লেখাজোখা নেই । ঘর ঘর খেলছি। এ ঘর পরিষ্কার করে ও ঘর, ও ঘর পরিষ্কার করে এ ঘর। চৈত্রমাস এলেই ঘর উলোট পালোট করে বছরে একবার ঝাঁকিয়ে নিই। সামনে পা বাড়িয়ে আছে আমাদের রাজপুত্র বৈশাখ মাস। জীর্ণ পুরাতনে তার বড়ই অনীহা। তার হয়ে আজকাল বিকেল হলেই ঝড়ো প্রকৃতি শ্লোগান ঝাড়ছে। উড়িয়ে নিচ্ছে ধূলা, গাছের হলুদ পাতা, প্লাস্টিক ব্যাগ, আইসক্রিমের কাপ। ঝরিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি, আকাশ পাথর শিলা আর বিদ্যুতের চকমকানি। আমার রক্তের ভেতর আদি বাঙ্গালীর ডমরু বেজে ওঠছে। কোমর বেঁধে লেগে যাই ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নতুন করে সাজাতে।
কাজ শেষে মাঝে মাঝে আবার এক চোখ বন্ধ করে খুব মন দিয়ে মেডিটেশন করতে বসি। অশেষ হাসে, মাম একি ? এভাবে নয়। ক্লোজ ইয়োর টুআই---
ধ্যাত, আমি কি যোগী সন্ন্যাসি দরবেশ হবো নাকি! তাছাড়া দুচোখ বন্ধ করলে এই যে চৈত্রগন্ধ ঢালা দিনরাত, বাতাসে নুয়ে পড়া আমপাতা, ঝরা বউলের কান্না কি করে দেখব ! আমার এতেই চলবে!
তাহলে দেখো--- লাল, পার্পেল, কালো সবুজ কাপড়ে মোড়া কয়েকটি তালপাখা আর সেই রঙ্গীন কাগজে বানানো কতগুলো চরকা অশেষ দুলিয়ে দেয় আমার খোলা এক চোখের সামনে। ওয়াও ওয়াও ওয়াও ! আমার মেডিটেশন হাওয়া। খুশিতে প্রায় ঝুলে পড়ি, কোথায় পেলি পোক্রুস্কা! ইসস কি সুন্দর রে !
ডাবল ডেকারের মত দেখতে বোঁচা নাক নাচিয়ে ছেলে টিভি খুলে বসে। জানি কিছুতেই বলবে না। ও এরকমই। মাঝে মাঝে মাকে চমকে দিয়ে আনন্দ লুটে নেয়। হয়ত লেকসার্কাস গার্লস ইশকুলের সামনের তেঁতুলতলায় কোনো বৈশাখী ফেরিওয়ালা এসে বসেছে। হয়ত মনে পড়েছে বৈশাখ নিয়ে মায়ের ছেলেবেলার গল্পবলা সেই অনিন্দ্য মুখ। সেই মধুমতি চর, মেলা, নাগরদোলা, পাঁপড় আর গরম জিলাপি খেয়ে বাঁশিতে ফুঁ ফুঁ করে দুরন্ত মায়ের ঘরে ফেরার গল্প।
কি খুশি? নরম করে হাসে অশেষ। আর আমার ভেতর ছুটে, দৌঁড়ে, নেচে, কুঁদে, হেসে হাঁপাতে হাঁপাতে ভেসে আসে দুরন্ত সেই আমি।
চৈত্রের বিকেল। শচীন কাকুর হাত ধরে আমি ঝুলে পড়ি, টাকা দাও কাকু। আজকে আমরা সন্দেশ খাবো না।
শচিনকাকু জানতে চায়, তাহলে কি করবা মনা ?
রঙ্গিন কাগজ কিনবো। দাও না কাকু। তাড়াতাড়ি দাও। ভাইয়াটাও মাথা নাড়ে, কাকু দাও।
কাকু অনড়। নীল এপ্রনে হাত মুছে জানায়, তোদের হাতে টাকা দেওয়া যাবে না। বড়দা বলিছে তোদের সন্দেশ কিনে দিতি! চল তাই দিচ্ছি।
বাপি যে একথা বলে গেছে আমরা জানি। কারণ হাতে টাকা পেলেই আমরা চানাচুর, বাদাম, কটকটি, আমড়া, চালতার আচার আর কত কি যাচ্ছেতাই খাবার কিনে খাই। আর সন্ধ্যায় পেট ব্যাথার কথা বলে পড়তে বসি না।
অনেক করে বলার পরেও কাকু পাত্তা দিচ্ছে আমাদের। ওদিকে ভাইয়ার বড় বড় চোখের পাপড়িতে হতাশা লেপটে যাচ্ছে।
আমি কাকুর হাতে খামচে দিই, বললাম তো সন্দেশ খাবোনা। টাকা দাও। তাড়াতাড়ি দাও।
কাকু দেবে না কিছুতেই। এবার আমি কাকুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বাপির টেবিল থেকে তুলে নিই কাঁচের পেপার ওয়েট, টাকা দাও কাকু, না দিলে কিন্তু মাথা ফাটিয়ে দেবো তোমার ! এই যে দিলাম ! দিলাম !
হা, আমি ডাকাত। জানে সবাই। আমার হাতের তাক্ নির্ভুল। দু একবার দেখেছেও পাড়ার লোক। আমি ক বললেই কালবোশেখি। আর ঘাটালে মহা কেলো হয়ে যায়। টাকাটা ছিনিয়ে নিই কাকুর হাত থেকে। ভাইয়া মিষ্টি করে কাকুকে সান্ত্বনা দেয়, মা লুচি করেছে কাকু ! আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছে। এখুনি যেতে বলেছে।
হাহহা কাকু এবার মোটা করে কাটা বেগুন ভাজার সাথে লুচি খাবে আর “মেয়ে তো নয়, যেনো ডাকাত” বলে আমার সাতকাহন শুরু করে দেবে। আর মাও এই সুযোগে জেনে নেবে, হ্যারে শচীন ফার্মেসিতে কে কে এসছিলো রে কবিতা শিখতে?
কোনো এক মহিলার নাম শুনেই মা জ্বলে উঠবে, ক্ষি, অই মহিলাও ! মাগো মা। কি ঢঙ্গি মহিলা রে বাবা। তা কার কবিতা শিখছে অই ঢঙ্গি?
খেতে খেতে কথা বলতে কাকু খুব মজা পায়। কারণ মা গোয়েন্দার মত বাপির সম্পর্কে নানা কিছু জানতে চায় আর একটার পর একটা লুচি বেগুন ভাজা তুলে দেয় কাকুর থালায়। কোনো মতে কাকু জানায়, আবুল হাসান।
ধনুকের ছিলার মত সোজা হয়ে মা রাগ দেখায়, আবুল হাসানের ? আমাদের বর্ণির আবুল হোসেন ? তা তোর দাদা ছাড়া বুঝি আর কেউ নেই আবৃত্তি শেখানোর। উনার কাছেই আসতে হবে নিত্যি দিন ! মরণ আর কি !
কাকু খেয়েই চলে আসে ফার্মেসিতে। জানে সন্ধ্যায় বাপি ঘরে ফিরলেই জমে যাবে নাটক। ফার্মেসির পেছনে কালিবাড়ির বিরাট পুকুর। পুকুর পর্যন্ত ফার্মেসির বারান্দা বাড়িয়ে হাওয়াঘর করে নিয়েছে বাপি। সেখানে বৈশাখ এলে রিহার্সেল হয়। রবীন্দ্র নজরুল সুকান্তের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছাড়াও বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলা হয় জম্পেশ আনন্দে। আমার মার সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। নেই তাস খেলাতেও। শুধু কিছু কিছু মহিলাকে মা দুচোখে দেখতে পারে না। কিন্তু এই আন্টিদের আমার ভালোই লাগে। কত চকোলেট,বিস্কিট, খেলনা এনে দেয় আমাকে আর ভাইয়াকে। মার জন্যেও অনেককিছু আনে। মা সেগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার গুছিয়ে রাখে।
এখন বৈশাখ উদযাপনের মহড়া চলছে। বাপি ব্যস্ত রিহার্সেল করাতে। ফার্মেসি সামলাচ্ছে শচিনকাকু।
ভাইয়াও মহা ব্যস্ত। আমাদের দোতলাবাড়ির এক রুমে আমরাও বৈশাখ নিয়ে কাজ করছি। আমার মোটা বুদ্ধি। অশিল্পিত আঁকার হাত। তাই পাহারা দিচ্ছি কেউ যেনো আগে থেকে দেখে না ফেলে আমাদের কাজ। বৈশাখের ভোরে আমরা অবাক করে দেবো সবাইকে। ভাইয়া বললে কখনো সখনো একটু রঙ এগিয়ে দিচ্ছি। কোনোটায় একটু আঠা বা একটু সূতো বেঁধে দিচ্ছি। আমরা গোপনে গোপনে বানিয়ে নিচ্ছি চরকা, পাখি, কাগজের পাখা ফুল মালা, কুমির। আমার জন্যে স্পেশাল গরুড় পাখি , ভুতুম পেঁচা, দুলদুল ঘোড়া। পহেলা বৈশাখ আসতে মাত্র আর কটা দিন !
পহেলা বৈশাখ। আমার নতুন জামা ঘামে ভিজে সপসপ। চন্দনের ফোঁটা আধমোছা! তাতে কি ! প্রাণপণে চেঁচাচ্ছি আমরা,ও হো হো, এসো হে বৈশাখ এসো এসো---- আমাদের বানানো চরকাগুলো বনবন ঘুরছে। ঘরের এদিক সেদিক দোল খাচ্ছে কাগজের ফুল পাখি, কুমির, ঘোড়া, মাছ। কি সুন্দর হাসছে সবাই। মা সেই আন্টিদের সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। নতুন কাপড় জামা শাড়িতে কি ভাল লাগছে সবাইকে। এরমধ্যে কেউ কেউ ফুট কাটে, দেখ কেমন সাজিয়েছে! একদম হিন্দুদের মত!
বাপিসহ অনেকেই হেসে ওঠে, ওরে ছেলের বই থেকে বাংলা নববর্ষএর ইতিহাস ভালো করে পড়ে নিস। সবই তো দিয়ে দিলি হিন্দুদের, টুপি দাড়ি ছাড়া আর থাকল কি তোদের!
কেউ একজন পায়েসের বাটি এনে দেয়, নে, এখন পায়েস খা। এই নে নারকেলের বরফি। এটাও কিন্তু হিন্দুরা বানায়। আরবে তো নারকেল গাছ নাই। তাই বরফি বানাতে পারে না ওরা।
হো হো হাসিতে তলিয়ে যায় সন্দেহবাজ লোকগুলো। আলোর দিকে পেছন দিয়ে বসে থাকে ওরা। অন্ধকারে মিশে যায় ওদের সাম্প্রদায়িক অসুন্দর মন। বাগানের অন্যদিকে তখন গান গাইছে দিভাই আপুলিরা, আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ , মায়ার কুঞ্ঝটিজাল যাক দূরে , যাক যাক যাক --
কোনো এক নদীগন্ধমাখা শহরের তরুণ প্রাণরা বৈশাখকে বরণ করে নিতে কত কিছুই না বানাচ্ছে। পোস্টানো ছবিতে আমি ওদের হাত দেখি, হাতের আঙুল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রঙ, কাগজ। উদ্ভাসিত আলো এসে ছুঁয়ে গেছে ছেলেমেয়েদের চোখ মুখ। ওদের হাসি, হাসিতে বৈশাখী হাওয়া, ঝড়, বৃষ্টি , রোদ্দুরের জন্যে অনাবিল আহবান। কেউ কেউ ডাকে, ম্যাম আসুন। আসুন না প্লিজ। এ তো আপনারও শহর। দীর্ঘ রাস্তা জুড়ে আলপনা হবে। রঙ কেনা হয়ে গেছে। আপনিও আল্পনা আঁকবেন আমাদের সাথে। কি যে ভালো লাগবে ম্যাম!
একজন আবার জানালো নৌকা বাইচ হবে ধারে কাছের কোনো বড় নদীতে । নারী পুরুষদের সম্মিলিত বইঠার ঘায়ে নেচে উঠবে নদীতরঙ্গ। অগ্নিযুগ স্মরণে লাঠিখেলাও হবে। খেলা গান, কবিতা আরো কতকিছু। প্লিজ আসুন ম্যাম।
ওদেরকে বলেছি, আসবো আমি। এক নবীন প্রাণকে সাথে নিয়ে আসবো। এই বৈশাখে তোমাদের হাতে হাত মিলিয়ে দেবো ওর। সম্মেলক শক্তি হতে হবে যে এখন। অন্ধকারের জীবরা বড় ভাসমান। প্রকাশ্য আওয়াজ দিচ্ছে বৈশাখি উৎসব পালনের বিরুদ্ধে। বাঙালির ইতিহাসের উপর ছুটিয়ে দিচ্ছে আরবীয় ঘোড়া। টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে বাঙালির অনাদি একাত্মতাকে। সেই পুরনো আওয়াজ তুলেছে, বৈশাখ পালন মুসলমানের জন্যে হারাম। এটা হিন্দুদের অনুষ্ঠান।
আসছে অচলায়তন। এদের মুখতোড় জবাব দিতে হবে এখুনি। প্রতিষ্ঠা করতে হবে বৈশাখী উৎসব হিন্দু মুসলিম, খৃষ্টান বৌদ্ধ কারো নয়। এ কেবল বাঙালি জাতির নিজস্ব উৎসব। মসজিদে মোনাজাতে, মন্দিরে পূজাপাঠে, গির্জায়, মঠে যে যার ধর্মিয় মতে দেশ, পৃথিবী, আপনজনদের জন্যে প্রার্থনা করবে এদিন। আর হবে সর্বজনীন বৈশাখী উৎসব। গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটকে ফুটে উঠবে বাঙ্গালির প্রাণচিত্র। ধর্ম যার যার, উৎসব হবে সবার। আসছি আমি। তোমাদের সাথে আছি আমরণ এবং আজীবন।