২০১৮-র বাইশে ডিসেম্বর মনোজ মিত্র ৮১ পা দিলেন। সেই ১৯৫৯-এর মৃত্যুর চোখে জল নাটকের বৃদ্ধ বঙ্কিম (তখন তিনি ২১) এত বছর ধরে একটু একটু করে প্রকৃত বয়সে পৌঁছেছে। জীবনের সত্য আর মঞ্চের মায়াজাল মিলে মিশে গেছে। বাঞ্ছারাম বৃদ্ধ হয়েছেন কিনা জানি না, গেল ২০১৪-র ষোলই আগস্ট তো একাডেমি মঞ্চে বাঞ্ছারাম আবার এল, বুড়ো বাঞ্ছা ধীরে ধীরে সিধে হয়ে উঠেও দাঁড়াল। ১৯৭৭-এ যে নাটকের শুরু, ২০১৪-এও সেই বাঞ্ছারাম আবার মঞ্চে স্বমহিমায়। ২১-এ বঙ্কিম, ৩৭-এ গজমাধব( পরবাস ) ৩৯ এ বাঞ্ছারাম (সাজানো বাগান) এই তিন বৃদ্ধ আমাদের মঞ্চে মিথ হয়ে গেছে অনেকটা। এখানে তিনিই অভিনেতা। আবার ১৯৭২-র নাটক চাকভাঙা মধু (প্রযোজনা ঃ থিয়েটার ওয়ার্কশপ)-র জটা, মাতলা বা আরো পরের নাটক রাজদর্শন (প্রযোজনাঃ বহুরূপী) বা অন্য অনেক নাটকে বৃদ্ধ এক চরিত্র নিয়েই নাটক হয়ে ওঠে জীবনের এক অনুপম ভাষ্য। বৃদ্ধ হলেন বহুদর্শী। জীবনকে দেখেছেন তিনি বহুবছর ধরে। সেই দেখাই যেন তাঁর নাটকের দর্শন। যত বয়স বেড়েছে, বার্ধক্যের দিকে যত এগিয়েছে মানুষ, ত্রিকালদর্শী সেই চরিত্র হয়ে উঠেছে বার্ধক্যের কারণেই অনেকটা নিরূপায়। এই নিরূপায়তার গল্পই বলেছেন তিনি তাঁর নাটকে। মৃত্যুর চোখে জল-এর বঙ্কিম বা পরবাসের গজমাধবকে মনে তো পড়বে। গজমাধব আমাদের নাট্য সাহিত্যে এক অদৃষ্ট-পূর্ব চরিত্র। কিন্তু যে বঙ্কিম একান্ত নিরূপায়, নিজের ওষুধের শিশি বোতল নিয়ে কোনোক্রমে বেঁচে থাকতে চায় যে, সে চাকভাঙা মধুতে এসে (জটা) বেঁচে থাকাকে একটু সহনীয় করে তুলতে নানা কৃতকৌশল অবলম্বন করে। শোধ নিতে চায় অঘোর ঘোষের মৃত্যু ঘটিয়ে দিয়ে। জোতদার অঘোর ঘোষ এসেছিল সাপের কামড় খেয়ে সেই তল্লাটের বড় সাপের ওঝা মাতলার কুটিরে। নিয়ে এসেছিল তার পুত্র। মাতলার বুড়ো কাকা জটা শোধ নিতে চায়। অঘোর তাদের সব নিয়েছে। এবার যেন ফেরত নেবে। আসলে শ্রেণী চরিত্রের তফাতে জটা আর বঙ্কিম আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু বেঁচে থাকার অদম্য বাসনা তাদের একই রকম। চাকভাঙা মধু এখন ইতিহাস। বাংলা মঞ্চ অমন প্রযোজনা আগে দ্যাখে নি। অমন নাটকও নয়। আমাদের নাটকের ছকটাই ভেঙে গিয়েছিল চাকভাঙা মধুতে। জটা মাতলা আর মাতলার গর্ভবতী মেয়ে বাদামী, এই তিনজনের শেষ দুজন চায় অঘোর বাঁচুক। জটা তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিল আহত বিষধর কে বাঁচিয়ে রাখা মানে নিজেদের মরণ ডেকে আনা। এই দ্বন্দ্ব, বাঁচাব না মারব, নিয়েই নাটক। থিয়েটার ওয়ার্কশপের সেই প্রযোজনা ( নির্দেশনা ঃ বিভাস চক্রবর্তী ), আর বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, মানিক রায় চৌধুরী ও মায়া ঘোষের অভিনয় এখনো আমার স্মৃতিতে অমলিন। বৃদ্ধ বঙ্কিম বাঁচত শিশি বোতল নিয়ে, জটার বাঁচা আর মরা যখন একাকার তখন সে শোধ নিয়ে বাঁচতে চায়। সে হল সুন্দরবনের হতভাগ্য ভূমিহীন, না খেতে পেয়ে চারপেয়ে হয়ে যাওয়া মানুষ। ফলে সে আর বঙ্কিম তো আলাদা হবেই। এরপর ১৯৭৫-এর নাটক পরবাস, সেখানে উচ্ছেদ হওয়া ভাড়াটে গজমাধব নানা কৃত-কৌশলে থেকে যেতে চায় তার বহুকালের পুরোন আশ্রয়ে। এ নাটক তাই হয়ে ওঠে অসামান্য ব্যঞ্জনাময়। গজমাধবই যেন বাঞ্ছারাম হয়ে ওঠে সাজানো বাগানে। তার আগে বা পিছে লেখা কেনারাম বেচারাম হয়ে সাজানো বাগান। সাজানো বাগানের পর রাজদর্শন, কিনু কাহারের থেটার...কত নাটক। বেঁচে থাকার কৌশল আর অদম্য স্পৃহাই হয়ে ওঠে সমস্ত নাটকের মূলমন্ত্র। বেঁচে থাকার কথাই নানা ভাবে ঘুরে আসে। আর সেই বেঁচে থাকা এক ত্রিকালজ্ঞ বৃদ্ধের। তার বেঁচে থাকা শেষ অবধি যেন মানব সভ্যতার বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে। সাজানো বাগান যেন সেই কথাই বলেছে শেষ পযর্ন্ত। বৃদ্ধের বেঁচে থাকা আর একটি শিশুর জন্ম সমার্থক হয়ে ওঠে।
মনোজ মিত্রের নাটক সাহিত্য পাঠের স্বাদ দেয়। তাঁর সংলাপে যেমন নাট্যগুণ তেমনি সাহিত্যের গুণ। রসবোধ অসামান্য। কাহিনির গভীরতা, নাট্য কাহিনীতে জীবনের অতল তল ছুঁয়ে যাওয়া, এসব আমাদের নাট্য সাহিত্যকে দিয়েছে এক বিরল মাত্রা। মঞ্চ ব্যতীত নাটক পাঠ তো উঠে গিয়েছিল। অথচ আমি নিজেই তো ডাকঘর, বিসর্জন, রক্তকরবী ঘুরে ঘুরে পড়ি। পড়ি চাঁদ বনিকের পালা। আবার যা নেই ভারতে বা চাকভাঙা মধু, সাজানো বাগান, অশ্বত্থামা। মনোজ মিত্রের নাটকে সেই আস্বাদ পাওয়া যায়। অশ্বত্থামা নাটক পাঠ একটি কাব্য পাঠের অভিজ্ঞতা দেয়। আমি পড়ি ঘুরে ঘুরে। তেমন অভিনয় না হয়েও এই নাটক উচ্চারিত হয় এর সাহিত্যগুনে।
একটা কথা স্মরণ করতে হবে জরুরি অবস্থার সময় তিনিই লিখেছিলেন সেই গান, ‘ কেউ কথা বলো না, কেউ শব্দ করো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না…’। নাটক নরক গুলজার। ওই গানের সুর দিয়েছিলেন দেবাশিস দাশগুপ্ত। নাটক নরক গুলজার। সমস্ত রকম সেনসরশিপের বিপক্ষেই সেই গান।