ঠিকই, এটা কোনও বিজ্ঞান নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বার বার এমনটা হয়ে এসেছে। এটাকে একটা ঝোঁক বলা যেতে পারে। এটা দিয়ে আমরা অনেক সময় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি আন্দাজ করার চেষ্টা করি। সেটা কী? সেটা হল, এই রাজ্যের মানুষ রাজনীতির ক্ষেত্রে একবার যাদের বেছে নেন, তাদের বেশ কিছুদিন সময় দেন। কিন্তু যখন পরিত্যাগ করেন, তাদের আর ফেরান না। কংগ্রেসকে ১৯৬৭ সাল থেকে এই রাজ্যের মানুষ ত্যাগ করতে শুরু করলেন। বেশ কয়েকটা জোড়াতালি সরকার এবং জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭-এ গিয়ে সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।তার পর থেকে বামেরা সাফল্যের সঙ্গে চলা শুরু করলেন। সেই চলনে তাল কাটতে শুরু করে ৯০-এর দশকের শুরুর দিকে। ধীরে ধীরে সেটা বাড়তে থাকে। পরবর্তী বেশ কিছুটা সময় কিছুটা গায়ের জোরে ওভারটাইম করার মতো টিকে ছিল বামফ্রন্ট।
তৃণমূলের যে ক্ষমতা বাড়ছিল সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ২০১১ তে এসে সেই যে তৃণমূলের হাতে বামেদের বিদায়, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা উঠে বসতেই কোমর ধরে যাচ্ছে বামেদের। তৃণমূল কংগ্রেস বিরাট সুযোগ পেয়েছিল। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস যে ক্ষমতায় আসছে সেটা আমরা সাংবাদিকরা অনেকেই নিশ্চিত ছিলাম। টেলিভিসনে সেকথা স্পষ্ট করে বলার জন্য বামপন্থী বন্ধদের কাছে অপ্রিয়ও হয়েছিলাম। এক বামপন্থী নেতা ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলে, ‘ধরুন যদি ওরা আসেই, আগ বাড়িয়ে আপনাদের বলার দরকার কী’।সেই সময় সাংবাদিকদের কারও কারও মনে হয়েছিল, গ্রাম থেকে তৃণমূল বিপুল ভোট পেলেও ন্যানো কারখানা করতে না দেওয়ার জন্য শহরের চাকরি প্রর্থী যুবকরা হয়তো তাদের ভোট দেবেন না। ফল বেরোতে বোঝা গেল তাদের ধারণা ভুল ছিল। শহরও ঢেলে ভোট দিয়েছিল তৃণমূলকে। ২০১০-এ কলকাতা পুরসভায় বামেদের পরাজয় তার প্রমাণ। তৃণমূল কংগ্রেসকে মানুষ ভোট দিয়েছিল বিকল্প ভাবনা থেকে।সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সঙ্গে বাড়তি জুটল কাটমানির উপদ্রব আর লাগাতার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। আরও একটা বিষয়, এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই অবদান, সেটা হল, ‘দল বদল’। গত কয়েক বছরে ২৫-২৬ জন বিধায়ক, অসংখ্য পঞ্চায়েতসদস্য হাজার হাজার দলের সদস্য এদল, ওদল সেদল ঘুরে বেরিয়েছেন। এই সংস্কৃতি তৃণমূলের আমদানি। এখন তৃণমূল তার খেসারত দিচ্ছে। প্রধানমনম্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করছেন ৪০ জন তৃণমূল বিধায়ক নাকি তাঁর দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এই অতি নিম্ন মানের রাজনীতি এই রাজ্য আগে দেখেনি। এরই মধ্যে দেশে তো বটেই, রাজ্যেও হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান রাজনীতিতে এক সাম্প্রদায়িক মাত্রা যোগ করেছে। ফলে এখন, একদিকে ৫৬ ইঞ্চির হুঙ্কার অন্যদিকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বোঝাবুঝির চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছে বাঙালি।যে বাঙালিকে নিয়ে বামপন্থীরা এতদিন বলতেন, সচেতন ভাবে তারা নাকি বামেদের ভোট দেন, বাংলার মাটি নিয়ে দুর্জয় ঘাঁটি-ফাটিও বলা হত তখন, সেই বাঙালি এখন রামনবমীতে নকল লেজ লাগিয়ে রাস্তায় অস্ত্র হাতে ধেই ধেই করছে। যার হাতে নাতে ফল, লোকসভা ভোটে বিজেপির ১৮টি আসন।
আগে তো সত্যিটা জানতে হবে, তার পর আপনি কৌশল ঠিক করুন। সত্যিটা হল, বাংলার মানুষ তৃণমূল থেকে সরে সরে যাচ্ছে, বিজেপিকে পছন্দ করছে। এই পছন্দ করার গ্রাফটা রাতারাতি নামবে বলে মনে হয় না। বাড়তে থাকবে।তার সমস্ত ইঙ্গিত এখন স্পষ্ট।যেমন স্পষ্ট তৃণমূলের পড়তির লক্ষণ।
বামপন্থীদের কারও কারও মত, তৃণমূলের এই পড়তির সুফল বামেদের ঝোলায় যাবে। যদিও যা ঝোঁক, তাতে তেমন ঘটবে বলে মনে হয় না।
ত্রিপুরার দিকে তাকানো যাক। সেখানে ২০১৮ তে গত বিধান সভায় বিজেপি জোট ৫০ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। বামেদের ভোট ছিল ৪২.৭০ শতাংশ। কংগ্রেস ১.৮০ শতাংশ। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে দেখা গেল, বিজেপি ৪৯ শতাংশ। বামেরা কমে ১৭ শতাংশ। কংগ্রেস বেড়ে ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে আরও কয়েক লক্ষ মানুষ বামেদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস বাড়ছে। ত্রিপুরার নির্বোধ শাসকদলের নেতারা পঞ্চায়েতে ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি বহু জায়গায়, দিলে বামেদের ভোটে আরও ক্ষয় ধরা পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।অন্তত সেখানকার বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে তেমনই মনে হয়েছে।
এই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদীদের পেছনে জন সমর্থন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়শ্রীরাম বাহিনী, গোরক্ষক বাহিনীর সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নিয়মিত ঘটনা ঘটে চলেছে। এটা বাড়বে। অনেক বাঙালি মনে করে এসব ঠিক হচ্ছে। নাজিদের ব্ল্যাক শার্ট ভলানটিয়ারদের মতো এই গোরক্ষকদের ভূমিকা হয়ে উঠছে। এরাই হয়ে উঠছে সমাজের মাতব্বর। পুলিশ নয় এদের দিয়েই হয়তো একদিন খুঁজে বের করা হবে কারা তাদের মনের মতো জাতীয়তাবাদী নয়। আর সেই কারণেই দেখা যায় এই বাহিনীকে হিন্দুত্ববাদীরা স্যালুট করে। এরা ধরা পড়লে শাস্তি হয় না। জেলে গেলে ফিরে আসার পর মন্ত্রী বাড়িতে ডেকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন, এমন ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের চাকরিও দেওয়া হয়েছে। গণপিটুনি দিয়ে যারা লোক খুন করছে তাদের কড়া শাস্তির আইনেও হিন্দুত্ববাদীদের আপত্তি স্পষ্ট। এবং পেহেলু খান খুনের সব অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। ভিডিও ছিল, কিন্তু ছাড়া পেল প্রমাণের অভাবেই।
মানবিকতা, বামপন্থার প্রয়োজন ফুরোবে না সেটা যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক, মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি, কালো টাকা, পুলিশকে ঢিল, ধর্মতলায় জমায়েত, ধর্মঘট, ট্রাম-বাসে আগুন বামেদের এসব আন্দোলনের পাশে ছাত্র-ছাত্রী, যুবক, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, কৃষকরা দাঁড়াচ্ছেন না। কারণ বামপন্থীরা অনেকটা বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছেন। অথচ সম্প্রতি সরাসরি ভুক্তভোগীরা অনসন করে কিছুটা দাবি আদায় করতে পেরেছেন দেখা গেল, সেটা খুব শিক্ষণীয়। তবে নদী, জল, দূষণ, জলাভূমি, মাটির নীচের জল, অরণ্যের অধিকা এই সব বিষয়ে উপর উপর নয়, আন্তরিক আন্দোলন করলে বামপন্থীরা মধ্যবিত্ত, শিক্ষিতদের সমর্থন পাবেন বলে মনে হয় । এর সঙ্গে কৃষকের জীবনও গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে। যদিও এইসব বিষয়কে মানুষের প্রথম সারির প্রয়োজনের তালিকায় বামপন্থীরা এখনও সেভাবে রাখতে চান না। এটা একটা বড় সমস্যা।