। কোত্থেকে যে এই খামখেয়ালি মেয়েটা ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ল ! চেনা ছকের সমস্তকিছুই ওলটপালট হয়ে গেল তার ! জীবনের হিসেব, বাঁচবার তাগিদ, স-ব ! অথচ আলাপটা জমে উঠেছিল খুব সাধারণ নিয়ম মেনেই। মানে এখনকার নেট স্যাভি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের যেমনটা হয়ে থাকে আরকি। কোলাভেরিডি-র সদ্য রিলিজের পর গান নিয়ে একটা ফেসবুক গ্রুপে তখন তুমুল তর্ক বিতর্ক। ভালোমন্দের তুল্যমূল্য বিচারে কেউই প্রায় বিনা যুদ্ধে নাহি দিবে সূচ্যগ্র মেদিনী। বিপক্ষে মতামত বেশি। এসবের মধ্যেই খোলাচুল উদাস চোখের প্রোফাইল পিকচার লাগানো জনৈক মৌবনী ভৌমিক ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল ঝরঝরে ইংরেজিতে লিখল- ‘সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির বোধ নেহাতই আপেক্ষিক। ভিভালডি শুনে যে বড় হয়েছে, কোলাভেরিডি তার ভালো নাই লাগতে পারে। আবার যে হরিহরণের গুণমুগ্ধ, হতেই পারে তার কাছে হ্যারি বেলা ফন্টে সাংঘাতিক দুর্বোধ্য। সত্যি বলতে কী, একজন নির্দিষ্ট মানুষের জীবনেও তো এই ভালোলাগা-খারাপলাগার মাত্রাগুলো নিয়ত বদলে বদলে যায়- তার পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে, তার অন্তঃকরণের নিরিখে। বদলায় তো। তবে যা যা আমাদের হাসায়, কাঁদায়, রক্তস্রোতে ঝড় তোলে, আগুন জ্বালায়- তার সবটাই তো শিল্প। সেখানে সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি ক্লিশে বিভাজন নেহাতই অযৌক্তিক।’ মধুপল একশ আঠেরো-তম লাইকটা দিতে গিয়ে থমকায়। ভিড় তার কোনদিনই ভালো লাগেনি। বরং মেসেজে লিখে ফেলে দু’কলম- ‘যদিও যেকোনো সঙ্গীত শিল্প হয়ে উঠতে পারেনা, তবু তোমার দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে একমত। আর হ্যাঁ, হরিহরণ আমার প্রিয় গায়ক।’ এভাবেই আলাপচারিতা শুরু হয়, বাড়তে থাকে চেনাশোনা। অফিসে কাজের অবকাশে, রাতে ঘুমোনোর আগে, ছুটির দিনগুলোয় এমনকি সকালেও কথোপকথন চলে। মৌবনী তার ছোটবেলার কথা বলে, গ্রামের বাড়ি, ঠাকুরদাদা, লাল উঠোন, শিউলি গাছ। মধুপল তার বড় হওয়ার গল্প শোনায়, কোল্লমের পথঘাট, একান্নবর্তী পরিবার, কাল্লদা নদী, নারকেলের বাগান। দুটো মানুষ শব্দে ভর করে কাছাকাছি আসতে থাকে পরস্পরের, আর তাদের হাত ধরে মানচিত্রের কড়া নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, দুটি রাজ্যও।
প্রাতিষ্ঠানিকতায় আস্থাহীন দুজন মানুষ প্রথম দিকটায় অনায়াসেই বেঁচে নিচ্ছিল বিডন স্ট্রীটের দালানওয়ালা সুপ্রাচীন বাড়িতে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ফের সম্পর্কের দোলাচল। মৌবনীর মনে হচ্ছিল, এই যৌথতায় সবটাই যেন কেমন আরোপিত। বিভাসের অন্যান্য বান্ধবীদের থেকে সে কেন অথবা কোথায় আলাদা, ক্রমশ তাই নিয়ে ধন্দের সৃষ্টি হচ্ছিল। পুরনো আসবাবে ঠাসা ঘর, আশেপাশে প্রমোটারদের দৌরাত্ম্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ মাল্টিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট। রোদ আসত না বড় একটা। বিভাসের না-ফেরার রাতগুলোকে মৌবনী বাজাতে চাইত ছ’তারার যন্তরটায়। ভোর হয়ে যেত দেখতে দেখতে। দ্রুত চান খাওয়া সেরে অটো আর মেট্রো বদলে দফতর। তবু ফাঁকা তো লাগতই। আলোহীন। চিলতে বারান্দায় দুটো নয়নতারা বসিয়েছিল মৌবনী। সাদা আর বেগনী। প্রমিতার কোলেসিসটেকটোমির সময় দিন পাঁচেক না থাকার ফলে জল পড়ল না। মৌবনী ফিরে এসে দেখল মরে গেছে। তারপর একটা কচু পাতার মতো দেখতে ছোট্ট মিষ্টি বাহারে গাছ। নার্সারির মাড়ওয়ারি ভদ্রলোক বলেছিলেন- ‘ইসকো ধুপ ভি চাহিয়ে অউর ছাও ভি’। কিন্তু বাঁচানো গেল না তাকেও। বাঁচানো গেল না, বিভাস-মৌবনীর যৌথতা। উসকো ধুপ ভি চাহিয়ে থি অউর ছাও ভি। কোল্লম ছেড়ে যেতে চায়নি মধুপল। কিন্তু তেরো বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দ্বিতীয় বিবাহিত জীবনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল না বলে একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দিল্লির মাসির বাড়িতে। তখন থেকেই সে ছিন্নমূল। একটা দীর্ঘ সময়কাল পর্যন্ত প্রায় রোজ রাতে মধুপল স্বপ্নে তার বাড়িটা দেখতে পেত। কেরালার ব্যপ্ত নীল, প্রশস্ত সবুজে ঘেরা একখানা মস্ত বাড়ি। ক্রমে স্বপ্নগুলো মলিন হয়ে এলো, ফিকে। চৌত্রিশ বছর বয়সী মধুপল এই গল্পটা প্রথম কোনো নারীকে বলছে, এমন একটি মেয়ে, যাকে দেখবে বলে সে জীবনে প্রথমবার কোলকাতায় পা রেখেছে। সেদিন পরস্পরকে শুনতে শুনতে কিভাবে বারিস্তার ম্রিয়মান আলোয় কেটে গিয়েছিল পৌনে চার ঘন্টা, ওরা বুঝতেই পারেনি কেউ। আর মৌবনী দেখছিল, মায়ের কথা বলতে বলতে মধুর গলা নেমে আসছে কোমল নিষাদে। মধু কি কাঁদছে? মৌবনী একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল ক্রমে ক্রমে। মধু চলে যাচ্ছিল দমদমের কাছাকাছি হোটেলে যেটা স্রেফ দু’রাতের জন্য বুকিং করা। রাত্তির আড়াইটে নাগাদ মধুপলের ফোনে মৌবনীর কণ্ঠ- ‘আমি জানি তুমি এখনও জেগে। আমি যদি তোমাকে একটা লালাবি শোনাই তুমি কি ঘুমোবে? কান্ট্রি রোডস টেক মি হোম/ টু দ্য প্লেস আই বিলং/ আই হিয়ার হার ভয়েস/ ইন দ্য মর্নিং আওয়ার শি কলস মি/ দ্য রেডিও রিমাইন্ডস মি অফ মাই হোম ফার আওয়ে/ অ্যান্ড ড্রাইভিং ডাউন দ্য রোড আই গেট আ ফিলিং/ দ্যাট আই শুড হ্যাভ বিন হোম/ ইয়েসটারডে/ ইয়েসটারডে।’ তিনদিন পর আশ্বিনের সন্ধ্যেয় ক্লান্ত মৌবনী যখন অফিসফেরত ট্যাক্সি ধরতে যাবে, ঠিক তক্ষুনি একটা এসএমএস এলো মধুর- ‘হ্যাভ মেড আ প্ল্যান টু গো ব্যাক টু মাই প্লেস। উইল ইউ কম উইথ মি লেডি?’ প্রচণ্ড হিউমিডিটি আজ। মৌবনীর ট্যাক্সি ছুটে যাচ্ছে চিংড়িঘাটা উল্টোডাঙা হয়ে। মৌবনী কিন্তু গন্তব্যহীন। ব্যস্ত শহর, সার বাঁধা আলো, দ্রতগামী যান। তবু কি একটা নেই, কী যেন একটা। ছ’মিনিটের পথটুকু হেঁটে আসবে বলে সামান্য এগোতেই খুব বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। মৌবনী আবার দাঁড়ালো ছাউনি খুঁজে নিতে। বেঙ্গল বেডিং স্টোরসের দেওয়ালে ইয়াব্বড় হরগৌরীর ক্যালেন্ডার। আর ঠিক এক সপ্তাহ পর মহালয়া।
মৌবনীর সম্মতিসূচক উত্তর পেয়ে মধুপল ফ্রেডির মেলের জবাব দিল চটজলদি। ফ্রেডি ওরফে আলফ্রেড জন। মধুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অবসরের পর থেকে একটা সংস্থা চালাচ্ছেন পশ্চিম উপকূলের মৎস্যজীবী মানুষগুলোর সন্তানসন্ততিদের নিয়ে। মধুর একটি বই মাস ছয়েক আগে ফ্রেডির হাতে আসে। সেখান থেকেই প্রকাশক মারফৎ ইমেল আইডি জোগাড় করে অসুস্থ ফ্রেডি মধুপলকে লেখেন- ‘তোমার মতো উদ্যমী ছাত্ররা এখানে এসে আমার কাজের হাল ধরলে আমি নিশ্চিন্তে সবকিছু যেতে পারব হয়ত। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে মধুপল। তুমি কি চাইবে আমার সঙ্গে কাজ করতে?’ মেলটা উত্তরহীন পড়েই ছিল এতদিন। মধু জানত না ঠিক কিসের টানে সে ফিরবে। আজ লিখল- ‘আমি ও আমার কোলকাতানিবাসী বান্ধবী ত্রিবন্দ্রমের উদ্দেশে রওনা হচ্ছি। অন্নসংস্থানের চিন্তা দূর হয়েছে। বাসস্থানের ব্যাপারে আপনার সাহায্যপ্রার্থী।’ ওরা ফ্রেডির বাড়ির একতলায় এক বেডরুমের ঘরে জায়গা পেয়ে গেল। সঙ্গে একখানা ছয় বাই আট বারান্দাও। ঘরগুলোকে বাসযোগ্য করে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব মৌবনী স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিল। এ ব্যাপারে অপটু লোকের নাক গলানো তার না-পসন্দ। এখান থেকে তাদের কর্মস্থল বাস দূরত্বে আধঘন্টা। আর ফিল্ডে তো দুজনকেই যেতে হয় নিয়মিত, কখনও একসাথে, বেশিরভাগই আলাদা আলাদাভাবে। নিত্য ব্যবহার্য টুকিটাকি কিছুটা তারা কিনে নিল। কিছু ফ্রেডির ঘরেই রাখা ছিল। বিশেষত এই আকাশি নীলরঙা স্বচ্ছ্ব ওয়াটার ফিল্টার। একটু পুরনো ধাঁচের। ব্যাটারিচালিত। একেকবারে দশ লিটার জল শোধন করতে পারে। তবে ছমাস অন্তর ব্যাটারি বদলাতে হয়, ঝক্কি এইটুকুই যা। অব্যবহৃত অবস্থায় কিছুদিন পড়ে ছিল, অতএব মধুপল সাফসুতরো করে জল ভরলো তাতে। দিন কয়েক দিব্যি চললও নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু আচমকাই একদিন রাত্তিরবেলায় জল নিতে গিয়ে মৌবনী দ্যাখে ফিল্টারের নিচের সেগমেন্টে হাল্কা সবুজ আস্তরণ। জল-টলের ব্যাপারে সে আবার ভয়ানক সচেতন। ফিল্টারের গা থেকে টোল ফ্রি নম্বর নিয়ে কোম্পানিকে ফোন করল তৎক্ষণাৎ। তারা জানাল আগামীকাল যেহেতু রোববার তাই পরশুর আগে কোনো সার্ভিস দেওয়া সম্ভব নয়। প্রবল বিরক্তিতে মৌবনী ঘুমোতে যায়। ছুটির দিনে ওঠার তাড়া নেই, তবু পুবের জানলা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া একরাশ ঝকঝকে রোদ্দুরে মৌবনীর চটজলদি ঘুম ভাঙে। মনের মধ্যে খচখচ একটা রয়েই গেছে- আহা এত সুন্দর দেখতে ফিল্টারটা। তাছাড়া খারাপ হয়ে গিয়ে থাকলে তো ফ্রেডিকেও জবাবদিহি করতে হতে পারে। যদিও উনি খুবই স্নেহ করেন মৌবনীকে, তবু... মধুকে টপকে বিছানা থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে যায়। সমস্ত জল বেসিনে ঢেলে ফেলে নিচের সেগমেন্টটুকু নিয়ে বারান্দায় আসে। হাত ঢুকিয়ে অনুভব করে সবুজ স্তরটা পুরু আর নরম ! আরে এটা তো সামান্য ব্যাপার ! লিভিং রুমের জানলা দিয়ে সারাটাদিন প্রচুর আলো আসছে। আর ফিল্টারের দেওয়াল স্বচ্ছ্ব হওয়ায় জলের আনুকূল্যে তরতর করে গজিয়ে উঠছে শ্যাওলারা ! মৌবনী উত্তেজনায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। প্রচণ্ড ঝাঁকিয়ে মধুপলকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। তারপর ফিল্টারের অংশটা তুলে এনে মধুকে দেখায়। মধু বেভ্ভুলের মতো বলে- ‘হোয়াট?’ মৌবনী জবাব দেয়- ‘অ্যালগি অর হোয়াট ! কান্ট সি !’ কোনোরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই মৌবনীর বাসায় একটা প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে ! ওর কান্না পেয়ে যায় ! কৃষ্ণকায় যুবকটি তার নারীকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু খায়। না, এ ফিল্টারটা তারা সারাবে না আপাতত। বরং ছয় বাই আটের বারান্দায় সে আরো কিছুকাল রোদ্দুরে ভিজতে থাকুক। মৌবনী আবার অনেকটা জল ভরে দেয়। আর ফিসফিস করে তার কানে বলে- বেড়ে ওঠো জীবন !