এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পায়ের তলায় সর্ষে - বাংলাদেশ

    স্বাতী রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ৩৩৩১ বার পঠিত
  • #জলছবি-বাংলাদেশ
    ( সবার যেমন কিছু স্বপ্নের ভ্রমণ থাকে, আমারটা ছিল বাংলাদেশ। বাবা-পিতামো’র চরণধুলি যেখানে পড়েছিল সেই দেশ দেখব। এই ছিল স্বপ্ন। চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা। তবুও। গিয়েওছিলাম। অসম্ভব আনন্দ হয়েছিল। আজ প্রায় এক দশক পরে দেখছি স্মৃতিটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু এই স্মৃতিটা এমন, যাকে আমি একদম ফিকে হয়ে যেতে দিতে চাই না। সেই ধরে রাখার তাগিদে এই লেখা। তবে হয়তো একটু ভালবাসায় বায়াসড, কখনো বা পলিটিক্যালি ভুল লেখা হবে। যারা পড়বেন তাঁরা নিজ গুণে মার্জনা করবেন এই আশা। )

    দিন - ১

    বাংলাদেশ গিয়েছিলাম বহুবছর আগে, ২০০৯ সালে। প্রচুর চাপ তখন জীবনে, ছেলে মোটে তিন বছরের, মেয়ের কিশোরীবেলা - একটু বেশিই মনোযোগ লাগে, অফিসেও অনেক কাজ - তবু খালি মনে হচ্ছিল সময় চলে যাচ্ছে , আরও বেশী দেরী হওয়ার আগেই যেতে হবে। দরকারটা একেবারে নিজের মনের - বাবার হাত ধরে একবার পিতৃ-পুরুষের ভিটেয় গিয়ে দাঁড়াব, মিলিয়ে নেব ঠাকুমার কাছে শুনে শুনে মনের মধ্যে তৈরি হওয়া ছবিগুলোকে। বাবা তখন মাঝে মাঝেই একটু হাসপাতালে কাটিয়ে আসছেন, তাই তাড়াটা বাড়ছিল। কিন্তু সবার সময় হতে হতে সেই মে মাস। মনের মধ্যে খুঁতখুঁতুনি - ওই ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে মে মাসের গরমে অতখানি ঘোরা - যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে তো আমার গর্দান চলে যাবে। তার উপর আমার ছেলে সেই বয়সেই তাসের দেশের লোকেদের মত নিয়ম-মতে চলে এবং একটি পরিপূর্ণ জ্ঞানের সাগর। দুপুরে ভাতের বদলে শুকনো খাবার দিলে বলে, " এখন কি কেউ সন্দেশ খায়? আমি ভাত খাবো - এখন ভাত খাবার সময়।" এই সব পাবলিক নিয়ে আদৌ বেড়ান যাবে তো! তবু ওই যে, মনের মধ্যে টান পড়েছে। তাই সব খুঁতখঁতুনি চাপা দিয়ে, জয় দুর্গা বলে রওনা দেওয়া হল। সব ব্যবস্থাপনা জেনর্ড ট্রাভেলস এর গৌতম বাবুর, দায়িত্বে রাজীব শিকদার। প্রসঙ্গত বলি, বেড়ানর ব্যবস্থা আমি নিজের হাতে করতে বড্ড ভালোবাসি - প্রতিটা হোটেলের বুকিং, প্রতিটা ট্রেনের টিকিট আমার মনে একটা এক্সট্রা রোমাঞ্চ জাগায়। আজ নাহয় কয়েকটা মাঊস-ক্লিকেই কাজ হয়। যে আমলে সেটা সত্যি ছিল না, চিঠি লিখে, মানিঅর্ডার করে হোটেল বুকিং করতে হত সে আমলেও আমার কাজটা করতে ভারি ভালো লাগত। আমার মতে , সেটাও বেড়ানোর অংশ। আর অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে ভরসাও হয় না মোটেই। এবারও প্রথমে জেনর্ডের দ্বারস্থ হয়েছিলাম শুধু ভিসা করিয়ে দেওয়ার জন্য । কিন্তু না, ওঁরা করলে সব ব্যবস্থাই করবেন, না হলে কিচ্ছু নয়। অগত্যা ... তবে রাজীবের মত একটি চৌখস ছেলের হাতে দায়িত্ব দিয়ে ভরসা করা যায়, সেটা অচিরেই বুঝলাম। গন্তব্য "দ্যাশের বাড়ি " আর সেই সঙ্গে এটা- ওটা - সেটা।

    সেদিন কলকাতায় ভোট – ভোরবেলায় ফ্লাইট। গাড়ী পাওয়ার সমস্যা হতে পারত – কিন্তু হল না। গৌতম বাবু নিজের গাড়ী পাঠিয়ে দিলেন এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসার জন্য। বাড়ী থেকে এয়ারপোর্ট আসতে যে সময় লাগল, কলকাতা এয়ারপোর্ট ছেড়ে ঢাকা পৌঁছাতে বোধহয় তার থেকে কম সময় লাগল। ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ হল। পাসপোর্ট দেখিয়ে বিদেশে গেছি যে ক’বার সব ক’বার-ই অফিসের কাজে। ল্যাপটপ নিয়ে ল্যাগর-ব্যাগর করতে করতে, আমার টুটাফাটা ইংরাজীতে কোন মতে কাজ সারতে সারতে। এই প্রথম এয়ারপোর্টে নেমে বাংলায় কিচির মিচির শুনে প্রাণটা ত’র হয়ে গেল। এতই আনন্দ হল যে খেয়ালই হল না যে ল্যাপটপের ব্যাগ না থাকলে কি হবে, কাঁধে রয়েছে পেল্লায় ছেলের সরঞ্জামে ভরা ব্যাগ। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখি সব সাইনবোর্ড বাংলায়। ব্যস ঢাকার সঙ্গে লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়ে গেল। আমার মাল্টি-লিঙ্গুয়াল শহর শুধু বাংলায় দোকানের সাইনবোর্ড দেখার চোখের আরামটুকু আমাকে দেয় না। জানি, জানি, যাই চকচক করে তাই সোনার নয় – আমার ঢাকা সুন্দরীর হরেক রকম অব্যবস্থা, তার যানজট, তার আজকের পলিটিক্যাল করাপশন, তার আজকের ধর্মান্ধতা – সবই জানা। আর বর্ডারের এপার ওপার মানুষগুলো তো সব একই – কাজেই আমার শহর কলকাতার থেকে খুব আলাদা হওয়ার কোন কারণ-ও নেই। তবু প্রেম জাগিল পরাণে। কিন্তু প্রেম শিকেয় তুলে এখন ঢাকা ছেড়ে বেরোতে হবে। আমাদের আজকের গন্তব্য নওগাঁ। সেখানে বাবার মামাবাড়িতে আমাদের আজকের আদর-বাস। পদ্মার উপর বিশাল ব্রিজ পেরিয়ে, পথে হরেক রকম মিষ্টি-টিস্টি খেয়ে দেয়ে প্রায় মাঝ দুপুরে যখন তিরতিরে বইতে থাকে আত্রাই নদীর ধারে আধা-ঘুমন্ত শহরটিতে ঢুকলাম, দেশের বাড়ির ভালোবাসা জড়িয়ে ধরল আমাদের।

    এই পুরো সিরিজের বেশীর ভাগ ছবিই তুলেছেন সুদীপকল্যাণ দে। আমি ধার নিয়েছি মাত্র। এখানে রইল কিছু ছবি যেগুলো প্রায় সবাই চেনেন, জানেন। তবু দ্যাশের বলে আদেখলাপণা যায় না ।

    প্রথম পদ্মা চোখে দেখা


    পাতা উনুন


    jযে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে সেই ঢেঁকি :D


    ঢেউটিনের বাড়ি


    দিন- ২

    গত সন্ধ্যে থেকেই শুধু গল্প আর গল্প। নিতান্ত-ই ব্যক্তিগত স্মৃতি দিয়ে ভরে তুলতে চাই না – তবু একটা কথা বলতে পারি। লোকে বলে বোনেতে বোনেতে দেখা হলে গল্প ফুরায় না – ভাইতে ভাইতে দেখা হলেও কম কিছু হয় না। রাতেই ঘুরে এসেছি আমার বোনের বাড়ি। সে একটি ঝমকঝামক বিউটি পার্লার চালায়। স্বামী-পুত্র নিয়ে ভর-ভরন্ত সংসার সামলেও। মেয়েদের স্বয়ং-সম্পূর্ণা রূপটি দেখতে বড় ভালো লাগে – তাই মনটা ভরে গেল। হরেক রকম গল্পের মাঝখানে আমার মাথায় ঘুরছে আমার দিদার কথা। সম্পন্ন ব্যবসায়ীর ঘরে জন্ম। দিদার বাবা আবার লক্ষ্মীর সন্ধানে ঘর ছেড়েছিলেন। ফরিদপুরের খোলাবেড়িয়া থেকে এসে ঠাঁই পেতেছিলেন পাড়-নওগাঁতে। দিদা বাপের আদুরে মেয়ে ছিলেন। সুন্দরী। সাত বছরে বিয়ে। বিয়ের দিনও নাকি গাছ-কোমর বেঁধে গাছে চড়েছিলেন। বিয়ে হয়ে চলে গেলেন আবার সেই ফরিদপুরে। নিজেদের আদি বাড়ী খোলাবেড়িয়া থেকে মাইলখানেক দূরের খানখানানপুর রেল স্টেশন ( এরই কাছে গোয়ালন্দ – রাজবাড়ী ) , তারপর বসন্তপুর, তারপরেই শিবরামপুর। দেশের বাড়ির কাছে, তবু বাবা-মার থেকে কত দূরে। শিবরামপুর থেকে অম্বিকাপুর হয়ে ফরিদপুর – ট্রেন ছুটবে পোড়াদা হয়ে সান্তাহার – সেখান থেকে টমটমে চেপে তবে আসবে বাপের বাড়ির দ্যাশ। কি মনে হত পরে, যখন বাপের বাড়ি আসতেন? পুতুল খেলার বাক্স টেনে নামাতে ইচ্ছে হত কখনো? আনাচে কানাচে জন্মে থাকা গাছগুলোর গায়ে গায়ে খুঁজতেন ফেলে যাওয়া শৈশবের গন্ধ? নাকি দীর্ঘকালের শ্বশুরালয়বাস তাঁকে শৈশব ভুলিয়ে দিয়েছিল? কি জানি!

    ভোরবেলা থেকেই শুনছি সবাই বেড়াতে বেরোচ্ছে, আমিও এক ফাঁকে সঙ্গ নিলাম তাঁদের। ব্রীজ পেরিয়ে নাদুস-নাদুস থ্যাবড়া-নাকী হেলেদুলে-হাঁটা হাঁসের দলের পিছন পিছন চলে গেলাম কাকার দোকানে। বড় বাসনের দোকান। ভাই সামলাচ্ছে সেই দোকান। ছোট্ট কুট্টি ভাইটাকে ছোটবেলায় দেখে কখনো মনেই মনে হয় নি সে একটা ভারিক্কি গোছের ব্যবসায়ী হয়ে উঠবে। বেশ মজাই লাগল।

    আর কত ধরণের বাসন! মানুষের কত কিছুই না লাগে কাজে। তবে কাকা বাসনের কারবারের সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্যই সেদিন একটা নতুন অভিজ্ঞতা হল। হাতে হাতে বাসন বানান দেখলাম। হাপরের আগুনে ধাতুকে নরম করে তারপর সেই পাতকে একটি উঁচু বেদীর ঊপর রেখে তার চারপাশে অনেক জন মিলে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে এক দুরবোধ্য সুরের সঙ্গে তালে তালে হাতুড়ির ঘা মারছেন, আর ধাতুর তালটি ধীরে ধীরে বাসনের চেহারা নিচ্ছে। নিখুঁত টিমওয়ার্ক। পুরো পর্বটির ছন্দে বিভোর হয়ে থাকতে পারলেই ভালো – যদি না চোখে ভাসে মানুষগুলোর দড়ি পাকানো ক্ষয়া চেহারা। আসলে শারীরিক শ্রমের জগতের বেশী সংখ্যার মানুষের অল্প আয় আর যন্ত্র দুনিয়ার কম মানুষের হাতে সামান্য বেশী পয়সা কোনটা যে উপমহাদেশের জন্য ভালো সেটা আজও বুঝে উঠি নি। শুধু এইটুকু বুঝি যে তলার ধাপে থাকা মানুষদের এক্সপ্লয়টেসনটা গ্যারান্টিড।

    বাসন তৈরি হচ্ছে





    কাকা-কাকীমার আদর খেতে খেতে যাওয়ার ইচ্ছে আর ছিল না – তবু যেতে হবে। গোনা-গুনতি দিন হাতে – তাই সময় সবচেয়ে মুল্যবান এই ক’দিন। তাই ঢিমা তালে তৈরি হতে হতে একসময় এসে গেল বিদায়ের ক্ষণ। ঢেঁকি-ঘর, আমগাছ সব নিয়ে পাড়-নওগাঁ পরে রইল নিজের কোণটিতে। আমরা চলতে শুরু করলাম। আমাদের আজকের পথ অতি দীর্ঘ। পাহাড়পুর যাব প্রথমে। সোমপুর মহাবিহার। সেই কোন কালে ইস্কুলে ইতিহাসের ক্লাসে পালরাজাদের কীর্তিকলাপ পড়েছি। সেই পালরাজ গোপালের ছেলে ধর্মপাল তৈরি করান এই বৌদ্ধ বিহার। আটশ সালে নাগাদ – মানে ১১০০ বছর আগে। ধর্মপালের পরে দেবপাল, আরও পরের পাল রাজাদের দাক্ষিণ্যও পেয়েছিল এই মহাবিহার। বিশাল, ছড়ানো জায়গা নিয়ে তৈরি – অনেক ঘর, চৈত্য আর অনেক বাড়ী। এখন ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট এটা - খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। একটা ছোট খাট মিউজিয়াম-ও আছে। বিক্রমশীলা বা নালন্দা বা ওদন্তপুর বিহার দেখিনি এখনো - সোমপুর বিহার-ই প্রথম দেখলাম। আমার চিরকালই ক্যাম্পাস ইউনিভার্সিটির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। যাদবপুরে যদিও বা আমরা ছোট্ট একটা ক্যাম্পাস পেয়েছি, অনেকের তো সেটুকুও জোটে না। তার উপর আবার অতীশ দীপঙ্করের মতন মহামহিমকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া! তাই আমাদের সেই সব পূর্বপুরুষদের প্রতি বেশ খানিকটা ঈর্ষাই হল। তবে মে মাসের গরমে ওই বিশাল ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান মোটেই বিশেষ সুখকর স্মৃতি নয়। ছাতা, টুপি, সানগ্লাস সব অস্ত্র সাজিয়েও কিছুতেই সূর্যদেবকে কাবু করা যাচ্ছে না। তাই দেখার শেষপর্ব সারা হল খুব তাড়াতাড়ি। তবু তারই মাঝে সুন্দর টেরাকোটার প্যানেলগুলো চোখ এড়াল না। বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মত সূক্ষ্ম কাজ নয়, তবু বেশ সুন্দর। তবে একটা দুঃখ হল যে – এত বড় একটা ঐতিহাসিক জায়গা – তবু কোন গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা নেই! অথচ একজন সুকথক গাইড যে কিভাবে ইতিহাসকে চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলতে পারেন! আর বাংলাদেশে মনে হয় হরিহর রায়’দের অভাব হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের জায়গায় জায়গায় যেন ইতিহাস বই পাতা খুলে বসে আছে – একটু সরকারী তরফে সচেতনতা থাকলে হয়তো নাগরিক জীবনে ইতিহাস জ্ঞান বাড়ত একটু। আর নিরপেক্ষ ইতিহাসের ধারণা যে কোন মানুষকে সমৃদ্ধতর করে বলে আমার ধারণা।

    সোমপুর বিহার



    তার টেরাকোটার প্যানেলঃ



    পরের গন্তব্য ইতিহাসের আরও গহনে। খৃষ্টজন্মেরও তিনশ বছর আগের এক জায়গা। পৌণ্ড্রবর্ধন। নামটা চেনা চেনা লাগছে তো – হ্যাঁ মহাভারতেও আছে এই জায়গার কথা। এরই আজকের নাম মহাস্থানগড়। করতোয়া নদীর ধারে। প্রায় দুই কিলো মিটার করে লম্বায়, চওড়ায় জায়গা জুড়ে এক বিশাল আরকিওলজিক্যাল সাইট। একেবারে খাঁটি অনার্য রাজ্য ছিল আদতে। তারপর মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন সব রাজারা এসেছেন , গেছেন – জায়গাটার রমরমা ছিল অনেক অনেক দিন ধরে। এই জায়গাটা নিয়ে একটা মজার গল্প পড়েছিলাম। এখানে নাকি শাহ বলখি মাহিসওয়ার বলে একজন ফকির মাছের পিঠে চেপে এসে হাজির হন। পারো’র টাইগার’স নেস্টে ও তো গুরু পদ্মসম্ভব বাঘিনীর পিঠে চেপে এসে নেমেছিলেন। মানুষ চিরকালই গুরুবাদে বিশ্বাসী আর সেই গুরুরাই বেশি বিখ্যাত যাদের নিয়ে এই ধরণের অবাস্তব গল্প চলে বাজারে। সে যাক গে। এদিকে ফকিরের সঙ্গে রাজার যুদ্ধ বাধে। এদিকে মহাস্থানগড়ে একটি কুয়ো ছিল যে কুয়োর জলে স্নান করলে মৃত সৈনিকরাও প্রাণ ফিরে পেত। তাই রাজাকে কিছুতেই হারাতে পারছিল না ফকির। শেষে এক চিলকে দিয়ে একটুকরো গরুর মাংস সেই কুয়োর জলে ফেলানো হয়। ব্যস খেল খতম। রাজার জারিজুরি শেষ। তখন রাজার সেনাপতি ভয় পেয়ে বিশাল দলবল নিয়ে ফকিরের দলে যোগ দেন। রাজা আত্মহত্যা করেন। ফকিরের একটি মাজারও আছে এখানেই। গল্পটা পড়েই মনে হয়েছিল, কি নিদারুণ ভাবে একটা মানবিক বিশ্বাসঘাতকতার গল্পকে চাপা দেওয়া হল একটি অবাস্তবতা আর ধর্মীয় বিভেদের জুজু দিয়ে। এই সব হিজিবিজি গল্প শুনেই আর বিশেষ আগ্রহ ছিল না জায়গাটার প্রতি। তার উপর ড্রাইভার জানালেন এখানেও কোন গাইড নেই। যা দেখার নিজেদের খুঁজে পেতে দেখতে হবে। এ দিকে তার আগে চড়া রোদে সোমপুর বিহারে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে সবাই আধা-বিধ্বস্ত। কারোরই আর বিশেষ দেখার গরজ নেই। অগত্যা বললে বিশ্বাস করবেন না, আমাকে অন্য কেউ বললে আমি হাঁ করে ঘণ্টা দুয়েক তার দিকে তাকিয়েই থাকতাম, আমরা মুল জায়গাটার বাইরে নেমে ঠিক দু মিনিট এপাশ ওপাশ দেখে আবার গাড়ীতে উঠে পড়লাম। একটা তিনশ বিসির জায়গা! আর কোনদিন আসা হবে না তা খুব ভালো করেই জানি। সামনে দিয়ে ফিরে চলে এলাম। কি আর করা! প্রথম দিনেই রোদ লেগে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুরো ঘোরাটাই মাটি। বিপদের সময় অর্ধেক ত্যাগ করারই নিয়ম। অগত্যা।

    মহাস্থানগড়



    চলো, চলো এগিয়ে চলো। যেতে হবে অনেক দূরে। সেই নাটোর হয়ে কুষ্টিয়া। আমাদের যিনি ড্রাইভার ছিলেন, কি লজ্জা, কি লজ্জা – তাঁর নামটা ভুলে গেছি। অসম্ভব সজ্জন, ভদ্র একজন মানুষ। এবং তুমুল ভাবে সার্ভিস ওরিয়েন্টেড। তাঁকে চুপি চুপি বলে রেখেছিলাম, নাটোরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দাঁড়াতে। সেই মানুষটি যাকে দিয়ে আমার নিজের আনন্দে বাংলা কবিতা পড়ার শুরু, এবং শেষ – একবার তাঁকে মনে করব নাটোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বেরোতেই দেরী হয়েছে। পাহাড়পুর দেখতেও অনেকটা সময় লেগেছে। মহাস্থানগড় থেকে বেরন’র পরে যখন আমরা নাটোরের পথে আধাআধি যেতে না যেতেই সূর্যিমামা অস্তাচলে যেতে বসলেন। ছড়ানো মাঠের মধ্যে দিয়ে রাস্তা , কোথাও কোথাও গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে পথ ঢেকেছে – কখন যেন সেই ছায়া কালো হয়ে চরাচর ঢেকে দিল। অনেক অনেক পথের পরে, দূরে যখন নাটোরের আবছা আলো দেখা দিল, গাড়ীর মধ্যে তাকিয়ে দেখালাম – বাচ্চা বুড়ো সবাই আধো ঘুম, আধো জাগরণে। গাড়ী আর থামাতে বারণ করলাম – বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে অন্ধকারে বনলতা সেনদের মুখোমুখি বসার সুযোগ কি আর সবাই পায়! এমনি ভাবেই অন্ধকারে পেরিয়ে গেল ঈশ্বরদী – পদ্মার উপরের ব্রীজ পেরিয়ে চলে এলাম দক্ষিণবঙ্গে।

    ব্যবস্থাপকরা চেয়েছিলেন আমরা নাটোরেই রাত্রিবাস করি। সেখানে ব্যবস্থাপত্র ভালো। আমিই ভেটো দিই। আমাদের এ দিনের যাত্রাপথ যদি দীর্ঘ হয়, পরের দিনেরটিও তুল্যমূল্য। তাই চেয়েছিলাম যতটা এগিয়ে থাকা যায়। কুষ্টিয়াতেই থাকতে চাই। বলেছিলাম, পরিস্কার টয়লেট-সহ সেফ ঘর পেলেই হবে। অনেক গড়িমসি করে সেই মত ব্যবস্থাই হয়েছিল। প্রায় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ এসে পৌঁছালাম সেই রাত- কাটানোর আস্তানাটিতে। এসেই চক্ষু চড়ক গাছ। ঠিক বাজারের মাঝখানের হোটেলটি চার তলায়। এবং তাতে লিফট নেই। আমাদের সঙ্গে ছোট বড় মাঝারি হরেক সাইজের হরেক ধরণের লাগেজ – দলে তিন থেকে তিয়াত্তর বছরের লোক – সবাই হাঁ। তবে দায়ে পড়লে মানুষ কি না করে! আমরাও নিজেরা উঠলাম, সব মালপত্র কিছু আমরা তুললাম, কিছু হোটেলের লোক তুলল।

    কিন্তু শেষ হাসি কে হাসল বলুন দেখি? ঘরে সব মালপত্র পৌঁছানর পরে হোটেলের একজন কি একটা দাবী করতে আমি তো তাকে তেড়ে বকুনি দিচ্ছি, এ আবার কি রকম হোটেল- চারতলার উপরে অথচ লিফট নেই – এ রকম ভাবে ব্যবসা হয় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ তিনিও সমান তেড়ে উঠে বললেন , এই সব ‘নরমাল’ শহরে আবার লিফট থাকে নাকি! একি ঢাকা নাকি! আমি তাতেও তেড়ে বললাম, ঢাকা কি এবনরমাল শহর নাকি? ততক্ষণে সবাই হেসে উঠেছে। হাসির মধ্যে দিয়েই তফাতটা মাথায় ঢুকল, নিজের-চোখে-জগত-দেখে-অভ্যস্ত আর চাইলেই-পেতে-থাকা আমাদের মত বড় শহরের মানুষেরা যে তফাতগুলো অনেক সময় প্রায় ধরতেই পারি না।

    দিন ৩

    আমার মায়ের বাপের বাড়ী

    বাপের বাড়ীর দ্যাশের গল্প যতটা শুনে শুনে বড় হয়েছি, মায়ের বাপের বাড়ীর গল্প কিন্তু একেবারেই শুনি নি। আমার মা শৈশবে মাতৃহারা। সেটা সে আমলে খুব একটা কিছু আশ্চর্য ঘটনা অবশ্যই নয়। যেটা আশ্চর্য সেটা হল আমার দিদিমা, যিনি পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, কম বেশী পনের বছর সংসার করেছেন একটি মানুষের সঙ্গে, তাঁর একটা ছবি, একটা চিহ্ন নেই কোথাও। মানুষটা খুব সহজেই একেবারে ‘নেই’ হয়ে যেতেন, যদি না তাঁর সন্তানেরা থাকতেন। আমার মা তাঁর চেহারাটুকুও মনে করতে পারেন না। কম-কথার মানুষ দাদুর কাছেও কখনো শুনি নি দিদার কথা। এই নিঃসীম ফাঁকের সামনে দঁড়িয়ে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কেমন ছিলেন তিনি? দাদুর ছিল বদলীর চাকরী। মায়ের ছোটবেলা কেটেছে এ পার বাংলায়। মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখে এসেছি সে সব জায়গা। যে ভাড়াবাড়ীতে মা থেকেছেন, মা’র স্কুল, মায়ের কলেজ - মা'র কিশোরীবেলা কল্পনা করতে খুব আটকায় না।আমার মায়েরও অবশ্য বছর কুড়ি বয়সের আগের কোন ফটো নেই – তবে মায়ের স্কুলের প্রাইজ পাওয়া অনেক বই আছে। সেগুলোতে হাত বুলিয়ে আমি মায়ের ছোটবেলার মা’কে খুঁজে পাই। কিন্তু দিদিমাকে ধরতে পারি না মোটেই। ’৪৭ সালে সরকারী চাকুরে দাদু দেশভাগের সময় ইন্ডিয়ার অপসন দেন। সেই মত এসে পড়েন এ দেশে। মায়ের তখন বছর তিনেক বয়েস। এদেশের মাটিতে দিদিমা বেশীদিন নিঃশ্বাস নেন নি। তাই জানতাম দিদিমাকে ধরতে গেলে যেতে হবে, সেই গ্রামটিতে যেখানে তিনি সংসার পেতেছিলেন। তাঁর বাপের বাড়ীও কাছে পিঠে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে।

    সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। আজকের যাত্রা আমাদের উজানে। স্মৃতি, রোমাঞ্চ আর বাস্তবের এক বিন্দুতে মেলার দিন। প্রথম গন্তব্য অবশ্য যাওয়ার পথে পড়া ছেঁঊরিয়ায় লালন ফকিরের মাজার। মূল গেট দিয়ে ঢুকেই সামনে সাদা মাজার এবং মুল দরজার উপরে লেখা লালনের বাণী, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” – একদম ঠিক তারে সুরটি বেঁধে দেয়। মাজারের জায়গাটি বিরাট বড়। সামনের চত্ত্বরে বিশিষ্ট ভক্তদের কবর। লালনের সম্বন্ধে কিছুই আর নতুন করে বলার নেই। আমরা যখন মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেদিন কোথা থেকে যেন হালকা বাঊল গানের সুর ভেসে আসছিল। শুনেছি বাউল গান গভীর দ্যোতনার অধিকারী- পরতে পরতে তার ভিন্ন ভিন্ন মানে সঠিক অধিকারীর কাছে উদ্ভাসিত হয় - বাঊলগানের সংকেতবাক্যের গহীন অর্থ বোঝার ক্ষমতা আমার নেই, অধিকারও নেই। আপাতদৃষ্টিতে যেটুকু কানে ভাসে সেটুকুই বুঝি। কিন্তু সুরের সরলতা এবং গায়কের আর্তি দুই-ই মনে এক ঘোর লাগায়। সেদিন ওইখানে দাঁড়িয়ে তো আরোই ভাল লাগছিল। পাশেই আছে লালন আক্যাডেমি। আর মুল গেটের বাইরে ছোট খাটো কয়েকটি দোকান। এখানেই হয় লালন-মেলা। বাউল-গানের আসর বসে তখন। আমাদের বাউল গান অবশ্য থাকবে ইউ টিউবে; ঠিক যেমন লালনশাহী দর্শন বেঁচে থাকবে এই মাজার ছাড়িয়ে সারা বাংলার মরমিয়া মানুষের মধ্যে। (১)

    বাউল গানের সুর কানে নিয়ে পৌছালাম শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। বেশ সুন্দর সবুজ ঘাসের কার্পেটের মধ্যে একটি ছিমছাম বাড়ী। বিশেষত আর্কিটেকচারটি মনোরম। এখন ওখানে সে আমলের জিনিসপত্র আর রবীন্দ্রনাথের ছবি দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। তবে সত্যি কথা বলতে যে কোন সৃষ্টিশীল মানুষ আমার চোখে বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে – তাঁর পায়ে দেবার খড়ম বা জলের গ্লাস এই সব দেখে আমি বিশেষ আনন্দ পাই না। বাড়ীর বারান্দায় একটি নৌকা রাখা রয়েছে – কেউ একজন বললেন সেটি নিয়ে নাকী রবীন্দ্রনাথ পদ্মায় ভেসে বেড়াতেন। বরং আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। শুনেছি আমার দাদু নাকি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় এই শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে এসে ছিলেন। তখনকার দিনে এটাই দস্তুর ছিল। গ্রামের ছেলেরা শহরে বা অন্যত্র গেলে স্থানীয় সম্পন্ন লোকেরা তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। শুনেছি দাদু দরকারে কলকাতায় এলে থাকতেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত মোহিনী মিলের মালিকদের বাড়িতে। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই - কালের নিয়মে রীতিটি হারিয়ে গেছে।

    কুঠিবাড়ীর সামনে অনেক দোকান – একটা মেলাই বলা চলে। সেখানে হরেক জিনিসের সম্ভার। ভারী শখ হল একটা খেলনা একতারা কেনার। কিন্ত আমার বিশ্ববুড়ো ছেলের মোটেই এই সব কাজে কোন সায় নেই। অগত্যা হাতের খেলনা নামিয়ে রেখে গাড়ীতে চাপলাম। বুকের মধ্যে একটু চাপা উত্তেজনা। এবার যাব আমার মায়ের বাপের বাড়ী। উপজেলা কুমারখালি, গ্রাম তেবাড়িয়া।

    যাব তো বটে। কিন্তু সম্বল শুধু নামটুকু। মায়ের কিচ্ছু মনে নেই। তবু ভরসা দিলেন আমাদের ড্রাইভার, বললেন একটু তো খুঁজে দেখি। খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম কুমারখালি রেলওয়ে স্টেশন। তখন মার মুখে একটু হাসি ফুটল – বোধহয় স্মৃতিতে কোথাও ঘাই মারল। তারপর অবশ্য আর বিশেষ অসুবিধা হল না – দাদুরা ভারতে চলে এলেও দাদুর এক জ্ঞাতি রয়ে গিয়েছিলেন ভিটেতে। তাঁদের নাম করে খুঁজতে সন্ধান মিলল। গড়গড়িয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। আমাদের ড্রাইভার-সাহেবের মুখে ফুটল চওড়া হাসি - যাক মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে হয় নি অন্তত। মায়ের দিকে তাকালাম - ’৪৭ সাল থেকে ২০০৯ – বাষট্টি বছরের ব্যবধান ঘুচে গেল কি?

    কি আশ্চর্য! দাদুর নাম বলাতে একবারেই চিনলেন বাড়ীর সবাই। এখন যিনি গৃহকর্তা, তিনি ডিস্পেন্সারীতে ছিলেন। তাঁকে খবর পাঠান হল। তিনি এসে পৌঁছানর আগেই অবশ্য খবর পেয়ে এলেন আরেকজন প্রতিবেশিনী, তিনি আমার দিদিমার সই ছিলেন। অনেক বয়েস তাঁর, স্মৃতিও যে খুব অটুট এমন না। আমার অজস্র প্রশ্নের খুব কম অংশেরই উত্তর মিলল। তবু তিনি আমার দিদিমার একটি আবছা বিবরণ দিলেন। এই প্রথম চোখের সামনে দেখতে পেলাম অনেক বেলা করে একটি তরুণী বধু এক গোছা বাসন নিয়ে পুকুরপাড়ে চললেন – মাথায় একরাশ চুলের বোঝা, ফর্সা মুখটাতে সিঁদুরের টিপটা ঘামে লেপ্টে গেছে – একটু পরেই ছবিটা আবছা হয়ে গেল, কল্পনার দৌড় এইটুকুই - তবু এটুকুও যে পেলাম এই ঢের। ইতিহাস তো আর কখনোই ঘরের বৌদের হিসেব রাখে না।

    কিন্তু তার থেকেও অবাক কান্ড হল আমি দাদুকে কিছুতেই এই টলটলে সবুজ, মায়ায় জড়ানো গ্রামের মাটিতে কল্পনা করতে পারলাম না। কৈশোরে অনাথ, সম্পূর্ণ নিজের জেদে পড়াশোনা চালিয়ে জীবনের প্রথমে মিলিটারীতে চাকরী করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, প্রখর ধীমান, সংস্কৃতজ্ঞ, তীব্র আত্মসম্মানবোধযুক্ত চির-ঋজু দাদু, যিনি জীবনের শেষ দিন অবধি নিজ সিদ্ধান্তে অচল ছিলেন, তিনি তাঁর সর্ব তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা নিয়ে কিছুতেই এই শ্যামল ছায়ার মাঝখানটিতে ধরা দেবেন না বলে মনস্থ করলেন। দাদু দিদার যৌথ ছবিটি তাই অধরাই থেকে গেল।

    (উল্লেখ্য ১- এক বন্ধুর এটা পড়ে বক্তব্য ছিল যে লালনশাহী কথাটির প্রয়োগ অশুদ্ধ। এবং তাঁর মতে লালন শাহ নামটিও অশুদ্ধ, এটি লালন সাঁই। সমস্যা হল আমি বহু জায়গায় এমনকি লালন শাহের মাজারেও তাঁর নামটি লালন শাহ দেখেছি। সাঁই তো তিনি বটেই, সাঁই অর্থে গুরু, মুর্শিদ। শুধু লালন নন, ফকির-বাউলরা তাঁদের গুরুকে অনেক সময়ই সাঁই বলতেন বলে জানি। এবং লালন শাহ’র নামের থেকে লালনশাহী কয়েনেজটাও আমার এমন কিছু অশুদ্ধ মনে হয় নি। সম্রাট অর্থে শাহ ধরলেও যে তিনি ছিলেন হৃদয়-সম্রাট। )

    লালন ফকিরের মাজার


    শিলাইদহের কুঠিবাড়ী

    ও আমার দেশের মাটি

    If winter comes, can spring be far behind? অবশ্যই না। আজ আমার শিকড় খোঁজার দিন। এক তীর্থদর্শন হল, এবার চলো আরেকখানে। মায়ের বাড়ী থেকে ঘন্টা আড়াই-এর পথ। কুমারখালি থেকে যখন বেরোলাম, তখনই প্রায় সাড়ে এগারটা, বারোটা বাজে। মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ রাখা গেল না। সেদিন আমাদের ফরিদপুর হয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা। পদ্মা পেরিয়ে। মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল যে পদ্মার ঘাটের পাইস হোটেলের এত গল্প শুনেছি, সেখানেই একবার পাত পাড়বো, নাহয় একটু বেলাই হল। এমনিতেই মিষ্টিভোজ যা হল, তা অবশ্য মধ্যাহ্ন ভোজের বাড়া। আর যার মিষ্টিতে সমস্যা থাকে থাকুক, আমার কোন সমস্যা নেই।

    দুদিন ধরেই প্রায় গাড়ীতেই সারাসময় কাটছে। খুব ভয় ছিল, ওইটুকু বাচ্চা ছেলেকে কিভাবে গাড়ীতে টানা বসিয়ে রাখবো ! কিন্তু দেখলাম তাতে বিশেষ অসুবিধা হল না। আমার ছেলে হল প্রানীজগতে নিবেদিত প্রাণ। তার ২ বছর বয়সের মন্টেসরী ক্লাসের প্রোগ্রেস রিপোর্ট ছিল, he seems to be obsessed with cows. সেই গরুই আমাদের এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিল – জানলা দিয়ে মাঠের মধ্যে পালে পালে গরু চড়ে বেড়াচ্ছে দেখে আর সে তুমুল উত্তেজনায় চোখ গোল গোল করে নন-স্টপ “ওই দেখ লাল গোলু, ওই দেখ কালো গোলু” করে যায়। এই পর্ব চলেছিল গোটা ট্রিপ ধরে। এমনি সে উত্তেজনা যে কলকাতায় ফেরার পরেও বহুদিন আমরা গরু দেখলে আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠতাম। মিথ্যে বলব না, গরুকে মাতা বলতে আমার যৎকিঞ্চিত আপত্তি থাকলেও, সে যাত্রায় আমাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য গরুর প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। তো খানিকক্ষণ গরু-নাম শুনে আমি মানে মানে প্রাণ বাঁচানোর জন্য জানলায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চাইছি, হঠাৎ দেখি বাবা প্রবল উত্তেজনায় সিট খামচে খাড়া হয়ে বসেছেন। বুঝলাম, এসে গেছে।

    শিবরামপুর। আগে রেল স্টেশনেরও নাম ছিল শিবরামপুর, এখন অবশ্য সে নাম বদলে হয়েছে আমিরাবাদ। আমরা এসেছি সড়কপথে ঢাকা ফরিদপুর মহাসড়ক ধরে, সে পথ রেলস্টেশনের অল্প পশ্চিমে। তাই স্টেশন অবধি আমাদের যেতে লাগে নি। ফরিদপুরে যখন কলেজে পড়তেন, তখন বাবা রাতের বেলা এই স্টেশন থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফিরতেন। গুগুলে দেখলাম আধ-ঘণ্টার হাঁটা পথ। স্টেশনের থেকে হাইওয়েতে আসার পথে পড়ে শিবরামপুর আরডি আক্যাডেমিও, আমার বাপ জ্যাঠার স্কুল। হাইওয়ের থেকে সামান্য ভিতরে। তাকে ডানহাতে রেখে আমরা চললাম মদনদিয়া গ্রামের দিকে। সহজে চেনার জন্য এই গ্রাম জোড় বেঁধেছে কাছেরই আর একটু বড় গ্রাম চাঁদপুরের সঙ্গে – লোকে তাই একে চেনে চাঁদপুর মদনদিয়া বলে।
    গ্রাম অবধি তো চলে গেলাম – এই অঞ্চল্টা নিরবিচ্ছন্ন সবুজ আর জলময়। অবশ্য এ কথাটা শুনে একজন পরে খুব হেসেছিলেন, বলেছিলেন জল আর ওখানে কি দেখলেন। জল দেখতে হলে চলেন খুলনা, বরিশাল – খুব লোভও ছিল। হল না এ যাত্রায়। পরে কবে কোনোদিন ... এতক্ষণ গটগটিয়ে হেঁটে আসা বাবা পুকুড়পাড়ে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাবাদেরই জ্ঞাতিজ্যাঠা ছিলেন গ্রামের জমিদার স্থানীয়। তাঁদের কয়েকজন এখনো ওখানেই থাকেন। পুকুড়পাড়ে কয়েকজন মহিলা বাসন মাজছিলেন। বাবা তাঁদের আত্মীয়দের নাম ধরে জিজ্ঞাসা করতে একজন মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে বললেন, সে আমাগর বাড়ী। আপনে? ব্যস মিলে গেছে হদিশ। বাবার পিছনে পিছনে মার্চ করে সবাই মিলে ঢুকলাম সেই বাড়ীতে। বেলা তখন দুটোর আশেপাশে। এটি আমার সম্পর্কে কাকার বাড়ী। এই কাকারই দুই দাদা, বোনেরা থাকেন কলকাতায়, তাঁদের চিনি ছোটবেলা থেকেই।

    আমার গোয়ালন্দের পাইস হোটেলে খাওয়ার স্বপ্ন মিলিয়ে গেল। রান্না চেপে গেছে উনুনে। আমার মেয়ের নাকি সকাল থেকে না খেয়ে দেয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে। রাশি রাশি চকো-পাই যে সারাক্ষণ গাড়ীতে বসে সাঁটালো সেগুলো তবে কোথায় গেল! তবে আমি ছাড়া আর কারোরই গোয়ালন্দের খাবার নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই দেখলাম – তাহলে যাকগে! ইতিমধ্যে খবর চলে গেছে পাড়ার পুরোন বাসিন্দাদের কাছে। গ্রামে পুরোন মানুষ খুবই কম জন আছেন যদিও। বেশীর ভাগই স্বাধীনতার পরে পরেই চলে এসেছেন। তাও টিমটিম করে যারা জ্বলছিলেন, তাঁরাও বেশির ভাগই দেশ ছাড়েন ’৭১ এ। যে সব বাড়ীতে তাও এখনো মানুষ আছেন, তাঁদেরও পরিবারের অধিকাংশ মানুষই চলে এসেছেন এপারে। এক আধজন-ই ওখানে বাড়ী আগলে পড়ে আছেন। যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কেমন আছেন তাঁরা। এপাশে সংখ্যালঘুদের আমরা কতটা স্বস্তিতে রেখেছি তার কিছু কিছু খাপচা ছবি জানি। ওপাশে ওঁরা কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় নি – কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। বরং স্মৃতি-রোমন্থন বেশ নির্দোষ ব্যসন। যারা দেশে আছেন, যারা ভারতে চলে এলেন – তাঁদের সবার গল্প! এপারের এঁদের সব দেখেছি বাড়ীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে – কিন্তু কে যে রক্ততুতো আর কে যে গ্রামতুতো, বাঙ্গালবাড়ীতে বসে সে বোঝার থেকে ডিভ-গস-কার্লের অঙ্ক কষা সহজ। তার উপর আছে কে জ্ঞাতি, কে কুটুম। তাই বেশী মাথা না ঘামিয়ে চুপ করে বসে সেই দু-দফায় exodus এর বিষাদকাহিনী শুনি। তাও বেশি গভীরে না যাওয়াই ভালো – ’৭১ এ নওগাঁর দাদুকে শুনেছি পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে রেখে বাড়ীর সবাইকে প্রাণ হাতে করে পালাতে হয়। পরে স্বভাবতই তাঁকে আর পাওয়া যায় নি। স্বাভাবিকতার পরতের তলায় লুকিয়ে থাকে এইসব অনন্ত শোকের উৎস। সাবধানে কথা বলি, যাতে অজান্তে কোথাও ঘা দিয়ে না ফেলি! ’৪৭ র পরে প্রথমদিকে কি তখনকার পুর্ব পাকিস্তানেরর সঙ্গে কোন ড্যুয়াল সিটিজেন্সিপের কোন গল্প ছিল? সঠিক বলতে পারব না, তবে আমাদের বাড়ীতে স্মৃতি হিসেবে আমার চল্লিশের দশকে, বাবার বছর ছয়েক বয়েসে, মারা যাওয়া দাদুর ফটোর সঙ্গে তুলে রাখা বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখেছি ছোটবেলায়। অবশ্য পাসপোর্ট জমা দিয়ে ভারতের সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট নেওয়া হয়েছিল তাও জানি। এই এন সি আরের বাজারে বাংলাদেশের কথা লিখছি, তাই এই কথাটাও অন-রেকর্ড থাকুক।

    আমার বাবা, বাড়ীর ও পাড়ার সব ছোটদের সোনাদা, দেশ ছেড়েছেন গ্রাজ্যুয়েশন করে পঞ্চাশের দশকে, ফলে প্রথম যৌবনের সোনালী দিনগুলো কাটিয়েছেন এই গ্রামে। মায়ের যেমন নিজের স্মৃতি কিছুই নেই, বাবার তা নয় – বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে দিন কেটেছে এখানেই। কিছু কিছু গল্প শুনেছি – তবু কতটুকুই বা আর জেনেছি! অন্যের জীবন তো আর বাস করা যায় না। বিয়ের পরে আমরা এক ভাড়াবাড়িতে থাকতাম, জানতাম নিজের বাড়ী না, ছেড়ে চলে যেতে হবে – বেশিদিন থাকিও নি। অনেক দিন পরে একবার বাড়িওয়ালা দাদার সঙ্গে দেখা করতে গেছি, মনে হয়েছিল প্রথম যৌথজীবনবাসের স্মৃতিগুলো এসে যেন আঁকড়ে ধরল! আরও কষ্ট হয়েছিল এই ভেবে যে ইচ্ছে হলেই সেখানে আর ফিরে যেতে পারব না। সেই অনুভূতিটা মনে রেখে বাবার মনের অবস্থাটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম।

    আমাদের নিজের বাড়ী এখন জবর দখল। বাড়ীটাও বদলে গেছে অনেক, নেই অনেক কিছুই। রয়েছে শুধু সেই দাওয়ায় ওঠার আদি কাঁঠালকাঠের পৈঠা। যার বাড়ী তিনি নাকি লোক সুবিধার নয়, তাই বাড়ীর ছবিও তোলা গেল না। বাড়ীর থেকে অ-নেক দূরে ভাঙ্গাচোরা শৌচাগার। মুল বাড়ির থেকে বেশ দূরে রান্নাঘরটিও নেই – একটা ভাঙ্গাচোরা খন্ডহরের উপর প্রাণের আনন্দে গাছ-পালা-লতারা জাল বুনেছে। আমাদের বাপ-মেয়ে দুজনের-ই যে কোন বাড়ীর প্ল্যান নিয়ে ভারী ইন্টারেস্ট। তাই বাস্তুভিটের প্ল্যানও আমাদের আলোচনায় আসে – বাইরের উঠোনের এক ধারে গদিঘর; তার পাশে খড়িঘর (জ্বালানী কাঠ রাখার ঘর ) উল্টোদিকে এক টানায় দুটো শোয়ার ঘর, সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানহাতে ঠাকুরঘর – তার পিছনে ভিতর বাড়ির উঠোন, ঊঠোনের কুয়ো, আর উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর, নিরামিষ ঘর, ভাঁড়ারঘর, ঢেঁকিঘর – তারও পিছনে গোয়াল – ঢেঁকিঘরের পিছন দিকে হাতদশেক দূরে দাদুর বাবা, আমাদের বাড়ির অক্ষয়কুমারের “টয়লেট এক প্রেমকথা” - একমাত্র পাকা ঘর, সেটাই এখনো খাড়া আছে। বুড়ো-দিদা (দাদুর মা) যে কতখানি হুড়কো দিয়েছিলেন, কে জানে! বাঊন্ডারী বর্জিত বাড়ী – বাইরের ঊঠোনের মাঝখান দিয়ে গ্রামের লোকের যাতায়াতের পথ। এই হল সে আমলের গ্রামের গৃহস্থের আব্রুর নমুনা! বাবা দেখালেন ওই এতখানি জায়গা জুড়ে ছিল আমাদের বাড়ী। বাপরে! এতখানি জায়গা!

    স্পষ্ট দেখতে পেলুম কৈলাসচন্দ্র রায় ( আমার দাদুর বাবা) দুই শোয়ার ঘরের মাঝখানের কাঁঠালগাছের তলায় বসে গুড়ুক গুড়ুক থেলো হুঁকো টানছেন, আর দূরে পুকুরের পাড় দিয়ে কিড়িং কিড়িং বেল বাজাতে বাজাতে সাইকেল চেপে আসছেন আমার ছোড়দাদু, গলায় সদ্য দেখা যাত্রার গানের সুর – বাবাকে দেখেই গান বন্ধ হল, সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে আসতে লাগলেন। শব্দ শুনে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে হাতের কাজ সারতে থাকা রাশভারী জ্ঞানদাসুন্দরী ( দাদুর মা ) অল্প গলা তুলে ভাঁড়ার ঘরের ভিতরে থাকা বড়বৌমাকে বললেন, সতীশ এলো, বেতের ধামায় করে ওর জন্য জলখাবার বাড়ো। আজ একাদশী, মণি- অমি বায়না ধরেছে তোমার সঙ্গে সাবুমাখা খাবে। জামবাটিতে সবার জন্য সাবু ভিজিয়ে রাখা আছে, বাকী জোগাড়যাত সেরে রাখো। খাওয়ার পাট চুকলে বরং কাগজ-কলম নিয়ে বোস একবার – কনককে আনার জন্য চিঠি পাঠাতে হবে ওর বাপের কাছে । সুবাসিনীর মুখে হাসি ফুটল, ছোটজা এলে তাও একটু কথা বলার লোক জুটবে। ভাঁড়ার ঘরের বাইরে এলেন। মেয়ে আর ছেলের হাত ধরে গিয়ে দাঁড়ালাম দিদার পাশে। দিদা মুখ তুলে অল্প হেসে বললেন, এলি? এত দেরী হল যে?

    (উল্লেখ্য ২ – বাঙ্গাল ভাষা আমি বলতে / লিখতে পারি না, বিশেষতঃ তার টানটোন কলমে ফোটান আমার সাধ্যের বাইরে। ছোটবেলায় আসলে বাড়ীতে কলকাত্তাই ভাষাই শুনেছি – কিছু কিছু শব্দের ব্যবহারে শুধু বাঙ্গাল বলে বোঝা যেত। তবে পদ্মাপার না হলে কি আর ঠিক মত বাঙ্গাল হয়! তাই ফরিদপুরিয়া আমার ভাষার ভুল ব্যবহার খ্যামা-ঘেন্না করে মাপ করে দেবেন। )

    ( চলবে )
    দিন ৪

    আবেগ, আবেগ – তোমার বাস্তববোধ নাই কুসুম? অল্পবিস্তর আছে বৈকি – তাই জানি যতই গ্রাম-দর্শনের যাত্রা আবেগমুখর হোক, এ শুধু শিকড়ের সন্ধান মাত্র। বেশীও নয়, কমও নয়। শুধু ফিরে দেখার সাধ মাত্র। সেই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন না , সুতীক্ষ্ণ তরবারির আঘাতে বিধাতাপুরুষ মৃন্ময়ীর জীবনকে কখন যে দ্বিখণ্ডিত করে দিলেন তা মৃন্ময়ী বুঝতেও পারে নি, সে কথা যে কোন পরিযায়ী মানুষের জন্যই খাটে। একাধিক জীবনের অধিকারী হন তাঁরা – অনেক দিনের পরে এই উৎস-অভিমুখে ফিরে যাওয়া আসলে দুটি জীবন কে মুখোমুখি করার এক চেষ্টা মাত্র। তবে সে দুটি জীবনকে মেলান’র চেষ্টা নয়। খুব সম্ভবতঃ দীর্ঘদিনের জীবন-যুদ্ধে পোড়-খাওয়া আমার বাবা-মা সেটা আমার থেকেও ভালো বোঝেন। আর আমি বুঝি অন্য কথা। গ্রামীণ কৃষিনির্ভর ঘন-সংবদ্ধ গোষ্ঠী-ভিত্তিক সমাজজীবন মানুষকে স্থিতি দিতে পারে, আনন্দের উৎস হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি-বিকাশের পক্ষে, বিশেষত স্বাধীনচেতা মেয়েদের সামান্য ব্যতিক্রমী বিকাশের পথে গোষ্ঠী-বদ্ধতা ( যাকে বলে collective society) একটা অচলায়তন বাধাও হয়ে দাঁড়াতে পারে। মহীয়সীদের কথা আলাদা, তাঁরা অনেক বিপত্তি ঠেলে এগোতে পারেন। কিন্তু ক্ষুদ্রপ্রাণ, মধ্যমেধার মানুষ উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যতটা ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠে, অন্যত্র সেটা হয় না। কলকাতা তার সব মহানাগরিক সুযোগ-সুবিধা এবং আপাত নির্লিপ্তি নিয়ে আমাদের জন্য সেই সুবিধার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আমি সব সময় বাবাকে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার সিদ্ধান্তের জন্য, কতটা কষ্টের ছিল সে সিদ্ধান্ত তা বুঝেও, ধন্যবাদ দিই।

    এই সব দুমুখী ভাবনাচিন্তার জন্যই বোধহয় যখন গ্রাম ছেড়ে রওনা দিলাম, তখন মনে আনন্দ ছিল, কষ্ট ততটা ছিল না। এবার যাব পদ্মা পেরিয়ে ঢাকা। গাড়ীসুদ্ধ নদী পেরোন’র অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। গড়গড়িয়ে গাড়ী চলে এল জাহাজের পেটে – প্রাইভেট কার, বাস, লরী সব পেটে পুরে ধীরে ধীরে পদ্মার এপার থেকে ওপার পাড়ি দিলেন আমাদের জাহাজ। পরে এ অভিজ্ঞতা আবার হয়েছে বহরমপুরে – কিন্তু জোড়া নৌকার উপর কাঠের পাটা ফেলে করা সে প্রায়- অপেশাদারী প্রাণ-হাতে-করে যাত্রার ব্যবস্থার তুলনায় পদ্মার সে নদীপারের অভিজ্ঞতা রাজসিক। আরো মন ভরালো নদীর জলে, আকাশের মেঘে অস্তগামী সূর্যের রং এর খেলা। ভাষায় তার বর্ণনা করি এমন সাধ্য নেই। সঙ্গে ছবি রইল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান’র জন্য। ঘণ্টা পাঁচেকের পথ ঢাকার সুবিখ্যাত যানজট ঠেলে কতক্ষণে যে ঠিক এসে পৌঁছালাম, তা আর মনে নেই। শুধু মনে আছে বিজয়নগর রোডের হোটেল অর্নেটে যখন ঢুকলাম, তখন ডিনার টাইম।

    পদ্মার বুকে সূর্যাস্ত


    নদী পারাপার


    ঢাকা দেখার জন্য হাতে বরাদ্দ একটি মোটে দিন। এদিকে হাতে একটি বিশাল লিস্টি। আমার মনে মনে ঢাকা বেড়ান’র শুরু ছোটবেলায়, বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে। তারপর সেই স্বপ্নবিলাসে ইন্ধন জুগিয়েছেন আরো অনেকের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসু। এদিকে আমাদের ড্রাইভার-সাহেবের নির্দিষ্ট কিছু গন্তব্য দেখাতেই হবে, ঢাকায় এসে এগুলোও না দেখে ফিরে গেলে লোকে কি বলবে? দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটাতে প্রথমেই যাওয়া হল রামকৃষ্ণ মিশনে। মন্দিরটির সুন্দর আর্কিটেকচার। এরপর থেকেই শুরু হল যানজট। পুরোন ঢাকার সরু মোটা রাস্তা দিয়ে আমরা গেলাম আহসান মঞ্জিল। কিন্তু তার এখনো খোলার সময় হয় নি। চলো অন্য কোথাও, এখানে আবার পরে ফিরে আসতে হবে। কোথা দিয়ে যে কোথায় যাচ্ছি তাও বুঝছি না। পুরোন ঢাকার কোথাও আমার জেঠ্যিমার বাপের বাড়ী ছিল – এইখানেই কোথাও, কিন্তু ঠিক জানি না। বাবাকে আর জিজ্ঞেস করলাম না। হঠাৎ এক জায়গায় ড্রাইভার বললেন, সামনে আপনার মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল – এই হল বিনয় বসুর পদধুলিধন্য মিটফোর্ড কলেজ। যদি খুব ভুল না করে থাকি, এই কলেজেই পড়তেন আমার জেঠ্যুও – ’৪৭ এর ঢাকার রায়টে পড়া ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মেয়েকে নিয়ে টক করে নেমে গিয়ে একবার দেখে চক্ষু সার্থক করলাম। আমরা নকশাল আন্দোলনের জন্য যে সব মেধাবী তরুণ প্রাণ দিলেন তাঁদের নিয়ে হাহুতাশ করি, আজকের রাজনীতিতে ছাত্রদের যোগদান নিয়ে অনেক বিজ্ঞ মতামত দিই, কিন্তু ভুলে যাই যে যে বিপ্লবীরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে কিশোর, সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কিশোর কতজন ছিলেন। জগত জুড়ে হিসেব করলে দেখা যাবে যে বুড়োরা আন্দোলন প্ল্যান করতে পারে, মাথা হতে পারে, কিন্তু তরুণরাই তার জ্বলন্ত শিখা হয়। তাই কেউ যখন বলে ছাত্রদের পড়াশোনা করার সময়, তাঁরা কেন রাজনীতি করবে, তখন বেশ মজা লাগে।

    রামকৃষ্ণ মিশন


    মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ এক ঝলকে



    বিনয় আর তাঁর আগুনখেকো সঙ্গীদের কথা ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম আরেক আবেগ ভরা জায়গায় – “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলতে পারি”। মাথা নিচু হয়ে আসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম রক্তপাত এখানেই হয়।

    ঢাকা শহীদমিনার


    আমার বাংলাভাষাকে নিয়ে এত আবেগের কি আছে? এই প্রশ্নটা বারে বারে শুনেছি। অনেকে বলেছেন আমার নিজের বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা জানা নেই বলেই এত আবেগ। বলেছেন, আগে বহু ভাষাবিদ হও, তারপরেও যদি বাংলার প্রতি এত ভালোবাসা থাকে, তাহলে বোলো। এই অসম-তর্কে কিছু বলতে পারি নি। সত্যিই তো, একমাত্র বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষাই বা স্বপ্ন-দেখার সাবলীলতায় জানি! তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়। তবু আবার কোথাও মনে হয়, একেই তো নাগরিক জীবন থেকে বহু বহু সাংস্কৃতিক ছাপ হারিয়ে গেছে। ধর্ম নিয়ে ছুঁৎ-মার্গতার কারণে জীবন থেকে বাদ হয়ে গেছে একটা বড় আচারের অংশ। ভাষাটুকুকেও না আঁকড়ে ধরলে, যে শিকড়ের খোঁজে এত দূর যাওয়া, সেই শিকড়ের আর কি-ই বা থাকবে? তবে এ একেবারে নিজস্ব ভাবনা, কারোর উপর কোন জোরাজুরি নেই।

    কোন মিউজিউয়াম কখন খুলবে সেই হিসেব করে আমরা ঢাকা শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চরকি নাচ নাচছি। ঢাকেশ্বরী কালিবাড়ি দেখে চললাম ঔরংজেবের ছেলে শাহ আজমের হাতে তৈরি বাদশাহী লালবাগ কেল্লার দিকে। ঢাকা বলতেই আমার খালি মনে হয় ১৯০০ র পরের ঢাকার কথা। তারও আগে ভাবতে গেলে খালি মনে পড়ে ঘসেটি বেগমের কথা। তাঁকেই তো আলিবর্দী খাঁ ঢাকার নায়েব-নাজিমের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন না? যদি ঢাকায় এসে থাকতেন আর সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত না করতেন, তাহলে হয়তো ভারতের ইতিহাসটা অন্য রকম হত! সে যাই হোক, ঢাকার যে তারও আগের একটা মোঘলাই ইতিহাস আছে তা প্রায় মনেই থাকে না। লালবাগ সেটাই মনে করাল। ঔরংজেবের ছেলে শাহ আজম যখন বাংলার সুবেদার ছিলেন, তখন তিনি এই কেল্লা বানাতে শুরু করেন। কিন্তু বাবার ডাকে তাঁকে দিল্লি চলে যেতে হয়। তাঁর জায়গায় আসেন শায়েস্তা খাঁ। গল্প আছে যে এই শায়েস্তা খাঁর অন্তঃপুরে ছিলেন পরী বিবি, শাহ আজমের বাগদত্তা। লোকবিশ্বাস ইনি শায়েস্তা খাঁর মেয়ে যদিও অন্য মতে বলে ইনি আসলে আরাকান বা ত্রিপুরার কোথাওকার রাজার মেয়ে। বাবা যুদ্ধে হেরে গেলে শিশুকন্যাকে মোগলদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন. শায়েস্তা খাঁর অন্দরে থাকতেন, পরে তাঁকে জোর করে মুসলিম করা হয়। কোনটা সত্যি জানা নেই। তবে বিয়ের আগেই তিনি মারা যান। এর একটি সমাধি আছে লালবাগের ভিতরে। জানি না, এর সমাধি তৈরির জন্য রাজস্থান থেকে পাথর-টাথর এনে এক এলাহি কান্ড করা হল, সেটা তো সামনে থেকে শায়েস্তা খাঁ করলেন, কিন্তু তার পিছনের ইন্সপিরেশন কে? শায়েস্তা খাঁ নিজেই নাকি শাহ আজম? এই সমাধি কি কন্যাস্নেহের দ্যোতক নাকি হবু-পত্নী প্রেমের? বোঝা গেল না! তবে এঁর মৃত্যুর পরে শায়েস্তা খাঁর ধারণা হয় কেল্লাটা অপয়া এবং তিনি কেললা ত্যাগ করেন। কেল্লা পড়ে রইল অর্ধসমাপ্ত।

    পরীবিবির সমাধি


    লালবাগ কেল্লার অংশ -


    এরপরের গন্তব্য বঙ্গ-রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান আহসানমঞ্জিল, ঢাকার নবাবদের বাড়ী। ১৮৫৯ সালে তৈরি এই প্রাসাদের অসামান্য স্থাপত্য, ইউরোপীয় রীতির সঙ্গে মোঘলাই-রীতির সংমিশ্রণে তৈরি। খাজা আব্দুল গণি যিনি পরে ঢাকার নবাব বাহাদুর উপাধি পান, তিনি সে সময়ের ভারতের বেশিরভাগ বিচক্ষণ ধনী মানুষের মতই ছিলেন ইংরেজ-ভক্ত। এঁরই নাতি নবাব সালিমুল্লাহর নেতৃত্বে এই প্রাসাদ থেকেই মুসলিম লীগের জন্ম হয়। অবশ্য ঢাকার উন্নতির জন্যেও এঁদের অবদান অনেক – জল বন্টন, বিদ্যুৎ বন্টন নবাবদের দাক্ষিণ্যেই শুরু। আহসান মঞ্জিলের সংগ্রহ, ছবি, নথি দেখে অনেক পুরোন ইতিহাসের কথা মনে পড়ল। কিন্তু এর পরে যেটা দেখতে গেলাম, সেটি অবিশ্বাস্য। ঢাকা মিউজিয়াম। বিশাল সংগ্রহ, সুন্দরভাবে প্রতিটির পরিচয় দিয়ে দিয়ে সাজানো – অসম্ভব দরদের সঙ্গে সাজানো। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আর জনজীবনের পরিচয় জানতে হলে এর তুল্য জায়গা নেই। আমরা দুঘন্টা কাটিয়েছি এখানে, এক-তৃতীয়াংশও বোধহয় দেখা হয় নি, যেটুকু দেখেছি তাতেও তৃপ্তি হয় নি, মনে হয়েছে আরও খুঁটিয়ে দেখতে পেলে ভালো হত। এই মিউজিয়ামটি ভালো করে পুরোটা দেখতে পেলাম না এ আমার বড় আক্ষেপ! শুধু একে দেখার জন্যই আবার ঢাকা যাওয়ার শখ। যিনি বা যাঁরা এর পরিকল্পনা করেছেন এবং স্বপ্নটিকে বাস্তবায়িত করেছেন, তাঁদের আমার হাজারো কুর্নিশ।

    আহসানমঞ্জিল


    চমকের পরে চমক। আমাদের বেড়ানর ব্যবস্থা যিনি করেছেন সেই গৌতম সেন বাবুর একটি বাংলাদেশের সহায়ক সংস্থা আছে। নাম পেট্রো অ্যাভিয়েসন ( Petro Aviation) । তাঁরাই বাংলাদেশে আমাদের জিম্মাদার। এঁদের অফিস ঢাকাতে। সেই অফিসের সকলের সঙ্গে আজ আমাদের লাঞ্চের নিমন্ত্রণ। রেস্টুরেন্টের নাম মনে নেই – অনেকটা আমাদের সাবীরের ধাঁচের, বেশ আন অ্যাজুমিং, কিন্তু আহা কি খাইলাম! জন্ম জন্মান্তরেও সে স্বাদ মুখে লেগে থাকবে। কাবাব –টাবাব জাতীয় ভেজাল ছিল আর সে এমন কিছু আহামরীও না , কিন্ত কচ্চি বিরিয়ানি – আহা ন ব’ছর পরেও আমার জিভে জল চলে আসছে। এমনিতে আমার হাজার ভালো বিরিয়ানীরও মশলার উগ্রতা তেমন ভালো লাগে না, কিন্তু এখানে মশলার তারের নাজুকত্ব বিরিয়ানীর সুপার-হালকাভাবের সঙ্গে মিশে একটাই কথা মুখ থেকে বার করে আনল, স্বর্গ যদি থাকে কোথা এই ধরারই মাঝে, এই খানে তা, এই খানে তা, এই খানে তা রাজে!

    পরের গন্তব্য ধান-মন্ডি। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাড়ী। দেওয়ালে গুলির দাগ, ঘরে ঘরে নৃসংশতার স্মৃতি – এখানে না এলেই ভালো ছিল! অপ্রতিরোধ্য ( নাকি indomitable বললে বেশী ভালো বোঝা যেত ) বাঙ্গাল-স্বভাব যার “আমারে কেউ দ্যাবায়ে রাখতে পারবা না” এই উচ্চারণে, তাঁকে কেন এই ভাবে মারা হল সেটা তলিয়ে বুঝতে হলে শুধু খবর কাগজের খবরের বাইরেও তখনকার বাংলাদেশী রাজনীতি বুঝতে হয় – সে জ্ঞান আমার নেই। আমি কিন্তু এই সবের বাইরে মুজিবকে মনে রাখি একটি আখ্যানের কারণে – স্বাধীনতার পরে অজস্র ধর্ষিতার সন্তান নিয়ে যখন বাংলাদেশ এক সামাজিক সমস্যায়, তখন মুজিব বলেছিলেন, সবার বাবার নাম লেখ, মুজিব। যে কোন যুদ্ধ মানেই মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা – সেই কীটস্য কীট মেয়েদের কষ্টটা সরকারী টানাপোড়েনে আরও কত বাড়তে পারে সেটা অনুভব করে এ কথা বলতে একটা বড় প্রাণ লাগে। তাই বিষণ্ণ মনে শুধু ছবি, আসবাবে সাজিয়ে রাখা হত্যাকাহিনী দেখলাম। এখানে কোন ছবি তোলা গেল না। আর বাইরে থেকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা – কিছুই দেখা যায় না। ফলে শুধু মনেই যেটুকু ধরা রইল। মুজিবের জন্য মন-খারাপ নিয়েই চললাম সাভারের জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখতে। বাংলাদেশের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এর স্বাধীনতার সাতটি বিশিষ্ট ঘটনার স্মৃতিতে সাতটি প্রিজম-দেওয়াল একসঙ্গে রয়েছে – সবার উঁচুটি অবশ্যই ’৭১ র স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্যোতক। সেইখানে দাঁড়িয়ে স্মরণ করলাম সব নাম জানা ও না-জানা শহীদদের আর জাহানারা ইমামের মত অজস্র মাকে। সেই ইয়োহিয়া খান, যার নৃশংসতার কথা শুনে হিটলারও শ্রদ্ধায় মাথার টুপি খোলেন, তার সর্বশক্তিমান বাহিনীর থেকে ছিনিয়ে আনা অদম্য জেদ, রাজনীতি জ্ঞান আর দুর্ধর্ষ মিলিটারী স্ট্রাটেজি দিয়ে ছিনিয়ে আনা রক্তাক্ত, অমুল্য স্বাধীনতা!

    সাভার

    "বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা,
    এর যত মুল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।

    স্বর্গ কি হবে না কেনা।
    বিশ্বের ভান্ডারী শুধিবে না এত ঋণ? "

    এরপর পার্লামেন্ট হাউস দেখে, তার সামনের পার্কে খানিক ঘুরে বেড়িয়ে যখন হোটেলে ফিরছি, তখন কত্তা-গিন্নি দুজনে মিলে হিসেব করলাম কি কি হল না। কত্তার আক্ষেপ বাখরখানি খাওয়া হল না, রাস্তার ধারের দোকানে হাঁড়ি ভর্তি হালিম দেখেও খাওয়া হল না। আর আমার দুঃখ বনানী, গুলশন দেখতে পেলাম না, সত্যেন বোসের স্মৃতি জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে '৭১ র বিদ্রোহী সন্তানদের আবাসস্থল হলগুলি দেখতে পেলাম না, রমণার সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করলেও রমণার পার্কে গড়াগড়ি খেয়ে অলস বিকাল কাটান হল না, সদরঘাটের রাস্তায় নেমে তার গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে নিরুদ্দেশ হাঁটা হল না, খোঁজ পেলাম না কুট্টি গাড়োয়ানদের। একটি মোটে দিনে আর কত কি-ই বা হবে। মিঊজিয়াম পুরো না দেখতে পাওয়ার দুঃখ তো আছেই। শুধু এক জামদানী আর রাজশাহী সিল্ক কেনার আনন্দে এত দুঃখ কি ভোলা যায়!

    (চলবে )

    বিনয় আর তাঁর আগুনখেকো সঙ্গীদের কথা ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম আরেক আবেগ ভরা জায়গায় – “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলতে পারি”। মাথা নিচু হয়ে আসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম রক্তপাত এখানেই হয়।

    ঢাকা শহীদমিনার


    আমার বাংলাভাষাকে নিয়ে এত আবেগের কি আছে? এই প্রশ্নটা বারে বারে শুনেছি। অনেকে বলেছেন আমার নিজের বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা জানা নেই বলেই এত আবেগ। বলেছেন, আগে বহু ভাষাবিদ হও, তারপরেও যদি বাংলার প্রতি এত ভালোবাসা থাকে, তাহলে বোলো। এই অসম-তর্কে কিছু বলতে পারি নি। সত্যিই তো, একমাত্র বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষাই বা স্বপ্ন-দেখার সাবলীলতায় জানি! তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়। তবু আবার কোথাও মনে হয়, একেই তো নাগরিক জীবন থেকে বহু বহু সাংস্কৃতিক ছাপ হারিয়ে গেছে। ধর্ম নিয়ে ছুঁৎ-মার্গতার কারণে জীবন থেকে বাদ হয়ে গেছে একটা বড় আচারের অংশ। ভাষাটুকুকেও না আঁকড়ে ধরলে, যে শিকড়ের খোঁজে এত দূর যাওয়া, সেই শিকড়ের আর কি-ই বা থাকবে? তবে এ একেবারে নিজস্ব ভাবনা, কারোর উপর কোন জোরাজুরি নেই।

    কোন মিউজিউয়াম কখন খুলবে সেই হিসেব করে আমরা ঢাকা শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চরকি নাচ নাচছি। ঢাকেশ্বরী কালিবাড়ি দেখে চললাম ঔরংজেবের ছেলে শাহ আজমের হাতে তৈরি বাদশাহী লালবাগ কেল্লার দিকে। ঢাকা বলতেই আমার খালি মনে হয় ১৯০০ র পরের ঢাকার কথা। তারও আগে ভাবতে গেলে খালি মনে পড়ে ঘসেটি বেগমের কথা। তাঁকেই তো আলিবর্দী খাঁ ঢাকার নায়েব-নাজিমের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন না? যদি ঢাকায় এসে থাকতেন আর সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত না করতেন, তাহলে হয়তো ভারতের ইতিহাসটা অন্য রকম হত! সে যাই হোক, ঢাকার যে তারও আগের একটা মোঘলাই ইতিহাস আছে তা প্রায় মনেই থাকে না। লালবাগ সেটাই মনে করাল। ঔরংজেবের ছেলে শাহ আজম যখন বাংলার সুবেদার ছিলেন, তখন তিনি এই কেল্লা বানাতে শুরু করেন। কিন্তু বাবার ডাকে তাঁকে দিল্লি চলে যেতে হয়। তাঁর জায়গায় আসেন শায়েস্তা খাঁ। গল্প আছে যে এই শায়েস্তা খাঁর অন্তঃপুরে ছিলেন পরী বিবি, শাহ আজমের বাগদত্তা। লোকবিশ্বাস ইনি শায়েস্তা খাঁর মেয়ে যদিও অন্য মতে বলে ইনি আসলে আরাকান বা ত্রিপুরার কোথাওকার রাজার মেয়ে। বাবা যুদ্ধে হেরে গেলে শিশুকন্যাকে মোগলদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন. শায়েস্তা খাঁর অন্দরে থাকতেন, পরে তাঁকে জোর করে মুসলিম করা হয়। কোনটা সত্যি জানা নেই। তবে বিয়ের আগেই তিনি মারা যান। এর একটি সমাধি আছে লালবাগের ভিতরে। জানি না, এর সমাধি তৈরির জন্য রাজস্থান থেকে পাথর-টাথর এনে এক এলাহি কান্ড করা হল, সেটা তো সামনে থেকে শায়েস্তা খাঁ করলেন, কিন্তু তার পিছনের ইন্সপিরেশন কে? শায়েস্তা খাঁ নিজেই নাকি শাহ আজম? এই সমাধি কি কন্যাস্নেহের দ্যোতক নাকি হবু-পত্নী প্রেমের? বোঝা গেল না! তবে এঁর মৃত্যুর পরে শায়েস্তা খাঁর ধারণা হয় কেল্লাটা অপয়া এবং তিনি কেললা ত্যাগ করেন। কেল্লা পড়ে রইল অর্ধসমাপ্ত।

    পরীবিবির সমাধি


    লালবাগ কেল্লার অংশ -


    এরপরের গন্তব্য বঙ্গ-রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান আহসানমঞ্জিল, ঢাকার নবাবদের বাড়ী। ১৮৫৯ সালে তৈরি এই প্রাসাদের অসামান্য স্থাপত্য, ইউরোপীয় রীতির সঙ্গে মোঘলাই-রীতির সংমিশ্রণে তৈরি। খাজা আব্দুল গণি যিনি পরে ঢাকার নবাব বাহাদুর উপাধি পান, তিনি সে সময়ের ভারতের বেশিরভাগ বিচক্ষণ ধনী মানুষের মতই ছিলেন ইংরেজ-ভক্ত। এঁরই নাতি নবাব সালিমুল্লাহর নেতৃত্বে এই প্রাসাদ থেকেই মুসলিম লীগের জন্ম হয়। অবশ্য ঢাকার উন্নতির জন্যেও এঁদের অবদান অনেক – জল বন্টন, বিদ্যুৎ বন্টন নবাবদের দাক্ষিণ্যেই শুরু। আহসান মঞ্জিলের সংগ্রহ, ছবি, নথি দেখে অনেক পুরোন ইতিহাসের কথা মনে পড়ল। কিন্তু এর পরে যেটা দেখতে গেলাম, সেটি অবিশ্বাস্য। ঢাকা মিউজিয়াম। বিশাল সংগ্রহ, সুন্দরভাবে প্রতিটির পরিচয় দিয়ে দিয়ে সাজানো – অসম্ভব দরদের সঙ্গে সাজানো। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আর জনজীবনের পরিচয় জানতে হলে এর তুল্য জায়গা নেই। আমরা দুঘন্টা কাটিয়েছি এখানে, এক-তৃতীয়াংশও বোধহয় দেখা হয় নি, যেটুকু দেখেছি তাতেও তৃপ্তি হয় নি, মনে হয়েছে আরও খুঁটিয়ে দেখতে পেলে ভালো হত। এই মিউজিয়ামটি ভালো করে পুরোটা দেখতে পেলাম না এ আমার বড় আক্ষেপ! শুধু একে দেখার জন্যই আবার ঢাকা যাওয়ার শখ। যিনি বা যাঁরা এর পরিকল্পনা করেছেন এবং স্বপ্নটিকে বাস্তবায়িত করেছেন, তাঁদের আমার হাজারো কুর্নিশ।

    আহসানমঞ্জিল


    চমকের পরে চমক। আমাদের বেড়ানর ব্যবস্থা যিনি করেছেন সেই গৌতম সেন বাবুর একটি বাংলাদেশের সহায়ক সংস্থা আছে। নাম পেট্রো অ্যাভিয়েসন ( Petro Aviation) । তাঁরাই বাংলাদেশে আমাদের জিম্মাদার। এঁদের অফিস ঢাকাতে। সেই অফিসের সকলের সঙ্গে আজ আমাদের লাঞ্চের নিমন্ত্রণ। রেস্টুরেন্টের নাম মনে নেই – অনেকটা আমাদের সাবীরের ধাঁচের, বেশ আন অ্যাজুমিং, কিন্তু আহা কি খাইলাম! জন্ম জন্মান্তরেও সে স্বাদ মুখে লেগে থাকবে। কাবাব –টাবাব জাতীয় ভেজাল ছিল আর সে এমন কিছু আহামরীও না , কিন্ত কচ্চি বিরিয়ানি – আহা ন ব’ছর পরেও আমার জিভে জল চলে আসছে। এমনিতে আমার হাজার ভালো বিরিয়ানীরও মশলার উগ্রতা তেমন ভালো লাগে না, কিন্তু এখানে মশলার তারের নাজুকত্ব বিরিয়ানীর সুপার-হালকাভাবের সঙ্গে মিশে একটাই কথা মুখ থেকে বার করে আনল, স্বর্গ যদি থাকে কোথা এই ধরারই মাঝে, এই খানে তা, এই খানে তা, এই খানে তা রাজে!

    পরের গন্তব্য ধান-মন্ডি। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাড়ী। দেওয়ালে গুলির দাগ, ঘরে ঘরে নৃসংশতার স্মৃতি – এখানে না এলেই ভালো ছিল! অপ্রতিরোধ্য ( নাকি indomitable বললে বেশী ভালো বোঝা যেত ) বাঙ্গাল-স্বভাব যার “আমারে কেউ দ্যাবায়ে রাখতে পারবা না” এই উচ্চারণে, তাঁকে কেন এই ভাবে মারা হল সেটা তলিয়ে বুঝতে হলে শুধু খবর কাগজের খবরের বাইরেও তখনকার বাংলাদেশী রাজনীতি বুঝতে হয় – সে জ্ঞান আমার নেই। আমি কিন্তু এই সবের বাইরে মুজিবকে মনে রাখি একটি আখ্যানের কারণে – স্বাধীনতার পরে অজস্র ধর্ষিতার সন্তান নিয়ে যখন বাংলাদেশ এক সামাজিক সমস্যায়, তখন মুজিব বলেছিলেন, সবার বাবার নাম লেখ, মুজিব। যে কোন যুদ্ধ মানেই মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা – সেই কীটস্য কীট মেয়েদের কষ্টটা সরকারী টানাপোড়েনে আরও কত বাড়তে পারে সেটা অনুভব করে এ কথা বলতে একটা বড় প্রাণ লাগে। তাই বিষণ্ণ মনে শুধু ছবি, আসবাবে সাজিয়ে রাখা হত্যাকাহিনী দেখলাম। এখানে কোন ছবি তোলা গেল না। আর বাইরে থেকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা – কিছুই দেখা যায় না। ফলে শুধু মনেই যেটুকু ধরা রইল। মুজিবের জন্য মন-খারাপ নিয়েই চললাম সাভারের জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখতে। বাংলাদেশের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এর স্বাধীনতার সাতটি বিশিষ্ট ঘটনার স্মৃতিতে সাতটি প্রিজম-দেওয়াল একসঙ্গে রয়েছে – সবার উঁচুটি অবশ্যই ’৭১ র স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্যোতক। সেইখানে দাঁড়িয়ে স্মরণ করলাম সব নাম জানা ও না-জানা শহীদদের আর জাহানারা ইমামের মত অজস্র মাকে। সেই ইয়োহিয়া খান, যার নৃশংসতার কথা শুনে হিটলারও শ্রদ্ধায় মাথার টুপি খোলেন, তার সর্বশক্তিমান বাহিনীর থেকে ছিনিয়ে আনা অদম্য জেদ, রাজনীতি জ্ঞান আর দুর্ধর্ষ মিলিটারী স্ট্রাটেজি দিয়ে ছিনিয়ে আনা রক্তাক্ত, অমুল্য স্বাধীনতা!

    সাভার

    "বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা,
    এর যত মুল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।

    স্বর্গ কি হবে না কেনা।
    বিশ্বের ভান্ডারী শুধিবে না এত ঋণ? "

    এরপর পার্লামেন্ট হাউস দেখে, তার সামনের পার্কে খানিক ঘুরে বেড়িয়ে যখন হোটেলে ফিরছি, তখন কত্তা-গিন্নি দুজনে মিলে হিসেব করলাম কি কি হল না। কত্তার আক্ষেপ বাখরখানি খাওয়া হল না, রাস্তার ধারের দোকানে হাঁড়ি ভর্তি হালিম দেখেও খাওয়া হল না। আর আমার দুঃখ বনানী, গুলশন দেখতে পেলাম না, সত্যেন বোসের স্মৃতি জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকে '৭১ র বিদ্রোহী সন্তানদের আবাসস্থল হলগুলি দেখতে পেলাম না, রমণার সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করলেও রমণার পার্কে গড়াগড়ি খেয়ে অলস বিকাল কাটান হল না, সদরঘাটের রাস্তায় নেমে তার গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে নিরুদ্দেশ হাঁটা হল না, খোঁজ পেলাম না কুট্টি গাড়োয়ানদের। একটি মোটে দিনে আর কত কি-ই বা হবে। মিঊজিয়াম পুরো না দেখতে পাওয়ার দুঃখ তো আছেই। শুধু এক জামদানী আর রাজশাহী সিল্ক কেনার আনন্দে এত দুঃখ কি ভোলা যায়!

    (চলবে )
    দিন ৫

    বারো ভুঁইয়াদের কথা মনে পড়ে? সেই যে মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুতেই নতি স্বীকার না করা, বার বার নিজেদের কিছুতেই হার-না-মানা তেজ, জলপথে যুদ্ধের ক্ষমতা আর নিজেদের এলাকাকে হাতের তালুর মত চেনাকে সম্বল করে মুঘন বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করা জমিদার-দের কথা? যশোরের প্রতাপাদিত্য, চন্দ্রদ্বীপের ( আজকের বরিশাল বোধহয় ) কন্দর্পনারায়ণ, নাটোরের কংসনারায়ণ, বাঁকুড়ার হাম্বীর, রাজশাহীর পীতাম্বর রায়, দিনাজপুরের প্রমথ রায় – এঁদের মধ্যমণি ছিলেন সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঈশা খাঁ, আদতে মৈথিলী কায়স্থ সন্তান । ইনি যখন নিজের রাজ্যখানির সীমানা বেশ বাড়িয়ে নেন, তখন নিজের রাজধানীটি সরিয়ে নেন মেঘনার তীরে সোনারগাঁওতে। সোনারগাঁও তখন এক দারুণ সমৃদ্ধশালী বন্দরনগরী। দিকে দিকে বাণিজ্য চলে এখান থেকে। অবশ্য মোটামুটি ১৫৭৬ সালে বাংলার সুলতানদের পতনের পরের থেকে ঈশার যে উত্থানের শুরু, ১৫৯৯ অবধি সেটা জারী থাকলেও তাঁর ছেলে মুশা খাঁ ১৬১০ এ এসে মুঘলদের হাতে পরাজিত হন। প্রতাপাদিত্য হেরে গেছেন আগেই। বাংলায় মুঘল শাসন এবার স্থায়ী হবে। রাজধানী চলে যাবে সোনার গাঁও ছেড়ে জাহাঙ্গীরাবাদে, আজকের ঢাকা।

    একজায়গায় পড়েছি যে কলহন নাকি রাজতরঙ্গিনীতে লিখেছেন যে ঢাকা নামকরণের কারণ সে আমলের বিক্রমপুর আর সোনারগাঁও তে দুটি বড় ওয়াচটাওয়ার ছিল – আর ওয়াচটাওয়ারকে নাকি ঢাক্কা , কোন ভাষায় তা খোদায় মালুম, বলে – সেই থেকে নাম ঢাকা। কে জানে সত্যি মিথ্যে। সে অবশ্য লোকে এও বলে ঢাকেশ্বরী কালিবাড়ি নাকি বল্লাল সেনের তৈরি। কে জানে আজকের চুণ-সরকি-মার্বেলের তলায় কোথায় সে বল্লাল-সেনী ইঁট লুকিয়ে আছে! থাকুক গে!

    ভোর ভোর রওনা দিয়েছি। উদ্দেশ্য ঢাকার রাস্তায় লোক নামার আগে ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া। পিছনে পড়ে রইল টিকাটুলি। গাড়ীর জানলা খুলে দিয়েছি একটু। সবাইকে সরিয়ে আজ জানলার ধারে বসেছি। ছেলে আর মেয়ে পিছনে কি সব হিজি-বিজি বক বক করছে। কিচ্ছু শুনছি না। প্রাণভ’রে শেষবারের মত ঢাকা দেখে নিচ্ছি। কাল রাতেও আলোচনা করেছি আবার একবার ঢাকা আসতে হবে। কিন্তু যতই আবেগ সে কথা বলুক, মনে জানি আর আসার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। বিপুল বসুধাতে কত জায়গা, তাদের কত বিচিত্র রং-রূপ- এই ক্ষুদ্র জীবনে পকেট সামলে-সুমলে কটাই বা আর দেখা হবে! তাই এক জায়গায় একাধিক বার আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই ছেড়ে যাওয়ার পথেও শেষবিন্দু অবধি শুষে নিতে চাইছি ঢাকাইয়া অস্তিত্ব। রাস্তার পাশের দোকানের সাইনবোর্ড পড়ছি – হঠাৎ চোখে পড়ল যাত্রাবাড়ী’র নাম – কার লেখায় পড়েছি যাত্রাবাড়ীর কথা? প্রফুল্ল রায়? অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়? নাকি অন্য কারোর? মনে নেই – কিন্তু জায়গাটার নাম মনে আছে ঠিক।

    শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের নারায়ণগঞ্জের তখনো আড়মোড়া ভাঙছে – নদী পেরিয়ে চলে এলাম মেঘনার তীরে সোনার গাঁও। তখনো রাস্তায় ভালোভাবে লোক চলাচল শুরু হয় নি। প্রথমেই পানামের প্রায় পরিতক্ত্য নগরী – যদিও অনেক বাড়িতেই মানুষ থাকার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ বাড়ীই ভাঙাচোরা – তবু বোঝা যায় আগে কি অপূর্ব-ই না ছিল। চূণ-সুরকির কাজ, কাস্ট আয়রনের কারুকাজকরা রেলিঙ, কোথাও আবার থামের গায়ে মোজাইকের কাজ – একটা রাস্তার ধারের দুধারে প্রায় সব বাড়ি এ বলে আমায় দ্যাখো, ও বলে আমায় দ্যাখ। ভাবা যেতে পারে কলকাতার মারবেল প্যালাসের মত প্রায় গোটা পঞ্চাশেক বাড়ী গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ রাস্তায় ছিল হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়ী – ’৪৭ এর রায়টে ভয়াবহ ভাবে ক্ষতি হয় এখানকার মানুষজনের। তারপরেই সবাই দেশ ছেড়ে পালান। বাড়ীগুলি সব পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে এ খন্ডহর। আলোর অভাবে ভালো করে ছবি তোলা গেল না। এ দুঃখ যাবার নয়। এখানেই একটা জিনিস দেখেছিলাম যেটা কেন বুঝি নি – আর্চের মাথায় ত্যারচা করে করে ইঁট বসান হয় জানি, বোধহয় আগেকার দিনে লিন্টেল-ও তৈরি হয়ত সেভাবেই – কিন্তু চার চৌকো দেওয়ালের মাঝে কেন হঠাৎ একটি চৌকো অংশে ত্যারচা করে ইঁট বসান হবে। কেউ যদি জানেন তাহলে কারণটা জানালে বাধিত হব। এই পোড়া নগরে যেখানে চারিদিক নিঃঝুম, সেখানে হঠাৎ দেখি দীঘির ধারে চালার নীচে বেদীর উপর রাখা রয়েছে একটি মা কালির মূর্তি। কে কাকে রক্ষা করে! এই পানাম শহরের একদম কাছেই জয়নাল আবেদিনের তৈরি ফোক- আর্ট ও ক্র্যাফট মিউজিয়াম – সে খুলবে অনেক পরে। শুনেছিলাম সেখানে খুব ভালো কাঁথার কালেকশন আছে। এও মিস হল। এর অল্প দূরে দীঘির ধারে ঈশা খাঁর বাড়ি। দুই অশ্বারোহী পাহারা দিচ্ছে পরিত্যক্ত বাড়ীর প্রবেশদ্বার। দালান থেকে সিঁড়ি এসে মিশেছে দীঘির জলে। মুশা খাঁ হেরে যাওয়ার পর সোনার গাঁও ছেড়ে চলে যান – অথচ তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিকেরা নিজ দায়িত্বে অটল রয়ে গেছে আজও – সেই সঙ্গে জমাট বেঁধে রয়েছে সময়।

    ঈশা খাঁর বাড়ির দুই অশ্বারোহী পাহারাদার


    পানামের একটি বাড়ীর ছবি


    এখান থেকে আরও উত্তরপূর্বে চলে গেলে ব্রাহ্মণবেড়িয়া, তার কাছেই মালোপাড়ার কাহিনী নিয়ে লেখা অদ্বৈত মল্লবর্মণের “তিতাস একটি নদীর নাম”। তারও উত্তর-পূর্ব দিকে চলে গেলে সিলেট। সিতারা সাহেবের বাড়ি সেখানে। এ যাত্রায় সে সব থাক। অবশ্য থেকে গেল তো আইতে শাল, যাইতে শাল যে সেই বরিশালও। বাদ পড়ল খুলনাও। আজ আমাদের সঙ্গে চলেছেন পেট্রো এভিয়েশনের হাসান সাহেব। একজন দারুণ ইন্টারেস্টিং মানুষ। বর্ণময় জীবন। তাঁর গল্প শুনেই সময় কেটে যাচ্ছে। ইনি ইতিমধ্যেই নিমন্ত্রণ করেছেন, বাংলাদেশের সুন্দরবনে আসেন একবার। এবারে আসার আগে থেকে সবার ভারী ইচ্ছে বাংলাদেশের প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন যাওয়ার। সমুদ্রের মাঝে নৌকায় পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় সেখানে। হাসান সাহেব বারণ করলেন। বললেন এখন সে জায়গা নিরাপদ নয়। যে কোন সময় ঝড় বৃষ্টিতে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে সব শুনে টুনে আমরাও বাচ্চা-বুড়ো নিয়ে সেখানে যাওয়ার সাহস করলাম না। কিন্তু বাংলাদেশ দেখা কি আদৌ সম্পূর্ণ হতে পারে চট্টগ্রাম না গেলে? একবার কর্ণফুলীর তীরে দাঁড়িয়ে মাস্টারদা আর তার সহযোগীদের কথা না স্মরণ করলে? ব্যাকপ্যাকিং করলে হয়ত আমার ইতিহাস-চারণ অন্য রকম হত, কিন্তু এ হল পারিবারিক ভ্রমণ – সবার পছন্দ-অপছন্দ মাথায় রেখে প্ল্যান করা। চট্টগ্রামে ইতিহাসের হাত ধরে আছে অপার প্রকৃতির মাধুর্য – পাহাড়, নদী, সমুদ্র, লেক যা চাই তাই পাই। সবার ভালোলাগা মাথায় রেখে তাই পরের গন্তব্য জিলা চট্টগ্রাম।

    (চলবে)
    তবু ইতিহাসের মায়া কাটে না। দাউদকান্দি ছাড়িয়ে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে চলেছি - মাঝপথে পরে কুমিল্লা। সে আরেক ইতিহাসের জায়গা। ইংরেজ আমলে এখানে ১২২০ সালের রণবঙ্কমল্ল নামের হরিকেল-রাজার নামে এক তাম্রপত্র পাওয়া যায়। পরে একটি গড়ের ধ্বংসাবশেষও মেলে। তবু কেউ কোন পাত্তাও দেয় নি। তার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে ইংরেজরা এয়ারপোর্ট ইত্যাদি বানাতে শুরু করে মিলিটারী প্রয়োজনে, তখন দেখা যায় এখানে প্রচুর পুরোন ইঁট পড়ে আছে। সেই দিয়েই নির্মাণ শুরু হয়ে যায়। শেষমেশ এক প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হর্তা কর্তার নজরে পড়ায় এসব কাজ বন্ধ হয়। এবং আংশিক খনন করে আবিস্কার হয় একটি বহুস্তরীয় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। আমার মত যাদের ইতিহাসের বিদ্যে ক্লাস টেনেই শেষ হয়ে গেছে, তাঁদের পক্ষে এই জায়গার ইতিহাস ধরাও কঠিন। প্রথম ঠক্কর হরিকেলটা আবার কোথায় !

    একটু চেষ্টা করা যাক প্রাক মুসলিম যুগের কুমিল্লার ইতিহাস বোঝার। যদি কিছু তথ্য ভুল হয়, ইতিহাসবিদ বন্ধুরা ভুল ধরিয়ে দিলে খুশী হব। আর কারোর যদি ইতিহাসের কচকচিতে দাঁত ফোটান’র ইচ্ছে না থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় টপকে পরের অংশে চলে যেতে পারেন। রাজা বলির স্ত্রীর গর্ভে দীর্ঘতমস ঋষির পাঁচটি ছেলে হয় – অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুহ্ম। এ কথা খাস মহাভারতের। ভালো করে পঙক্তিটি লক্ষ্য করুন – এই যদি ঘটনা হয়, তাহলে তাবৎ বাঙ্গালী পরিবারের বংশের শুদ্ধতা-রক্ষায় বিধবা কন্যাদের বেনারসে নির্বাসন দেওয়া, বা ছেলে-মেয়েদের অন্য জাতে বিয়ে দেওয়ায় আপত্তি কি পরিমানে হিপোক্রেসী সেটা বোঝাই যায়! যাই হোক, এই পাঁচ পুত্রের থেকে তৈরি হল পাঁচ রাজ্য। এর মধ্যে বঙ্গ আর পুণ্ড্র নিয়ে আমাদের এযাত্রার কারবার। খুব গোদাভাবে বললে এই পুণ্ড্র হল উত্তর-বঙ্গের করতোয়া নদীর তীরের, ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমের পৌণ্ড্রবর্ধন আজকের বগুড়া-রাজশাহী-রংপুর-দিনাজপুর ( মহাস্থানগড়ের প্রসঙ্গে এর কথা বলেছি ) , আর বঙ্গদেশ হল ভাগিরথীর পুব পাড়ের বদ্বীপ অংশ। মনে রাখতে হবে ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, ঢাকা এই খ্রীষ্টপুর্ব সময়ে তখনো সমুদ্রের গর্ভে। খ্রীষ্টপুর্ব সময়ের মৌর্য রাজারা পৌণ্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন। গুপ্ত যুগে, ( মোটমাট ৩০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ শুরু ) মানে তৃতীয় শতক থেকে ত্রিপুরা-কেন্দ্রিক সমতটের কথা শোনা গেল। কিন্তু পরে গুপ্তযুগের পতন ঘটলে সেই সুযোগে এখানকার রাজা প্রায়-স্বাধীন হয়ে ওঠেন, যার একজন গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক ( ৬০০ খ্রীষ্টাব্দের এদিক-ওদিকে যার রাজ্য ) । শশাঙ্ক মারা যাওয়ার পরের মাৎস্যন্যায় পর্বের খানিক হদিশ মেলে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় “তুমি সন্ধ্যার মেঘে”। সেই সময়ে সমতটে উঠে আসেন খড়গ বংশ মোটামুটি ৬২৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে। টিঁকে ছিল প্রায় ৭২০ খ্রীষ্টাব্দ অবধি। গুপ্তদের ব্রাহ্মণ্যধর্মের জায়গায় এঁরা ছিলেন বৌদ্ধ। অবশ্য খড়গদের পরের দিকের দুর্বলতার সুযোগে কুমিল্লা অঞ্চলে উঠে আসে আরেক সামন্ত বংশ, রাত বংশ। এই রাত বংশের রাজধানী ছিল দেবপর্বত, আজকের কুমিল্লার ময়নামতী অঞ্চল। পরে খড়্গ রাজা দেবখড়গ একে হটিয়ে দেন। এর পরে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে প্রায় একশ বছর এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন দেব বংশের শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ভবদেব। এই সপ্তম শতকে প্রথম নাম পাওয়া যাচ্ছে হরিকেলা বলে একটি জায়গার – এটি খুব সম্ভবত শ্রীহট্ট-কেন্দ্রিক ছিল। এরপর ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে এলেন পালবংশের গোপাল। মোটামুটি ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের ধারেকাছে, মহিপালের আমলে আবার পালরাজ্যে ভাঙ্গন ধরে। সমতট দখল করে হরিকেলার চন্দ্র বংশ, যারা কিনা রাজত্ব করেছে ৯০০ থেকে ১০৫০ সাল অবধি। এঁরা অবশ্য রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান বিক্রমপুরে। হরিকেলা রাজ্যের সীমানা ছড়িয়ে পড়ে কুমিল্লা ছাড়িয়ে চট্টগ্রামের সমুদ্রতট অবধি। এইবার কখনও তাকে সমতট বলা হচ্ছে, কখনও হরিকেলা। যার নেট ফল দ্বাদশ শতকে এসে ভাগিরথীর পুর্বতীর থেকে মেঘনার মোহনা অবধি সমতট ছড়িয়ে গেল। ১১০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ রাঢ় অংশে সেনবংশ ক্ষয়ে যাওয়া পালবংশকে উচ্ছেদ করে। প্রায় ১০০ বছর পরে সেন রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে উঠে আছে বৈষ্ণব-হিন্দু দেব বংশ প্রায় ১১৮০ সালে এবং রাজত্ব করেন ১২৮০ অবধি। এরপর এই অঞ্চলে শুরু হয় নবাবী রাজ্য।

    এত কথা বললাম একটাই কারণে। আমরা স্কুলে থাকতে এত বিশদে এই ইতিহাস পড়ি নি। শশাঙ্ক, পালবংশ, সেন বংশ – ব্যস। ফলে ময়নামতিতে গিয়ে যখন শুনলাম যে এখানে দেববংশের রাজাদের আমলের অনেক কয়েন, বাসনপত্র, তাম্রপাত্র পাওয়া গেছে, কিছুই বুঝলাম না। এখানকার যে শালবন বিহার তার শুরু খুব সম্ভবত সপ্তম শতকের খড়গ বংশের বা রাত বংশের সময় থেকেই। প্রচুর মুদ্রা ও বিভিন্ন টেরাকোটার লিপিও মিলেছে এখানে। তারপর শুনলাম চন্দ্রবংশের রানী ময়নামতির প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ আছে এখানে, নিজের অজ্ঞানতা নিয়ে আরও সমস্যায় পড়লাম। “গোপীচন্দ্রের গান” পড়ি নি তখনও, নাথপন্থীদের সম্বন্ধে হয়তো খুব বেশী হলে এক দু লাইন জানি – তাই জানতামও না ময়নামতী আর গোপীচন্দ্রের গল্প যেখানে দৈব নির্দেশে আসন্ন অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে গোপীচন্দ্র নাথ গুরুর শিষ্যত্ব নিয়ে সন্যাসীর বেশে গৃহত্যাগ করেন এবং পরে আবার দেশে ফিরে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে রাজ্যশাসন করেন। এই গোপীচন্দ্রই নাকি চন্দ্র বংশের রাজা গোবিন্দচন্দ্র। কিছুই বুঝতে না পারলে আমার কোন ঐতিহাসিক জায়গা দেখতে ভালো না।

    ময়নামতী অঞ্চলে অনেকগুলো সাইট। যেটিতে আমরা গেলাম সেখানে আমরা ছাড়া আর ধারে কাছে কোন মানুষজন নেই। আমাদের যে খুব প্রাথমিক কিছু প্রশ্ন তারও কোন উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। এবং সাইটে কোন স্থান-বিজ্ঞপ্তিও নেই – ফলে কি দেখছি, কেন দেখছি কিছুই বুঝছি না। এদিকে মাথার উপর চড়া রোদ। বুড়ো মানুষদের, বাচ্চাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। এই জন্যেই শীতের দিন ছাড়া এ সব জায়গায় আসতে নেই। বাকী সাইটগুলো আমাদের পথ থেকে অনেকটা দূরে। বেশ খানিকটা ভিতরে ঢুকতে হবে। আর এত বছর পরে আমার ঠিক মনে পড়ছে না, কিন্তু বিদেশী বলে কোন বিশেষ পারমিশন দরকার ছিল এরকম কিছু একটা শুনেছিলাম কিনা। মোদ্দা কথা আমরা ওই একটি সাইট দেখেই চট্টগ্রামের পথে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

    তবে এ তাবৎ যে কয়েকটি আরকিওলজিক্যাল সাইট দেখেছি, তার মধ্যে ধোলাভিরা বা লোথালের হরপ্পা সভ্যতার অংশ বা খুব ছোট স্কেলে মোগলমারীর ধ্বংসস্তুপ অথবা বাংলাদেশের সোমপুর-বিহার বা ময়নামতির ধ্বংস স্তুপ, সবকটিই দেখে বার বার একটা কথাই মনে হয়েছে যে শুধু ঠিক ঠিক পরিবেশনের অভাবে জায়গাগুলিতে মানুষ কেমন উৎসাহ পান না।

    যাই হোক, ইতিহাস জানি বা নাই জানি, এ উপমহাদেশের মানুষের গুল-গল্পে পূর্ণ অধিকার – সেরকমই একটা এখানে বলে নিই। এই লালমাই – ময়নামতি হল ছোট ছোট ঢেউ-খেলান পাহাড়ী এলাকা। তো কি করে সেটা তৈরি হল জানেন? সেই লক্ষ্মণকে বাঁচানর জন্য হনুমান বিশল্যকরণী আনতে গিয়ে গন্ধমাদন নিয়ে এসেছিলেন না, এইবার হয়েছে কি, লক্ষ্মণ সেরে ওঠার পরে হনুমানের কাজ পড়েছে সেই পাহাড়কে যথাস্থানে রেখে আসার। কিন্তু হনুমান হলেন আমাদের ভুলো-মন দাদা – তাই তিনি সব জায়গা-টায়গা ভুলে মেরে দিয়ে কুমিল্লাতে চলে এসে পাহাড়টা ধপ করে ফেলে দেন। সেই পাহাড়ই আজকের লালমাই-ময়নামতী। সাধে বলে হনুমান!

    (চলবে )
    কুমিল্লার থেকে পথ চলেছে সোজা দক্ষিণে। ইতিমধ্যে লাঞ্চ করা হয়েছে পথের ধারের একটি হোটেলে। আমরা তো খুব সাধ করে অর্ডার দিয়েছি পায়রার মাংস – কিন্তু খেতে বসে বড্ড বিবেক দংশন হল – ছোট্ট একটা প্রাণী, তাকে নিজেদের আনন্দের জন্য কেটে কুটে খেয়ে ফেললাম! মুখ ফুটে বলতেই অবশ্য প্রভূত ঝাড় খেলাম, এই টুকুটুকু মৌরলা মাছ পেলেই হাপুস-হুপুস করে খেয়ে ফেলছিস, আর এখন ন্যাকামি! সেও বটে, যুক্তিতে দাঁড়াতে পারব না – কিন্তু কষ্ট যে লাগলো তাও তো মিথ্যে নয়।

    চলছি তো চলছিই – পথের শেষ নেই। হঠাৎ ড্রাইভার ভারী উত্তেজিত হয়ে দেখালেন, ওই দ্যাখেন ইন্ডিয়া! ওমা! সত্যিই তো – সামনেই দেখি কাঁটাতারের বেড়া। এ একটা অন্য অনুভুতি কিন্তু। দেশের থেকে ওয়াঘা বর্ডার দেখেছি, নেপাল বা ভুটান বর্ডার তেমন ভালো করে বুঝতে না পারলেও টাকীর থেকে দেখেছি ইছামতীর জলে ভাসানো সীমান্তের বয়া – কিন্তু অন্য দেশের থেকে নিজের দেশের ভুখন্ড দেখে কেমন একটা "ও আমার দেশের মাটি" গোছের পাভলভিয়ান রিঅ্যাকসন হল!

    চলতে চলতে এসে গেল ফেণী। তারও অনেকক্ষণ পরে দেখলাম চারপাশটা একটু বদলে গেল – পেরোতে শুরু করলাম অনেক অনেক খাল, জলাশয় - দেখতে পেলাম একটা সাইক্লোন সেন্টার – চট্টগ্রাম এসে গেল কি? অবশ্য আজ আমরা যাচ্ছি বান্দরবন। ঘন সুন্দর সবুজে মোড়া পর্বত-সুন্দরীর সঙ্গে মোলাকাতে। চট্টগ্রাম পৌছানর আগেই আমরা পুবমুখো হয়ে ঢুকে পড়লাম পাহাড়ী রাস্তায়। তবে এ রাস্তা আমাদের পরিচিত পাহাড়ী রাস্তার মত অত প্যাঁচালো নয় – বরং অনেক সরল, সোজা, ঠিক এখানকার আদিবাসী মানুষদের মতই।
    আমাদের আজকের রাস্তা শেষ হবে নীলগিরি হিল রিসর্টে। হাসান সাহেবের থেকে গল্প শুনেছি, এই পুরো এলাকাটাই সেনাবাহিনীর কড়া নিয়ন্ত্রণে। এমনকি যে নীলগিরি রিসর্টে আমরা থাকব, সেও সরাসরি সেনার হাতে। তবে ওদের কোম্পানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বান্দরবনে ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে – প্যারাগ্লাইডিং জাতীয় বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, হাইকিং ট্রেল এসব তৈরি করার চেষ্টা করছে। এখন কাজ চলছে। শুনে খুব ভালো লাগল।

    রিসোর্টে ঢোকার অল্প আগে একটি আদিবাসী গ্রামে আমরা একটা ছোট বিরতি নিলাম। বাঁশের মাচার উপর ঘর, সিঁড়ির ব্যবস্থা নিতান্ত প্রিমিটিভ – তাই বেয়ে বাচ্চারা কি সাবলীল ওঠা-নামা করছে। গ্রামে ঢুকতেই বাচ্চাগুলো এসে ঘিরে ধরল। আমরা তো ভারী অপ্রস্তুত হলাম – এখানে আসব জানতামও না, তাহলে একটু লজেন্স-টজেন্স নিয়ে আসা যেত। অবশ্য হাসান সাহেবের কাছে সব ব্যবস্থা মজুত – তিনি-ই ওদের সব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিলেন। একজন পুরুষ কিছু একটা বাদ্য যন্ত্র বাজাচ্ছিলেন, সামান্য কৌতুহল দেখাতেই অনেকক্ষণ ধরে বাজিয়ে শোনালেন। বাজনা শুনতে শুনতে মেয়েরা ফিরল কাছের ঝোড়া থেকে জল নিয়ে – পিঠে বাঁধা ঝুড়িতে রাশি রাশি প্ল্যাস্টিকের বোতলে ভরা জল। ঝর্ণার দুরত্ব লগভগ আধা-মাইল হবেই। পাহাড়ী পথে ওই অতগুলো বোতল নিয়ে ঘরে ফেরা! এই মেয়েদেরই একজনের সংসার দেখতে গেলাম। ছোট্ট ঘর, যৎসামান্য উপকরণ – তবু তেমন অতৃপ্তি নেই। অনেক প্রশ্ন ছিল মনে, কিন্তু ভাষার ব্যবধানে আর স্বভাবগত বাধো-বাধো ভাবের জন্য করে ওঠা গেল না। একজনের সঙ্গে কথা হচ্চিল, তাঁর শ্বশুরবাড়ী বার্মায় – সেখানে বিয়ের নেম্নতন্নে যাবেন – জানতে চাইলাম কিকরে যাবেন? পাসপোর্ট – ভিসা লাগবে না? তিনি শুনে হেসেই আকুল, বললেন আমাদের গ্রামের প্রায় সবারই আত্মীয় আছেন বর্মায় – আমরা তো পাহাড় ডিঙ্গিয়ে হরদম যাতায়াত করি , কে দেখবে পাসপোর্ট? বোঝো! এই নাকি সেনা বাহিনী সব সময় নজরে নজরে রাখে, তার তলাতেই এই কান্ড!

    আদিবাসীদের বাসস্থানঃ


    শিশুর দল


    ম্রো দের বাদ্যযন্ত্র (Plung)


    জল বয়ে নিয়ে আসা আদিবাসী মহিলা


    বিকেল বিকেল রিসোর্টে পৌঁছালাম। জায়গা হল একটি কটেজে – পাশাপাশি দুটি ঘরে। একটু দূরে আরও একটি ( নাকি দুটি ? ) ডাবল রুম কটেজ। ব্যস। হাত মুখ ধুয়ে, ফ্রেশ হয়ে এসে ছেলেকে সামনের লনে ছেড়ে দিতেই সে ভারী খুশী – ছুটোছুটি করে খেলতে শুরু করল। আর আমরা বসে দেখছি একদম শান্ত প্রকৃতি – গাছের পাতার মধ্যে হাওয়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে – সামনের উপত্যকা থেকে মেঘ উঠে আসছে, সেই সঙ্গে উঠে আসছে হালকা ঝিম ধরানো আদিম প্রকৃতির গন্ধ – যেখানে মেঘ ছিঁড়ে যাচ্ছে, সেখানে দূরের ধোঁয়া-নীলচে পাহাড়ের ঢেউ দেখা যাচ্ছে – মেঘের গায়ে রং ধরছে – এক সেনানী এসে পতাকাকে স্যালুট করে সামনে উড়তে থাকা বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ নামিয়ে নিলেন, সুজ্যিমামা অস্তে গেলেন, প্রজাপতিরা ওড়াউড়ি থামিয়ে ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসল, রং তবু মোছে না মেঘের গায়ের থেকে – আস্তে আস্তে চাঁদের মা বুড়ি এসে মেঘেদের ডাক দিলেন, বাছারা তোদের শালিধানের চিঁড়ে দিয়েছি, শীতল নদীর জল দিয়েছি, নরম-গরম বিছানা দিয়েছি – খেয়ে দেয়ে ঘুমোবি আয় – মেঘেরা তখন গুটিগুটি বুড়ি মার আঁচলের তলায় গিয়ে ঢুকল – নীল আকাশে পাত্র-মিত্র-অমাত্য- কোটাল সাজিয়ে রাজপাটে বসলেন চাঁদমামা, চারিদিক ভেসে গেল পূর্ণ চাঁদের মায়ায় । ... আমি অকৃতি, অধম, বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি ...

    উল্লেখ্য ৩ – গোটা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে আগে ছিল শুধুই পার্বত্য সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। যতই সেখানে নতুন টেকনোলজি, নতুন বাণিজ্য ভাবনা পা রেখেছে, সেই সঙ্গে পা ফেলেছে সমতলের মানুষ, তত-ই প্রকট হয়েছে স্থানীয় আদিবাসীদের উপর ক্ষমতাবানের অত্যাচারের গল্প। নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশেও দিকুরা দখল করেছে জঙ্গলের অধিকার। এবং এই নিয়মটি পৃথিবীর সর্বত্র কম-বেশি চলে – আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান থেকে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবওরিজিন্যাল অবধি। এমন নয় যে অত্যাচারকে সমর্থন করছি । তবে আমার লেখাটি আদিবাসীদের অধিকার-অনধিকার বা তাদের জীবন, কৃতিত্ব নিয়ে থিসিসপত্র নয়, নিতান্ত-ই এক ছোট মাপের মানুষের ভ্রমণ কাহিনী – আদিবাসীদের কথা যেটুকু এসেছে তা বেড়ান’র গল্পের টানে। সেই গন্ডীরেখাটুকু মেনে নিয়ে পড়লে আমার ভালো লাগবে। আসলে আমার ফেসবুকের দেওয়ালে এই লেখাটি পড়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কেন বলা নেই, ওটা কেন আরও বিশদে বলা হল না – এই ভ্রমণ-কাহিনীর পরিসরে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অপারগ। সে কারণে এই কৈফিয়ত।

    উল্লেখ্য ৪ – বান্দরবনের সরকারী নাম বান্দরবান। স্থানীয় ভাষায় এর অর্থ নাকি dam of monkeys. সেই অর্থেও হয়তো বান্দরবানই হওয়া বেশী যুক্তিযুক্ত। তবে আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, আমি আমাদের ভ্রমণসঙ্গীদের মুখে নামটি বান্দরবনই শুনেছি। এবং পরে নেটদুনিয়ায় দেখলাম বান্দরবান এবং বান্দরবন দুই-ই হাজির। তাই আমি আমার কানে শোনা বান্দরবন নামটিই ব্যবহার করেছি।

    (চলবে)
    দিন ৬
    ---------

    সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন আকাশে রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। প্রকৃতির দুনিয়ায় কিছু দৃশ্য কখনোই পুরোন হয় না। তাই লক্ষ লক্ষ বার দেখা সেই একই সূর্যোদয় আবারো জীবনে নতূন আশা জাগায়। নীচের উপত্যকা বোধহয় সাঙ্গু নদীর উপত্যকা – এ নদী এসেছে অনেক দক্ষিণের থেকে, কত কত জায়গা ঘুরে গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। আরাকান মানে বার্মা, আমার দেখার লিস্টিতে থাকা আরেক দেশ – সেও কি আর কখনো দেখা হবে? কে জানে! সূর্য উঠলেও এখনো তার দাঁত-নখ বেরোয় নি – নীচের উপত্যকা মেঘ-চাদর জড়িয়ে বসে আছে। আকাশ তার রং-ঢং মুছে ফেলে এবার নীলের বিভিন্ন শেডে সাজছে। সার্থক এর নাম নীলগিরি। ঘুরে ঘুরে দেখছি আমরা – এক দিনের অতিথি। এ পাহাড়-জঙ্গল যাদের, তাঁদের কথাও মাথায় ঘুরছে। চট্টগ্রামের এই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সমতলের বাঙ্গালীদের যত না আত্মার মিল, তার থেকে অনেক বেশী মিল আরাকানের মানুষদের। সেই আরাকান যেখানে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের বিদ্রোহী পুত্র শাহ সুজা পালিয়ে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন , বিনিময়ে জুটেছিল শুধু বিশ্বাসঘতকতা। রবীন্দ্রনাথের দালিয়া মনে আছে নিশ্চয়। কবির কলমের গুণে এক নগ্ন নিষ্ঠুর ইতিহাস কেমন মেদুর প্রেমের গল্প হয়ে গেল!

    আরাকানও এক ইতিহাসের দেশ – সেই কোন যুগের ( চতুর্থ শতকের ) ধান্যবতী নগরী সে ইতিহাস বহন করছে। তারপর যতদুর পড়েছি, চন্দ্র বংশের আমলে আরাকানের অনেকটাই ছিল হরিকেলা রাজ্যের মধ্যে। রাজা-প্রজা সবাই তখন বৌদ্ধ। তারপর বাংলার আরেক রাজবংশ বর্মণরাও এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। মজার কথা হল আরাকানে মুসলমান ধর্ম কিন্তু উত্তর-ভারতের মত মধ্য-এশিয়াবাসীদের হাত ধরে ঢোকে নি। আটের দশকে এর উপকুলে আরবদের জাহাজডুবির ফলে মুসলিম ধর্ম প্রথম পা রাখে এখানে। তারপর তো পঞ্চদশ শতকে বাংলার মত আরাকানেও প্রচুর মগল-পাঠান ভিড় করে। পরে পর্তুগীজরাও এসে জোটে। ফলে এখানেও সেই “এক দেহে হল লীনের” গল্প। তারপরে ইংরেজরা এল – দ্য গ্রেট লেভেলার – সবাইকে এক করল আবার আলাদাও করল – দেখা গেল আদত আরাকানের খানিক গেল বাংলাদেশে, খানিক বাংলায়, খানিক বর্মায়। এত আরাকানের গল্প শুনে বাংলাদেশে মগদস্যুদের নৃশংস অত্যাচারের কথা মনে পড়ছে তো! আর সাম্প্রতিক রোহিঙ্গাদের উপর বুদ্ধিস্ট মায়নামার আর রাখাইনদের অত্যাচারের কথাও মনে পড়তে পারে। আশ্চর্য এই যে বুদ্ধের শান্তির ললিত বাণী কোথাও আরাকানবাসীর মনের মধ্যের হিংস্রতাকে চাপা দিতে পারে নি! ঠিক আমাদের পঞ্চশীলের দেশের কথা মনে পড়ছে না?

    যাকগে যে কারণে সক্কাল বেলা এত ইতিহাস মনে পড়ল, তা হল এই গোটা আরাকান অঞ্চল নিয়ে অনেক উপজাতির বাস। রাঙ্গামাটি অঞ্চল জুড়ে আছেন চাকমারা – তাঁদের দেশ দেখাও আছে এবারের লিস্টিতে। কক্সবাজার, বান্দরবনে আছেন এই মগরা। ( কেউ কেউ বলেছেন মগ শব্দটি নাকি অপমানকর। এখানে কিন্তু কাউকে কোন অপমান করার জন্য বলা হয় নি। ) অবশ্য মগদের থেকেও এখানে সংখ্যায় বেশী হলেন ম্রো রা। ম্রোদের একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না – এঁদের এক রাজার রানীকে নাকি কুমীর চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিল। সেই কুমীরকে ঠেকান’র জন্য রাজা নদীর পথে পথে বাধা সৃষ্টি করেন – তার থেকে তৈরি হয় ঝর্ণা। এই গল্পটি কোথায় পড়েছিলাম আজ আর মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে কোন এক সাহেব বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এক সরকারী রিপোর্টে এর উল্লেখ করেন। আমরা সুদূর আফ্রিকার উপকথা পড়ি, পড়ে মজা পাই- অথচ ঘরের কাছের এই সুন্দর গল্পগুলো হারিয়ে যেতে দিই। মারমা সহ সব থেরবাদী বৌদ্ধদের এক তীর্থস্থান দেখতে যাব আজ।

    কিন্তু সে তো পরের কথা। তার আগে এখানে ব্রেকফাস্ট সারার কথা। যে কথাটা বলতে ভুলে গেছি, ঢাকা ছাড়ার দিন সেই ভোরবেলা হাসান সাহেব আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এক বিশাল পোটলা। বললেন, এখন গাড়ীতে ওঠেন, পরে দেইখ্যেন। সারাদিনের ঘোরাফেরায় সেটা আর দেখা হয় নি। কাল রিসোর্টে পৌঁছে সেটা খুলে দেখা গেল, এক বস্তা বাখরখানি। আমাদের হা-হুতাশ শুনে আমাদের ড্রাইভার সারা দিন গাড়ী চালানোর পরে আবার পুরোন ঢাকায় গিয়ে অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন। আবার ভোরের বেলায় তুলে নিয়ে এসেছেন। আমাদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। এই আতিথেয়তাকে কি-ই বা বলি!
    যারা জানেন না বাখরখানি কি, তাঁদের জন্য বলি, এটির আদত রেসিপি হল, ময়দা আর খোয়া ক্ষীর মিশিয়ে খুব খুব ভালো করে মেখে তারপর হাত দিয়ে টেনে টেনে লম্বা করা হয় – তারপর নবাবী মাপে তাতে ঘি মাখিয়ে, অল্প শুকনো ময়দা ছড়িয়ে পাকিয়ে নিতে হয়। এই প্রসেসটি কয়েকবার রিপিট করে তারপর তার থেকে গোল গোল রুটির মত বানিয়ে তাকে তন্দুরে চাপান হয়। মাঝরাতে বসে উনুনে, সকালে খাবার জন্য তৈরি ‘শুখা রুটি’ – রুটি না বলে বিস্কিট ই বলা যায়। ছবি দিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু দুঃখের কথা খাবার জিনিস সামনে রেখে ছবি তোলা আমাদের ধাতে সয় না। কাল বিকেল থেকে তাই খেয়ে যাচ্ছি – প্রথম এক দফা চা দিয়ে, তারপর থেকে এমনি এমনি-ই। সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনে অসময়ে চা চাওয়ার সাহস হয় নি আর।


    নীল আকাশের বুকে সেনানীর পতাকা তোলা

    আজ সকালে তৈরি হয়ে গেলাম ব্রেকফাস্টে। এদের খাবার ঘরটি চমৎকার, চারদিকে কাঁচ দেওয়া - খাওয়া হলেও আর উঠতে ইচ্ছে করে না। তবু ব্রেকফাস্টের টেবিলে গিয়েই আমার চক্ষু-চড়কগাছ। টেবিলে সাজান সাবুর খিচুরি আর ফেনাভাত। দুয়ের সঙ্গেই আমার তুমুল দুশমনি। কিন্তু সবাই ভয় দেখাল জলপাই-পোশাকের সেনাদের হাতে বানানো খাবার – খাব না বললে যদি তারা রেগে যান! অগত্যা বেজার মুখে তাই খেতে হল। তবে চুপি চুপি বলে রাখি ফেনাভাতটার চালের গন্ধটা বেশ সুন্দর ছিল। একটু গাঢ় লালচে-খয়েরী ধরণের, চালটাই ছোট না খুদ দিয়ে করা সেটা ভালো বুঝি নি। মেয়ে জানাল, তাকে সৈনিক কাকু বলেছে, ওই চাল নাকি ওখানকার জুম চাষের থেকে পাওয়া। তবে কি এই সেই বিন্নি চাল, এখানে যে খুব হয় শুনেছি? জানি না সে কথা, চাল চিনি না মোটেই। তবে খেতে খেতে দেখলাম, বাবা-মা’র মুখটা এক স্বর্গীয় অনন্দে ভরা – ওঁরা বোধহয় সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছেন যখন সকালে ফেনাভাত খাওয়াই রেওয়াজ ছিল, যে চল এখন হারিয়ে গেছে পাঁউরুটি- কর্ণফ্লেক্সের –ওটসের চটজলদি শহুরেয়ানায়।

    খেয়ে-দেয়ে নীলগিরিকে গুডবাই। ইতিমধ্যেই হাসান সাহেবকে তিনশ চৌদ্দবার জিজ্ঞেস করেছি যে কোথা দিয়ে ওঁরা ট্রেল বানানোর প্ল্যান করছেন! যে মানুষগুলি ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করার সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন, তাঁদের প্রতি ঈর্ষা হচ্ছে। এই এখান থেকে নাকি সোজা গিয়ে পৌছাবেন ওই দূরে দেখা যাওয়া সরু ফিতের মত নদীর কাছে। সাঙ্গু নদীতে নাকি নৌকো করে ভ্রমণের ব্যবস্থাও হচ্ছে। ইস কি মজা! একেকটা গাছ, এই উপর থেকেই দেখতে পাচ্ছি, কি মোটা গুড়ি তাদের আর কতদুর অবধি ছড়ান তাদের ডালপালা, মহারাজের মত দাঁড়িয়ে আছে একেবারে! ভিতর জঙ্গলে না জানি কি অসীম সৌন্দর্যই আছে! পুত্রকে তার বাবা কোলে করে পাখী দেখাচ্ছে – ভরসা পেলাম আর কদিন পরে হয়তো তার অসীম গরুপ্রীতি পাখি প্রীতিতে পরিণত হবে। দাদুও নাতনীকে গাছ চেনাচ্ছেন। কারোরই খুব একটা যাওয়ার ইচ্ছে নেই বলে মনে হচ্ছে। তবু যেতে হবে।

    এবার আমরা যাব বান্দরবন বৌদ্ধ ধাতু জাতি, যাকে সবাই গোল্ডেন টেম্পল বলেন, সেটি দেখতে। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, শৈলপ্রপাতের পাশ দিয়ে , সাঙ্গু নদী পেরিয়ে বান্দরবন-বলাঘাটের কাছে পাহাড়ের উপর তার সোনার চূড়া ঝকঝক করছে। এখানে স্থানীয় থেরবাদী বৌদ্ধদের বিশ্বাস বুদ্ধের শরীরের অংশ রাখা আছে। এই সব চিতাভস্ম বা শরীরের অংশ, তা সে সতীরই হোক বা বুদ্ধের বা নেতাজীর, এই নিয়ে আমার কোন কৌতুহল নেই। তার উপর নেহাতই অর্বাচীন মন্দির – ২০০০ সালে তৈরি – গত কদিন ধরে ঐতিহাসিক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বর্তমান কালকে নেহাতই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্মেরও কিছু বুঝি না। শুধু ঐ থেরবাদী, মহাযান, বজ্রযান এই সব কটা নামই শুধু ইতিহাসের বইতে পড়েছি। তার বাইরে পুরো ফাঁকা – আর সত্যি কথা বলতে কি, থেরবাদী মতকে পুরো গুরুবাদী লাগে ( অপক্ক জ্ঞানের কারণে এমন মনে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক ) আর তিব্বতী বজ্রযানী ভৈরব বা মহাকালের মূর্তি দেখলে বেশ অস্বস্তি লাগে। বুদ্ধের করুণাঘন রূপের থেকে শতযোজন দূরে যেন! এই সবের জন্য খুব ধর্মটিকে বোঝার ইচ্ছেও হয় নি( যদিও এই না বোঝার ইচ্ছেটাকে গ্লোরিফাই করতে চাই না ) । তাই আলগা আলগা চোখ বোলাচ্ছিলাম। তবে জায়গাটা গ্ল্যামারাস সে বাবদে সন্দেহ নেই। কিন্তু নজর কাড়ল পাশের একটি ছোট ঘর – সেখানে দেওয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে দুটি কৌতুহল-জাগানো জিনিস, একটি তুচ্ছ ক্যালেন্ডার, কিন্তু অসামান্য এই কারণে যে মারমা শিল্প গোষ্ঠীর এই ক্যলেন্ডারে তাঁদের বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের ছবি রয়েছে। আর অন্যটি একটি বর্ণমালার ছবি – সেটা আমাদের বলা হল, বারমিজ ভাষার অক্ষরমালা, সত্যি মিথ্যে জানি না। ( ছবি রইল সঙ্গে। জানলার ফাঁক দিয়ে তোলা, ছবি হিসেবে খুব উচ্চাঙ্গের নয় মোটেই,তবু কন্টেন্টটা ইন্টারেস্টিং। ) তারপর নেমে এসে একটি স্থানীয় কাফেতে ঢুকলাম। সকালের চা’টা ঠিক জমে নি, এককাপ গরম চা দরকার – প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চা এল। ব্যাগের থেকে বেরোল বাখরখানি। জমাটি।


    মারমাদের বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের ছবি


    অক্ষরমালা


    পথের পাশের সুচারু গেট

    চলেছি কক্সবাজার অভিমুখে। বাচ্চারা সমুদ্র দেখার জন্য অধীর। আমার আবার মন খারাপ নীলগিরি ছেড়ে নামতে হল বলে। এই পাহাড় আর সমুদ্রের বখেড়া আমাদের চিরকালের। বাড়ীর সবাই সমুদ্র-অভিমুখী আর আমি শুধু পাহাড়ু। কি আর করা! তবে এবার দুটোই আছে লিস্টিতে এটাই সবার আনন্দ। তবে সমুদ্র দেখার আগে আজকে আরও কিছু বাকী আছে। মাঝখানে আমরা থামলাম আরেকটি তীর্থস্থান দেখতে। রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার। ইতিহাস শুনতে শুনতে সবার নিশ্চয় কান পচে যাচ্ছে! কিন্তু কি আর করা! সব জায়গাগুলোই এমন ইতিহাসময় যে কি আর বলি! নেহাত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত কলমের জোর নেই, নাহলে এই সব জায়গাগুলোতে দাঁড়ালে বেশ চোখের সামনে ইতিহাস বই-এর চরিত্ররা ঘোরাফেরা করেন । যাই হোক স্থানীয় লোকগাথা অনুযায়ী বুদ্ধদেব নিজে নাকি এখানে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আনন্দ। পালযুগে যাকে রম্যভূমি বলা হত, সেই সুন্দর দেশের মায়ায় মুগ্ধ বুদ্ধদেব নাকি আনন্দকে বলেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পাঁজরার হাড় যেন এখানে রাখা হয়। সেই রাং থেকে নাকি রাঙ্গু, তার থেকেই রামু। আরবরা একে যে Ruhmi বলে জানতেন, তার থেকেও রামু নাম হতে পারে।

    একটা পাহাড়ের নীচে একটি উঁচু দরজা – বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙ্গে মাঝামাঝি গেলে বৌদ্ধ মন্দিরটি পড়ে। আর দরজার গায়েই একটা ঘেরা জায়গায় হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরজার গায়ে লেখা এটি ৩০৮ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দে তৈরি। আর ভিতরে একটি পরিচয় লিপিতে লেখা এটি সম্রাট অশোকের তৈরি করা। হুয়েন সাং এসেছিলেন এখানে। ছোটখাট ছিমছাম মন্দির। তবে অশোকের আমলের কিছু দেখতে চাইলে মুশকিল। খানিক খুঁজে পাওয়া গেল কিছু পাথরের ভাঙ্গা মূর্তির টুকরো – জানি না সে সত্যিই অতবছর আগের কিনা। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব তীর্থস্থানই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। এই জায়গাটাও কোন ব্যতিক্রম না – ঘন সবুজ গাছের দল পথের পাশে, মুখ তুলে তাকালেই চোখের আরাম, মনের শান্তি! বুদ্ধমুর্তি, তাঁর ধ্যান কতটা মানসিক শান্তি দেয় জানি না, কিন্তু এই প্রকৃতির দিকে চোখ মেলে চাইলেই মনের শান্তি একেবারে স্থির-নিশ্চিত। তবে এই জায়গার সম্বন্ধে আরও বলে যে রাম নাকি বনবাসে থাকার সময় সীতা আর লক্ষ্মণকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। যার নেট ফল এখানে একটি হিন্দু-মন্দিরও আছে। সর্বধর্ম সমন্বয়ের উদাহরণ-ই বলা যেত, যদি না ২০১২ সালে এখানে একটি দাঙ্গা হত। অবশ্য কোন দেশেই বা আর সেরকমটা হচ্ছে না! ধর্ম যখন রাজনীতির অংশ হয়, তখন এটা অবশ্যম্ভাবীও।

    এরপরে আর থামাথামি নেই কোথাও, সোজা কক্স-বাজার, নিতল-বে হোটেল। অবশ্য হোটেলের নামটা শুধু ইংরাজীতেই দেখেছিলাম, Nitol bay – বাংলায় নামটা আমিই এমন করলাম। সমুদ্র বোধহয় নিটোল হয় না , হতে পারে না। আর বঙ্গোপসাগরের পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে তলহীন মনে হওয়ারই কথা। হোটেলটা সুন্দর, আরও সুন্দর হোটেলের রেস্তরাঁর নাম – পানকৌড়ি। আহা! হোটেলটা ভালো লেগে গেল এক মুহূর্তে।
    কক্সবাজারে অবশ্য আমরা বেশ দুঃখ নিয়েই গিয়েছিলাম। আমরা হলাম সেই সব আদিম, বর্বর মানুষের দল যারা সমুদ্রের ধারে গিয়ে সমুদ্রেই স্নান করি। আল্ট্রা-ভায়লেট রে, সানস্ক্রিন লোশন এই সব নিয়ে অন্তত স্নানের সময় মাথা ঘামাতে আমরা পছন্দ করি না। আর খুব পছন্দ করি একেবারে সমুদ্রের উপরে থাকতে যেখানে প্রতিটা মুহূর্ত সমুদ্র সঙ্গে থাকে তার সব রূপ-রস-হাওয়া নিয়ে। কক্সবাজারে দুটোরই সম্ভাবনা নেই – হোটেলটা বীচের থেকে দ্বিতীয় সারিতে, কাজেই স্নান করা যাবে না, আর দিশি-দিশি-সমুদ্রবাসও হবে না। কি আর করা যাবে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে আমরা যাব ইনানী বীচে। সেখানে পায়ের পাতা ডোবান জলে শুধু স্বপ্ন-স্নান। ঘন-সবুজের পাশ দিয়ে হিমছড়িকে এক পাশে রেখে রাস্তা গেছে ইনানীর দিকে। এই রাস্তাটি ভারি সুন্দর, দেখলেই মনে হয় যতদূর চলে, ততদুর চলে যাই।

    এই রাস্তা দিয়ে চলে গেলেই টেকনাফ। সীমান্তের শহর – শুনেছিলাম বার্মিজ হাট বসে সেখানে। বার্মিজ কথাটি হয়ত পলিটিক্যালি অশুদ্ধ, হয়তো আদতে স্থানীয় রাখাইনরা চালায় সে হাট, ঠিক জানা নেই – কিন্তু বার্মিজ সংস্কৃতি তো বটে! কিন্তু সেখানে যাওয়া হবে না আমাদের – সময় নেই। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম যে এই সিদ্ধান্তটি ভারী ভুল ছিল, টেকনাফ যাওয়া অতি অবশ্য উচিত ছিল। কিন্তু তখন আর সিদ্ধান্ত ফেরত নেওয়ার উপায় নেই। সেদিন অবশ্য খানিকটা সে রাস্তায় এগোলামও – মাছের গন্ধে বাতাস ভারী হতে শুরু করল। এদিকে সূর্য পাটে নামছে, আমাদের তাঁর সঙ্গে একেবারে ডোবার মহামুহুর্তে দেখা করার কথা ইনানী বীচে- ইনানী বীচ শান্ত হয়ে সেই মহা-লগনের অপেক্ষা করছে – দূর দূর থেকে নৌকা গুলি ভেসে ভেসে এসে পাল নামিয়েছে সমুদ্রসৈকতে – আমদের চেনা ধাঁচের নৌকোর থেকে সামান্য একটু অন্য দেখতে সাম্পানগুলো কি এক অচেনা সুদূরের সুর বয়ে আনে কানে - বাতাসও যেন গাছের পাতাগুলির কানে কানে ফিসফিস করা বন্ধ করে চুপটি করে কিসের অপেক্ষা করছে - অনেক দূরে ওই জলের মধ্যে তিনি ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছেন, দূর থেকে দেখে এই শ্যামল তটভুমি দেখে তাঁর কি রোজকার মতই আবারো মনে হচ্ছে,
    “দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
    আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্দ্ধারানিবদ্ধের কলঙ্করেখা॥”
    কি আশ্চর্য সুন্দর এই বেঁচে থাকা!

    ( এখনো ভ্রমণের অনেকটাই বাকী। কিন্তু বুঝতে পারছি না কেউ পড়ছেন কিনা। যদি কেউ ধৈর্য ধরে এতদুর পড়েন, তাহলে একটু হাঁকাড় দিয়েন প্লীজ। তাহলেই আবার গড়গড়িয়ে চলবে। নাহলে ইতি প্রথমঃ সর্গঃ। )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ৩৩৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বাউণ্ডুলে বান্দা | ***:*** | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৬:৪৯61873
  • পরের পর্বগুলো আরও তাড়াতাড়ি আসুক !
  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:২৬61874
  • ব্রেভো! তারপর?
  • Muhammad Sadequzzaman Sharif | ***:*** | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:২৪61877
  • আচ্ছা, আমার মন হয় এক নজর দেখেই বলে দেওয়া ঠিক হয়নি। কি নদী জানতে হলে আসলে কোন পথে নওগাঁ গিয়েছেন তা জানতে হবে। আপনি যদি ভিন্ন পথে ঘুরে ফিরে গিয়ে থাকেন তাহলে পদ্মা নদী পার হতেও পারেন, কিন্তু যদি সবাই যে পথে যায় বা ঢাকা থেকে সহজ যে পথ সেই পথে যান তাহলে আপনি বড় একটা সেতু পার হয়েছেন, তা হচ্ছে যমুনা নদীর ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতু। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, সেতু পার হলেন, গেলেন সিরাজগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া, তারপর নওগা।
  • Muhammad Sadequzzaman Sharif | ***:*** | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:১৭61875
  • অসাধারণ। পুরো অভিজ্ঞতা জানার অগ্রহে থাকলাম। একটু তথ্যগত সাহায্য করি। আপনি যেটাকে পদ্মা বলছেন তা আসলে যমুনা নদী। ভালবাসা থাকল।
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৯:১১61876
  • @বিপ্লব ছবি দিতে হলে সেগুলো postimage.org সাইটে গিয়ে আপলোড করুন। তারপর ওখানেই তোলা ছবির একটা লিঙ্ক দেবে, সেটা এনে লেখার মধ্যে লাগিয়ে দিন। ব্যস।

    @Muhammad Sadequzzaman Sharif এম্মা! ওটা পদ্মা নয়! আমি যে গত ন'বছর ধরে ওকেই পদ্মা ভেবে তুমুল আবেগে আবেদাপ্লুত হয়ে আছি! সব আবার রিওয়াইন্ড করতে হবে ! কি বাজে ভুল! ... তবে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ঠিক টি জানানর জন্য ।
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:৪৭61878
  • নাঃ আপনিই ঠিক বলেছেন মনে হয়। কারণ আমার আবছা মনে পড়ছে আমি বঙ্গবন্ধু সেতু পেরিয়ে গেছি। আর বগুড়াতে নেমে মিষ্টি খেয়েছি। অতএব ...
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৫:০৫61879
  • #জলছবি- বাংলাদেশ
    দিন- ২

    গত সন্ধ্যে থেকেই শুধু গল্প আর গল্প। নিতান্ত-ই ব্যক্তিগত স্মৃতি দিয়ে ভরে তুলতে চাই না – তবু একটা কথা বলতে পারি। লোকে বলে বোনেতে বোনেতে দেখা হলে গল্প ফুরায় না – ভাইতে ভাইতে দেখা হলেও কম কিছু হয় না। রাতেই ঘুরে এসেছি আমার বোনের বাড়ি। সে একটি ঝমকঝামক বিউটি পার্লার চালায়। স্বামী-পুত্র নিয়ে ভর-ভরন্ত সংসার সামলেও। মেয়েদের স্বয়ং-সম্পূর্ণা রূপটি দেখতে বড় ভালো লাগে – তাই মনটা ভরে গেল। হরেক রকম গল্পের মাঝখানে আমার মাথায় ঘুরছে আমার দিদার কথা। সম্পন্ন ব্যবসায়ীর ঘরে জন্ম। দিদার বাবা আবার লক্ষ্মীর সন্ধানে ঘর ছেড়েছিলেন। ফরিদপুরের খোলাবেড়িয়া থেকে এসে ঠাঁই পেতেছিলেন পাড়-নওগাঁতে। দিদা বাপের আদুরে মেয়ে ছিলেন। সুন্দরী। সাত বছরে বিয়ে। বিয়ের দিনও নাকি গাছ-কোমর বেঁধে গাছে চড়েছিলেন। বিয়ে হয়ে চলে গেলেন আবার সেই ফরিদপুরে। নিজেদের আদি বাড়ী খোলাবেড়িয়া থেকে মাইলখানেক দূরের খানখানানপুর রেল স্টেশন ( এরই কাছে গোয়ালন্দ – রাজবাড়ী ) , তারপর বসন্তপুর, তারপরেই শিবরামপুর। দেশের বাড়ির কাছে, তবু বাবা-মার থেকে কত দূরে। শিবরামপুর থেকে অম্বিকাপুর হয়ে ফরিদপুর – ট্রেন ছুটবে পোড়াদা হয়ে সান্তাহার – সেখান থেকে টমটমে চেপে তবে আসবে বাপের বাড়ির দ্যাশ। কি মনে হত পরে, যখন বাপের বাড়ি আসতেন? পুতুল খেলার বাক্স টেনে নামাতে ইচ্ছে হত কখনো? আনাচে কানাচে জন্মে থাকা গাছগুলোর গায়ে গায়ে খুঁজতেন ফেলে যাওয়া শৈশবের গন্ধ? নাকি দীর্ঘকালের শ্বশুরালয়বাস তাঁকে শৈশব ভুলিয়ে দিয়েছিল? কি জানি!

    ভোরবেলা থেকেই শুনছি সবাই বেড়াতে বেরোচ্ছে, আমিও এক ফাঁকে সঙ্গ নিলাম তাঁদের। ব্রীজ পেরিয়ে নাদুস-নাদুস থ্যাবড়া-নাকী হেলেদুলে-হাঁটা হাঁসের দলের পিছন পিছন চলে গেলাম কাকার দোকানে। বড় বাসনের দোকান। ভাই সামলাচ্ছে সেই দোকান। ছোট্ট কুট্টি ভাইটাকে ছোটবেলায় দেখে কখনো মনেই মনে হয় নি সে একটা ভারিক্কি গোছের ব্যবসায়ী হয়ে উঠবে। বেশ মজাই লাগল।

    আর কত ধরণের বাসন! মানুষের কত কিছুই না লাগে কাজে। তবে কাকা বাসনের কারবারের সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্যই সেদিন একটা নতুন অভিজ্ঞতা হল। হাতে হাতে বাসন বানান দেখলাম। হাপরের আগুনে ধাতুকে নরম করে তারপর সেই পাতকে একটি উঁচু বেদীর ঊপর রেখে তার চারপাশে অনেক জন মিলে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে এক দুরবোধ্য সুরের সঙ্গে তালে তালে হাতুড়ির ঘা মারছেন, আর ধাতুর তালটি ধীরে ধীরে বাসনের চেহারা নিচ্ছে। নিখুঁত টিমওয়ার্ক। পুরো পর্বটির ছন্দে বিভোর হয়ে থাকতে পারলেই ভালো – যদি না চোখে ভাসে মানুষগুলোর দড়ি পাকানো ক্ষয়া চেহারা। আসলে শারীরিক শ্রমের জগতের বেশী সংখ্যার মানুষের অল্প আয় আর যন্ত্র দুনিয়ার কম মানুষের হাতে সামান্য বেশী পয়সা কোনটা যে উপমহাদেশের জন্য ভালো সেটা আজও বুঝে উঠি নি। শুধু এইটুকু বুঝি যে তলার ধাপে থাকা মানুষদের এক্সপ্লয়টেসনটা গ্যারান্টিড।

    বাসন তৈরি হচ্ছে




    কাকা-কাকীমার আদর খেতে খেতে যাওয়ার ইচ্ছে আর ছিল না – তবু যেতে হবে। গোনা-গুনতি দিন হাতে – তাই সময় সবচেয়ে মুল্যবান এই ক’দিন। তাই ঢিমা তালে তৈরি হতে হতে একসময় এসে গেল বিদায়ের ক্ষণ। ঢেঁকি-ঘর, আমগাছ সব নিয়ে পাড়-নওগাঁ পরে রইল নিজের কোণটিতে। আমরা চলতে শুরু করলাম। আমাদের আজকের পথ অতি দীর্ঘ। পাহাড়পুর যাব প্রথমে। সোমপুর মহাবিহার। সেই কোন কালে ইস্কুলে ইতিহাসের ক্লাসে পালরাজাদের কীর্তিকলাপ পড়েছি। সেই পালরাজ গোপালের ছেলে ধর্মপাল তৈরি করান এই বৌদ্ধ বিহার। আটশ সালে নাগাদ – মানে ১১০০ বছর আগে। ধর্মপালের পরে দেবপাল, আরও পরের পাল রাজাদের দাক্ষিণ্যও পেয়েছিল এই মহাবিহার। বিশাল, ছড়ানো জায়গা নিয়ে তৈরি – অনেক ঘর, চৈত্য আর অনেক বাড়ী। এখন ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট এটা - খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। একটা ছোট খাট মিউজিয়াম-ও আছে। বিক্রমশীলা বা নালন্দা বা ওদন্তপুর বিহার দেখিনি এখনো - সোমপুর বিহার-ই প্রথম দেখলাম। আমার চিরকালই ক্যাম্পাস ইউনিভার্সিটির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। যাদবপুরে যদিও বা আমরা ছোট্ট একটা ক্যাম্পাস পেয়েছি, অনেকের তো সেটুকুও জোটে না। তার উপর আবার অতীশ দীপঙ্করের মতন মহামহিমকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া! তাই আমাদের সেই সব পূর্বপুরুষদের প্রতি বেশ খানিকটা ঈর্ষাই হল। তবে মে মাসের গরমে ওই বিশাল ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান মোটেই বিশেষ সুখকর স্মৃতি নয়। ছাতা, টুপি, সানগ্লাস সব অস্ত্র সাজিয়েও কিছুতেই সূর্যদেবকে কাবু করা যাচ্ছে না। তাই দেখার শেষপর্ব সারা হল খুব তাড়াতাড়ি। তবু তারই মাঝে সুন্দর টেরাকোটার প্যানেলগুলো চোখ এড়াল না। বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মত সূক্ষ্ম কাজ নয়, তবু বেশ সুন্দর। তবে একটা দুঃখ হল যে – এত বড় একটা ঐতিহাসিক জায়গা – তবু কোন গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা নেই! অথচ একজন সুকথক গাইড যে কিভাবে ইতিহাসকে চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলতে পারেন! আর বাংলাদেশে মনে হয় হরিহর রায়’দের অভাব হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের জায়গায় জায়গায় যেন ইতিহাস বই পাতা খুলে বসে আছে – একটু সরকারী তরফে সচেতনতা থাকলে হয়তো নাগরিক জীবনে ইতিহাস জ্ঞান বাড়ত একটু। আর নিরপেক্ষ ইতিহাসের ধারণা যে কোন মানুষকে সমৃদ্ধতর করে বলে আমার ধারণা।

    সোমপুর বিহার


    তার টেরাকোটার প্যানেলঃ


    পরের গন্তব্য ইতিহাসের আরও গহনে। খৃষ্টজন্মেরও তিনশ বছর আগের এক জায়গা। পৌণ্ড্রবর্ধন। নামটা চেনা চেনা লাগছে তো – হ্যাঁ মহাভারতেও আছে এই জায়গার কথা। এরই আজকের নাম মহাস্থানগড়। করতোয়া নদীর ধারে। প্রায় দুই কিলো মিটার করে লম্বায়, চওড়ায় জায়গা জুড়ে এক বিশাল আরকিওলজিক্যাল সাইট। একেবারে খাঁটি অনার্য রাজ্য ছিল আদতে। তারপর মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন সব রাজারা এসেছেন , গেছেন – জায়গাটার রমরমা ছিল অনেক অনেক দিন ধরে। এই জায়গাটা নিয়ে একটা মজার গল্প পড়েছিলাম। এখানে নাকি শাহ বলখি মাহিসওয়ার বলে একজন ফকির মাছের পিঠে চেপে এসে হাজির হন। পারো’র টাইগার’স নেস্টে ও তো গুরু পদ্মসম্ভব বাঘিনীর পিঠে চেপে এসে নেমেছিলেন। মানুষ চিরকালই গুরুবাদে বিশ্বাসী আর সেই গুরুরাই বেশি বিখ্যাত যাদের নিয়ে এই ধরণের অবাস্তব গল্প চলে বাজারে। সে যাক গে। এদিকে ফকিরের সঙ্গে রাজার যুদ্ধ বাধে। এদিকে মহাস্থানগড়ে একটি কুয়ো ছিল যে কুয়োর জলে স্নান করলে মৃত সৈনিকরাও প্রাণ ফিরে পেত। তাই রাজাকে কিছুতেই হারাতে পারছিল না ফকির। শেষে এক চিলকে দিয়ে একটুকরো গরুর মাংস সেই কুয়োর জলে ফেলানো হয়। ব্যস খেল খতম। রাজার জারিজুরি শেষ। তখন রাজার সেনাপতি ভয় পেয়ে বিশাল দলবল নিয়ে ফকিরের দলে যোগ দেন। রাজা আত্মহত্যা করেন। ফকিরের একটি মাজারও আছে এখানেই। গল্পটা পড়েই মনে হয়েছিল, কি নিদারুণ ভাবে একটা মানবিক বিশ্বাসঘাতকতার গল্পকে চাপা দেওয়া হল একটি অবাস্তবতা আর ধর্মীয় বিভেদের জুজু দিয়ে। এই সব হিজিবিজি গল্প শুনেই আর বিশেষ আগ্রহ ছিল না জায়গাটার প্রতি। তার উপর ড্রাইভার জানালেন এখানেও কোন গাইড নেই। যা দেখার নিজেদের খুঁজে পেতে দেখতে হবে। এ দিকে তার আগে চড়া রোদে সোমপুর বিহারে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে সবাই আধা-বিধ্বস্ত। কারোরই আর বিশেষ দেখার গরজ নেই। অগত্যা বললে বিশ্বাস করবেন না, আমাকে অন্য কেউ বললে আমি হাঁ করে ঘণ্টা দুয়েক তার দিকে তাকিয়েই থাকতাম, আমরা মুল জায়গাটার বাইরে নেমে ঠিক দু মিনিট এপাশ ওপাশ দেখে আবার গাড়ীতে উঠে পড়লাম। একটা তিনশ বিসির জায়গা! আর কোনদিন আসা হবে না তা খুব ভালো করেই জানি। সামনে দিয়ে ফিরে চলে এলাম। কি আর করা! প্রথম দিনেই রোদ লেগে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুরো ঘোরাটাই মাটি। বিপদের সময় অর্ধেক ত্যাগ করারই নিয়ম। অগত্যা।

    মহাস্থানগড়


    চলো, চলো এগিয়ে চলো। যেতে হবে অনেক দূরে। সেই নাটোর হয়ে কুষ্টিয়া। আমাদের যিনি ড্রাইভার ছিলেন, কি লজ্জা, কি লজ্জা – তাঁর নামটা ভুলে গেছি। অসম্ভব সজ্জন, ভদ্র একজন মানুষ। এবং তুমুল ভাবে সার্ভিস ওরিয়েন্টেড। তাঁকে চুপি চুপি বলে রেখেছিলাম, নাটোরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দাঁড়াতে। সেই মানুষটি যাকে দিয়ে আমার নিজের আনন্দে বাংলা কবিতা পড়ার শুরু, এবং শেষ – একবার তাঁকে মনে করব নাটোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বেরোতেই দেরী হয়েছে। পাহাড়পুর দেখতেও অনেকটা সময় লেগেছে। মহাস্থানগড় থেকে বেরন’র পরে যখন আমরা নাটোরের পথে আধাআধি যেতে না যেতেই সূর্যিমামা অস্তাচলে যেতে বসলেন। ছড়ানো মাঠের মধ্যে দিয়ে রাস্তা , কোথাও কোথাও গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে পথ ঢেকেছে – কখন যেন সেই ছায়া কালো হয়ে চরাচর ঢেকে দিল। অনেক অনেক পথের পরে, দূরে যখন নাটোরের আবছা আলো দেখা দিল, গাড়ীর মধ্যে তাকিয়ে দেখালাম – বাচ্চা বুড়ো সবাই আধো ঘুম, আধো জাগরণে। গাড়ী আর থামাতে বারণ করলাম – বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে অন্ধকারে বনলতা সেনদের মুখোমুখি বসার সুযোগ কি আর সবাই পায়! এমনি ভাবেই অন্ধকারে পেরিয়ে গেল ঈশ্বরদী – পদ্মার উপরের ব্রীজ পেরিয়ে চলে এলাম দক্ষিণবঙ্গে।

    ব্যবস্থাপকরা চেয়েছিলেন আমরা নাটোরেই রাত্রিবাস করি। সেখানে ব্যবস্থাপত্র ভালো। আমিই ভেটো দিই। আমাদের এ দিনের যাত্রাপথ যদি দীর্ঘ হয়, পরের দিনেরটিও তুল্যমূল্য। তাই চেয়েছিলাম যতটা এগিয়ে থাকা যায়। কুষ্টিয়াতেই থাকতে চাই। বলেছিলাম, পরিস্কার টয়লেট-সহ সেফ ঘর পেলেই হবে। অনেক গড়িমসি করে সেই মত ব্যবস্থাই হয়েছিল। প্রায় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ এসে পৌঁছালাম সেই রাত- কাটানোর আস্তানাটিতে। এসেই চক্ষু চড়ক গাছ। ঠিক বাজারের মাঝখানের হোটেলটি চার তলায়। এবং তাতে লিফট নেই। আমাদের সঙ্গে ছোট বড় মাঝারি হরেক সাইজের হরেক ধরণের লাগেজ – দলে তিন থেকে তিয়াত্তর বছরের লোক – সবাই হাঁ। তবে দায়ে পড়লে মানুষ কি না করে! আমরাও নিজেরা উঠলাম, সব মালপত্র কিছু আমরা তুললাম, কিছু হোটেলের লোক তুলল।

    কিন্তু শেষ হাসি কে হাসল বলুন দেখি? ঘরে সব মালপত্র পৌঁছানর পরে হোটেলের একজন কি একটা দাবী করতে আমি তো তাকে তেড়ে বকুনি দিচ্ছি, এ আবার কি রকম হোটেল- চারতলার উপরে অথচ লিফট নেই – এ রকম ভাবে ব্যবসা হয় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ তিনিও সমান তেড়ে উঠে বললেন , এই সব ‘নরমাল’ শহরে আবার লিফট থাকে নাকি! একি ঢাকা নাকি! আমি তাতেও তেড়ে বললাম, ঢাকা কি এবনরমাল শহর নাকি? ততক্ষণে সবাই হেসে উঠেছে। হাসির মধ্যে দিয়েই তফাতটা মাথায় ঢুকল, নিজের-চোখে-জগত-দেখে-অভ্যস্ত আর চাইলেই-পেতে-থাকা আমাদের মত বড় শহরের মানুষেরা যে তফাতগুলো অনেক সময় প্রায় ধরতেই পারি না।
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৫:১৪61880
  • সব ছবি গুলো আসে নি দেখছি - আবার দিচ্ছি। বাসন তৈরির ছবি -





    সোমপুর বিহারের ছবি


    বিহারের টেরাকোটা প্যানেলের ছবি -
  • | ***:*** | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৫:৫২61881
  • এহে দিন২ এর লেখা আর ছবি কমেন্টে এসে গেছে। ওই আপনার মন্তব্য যোগ করুন বাক্সটা আসলে ড্রপ ডাউন। ওটায় ক্লিকালে নীচে একটা অপশান আসে মূল লেখায় যোগ করুন বা এরকম কিছু। সেটা সিলেক্ট করে তারপর লিখলে মূল লেখায় চলে যাবে
  • Muhammad Sadequzzaman Sharif | ***:*** | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৭:৪৪61882
  • এইরে! মহাস্থানগড় দেখে ঘুরে গেলেন আর বেহুলার বাসর ঘর দেখে আসেননি? মহাস্থানগড় থেকে অল্প একটু দূরেই ছিল। বাকি গল্প শোনার আশায় থাকলাম।
  • SKM | ***:*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:১৫61883
  • জেনর্ড ট্রাভেলস এর English স্পেলিং কি হবে । ওয়েবসাইট আছে কি ?
    কন্টাক্ট ডিটেলস পেলে ভালো হবে ।
  • pepe | ***:*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:২০61884
  • মহাস্থানগড় নাম শুনলেই আমার বাবা আর পিসির মুখে ছোটবেলা শোনা তাদের ছোটবেলার গল্প মনে পরে। কোনোদিন হয়তো সেই জায়গা গুলো দেখতে পাবো না ঃ(
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৫১61885
  • @SKM genord travels এর পুরো নাম

    Genord International ( যতদূর জানি নিজের ওয়েবসাইট নেই )
    কন্ট্যাক্ট - Gautam Sen
    ইমেল genord.international@gmail.com
    ( ফোন নং আর নেই আমার কাছে - এইটা নেটে পেলাম 9830084317 । ট্রাই করে দেখতে পারেন। )

    @দ একসঙ্গে দিন ৩ র প্রথম পর্ব আর আগেই দেওয়া দিন ২ জুড়ে দিলাম মুল লেখায় - যদি না বোঝা যায়, বলবেন একটু।

    @Muhammad Sadequzzaman Sharif কত কিছুই দেখা হল না!
  • | ***:*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৫৭61886
  • সেই ঘরের বৌ-এর আবার অত বৈশিষ্ট্য কী? লোকে মনে রেখেছে এই ঢের!

    আরো পর্ব আসবে আশা করি।
  • | ***:*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:৫৮61887
  • হ্যাঁ এবারে ঠিকঠাক আছে। থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু
  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৩৮61888
  • জল ছবি, দিন ২//

    বগুড়ার মহাস্থানগড় না দেখাটি সত্যিই এক বড় বিপর্যয়। ফকিরের ঢপের গল্পের কতো যে ভার্সান আছে!

    এবার এলে শুধু মহাস্থানগড় দেখার জন্যই অন্তত পুরো একদিন সময় হাতে রেখ। ইউনেস্কো হেরিটেজ। এখন বগুড়ায় অনেক ভাল হোটেল রেস্তোরাঁ আছে। বিশ্রাম নিয়ে আয়েশ করে গড় দেখা যাবে। এখানে খুব সমৃদ্ধ একটি জাদুঘর রয়েছে। গাইডের অভাব পুষিয়ে দেবে প্রচুর বইপত্র।

    বগুড়ার আরেকটি জিনিসের আস্বাদ মিস করে গেছ। সেটি হচ্ছে ঘটির দই। বিশ্ব সেরা দই বগুড়াতেই হয়। আধা কেজি ও এককেজির ঘটির দই, সে এক অমৃত।

    "নাটোরের বনলতা সেন" জীবনানন্দের কবিতার চরিত্র মাত্র। বাস্তবে কবির জীবনে এই নামে কেউ ছিল না। নাটোরে সেন বংশের কারো বাস কখনো ছিল না, প্রাচীন বইপত্রে এর সাক্ষ্য নেই। কাজেই আবেগটি নেহাতই! তবে কবি জীবনে কোন এক "বনলতা" যে ছিলেন না, তাইই বা নিশ্চিত বলি কী করে?

    তবে নাটোরের রাজবাড়ীটি একটি দর্শনীয় স্থান। ইউরোপের অনেক ভাস্কর্য ও নিদর্শন প্যালেসটির পরতে পরতে। নাটোরের কাচা গোল্লা ছেলেবুড়ো সবাই মিস করে গেছ। বিরতিটা সত্যিই দরকার ছিল। আচ্ছা, সে সব পরের বারের জন্য তোলা থাক।
  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৫৭61889
  • জল ছবি, দিন ৩//

    স্বাতী, তোমার ব্যাখ্যা মেনেই ফকির লালনকে তার ভক্তরা #সাঁই (গুরু, প্রভু, স্বামী, পথপ্রদর্শক/গাইড) নামে অভিহিত করেন, আর যাই হোক মরমি বাউল সাধক লালন মুঘলজাত "শাহ" বংশীয় নন। তবে তাকে "লালন শাহ" বলা একটি খুবই প্রচলিত ভুল।

    যেমন, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে, “লালন শাহ সেতু”। বেশকিছু সরকারি নথিপত্র, এমনকি সাইনবোর্ডেও তেমন হতেপারে।

    লালনের নামের সঙ্গে “#সাঁই” এর বদলে মুঘল বংশীয় “#শাহ” জুড়ে দেওয়া একটি প্রচলিত ভুল। যেটি লালনের অনেক অনুসারী বাউল নিজের পদবী হিসেবে নিজেই “শাহ” জুড়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

    কিন্তু এরমানে এই নয় যে ফকির লালন “#শাহ” হিসেবে পরিচিতি পাবেন।

    #

    লালন নিজেই তার একটি গানে ভাব গুরুকে প্রতিষ্ঠা করেছেন --

    "সিরাজ #সাঁই (মোটেই #শাহ নন) কন, কোথায় রে মন, সোনার পালংক এমন?

    লালন কহে, সব অকারণ, মরলে সার হবে মাটির বিছানা"...
  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:০৫61890
  • ও আমার দেশের মাটি//

    "এক আধজন-ই ওখানে বাড়ী আগলে পড়ে আছেন। যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কেমন আছেন তাঁরা। এপাশে সংখ্যালঘুদের আমরা কতটা স্বস্তিতে রেখেছি তার কিছু কিছু খাপচা ছবি জানি। ওপাশে ওঁরা কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় নি – কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।"

    ভাষাহীন, স্বাতী। বুকের ভেতরে খচ করে যেন কাঁটা বিঁধে গেল। হায় দ্যাশ!
  • সিকি | ***:*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৬:১৯61891
  • শেষ অবধি পড়তে পারলাম না। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
  • | ***:*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৬:৩৫61892
  • পড়ছি পড়ছি।
  • সিকি | ***:*** | ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৩৮61893
  • বাংলাকে নিয়ে আবেগের কথা লিখছিলে স্বাতী।

    আবেগকে যদি কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত, তা হলে আবেগের নাম হত যুক্তি। আমার এই যে আমিত্ব, এর থেকে আমার বাংলা ভাষা, আমার বাঙালিত্ব কোনখানটায় আলাদা, ভেবে দ্যাখো? বিশ্বায়নের যুগে আমি চাইলেই আজ ভারতীয় নাগরিকত্বের বদলে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা বা অন্য কোনও দেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারি, ধর্ম বদলে এক্স থেকে ওয়াই ধর্মাবলম্বী হয়ে যেতে পারি, রাজনৈতিক মতাদর্শও বদলায়, শিক্ষিত বামকে ধীরে ধীরে দক্ষিণপন্থী হয়ে যেতে দেখেছি, সব কিছু বদলে ফেলা যায় - নাম, পরিচয়, বাসস্থান, কিন্তু বলো তো, তারপরেও কি আমার বাঙালিত্ব ঘুচতে পারবে? আমি বাঙালি থেকে পঞ্জাবী বা মারাঠি বা তেলুগু হতে পারব? জার্মান হয় তো নাগরিক হতে পারি, কিন্তু সত্যিকারের জার্মান হতে পারব? আমৃত্যু আমি বাংলাভাষীই থাকব। সাড়ে তিনখানা ভাষা "জানি" বলে দাবি করতে পারি, তারপরেও বাংলার জন্য যে আবেগ, সেটা কেবলমাত্র এই ভাষা প্রথম নোবেল পেয়েছিল বলে নয়, এই ভাষায় লেখা গান দু দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীত বলে নয়, এই ভাষার শহীদদের সম্মানে আজ সারা পৃথিবী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানায় বলে নয় - এগুলো তো অ্যাচিভমেন্ট, কোনও অংশে খাটো নয় - তবু আমার এই আবেগ শুধুমাত্র আমার বাংলাময় অস্তিত্বের জন্য। বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক। বাংলা আমার দৃপ্ত শ্লোগান, ক্ষিপ্ত তিরধনুক। বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ।

    বাকি যে দুটো ভাষা ভালো করে জানি, লিখতে-পড়তে-বলতে-বুঝতে পারি, তাদের তুলনায় এই দেশে বাংলা বড় অবহেলিত। বাকি দুটির আগ্রাসনে বাংলা আজ অনেক কোণঠাসা। আবেগটা সে-কারণেও অনেকটা কাজ করে।
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৫১61894
  • @সিকি হক কথা। বাংলাভাষা নিয়ে বলেইছি যে আমি খুব আবেগী। আর আবেগের অনেকটাই হয়ত আসে ওই সবথেকে দুবলা ছেলে হওয়ার কারণে।

    তবে সামগ্রিক ভাবে বাঙালিত্ব বাবদে আমি খুব confused soul. মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যাকে বাঙ্গালিয়ানা বলছি সেটা বোধহয় অন্ধের হস্তি দর্শনের সমতুল্য। জানি না ঠিক।
  • | ***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০২:২১61895
  • কিন্তু ধর্মান্তর বিশ্বায়নে সোজা হয়েছে , এই টা কি তথ্য নির্ভর না ফস কইরা?সিকির পোস্টে?স্বাতী চমৎকার লিখে ছেন, মানে অসম্ভব দরদ। অভিনন্দন, আমার অবশ্য ইমিগ্রান্ট পরিবারে জন্ম হলেও মনে হয়, দেশ ভাগে প্রচুর ঝামেলা হ ওয়া সত্ত্বেও যা হয়েছে ভালো হয়েছে, ওখান কার লোকদের নইলে সারা জীবন দিল্লির সঙ্গে ঝগড়া করে কাটাতে হত।আমার এমনি বাংলাদেশ যাও য়ার কোনদিন ইচ্ছে ছিল না, তবে বড় হয়ে ওয়ালিউল্লাহ, জহির আর ইলিয়াস পড়ে থেকে একটু ইচ্ছে করে একটু ওঁদের সমাধিতে ফুল দিয়ে আসি।
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:০৭61896
  • বড় হয়ে ওয়ালিউল্লাহ, জহির আর ইলিয়াস পড়ে থেকে একটু ইচ্ছে করে একটু ওঁদের সমাধিতে ফুল দিয়ে আসি। - আহা!
  • | ***:*** | ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:৫৬61897
  • ইতিহাস অংশের অনুপপত্তি দূর করতে অণু তারেককে জিগ্যেস করতে পারেন। ওণুর বিশেষ উৎসাহ আগ্রহ আছে ইতিহাসে আর গোটা বাংলাদেশ চক্কর কাটে।
  • | ***:*** | ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:৫৬61898
  • হ্যাঁ পড়তে যে খুবই ভাল লাগছে। এইসব জায়্গায় যেতেও ইচ্ছে করছে সেকথা বলতে ভুলেছি।
  • de | ***:*** | ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০৯:২৭61899
  • এতো সুন্দর করে ঘুরেছেন স্বাতী! পড়া শেষ হওয়া থেকে আমর হাঁ মুখ আর বন্ধ হচ্চে না -

    খুব ভালো লেখাও হচ্ছে - আমারো একবার বাবা-মাকে নিয়ে বাংলাদেশ ঘোরার বড়ো ইচ্ছা - কে জানে কবে হবে!
  • স্বাতী রায় | ***:*** | ১১ অক্টোবর ২০১৮ ০৬:০০61900
  • দ আর de কে অনেক ধন্যবাদ।

    দ, অণু তারেককে পাব কোথায়?
  • | ***:*** | ১১ অক্টোবর ২০১৮ ০৭:০৪61901
  • ফেসবুকে পাবেন Onu Tarq নামে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন