সন্ধের পর বাইরে বেরিয়েছিল অচিন। এমনি। সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি হয়েছে। বিকেল থেকে ধরেছে আকাশ। এবার হয়তো শীত পড়তে পারে। নভেম্বরের শেষ। অচিন সিগারেট কিনবে আর একটু হেঁটে আসবে। সারাদিন ঘুমিয়েছে, পড়েছে, ইউটিউবে শর্ট ফিল্ম দেখেছে। আলস্যেরও এক ক্লান্তি আছে। সেই ক্লান্তি কাটাতে সে বাইরে এল। আজ রবিবার। সুমনা গেছে বিরাটি, বাপের বাড়ি। এমনি।
‘অনেকদিন যাইনি, মা ফোন করে বারবার, একটু ঘুরে আসি।’
ছেলে দিল্লিতে পড়ে। এখন যা পড়ে লোকে। ম্যানেজমেন্ট। কোম্পানি চালাবে। বিদেশ যাবে। অনেক টাকা উপার্জন করবে। হয়তো বিদেশেই ঠিকানা হবে ওর। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে থাকে পশ্চিমে। ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের মোরেনো ভ্যালি। ছবি দেখেছে অচিন। পাহাড়ে ঘেরা এক অপূর্ব প্রকৃতি। অচিন খুব শিগ্রি যাবে। শুনেছে কাছেই ঘন্টা দেড়েকের ড্রাইভে এক মরু অঞ্চল আছে। জশুয়া বৃক্ষের ন্যাশানাল পার্ক। আবার দেড় ঘন্টায় প্যাসিফিক, সান দিয়েগো। মেহিকোর সীমান্ত। কয়েক পা হেঁটে দাঁড়াল অচিন। দীপেন না ? হ্যাঁ,দীপেন। সে এ পাড়ায় কেন ? মেহিকো থেকে এসে পড়েছে যেন আমেরিকা মহাদেশে। দীপেন থাকে তো চেতলার বস্তিতে। আদি গঙ্গার ধারেই প্রায়। কত বছর আগে গিয়েছিল দীপেনের বাড়ি। দীপেন তখন লিখত। গল্প। এখনো কি লেখে ? দেখতে পায় না তো। মনে আছে দীপেন একটা গল্প লিখেছিল, বস্তিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি। এখন না লিখে কী করে ঠিক জানে না অচিন। সে নিজে অধ্যাপনা করে। ছাত্র পড়ায়। ছাত্রী নিয়ে ঘোরে। তার গল্প হবে না, তাই লেখে না। এখন সাহিত্যের কোনো খোঁজই রাখে না। দীপেন এখন কি এদিকে চলে এসেছে ? দক্ষিণ থেকে উত্তরে , দীপেন তুমি যে ?
শীর্ণকায় দীপেন অন্ধকারে অচিনকে দেখে থমকায়। গায়ে ময়লা সোয়েটার, গলায় একটি মাফলারও আছে। অচিনের গায়ে একটি শাল। পায়জামা পাঞ্জাবি। চোখে চশমা, পায়ে স্নিকার। মাথার চুলে পাক ধরেছে। অ্চিনের চোখে মুখে কেমন সৌম্যভাব এসেছে। নামী অধ্যাপক। দীপেন তাকে দেখে বিব্রত হয়েছে যেন, কোনো রকমে বলল, ও, তুমি এদিকে থাকো অচিনদা ?
অচিন বলল, তুমি চেতলা থেকে চলে এসেছ ?
না, চেতলাতেই আছি।
এদিকে যে, আমার ফ্ল্যাটে চল। অচিন হাত ধরল দীপেনের, আমি এদিকে থাকি, জান না ?
দীপেন বলল,খুব জানি, কিন্তু বাড়িটা ভুলে গেছি অচিনদা, ভালো আছ ?
তুমি কেমন আছ দীপেন, কোথায় চাকরি করছ, সেই নিউজ পেপারে ?
মাথা নাড়ে দীপেন, নাহ, কাগজ তো বন্ধ হয়ে গেছে।
তাহলে ?
দীপেন বলল, এক পাবলিকেশনে আছি, কলেজ স্ট্রিটে।
তারপর ? অচিন নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল।
তার আর পর নেই, আছি! দীপেন হাসল কিংবা হাসতে চেষ্টা করল। অচিন লেখার কথা জানতে চেয়েছিল। থেমে যায় অচিন। কিছু বলতে পারে না প্রথমে। তারপর প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল,সেই বাড়ি এখন হাই রাইজ, আসবে ফ্ল্যাটে, এস, দেখা যখন হলো।
মাথা নাড়ে দীপেন, বলল, আমি একটা কাজে এসেছি, বাড়ি ফিরব, কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে কে জানে, খুব ভীড় হয় !
কাজটা কী ? না, অনাথবাবু লেনের কবিরাজ এস, চক্রবর্তী, ধন্বন্তরীর কাছে ওষুধ নিতে আসে দীপেন।
ধন্বন্তরী, এস, চক্রবর্তী ? অচিন বলল, তেমন কেউ এদিকে থাকেন নাকি ?
হ্যাঁ, আমাকে মাসে দুবার আসতে হয়।
কেন ? অচিন জিজ্ঞেস করল, কার অসুখ, কবিরাজিতে সর্দি কাশি সারে, আর কিছু হয় কি না ... ?
দীপেন অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ছেলেটা খুব ভোগে, বাতাস নিতে পারে না, দম আটকে আসে, আমি যাই অচিনদা।’ ঘড়ি দেখল দীপেন, বাড়ি ফিরতে হবে তো, উত্তর থেকে দক্ষিণে। সে আর দাঁড়াল না। অচিন দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর সিগারেট কিনে পায়চারি করে ফ্ল্যাটে ফিরল। ফ্ল্যাট ফাঁকা। সুমনা থাকলে টিভি চলত। ফিরতে রাত হবে। গাড়ি নিয়ে গেছে। অচিন তার সাজানো ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। এই রাস্তা দিয়েই তো দীপেন ফিরবে, কিছুই জানা হলো না। দীপেনের বউ কি চাকরি করে ? পাবলিকেশনে আছে, কেমন প্রকাশক ? কত আর মাইনে দেয়। বাংলা বইয়ের প্রকাশক তো। বই কে পড়ে এখন ? ক’জনের বই বিক্রি হয় ? অচিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। লোক চলাচল করছে। গাড়ি আসছে যাচ্ছে। দীপেন ফিরবে এখান দিয়ে। কত সময় লাগবে ফিরতে ? লাইনে দাঁড়াতে হয়। একটি সিগারেট শেষ করে ঘরে ফিরল অচিন। কম্পিউটার খুলল। ফেসবুক। সার্চ করল দীপেন সেন। সাতজন পায়। তাদের ভিতর একজন যেন এই দীপেন। ছবিটা চেনা লাগে যেন। কম বয়সের ছবি দিয়েছে মনে হয়। কিন্তু টাইম লাইন দেখে কিছুই বোঝা যায় না। শুধু ঠাকুর দেবতার ছবি। অচিনের মনে হলো, এই প্রোফাইল দীপেনের নয়। দীপেন ফেসবুকে নেই তাহলে। থাকলে সে বন্ধু হতো।
কী মনে হতে অচিন ফোন করল বিজনকে। বিজন সাংবাদিক। বিজন কি এখন দীপেনের খবর রাখে ? বিজন বলল, আমি দিল্লিতে অচিনদা, দীপেন সেন তো, খারাপ লাগে ওর জন্য, কিছুই করতে পারল না, জীবন নিয়ে অত এক্সপেরিমেন্ট করলে কিছু হয়।
অচিন বলল, সকলে তো শেষ অবধি পারে না বিজন।
বিজন বলল, ওর কথা থাক, অচিনদা, ওর বাস্তব জ্ঞান খুবই কম, চাকরি তো চলে গেছে।
পত্রিকা বন্ধ হয়নি ?
হয়েছে, তারপর ওরা তো ওকে দিচ্ছিল ওদের ইংলিশ ডেইলিতে, আমি সেখানেই আছি, ওকে এলাহাবাদ যেতে হতো।
গেল না ?
না যায়নি, কেন শুনবে ? বিজন জড়ান গলায় বলল।
অচিন জিজ্ঞেস করল, তুই এখন ফ্রি আছিস ?
হ্যাঁ, ঝাড়া হাত পা, রণিতা কলকাতায়, আমি এখেনে একা, দুটো আর,সি, নিয়েছি, বেশি খাই না, তুমি কী করছ অচিনদা ?
ছেড়ে দিয়েছি, লিভার ফাংশনিং খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
আমাকেও ডাক্তার বারণ করেছে, কিন্তু একেবারে বাদ দিতে পারি না।
অচিনের লিভার সফট হয়ে গিয়েছিল। হাফ পেগ নেওয়াও একেবারে বারণ। কিন্তু এখন যেন সাধ হলো। বাড়িতে নেই। থাকে না। অচিন বলল, ছেড়ে দে বিজন, ডাক্তার বারণ করলে বন্ধ করে দে, ভয় করে না তোর ?
বিজন বলল, আজই শেষ, আর একটা নেব, ব্যাস, এ জীবনে আর না।
হা হা হা করে হাসল অচিন। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণে কি চলে গেছে দীপেন ? এদিকে কোন ধন্বন্তরী থাকে যে চেতলা থেকে আসতে হয়। অচিন জিজ্ঞেস করল, গেল না কেন দীপেন, কলকাতার বাইরে চাকরি করতে যাবে না ?
না, তা নয়, আসলে দুশো জনের টোয়েন্টি পারসেন্টকে এলাহাবাদ পাঠাচ্ছিল, বাকিদের চাকরি নট, ও বলল তা হয় না, ও বিট্রে করতে পারবে না, আমার মুখটা কোথায় গেল বলো দেখি অচিনদা।
কেন, তোর এতে কী ?
ও তো প্রুফ রিডারের চাকরি করত, এমনিতে এখন প্রুফ রিডিঙের গুরুত্ব কমে গেছে, ওকে অ্যাকাউন্টসে চাকরি দিচ্ছিল, আমি রিকোয়েস্ট করতে হয়েছিল চাকরিটা, কিন্তু ও রিফিউজ করল, ঝান্ডা নিয়ে বসে পড়ল, আমার কথাটা ভাবল না।
অচিনের মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, তখন সে থাকত প্রতাপাদিত্য রোডে, দীপেন চেতলা, বিজন নিউ আলিপুর, বিকাশ মুদিয়ালি, তাদের পত্রিকা ‘মৃত্তিকা’ তখন বেরিয়েছে, অচিন একটা স্কুলে ঢুকেছে। আর কেউ কিছু করে না। দীপেন ঠিক সেই সময়ে একটা চাকরি পেয়েছিল। ডালডা ফ্যাক্টরিতে। সুপারভাইজার। ভালো মাইনে। রোববার বিকেলে লেকের ধারে বসে জিজ্ঞেস করল, কী করি ?
কেন, চাকরি তো ভালই। অচিন বলেছিল।
সাঙ্ঘাতিক এক্সপ্লয়টার, তিরিশজনকে বসিয়ে দিয়েছে, তোরা কী বলছিস, ওখানে জয়েন করব, আমি তো লিখব।
আমরা সবাই কী বললাম ? না। তা হয় না। ছেড়ে দে দীপেন। তুই লিখবি। ডালডা ফ্যাক্টরিতে লেখক কী করবে ? পত্রিকায় করতে পারিস।
দীপেন বলল, তোরা যা বলবি, তাইই করব আমি। অচিনের সব মনে পড়ল। সেই ডালডা কোম্পানি কি আছে বিজন, তুই তো সাংবাদিক।
বিজন বলল, আছে, হেভি ব্যবসা করে, এক্সপোরট করে মিডল ইস্টে।
ওই চাকরি নিলে দীপেন বেঁচে যেত।
বিজন হাসে, ধুর, ও কোথাও টিকত না।
কেন, তোর পত্রিকায় তো কুড়ি বছরের উপর করেছে। অচিন বলে।
কয়েকবার চাকরি যেতে যেতে থেকেছে, ও একটা গল্প লিখেছিল মালিককে নিয়ে, তা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। বিজন বলল, আনগ্রেটফুল, তোকে যে ভাত দিচ্ছে, তার কেচ্ছা লিখে দিচ্ছিস।
কেমন লেখে এখন ? অচিনের কৌতুহল কম নয়।
কেমন আবার, ৩০-৩৫ বছর আগে যেমন তেমনি, বদলায়নি। বিজনের গলায় বিরক্তি।
অচিন বলল, বিজন, হয়তো দীপেনের লেখার বিচার হবে পরে।
তার মানে ? বিজন প্রায় ক্রুদ্ধ গলায় বলল, অসফল মানুষ মৃত্যুর পর সফলতা পায় ?
জীবিত কালে কত লেখক তার প্রাপ্য সম্মান পায় না। অদীপ বলল।
হা হা করে হাসে বিজন, জীবনানন্দ দাশ ?
দীপেন হয়তো ওর লেখা বাক্স বন্দী করে রাখছে, একদিন ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।
বিজন বলল, তুই তো নেশা করিসনি, করেছি আমি, ভাট বকছিস কেন, যে নিজেকে বদলাতে পারে না, সে কিছুই করতে পারে না।
অচিন চুপ করে থাকে। দীপেন এমনিতে নিরীহ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক রোখা, দুর্বিনীত। সেই তিরিশ বছর আগে যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু দীপেনের ছেলে অসুস্থ, তা কি জানে বিজন ? বিজন বলল, শোনেনি কোনোদিন। ব্যালকনি থেকে অন্ধকার নির্জন রাস্তা দেখছিল অচিন। চলে গেছে দীপেন ? নাকি এখনো বসে আছে ওষুধের জন্য ?