একখানা লেখা শুরু করতে গিয়ে উমবার্তো ইকো বলেছিলেন, অনেকসময় তিনি নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেও লেখেন (এবং সংশ্লিষ্ট সেই প্রবন্ধটিও নাকি ঠিক তেমন কারণেই লেখা হয়েছিল)।
হঠাৎ করে একেবারে উমবার্তো ইকো-কে নিয়ে টানাটানি করাটা বেখাপ্পা শোনালেও একথা সত্যি, যে, এলোমেলো চিন্তাধারা একবার সাজিয়ে লিখতে পারলে ভাবনাগুলো কিছুটা বিন্যস্ত হতে পারে।
বিশেষ করে, দেশের স্বাস্থ্যের হালহকিকত নিয়ে ভাবতে বসলে আশার আলোটুকু এতোই দুর্লভ, যে একটু গুছিয়ে আগলে না রাখতে পারলে অন্ধকারই অনিবার্য বোধ হওয়ার আশঙ্কা। সেইখানে, নিজের ভাবনা অস্বস্তি, হাজার না-পাওয়ার পাশে ছোটখাটো প্রাপ্তিগুলো, নিদেনপক্ষে প্রাপ্তির আশাটুকু সাজিয়ে লিখে রাখা জরুরী।
একদিকে দেশের স্বাস্থ্যের পেছনে সরকারের খরচ ক্রমেই কমতে কমতে আণুবীক্ষণিক হয়ে দাঁড়ানোর বাস্তব, প্রতিবছর স্রেফ চিকিৎসার খরচা মেটাতে গিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে যাওয়া, বিশ্বের সুস্থ দেশের সারণীতে আমাদের দেশের ক্রমেই পিছিয়ে পড়া, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ডামাডোলের পেছনে এক এবং একমাত্র ডাক্তারদেরই দায়ী ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে (আর এরাজ্যে তো কথাই নেই, আক্ষরিক অর্থেই “এগিয়ে বাংলা”) ডাক্তারদের উপর আক্রমণের খবর।
আর, অন্যদিকে, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কর্পোরেট অংশীদারিত্ব বাড়ার খবর, ডাক্তারি শেখার ব্যাপারটাকেও লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করা, নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য বাদ (ওই একটা ব্যাপারে অবশ্য এমনিতেও বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের তেমন উৎসাহ থাকে না) দিয়ে অন্য ক্ষেত্রে বেসরকারি অংশগ্রহণকে শিরোধার্য করার ঘোষণা, দেশের আমনাগরিকের স্বাস্থ্য বিষয়ে চিন্তাভাবনা ছেড়ে হেলথ ট্যুরিজমের পিছনে সরকারি উৎসাহ, গরীব মানুষের স্বাস্থ্যকে বীমার ভরসায় ছেড়ে দেওয়া।
আর, এইসব কিছুর সাথে সাথে প্রিভেনটিভ হেলথকেয়ারের বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিতে দিতে প্রায় খায় না মাথায় মাখে ধাঁচের অপরিচিতিতে এনে ফেলতে পারা। এমনকি, মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রিভেনটিভ হেলথ বিষয়টাকে কোনোক্রমে পার করা, যাতে ভবিষ্যতের ডাক্তাবাবুরা ওইসব অবান্তর চিন্তায় সময় না কাটান। স্বাস্থ্য মানে শুধুই চিকিৎসা - না শুধু চিকিৎসা নয়, একেবারে হাইটেক চিকিৎসা - এক স্পেশালিস্ট দিয়ে চলবে না, একেবারে সুপারস্পেশালিটি ছাড়া দিন অচল - এই ধাঁচে ভাবার অভ্যেস হয়ে গেলেই ব্যাস, ব্যবসার রমরমা হতে আর বাধা থাকে না।
এইসব ঢক্কানিনাদ নিওনবাতির ঝলকানির মাঝে টিমটিম করে একদল মানুষ মানে করিয়ে দিতে থাকেন সবার জন্যে সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যপরিষেবার কথা, জনস্বাস্থ্যের উপরে জোর দেওয়ার কথা, দেশের নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা, স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ভাবার কথা। বলা বাহুল্য, আরো অনেক আপাত ন্যায্য দাবীর মতো, এইগুলোও, প্রান্তিক দাবী।
দেশজুড়ে কয়েক হাজার চাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়ার পরেও, চাষীরা সংগঠিত হয়ে রাস্তায় না নামলে সরকার বা বিরোধীপক্ষ কারোরই ঘুম ভাঙে না। স্বাভাবিকভাবেই, দেশজুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ ফিবছর নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাচ্ছেন চিকিৎসার খরচ জোগাতে না পেরে বা আরো কয়েক লক্ষ বেঘোরে মারা যাচ্ছেন স্রেফ চিকিৎসাটুকুই না করাতে পেরে - এই নিয়ে কারোরই চিন্তিত হওয়ার কারণ ছিল না, কেননা, তেমন করে সংগঠিত হয়ে রাস্তায় নেমেছেন কজন?
কিন্তু, এইবার যেন কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ল।
স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথমবার দেশের প্রথমসারির রাজনৈতিক দলগুলো স্বাস্থ্যকে ঠাঁই দিয়েছেন তাঁদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোয়, এবং রীতিমতো গুরুত্বের সাথে কিছু ভাবনার কথা বলেছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যভাবনা ও স্বাস্থ্য-রূপরেখা, স্বাভাবিকভাবে, তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানের অনুসারী। কিন্তু, আমার মনে হল, এই স্বাস্থ্যভাবনা প্রকাশ্য ইস্তেহারে আসার ঘটনাটি খুবই আশাব্যঞ্জক।
প্রথমেই সরকারপক্ষের প্রসঙ্গে যাই। বিজেপি, প্রত্যাশিতভাবেই, তাঁদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোয় বলেছেন, তাঁরা তাঁদের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পটিকে আরো মজবুত করতে চান। এর সাথে জোড়া হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হেল্থ আর ওয়েলনেস সেন্টার তৈরী করার কথা। টেকনোলজি এবং টেলিমেডিসিনের উপযুক্ত ব্যবহারে গরীব মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা, রোগনির্ণয়ের পরিষেবা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। বীমানির্ভর চিকিৎসার একটি মূল খামতি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য তেমনভাবে এর আওতায় আসে না এবং হাসপাতালে ভর্তি না হলে বীমার সুবিধে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় (যদিও মানুষের চিকিৎসার খরচের সিংহভাগই ভর্তি না থাকা অবস্থাতেই হয়)। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দের উল্টোপিঠেই সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যয়সঙ্কোচন - প্রাইমারি হেলথকেয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদবিগ্ন ছিলেন অনেকেই। এই টেকনোলজি-বেসড প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিষেবার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সেই উৎকন্ঠার দিকে নজর দেওয়া হল, সম্ভবত। আবার, ওষুধপত্রের দাম বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি জরুরী চিকিৎসার সামগ্রী ও যন্ত্রপাতির তালিকা তৈরী করে সেইগুলোর দাম বেঁধে দেওয়া এবং দেশের সর্বত্র তার সরবরাহ নিশ্চিত করার ভাবনাও রয়েছে।
এও জানা গিয়েছে, মিশন ইন্দ্রধনুষ প্রকল্পের মাধ্যমে টীকাকরণে বিপুল সাফল্যের পর পরবর্তী লক্ষ্য টিবি রোগকে নির্মূল করা। টীকাকরণের সাফল্য কেমন সেই নিয়ে বেশী কথাবার্তা না বলাই ভালো, কেননা, অন্তত এই রাজ্যে এমএমআর টীকা দেওয়া বারবার ভেস্তে যাওয়ার স্মৃতি এখনও টাটকা। মূল কথা হল, নামটা খেয়াল করুন - এমন জম্পেশ নাম, ইন্দ্রধনুষ - শুনলেও সম্ভ্রম হয় - গাড়ুর নামটি কবে যে পরমকল্যাণবরেষু হতে পারবে, সেই অপেক্ষায় রইলাম।
তেমনই, ২০২৫ সালের মধ্যে টিবি রোগকে একেবারে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়েও হাসাহাসি করব না, কেননা, আমরা তো হর লাইনকো খতম করনে কে লিয়ে আখরি লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, নিরক্ষর মানুষে ভরা দেশটি রাতারাতি ডিজিটাল ইন্ডিয়া হয়ে যাবে, এই স্বপ্নেও বিশ্বাস করে বসেছিলাম - সেইসব বিবেচনা করলে, অন্তত যক্ষ্মার মতো অসুখ নিয়ে যে সরকার গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন, ভাবতে শুরু করছেন, এইটাই একটা বড় পাওয়া।
জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের মূল দাবীগুলোর সাথে বরং কংগ্রেসের ইস্তাহারের বেশ কিছুটা মিল আছে। বিরোধী দলের পক্ষে সেইটা স্বাভাবিক, অন্তত অস্বাভাবিক তো নয়ই। স্বাধীনতার পর এতগুলো দশক ক্ষমতায় থেকেও এইসব দাবি নিয়ে তাঁরা কী করছিলেন, বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Health for All 2000 ডাকের প্রথমদিককার স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হয়েও এবং অকুন্ঠ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও এই বিষয়ে তাঁরা এগোন নি কেন, এমন বেয়াড়া প্রশ্ন ছেড়ে বেটার লেট দ্যান নেভার ভেবে ইস্তেহারটি দেখা যাক।
স্বাস্থ্যচিকিৎসা সব নাগরিকের অধিকারের মধ্যে পড়ে, এইটা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বীমাভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তে মুখ্যত সরকারি স্বাস্থ্যকাঠামোকে মজবুত করে (এবং বেসরকারি সহযোগিতার সাথে) দেশের সব নাগরিককে বিনাখরচায় চিকিৎসা, শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নয়, এমনকি নিখরচায় ওপিডি বা আউটডোর চিকিৎসা ওষুধপত্র পরীক্ষানিরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। বীমাভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার খামতির উল্লেখ করা হয়েছে প্রত্যাশিতভাবেই। বর্তমান স্বাস্থ্যকাঠামোর ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ ধাপে ধাপে বাড়িয়ে জিডিপির তিন শতাংশ করার কথা ভাবা হয়েছে।
২০১০ সালের ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্টকে ঠিকভাবে লাগু করে বেসরকারি এবং সরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নজরদারির কথা বলা হয়েছে। মেডিকাল রেকর্ডসের ডিজিটাইজেশন করে তাকে সহজপ্রাপ্য করা ও ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার কথা বলা হয়েছে।
এর সাথে যেটা উল্লেখযোগ্য, মূলধারার একটি রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি, এই প্রথম (এইবারের ইস্তেহারে বামেরাও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভেবেছেন), অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উল্লেখিত হয়েছে। অন্তত জেলা হাসপাতালগুলিতে মানদিক অসুস্থতার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থা করে চিকিৎসার কাঠামো তৈরীর কথা বলা হয়েছে।
বিজেপি এবং কংগ্রেস, দুই দলের ইস্তাহারেই চিকিৎসকের অপর্যাপ্ততার কথা বলা হয়েছে এবং বাড়তি মেডিকেল কলেজ গড়ে এই ঘাটতি মেটানোর কথা বলা হয়েছে। যদিও, এইক্ষেত্রে, বিজেপির মত করে জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ ও সুপারস্পেশালিটি পরিষেবার আকাশকুসুম কল্পনাশক্তি কংগ্রেস দেখিয়ে উঠতে পারে নি।
এরপর আসা যাক বামদলগুলির কথায়। শক্তিক্ষয় হতে হতে, এইরাজ্যে তো বটেই, দেশের প্রেক্ষিতেও বামদলগুলি প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু, প্রান্তিক মানুষের ইস্যুগুলোকে মূলধারার রাজনীতির অ্যাজেন্ডা হিসেবে তুলে আনার ক্ষমতা, এবং সেই বিষয়ে তাঁদের লেগে থাকার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক-শ্রমিক র্যালির মাধ্যমে কৃষির সমস্যাকে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে সামনে আনার কৃতিত্ব মুখ্যত তাঁদেরই। এর সুফল ভোটের বাক্সে বামেরা না পেলেও, এই রাজনীতির সুফল চাষীরা পেয়েছেন, নিঃসন্দেহে।
সিপিআইএম-এর নির্বাচনী ইস্তেহারেও স্বাস্থ্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছে। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের দাবীদাওয়ার সাথে তাঁদের ইস্তেহারের মিলই সর্বাধিক। রীতিমতো আইন করে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাথমিকভাবে জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদে পাঁচ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরো মজবুত ও সুসংহত করার দাবী তোলা হয়েছে। কারণে-অকারণে সরকারি কাঠামোর বেসরকারিকরণ এবং পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে সরকারি ক্ষেত্রে বেসরকারি মুনাফার বিরোধিতা করা হয়েছে, যদিও, এই রাজ্যে, ক্ষমতায় থাকাকালীন, এইসব ক্ষেত্রে, তাঁদের ইতিহাস খুব উজ্জ্বল নয়। এর পাশাপাশি কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আরো বেশী নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির কথা বলা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে জায়গা পেয়েছে এবং ন্যাশনাল হেলথ মিশনের সাথে নতুন ডিস্ট্রিক্ট মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামকে মিলিয়ে পুরোটাকে আরো সুসংহত করার দাবী তোলা হয়েছে। ওষুধপত্রের সুষ্ঠু সরবরাহ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ তো রয়েছেই, কিন্তু এছাড়া কিছু কিছু দাবী রয়েছে, যেগুলো শুনতে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে কেমন করে করা সম্ভব, বুঝে পাওয়া মুশকিল। যেমন, এদেশ থেকে ইউএসএফডিএ-র অফিসের পাট চুকিয়ে দেওয়া বা নতুন ওষুধের ক্ষেত্রেও মাল্টিন্যাশনাল ড্রাগ কোম্পানির মনোপলি ভাঙা। ক্লিনিকাল ট্রায়ালের উপর আরো নজরদারির দাবী তোলা হয়েছে, যেটা সত্যিই সময়ের দাবী এবং খুব গুরুত্বপূর্ণও বটে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর জোগান বাড়াতে সরকারি উদ্যোগে আরো বেশী মেডিকেল কলেজ খোলার কথা বলা হয়েছে।
সবশেষে তৃণমূল। এই একটি ইস্তেহারই বাংলাভাষায়য় পড়ার সুযোগ হল। রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করলেও, এই ইস্তেহারটুকু নজর এড়িয়ে গেলে কিছু মিস করতাম না অবশ্য। একেবারে অনির্বচনীয় বাংলাভাষা। আমাদের কবিরা ক্ষমতার চেয়ার মোছার গুরুদায়িত্ব ছেড়ে যদি একটু ইস্তেহারের ভাষা গোছানোর মতো নীচু কাজের দিকে নজর দিতেন!! থাক, না হয় ফর্ম ছেড়ে কন্টেন্টের দিকে তাকাই। “আমাদের অভিপ্রায় ৫ লক্ষ টাকা বার্ষিক পারিবারিক আয় সমৃদ্ধ সমস্ত ভারতীয় নাগরিককে একটি স্বাস্থ্য বীমার আওতাভুক্ত করা।” আয়ুষ্মান ভারতের সাথে ফারাক কোথায়? “৬ লক্ষ টাকা বার্ষিক পারিবারিক আয় সমৃদ্ধ বয়স্ক মানুষজন পাবেন বিনামূল্যে মেডিকেল পরিষেবা।” তাহলে, তাঁরা কি স্বাস্থ্যবীমার আওতাভুক্ত হবেন না? তাঁদের চিকিৎসা কোথায় হবে। “পশ্চিমবঙ্গের মতোই সমস্ত সরকারি হাসপাতাল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ঔষধ, চিকিৎসা ও রোগ নির্ধারণ করবে।” বেশ কথা। তাহলে আর বাকি কথার দরকার থাকে কি? পাঁচ লক্ষ, ছয় লক্ষ, স্বাস্থ্যবীমা এমন হাজারো ফ্যাঁদাপ্যাঁচালের মানে কী? প্রত্যাশামতই সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল ইত্যাদি রঙীন গল্পটল্প সবই আছে, বিশদ বিবরণ নিষ্প্রয়োজন। আরো অনেককিছুই আছে, সবকিছুর উল্লেখ করে আপনাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেবো না। কিন্তু, অন্তত দুটি পয়েন্ট না শোনালেই নয়।
“স্বাস্থ্য সবার প্রকল্পে মা ও শিশুকে আমরা কেন্দ্রভাগে রাখছি।” বুঝলেন কিছু?
“আমরা সনাতন চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে আরো বেশী পরিমাণ গবেষণা ও উন্নয়ন নিয়ে আসবো।” শুধু সেই উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থাকলেই আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি, তাই না?
কিন্তু, শ্লেষ-বিদ্রূপ-হাসিঠাট্টা-অবিশ্বাস-বিরক্তি এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। জনস্বাস্থ্য-আন্দোলনের এক শরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি এই ম্যানিফেস্টোগুচ্ছ পড়া হয়, তাহলে প্রাপ্তির ভাঁড়ারে ঠিক কী পড়ে থাকে, যেখানে একথা সবাই জানেন, যে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, স্রেফ ভাঙার জন্যেই?
দেখুন, কোনো আন্দোলনেই সাফল্য রাতারাতি আসে না। দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে একেকখানা ফ্রন্ট জয়, ছোট ছোট সাফল্যের কিছু মাইলফলক থাকে। যেকোনো দাবীদাওয়া পূরণের আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি জরুরী ধাপ, দাবীগুলোকে জোরগলায় পেশ করতে পারা, দাবীটিকে প্রান্তিক থেকে মূলস্রোতে আনতে পারা।
হাজার আলোর ঝলকানির মাঝে যখন সবার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল করা গিয়েছে, যে, স্বাস্থ্য বাজারে কিনতে পাওয়া একখানা পণ্য মাত্র, এবং, আমাদের চয়েসের স্বাধীনতার অর্থ ঠিক কেমন দামে আমরা সেই পণ্য কিনে আনবো, কতখানি আরামের বিছানায় শুয়ে নিজের চিকিৎসা করাবো - সেইখানে স্বাস্থ্য আমার অধিকার, দেশের সব মানুষের অধিকার এই দাবী বাজারের পক্ষে বিপজ্জনক এক বিকল্পের কথা বলে, আক্ষরিক অর্থেই এক ভিন্নধারার চয়েসের কথা বলে। সবার জন্যে স্বাস্থ্যের সেই দাবী প্রান্তিক থেকে আরো প্রান্তিক হয়ে শেষমেশ মাঠের বাইরে চলে যাবে, এই তো একমাত্র স্বাভাবিক ছিল, তাই না?
কিন্তু, এইবার বিপরীতটাই ঘটল। দেশের সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা কেউই অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। পারলেন না, এমনকি, সেইসব দলও, যাঁরা কিনা প্রায় প্রত্যক্ষতই বৃহৎ পুঁজির দোসর। স্বাস্থ্যের দাবীদাওয়াগুলো একেবারে হইহই করে প্রান্তিক অবস্থান থেকে মূলস্রোতে এসে পড়ল।
সেইদিক থেকে ভাবলে, গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের অনিবার্য সাফল্যের পথে, এই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, একটি উজ্জ্বল মাইলফলক বই কি!!