যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গুজরাট দাঙ্গার পর পর নির্বাচনী সাফল্যের জন্য নরেন্দ্র মোদিকে ফুল পাঠিয়েছিলেন। আরএসএসের অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলে এসেছিলেন, এই সংগঠন দেশের জন্য কাজ করে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ( মাঝে সামান্য সময় বাদে) বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছেন তিনি, কিন্তু আজ সেসব অতীত। এবারের জাতীয় নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির অর্থবল, প্রশাসনিক ক্ষমতার দাপট, শান দেওয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে মমতার যে লড়াই লড়ছেন, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মমতার এই গর্জন শোনা গিয়েছে। জাতীয় সংবাদ মাধ্যম এবারের ভোটে মমতাকে নিয়ে যত লক্ষ শব্দ লিখেছে, অতীতে কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে তা হয়নি। রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করছি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখেছি, এত কিছুর পরও, তার ভিত্তিতেই বলছি, পূর্বসূরীদের মতোই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানুষ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে সব সমালোচনা হয়, তার মধ্যে প্রধান হল, একনায়কসুলভ মানসিকতা, মানবাধিকার কমিশনের মতো সংগঠনগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা, দলের মাঝারি এবং নিচুতলার তোলাবাজি দু’এক বার চেষ্টা করেও বন্ধ করতে না পারা এবং কার্যত মেনে নেওয়া এবং সব শেষে, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় এক কোটি মানুষ যাতে ভোট দিতে না পারে তার দানবীয় ব্লু-প্রিন্ট-এ কার্যত সায় দেওয়া। সঙ্গে আছে বিজ্ঞাপন দিয়ে বা না-দিয়ে মিডিয়া শাসন।
উল্টো দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে আছে রাজ্য-কেন্দ্রের মিলিয়ে ৪৬টি জনকল্যাণ কর্মসূচি। তার মধ্যে জেলা ভিত্তিক পড়ুয়াদের বড় অসুখের ক্ষেত্রে কলকাতায় বিনামূল্যে চিকিৎসা, কন্যাশ্রী, সাইকেল দেওয়ার কর্মসূচি ইত্যাদি প্রকল্পে ভালো কাজ হয়েছে। বাড়ির জন্য টাকা, ব্যবসার জন্য টাকা, গাড়ির জন্য টাকা, এই সব প্রকল্পে মাঝারি নেতাদের কাট মানি নেওয়ার অভিযোগ বেশ ভালই আছে। রাস্তা, ঘাট, সেতু, সাঁকো, ইস্কুল বিল্ডিংয়ের কাজ খুব ভালো না হলেও ভালো হয়েছে। হাসপাতাল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, তবে তার সুফল পেতে আরও বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। রাজ্য সরকারের আয় অনেকটা বেড়েছে। স্কুলের লেখা পড়ার মানের বলার মতো কোনও উন্নতি হয়নি। কাজ যা হয়েছে, সেটা আলাদা করে দেখলে, আগের সরকারের প্রথম সাত বছরের থেকে কোনও অংশে কম নয়। বেশিও হতে পারে।
তাহলে গ্রামের মানুষ কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর খুব খুশি? তা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নয়। তার প্রথম কারণ গত পঞ্চায়েতে প্রায় এক কোটি মানুষকে ভোট দিতে না দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, মাঝারি স্তরে তোলাবাজি। আরও একটা কারণ আছে। সেটা হল প্রকাশ্যে দলের লোকেদের নিজেদের মধ্যে মারামারি খুন জখম ইত্যাদি।
যতদিন না স্টেট ফান্ডিং চালু হচ্ছে, সিপিএমের এটা একটা অনেক দিনের দাবি, ততদিন ভোটে কোটি কোটি টাকা খরচ না করতে পারলে লড়াই করাই অসম্ভব। বিজেপির হাতে যত টাকা, মায়াবতী, অখিলেশ, চন্দ্রবাবুদের হাতে যত অর্থবল, তৃণমূলের তার সিকি অংশও নেই। সিপিএম নেতা গৌতম দেব অভিযোগ করেছিলেন, ২০১১-র ভোটে তৃণমূলের ফান্ডে চিটফান্ডের টাকা ঢুকেছিল। হয়তো ঢুকেছিল, কিন্তু তা আজও প্রমাণ হয়নি। ২০১৪তেই তৃণমূলের হাতে টাকা যথেষ্ট কম ছিল। বিজেপি তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গ দখলের পরিকল্পনা করে। এবং তারা জানত, মমতাই প্রধান বাধা। দলেরই একজন টাকা দিয়ে নিয়োগ করে এক এজেন্সিকে। যার ফল আমরা দেখেছিলাম, পাঁচ লক্ষ টাকা করে নিচ্ছেন একেক জন নেতা। কাজটা খুবই খারাপ। কিন্তু এটা মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার একটা বড় ষড়যন্ত্র, যার সবটা প্রমাণ অভাবে লেখা সম্ভব নয়, কারণ মামলা হতে পারে। এবং এই আলোচনাটাও হওয়া উচিত, ষড়যন্ত্র আর সাংবাদিকতা এক কিনা?
গোড়ার কথায় ফেরা যাক। ২০২১-এ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে চায়। ফলে তাদের এবারের ভোটে এই রাজ্যে বড় জমি চাই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই রাজ্যে ১৭টা সভা করেছেন। অমিত শাহ সারা দেশে যে ১৬৫টা সভা করেছেন, তার অন্তত তিরিশটা এই রাজ্যে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে মমতা সভা করেছেন ১২৪টা। পদযাত্রা করেছেন ৭৭ কিলোমিটার। বোঝাই যাচ্ছে লড়াইটা বড় মাপের। সম্ভাবনা দু’টি। বিজেপি এই রাজ্যে দশের বেশি আসন পেল, দিল্লিতেও ক্ষমতায় ফিরল। তাহলে ২০২১-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপদের কারণ হতে পারে সেটা। অনেক বাঙালিও মনে করেন, বিপদের কারণ তাদেরও।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা, এরাজ্যে বিজেপি দশের বেশি আসন পেল, কিন্তু দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরতে পারল না। সে ক্ষেত্রে মমতা ২০২১-এ হয়তো বিজেপিকে রুখে দিতে সফল হবেন।
বিজেপির যা সংগঠন তাতে তাদের ৩-৪টির বেশি আসন পাওয়ার কথা নয় এবারের লোকসভা ভোটে। যদি দশ বা তার বেশি আসন বিজেপি পায়, সেটা হবে একটিই কারণে। আমাদের কাছে নির্দিষ্ট খবর, সিপিএমের ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন। এবং ১৯ তারিখের ভোটেও একই ঘটনা ঘটবে। যেখানে বিকাশ ভট্টাচার্য, মহম্মদ সেলিম বা অমিয় পাত্র-র মতো প্রার্থীরা আছেন, সেখানে সেই লোকসভার সাতটি বিধানসভার দু’একটিতে সিপিএমের ভোট সিপিএম প্রার্থী পাচ্ছেন বা পাবেন। কিন্তু সাধারণ ভাবে বাম ভোট চলে যাচ্ছে রামের বাড়ি।
কেন? বেশ কয়েক জন সিপিএম নেতার সঙ্গে কথা বলে এই জানা গেল। তারা ভাবছেন, যদি তৃণমূল ২০২১-এ হেরে যায়, বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে দু’টো জিনিস ঘটবে। তাঁদের মতে, এমন হলে তৃণমূল দলটা উঠে যাবে। সিপিএম দু’নম্বর দল হবে এই রাজ্যে। তার পর তারা লড়াই করে নিজেদের হারানো আসন পুনরুদ্ধার করবে।
ঈশ্বর কমিউনিস্টদের শুভ বুদ্ধি দিন।
কমিউনিস্ট পার্টি আর আরএসএসের জন্ম প্রায় একই সময়ে। দু’জনেরই প্রায় এখন একশো ছুঁই ছুঁই। তার বিদ্বেষ নির্ভর আদর্শ নিয়ে আরএসএস টিকে আছে শুধু নয়, বাড়ছে। কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে এখন কৌশলের নাম করে কার্যত আরএসএসকে সমর্থনের পথে।
এর পর তো একটাই প্রশ্ন থাকে। রাত কত হইল? উত্তর মেলে না...