মহামন্ত্রী বেজায় সমস্যায়, কারণ তাঁহার নাকি বডি-শেমিং হইয়াছে। কলকাতার কোন এক পার্ক-সার্কাসে ফচকে ছোঁড়ারা তাঁর নামে কুশপুতুল জ্বালাইয়াছে। তাহাতে ক্ষতি নাই, ও তো কত লোকেই করিয়া থাকে। কিন্তু ব্যাটারা নাকি পুতুলটির ভিতরে পাশবালিশ পুরিয়া তাহার উপর কাগজ সাঁটাইয়া দিয়াছিলঃ
মোটার ভুঁড়ি করব লিক
আমরা হলাম আঞ্চলিক।
আরও ভয়ানক যাহা, তাহা হইল, পার্শ্বেই আরও একটি পাশবালিশ রাখিয়া তাহার উপর লিখিয়াছিলঃ
ছাতির বহর ছাপ্পান্ন, পেট গলারও একই মাপ
দিল্লি গিয়ে মন্ত্রী হল, গর্তে থাকলে বলত সাপ।
মহামন্ত্রী বেজায় সমস্যায়, কারণ, এ সংবাদ পাইবামাত্র রাজামহাশয় ধোকলা-পানি ত্যাগ করিয়াছেন। নতুন সুটে তাঁহার আর রুচি নাই। এমনকি দেশভ্রমণেও আর যাইবেননা বলিতেছেন। শুনিয়া রাজসভায় হই-হই পড়িয়া গেল। হাজার হইলেও মহারাজা। হলইবা, তিনি দশ কোটি মানুষকে নির্বাসনে পাঠাইবেন বলিয়াছেন, নিজ খাসতালুকে গণহত্যা ঘটাইয়াছেন। তা বলে তাঁকে এইরূপে আক্রমন? এ সবই ম্লেচ্ছ চক্রান্ত। বিদ্বজ্জনরা হায়-হায় করিলেন। সভাকবি শেষে আসিয়া বলিলেনঃ
ম্লেচ্ছকুলের এরূপ দ্বেষ?
পাঠিয়ে দেবেন বাংলাদেশ।
শুনিয়া তবে রাজামহাশয় একটু শান্ত বোধ করিলেন। মহামন্ত্রী ফৌজদারকে দূরভাষে ডাকিয়া বলিলেন, এ কী কান্ড। তুমি কুশপুতুল আটওনাই কেন। ফৌজদার বলিলেন, আভি দেখিতেছি জাঁহাপনা। বলিয়াই ধড়মড়িয়ে গার্জেন কল করিবার নিমিত্ত বিদ্যালয়ে দৌড়ালেন। কিন্তু তাহাতে কোনো কাজ তো হইলইনা। বরং বদ ছাত্ররা কী করিয়া সে সংবাদ পাইয়া পার্ক-সার্কাস ময়দানে আরও একটি পুত্তলিকা আনিয়া তাহার উপর লিখিয়া দিলঃ
রাজার ধনটি টুনির এবং রানীর ধনটি বরের
কৃষ্ণধনটি পরের এবং রাজ্যধনটি খড়ের।
ফিরিবার পথে এই শিল্পকীর্তি দেখিয়া ফৌজদারের চক্ষু ললাটে উঠিয়া গেল। এ তো প্রায় অশ্লীলতা। ওদিকে অপরাধীদের কোনো খবর নাই। দূরভাষে মহামন্ত্রীর নিকট কাঁদিয়া-কাটিয়া অস্থির হইয়া বলিলেন, কিছু একটা বিহিত করুন অমিতবল মন্ত্রীমহাশয়। এরূপ অজস্র অপমান আমি যে আর নিতে পারিনা।
মহামন্ত্রী বলিলেন, আবার কী অপমান?
ফৌজদার বলিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়াছিলাম, চেয়ার দেয় নাই। ছাত্রদিগকে তলব করিব বলিয়া চিঠি লিখিলাম, উহারা আর্দালি দিলনা। হয়তো গাড়ি দিবে, কিন্তু ড্রাইভার কাড়িয়া নেবে, এই ভয়ে আমি দ্রুত ফিরিয়া আসিতেছি, এমতাবস্থায় দেখি এই কান্ড। দেহরক্ষীগুলো অবধি হাহা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
মন্ত্রী দাঁত কিড়মিড়িয়া বলিলেন, এই জাতটাই কী এইরূপ? তুমি তো ৩০০০ পুস্তক পড়িয়াছ, তোমার কী মনে হয়?
ফৌজদার বলিলেন, সে তো চাচা চৌধুরি আর চান্দামামা জাঁহাপনা। এই বর্বর জাতি সুললিত হিন্দি ভাষার এই সব পুস্তকাদি পাঠই করেনা। এমনকি উহারা মহারাজার কুমীর শিকারকেও গল্পকথা মনে করে।
মন্ত্রী বলিলেন, তবে তো উহাদের রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা দিতে হইবে।
যেমন কথা তেমনই কাজ। ঢাকঢোল পিটাইয়া রাজ্যভবনে সাপ্তাহিক হিন্দি দিভাস পালনের তোড়জোড় হইল। তোরণদ্বারে বিরাট অক্ষরে লেখা হইলঃ
মোদীর গারাভ মোদীর আশা
বিন্দাস হিন্দি ভাষা
সে এক বিপুল কান্ড। যে দেখিল সেই 'কী জিনিস, কী জিনিস' বলিল। কেষ্ট-বিষ্টুরা কাড়াকাড়ি করিয়া দূরদর্শনে আপ্রাণ কামড় দিলেন। সব তোড়জোড় সুসম্পন্ন। কেবল অনুষ্ঠান শুরুর দিন দেখা গেল কে যেন তোরণের নিচে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখিয়া গেছেঃ
কোথা থেকে এল এই চারপেয়ে প্রাণী
বাঙালির পোলা নয় হিন্দুস্তানি।
ব্যস। দিগ্বিদিকে হুলুস্থুল। রাজসভায় রাজামহাশয় গম্ভীর মুখে পায়চারি করিতে লাগিলেন। এ তো রীতিমতো জাতিবিদ্বেষ। যাঁরা কাশ্মীরে 'ব্যাটারা মরিয়াছে, বেশ হইয়াছে' বলিতে ব্যস্ত ছিলেন, যাঁহারা বঙ্গজাতিকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সকলেই নিজনিজ কর্ম ত্যাগ করিয়া এই জাতিবিদ্বেষের কড়ি কিন্দা করিলেন। শেষমেশ রাজকবি এসে বলিলেনঃ
সংস্কৃতির গর্বে ওদের অ্যাত্তো বড়ো গত্তো
রাজনীতিতে সবার আগে চাইছি সঠিকত্ব।
তখন রাজামহাশয় কিছু শান্ত হইলেন। মন্ত্রী ফৌজদারকে দূরভাষে বলিলেন, এইভাবে হইবেনা। ব্যাটাদের আগে ধর্মশিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
ফৌজদার কাঁদোকাঁদো স্বরে কহিলেন, আর কীভাবে দিব জাঁহাপনা?
মন্ত্রী দাঁত কিড়মিড়াইয়া কহিলেন, তাহাও কি শিখাইয়া দিতে হইবে? গুজরাত দেখ নাই?
যেমন কথা তেমন কাজ। আইটি সেল হইতে নানা ভাইটি জোগাড় হইল। তাহারা অন্তর্জাল জুড়ে সংখ্যালঘু নাম গ্রহণ করিয়া সংখ্যাগুরুদের গাল পাড়িতে লাগিল। বুড়া ভাম ও মৌলানা মমতার নিন্দায় কান পাতা দায় হইল।
কিন্তু দাঙ্গা লাগিলনা। মন্ত্রী কহিলেন আয়োজন কতদূর হে। ফৌজদার কহিলেন, আর বিশেষ দেরি নাই হুজুর।
কর্মে গতি আনিতে এইবার স্থানীয় ভাই নিয়োগ করা হইল। তাহারা লাথি ও পাথর লইয়া যত্রতত্র ছুঁড়িতে লাগিল। লৌহশকট পুড়াইল। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশিয়া রেললাইন উপড়াইতে উৎসাহিত করিল। সকলেই বলিল প্রলয় আসন্ন।
কিন্তু দাঙ্গা লাগিলনা। মন্ত্রী অধৈর্য হইয়া কহিলেন, আর কত দেরি। এক ধাক্কা আউর দো। তাঁহার বাক্যই আদেশ। তাই এইবার গরু ও শুয়োর লইয়া খেলাধূলা শুরু হইল। মসজিদে ও মন্দিরে মাংস নিক্ষেপপূর্বক ভক্তরা মজা দেখিবার নিমিত্ত অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
কিন্তু তাহাতেও দাঙ্গা লাগিলনা। উল্টে খবর পাওয়া গেল, ফচকে ছোঁড়ারা নতুন করিয়া কুশপুত্তলিকা জ্বালাইতেছে। এবার পুতুলের উপর লেখাঃ
গরু-ছাগল ঘাস-পাতা খায়
ব্যাঙের খাবার কুয়োর
মনুষ্যরা সাঁটিয়ে বেড়ায়
গরু এবং শুয়োর।
রাজ্যভবন এবং দিল্লিতে দীর্ঘশ্বাসের ঝড় উঠিল।সেই হুহু হাহাকারে নতুন শীতের পাতাগুলি দিগ্বিদিকে উড়িতে লাগিল। রাজার একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও সুবা বাংলায় কিছুতেই দাঙ্গা হইতেছে না। এ কী অনাসৃষ্টি।