মে মাসের ৬ তারিখ, আনন্দবাজার পত্রিকায় চারু মজুমদারের স্ত্রী লীলা মজুমদারকে নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই একই বিষয়ে একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন মৌসুমী ভৌমিক। বইটির নামঃ 'লীলাদি: এক অনন্য রাজনৈতিক যাপন' (কলকাতা: ঋত প্রকাশন, ২০১৮)। আনন্দবাজারে লেখাটি প্রকাশিত হবার পরই তিনি সামাজিক মাধ্যমে একটি খোলা চিঠিতে অভিযোগ করেন, যে, এই বইটির থেকে লেখাটির বহু তথ্য এমনকি ছবিও নেওয়া হয়েছে, কোনো স্বীকৃতি প্রদান ব্যতিরেকেই। বস্তুত অভিযোগ এই, যে, লেখা এবং ছবিগুলি নেওয়া হয়েছিল, বইটির সম্পর্কে একটি আলোচনা লেখার জন্য, সম্পূর্ণ নতুন একটি তথাকথিত 'মৌলিক' লেখার জন্য নয়। খোলা চিঠিটি প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রটি একটি সংশোধনী প্রকাশ করে। কিন্তু তার পরেও সম্পাদিকার কিছু বক্তব্য তো থেকেই যায়। মৌসুমী ভৌমিক তাঁর নিজের কথা লিখছেন এখানে।
আজ (৮/৫/২০১৮) আনন্দবাজারের চিঠিপত্র বিভাগে একটি ছোট নোট ছাপা হয়েছে। শিরোনাম, ‘ঋণস্বীকার’। তাতে অশোককুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘আমার লেখা “অন্দরের মেয়েদের আঁচলেই বাঁধা আছে বিপ্লবের মুক্তি” নিবন্ধটির (রবিবাসরীয়, ৬-৫) অধিকাংশ তথ্য, উদ্ধৃতি-চিহ্নের মধ্যে রাখা বাক্যবন্ধ এবং ছবি (চারু মজুমদারের ছবিটি বাদে) নেওয়া হয়েছে ‘লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’ বই থেকে। যার সম্পাদক মৌসুমী ভৌমিক। প্রকাশক: ঋত প্রকাশন। এই তথ্য লেখার শেষে ঋণ স্বীকারে ছিল, ছাপার সময় বাদ পড়েছে। এই স্বীকৃতি ছাপার অক্ষরে থাকা জরুরি।’
শ্রী অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় যে ‘নিবন্ধের’ কথা লিখেছেন, এবং লীলা মজুমদারের ওপর বেরনো যে বইটির কথা এখানে উঠেছে, আমার এই লেখাটি আমি সেই প্রসঙ্গেই লিখছি। ৬ মে সকালে রবিবাসরীয়তে অশোকবাবুর লেখা পড়ার পর দুপুরবেলায় আমি আনন্দবাজারের সম্পাদককেও একটি ইমেল লিখেছিলাম। তিনি তখন তখনই উত্তর দেন, এবং বলেন যে, বিষয়টির কথা তিনি জেনেছেন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমি আমার ইমেল এবং সম্পাদকের বক্তব্য প্রসঙ্গে একটি পোস্ট লিখেছিলাম ফেসবুকে। দু’দিন পর অশোক মুখোপাধ্যায়ের এই ঋণস্বীকার। আমি এই কথাটাই আনন্দবাজারের সম্পাদককে লিখেছিলাম, যে, আপনারা একটা লাইন ছেপে দেবেন দুঃখ প্রকাশ করে। ব্যাস, আপনাদের দিক থেকে আপনারা পরিষ্কার হয়ে যাবেন।
আশোকবাবুর লেখায় অবশ্য কোনও দুঃখ প্রকাশ নেই, একটি তথ্য জানিয়ে রাখা আছে মাত্র। এবং দায় প্রকারান্তরে পত্রিকার প্রোডাকশনের ওপর ঠেলে দেওয়া হয়েছে, লেখক বা সম্পাদক সেখানে মুক্ত। আমি গতকাল আমার এক দিদি-বন্ধু, আজীবন রাজনৈতিক সংগঠক কৃষ্ণা মীরা রায়কে ঠিক এই কথাটাই লিখেছিলাম, যে কোনো একটি জুনিয়র স্টাফের ওপর হয়ত খাড়াটা নামবে, সব দায় তার হবে, তুমি দেখো! ব্যাস, আর কিছু না। এখানে অবশ্য দায়টা যে কার হলো, তা-ই ভাল করে বুঝলাম না। যাই হোক, মীরাদিকে লেখা চিঠিটি আমি আর একটু গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি আবার। কারণ অশোকবাবুর ঋণস্বীকার আসলে একই সঙ্গে একটা অনেক বড় দায়িত্বকে আস্বীকার করে। আর সেই দায় থেকে না তো অশোকবাবুর, না তো আনন্দবাজারের মুক্তি আছে।
আমি গত রবিবার থেকে অনেক ভেবেছি এই বিষয়টা নিয়ে। আমরা অনেকেই ভেবেছি। আমাদের মতন করে লিখেছি, আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি, জনমত তৈরি করার চেষ্টা করেছি। Plagiarism বা লেখকের অসততার কথা অনেকেই বলেছেন, আনন্দবাজারের বাজারি আচরণের কথা বলেছেন অনেকে আর অনেকে লেখাটি শেষ পর্যন্ত লীলা মজুমদারকে কীভাবে উপস্থাপন করলো, অর্থাৎ লেখার content নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অভি (লীলা মজুমদারের ছেলে) তো যেন নিজেই এই ঘটনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে গেল। এমনিতে লিখেছে--এই সব লেখাই ক’দিন ধরে ফেসবুকে বা ইমেলে চালাচালি হয়েছে-- ‘এই বাজারি অসততায় আমরা পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত।’ আবার বলেছে, ‘তবুও আমি এই অনীতিনিষ্ঠ মানুষটির তোমাদের তিন বছরের অক্লান্ত শ্রমসাধ্য কাজটির এহেন অসম্মান ঘটানোর দায়ে নিজেকেই অপরাধী মনে করছি এবং প্রত্যেকের কাছে ক্ষমা চাইছি।’ বেচারা কার কাছে যে কে ক্ষমা চাইছে? I suppose some people are born decent and some are not.
স্রোতা দত্ত বইটি সম্পাদনার কাজে আমার সহযোগী ছিল, স্বভাবতই ওরও খুবই গায়ে লেগেছে। মনে হয়েছে, এ তো সেই চিরকালের বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলার গল্প। ‘”লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন”-এর কথা আনন্দবাজার জানত না? খুব বেশি করে জানত বলেই ভণ্ড, বাজারিকে বরাত দিয়েছিল। বলা ভাল পরস্পরের পিঠ চুলকে, লেখক-বাজার আরও একবার, কোনও বিকল্প, ছকভাঙা স্বরের গলা টিপে, নিজের ধাঁচায় তাকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। মেয়েকে তো বটেই সেই সঙ্গে "মুক্তি"কেও "অন্দরের আঁচলে" বেঁধে করতে চেয়েছে এলোমেলো, খেলো।’ তরুণ তাজা যুবক অপূর্ব রায় এমনিতেই বয়সের নিয়মে চট করে রেগে যায়। ‘[লীলা] "আজীবন সিপিআই(এম) দলের বিশ্বস্ত সদস্য"--ইনি কি গাঁজা খেয়ে লিখেছেন এসব? আনন্দবাজার সিপিএমের বাইরে কোন "বাম" ভাবতে পারছে না,’ ওর মনে হয়েছে। আর People’s Film Collective-এর সংগঠক কস্তুরি বসুরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে কাজ করার চেষ্টা করছে অনেকদিন ধরে। ফলে ওদেরও একটা নিজেদের মতন দেখা আছে। ‘আনন্দবাজার আনন্দবাজারের মত কাজ করেছে আর লেখক টিপিক্যাল বাজারি আচরণ করেছে,’ কস্তুরি লিখেছে। ‘এটা মোটেও টাইপো বা নিছক ভুলবশত একটা লাইন মিস হয়ে যাওয়া নয়। লেখাটা বই এর রিভিয়ু। (যদিও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে রিভিয়ু হিসেবেও জঘন্য। the guy entirely misses the point and typifies Lila Majumdar into his favourite anondobazar-পাচ্য stereotype of the 'leader's wife' albeit with a difference)। কথা হল যে এমনকি যে উদ্ধৃতিগুলো বিভিন্ন লেখা থেকে দেওয়া হয়েছে সেখানেও কার লেখার উদ্ধৃতি, সেটুকুও হয় বলা নেই নয় সযত্নে এডিটেড আউট। এর সঙ্গে যুক্ত টিপিকাল আনন্দবাজারীয় বা বাজারীয় শয়তানি “আজীবন সিপিএম” এর ব্যাপারে। খুব কায়দা করে হাওয়ায় একটা ডাহা মিথ্যে ভাসিয়ে দেওয়া। অথচ ভাবটা এমন যে উনি লীলাকে প্রশ্নহীন শ্রদ্ধা নিয়েই দেখছেন। নকশালবাড়িতে জেন্ডার প্রশ্নের “expert” বানাতে চেয়েছে ওনাকে আনন্দবাজার, হয়তো। এই ধরণের কাগজে এই ধরণের হাফ বেকড “expert”' থাকেই। বাঙালি খায় ব্যাপারটা।’
এরকম আরো অনেক কথা অনেকে লিখেছেন এই গত ক’দিনে। আমার বন্ধুরা নানান দেশে থাকেন, তাঁরা মুলত লেখক হিসেবে আমাদের অধিকার লঙ্ঘনের দিকটিই দেখেছেন, আর বার বার প্লেজিয়ারিজম-এর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। আনন্দবাজারের সম্পাদককে লেখা আমার চিঠিটির পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ দিনের সহকর্মী-বন্ধু, কম্পোজার অলিভার উইক্স বলেছে, ‘If I ever find myself up in a situation like that, I may well find myself plagiarising bits of your letter.’
যে লেখার কথা অলি বলছে, তাতে আমি এইভাবে লিখেছিলাম: ‘I do not know where to start to protest. Should we go to a lawyer? Should we ask for compensation? I mean, you might--and you probably will, to save your face and stay legally safe--publish a one-line apology tomorrow and then your paper's hands will be washed clean. The damage this does to our book, where we feel used and abused, that does not go away. We have become helpless victims of a pillage. Our years of research and Anita-Abhijit-Madhumita-Indranil-Saikat-Bela-Madhubanti's closely treasured and painfully remembered stories about a time and people they dearly loved, has already gone out as someone's else's. My deeply involved editorial work has gone unacknowledged. How will you undo all that?
‘The point is, what do you, as ABP, care? People will forget this story, I know. A new scandal will take its place. But this systematic and systemic attempt by power-houses such as yours not to acknowledge other political ways of being, beyond the handouts of your mighty media, is something which will continue. I have been experiencing this all through my working life. You use our work to sell in the market and then refuse to acknowledge our existence.
‘Isn't it a real surprise that we we still continue to live and breathe and work in our own worlds? That we still dare to carry on with our ”onyo rajnoitik japon”?’
শুধুমাত্র plagiarism ?
সত্যিই কি বিষয়টা plagiarism-এ সীমাবদ্ধ? আমি যত ভেবেছি, আমার তত মনে হয়েছে যে শুধুমাত্র কারো অনুমতি না নিয়ে এবং স্বীকৃতি না দিয়ে তার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেবার বিষয় এটা কিন্তু নয়। তাহলে তো অশোকবাবু যেভাবে লিখেছেন যে উনি ঋণ স্বীকারের কথাটা লিখেছিলেন, ছাপা হয়নি, এখন ছাপা হয়ে রইলো, অতএব এবার ব্যাপারটা মিটেও গেল--সত্যিই তো ব্যাপারটা তাহলে এখানেই মিটে যায়। আর কীই বা বলার থাকে? দুঃখ প্রকাশ করেনি বলে একটুখানি গালাগাল দিতে পারি শুধু, বলতে পারি যে ছোটবেলায় বাবা-মা ভদ্রতা শেখাননি? যেমন, সেদিন আমি ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর একটা প্লাস্টিকের বড় ছাতা রাখা ছিল রাস্তায়, তাতে ব্যাংকের নাম লেখা। সেখানে দাঁড়িয়ে খুব চকচকে জুতো, জামা আর গলায় আইডি কার্ডের মালা পরে, এক ব্যাংককর্মী কী যেন বিক্রি করার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় খুব জোরে একটা হাওয়া দিলো আর অমনি ছাতাটা সোজা এসে পড়ল আমার মাথার ওপর আর আমার বেশ ব্যথা লাগল। ব্যাংককর্মীটিকে নির্বিকার দেখে আমার আরোই ব্যথা বেড়ে গেল আর আমি বললাম, এটা কী হলো? তিনি বললেন, হাওয়া দিলে আমি কী করবো? আমি বললাম, আপনি অন্তত sorry বলবেন আর আপনার দায় স্বীকার করে নেবেন আর ভবিষ্যতে এটা যাতে না হয়, তার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা নেবেন। আমি দেখলাম, আমি একাই কথা বলছি। লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, সবাই নিজের নিজের টাকা তোলার অপেক্ষায়। ব্যথা তাতে বুঝি আ-আ-রোই বেড়ে যায়।
এখন, সত্যিই তো ‘হাওয়ার’ ব্যাপারে আমাদের কীই বা করার আছে, বাবা মা খুব যথাযথ ভদ্রতা শিখিয়ে থাকলে বড়জোর মাথা নিচু করে, ‘ভুল হয়ে গেছে’ বলা ছাড়া? Perhaps that is all that is left for us to do? সত্যিই। সমস্যাটা হাওয়ার। লালনের ভাষায় বলতে হয়, সমস্যাটা একটা বদ-হাওয়ার। এই সময়ে, ঐ বদ-হাওয়ার তোড়ে আমরা সবাই আসলে বয়ে গেছি। The problem is with the air we are breathing. আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, ‘বাজারি মিডিয়া এবং তার সাংবাদিকতা নিয়ে আমার just কিছু বলার নেই। নরক তার চেয়ে পবিত্র।’ তিনি তাঁর যাপনের সূত্রে খানিক দূরত্ব এবং immunity অর্জন করেছেন হয়ত, আমি তো নিজেকেও দেখতে পাই এই পাকের ভিতরে। আমার মনে হয়, আমরা কেউ এর বাইরে নই, WE are the air we breathe. এই সময়ের ঊর্দ্ধে কেউ নই আমরা। ইলিনাদি (সেন) খুব অসুস্থতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে ‘লীলাদি: এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’-এ কাজ করেছিলেন। আমরা ওঁর মনের জোর দেখে বার বার হতবাক হয়ে গেছি। আজ ইলিনাদি আমায় লিখেছেন, ‘The entire episode reflects the patriarchy of our intellectual elite. From the title of the article, to the 'daay shara' tone of the apology, and the bureaucratic editorial response, it is a huge learning experience, if we needed any, of grudging paternalism.’ এই হলো তাঁর ক্ষোভের কথা। আবার প্রত্যয়ও আছে, এখনও আছে। ‘Today, I am really proud of the different values we have been able to establish through our lives and work. This episode gives us more reason why we should take strength from one another and take pride and pleasure in our collective solidarity.’
আমি ভেবেছিলাম, ওদের power of establishment থাকলে, we also have our strength in not being a part of the establishment। এই অ-প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান আমাদের একটা স্বাধীনতা দেয় যে, সেটা ওরা নিশ্চয় জানে? তাহলে ওরা এটা করলো কেন? আমাকে একজন বলছিল--সে ওই কাগজেই কাজ করে--যে, ‘ওদেরও তো ইমেজ নিয়ে ভাবতে হয়।’ আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ অশোকবাবু তথা আনন্দবাজারের বক্তব্য দেখে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওদের আসলে কিছুতেই কিছু যায় আসে না। অথবা, এই অপরিসীম ঔদ্ধত্যই হয়ত ওদের ইমেজ। ওরা হচ্ছে ‘হাওয়া দিলে আমি কী করবো?’ দলের লোক। ইংরেজিতে শব্দটা হলো impunity, সেই impunity ওদের আছে। বাংলায় কী বলবো? যা কিছু করে পার পেয়ে যাওয়ার লাইসেন্স, এক ধরণের ছাড়পত্র বলা যায় হয়ত। সমাজই ওদের দিয়েছে সেই ছাড়পত্র, এই সময়ই দিয়েছে। আমরাই দিয়েছি। তাই বলি, আমিও এই হাওয়ার ঘূর্ণিপাকের বাইরে নই।
কিন্তু, এই আপাত টানটান ঔদ্ধত্যের পাশাপাশি আসলে যে জিনিসটা ওদের আছে, তা হলো একটা লতপতে, পিচ্ছিল মেরুদণ্ডহীনতা। সেই কথায় পরে আবার আসছি।
কৃতজ্ঞতার লাইনটা অশোকবাবু লিখেছিলেন, আমি মেনে নিচ্ছি। (কস্তুরির মতন আমি বলছি না যে, এটা স্রেফ ছাপতে ভুল হয়ে যাবার ব্যাপার হতে পারে না)। ওদের রবিবাসরীয় যিনি দেখেন, তিনি শিক্ষিত, অভিজ্ঞ মানুষ, ফলে তিনিও হয়ত এটা হতে দিতেন না। কোনও ভাবে ঘটনাটা তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে, আমি সেটাও ধরে নিচ্ছি। অন্তত, তর্কের স্বার্থে। তাহলে আর কী বাকি থাকে? প্রোডাকশনে কারো একটা ভুল হয়েছে। সে যন্ত্র হতে পারে, মানুষ হতে পারে, জুনিয়র স্টাফ হতে পারে, ইতিমধ্যে যার চাকরিটি গেছে। কিন্তু যদি সেই ‘ভুল’টা না হতো? যদি লাইনটা বাদ না পড়তো? তাহলেই কি সব কিছু ঠিক থাকতো? অর্থাৎ, এই একটা লাইন বাদ পড়া ছাড়া আর কোনো ‘বদ- হাওয়া’ সংক্রান্ত সমস্যার দিকে এই ঘটনা নির্দেশ করছে কি?
যদি লাইনটা বাদ না পড়তো?
যে প্রশ্নটা এর থেকে উঠে আসে তা হলো, অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়-এর এই লেখাটা আসলে কী? ( http://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/lila-mazumdar-was-not-only-the-wife-of-charu-majumder-but-also-the-main-motivator-1.778074?ref=rabibashoriyo-new-stry ) এটা কি একটা curtain raiser? এটা কি বইটার স্বাদ দেবার জন্য লেখা হয়েছিল? না কি এই লেখাকে অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর একটি মৌলিক গবেষণা এবং রচনা হিসেবে রাখতে চাইছিলেন? এখানেই আসলে মূল corruptionটা। চিন্তার দৈন্য এখানেই। লোভ এখানেই। ধরা যাক, উনি যদি পঙ্কজদির বিষয়ে এক প্যারাগ্রাফ লিখে এটা বলতেন যে পঙ্কজদি’র কথা মনে পড়ে গেল অমুক বইটা পড়ে, তারপর তো তাহলে ওঁর নিজের কোনও কথা আর বলার থাকতো না। উনি একটা বই-এর গল্প বলছেন বলে ব্যাপারটা পাঠকের সমনে আসতো। এরকম অনেক লেখাই হয়, আমরা সবাই দেখেছি। ধরা যাক মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ লেখক, নৃবিজ্ঞানী এবং ফোকলরিস্ট Zora Neale Hurston (১৮৯১-১৯৬১)-এর একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি সম্প্রতি ছাপা হয়েছে। ( http://www.vulture.com/2018/04/zora-neale-hurston-barracoon-excerpt.html
বা https://www.newyorker.com/magazine/2018/05/14/zora-neale-hurstons-story-of-a-former-slave-finally-comes-to-print?mbid=nl_Magazine%20Optdown%20050718&CNDID=48719255&spMailingID=13461252&spUserID=MTc5ODk5NzU2NjQ1S0&spJobID=1400639563&spReportId=MTQwMDYzOTU2MwS2) । বইটির নাম ‘বারাকুন’। এক ক্রিতদাসের জবানবন্দী। এই বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপরিকায় লেখকরা কী লিখছেন? লিখছেন, এই প্রকাশনার কথা, জোরা নীল হার্সটনের কথা, এই প্রকাশনার তাৎপর্যের কথা, এবং শেষে হয়ত বইটা থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে দিচ্ছেন। এতে যিনি লিখছেন এই বিষয়ে তিনি কি ছোট হয়ে যাচ্ছেন? একেবারেই না! বরং, লেখকের নিজস্ব চয়ন এবং মনন সেখানে ফুটে উঠছে। সেখানে লেখক শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত নন, যাঁর কথা লিখছেন, তাঁর বিষয়ে তিনি শ্রদ্ধাশীল, যে প্রকাশনার কথা লিখছেন, তার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। তিনি সেখানে ‘বারাকুন’ বা জোরা নীল হার্সটনের নামটা ফুটনোটে গুঁজে দেবার চেষ্টা করছেন না।
লীলা মজুমদার সম্পর্কে খুব স্থানীয় পর্যায়ে, তাঁর মৃত্যুর পর দু একটা লেখা ছাড়া কোনোদিন কিছু লেখা হয়নি। অনিতাদি, লীলার বড় মেয়ে, এটাই ভেবেছিলেন, যে, মায়ের কথা কেউ জানে না। বাবার কথা নিয়ে তো কতই চর্চা হয়। তাই তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। অন্যদের দিয়ে লেখাতে চেয়েছিলেন। একটা খবরের কাগজের জন্য কোনটা বড় কথা? যে, এত দিন পর একটা মানুষের কথা জানা যাচ্ছে, নানান লেখক, অ-লেখককে জড়ো করে একটা সময়ের গল্প বলা হচ্ছে, অজস্র না-দেখা ছবির সঙ্গে কথা বুনে বুনে একটা যেন ট্যাপেস্ট্রি সাজানো হচ্ছে, সেইটা? কিন্তু সেইভাবে দেখলে তো বইটার কথা লিখতে হতো। অশোকবাবু তো তা চাননি। উনি তো এই বই-এর গল্পকে নিজের করে নিতে চেয়েছেন। এক ধরণের appropriation করতে চেয়েছেন । আর, তাই নিজের মতন লিখে নিয়ে শেষে বইটা সম্পর্কে (ধরে নিচ্ছি) একটা লাইন গুঁজে দিয়েছেন।
আনন্দবাজারও বইটা নিয়ে লিখতে চায়নি আসলে। আমার মনে হয় ওরা ভেবেছে, আহ! চারু মজুমদার, লীলা মজুমদার--great! এই নকশালবাড়ির ৫০ বছরে এটা খাবে মানুষ। তারপর আবার অন্য অনেক বাজার-কাটতি বিষয়ও আছে এর মধ্যে--women's history, unheard voices, বড় নেতার স্ত্রী--লাগিয়ে দাও! আবার এইভাবে বলো, যে, নকশাল বরের সিপিএম বৌ। যাত্রা পালার নামের মতন শোনাবে বেশ! এবং কার বৌ? না, খোদ CM-এর! Already দ্রোণাচার্য্য-কৃষ্ণা বন্দোপাধ্যায়ের জীবনকে ভিত্তি করে উপন্যাস লিখে নাম করেছেন, অতএব, চালাও চাক্তি! দাও ছেপে Sunday Supplement-এ!
বলেছিলাম না, এক লাইনের একটা বক্তব্য আসবে শুধু? তাই হলো। বাকি কোথাও কিছু নাড়া খেলো না। আমাদের এই ক’দিনের কথা বলায় কোনো কিছুই আসলে হলো না। হয়ত, আমার বাড়িতে বা শিলিগুড়ির মহানন্দা পাড়ায় অভিদের বাড়িতে কারো কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এই পর্যন্তই। বাকি সব যেমন থাকার তেমনিই থেকে গেল। আমার এক বন্ধু আমায় বললেন, ‘কাল অশোকের বদলে আর কেউ এসে আপনাদের কাজকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের মতন করে বেচে দেবে, আপনি কত জনকে ঠেকাতে পারবেন? এই সিস্টেম মানুষের মেরুদণ্ডহীনতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আপনি দেখতে পান না?’ পাই নিশ্চয়। আমি এও জানি যে সমস্যাটা আসলে তো simple plagiarism-এর নয়। সে জন্যই ওই ‘ঋণস্বীকার’-এ কিছু বদলালো না। সমস্যা তো এক সুগভীর corruption-এর। চিন্তা ভাবনার স্তরে corruption. সমস্যা মেরুদণ্ডহীনতার। A problem of deep enslavement. To a mighty system. সমস্যা তো একটা বদ-হাওয়ার।
কিছুই কি হলো না?
কিছুই হলো না কি এই ক’দিনের কথা বলায়? এই যে কথাটুকু বললাম আমরা, সেটাও কি কিছু না? কেউ কেউ ছিল হয়ত পুরনো খেলার সাথী, আজ হয়ত অন্যরকম হয়েছে, তাদের কারো কি ঘুমের ভিতরে ঘুম ভেঙে গেল না একবারের জন্যেও?
আমার একটা গান ছিল এইরকম:
প্রতিটা ঘর, নিরন্তর বাঁধতে চায়
ঘরের মধ্যে প্রতিটা দিন, মেরুদণ্ডহীন
প্রতিটা রাত, করাঘাত দরোজায়
দরজা খুলে বাইরে একই অন্ধকার,
আবার ঘর, ঘরে আবার রুদ্ধ দ্বার
আবার ঘর, ঘরে আবার রুদ্ধ দ্বার
আবার ঘর, ঘরে আবার রুদ্ধ দ্বার…
লিখতে লিখতে এখানে এসে একটু থমকে যাই। শেষের লাইনটা লিখবো কি? কী হবে লিখে? কী হবে আর অকারণ কথা বাড়িয়ে? আমরাই তো ওই হাওয়া। ওই বদ-হাওয়া যেমন আমাদের গায়ে এসে লাগে, তেমনি আমরাই তো তাকে জাগিয়ে তুলি? কী হবে বলো এই কথাটা লিখে, যে,
দ্বার খোলো, ভোর হলো, ও মানুষ।
এই অন্ধকার সময়ে কোনো ভোর হতে চায় না আর। ইলিনাদির মতন প্রত্যয়ে বলা কঠিন হয়ে যায় যে, এর পরও আমরা আমাদের মতন করে জোট বাঁধি। সেখানেই আমাদের জোর, আর জুলুমকে প্রতিহত করার শক্তি গচ্ছিত আছে। আছে হয়ত?