রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রশ্ন দিয়েই যদি আঘাতের গুরুত্ব মাপতে হয়, তাহলে ভারতবর্ষের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাওবাদী হামলাটি হয়ে গেল গত ২৫শে মে রাতে। মাওবাদী প্রভাব “প্রশমণ”এর বিষয়ে যে দুটি নাম সর্বভারতীয় স্তরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তার একটি হল প্রাক্তন ডিজিপি বিশ্বরঞ্জন এবং আরেকটি মহেন্দ্র কর্মা। মহেন্দ্র কর্মাই এই দুটি স্তম্ভের মধ্যে বেশি জোরালো ছিলেন। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাক বা বিজেপি, মাওবাদী দমনের স্ট্র্যাটেজির প্রশ্নের মহেন্দ্র কর্মার কথাই ছিল শেষ। রইলো এই স্তম্ভের পতনের আগের পরের কিছু কথা , রইলো কিছু বিশ্লেষণ, তোলা হল কিছু প্রশ্ন।
মহেন্দ্র কর্মা ও মাওবাদী হামলাঃ
------------------------------------
মিডিয়ার নানারকম খবরের ভীড়ে কিছু ধন্দ দেখা দিয়েছে। প্রথমে সেগুলি নিয়ে দু'কথা।
প্রথমত ঃ কতজন মাওবাদী হামলা করেছিল, এই নিয়ে নানা মুনির নানা খবর। চ্যানেলগুলো প্রথমে বলল ৫০০, পরে ৮০০, তারপরে ১০০০, কেউ প্রত্যক্ষদর্শীর কথা শুনে ১৫০০, যেন প্রত্যক্ষদর্শী ওই অবস্থায় ফল ইন করিয়ে গুনেছে!
----নির্ভরযোগ্য সংখ্যাঃ ১৫০ থেকে ২০০।
সূত্রঃ ছত্তিশগড়ের বর্তমান ডিজি রামনিবাসের দেয়া স্টেটমেন্ট। বিশ্বরঞ্জন যখন ডিজি ছিলেন, মানে অপারেশন গ্রীন হান্ট যখন শুরু হয়, তখন থেকেই উনি অ্যান্টি-নক্সাল অপারেশনের চিফ। বস্তারের টেরেইন, অপারেশনের লজিস্টিক প্রবলেমগুলো ওঁর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। কাজেই অ্যামেচারদের ইম্প্রেশনিস্টিক অনুমানের চেয়ে ওঁর বক্তব্যের বুনিয়াদ বেশি নির্ভরযোগ্য।
দ্বিতীয়তঃ, বলা হচ্ছে,ওরা মহেন্দ্র কর্মাকে আলাদা করে টার্গেট করেনি। নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
----এও ভুল।
সূত্র, বিলাসপুরের পুরনো কংগ্রেসি নেতা বিবেক বাজপেয়ির সঙ্গী ডাক্তারের বয়ান। প্রত্যক্ষদর্শীরা নন্দকুমার প্যাটেলের দুটো গাড়ির পরের গাড়িতেই ছিলেন। তাঁদের কথানুযায়ীঃ সুকমা হয়ে জগদলপুর ফেরার পথে দরবা ঘাটির( ঘাটি বা ঘাট মানে পাহাড়, টিলা বা পাহাড়ি টেরেন) কাছে তিনদিকে পাহাড়ের সামনে একটি ছোট নালার ওপর পুল দিয়ে গোটা কুড়ি গাড়ির কনভয় যাওয়ার সময় দুটো গাড়ি পুল পেরোতেই ওরা পুলে ব্লাস্ট করায়। পুল ভেঙে যাওয়ায় গোটা কনভয় যেন ইঁদুর কলে আটকা পড়ে। তিনদিকের উঁচু পাহাড় থেকে ঘন্টা দুই অজস্র গুলি চলে। এদের সঙ্গের সিকিউরিটি কিছু পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু পাহাড়ের ওপর জঙ্গলের আড়াল থেকে ছুটে আসা গুলি ও গ্রেনেডের মোকাবিলায় এসব অপর্যাপ্ত ছিল। প্রায় প্রতিটি গাড়িতে গুলি লাগে। প্রচুর লোক আহত হয়। এরা সব গাড়ি থেকে নেমে মাটিতে শুয়ে পড়ে। মহেন্দ্র কর্মা জেড ক্যাটেগরির সুরক্ষা প্রাপ্ত।
এরপর গোলাগুলি বন্ধ হলে ওরা বন্দুক উঁচিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে এবং কনভয়কে ঘিরে ফেলে। যারা গাড়ির ভেতরে ছিল সবাইকে মাথার ওপরে হাত তুলে বেরিয়ে আসতে বলে। তারপর জিগ্যেস করে – তোমাদের মধ্যে মহেন্দ্র কর্মা কে? অনেকে বলে্ন জানি না। ওরা বলে সবার আইডেনটিটি কার্ড দেখা হবে, মিথ্যে বললে গুলি করা হবে। এভাবে ওরা মহেন্দ্র কর্মাকে পেয়ে যায়। উনি প্রাণভিক্ষা চান। ওরা পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয়, তারপরও মাথায় বাড়ি মারে।
তারপর বলে লখমা কায়াসী কে? নন্দকুমার প্যাটেল কোনজন?
লখামা কায়াসী গুরুতর আহত হন। আর একটু পরে নন্দকুমার প্যাটেল ও তাঁর ছেলেকে ওরা পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায়। (সকালে ঘটনাস্থল থেকে ৫০ মিটার দূরে পিতাপুত্রের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়।) এরপর ওরা সবার মোবাইল বাজেয়াপ্ত করে, আইডি কার্ড দেখে একজন স্থানীয় পুলিশ সাব ইন্স্পেক্টরকে মেরে ফেলে। ডাক্তার ও অন্যান্য সিভিলিয়ানদের জল খেতে দেয় ও ইনজেকশন লাগাতে দেয়। তারপর সবাইকে রাস্তার ওপর শুয়ে থাকতে বলে ওরা চলে যায়।
তারপর সেদিন রাত থেকে বস্তারে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে রাতের উদ্ধারকার্য স্থগিত রাখতে হয়।
তাই জগদলপুরের মহারাণী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ইন্দিরা গান্ধীর সময়ের (ইমার্জেন্সির সময়ের) দাপুটে নেতা ৮৪ বছর বয়সের বিদ্যাচরন শুক্লাকে তিনটে গুলি শরীরে ঢোকার পরও গুরগাঁও নিয়ে যেতে প্রায় ১৫ ঘন্টা দেরি হয়।
এখানে নিহত ও আহতদের সম্বন্ধে দু'চার কথা বলা দরকার।
১) মহেন্দ্র কর্মাঃ হিমাংশু কুমারের ‘তেহলকা’য় প্রকাশিত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে একটি তথ্য সামনে আসে নি। তা হল ওই বুদ্ধিমান বই পড়তে আগ্রহী দন্তেওয়াড়ার আদিবাসী নেতাটি প্রথমে সিপিআইয়ের সদস্য ছিলেন এবং সিপিআইয়ের টিকিটেই দন্তেওয়াড়ার সাংসদ হন। তারপরে নির্দলীয়, পরে কংগ্রেসী ও রমন সিং সরকারের সহযোগী হন। সলওয়া জুড়ুমের ব্যাপারে উনি ওঁর পার্টি লাইনের বাইরে গিয়ে অগ্রণী হয়েছিলেন। কারণ হিমাংশু বলেছেন। ২০০৫ এ ওঁর ভাই নিহত হয়, গর নভেম্বরে উনি অল্পের জন্যে বেঁচে যান।
২) বিদ্যাচরণ শুক্লাঃ মধ্যপ্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী রবিশংকর শুক্লার (রায়পুর বুড়াপারা নিবাসী) দুই ছেলে। শ্যামাচরণ কয়েকবার মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। বিদ্যাচরণ দিল্লির রাজনীতি। ইন্দিরাজির জরুরি অবস্থার দিনগুলিতে উনি তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু সঞ্জয় গান্ধী, হরিয়ানার বংশীলাল ও বিদ্যাচরণ সেই সময় অতীব ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন। তখন প্রেসের ওপর হামলা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে তালা মারা, ইত্যাদি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক কাঠামো নষ্ট করার অভিযোগ ওঁর বিরুদ্ধে ছিল। রাজীবের সময় ওঁর ডানা ছাঁটায় জনমোর্চা গঠন করেন, পরে আবার কংগ্রেসে যোগ দেন। সোনিয়া জমানায় রোম্যান ক্যাথলিক অজিত যোগীর উত্থানে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় কংগ্রেসে ব্রাহ্মণবাদের অবসান হয়। তখন বিদ্যাচরণ সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন, বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপির টিকিটে অজিত যোগীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁর যা তা রকমের পরাজয় হয়। অতি কষ্টে গতবছর হাইকম্যান্ডকে নিমরাজি করিয়ে কংগ্রেসে ফিরেছেন। কিন্তু ক্ষমতাহীন।তাই আজ ৮৪ বছর বয়সে নিজের আনুগত্য প্রমাণ করতে এই কনভয়ে শামিল হতে হয়েছিল। কিন্তু গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁর হাল আশংকাজনক।
৩) নন্দকুমার প্যাটেলঃ রায়গড়ের এই কংগ্রেস নেতা বর্তমানে প্রদেশ কংগ্রেসের অধ্যক্ষ ছিলেন। আগে কংগ্রেস সরকারে উনি হোম মিনিস্টারও ছিলেন। সলওয়া জুড়ুমের প্রচারে মহেন্দ্র কর্মার পরই ওঁর নাম। তাই হিট লিস্টে ছিলেন মনে হয়।
এছাড়া নিহত কংগ্রেসি নেতাদের মধ্যে বিধায়ক উদয় মুদালিয়ার, দন্তেওয়াড়ার বিধায়ক গোপীচান্দ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
অতঃপর ?
অজিত যোগী কি এখন নিষ্কণ্টক নেতা ? না। আজকে কংগ্রেস সংগঠনে ও হাইকম্যান্ডের কাছে অজিত যোগীর ওজন খুবই কম। হাইকম্যান্ডের চোখে প্রদেশ কংগ্রেসীদের খেয়োখেয়ির জন্যে এই ভদ্রলোকের গুটবাজি ও পরিবারবাদ বিশেষ দায়ী। তাই কাল যখন উনি প্রথমেই রাষ্ট্রপতির শাসন দাবি করে স্টেটমেন্ট দিলেন, তখন দিল্লি থেকে এসে রাহুল গান্ধী উল্টোসুরে প্রায় রমন সিংয়ের মত বল্লেন – এখন গভীর শোকের সময়, রাজনীতি করার না। সঙ্গে সঙ্গে অজিতও সুর পাল্টে ফেল্লেন।
* * *
গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও কিছু প্রশ্ন ঃ
-----------------------------------
এখন প্রায় প্রতিদিনই দক্ষিন বস্তারে আধা মিলিটারি অপারেশন চলছে। এদিকের পত্রিকায় বেরয় না। যখন শুধু কোন আর্মি হেলিকপ্টারে গুলি লাগে বা পাইলটকে ফেলে অন্যেরা পালায় তখন বাকি দেশ জানতে পারে। গত দশদিনের মধ্যে মাওবাদী এনকাউন্টারের নামে একরাতে যে বেশ কিছু মহিলা ও শিশু মারা যায় তাতে রমণ সিং সরকার বেশ অস্বস্তিতে পড়ে তদন্ত ও প্রতি নিহতের পরিবারে দু'লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা বলছে।
৭-২ঃ
গত বছর কিডন্যাপড- কলেক্টরদের ছেড়ে দেবার সময় ডঃ ব্রহ্মদত্ত ও আই এ এস নির্মলা বুচের মধ্যস্থতায় যে এগ্রিমেন্ট হয় তাতে বিনাবিচারে একবছরের বেশি বন্দী ১০০০ আদিবাসীদের কেস গুদ্রুত রিভিউ করে নির্দোষদের ছেড়ে দেবার কথা হয়েছিল। ডকুমেন্ট তৈরি হয়েছিল।
তারপর বর্তমান সরকার কিস্যু করল না। জাস্ট ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিল।
৭-৩ঃ
যাঁরা গণতন্ত্র ও সংবিধানের কথা বলছেন তাঁরা একবার সোনী সোরি ও হিমাংশুকুমারের কথা মনে করুন।
হিমাংশুকুমার মাওবাদী ন'ন, ওদের সমর্থকও ন'ন। বরং গান্ধীবাদী পদ্ধতিতে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম চালিয়ে ইউনিসেফ ও সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রোজেক্টে যুক্ত ছিলেন। ওঁকে মাওবাদীরাও কিডন্যাপ করেছিল। এ পর্য্যন্ত সবই ঠিক চলছিল। কিন্তু যেই উনি সলওয়া জুড়ুমের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন তখন ওঁর ১৭ বছরের পুরনো আশ্রম সরকারী তন্ত্রের আদেশে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হল, ওঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা হল। বস্তার থেকে পালাতে বাধ্য করা হল। সেই হাল ডক্টর বিনায়ক সেনেরও।
সোনী সোরি নিয়ে এই মায়া পাতায় অনেক তথ্য আগেই দেয়া হয়েছে। সংক্ষেপে, ওঁর জননাঙ্গে পাথরকুচি ভরে হাতে পায়ে শেকল বেঁধে যে বীরপুরুষ টর্চার করল ( এগুলি সরকারি মেডিক্যাল রিপোর্টে প্রমাণিত) তাকে রাষ্ট্রপতি পদক দেয়া হল। আদালত কিছুই করতে পারল না।
৮) আমরা হিংসার বিরুদ্ধে গনতন্ত্রের পক্ষে।
কিন্তু আমরা সাদ্দামের অত্যাচার, বিন লাদেনের আমেরিকায় হামলা ইত্যাদি নিয়ে যতটা নিন্দে করি ততটা ইরাকে মিথ্যে কথা বলে একতরফা যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রচুর সিভিলিয়ানকে মারা, সাদ্দামকে ইঁদুরমারা করা বা দিনের পর দিন তালিবান নিধনের নামে ড্রোন হামলা করে হাসপাতাল স্কুল গুঁড়িয়ে দেয়া আমেরিকান রাশ্ট্রশক্তিকে করি না।কারণ আমরা একপক্ষকে ipso facto বর্বর ও অন্য পক্ষকে সভ্য মনে করি। সহজে সাদ্দাম-আফগানদের সঙ্গে নিজেদের রিলেট করি না, কম্ফর্টেবল মনে করি না। অথচ, আমেরিকার সংস্কৃতির সঙ্গে affinity অনুভব করি। এটাই সত্যি।এটাই ভারতের রাষ্ট্রশক্তি ও আদিবাসী মাওবাদীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতা ও ক্ষমতাহীনের হিংসাকে আমরা এভাবেই দেখব, কারণ সহজে ক্ষমতার সাথে থাকতেই কমফর্টেবল বোধ করি যে! তাই মাও দের হাতে নিহত আদিবাসীদের তুলনায় রাষ্ট্রশক্তির হাতে নিহত আদিবাসীর সংখ্যা যে কতগুণ বেশি তা দেখার চেষ্টা করি না।
আমি এখানে যা লিখছি তা আদৌ মাওবাদী রণদামামার ‘জাস্টিফিকেশন’ নয়, বরং যা ঘটছে, তা কেন ঘটছে, কেন এমনটাই ঘটছে, অমনটা নয় — সেটা ‘এক্সপ্লেন’ করার সামান্য চেষ্টা। যদিও আমি সবজান্তা বা শেষ কথা নই। অর্থাৎ আমি যদি বলি যে অমুক যে অকালে জিভের ক্যান্সারে মারা গেল তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, অত সিগ্রেট খেলে অন্যরকম না হওয়াটাই স্বাভাবিক, — তখন আমি আসলে বলতে চাই যে সিগ্রেটের নেশার বিরুদ্ধে কিছু না করে শুধু কেমোথেরাপি/ সার্জারি/রেডিয়েশন দিয়ে জিভের ক্যান্সারের রোগিকে বাঁচানো বা ক্যান্সার নির্মূল করা, কোনটাই সম্ভব নয়।
তাই মাওবাদী এজেন্ডার বিরুদ্ধে বললেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থক, আত্মসুখী চাটুকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বলতে গেলেই necessarily মাওবাদী এজেন্ডার সমর্থক — এই “আমরা-ওরা”র বাইরে নিশ্চয়ই কোন স্পেস আছে, সেটা খুঁজছি।
এই বিষয়ে আলোচনায় সাধারণভাবে দুটো বিষয় উঠে আসে।
এক, মাওবাদীরা কেন গণতন্ত্র ও সংবিধানের মা-মাসি করছে? যতই দমন শোষণ পীড়ন হোক, প্রতিবাদের রাস্তাও তো এই ব্যবস্থায় আছে, সেগুলো ব্যবহার না করে এ কি তান্ত্রিক বামাচারী কমিউনিস্ট আন্দোলন? কেন নেপালের মাওবাদীদের মত ইলেকশন লড়ে না? এগুলো আসলে কিছু নৈরাজ্যবাদী-টেররিস্ট আউটফিট, বিপ্লব-টিপ্লব ফক্কিকারী। এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই গ্রুপ।
দুই, উন্নয়ন কেন হচ্ছে না? মাওবাদী আন্দোলনে রাস্তাঘাট-স্কুল-হাসপাতাল সব বন্ধ? নাকি আগেই কিছু ছিল না? আর কোন উন্নয়ন? সত্যি কি মেইনস্ট্রিম ভারতের মত উন্নয়ন ওখানে না হলেই ভালো হবে?
এককথায় এ নিয়ে কিছু বলায় অতি-সরলীকরণের ঝোঁক এড়ানো কঠিন। তবু সামান্য চেষ্টা করব।
________________________________________
মাওবাদীরা ওদের পার্টি প্রোগ্রাম অনুযায়ী ভারত সরকারের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ওরা এই সংবিধান-ভিত্তিক সংসদ, সরকার, আদালত, পুলিশ-জেল সবকিছুকে একপেশে ভাবে শোষক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত মনে করে। তাই তারা চায় এই ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে, যেখানে ওদের তৈরি সংবিধান-ভিত্তিক সংসদ, সরকার, আদালত, পুলিশ-জেল থাকবে। কিন্তু সেগুলো, ওদের দাবী অনুযায়ী, জনগণের বৃহত্তর অংশের স্বার্থে মুষ্টিমেয় শোষকের দমনে ব্যবহৃত হবে।
সিপিএম কিছুদিন আগেও পার্টি প্রোগ্রামে ভারত সরকারকে(তখন কংগ্রেস) “ল্যান্ডলর্ড-বুর্জোয়া গভর্নমেন্ট, হেডেড বাই বিগ বুর্জোয়াজী” বলে বিশেষিত করে কৃষিবিপ্লবের মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করার কথা বলত। কিন্তু বলত বিপ্লবের সময় আসেনি, এখন কাজ জনগণের মনে এই ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার সঞ্চার করা। জনগণের ক্রমশঃ মোহমুক্তি ঘটিয়ে বিপ্লবের জন্যে তৈরি করা।
এখন সেই মোহমুক্তি ঘটাতে গিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে হল।
কেন? আমাদের সংসদ কি মার্ক্স-বর্ণিত বা লেনিনের ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতন’এ বর্ণিত ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ নয়? অন্যকিছু? আসলে কৌশলগত দিক থেকে পার্লামেন্টে গেলে জনগণের মধ্যে প্রচারের বিশেষ সুবিধে হয়। তাও হল। কিন্তু সংসদে গিয়ে সাংসদ হলে সেই বুর্জোয়া সংবিধানের নামে শপথ নিতে হয়। — ওটুকু ফর্মালিটি। আমরা তো কমনওয়েলথ গেমস্ থেকে বেরিয়ে আসিনি। তার মানে কি আমরা আজো বৃটিশ মহারাণীর বশংবদ প্রজা? রামোঃ! ওসব যেমন ফর্মালিটি, এগুলোও তেমনি। নির্বাচনে অংশ নেব। কিন্তু সরকারে যাব না। শুধু রাজ্য সরকারে যাব। কেন্দ্রে বাইরে থেকে সমর্থন দেব। এখন রাজ্যে-কেন্দ্রে যেখানে হোক সরকারে মন্ত্রী হলে এই সংবিধান রক্ষার শপথ নিতে হয়। এই সংবিধান মেনে আইন প্রণয়ন করতে হয়। সংশোধন করতে হয়।
তা সিপিএমও ওসব করল। লক্ষ্যণীয়, পঞ্চায়েত নির্বাচন আইন প্রণয়নে রাজ্যের অধিকার বাড়িয়ে ওদের পাশ করা আইনটাই কিভাবে ব্যুমেরাং হল।
সে যাকগে, এ তো সেই সন্নিসির কৌপীন ইঁদুর কাটায় বেড়াল পোষার থেকে গেরস্থালির গল্প। আজকে সিপিএম এর একমাত্র রণনৈতিক উদ্দেশ্য রাজ্যে রাজ্যে সরকার গঠন ও তৃতীয় শক্তির কোয়ালিশনে লালকিলা পর লাল নিশান!
ফিরে আসি মাওদের কথায়। বন্দী অবস্থায় শত্রুর থেকে আইনানুগ ব্যবহার চাওয়া, (সে আইন শত্রুর তৈরি হলেও) কি খুব অনৈতিক? তাহলে তো বৃটিশ জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দীদের ওদের খাবার মুখেই তোলা উচিত নয়।
আর কৌশলগত দিক দিয়ে দেখলে জনযুদ্ধে গেরিলারা মাও-বর্ণিত জলের মধ্যে মাছের মত থাকে যাতে ওদের আলাদা করে চেনা না যায়। তাই ধরা পড়লে সে অবশ্যই একজন সাধারণ নাগরিকের মত বর্তমান সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী বিচার চাইবে। সেভাবে একস্পোজ করতে পারবে যে এই ব্যবস্থায় আইন আসলে সবার জন্যে সমান নয়। কুঘো বা শ্রীনি’র জন্যে একরকম, সোনি সোরির জন্যে আরেক রকম।
সংবিধান, গণতন্ত্র ও মাওবাদঃ
১) একটি বক্তব্য এখানে উঠে এসেছে যে সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্পেস দিচ্ছে না, লেজিটিমেট আন্দোলনেও মিথ্যে অভিযোগ তুলে হামলা করছে, কেস দিচ্ছে, জেলে পুরছে। যেমন, গান্ধীবাদী হিমাংশুকুমারের ওপর আক্রমণ। যেমন মুম্বাই থেকে যাওয়া প্রেস ও সমাজকর্মীদের প্রেস কনফারেন্স ভেঙে দিয়ে ওদেরই জেলে পুরে দেয়া। যেমন বিনায়ক সেনকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে লাইফ টার্ম দেওয়া। মাওবাদী হামলার ঠিক দিন দশেক আগে সিআরপি রাত্তিরে পুকুরে পায়খানা করতে যাওয়া আটজন মেয়ে ও বাচ্চাদের গুলি করে মেরে দিয়ে এনকাউন্টারের গল্প চালিয়েছে। এটা চটপট ধরা পড়ে যাওয়ায় রমন সিং সরকারও ধামাচাপা দিতে এনকোয়ারি ঘোষণা করে মৃতদের পরিবারকে বোধহয় দু'লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
--এই অবস্থায় হাতিয়ার তোলা ছাড়া কী বিকল্প আছে? অর্থাৎ সিস্টেমের মধ্যে যদি গ্রিভান্স রিড্রেসাল ফোরাম না থাকে তাহলে অবদমিত উষ্মা, রাগ, ক্ষোভ প্রকাশের কোন পথ খুঁজে নেবে?
২) কিন্তু, যদি ওপরের এই বক্তব্যের কথার ভেতরে যাই তবে দেখব এর পেছনে প্রিসামশন হল — বস্তারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে বা ছিল। সাময়িক ভাবে প্রশাসন বা বর্তমান সরকারের ভুল মাইন্ডসেটের ফলে সেসব লঙ্ঘিত হচ্ছে। (যেমন সিপিআই এম নেতারা বর্তমান বঙ্গের ব্যাপারে অভিযোগ করছেন।)
তাহলে কিন্তু হাতিয়ার তোলা একমাত্র বিকল্প হয় না। বরং ধৈর্য্য ধরে শিকড় গেড়ে জন আন্দোলন গড়ার পথ ভাবা উচিত।
৩) আমার বক্তব্য হল দক্ষিণ বস্তারের বস্তুস্থিতিটাই আলাদা। আমার কথা বিশ্বাস না করে বরং গতকালকের জি-টিভিতে আলোচনায় ওদের দুই রিপোর্টারদের অবুঝমাড় ও মাওবাদী এলাকা ভ্রমণের পর ওদের বক্তব্য শুনে নিন। ওরা চর্মচক্ষে দেখে অনুভব করল যে সভ্য ভারত জানেই না এমন প্রাগৈতিহাসিক সমাজ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোহীন বিস্তীর্ণ এলাকা আজও ভারতের কোথাও টিকে আছে। তাই ওদের বক্তব্য এটা আদৌ রঘুডাকাত গোছের আইন-শৃংখলাজনিত সমস্যা নয়। বরং উন্নয়নের সমস্যা।
আমি ওদের কোট-আনকোট না করে নিজের অনুভবের কথাই বলছি। কিন্তু শব্দ আলাদা হলেও আমাদের বক্তব্য মূলতঃ এক, মিলিয়ে নেবেন।
দক্ষিণ বস্তারে দন্তেওয়াড়ার পাহাড়ের পেছনে অবুঝমাড় এলাকায় জনগোষ্ঠির সামনে ভারত সরকারের গণতন্ত্রের কী চেহারা?
একশ মাইলের মধ্যে বিজলী-পানীয় জল-স্কুল-ডাকঘর-হাসপাতাল-আদালত-পুলিশের দেখা নেই। আছে বাবা আদমের জমানার কিছু হাট-বাজার। সেখানে কেনাবেচা করতে হলে সকাল থেকে পায়ে হেঁটে চলতে হবে আর রাত্তিরে ফিরতে হবে। অধিকাংশ লোকের কাছে জমির কোন টাইটেল ডীড বা পাট্টা নেই। পুরুষানুক্রমে চাষ করে আসছে। কিন্তু সামান্য চুরির দায়ে (সত্যি বা মিথ্যে) বন্দী হলেও বিনাবিচারে বছরের পর বছর আটকে থাকতে হবে। কারণ একশ গাঁয়ের মধ্যে জমির পর্চি আছে শুধু একজন মালগুজারের কাছে। তাহলে ওর জামিন হবে কী করে? আর ওর কেস লড়তে হলে বাড়ির লোকজনদের কাজকর্ম ছেড়ে দু-তিন দিন লাগাতে হবে শুধু এক দিনের হিয়ারিংয়ের জন্যে, উকিলের খরচা বাদই দিলাম। কৃষি বলতে বৃষ্টিনির্ভর একফসল। অপুষ্টি স্বাভাবিক। কন্দ-মূল খাওয়া হয় কিছু মাস। সালপি নামের শালগাছের দিশি মদ খেয়ে শীত বা পেটের জ্বালা ভুলে থাকতে হয়। তাই ওদের কাছে ভারত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলতে গাঁয়ের মোড়ল বা কোতোয়াল।
কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ ওরা টের পায় ভারত সরকার বলে কিছু আছে। রেভিনিউ সিস্টেম চালু হয়েছে কয়েক দশক, আদিবাসী জানে না। নতুন রেকর্ডে ওদের নাম নেই। শহরের ঠিকেদার, কেন্দুপাতার ফড়ে সবার নাম আছে। আদিবাসীদের দাবিতে ভূমি সংস্কারের কমিটি তৈরি হল। সেই কমিতির অঙ্গুঠাছাপ সদস্য দেখল তার বাপ-পিতেমোর জঙ্গল কেটে আবাদ করা জমিন থেকে সে উচ্ছেদ হবে, কেন সেই জমিতে তার অধিকার ভূমি রেকর্ডে নেই।
আগে ১৯৬৮-৭০ অব্দি ছিল বস্তারের রাজবংশের শাসন। দন্তেশ্বরী দেবী ওদের কুলদেবী। দশেরার দিন রাজা (ভঞ্জদেওর বংশের) দরবার লাগিয়ে দশ গ্রামের মোড়লদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন। ১৯৬৪তে গণতান্ত্রিক ভারতের পুলিশ জগদলপুরে মহারাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেওকে ওঁর প্রাসাদের বারান্দায় গুলি করে মারল, মারা পড়ল কিছু সশস্ত্র আদিবাসী। তারপর থেকে রাজপরিবারের কোন ক্ষমতা নেই। আদিবাসীদের দৈনন্দিন সুবিধে-অসুবিধে শুনবে কে?
যে গণতন্ত্রের চেহারার সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার অস্তিত্ব এত দশকের পরেও অবুঝমাড়ে কোথায় আছে? যা নেই বা যে ওদের জমি কেড়ে নেয় তার জন্যে ওদের কোন মায়ামমতা বা বিশ্বাস থাকবে কেন?
৪) একটি মত হলঃ মাওবাদীদের কোন জনসমর্থন নেই। ওদের বন্দুকের ভয়ে নিরীহ আদিবাসীরা যোগ দিয়েছে। এই মতের সমর্থকদের আমি বলব দন্তেওয়াড়ায় জেলা সদরে সুপারিন্ডেন্ট অফ পুলিসের অফিসের কাছে যান। দেখবেন, কালেক্টর, এস পি ও জজের বাংলোর চারদিকে গোল গোল করে কাঁটাতারের ঘেরা। আর দেখবেন পুলিশের তরফ থেকে প্রচারিত উঁচু বিশাল এক হোর্ডিং —
এটি ভার্টিকালি দুভাগে বিভক্ত।
কেন গেছ নক্সালদের (মাওবাদী বলা নেই) সঙ্গে? ওরা তোমাদের কী দিয়েছে? মৃত্যু, অশিক্ষা,অনাহার, আতংক? (প্রত্যেকটার সঙ্গে সুন্দর আইকন)? | সরকার তোমাদের কী দিচ্ছে জেনে নাওঃ আহার, শিক্ষা, চিকিৎসা, রোজগার।(সঙ্গে আইকন)। |
বস্তার মা ডাকছে রে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আয়! |
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
৬) আমার উপসংহার। বস্তারের মাওবাদীদের যা শক্তি, ছত্তিশগড়ের বিশাল সমতলে তাই ওদের দুর্বলতা। সেখানে কৃষক সমাজ আদৌ এই ব্যবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী নয়। সমস্ত লুট, ভ্রষ্টাচার, ডেলিভারি সিস্টেমে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনটাকা কিলো দরে পাঁচজনের পরিবার পিছু মাসে ৩৫ কিলো চাল দেয়া হচ্ছে। সেচ ও পরিবহনের উন্নতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক পরিযোজনার টাকায় চুরিটুরি করেও অজ পাড়াগাঁয়ে পাকা রাস্তা হয়েছে। সর্বশিক্ষা অভিযানের ফলে গাঁয়ে গাঁয়ে স্কুল খুলছে। মধ্য প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে ছত্তিশগড় হওয়ার পর বিজলী সারপ্লাস। একবাতি কনেকশনের লাভ নিয়ে ঝোপড়পট্টিতেও বিজলী বালব জ্বলছে। ধানের দু’ফসল হচ্ছে অনেক জায়গায়।
তাই বস্তারের আদিবাসী আধারিত মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ছত্তিশগড়ের সমতলের কৃষকের কোন সমর্থন নেই। তায় ভাষাও আলাদা। ওদের হল্বী, গোন্ডি, সাদরি উপভাষা মেলে তেলুগুর সঙ্গে খানিকটা। আর ছত্তিশগড়ী হল হিন্দির উপভাষা।
এ কারণেই মাওবাদীরা ওখানে মিলিটারি অ্যাকশনকে যতই উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাক এ আন্দোলন অবুঝমাড়-বিজাপুর-দন্তেওয়াড়ার বাইরে ব্যাপক সমতলে ছড়াতে পারবে না। কাজেই এর ভবিষ্যত নিয়ে আমার কোন আশা নেই।
উন্নয়নের ছবিঃ মাওবাদীঃ মডেল ইত্যাদি
১) একটি মত হলঃ বস্তারের আদিবাসীরা অরণ্যের সন্তান, প্রকৃতির কোলে বড় হয়, প্রকৃতিকে মায়ের মত মনে করে। কাজেই সভ্যতার বিষ নিয়ে ওদের মধ্যে যাওয়া উচিত নয়।
— শুনতে বেশ রোম্যান্টিক লাগে, মানবিক মনে হয়। ভালো লাগে। কিন্তু এর পেছনে কি সেই “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ের”র প্রতিধ্বনি নেই? অর্থাৎ আগামী বহুদশক ধরে ওরা সেই আদিম শিকারী ও সাবসিস্টেন্স এগ্রিকালচারের স্তরে থেকে যাবে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বড় প্রতিষ্ঠানে পড়াবো, বিদেশ পাঠাবো। আর কখনো সখনো ট্যুরিস্ট হিসেবে ওদের ডেরায় গিয়ে বড়বড় চোখ করে ওদের দেখবো, নাচগান শুনবো, — যেমন করে ছুটির দিনে চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখি?
২) কিন্তু তাহলে কি উন্নয়নের নামে বেলাডিলার লৌহ আকর সস্তায় জাপানে পাঠাবো? টাটা-এসারের মত কোম্পানীদের বনজ-খনিজ সম্পদ লুটতে সাহায্য করব? ক্ষতিপূরণ না দিয়ে (জমির রেকর্ড নেই যে) উচ্ছেদ করব আদিবাসীদের? খেদিয়ে দেব ইন্দ্রাবতী-শংখিনী-ডংকিনী নদীগুলির ওপারে? ভয়াল অরণ্যে? আমাদের ছেলেপুলেরা কোলকাতা থেকে গিয়ে চাকরি পাবে তাই ওখানে মল-ডিস্কো-ডিপিএস স্কুল, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল খুলব? ওদের সালপি খাওয়া বা ঘরে বানানো প্রতিবন্ধিত করব যাতে সবাই মদ খেতে হলে কিংফিশারের মালিকের তৈরি মালটাই খায়? আর কয়েক দশক বাদে মুছে যাবে একটি জনগোষ্ঠী? মুছে যাবে ওদের নাচ গান লোককথাশুদ্ধু? মুছে যাবে আমাদের বাইরে থেকে এসে গেড়ে বসা শহুরে লোকজনের ঘনবসতি আর জনসংখ্যার চাপে? মুছে যাবে অপুষ্টি, অসুখ-বিসুখ আর আমাদের দেওয়া যৌনরোগের প্রকোপে? আমরা চোখ বুজে থাকবো কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দালাল বা আমলা বা তেন্দুপাতার ব্যবসায়ীরা বস্তারের সেগুন-শাল-মেহগনি-শিরীষের জঙ্গল কেটে সাফ করে দিচ্ছে? অ্যামাজনের পর এমন রেইনফরেস্ট আর কোথায় আছে? ক’টি আছে আমি জানি না।
৩) আমার মতঃ
ওপরের দুটো মডেলই কিন্তু দুই বিপরীত মেরুর। এর মাঝখানে কোন তৃতীয় বিকল্প সম্ভব কি না নিশ্চিত নই। কিন্তু মানুষ ভাবছে। তার আগে দেখা যাক মাওবাদীরা কী ভাবছেন। কী ভাবছেন আমি জানিনা। কিন্তু সেই লালগড়ের সময় এই মায়াপাতাতেই কেউ, নেট থেকে ওদের পার্টি প্রোগ্রামের লিংক দিয়েছিল। সেটা পড়ে দেখেছিলাম ওঁরা ক্ষমতায় এলে বিদেশি পুঁজি বাজেয়াপ্ত করে ইন্ডাস্ট্রিয়ালি স্ট্রং স্বাধীন ভারত গড়ার কথা বলছেন। গোড়াতেই হোঁচট খেলাম। কাঁচামালের জন্যে খনিজ সম্পদ বা অরণ্য সম্পদের দোহন না করে কী করে ইন্ডাস্ট্রিয়ালি স্ট্রং স্টেট গড়ে উঠবে? তার মানে আজ বিদ্বজনদের কথায় ওঁরা বস্তারের অরণ্য ও খনিজ সম্পদের রক্ষক, কিন্তু ক্ষমতায় এলে সম্ভবতঃ একই পথে হাঁটবেন। হয়ত সুচিন্তিত কোন বিকল্প মডেলের সন্ধান এখনো পান নি, খালি বিদেশি পুঁজির লুঠ ঠেকাবেন এইটুকুই ভালো লাগল। কিন্তু প্রোগ্রামটায় যেন বড্ড বেশি ১৯৪৯য়ের মাও-চৌদের বিকাশচিন্তার ছাপ। প্রোগ্রাম পড়লে মনে হয় না ২০১০ এ দাঁড়িয়ে আছি। যেন ইতিহাসের পাতা ওল্টাচ্ছি। খুব ভরসা পেলাম না। ওদের রাজ্যে থাকতে পারব বলে মনে হয় না। হয় তো আমাকে অনেক কিছু হারাতে হবে। আমি যে কিছুই হারাতে চাই না।
অতঃ কিম?
৪) আসুন, আপনাদের একটা গল্প বলি। গরীবঘর থেকে একজন নিজের মেধা ও পরিশ্রমের জোরে আই এ এস হলেন। নাম রাজাগোপাল নাইডু। বাবা পুলিশ কনস্টেবল। রায়পুরের জিলা পঞ্চায়েতের সি ই ও থাকাকালীন উনি আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডের সদস্য ডায়রেক্টর ছিলেন। সেই সূত্রে সামান্য আলাপ।
কয়েক বছর পরে দেখি উনি খবরের হেডলাইনে।
বস্তারের কালেক্টর হয়ে উনি জগদলপুরে গিয়ে দেখলেন যে অরণ্যসম্পদের লুঠ চলছে, এতে শহরের ব্যবসায়ী, ঠিকেদার, রাজনৈতিক নেতা সবাই জড়িত। উনি মোটা টাকার ঘুষের প্রলোভন এড়িয়ে লড়াই শুরু করলেন, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে একা কুম্ভ লড়াই করলেন। কিছুদিন বাদেই উনি বুঝতে পারলেন যে ওনার বস্ কমিশনার অফ বস্তার এই চক্রের একজন হোতা। ধমকি, আক্রমণ সব তুচ্ছ করে উনি শেষে নিজের বসের বিরুদ্ধেই এফ আই আর করলেন। এমন কাণ্ড কেউ আগে করেনি।
ফল?
কমিশনারকে সাময়িক ট্রান্সফার করা হল। কিন্তু কিছুদিন বাদে নাইডুর বিরুদ্ধেই অন্য তদন্ত শুরু করা হল। শেষে উনি চাকরি ছেড়ে অন্য পেশা ( সম্ভবতঃ কোন এনজিও) নিলেন। আর তথ্যপ্রমাণ একত্র করে বই লিখলেন হিন্দিতে “বস্তার কী মালিক-মকবুজা কাণ্ড্”, আমার কাছে এককপি আছে।
বলতে চাইছি যে আজাদীর এতগুলো বছরে বস্তারে শুধু লুঠ হয়েছে। সেই ৫০ এর দশকে নারায়ণ সান্যালের লেখা “দন্ডকশবরী” দুই ভাগ দেখুন। উনি ওখানে সেই যুগে সিপিডব্লুডির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। জঙ্গলমহলেও একই অবস্থা। অমর্ত্য সেন এর প্রতীচী ট্রাস্টের কুমার রাণার রিপোর্ট দেখুন। মাও আন্দোলনের স্পিন অফ হল সরকারের থেকে কিছু করার আশ্বাস, কিছু প্রোজেক্ট, কিছু চুরি ও কিছু সামান্য হওয়া।
সমস্যা হল দু’জায়গাতেই ওখানকার মানুষদের উন্নয়নের অংশীদার না করা। সরকার প্রাথমিক ভাবে ওদের হাসপাতাল, স্কুল, পানীয় জল দিক। রাস্তাঘাট বানিয়ে যাতায়াত সহজ সুগম করুক। বিভিন্ন যোজনার কথা বোঝাক, কিন্তু কোথায় কী হবে সেটা ধীরে ধীরে ওদের নিয়ে ওদের ইচ্ছে অনুযায়ী হতে দেয়া হোক। আজ আমাদের ওখানে গেলে হোটেল বা আইনক্স বা মল চাই বলে গাছপালা কেটে সেই সব বানানো বন্ধ হোক।
উদাহরণ হিসেবে বলছি, আন্দামানে গিয়ে দেখেছিলাম জারোয়াদের জন্যে পি ডব্লু ডি থেকে ফ্রি তে থাকার ঘর বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু “অকৃতজ্ঞ” জারোয়ারা ওখানে থাকে না, থাকে ওদের পুরনো মাটির বাড়িতে, সরকারি আবাসে যায় পায়খানা করতে।
কারণ, সরকারি আমলারা খেয়াল করেন নি যে বিষুবরেখার কাছে হওয়ার কারণে জারোয়াদের মাটির বাড়ি বেশি আরামদায়ক। সরকারি টিনের ছাদের বাড়ি ভীষণ গরম। আদিবাসী এলাকায় এধরণের মিসম্যাচ মডেল অপকার বেশি করবে। ধৈর্য্য ধরে ওদের স্বার্থে ওদের নিয়ে উন্নয়নের মডেল বানাতে হবে, আমাদের স্বার্থে নয় – এটুকু বুঝলাম।