তামিলনাডুতে ভোট করাতে পাঠানো হয়েছে ৪২ কোম্পানি আধাসেনা। আমাদের রাজ্যে ২৩ তারিখের তৃতীয় দফা ভোটে থাকবে ৩২৪ কোম্পানি। মনে হচ্ছে যুদ্ধ লেগেছে।
কলকাতার বাইরের সাংবাদিক বন্ধুরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, আমাদের রাজনৈতি্ক হিংসা নিয়ে। বেশ লজ্জাই লাগে। গত ১৮ তারিখে কাশ্মীর সহ সারা দেশে ৯৫ আসনে ভোট হল। কোথাও কোনও গোলমাল নেই। শুধু এখানে গুলি (পুলিসের নয়), রক্তপাত, গুলিবিদ্ধ শিশু (চোপড়া), কাঁদানে গ্যাস, লাঠি, গাড়ি ভাঙচুর, পথ-অবরোধের ঘটনা ঘটল।
৭২ সালের ভোট বাদ দিলে এই রাজ্যে নির্বাচনী হিংসা শুরু হয়েছে ১৯৯০ সাল থেকে। গায়ের জোরে ভোট করা। ৫০ হাজারে জেতার সম্ভাবনা থাকলে সেটাকে চুরি করে আড়াই লাখে নিয়ে যাওয়া। বুথ দখল, ভয় দেখানো, সাংবাদিক পেটানো, সব কিছুর শুরু ওই সময়ে।
এক সময়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানায় এসব হত। সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুকাল। শুধু বাঙালি এই রাজনৈতিক হিংসার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। সব থেকে বেশি রক্তপাত, যত দূর মনে পড়ছে, হয়েছিল ২০০৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে এবং তার আগে পরে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের সেই শুরু। যা আজ এক কদর্য পর্যায় গিয়ে পৌঁছেচে।
ভোটে স্বচ্ছতার দাবি জানিয়ে মমতা আন্দোলন শুরু করেছিলেন ১৯৯০ থেকেই। তবে তিনি ক্ষমতায় আসার পর পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙে খান খান হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, গুন্ডা এবং বিপুল অর্থ ছাড়া ভোটে লড়াই করা সম্ভব নয়। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কানে এসেছে, প্রমাণ করা সম্ভব নয়, চলতি ভোটে বিপুল টাকা ছড়িয়েছে এই রাজ্যে আসন বৃদ্ধিতে উৎসাহী একটি দল।
সারা দেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিপরীতে আমরা দেখছি, নতুন এক ঝাঁক তরুণ নেতা উঠে আসছেন। কানাহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, শহেলা রশিদ, জিগনেশ, হার্দিক। এরা কেজরিওয়াল পরবরতী প্রজন্ম। এইটুকুই যা আশার আলো। বাকিটা বড়ই অন্ধকার। কিন্তু আমাদের রাজ্যে এমন কিছু ঘটল না। উত্তর খুঁজছি, পাচ্ছি না।
আবার ভোটের কথায় ফিরি। পশ্চিমবঙ্গে দু’দফায় উত্তরবঙ্গের পাঁচ আসনে ভোট হয়ে গেল। কোন আসন কে জিতবে বা জিততে পারে সেসব নিয়ে কথা বলা অর্থহীন। কিন্তু এই পাঁচ আসনে যে ভোট হল, তাতে এটা পরিষ্কার বিজেপির ভোট এই রাজ্যে অনেকটাই বাড়তে চলেছে। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে এই রাজ্যে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ১৭ শতাংশের মতো। সেটা অনেকটাই বেড়ে যাবে এবারের ভোটে। বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, সেটা আমার মত। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন তা মনে করে না। করলে, দলটা ভোটে দাঁড়াতে পারত না। আর ভোটে দাঁড়ালে কোনও দল কম, কোনও দল বেশি ভোট পাবে, সেটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন একটা আছে। অস্বাভাবিকতা একটা আছে। যেটা কলকাতার বাইরের বন্ধুদের কাছে নিয়মিত শুনতে হচ্ছে। সেটা হল, দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক বামপন্থী পরিচিতি যে বাঙালি, সেই বাঙালি কী করে চূড়ান্ত এক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে?
উত্তর খুঁজে যাচ্ছি। এই বিষয়ে একটি মত রয়েছে। সেটা এখানে লিখছি। কিন্তু সেটাই যে ঠিক এমন দাবি করছি না। ভূপেন দত্ত, এম এন রায়রা এপার বাংলার বামপন্থী হলেও বাংলায় তাঁরা সেভাবে রাজনীতি করেননি। আবার, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিশ্বনাথ ব্যানার্জি, সুবোধ ব্যানার্জিরা এপার বাংলার নেতা হলেও বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্তৃত্ব কিন্তু মূলত ছিল ওপার বাংলার নেতাদের হাতেই। অনেক নামই রয়েছে। তার ভিতর প্রধানদের নাম করতে হলে মুজাফ্ফর আহনেদ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত,, সশস্ত্র বিপ্লবের নেতা চারু মজুমদার, কানু সান্যালদের নামই সবার আগে করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে বাম আন্দোলনের প্রসারে ওপার থেকে আসা মানুষের বিরাট ভূমিকা আছে। তারা সব খুইয়ে এসেও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার চর্চা না করে দিন বদলের স্বপ্ন দেখেছেন। অত্মত্যাগ করেছেন।
নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতা, বাম ফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনে নানা অন্যায় কাজে কি বাঙালির স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে? সেই স্বপ্নভঙ্গের শূন্যতাই কি পূরণ করছে একটা সম্পূর্ণ বিপরীত শক্তি? কারণ, এটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে বামপন্থীদের বড় অংশের ভোট সাম্প্রদায়িক শক্তির দিকেই যাচ্ছে। কী কারণে? সমস্যাকে বুঝতে হলে এর উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে।