গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের খাতায় নিজের নাম তুলবার নেশায় পেরেকের ওপর গোটা শরীরের ভর রেখে দু’পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন মানুষটি। সেই দৃশ্য দেখে আমরা যখন রোমাঞ্চিত, তখন পাশে বসা এক প্রবীণ শিক্ষক মন্তব্য করলেন “সারাজীবন ধইর্যা চেষ্টা কইর্যা যে পেরেকের উপর খাড়াইল, তাতে কী হইল!” কথাটা শুনে সেই যে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম সে অবস্থা আর কাটল না। মাঝে মাঝেই কথাগুলো মনে পড়ে আর নিজের মনে নিজের সঙ্গে তর্কাতর্কি চালিয়ে যাই।ক’দিন আগে কথাটা আবার মনে পড়ল এই শচীন তেন্ডুলকরের ভারতরত্ন খেতাব পাওয়া দেখে। মনের মধ্যে কেউ যেন বলে উঠল “সারাজীবন ধরে কাজের মধ্যে তো করল শুধু ব্যাটে বল ঠেকানো। তার জন্য খেতাব যা যা পাওয়ার তা তো পেয়েছেই, আবার ভারতরত্ন কেন বাবা !”
না, যা ভাবছেন তা নয়, এটা শচীন বনাম সৌরভ বা ক্রিকেট বনাম অন্য খেলার গল্প নয়, শচীন এখানে একটা না্ম মাত্র। এই কথাটা আগেও মনে হয়েছে, অন্য প্রসঙ্গে। যেমন ধরুন গতবছর (২০১২) আমাদের বিশ্বব্যাপী চতুর্বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার(অলিম্পিক গেমস) সময়। ছ’টা পদক পেয়ে ভারতীয় ক্রীড়াদপ্তর তাদের এযাবৎ শ্রেষ্ঠ কেরামতি দেখাল যা আবার অন্যন্য দেশের তুলনায় প্রায় আনুবীক্ষণিক! সেই নিয়ে এদলে-ওদলে বিবিধ চাপান-উতোরের মধ্যেও এই কথাগুলো আমার মনে পড়েছিল! ভাবছিলাম মূলতঃ মানুষের শারীরিক ক্ষমতার ওপরে ভিত্তি করে এই যে হরেক রকম ক্রীড়াশৈলী তৈরি হয়েছে আর তাকে কেন্দ্র করে এই যে বিশ্বজোড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন যাতে বিশ্বসুদ্ধ সব দেশের মানুষ সামিল হচ্ছেন, সেটা সত্যি সত্যি কতটা গুরুত্বপূর্ণ! আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা যে বেশির ভাগ খেলায় জিততে পারেননি তার পেছনে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, পরিশ্রম ও একাগ্রতার অভাব, পরিকাঠামোর ত্রুটি থেকে অন্তর্দেশীয় রাজনীতির প্রভাব সবকিছুই থাকতে পারে কিন্তু এই পারা-না-পারাটায় আসলে কী এসে যায়? এই যে শচীনকত্তা সারা জীবন ধরে শুধু ঠিকঠাক ব্যাট হাঁকাবার সাধনা করে গেলেন আর বেচারা উইসান বোল্ট জীবনের সব কিছু বাদ দিয়ে বছরের পর বছর লড়ে চল্লেন শুধু একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব পার হবার সময়টা কয়েক মিলিসেকেন্ড কমাতে এতে সামগ্রিকভাবে মানুষ জাতিটার কী মঙ্গল হল? এই যে সেদিন চিনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরের ছবিতে দেখলাম ফুলের মত কোমল শিশুরা তাদের শৈশবের সব কিছু স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে কড়া তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে সে তো শুধু সুদুর ভবিষ্যতে কোনোদিন এক ‘মিছিমিছি’ প্রতিযোগিতায় জেতার জন্যই! কিন্তু কিছু মানুষ খুব জোরে দৌড়োতে পারলে, খুব উঁচুতে লাফ দিতে পারলে, খুব জোরে বল পেটালে বা খুব তাড়াতাড়ি সাঁতার কাটতে পারলে সত্যি জগতের কতটা লাভ হয়, কীভাবেই বা হয় ?
লক্ষ্য করবেন আমি কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের উন্নতির কথা বলেছি, শুধু ভারত বা চীন বা পশ্চিমবাংলা বা কলকাতার উন্নতির(বা সম্মানের) কথা বলিনি। তাই দেশপ্রেম বা দেশের সম্মান জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে আপাতত ভাববেন না। প্রশ্নটা একেবারেই গোড়ায় গলদ বিষয়ক। অর্থাৎ খেলাধুলো সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে প্রতিযোগিতার ছাঁচে ফেলে ঢালাই করা আর সেই সব প্রতিযোগিতায় জেতা-হারা কে যতটা সম্ভব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একটা বিরাট সাফল্য ও সম্মান (এমনকি দেশের সেবা!) হিসেবে দেখা ও দেখানো, এইটা কতটা সঙ্গত, প্রশ্নটা সেইখানেই।
এই প্রশ্নটা কেন উঠছে সেই কথাটা এইবার বলি। অলিম্পিকের কথাই ধরা যাক প্রথমে। প্রথমতঃ, অলিম্পিক গেমস একটা অসম প্রতিযোগিতা, যেখানে শারীরিক সক্ষমতার তুলনা হয় শারীরিকভাবে অ-তুলনীয় ব্যক্তিদের মধ্যে। মানে উচ্চতায়, ওজনে, শারীরিক গঠনে, খাদ্যাভ্যাসে যারা অনেকটা আলাদা তাদের লড়তে হয় একই মাপের লক্ষ্যপূরণের জন্য, যে মাপটা অবশ্যই ‘বড়ো’দের ঠিক করে দেওয়া। এটাই কি একটা চূড়ান্ত অবিচার নয়! দ্বিতীয়তঃ, একেবারে স্বাভাবিক ও সাধারণ কিছু দক্ষতাকে প্রতিযোগিতার বিষয় হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে আর সেই দক্ষতাকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে (কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম পদ্ধতিতে) ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই চেষ্টার অংশীদার করে তোলার জন্য নানাভাবে উৎসাহিত (পড়ুন পুরস্কৃত) করতে হচ্ছে প্রতিযোগীদের ।অনুশীলনের চাপে (এবং পুরস্কারের আকর্ষণে) তাঁরা একটা অমানুষিক দক্ষতা অর্জন করছেন, যা তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্য, খ্যাতি ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিচ্ছে অথচ সেটাকে দেখানো হচ্ছে ‘দেশের সাফল্য’ হিসেবে। প্রতিযোগিদের জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে তার দাম দিতে হচ্ছে কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটা যাঁরা উপভোগ করছেন তাঁদের কাছে এই প্রতিযোগিতা আসলে কিছুটা বিনোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ দৌড়ের সময়টা একপলক কমানো বা লাফের উচ্চতা একফুট বাড়ানো একটা ব্যাক্তিগত অর্জন বা উত্তরণ যাই হোক, তাতে আপামর জনসাধারণের কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। যদি দেশীয় পর্যায়ে ভাবি, অর্থাৎ আমাদের ছেলেমেয়েরা আরো একটু জোরে দৌড়লে বা কয়েকটা লক্ষ্যভেদ করতে পারলে মানে অলিম্পিকে আরো দু-চারটে পদক পেলে বা ক্রিকেটে আর দশটা দেশকে হারিয়ে একটা কাপ জিতলে যে তথাকথিত সম্মান পাবেন, তাতে একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের জীবনযাত্রার কি কোনো উন্নতি হবে? কিচ্ছু হবে না, কারণ দেশের সম্মান নামক বায়বীয় পদার্থটি এইসব উন্নয়নের কাজে কোত্থাও লাগে না!
তার মানে ভুলেও ভাববেন না যে আমি খেলাধুলো ও শরীরচর্চাকে (এমনকি বিনোদনকেও) গুরুত্বহীন মনে করছি। সেটা একেবারেই নয়, বরং প্রতিটি মানুষের মধ্যে কিছুটা শরীরচর্চার গুরুত্ব বোঝার মত সচেতনতা আসাটাকে আমি সামাজিক অগ্রগতির একটা দিক বলেই মনে করি। সুস্থ শরীর মানুষের জীবনযাত্রার একটা প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান আর সেই কারণেই জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের একটা ধাপ হল নিয়মিত শরীরচর্চা। অনেকে সেটা খুব ভালবেসেই করেন, যেমন আমার পরিচিত একটি ছোট্ট মেয়ে রোজ দশ কিলোমিটার দৌড়োয়, যেটা না করতে পারলে নাকি তার মন ভাল থাকে না! কিন্তু সেইটুকু শরীরচর্চার জোরে তো আর বিশ্বকাপ কিম্বা অলিম্পিকের মানে পৌঁছানো যায় না। অলিম্পিকের বিজয়ী ক্রীড়ানক্ষত্ররা জীবনের অনেক কিছু বাদ দিয়ে ক্রমাগত যে অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে প্রায় যন্ত্রের সমকক্ষতায় নিয়ে যান, স্বাভাবিক জীবনে তো সেই মানের শরীরচর্চার প্রয়োজন নেই। এই মানে পৌঁছতে পারার পেছনে সেই প্রতিযোগীর অসীম পরিশ্রম, মনোযোগ, আত্মত্যাগ অনেক কিছু আছে কিন্তু এই এতসব করে শেষ পর্যন্ত তিনি যা করলেন (মানে কয়েক ফুট বেশি লাফানো বা কয়েক মিলিসেকেন্ড কম সময়ে দৌড়োনো) তা মানুষের মৌলিক উন্নয়নে কি কোথায় কাজে লাগল? যদি কিছু না-ই করে, তবে কেবল কিছুটা বিনোদনের স্বার্থে আমরা কতটা অপচয়কে ‘দরকারি’ বলে মেনে নেব আর কেনই বা নেব! বুলফাইটও তো একসময় দারুণ জানপ্রিয় বিনোদন ছিল, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আত্মরক্ষার স্বার্থে কুস্তির মারপ্যাঁচ জেনে রাখব সেটা ভালো কথা কিন্তু বিনা প্রয়োজনে দুটো লোক পরস্পরকে ঘুষোচ্ছে এই দেখে আমরা আমোদ পাবো, এটা কতটা স্বাস্থ্যকর বিনোদন, একবার ভেবে দেখব না?
এই অবধি পড়ে অনেকেই জানি মাথা নেড়ে বলবেন “এরকম ভাবলে তো সবকিছুকেই বন্ধ করে দিতে হয়...ইত্যাদি”। উত্তরে সবিনয়ে জানাই যে আজ্ঞে না মহাশয়রা, ‘সবকিছুই’ এমন নহে। মানুষের মৌলিক স্বার্থ, মৌলিক সাফল্য, মৌলিক উন্নয়ন ইত্যাদি বলেও জগতে কিছু হয়, যার পরিধিও নেহাত ছোট নয়। তবে এইসব মৌলিক উন্নয়নের অনেককিছুর গোড়ায় অবশ্যই আছে শিক্ষা। শুধু অনেক উঁচু লাফিয়ে বা অনেক জোরে দৌড়ে কি তির ছুঁড়েই কিন্তু চীনারা পৃথিবীর নজর তাদের দিকে ঘোরায় নি, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষায়-শিল্পে-বিজ্ঞানেও সমান তালে এগিয়েছে। কোনো দেশের কয়েকডজন লোক অলিম্পিকে দৌড়ে-লাফিয়ে-সাঁতরে মেডেল পেলেও কিম্বা বিশ্বকাপ জিতে এলেও দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের সমস্যার কোনো সুরাহা হয় না কিন্তু কয়েক ডজন ডাক্তার-প্রযুক্তিবিদ-বিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ বিশ্বমানের কাজ করলেও তা দেশের মানুষের মৌলিক সমস্যায় সরাসরি উপকারে আসতে পারে। তাই খেলাধুলোয় বিশ্বমানে পৌঁছোবার চেয়ে পড়াশোনায় পৌঁছোনর চেষ্টা করা এমনকি দেশের মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষার আলোয় আনাও অনেক বেশি জরুরি।
অবধারিত প্রশ্ন উঠবে যে ভারত গরীব দেশ বলে ভারতে কয়েক কোটি শিশু অনাহারে থাকে বলে কি কেউ গান গাইবে না, ছবি আঁকবে না, ছবি তৈরি করবে না, খেলাধুলো করবে না, না কি সরকার খেলাধুলো-শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করবে না? এই প্রশ্নের উত্তরে বলি ‘চর্চা’ আর ‘প্রতিযোগিতা’ এক কথা নয়, আমি বলতে চাইছি পড়াশোনা-শিল্পকলা-খেলাধুলো, সব কিছুরই চর্চা চলুক, সরকার তার উন্নতির চেষ্টা করুক কিন্তু সবকিছুকে প্রতিযোগিতার বিষয় হিসেবে দাঁড় করানো দরকারি নয়। বিশুদ্ধ বিনোদনমূলক বিষয়গুলো থাকুক ‘চর্চা’ ও ‘প্রদর্শন’ পর্যায়ে, তাকে প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাবার দরকার নেই। আর গেলেও তা হোক একেবারেই দেশীয় পর্যায়ে। প্রতিযোগিতা হোক সেই সব বিষয়ের যা মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, সেইরকম প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় খরচ করুক, যাতে আখেরে লাভ আছে। যদি ভারত ক্রিকেট না খেলেঅলিম্পিকে অংশগ্রহণ নাই নেয়, কী ক্ষতি হবে দেশের? ভেবে দেখা তো যেতে পারে! অলিম্পিকে পদক পাওয়া মানে সারা বিশ্বের নজরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা, যা হয়তো দেশীয় অর্থনীতিতেও কিছু প্রভাব ফেলে, সেসব কথা মাথায় রেখেও বলি এই পরোক্ষ স্বার্থ কি এই উন্নয়নশীল (পড়ুন গরীব) দেশের প্রত্যক্ষ উন্নয়নের সমকক্ষ হতে পারে? সেটা নিশ্চই একটা ভাবার বিষয় । কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটা ছিল অলিম্পিক গেমস আদৌ যদি নাই থাকে, জগতের কী ক্ষতি হবে?
মনে করিয়ে দিই এই লেখায় অলিম্পিক গেমস একটা উদাহরণ মাত্র, আসলে আলোচনাটা যে কোন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতারই সারবত্তা নিয়ে। আর খেলাধুলো হল এমনই একটা ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিযোগিতাই উৎকর্ষ লাভের একমাত্র পথ কারণ ওই যে বললাম অলিম্পিকের বিভিন্ন পর্যায়ে জেতার মত জায়গায় যেতে হলে একটা মানুষকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে যে আমানুষিক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, শুধুমাত্র ভালোবেসে কোনো মানুষ ততটা যেতে চাইবেন না। তার জন্য প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের টোপ দিতেই হবে আর দৈহিকভাবে শক্তিশালী প্রতিযোগী এগিয়েই থাকবেন। অর্থাৎ খেলাধুলোর জগতে সাফল্য পেতে গেলে একটা বিরাট ‘ফ্যাক্টর’ হল জন্মগত শারীরিক ক্ষমতা। এইখানে খেলাধুলো অন্যন্য বিনোদনের থেকে মানে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, সাহিত্য রচনা থেকে আলাদা হয়ে যায়। এইসব অন্যন্য ক্ষেত্রে ঘটা করে প্রতিযোগিতার আয়োজন না করলেও যারা যেটা ভালবাসে, সেটার চর্চা চালিয়ে যায়, আর সেই চর্চায় শিল্পীর সঙ্গে আত্মিক ও বৌদ্ধিক উন্নতি ঘটে রসিকেরও। শিল্পী নিজের ভেতরেই নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করে্ন, সমকালীন শিল্পী-সাহিত্যিকদের চেয়ে অন্যরকম বা আরো ভালো হবার তাগিদ অনুভব করেন, আর সেই করেই তাঁদের নাম ছড়ায় দেশে বিদেশে। তার জন্য কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার দরকার পড়ে না। ছবি দেখতে গেলে লোকে প্রদর্শনীতেই যায়, সেখান থেকেই পছন্দমত ছবি কেনে কোটি কোটি টাকা দিয়ে (হতে পারে তা প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা!)।একজন শিল্পীর গান শুনতে বা বই কিনতে গিয়ে কেউ জানতে চায় না ইনি ‘প্রথম’ কিনা ! এইসব মৌলিক বিনোদনের ক্ষেত্রে ভীমসেন যোশীকে বব ডিলান হয়ে উঠতে হয় না, এমনকি আলি আকবর খানও হতে হয় না, রবীন্দ্রনাথকেও টেনিসনের সঙ্গে লড়াই করে ‘জিততে’ হয়না। সবাই সমান গুরুত্ব পায়। অথচ দৌড়ের সব ব্যাকরণ মেনে চলেও শুধু একটা প্রতিযোগিতায় জিততে না পারায় পি টি ঊষা বা মিলখা সিং ফোর্থ ক্লাবের মেম্বারই হয়ে থাকেন, কোনোদিনই প্রদীপের আলোয় আসেন না। তাই মৌলিক প্রশ্নটা হল প্রতিযোগিতার আসর না বসালে যে গুণপনা বিশেষ উন্নয়ন হয় না সেইরকম বিষয়কে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ ? অলিম্পিক গেমস না থাকলে যদি মানুষের দৌড়ের সর্বনিম্ন সময়, লাফানোর উচ্চতা এইসব নথিতে বিশেষ বদল না হয় তো না-ই হবে; তাতে জগতের কি ক্ষতি হবে !
সত্যি বলতে কি খেলাধুলোয় এখন আর স্বতঃস্ফূর্ত পটুত্ব আর কতটুকুই বা আছে! প্রতিযোগীরা কোথায় অনুশীলন করছেন, কীরকম পরিকাঠামো পাচ্ছেন (কী কী ওষুধ খাচ্ছেন কিম্বা কার শরীরে কী কী জিন ঢোকানো হয়ছে, সে সব কথা না হয় ছেড়েই দিলাম) তার ওপরই তো নির্ভর করছে অনেক কিছু! সেই কোন আদ্যিকালে কে দুবেলা বই বগলে দশ মাইল দৌড়ে ইস্কুলে যেতে-আসতে গিয়ে ‘ন্যাচারাল রানার’ হয়ে উঠেছিলেন, সেই দিনকাল তো এখন আর নেই। অলিম্পিক গেমসের কয়েকশো সোনা-রুপো-ব্রোঞ্জ পদকের মধ্যে কয়েকটা (সর্বোচ্চ ছয় বা একটাও নয়!) পাওয়া আর অনেকগুলো না-পাওয়া দিয়ে গড়া যে ‘পার্টিসিপেশন’ তাও যদি ভারতীয় পরিকাঠামোতেই আয়ত্ত করা যেত, বুঝতাম! কিন্তু সেই তো শুরু থেকেই তাহাদের দেশে গিয়ে তাহাদের কথামতো তৈরি হওয়া... এতে ভারতীয়ত্বই বা থাকল কতটুকু? তাই প্রশ্নটা এসেই যায়, যে পারদর্শিতা সত্যিকারের কোনো কাজে লাগে না আর যা ঠিক পুরোপুরি নিজস্ব ক্ষমতার ওপর নির্ভরই করে না, তাকে এত গুরুত্ব দেবার কি কিছু আছে? তাছাড়া অলিম্পিকে সাফল্য তো ভারতের মত একটা দেশের প্রকৃত ছবিটাও তুলে ধরে না; অর্থাৎ ভারতীয়রা অলিম্পকে দু-চারটে পদক পেলেই তো ধরে নেওয়া যায় না ভারতের সাধারণ নাগরিকের গড় স্বাস্থ্য ও শরীরচর্চার মান যথেষ্ট উন্নত! বরং এই গুটিকয়েক খেলোয়াড়কে অলিম্পিকের জন্য তৈরী করতে, বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে (আর শেষ পর্যন্ত হেরে যাওয়া দেখতে) যে বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ হয় তাকে দেশের সাধারণ মানুষের, স্কুলের বাচ্চাদের দরকারি শরীরচর্চার পরিকাঠামো গঠনের কাজেই তো ব্যবহার করা যায়! তাতে বরং দেশের মানুষের কিছুটা সত্যিকারের উন্নয়ন হয়।
বিশ্বকাপ কিম্বা অলিম্পিকে পদক যদি বিজ্ঞানে নোবেলের সমতুল্য ধরা হয় (যদিও আসলে তা নয় কারণ নোবেলের জন্য কোনো অনুশীলন কেন্দ্র খোলা যায় না), তাহলে আমি বলব নোবেলের জন্য দৌড় অনেক বেশী কার্যকর (যদিও সরাসরি কোনো প্রতিযোগিতায় নোবেল পুরস্কার ঠিক করা হয় না)।কারণ অলিম্পিক পদক না পেলে গোটা বিনিয়োগটাই জলে গেল, আর পদক পেলেও সেটা দেশের লোকের কোনো কাজে লাগল না। কিন্তু নোবেল প্রাইজ শেষ পর্যন্ত পান বা না পান একজন বিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ বিশ্বমানের কাজ করলে সেই কাজটাই দেশের লোকের এবং বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে, মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে। সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। কোটি কোটি লোক পড়াশোনা করে, গুটিকয়েক লোক নোবেল পুরস্কার পায়, অনেকেই সেই মানের কাজ করে কিন্তু পুরস্কার পায় না কিন্তু তাদের কাজও প্রতিদিন মানুষের ছোটবড় ভালোমন্দের সঙ্গে জুড়ে থাকে। তাছাড়া নোবেল পুরস্কার পাবার দিকে তাকিয়ে একটা লোক পড়াশোনা বা লেখালেখি করে না, আর সেটা না পেলেই কাজ বন্ধ করে দেয় না। তেমনি বই পড়ার বা গান শোনার সময়ও এই লোক নোবেল বা গ্র্যামি পেয়েছেন কিনা তাই নিয়ে লোকে ভাবে না। সবচেয়ে বড় কথা সাহিত্যে / বিজ্ঞানে নোবেল বা গানের জগতে ‘গ্র্যামি’ পুরস্কার পাবার জন্য তো আর সরকার খরচা করে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠায় না, তাই এইসব বিষয়ের সঙ্গে ক্রীড়া প্রতিযোগিতাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না ! অলিম্পিক গেমকে বরং ‘মিস ইউনিভার্স’ বা ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতার সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে শারীরিক সৌন্দর্য্যকে প্রতিযগিতার বিষয় করে তোলা হয়; সেই সৌন্দর্য্য বিচারও হয় ‘দেখে’ নয়, ‘মেপে’ আর সেই মাপ ঠিক করে দেয় কিছু লোক নিজেদের সুবিধে মত। যতই মেয়েরা সাজগোজ করতে, সুন্দর হয়ে উঠতে ভালোবাসুক, সেই মাপে পৌঁছোতে গেলেও বিভিন্ন প্রতিযোগিকে যে অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, ওই পুরস্কারের টোপ না ঝোলালে কেউ সেই পর্যন্ত এমনি এমনি যাবেন বলে মনে হয় না। তাই আপনি যদি ‘বিউটি কন্টেস্ট’ অপছন্দ করেন, তবে আপনার মনে রাখা উচিৎ ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও খুব একটা আলাদা কিছু নয়!
তাই বলি খেলাধুলো-শরীরচর্চা চলুক (সাজগোজ-প্রসাধনও চলুক যেন সবাইকে সুন্দর দেখায়!) কিন্তু তাকে বিশ্বমানে পৌঁছে দেবার জন্য প্রাণপাত করার কিছু দরকার নেই। ওই বিশ্বমান ব্যাপারটাই একটা আপেক্ষিক ব্যাপার আর খেলাধুলোয় বিশ্বমানে পৌঁছে আপনার দেশের (বা জগতের) সত্যিকারের কিচ্ছু লাভ নেই। তৃতীয় বিশ্বের এই উন্নয়নশীল দেশ থেকে অলিম্পকে পদক পেল কিনা বা গ্র্যান্ড স্ল্যাম বা বিশ্বকাপ পেল কিনা তাই নিয়ে বেশী ব্যস্ত না হয়ে কত বেশি শিশু পড়াশোনা-খেলাধুলোর সুযোগ পায় সেইটা নিয়ে ভাবা বোধহয় অনেক বেশী দরকারি।
পুনশ্চঃ মতামতের আঙ্গিকে লেখা হলেও এই লেখা আসলে একটা চাপান-উতোর। নিজের সঙ্গে নিজের। সীমাবদ্ধ জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে একটু অন্যভাবে ভাবা, উলটে দেখা বা ভাবা প্রাকটিস করা। তাই এই লেখার যথোচিত কাটাছেঁড়া বিরুদ্ধ যুক্তির অবতারণা একান্ত প্রার্থনীয়।