টুকুন কোঁচড় থেকে ডিমগুলো বের করতেই সক্কলে হাঁ হয়ে গেল!
নদীর ধারে এমন হুটোপাটির চড়ুইভাতি, তাতে আবার ডিম! তার ওপর আধাআধি ভাগাভাগি নয়, মাথাপিছু একটা করে গোটা ডিম! প্রথম চোটে আনন্দে কথা ফুটল না কারো মুখে। তারপর বিস্ময় একটু থিতোতেই হইহই করে উঠল কচিকাঁচার দল। যক্ষের ধনের মতো ডিমগুলো কোথায় রাখবে তাই নিয়ে টগবগ করতে লাগল নানান মতামত।
আজ ওদের চড়ুইভাতি। বিল্বপত্র গ্রামের একধার দিয়ে বয়ে গেছে রূপনারায়ণ। নদীতটের এই অঞ্চলটা ফাঁকা। উঁচুনিচু। এদিকে-ওদিকে ঘাসের গুছি, শুকিয়ে যাওয়া কাশ আর বেতঝোপ। ফেরিঘাটও নেই কাছাকাছি। জনহীন হওয়ায় এইখানটা ছেলেপুলেদের ভারি প্রিয়। কখনও ওরা দলবেঁধে খেলতে আসে, কখনও বা জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কাটে। সন্ধেবেলা পিদিম জ্বালিয়ে, গান গেয়ে ব্রতের সরা ভাসাতে আসে এয়োতির দল। আর যে ছেলের মনে হঠাৎ করে সুদূর থেকে নেমে আসা মেঘ জমে, না-দেখা মানুষ না-দেখা দেশের জন্য দুঃখু হয় খুব, সেই ছেলে এইখানে এসে একা একা বাঁশি বাজায়।
অবশ্য নদীচরে কেউ থাকে না বললে একটুখানি ভুল হয়। গ্রামের সীমান্ত থেকে খানিক এগিয়ে পক্ষী আর ওর মায়ের বাসা। বাসা বলতে দুখানা দর্মার ঘর, একটা তুলসিমঞ্চ, বেড়া দিয়ে ঘেরা চিলতে ভিটে। ওরা একটেরে হয়ে থাকে। ওদের সঙ্গে মেশে না কেউ। পক্ষীর বাবা নেই। ওর মা বৈষ্ণবী। গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে ভিক্ষে করত। এখন থুত্থুরে বুড়ি হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। দুটো মানুষ যে রয়েছে, তাদের সঙ্গেই রয়েছে, এ-কথা যেন ভুলে থাকে গোটা বিল্বপত্র গ্রাম। বাড়ির ছেলেপুলেদেরও ওইদিকে যাওয়া মানা।
কাল বিকেলে খেলার দলে আচমকা কথা উঠল - কাল চড়ুইভাতি করলে কেমন হয়?
অবশ্যই দারুন হয়। কিন্তু রেস্ত আসবে কোত্থেকে?
সিধুদের বাড়ির পাশে ইয়াব্বড়ো মানকচু হয়েছে। ও তুলে আনবে। ভরত আনবে চাল। পলার ওপর ডালের ভার, সনকা আনবে বেগুন আর বুলু নুন-তেল-মশলা। ফটিক বলল, ‘পলতা পাতা আর কুমড়োর ফুল আনব আমি।’ অজন ভার নিল পেঁয়াজ-লঙ্কার। টুকুনরা বড্ড দুঃখী। তেমন কিছু আনতে পারবে না। ও এমনি আসবে - এমনটা নিরুচ্চারেই ঠিক ছিল। কিন্তু ও-ই বলল, ‘আমি বড়া করবার বেসন আনতে পারব। ঘরে বেশ কিছুটা আছে।’ তাই নয় আনবে। চাল-ডালে খিচুড়ি বসে যাবে, টুকরো করে আলু ফেলে দেওয়া হবে ওতে, সঙ্গে পলতা পাতা আর কুমড়ো ফুলের বড়া, কচুভাজা আর বেগুনপোড়া। এর সঙ্গে মিশে যাবে নদীর মিঠে বাতাস, ভেজা ঘাসের গন্ধ, ঢেউ-খোঁটা পাখিদের কিচিমিচি। আহা, ওদের পায় কে!
এতসব ঠিক হওয়ার পরেও, শুধু বেসন আনবে বলে, টুকুন ঠোঙাখানা নামিয়ে কোঁচড় থেকে বের করল গণ্ডাকতক ডিম! ওর মা মুরগি পালে। ওটাই ওদের রোজগার কেন না অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ওর বাবা ঘরে-বসা। মূলত গরিবগুর্বো মানুষের বাস বিল্বপত্র গ্রামে, অধিকাংশ বাড়িতেই ডিম উৎসবের ভোজের সমান। টুকুনের মা হপ্তায় দুদিন ডিম নিয়ে বসে হাটে, সেখান থেকে যা বিক্রিবাটা হয়।
চড়ুইভাতি-দলের মধ্যে সকলের বড়ো ভরত। ঈষৎ চিন্তিত মুখে ও বলল -
আবার ডিম আনলি কেন টুকুন, কাকি বকবে।
মা-ই তো দিল ভরতদাদা। আমাদের চড়ুইভাতি হবে শুনে, আলাদা করে গুছিয়ে রেখেছিল। বেসন নিয়ে বেরোচ্ছি, বলল - নিয়ে যা।
আহা, তুই না নিতে পারতি। কাকির তো অসুবিধে হয়!
ভরতের কথা শেষ হতে না হতে কুটোর মতো উড়ে গেল জোগাড়যাতের হরষে-হল্লায়। ততক্ষণে উনুন গড়ে, কাঠ ভেঙে, ফুঁ দিয়ে, বাসনকোসনের ঠোকাঠুকি লাগিয়ে নদীতট হুলুস্থূল করে ফেলেছে কচির দঙ্গল।
দূরে পক্ষীদাদার ঘরখানার দিকে তাকাল ভরত। বিস্তীর্ণ চরের ওপর এক-ফোঁটা বাসা, তাকে ঘিরে সবুজের জড়াজড়ি। ওদের বাসা ঘিরে প্রচুর কলাগাছ, সন্ধ্যামালতী ঝোপ, লম্বা লম্বা সুপুরিগাছ। পলকা ঘরের একদিকে বিরাট নদী, অন্যদিকে শূন্য জমি আস্তে আস্তে উঠে গেছে রাস্তায়। বর্ষার দিনে রূপনারায়ণ লাফিয়ে গিলে নিতে চায় পক্ষীদাদাদের ভিটে। কেউ জানে না, ভরত চুপিচুপি ভাব পাতিয়েছে পক্ষীদাদার সঙ্গে। সহজ মানুষটাকে খুব ভালোলাগে ওর। কেমন ছাড়া ছাড়া অল্প অল্প কথা বলে, যেন নির্দিষ্ট করে বলার নেই কিছু, যেন ওর অর্ধেক বাক্যগুলোর পর নিজের কথা বসিয়ে নিলেও দিব্যি চলে যায়। পক্ষীদাদার শব্দের কোনো আপন-পর বোধই নেই!
সবাই এটা-ওটা কাজে ব্যস্ত। শুধু অজন উবু হয়ে বসে ডিম আগলাচ্ছে। একটা সরার ওপর রাখা আছে ধপধপে নুড়ির মতো ডিম কখানা। এদিক-ওদিক চাওয়ার ফাঁকে কড়া নজর রাখছে অজন - যেন ফেটে-ফুটে না যায়। এমন দুর্মূল্য বস্তু চড়ুইভাতির পদ হিসেবে যে কোনোদিন পায়নি ওরা!
ভরত এগিয়ে গিয়ে বড়া ভাজার কাজে হাত লাগাল। খিচুড়ি নামবে সকলের শেষে। গরম গরম খাওয়া হবে। ওদিকে ইঁট পেতে বেগুন পোড়াচ্ছে সিধু আর সনকা। চড়ুইভাতির গন্ধে গন্ধে হাজির হয়েছে এক মেটেরঙা কুকুর। হুটহাট করে তাকে খেদিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে টুকুন। একঝাঁক তিতিরপাখি নেমেছে খানিক দূরে। দল বেঁধে উড়ছে, আবার নামছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওদের খেলার দিকে মন চলে যাচ্ছে ভরতের। আর দূরে, পক্ষীদাদাদের বাড়িটা আজ যেন ওকে ডাকছে। কেন কে জানে। ওইদিকে বেগুনপোড়া হয়ে গেছে, ইঁটের ওপরেই ডিমগুলো সেদ্ধ করতে বসিয়ে দেবে বলে অজনকে বলেছে সরাটা আনতে।
আচমকা চিৎকার করে উঠল অজন। সবাই ত্রস্ত হয়ে তাকাতে ও জানাল - বারবার ডিম গুনে আর মাথা গুনে ও দেখেছে একটা ডিম বেশি আছে!
সে কী! মহাচিন্তায় পড়ে গেল সবাই। একটা ডিম বেশি হলে তো গুনতিতে ভীষণ ঝামেলা। দুটো ডিম কে খাবে? তবে কি বাড়তিটা টুকুন ফেরত নিয়ে যাবে?
চট করে একটা বুদ্ধি খেয়ে গেল ভরতের মাথায়। গলাটা ভারি করে ও বলল, ‘ডিমটা থাক, একজনকে দেব।
কাকে রে ভরত? - সিধু শুধোল।
সে আছে, একজন ভালো মানুষ। ডিম-টিম চোখে দ্যাখে না। আমরা একা একা ভালোমন্দ খাব কেন, তাকেও একটু ভাগ দেব।
ভরতের সুরে কী যেন একটা ছিল। একটু ভারিক্কীভাব, একটু গোপনীয়তা, যাই হোক, আর কেউ ঘাঁটাল না। তাছাড়া অমন বিরাট একটা সমস্যার সমাধান যখন মিলে গেছে, আর কথা বাড়িয়ে লাভ কী। সাবধানে ডিমগুলো সেদ্ধ করবার দিকে মন দিল ওরা। শুধু ফটিক ফিসফিস করে সনকাকে বলল, ভরতদা ওর মাকে ডিম দেবে মনে হয়।
ভ্যাট, ওর মাকে কেমন করে দেবে? সে কি আছে? কবে মরে গেছে, সে-ইই ভরতদার জন্মের সময়।
আছে। তুই জানিস না। ভেন্নরকমভাবে আছে। আমাদের মতো করে নয়।
সে আবার কেমন করে থাকা?
হাওয়া-বাতাস হয়ে। কিংবা লিকলিকে ধোঁয়ার মতন।
তোর মুণ্ডু!
এই দ্যাখ। বিশ্বাস করিস না তো। আমি জানি। আমরা কেউ দেখতে পাই না, শুধু ভরতদা দ্যাখে। পেটের ছেলে তো, তাই।
দেহ নেই তবে খাবে কেমন করে? তার খিদেটাই বা থাকে কোথায়?
থাকে। মানুষ না থাকলেও খিদে থাকে। এইরকম অনেক চোখে না-দেখাদের খিদে এক জায়গায় জড়ো হলে তখন খরা হয়, মড়ক আছে - আমাকে ঠাকমা বলেছে।
সব জানে তোর ঠাকমা!
কী! তুই আমার ঠাকমাকে গাধা বললি? - ছিটকে উঠে দাঁড়াল ফটিক।
‘গাধা’ কখন বললাম? - সনকাও সহজে ছাড়ান দেওয়ার মেয়ে নয়।
বললি তো। ঠোঁট বেঁকিয়ে বললি না - ‘সব জানে’?
হ্যাঁ বলেছি। বেশ করেছি। ভূতের খিদে পেলে অনাবিষ্টি হয়, মড়ক হয়, এসব মোটেও সত্যিকথা নয়। মাটির রস শুকিয়ে গেলে খরা হয়। তাই তো বেশি বেশি করে গাছ পুঁততে হয়। বইতে পড়িসনি? মাস্টার বলেনি কেলাসে?
কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আবার মেনে নেওয়াও যায় না, তাহলে হার হয়। গজগজ করতে করতে ওখান থেকে সরে পড়ল ফটিক।
বেলা গড়িয়ে এল। একে একে পদ নেমে গেল। খিচুড়ি বসেছে এবার। ওটা হবে সকলের শেষে। নইলে গরম গরম খাওয়া যাবে না। সব কাজ সারা হয়ে গেছে বলে খিচুড়ির হাড়িটাকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছে সবাই। সকলের কান পাতা হাড়ির টগবগানির দিকে। থেকে থেকে ‘উহ’ ‘আহ’ করছে ফটিক। সিধু বলছে, ‘একটু নেড়ে দেখ না পলা। নইলে আলুগুলো কখন আবার টপ করে গলে যাবে।’ বোঝা যাচ্ছে আর তর সইছে না ওদের। এমন সময় হঠাৎ টুকুনের খেয়াল হল, খাওয়া যে হবে, পাতা কই?
এই রে! ভজুর কথা ছিল পাতা আনবার। চড়ুইভাতি হলে ও-ই পাতা আনে। কিন্তু হঠাৎ করে অন্য গাঁয়ে বাবার সঙ্গে কুয়ো পরিষ্কারের কাজ পড়ে যাওয়ায় ও আজ আসতে পারেনি। পাতার কথাটা সবাই বেমালুম ভুলে গিয়েছে। কী হবে? এখান থেকে যে কারোর বাড়ি গিয়ে পাতা কেটে আনতে অন্তত আধ-ঘন্টা লাগবে। হয়তো তারও বেশি। চিন্তায় মুখ ঝুম হয়ে গেল সব্বার।
তাই দেখে একটু ইতস্তত করে ভরত বলল, আমি পাতা আনতে পারি একটা জায়গা থেকে, যদি তোরা রাজি হোস।
কোত্থেকে রে?
পক্ষীদাদার বাড়ি থেকে। ওদের বিস্তর কলাগাছ। বললেই দেবে।
‘পক্ষীদা’র নাম শুনে মুখ চাওয়াচায়ি শুরু করল সবাই। দলের মনোভাব লক্ষ্য করতে লাগল ভরত। আকাশ বাইতে বাইতে সূর্য এখন মধ্যগগনে। কিন্তু মেঘ থাকায় রোদের তেজ নেই তেমন। তাই খোলায় চড়ুইভাতি করতে কষ্ট হচ্ছে না ওদের। নদীর মধ্যিখান দিয়ে একটা পাল-তোলা নৌকা ভেসে যাচ্ছে। একটা ধানের খোসার মতো এইটুকু দেখাচ্ছে ওকে। ধীরগতিতে ভেসে যাওয়া নৌকাটাকে দেখতে লাগল ভরত। যা কিছু মন্থর তারা ওকে টানে।
দলের মধ্যে সনকা একটু ঠোঁটকাটা। ফট করে বলল, ওরা তো গেরামে একঘরে। ওদের থেকে পাতা নিয়ে তার ওপর অন্ন খাওয়া কি উচিত?
ভরতের কাছে এর কোনো উত্তর নেই। একবার হাটে মুড়ি আর ছোলাভাজা বিক্কিরি করতে বসেছিল পক্ষীদাদা। দেখতে পাওয়ামাত্র গ্রামের লোক ওকে তুলে দিয়েছিল। ওর হাত থেকে খাবার খাওয়া যাবে না। কারণ পক্ষীদা ওর বাবার পরিচয় জানে না। এত বড়ো আস্পদ্দা, বাপ না-চেনা ছেলে কিনা খাবার নিয়ে বিকোতে বসে?
হাট থেকে ফিরে বাবা বলছিল কাহিনিটা। অসহায় একটা ছেলেকে অত লোকের সামনে অপমান করার গল্প বলতে বলতে কী রোষ তার গলায়! ভরত বুঝতে পারেনি এখানে পক্ষীদাদার দোষটা কোথায়? ওকে ওর মা বাবার নাম জানায়নি, তাই ও জানে না; এর সঙ্গে ওর হাতে জল খাওয়া খাবার খাওয়ার কী আছে? এই যে আশপাশের গাঁ থেকে এত লোক এসে বসে হাটে, সবাই কি সব্বার বাবার নাম জানে? নাকি জানাটা দরকার? কেউ খারাপ জিনিস বিকোলে, ফিরে এসে তার ওপর চোটপাট করে খরিদ্দার; তখন যদি দোকানি নিজের বাপের নামটা বলে দেয়, খরিদ্দার কি চুপচাপ সোনামুখ করে চলে যাবে?
এসব জিজ্ঞাসা করা যায় না। বাবাকে না, পিসিকে না, কাউকেই না। ভরত এখন টের পায়, এইরকম অনেক ধাঁধার উত্তরই ওদের কাছে নেই। এই না-থাকাটাকে পুরিয়ে দিতে ওরা রাগ করে। চোখ পাকায়।
সনকার কথা শুনে চুপ করে রইল ভরত। বাকিরা বলুক। নইলে কে বাড়ি গিয়ে এ-কথা সে-কথায় বলে ফেলবে, তখন ভরতের ঘাড়ে দোষ চাপবে। বাড়ি বয়ে এসে এ-ও নালিশ করে যাবে বাবার কাছে। এমনিতে মানুষটা ঠান্ডা, কিন্তু হুটপাট করে রেগে যায় কালে-অকালে। তখন তাকে শান্ত করে কার সাধ্যি! বেড়া থেকে বাখারি খুলে ভরতের পিঠে না ভাঙা অবধি থামবে না।
ভরতকে নিরুত্তর দেখে বাকিরাই এটা ওটা বলতে শুরু করল। খিদে চড়ছে। চরের হাওয়ায় খিচুড়ি নামানো মাত্র জল হয়ে যাবে। আহামরি কিছু তেল-মশলা পড়েনি, ওই তাতটাই জিভের আহ্লাদ! একে একে সংশয় কাটিয়ে অবশেষে সকলেই রাজি হয়ে গেল। হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল ভরত। টুকুনকে বলল, আমার সঙ্গে চ। দুজনে গেলে তাড়াতাড়ি হবে।
বলতে বলতে ভরত এগিয়ে গেল ডিমের দিকে। সেদ্ধ করে সেগুলো একটা সরার ওপর রাখা। দুখানা তুলে নিল ও। বাকিদের বলল - একটা বেশি ছিল, আরেকখানা আমার ভাগের। পক্ষীদাদা আর ওর মা আছে - দুজনকে দেব। আমার লাগবে না। শুধু হাতে পাতা নেব কেন। ধার মিটিয়ে দেব।
গলায় ইচ্ছে করেই একটু ডাঁট ফোটাল ভরত। যেন এইমাত্র বুদ্ধিটা মাথায় এল ওর। কিন্তু আগে থেকেই ও ঠিক করে রেখেছিল - একখানা ডিম পক্ষীদাদাকে চুপিচুপি ডেকে দিয়ে দেবে।
ফটিক ফুট কাটল - যা করবি ঝটতি কর ভরতদা। পেটে মোচড় দেয় যে।
ওর কাতরস্বরে হেসে উঠল সবাই। সেই হল্লার মধ্য দিয়ে পক্ষীদাদার বাড়ির দিকে পা বাড়াল ভরত আর টুকুন। নদীর বুক থেকে ছুটে আসা এক ঝলক হাওয়া গোল্লা পাকিয়ে পেটের ভেতর পাতাপুতো-ঘাস-কুটো নিয়ে ওদের পেছু পেছু গড়াতে লাগল। আর সঙ্গ নিল সকলের মুখ-ঝামটা খাওয়া কুকুরখানা। ভরতদের থেকে কয়েক হাত তফাতে সেও হাঁটা লাগাল।
২
পক্ষীদাদার সঙ্গে সখ্য আছে ভরতের। গ্রামের নিষ্ঠুর নিয়ম ও মানে না। খুব যে ভেবেচিন্তে যুক্তিবুদ্ধি খাটিয়ে অমান্য করে, তেমন নয়। অপাপবিদ্ধ মনের স্বাভাবিক উদারতা আর কৈশোরের গোপন দাঢ্য তাকে নীরবে অনেক কিছু ভাঙতে শিখিয়েছে। লুকিয়ে-চুরিয়ে ও মাঝেমাঝে আসে এখানে। পক্ষীদাদার মা ঝুঁকে ঝুঁকে কাজ করে বেড়ায়। তিলের নাড়ু বানায়। উঠোন তকতকে করে রাখে। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলসিমঞ্চ নিকোয়, তার গায়ে আলপনা আঁকে। সন্ধেবেলা প্রদীপ দেয়। ভরত একদৃষ্টে জেঠিমার ব্যস্ততা দেখে। এই মন্থর চলাচল দেখে ওর ঘোর লাগে। ওকে ভারি ভালোবাসে বুড়ি। গ্রামের মধ্যে একমাত্র এই মানুষটাই তো তাদের সুখ-দুখের হদিস করতে আসে। ভরত গেলে পাকা পেঁপে কেটে দেয় জেঠিমা। নারকোলের তক্তি খাওয়ায়।
শেষবার যখন এসেছিল পক্ষী, বুড়িকে দেখে ওর ভালো লাগেনি। দূরের পানে চেয়ে উঠোনে বসে আছে। গায়ে ছাইছাই চাদর জড়ানো। রোগা বুকখানা হাপরের মতো উঠছে নামছে। দেখে ভরতের মনে হয়েছিল - বুড়ি আর বাঁচবে না। শিগ্গিরিই মরবে। মৃত্যুকে বড্ড ডরায় ভরত। সে-ই তো অকালে এসে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছে। মানুষকে সে যে কোথায় নিয়ে যায়, তার ঠিকানা থাকে না। সে একবার ভাবে না, দুধের শিশুর থেকে মাকে নিয়ে যেতে নেই। একরত্তি ওই প্রাণকে মায়ের থেকে আলাদা করা পাপ।
কেউ মরণের কোলে ঢলে পড়ছে দেখলে ভরতের শীত করে। হাত-পা কাঁপে। গ্রামঘরে দু-একজনকে মরতে দেখেছে ও। আরও ছোটোকালে। সেই থেকে ওর ভেতর জাঁকিয়ে বসেছে ভয়। একজন মরেছিল সাপের ছোবলে। মুহূর্তের মধ্যে ফেনা ভাঙছিল ঠোঁটের কোণে। দেখতে দেখতে রাস্তার ওপরেই ধড়ফড়িয়ে মরে গেল লোকটা। আরেকজন হল মঙ্গলের পিসি। সকাল থেকে কয়েকবার রক্তবমি করল। দুপুর থেকে চলে গেল অথই ঘোরে। থেকে থেকে জ্ঞান ফিরে আসে আর পিসি বিড়বিড় করে - ‘একটু হরিনাম কর বাবা। হরিনাম শোনা।’ পয়সা দিয়ে পাশের গাঁ থেকে সংকীর্তনের দল এখন কে আনবে। তখন ভরতকে ডেকেছিল মঙ্গলের বাবা ভানুকাকু। ভরতের গলাটা মিঠে। ঠাকুরদেবতার বহু গান ওর জানা। বলেছিল পাশে বসে শোনাতে। সেদিন একদম কাছ থেকে সময় নিয়ে মৃত্যুকে দেখেছিল ভরত। সে এই নদীর মতো বিরাট। খরস্রোতা। ধাঁ করে আসে, দুকূল ছাপিয়ে, সক্কলকে বাক্যিহারা করে যা নেওয়ার নিয়ে চলে যায়। কাউকে রেয়াত করে না। জল সরে যাওয়া শিকস্ত চরে যেমন পলির পরত পড়ে থাকে, তেমনই মরণনদী রেখে যায় হাহাকার। পিসির পাশে বসে গান করতে করতে ঠকঠক করে কাঁপছিল ভরত। রাতের দিকে হঠাৎ চোখ মেলে দপদপ করে চাইল পিসি। কী স্বচ্ছ দৃষ্টি! একেবারে ভালোমানুষের গলায় বলল, ‘ও বউ, একটু জল দে।’ পাশে থেকে গেলাস তুলে জল দিয়ে যাচ্ছিল ভরত। কাকু মানা করল। বলল, ‘এসময় গঙ্গাজল দিতে হয়।’ ধারেকাছে তো গঙ্গা নেই, তাই রূপনারায়ণই ভরসা। ঘটে করে সে জল রাখা ছিল। পিসির ঠোঁট ফাঁক করে দেওয়া হল। ভানুকাকুকে পিসি বলল, ‘সাবুর পাঁপড়গুলো রোদে দেওয়া আছে। দিন কয়েক রোদ খাইয়ে তুলে রাখিস। ভুলিসনে।’ ব্যাস। এই বলে মাথাটে হেলে গেল একধারে। ডুকরে কেঁদে উঠল মঙ্গলের মা।
ভরত ভাবে, যেদিন ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে, একটুও ভয় না পেয়ে, ভানুকাকু যেমন জড়তাহীন হাতে জল ঢেলে দিয়েছিল দিদির মুখে, তেমন করে শেষ ঢোকটুকু খাইয়ে দিতে পারবে শেষযাত্রীকে, ঠিক সেইদিন ও বড়ো হয়ে যাবে। জীবনে অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পার হয় মানুষ। এইটা ওর একটা বড়ো পরীক্ষা। না, কেউ বলে দেয়নি; বুকের গহীনে ও নিজে নিজেই টের পেয়েছে। একটা আখাম্বা ভারি দরজার মতো ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। তাকে দুহাট করে খুলে দিলেই ভরতের জীবনটা বদলে যাবে। খুব মহার্ঘ্য কিছু নেমে আসবে ওর কাছে।
পক্ষীদাদাদের বাড়ির একেবারে কাছটায় এসে থমকে গেল টুকুন। ওর পায়ে খানিক ইতস্তত ভাব। ভরত কিছু বলল না। পকেটে দুখানা ডিম নিয়ে এগিয়ে গেল বেড়ার আগলের দিকে।
আগলখানা আলগা হয়ে বেঁকে ঝুলে পড়েছে। কাউকে আটকানোর ক্ষমতা আর ওর নেই। পক্ষীদাদাদের পরিচ্ছন্ন উঠোনের পাতা জমেছে। গেরস্থালিময় ছড়িয়ে রয়েছে একটা অপরিচিত মালিন্য। তাই দেখে বুকটা ধক করে উঠল ভরতের। ও বাইরে থেকেই হাঁক দিল - পক্ষীদাদা।
কোনো উত্তর নেই। শুধু ওদের লেজুড় হাওয়াটা হু হু করে বয়ে গেল। আরও বিষণ্ণ আর গম্ভীর হয়ে উঠল চারধার। গলাটা একটু পরিষ্কার করে আবার ডাকল ভরত - পক্ষীদাদা।
ঘরের ভেতর খুট-খাট আওয়াজ হল। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল পক্ষী। ওর শরীরটা একেবারে গুটিয়ে-পাকিয়ে গেছে। অদূরের খসে পড়া পেপে-পাতাটির থেকে যেন তফাৎ করা যায় না। খানিকটা এগিয়ে এসে পক্ষী বলল, ও ভরত। আয়।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ভরতের পিছনে আরেকজনকে দেখে থমকে গেল।
ভরত বলল, আমরা চরে চড়ুইভাতি করছি। পাতা আনা হয়নি। তোমাদের এখান থেকে কলাপাতা নেব গো?
নে না। মায়ের শরীরটা বড্ড খারাপ রে। তাই বিছনার পাশটায় বসে আছি। যা লাগবে নিয়ে যা।
এই বলে আবার ঘরে ঢুকে গেল পক্ষীদাদা।
সঙ্গে ছুরি এনেছিল টুকুন। হাত চালিয়ে কয়েকটা পাতা কেটে, ভরত বলল, দাঁড়া। ডিম দুটো দিয়ে আসি।
এই বলে ঘরে উঁকি মারতে দেখল মায়ের মাথার কাছটায় বসে নীরবে কেঁদে চলেছে পক্ষীদাদা। আরেকটা দেহে প্রাণ নেই কি না বোঝা দুষ্কর। একটা লন্ঠন জ্বলছে। তার হলুদ আলোয় পক্ষীদাদার বিরাট ছায়া পড়েছে উল্টোদিকের দেওয়ালে। সেই ছায়া চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে ওর মাকে। একটা তীব্র কাঁপন ছড়িয়ে গেল ভরতের পায়ের তলা থেকে মাথা অবধি। ওর মনে হল একটা বড়ো পরীক্ষা দেওয়া সময় এসেছে। হাওয়া ওকে এ-কথা বলছে। এই কথাই বলতে চাইছে মেঘ-জমা আকাশ, চরাচরের মরে আসা আলো।
দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ডিমদুটো রাখল ও। পক্ষীদাদাদের রান্নাশালটা বলতে গেলে ফাঁকা। তেমন কিছু নেই। পাবে কোত্থেকে ওরা? একটা সানকিতে ডিম দুটো রেখে, ভরত টুকুনকে বলল, তুই ফিরে যা। আমার এখানে থাকা দরকার। কখন মিটবে জানি না। তোরা খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে যাস। আমার বোধহয় দেরি হবে।
পুতুলের মতো ঘটঘটিয়ে মাথা নেড়ে চলে গেল টুকুন। ভরত গিয়ে বসল পক্ষীদাদার কাছে। ও টের পেল ঘরটা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে। দপদপ করছে লন্ঠনের শিখা। কূল চিরে রূপনারায়ণ পথ কেটে এগিয়ে আসছে এদিকে। কিন্তু সে জলের নদী নয়। তার সোঁতা ভরা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে জেগে উঠছে হাজার হাজার ঢেউ। একেকটা ঢেউ একেক হাত - পক্ষীদাদার মাকে তারা তুলে নিয়ে যাবে।
শায়িত দেহটাকে ভালো করে দেখল ভরত। বুকটা চলছে, তবে বড্ড ক্ষীণ। বার কয়েক দাদার চোখের নীচ দুটো মুছিয়ে দিল ভরত। তারপর বুঝল - শ্রমক্ষয়। ও জানতে চাইল, জল দিয়েছ?
মাথা নাড়ল পক্ষী।
নিশ্চয়ই খুব তেষ্টা পেয়েছে। দাঁড়াও জল আনি।
ওকে কিছুই বলল না পক্ষী। মা শুধু এই শয্যা, এই ঘর, এই উঠোন, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে তা নয়; পক্ষীর একমাত্র যে ভুবন, ওর অন্তরের ধুধু ভুবন, সেখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ওর একমাত্র গাছ। ভাত-গাছ। ঘুম-গাছ। সান্ত্বনা-গাছ। ডালপালা মেলা এক মাতৃবনষ্পতি। চিরতরে। প্রত্যেকটা পেয়ারাফলে যার গন্ধ, একেক প্রদীপশিখায় যার যুদ্ধের আলো, এই জীর্ণ সংসার ঘিরে থাকা হরেক ফুলে ফুলে যার মমতা, সব ফেলে রেখে সে চলে যাচ্ছে। ওষুধ খেতে চায়নি। যন্ত্রণা জানতে দেয়নি। শুধু সরু চৌকিটা ঘরের একধারে করতে বলে, মাটিতে বিছানা পেতে দিতে বলেছে ছেলেকে। তার ওপর শুয়েছে মা। আজ দুদিন হল। পক্ষীকে বলেছে, আমি চললাম। দুঃখ করিস না। আলাদা করে যাতনা পাওয়ার আর কীই বা আছে। তুই আমার নয়, এই পৃথিবীর পেটের ভেতর, বুকের ভেতর রাতদিন গুমরে গুমরে উঠছে যে যাতনা, তার সন্তান। সে যাতনা যে দেয়, তার নাম সমাজ। তার নাম মানুষ। তোকে যে সেই পরিচয় বুকে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে বাবা।
আর বলেছে, আমি চলে গেলে, ওই টিনের বাক্সটা খুলিস। গুটিকয় জিনিস আছে। একটা চিঠি রয়েছে। বহুকাল আগে একজনকে দিয়ে লিখিয়ে রেখেছিলাম। সেও ছিল আমার মতো বৈষ্ণবী। আমাকে বোন ডাকত। সে লেখাপড়া জানত। ওই চিঠিতে কয়েকটা কথা লেখা রইল। তোর জানা দরকার। আমার দেহটা নিয়ে কী করবি সেসবও লেখা আছে। আমি চোখ বোজার পর তবে খুলিস। তার আগে নয়।
রান্নাশাল থেকে একটা ঘটি নিয়ে রূপনারায়ণের দিকে ছুটল ভরত। সে আসছে। চারদিকে সাড়া ফেলে সে আসছে। সে মস্ত, আকাশপাতাল। সে হিমশীতল। সে ঘুটঘুটে কালো। তার গায়ে প্রাচীন জল, শ্যাওলা ও লক্ষকোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাসের গন্ধ। ভরতকে তার চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে হবে। হবেই। নইলে ও বড়ো হবে কেমন করে।
ঘটিটা ডুবিয়ে জল নিয়ে ও আবার ছুটে ফিরল বুড়ির ঘরে। জেঠাইমার মুখের ওপর ঝুঁকে বলল, জল খাবে?
চোখের পাতা দুটো মেলবার চেষ্টা করল মানুষটা। পারল না। কেঁপে কেঁপে বন্ধ হয়ে গেল। তবে এক চিলতে ফাঁক করে খুলে দিল দুঠোঁট। ঘটি থেকে সাবধানে একটুখানি জল ঢালল ভরত। পক্ষীদাদাকে ডেকে বলল, তুমিও দাও।
যন্ত্রের মতো কাছে এসে জল দিল দাদা। এমন সময় বাইরে ঝড় উঠল। দর্মার ঘর এফোঁড় ওফোঁড় করে শিসের শব্দ তুলে হাওয়া বইতে লাগল। ভরতের কানে এল শোঁ শোঁ করে ফুলে উঠছে রূপনারায়ণ। গাছপালায় ঝটাপটি জুড়ে দিয়েছে পাখির দল। উঠোনে নেমে ট্যাঁ ট্যাঁ করে চেঁচাচ্ছে চাতকের ঝাঁক। অন্ধ রাক্ষসের মতো বড়ো বড়ো পা ফেলে এসে ঝড়টা আছড়ে পড়ল পক্ষীদের ঘরে।
দপ করে নিভে গেল লন্ঠনখানা।
৩
টিনের বাক্সটা খুলে কয়েকটা কাপড়জামা, দু-তিনটে পুরোনো পুঁথি, থলে জড়ানো জপমালা, এইসব সরিয়ে একটা পুঁটুলি বের করে আনল ভরত। পক্ষীদাদা পাথর হয়ে আছে। ও-ই বলল, তুই একবার দ্যাখ দিকি।
পুঁটলিটা খুলতে বেরোল মুড়ে রাখা কিছু টাকা, একটা আংটি, সরু একটা হার, একটা তাবিজ। আর এদের সঙ্গে পক্ষীদাদার মায়ের চিঠি।
দাদা লেখাপড়া জানে না। গ্রামের ইস্কুল ঠাঁই দেয়নি ওকে। চিঠিটা ভরতকে ধরিয়ে বলল, তুই বিনা গতি কী...
অন্যের চিঠি পড়তে খুব লজ্জা করছিল ভরতের। আবার গায়ে কাঁটাও দিচ্ছিল। কে জানে কী লিখে গেছে মানুষটা!
পাতাটা অনেক পুরোনো। ভাঁজে ভাঁজে দুর্বল হয়ে এসেছে। ওটাকে সাবধানে খুলে ভরত পড়তে লাগল -
বাবা পক্ষী,
আমার ইচ্ছে ছিল আমি মরলে পরে এই চিঠিখানা তুই পড়বি। নিশ্চয় তা-ই ঘটছে। এখন তুই একা। সম্পূর্ণ একা। এই পৃথিবীতে তোকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই। জন্ম থেকেই তোর বাপ ছিল না। এখন মাও রইল না। তুই অনেকবার শুধোতিস, তোর বাপের নাম কী? আমি শিখিয়েছিলাম - তোর বাপ ওই রূপনারান। কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয় বাবা। তোর বাপ সত্যিই ওই নদী। এ-কথা কক্ষনও ভুলিস না। মানুষ-বাপকে তো সবাই চেনে, ভালোবাসে, সুখে-দুঃখে পাশে পায়। কিন্তু মস্ত ওই নদীকে বাবা হিসেবে পেলে তোর জীবনের সব ডর ঘুচে যাবে। দেখিস।
আমার দাদু ছিল বৈষ্ণব। বোধহয় তার থেকেই আমার মনে কৃষ্ণপ্রেমের বাতাস লাগে। কবে যে ও-পথ টেনে নিয়ে গেল আমায়, আজ মনে পড়ে না। আখড়া থেকে আখড়ায় ঘুরতে ঘুরতে, পথে পথে গান বিলোতে বিলোতে, তোর বাপের সঙ্গে দেখা। সেখান থেকে সম্পর্ক। আমরা ঘর বাঁধলাম। এসব কথা লিখতে যতখানি সহজ, আসলে তেমন ছিল না। তোর বাপ আর আমার ধর্ম ছিল আলাদা। আমাদের মেনে নিল না কেউ। তখন আবার ঘুরতে লাগলাম। আর জানলাম, তোর বাপ ছাড়া এই বিরাট দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই।
ভগবান যদি আমাদের মতো মানুষদের জন্য, যাদের সবাই তাড়িয়ে দেয়, দূরছাই করে, তাদের জন্য আরেকটা পৃথিবী গড়ে দিতেন, তাহলে মানুষজন্মটার ওপর এত রাগ হত না। আমরা দুজনে তাড়া খেতে খেতে এইখানে ঘর বাঁধলাম। রূপনারানের ধারে। তোর বাপের ভিটে থেকে এ-ঠাঁই বেশুমার দূর। কিন্তু সেখান থেকেও খবর এসে ছড়িয়ে গেল। আমরা একঘরে হয়ে গেলাম। কীভাবে যে দিন কাটিয়েছি রে বাবা, সে আমি জানি, আর জানে উঠোনের ওই তুলসিমঞ্চ। তুই যখন পেটে, একদিন বেলাবেলি করে চরায় বেঁধে রাখা দুটো ছাগলকে ফিরিয়ে আনতে গেল তোর বাবা। আর ফিরল না। বিকেলপড়লে হাঁচড়-পাঁচড় করে খুঁজতে গিয়ে দেখি নদীর ধারের কাদায় রক্তের দাগ। বুঝলাম, তার দেহটাকে ভাসিয়ে দিয়েছে। আমিও তক্ষুনি জলে ঝাঁপই দিতাম। ঝপ করে তোর কথা মনে হল। নিজের কষ্ট কি এত বড়ো যে তার বশে আরেকটা প্রাণকে হত্যা করব? ভাবলাম, সবই কি মন্দ? ছেলেবেলা থেকে যা দেখে এসেছি, যা পেয়েছি, সব কালো? সবাই নিঠুর?
না। সব খারাপ নয়। মানুষ আর তার কীর্তিকলাপ ছেঁটে দিলে পৃথিবীর বুকে যা পড়ে থাকে, তা সকলই ভালো। রোদ্দুর, বাতাস, সোঁদা মাটির গন্ধ, পিদিমের আলো, রূপনারানের ঢেউ - এদের মতো ভালো এদের মতো বড়ো আর কে আছে রে বাপ? তাই তোকে শিখিয়েছিলাম কোনো মনিষ্যি নয়, তোর বাপ ওই নদী।
এই চিঠির সঙ্গে তোর বাপের একটা তাবিজ, আমার ঠাকুমার থেকে পাওয়া হার-আংটি, আর কিছু টাকা রইল। কাছে রেখে দিস। টাকাটা কাজে লাগবে। আস্তে আস্তে নিজের জীবনটা গড়ে তুলিস বাবা। তোকে দুটো ভালোমন্দ খাওয়াতে পারিনি। চকমকে জামাকাপড় দিতে পারিনি অঙ্গে। শাকপাতা খেয়ে, ছেঁড়া-পুরনো পরে এতটা বড়ো হয়েছিস। পড়ালেখাও করাতে পারিনি। তোকে পাঠশালায় নিয়ে যেতে দেখে গ্রামের লোকেরা মারতে এসেছিল। তখনকার মাস্টার কিন্তু ভর্তি নিতে চেয়েছিল। বলেছিল, ‘ছাত্র আর রুগির কোনো জাত হয় না।’ সেই শুনে তাকেও সকলে এই মারে তো সেই মারে। ওই মাস্টারের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল ও কোনো মানুষ নয়। ও নদী। ও গাছ। ও এই উড়োপুড়ো বাতাস যে কী সহজে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল কত কত বছর ধরে মানুষের বুকে চেপে থাকা মস্ত পাথর!
তোর রূপনারায়ণ বাপের মতো, ওই মাস্টারের মতো, মানুষ হবি। আন্ধারকে ডরালে সে চিরকাল ভয় দেখাতেই থাকবে। তাকে একবার দুইহাতে ফালা করে দিলে দেখবি ফুটে বেরোচ্ছে আলো। সকালবেলার সোনা আলো। ঢলা-দিনের রাঙা আলো।
আমার শেষ ইচ্ছেটুকু জানাই রে বাপ। আগুনে আমার বড্ড ভয়। আমাকে পোড়াস না। ওই রূপনারানের জলে ভেলায় চড়িয়ে ভাসিয়ে দিস। সেই ইচ্ছে মনে পুষে রেখে রেখেই এত কলাগাছ বাড়িয়েছি উঠোনের ধারে। ওদিকে তোর বাবা গেছে, আমিও যাই, দেখি যদি দেখা পাই তার। কতদিন হয়ে গেল সে একা একা চলেছে।
ইতি -
মা
চিঠিটা পড়া শেষ হতে ছিলার মতো উঠে দাঁড়াল পক্ষী। বাইরে বেরিয়ে কোত্থেকে একটা দা হাতে নিয়ে ঘচাঘচ করে কেটে ফেলল গোটাকতক কলা গাছ। চালের বাতা থেকে দড়ি বের করে সেগুলোকে বেঁধে তার ওপর বিছিয়ে দিল পরিষ্কার কাঁথা। চারধারে চারটে কাঠি পুঁতে মশারি খাটালো। গুটিকয় ধূপ গেঁথে দিল ভেলার গায়ে। ঘর থেকে মাকে এনে শুইয়ে দিল মশারির ভেতর। তারপর আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে তুলে আনল ফুল। ওদের বাড়ি ঘিরে ফুটে থাকে ধুতরো, আকন্দ, অতসী, কালকাসুন্দা। আলো পড়ে আসায় ঝোপে ঝোপে দেখা দিয়েছে হলুদ আর গোলাপি সন্ধ্যামালতী। কোচড় ভরে ফুল এনে ভেলাটাকে সাজিয়ে দিল পক্ষীদাদা। তারপর ধপ করে বসে পড়ল উঠোনে।
ওর কাছটায় গিয়ে বসল ভরত। কখন যেন ওর সব ভয় দূর হয়ে গেছে। দাদাকে ছুঁতেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল মানুষটা। পক্ষীদাদা ওর চেয়ে অনেকখানি বড়ো। হ্যাঁ, তা কুড়ি-পঁচিশ বছরের বড়ো তো হবেই। তবে ভালো করে খেতে না পেয়ে, শরীরের যত্ন-আত্তি না করতে পারায়, খুব রোগা আর অল্পবয়সী দেখায় ওকে। সেই মানুষটা ভরতের কোলে মুখ গুঁজে বেঁকেচুরে যাচ্ছে কান্নায়। কী বলে ওকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে না পেরে ভরত বিড়বিড় করতে লাগল, ‘কাঁদে না পক্ষীদাদা। এই দ্যাখো আমারও তো মানুষ-মা নেই। মায়ের কথা শুধোলেই বাবা কেবল আকাশ দেখাত। পিসিও তাই। আমি তো জানি রাত্তিরবেলার ওই তারা-ফোটা আকাশটাই আমার মা। আমি ওর মতো হতে চাই। চোখের সামনে যাদের দেহ-গতর নিয়ে চলতে-ফিরতে দেখেছি তাদের আমার একটুও ভালো লাগে না। ওই আকাশ কত বড়ো, কত সুন্দর। হাজার হাজার তারায় সাজানো। আজকে আমি যেমন ওপরপানে চেয়ে মাকে খুঁজি, তেমনি নিজে ওর মতো হতে পারলে এই পৃথিবীর কত মা-হারা মানুষ আমার দিকে চেয়ে মায়ের মুখ দেখতে পাবে। শান্তি পাবে। তুমি নদীর ছেলে। আমি রাত্তিরের। ব্যাস, আজ থেকে আমরা দুজন বন্ধু হলাম। আর কান্না করো না।’
৪
ওরা দুজন মিলে ভেলাটাকে রূপনারায়ণের কাছে নিয়ে গিয়ে জলের ধারে নামিয়ে রেখেছে। পক্ষী শেষবার আদর করে নিচ্ছে মাকে। মুখটা মুছিয়ে দিচ্ছে। কপালে এঁকে দিচ্ছে রসকলি। সামান্য হাঁড়িকুড়ি যা ঘরে ছিল সব ও তুলে দিয়েছে ভেলায়। কত দূরের পথ কে জানে। মায়ের লাগবে।
সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমে। তবু গগন মগন করা আলোর রেশ বিছিয়ে আছে মাথার ওপর। একটা দুটো করে তারা ফুটছে। হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে এসেছে রূপনারায়ণ। কতদিন পর সঙ্গিনীকে কাছে পাবে, দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে জল।
ধূপের গোছা, প্রদীপ সব জ্বালিয়ে দিল পক্ষীদাদা। আবার একবার দেখে নিল সব। অভাবে, অর্ধাহারে শীর্ণ হয়ে গেছে বুড়ির শরীর। দেখে বিশ্বাসই হয় না একদিন ওই দেহ থেকে আরেকটা প্রাণ বেরিয়েছিল। পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিল ভরত। ওর পরীক্ষা কি সাঙ্গ হল তবে? ও কি পারল? জীবনে একজন বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া কি বিরাট পাওয়া নয়? ওরই মতো বন্ধু - একটা মস্ত নদী যার বাবা!
এইবার কাদার ওপর দিকে জলের দিকে ভেলাটা ঠেলতে শুরু করল পক্ষীদাদা। হঠাৎ কী খেয়াল হল ভরতের, ও বলে উঠল - দাঁড়াও।
থমকাল পক্ষী।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে খোলাশুদ্ধ ডিম দুটো বের করে আনল ভরত। রান্নাশাল থেকে যখন বাসন-কোসন বের করছিল পক্ষীদাদা, ডিম দুটো তুলে নিতে হয়েছিল। তখন পকেটে পুরে নিয়েছিল ভরত।
ভেলার ওপর একটা বাটির ভেতর ডিম দুটো রেখে দিল ও। আকাশের একধারে চাঁদ উঠেছে। তার আলো পড়ে চকচক করছে ডিম দুখানা - যেন ওরা চাঁদ থেকে কুড়িয়ে আনা নুড়ি! কী আলো বেরোচ্ছে গা থেকে, মায়ের যাত্রাপথে আর প্রদীপ লাগবে না!
ফিসফিস করে ভরত বলল, ও-দুটো থাক। অনেকখানি রাস্তা। যদি খিদে পায়।