এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বিজ্ঞানের দর্শন: মানবেন্দ্রনাথ রায় # দুই

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ অক্টোবর ২০১৬ | ১৯৪০ বার পঠিত
  • এক | দুই | তিন
    [৩] প্রত্যক্ষবাদ নয়

    তবে শুরুতেই একটা কথা বলে নেওয়া দরকার।

    মানবেন্দ্রনাথ রায় যদি সরলরৈখিক ভাষায় বস্তুবাদের সাধারণ সুপরিচিত সিদ্ধান্তগুলি পর পর বলে যেতেন তাহলে আজ আমাদের কাছে তার কোনোরকম গুরুত্বই থাকত না। তা তিনি করেননি। বরং আমরা দেখব, তিনি বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ে সেই সময়ের সব চেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং বিজ্ঞানের দর্শন আলোচনার গোড়াতেই সেকথা বলে নিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলিকে যে আর আগেকার মতো ধ্রুপদী ভাববাদের সপক্ষে কাজে লাগানো যায় না, এ কথা বিশ শতকের যে কোনো ভাববাদী দার্শনিকই ভালো করে জানতেন। তাই তাঁদের কাছে ভাববাদের দিকে বৈজ্ঞানিক ভাষ্যের ঝোল টানার একমাত্র উপায় হল, বিজ্ঞানের জ্ঞাতব্য বিষয়গুলিকে বস্তুসত্তাক (ontological) ব্যাখ্যার বদলে জ্ঞানসত্তাক (epistemological) ব্যাখ্যার দিকে ঠেলে দেওয়া। একথার অর্থ হল, বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা ‘কাকে জানছি’, এই প্রশ্নের পরিবর্তে আমরা ‘কীভাবে জানছি’—এই প্রশ্নকে বেশি করে সামনে নিয়ে আসা। ভালো করে লক্ষ করলে এটা সহজেই বোঝা যাবে, প্রথম প্রশ্নটির মধ্যে মনে মনে স্বতঃপ্রকটভাবে জ্ঞেয়-কে জ্ঞাতার থেকে আলাদা বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তার ফলস্বরূপ জ্ঞেয়-র অস্তিত্বকে সেই সঙ্গে জ্ঞাতার জানার প্রচেষ্টা নিরপেক্ষ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। যাকে জানতে চাই সে আমার জানার চেষ্টা শুরু করার আগে থেকেই আপন নিয়মে এবং বৈশিষ্ট্যে অস্তিত্বশীল -- এটা ধরে নেওয়া হচ্ছে। আমি তাকে জানি বা না জানি, সে আছে। এই ধরনের জ্ঞানতত্ত্ব স্বভাবতই আপনাকে বস্তুবাদের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু উপরোক্ত গোড়ার প্রশ্নটি বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে ‘কীভাবে জানছি’-- এই দ্বিতীয় প্রশ্নের মধ্যে শুরুতেই একবার জড়িয়ে পড়লে আমরা আমাদের অগোচরেই জ্ঞেয়-কে জ্ঞাতা নিরপেক্ষ বলে ভাবার বদলে জ্ঞাতব্যকে জানার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঢুকিয়ে ফেলব। কেন না, যখন জানছি, তখন জ্ঞাতার সাথে আমাদের মিথষ্ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তখন আর সে আমাদের জানার প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে অস্তিমান নয়।

    এই হচ্ছে ভাববাদ বা আধুনিক প্রত্যক্ষবাদের প্রাথমিক স্তম্ভ।

    রায় সমস্যাটা ধরতে পেরেছিলেন। তাই তিনি এই ব্যাপারে সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, “বিজ্ঞানের সবটাই কেবল মূর্ত ঘটনা নয়, কিংবা কেবল বিশুদ্ধ চিন্তার অর্থাৎ দূরকল্পনার সৃষ্টিমাত্র নয়। . . . বিজ্ঞান দুটি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটি হল অভিজ্ঞতা, অর্থাৎ, নিরীক্ষণজাত তথ্য, আর অপরটি হল সেসব তথ্যের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী একটি সাধারণ নিয়ম। প্রথমটি পেতে হয় “বাহ্যিক জগত” থেকে, দ্বিতীয়টি হল বিজ্ঞানীদের অবদান।” কেন না, “বিজ্ঞানীর মনগড়া কল্পনা থেকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সৃষ্টি হয় না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে হলে অনেক কিছু কাঁচা মাল-মশলার প্রয়োজন হয় এবং বিজ্ঞানী তার বুদ্ধি ও কলা কৌশলের সাহায্যে সেই সব মাল-মশলা মিশিয়ে নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গড়ে তোলেন। আশু অভিজ্ঞতাসমূহকে সমন্বিত করে একটি নিয়মপদ্ধতির মধ্যে বিধিবদ্ধ করতে হলে বিজ্ঞানীর অবশ্যই কিছু পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।” [Roy 1947, 20]

    এখানেই তিনি থেমে যান না। স্মরণ করিয়ে দেন, “এর পরেই এক প্রশ্ন জাগে: কিসের অভিজ্ঞতা? উত্তরটা যদি হয়, অভিজ্ঞতাটা হল জ্ঞাতার চেতনার বাইরে যে বস্তুসমূহ আছে সে সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা, তাহলে দর্শন বলতেই বোঝাবে একমাত্র বস্তুবাদকে, যদিও তাতে জ্ঞানের জ্ঞাতৃকেন্দ্রিক উপাদানগুলি উপেক্ষিত থাকবে না।” [Ibid, 21] রায় তাঁর দার্শনিক অবস্থান এখানে সুনির্দিষ্ট করে বলে দেন।

    তবে রায় আবার এও বলেন, অভিজ্ঞতার পেছনে “একজন জ্ঞাতা আছেন”, এবং “বাহ্য জগতের সবকিছু থেকে এই জ্ঞাতার অবস্থিতি যে পৃথক” সেটা ধরে নিলেও “বস্তুত “বাহ্যিক জগত” একটি বিভ্রান্তি উৎপাদক শব্দ”, কেন না, জ্ঞাতাও এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। [Ibid, 21] তিনি এও বলেন, “একদিকে পদার্থবিজ্ঞান অন্যদিকে জীববিজ্ঞান এমন এক জায়গায় এসে মিলেছে যেখানে “বাহ্যিক জগত” শব্দটি অর্থহীন হয়ে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী সব আবিষ্কারের আলোতে অবভাস ও বাস্তব সত্তার মধ্যে যে কৃত্রিম ব্যবধান ছিল তা অবশ্যই লোপ পাবে।” [Ibid, 24]

    স্বীকার করতেই হবে, রায়ের এই জাতীয় কথাগুলি সামান্য হলেও বিজ্ঞানের দর্শনে আলোচনার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা “বিভ্রান্তি উৎপাদক”। এই বাক্য থেকে একই সাথে দু-রকম সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। যেমন, কেউ বলতে পারেন, অবভাস আর বাস্তব সত্তার মধ্যে ব্যবধান এমনভাবে মিলিয়ে গেছে যে আমরা যা কিছু জানতে পারি তা আসলে অবভাস বৈ অন্য কিছু নয়। আবার অন্য কেউ এও বলতে পারেন, আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে অবভাসের কোথাও কোনো জায়গা নেই; যা কিছু আমরা জানছি তার সবই বাস্তব সত্তারই জ্ঞান।

    সুতরাং জানতে কৌতূহল হয়, রায় নিজে কোন মতটির পক্ষে।

    “এখন আমরা সেই প্রশ্নে ফিরে আসি। কিসের অভিজ্ঞতা? আমরা কি বাস্তব সত্তার অভিজ্ঞতা লাভ করি, নাকি অবভাসের? (মানুষের যেটুকু জ্ঞান তা যে বাস্তব সত্তার সম্বন্ধেই জ্ঞান -- অবভাস মাত্র নয়, সে সম্বন্ধে) আগে যে সব কথা বলা হল তারপরে এ প্রশ্ন আর ওঠে না।” [Ibid, 24-25] বোঝা যাচ্ছে, মানবেন্দ্রনাথ স্বয়ং খুব ভালোভাবেই সচেতন যে তাঁর উপরোক্ত মন্তব্য থেকে এরকম একটা অর্থদ্বৈধ (ambiguity) ঘটতে পারে। তিনিও লক্ষ করেন যে বিংশ শতাব্দের পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কারের দোহাই দিয়ে একদল বিজ্ঞানী “নতুন এক অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে” দাবি করেন, “আমরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করি তা বাহ্য জগত সম্বন্ধে নয়, তা হল আমাদের ইন্দ্রিয়াদির সংবেদন সম্বন্ধে, এবং বাইরের বস্তুর সঙ্গে এই সমস্ত সংবেদনের কতখানি মিল আছে তা আমাদের জানার কোনো উপায় নেই।” এই সব মতবাদ বিস্তৃতভাবে তুলে ধরার পর তিনি মন্তব্য করেন, “এই সব কথার অর্থ পদার্থবিজ্ঞানের বিলোপ সাধন ছাড়া আর কিছু নয়।” [Ibid, 25-26] অর্থাৎ, যিনি পদার্থবিজ্ঞানের বিলোপ সাধন হোক চাইবেন না, তাঁর পক্ষে ওই সব অবভাসপন্থী বক্তব্য মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

    এইভাবে রায় তাঁর বইয়ের শুরুতেই প্রত্যক্ষবাদের বিরুদ্ধে বস্তুবাদের দিকে আমাদের মনকে খানিকটা তৈরি করে নেন। পরেও তিনি আবার অন্য প্রসঙ্গে এই কথায় ফিরে আসেন এবং দৃঢ়ভাবে দাবি করেন: “The new knowledge about the substratum of the world does not imply a denial of the reality of matter. The problem raised is about the structure of the ultimate substance.” [Ibid, 86] “The physical world exists. It is not to be constructed by the mind of man. It is there, to be studied, explained, known, understood. That is the function of science.” [Ibid, 100] বিজ্ঞান সেই কাজই করছে এবং সে বস্তুজগতের মূলে এমন কিছু আবিষ্কার করেনি যে সবটাই শূন্যে মিলিয়ে গেছে। বস্তুর আগে সে মনকেও বসায়নি। বরং সে বস্তুর স্বয়ম্ভূতিকেই সিদ্ধ করেছে। “Matter is an objective category. Self-sufficient objectivity is the ultimate reality. Therefore matter is the only reality. It is ontologically real. Its epistemology logically follows.” [Ibid]

    সেদিনকার কোপেনহগেনপন্থীদের প্রত্যক্ষবাদী ভাববাদী বিজ্ঞানভাষ্যকে এইভাবে বিরোধিতা করে বস্তু সম্পর্কে লেনিনের প্রসিদ্ধ সংজ্ঞাকে রায় অনেকটা যেন পাঠ্যপুস্তকের ভাষাতেই বিদ্যায়তনিক দর্শন-চর্চায় প্রতিষ্ঠিত করে দেন।

    [৪] আপেক্ষিকতাবাদ

    এবার দেখা যাক, তিনি আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

    একথা সকলেই জানেন, ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন যে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, তাতে দেশ কাল গতি সম্পর্কে শুধু সাধারণ মানুষের নয়, বিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ধারণায় এক বিরাটা ধাক্কা লেগেছিল। নিউটনের প্রবর্তিত গতির নিয়ম এবং দেশ কালের চিত্র -- যাকে এযাবত কাল শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এমনকি বিজ্ঞানীরাও মনে করে এসেছেন অখণ্ডনীয় সর্বজনীন নিয়ম হিসাবে, সেই সব যেন এক ধাক্কায় বিশ্ব জগতের এক কোণে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। ভ্রান্ত নয়, আবার সর্বত্র প্রযোজ্যও নয়। তবে, আজ একথা মনে রাখা দরকার, ধারণায় বৈপ্লবিকতা থাকলেও সেই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব বুঝতে খুব অসুবিধা হয়নি। তার গাণিতিক কাঠামোও এমন কিছু বিরাট জটিল ব্যাপার ছিল না। ফলে তার উপর অনেক বই লেখা হয়েছে। লোকপ্রিয় গ্রন্থও বেরিয়েছে অনেক। কিন্তু তার দশ বছর পরে আইনস্টাইন যখন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব নিয়ে এলেন, তা অত সহজবোধ্য ছিল না, তার অঙ্কও অত্যন্ত দুরূহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তরের গণিত জানা না থাকলে তার ভৌত-জাগতিক অর্থ ও তাৎপর্য কেউ চট করে উদ্ধার করতে পারবেন না। এই জন্য সেই তত্ত্ব খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। তার উপর লোকপ্রিয় বিজ্ঞানের বইও বিশেষ লেখা হয়নি। পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে আপেক্ষিকতাবাদের উপর যে কটা লোকপ্রিয় গ্রন্থ বেরিয়েছে তার সবই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের সম্পর্কে, একটাও সাধারণ আপেক্ষিকতা সম্পর্কে নয়।

    প্রসঙ্গত একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে।

    ১৯৩৭ সালে এক গবেষক ছাত্র এসে সেই কালের বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী স্যর আর্থার এডিংটনকে বলেছিল, “স্যর, শুনেছি, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নাকি এখন পৃথিবীতে মাত্র তিনজন ব্যক্তি বোঝেন। এ কি সত্যি?” শোনা যায়, সঙ্গে সঙ্গে এডিংটন গম্ভীরভাবে সেই ছাত্রকে জিগ্যেস করে বসেন, “তা, তোমার সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি কে বাছা?” [উদ্ধৃত, Kuznetsov 1965, 207-8] ১৯৬৭ সালে অবশ্য রিচার্ড ফাইনম্যান আর একটু সংখ্যা বৃদ্ধি করে বারো জনকে তত্ত্বটি বোঝার অধিকার দেন। [Feynman 1992, 129]

    এই তথ্যগুলো সবাইকে মনে রাখতে বলছি এই জন্য যে, মানবেন্দ্রনাথ রায় যখন ১৯৩০-এর দশকে জেলে বসে এইসব বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করেন, বা ১৯৪৭ সালে তাঁর এই বই যখন বেরয়, তখন তাঁর সামনে আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারগুলিকে বস্তুবাদী দার্শনিক পর্যায়ে ব্যাখ্যা করার মতো কোনো উপযুক্ত পূর্ব-উদাহরণ ছিল না। অথচ তিনি সাহস করে এগোলেন এবং লিখলেন। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র বা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র নন, তিনি প্রথাগত অর্থে দর্শনেরও ছাত্র নন। তিনি বিদ্যায়তনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতর জ্ঞানচর্চার সঙ্গেও কোনোভাবেই কোনোদিন বিজড়িত ছিলেন না। তাই বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবি, এতদ্‌সত্ত্বেও বিষয়টিকে ধরতে তথা এডিংটনের সেই উদ্দিষ্ট “তৃতীয় ব্যক্তি”র ভূমিকা পালন করতে এই ব্যাপারে তাঁর কিন্তু কোনো অসুবিধা হল না।

    এই বিষয়ে দর্শনের ক্ষেত্রে বহুদিনই তিনি প্রথম এবং একমাত্র ছিলেন।

    যাই হোক, এম এন রায় বললেন, “দেশ-কালের স্বরূপ জানার জন্য দর্শন যুগ যুগ ধরে বৃথা দূরকল্প চিন্তা করে এসেছে। অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে এইসব প্রচলিত অধিবিদ্যক ধারণাসমূহকে বিচার-বিশ্লেষণ করে আপেক্ষিকতাবাদ দেশ-কালের বাস্তব সত্তা আবিষ্কার করেছে। দেখিয়েছে যে, দেশ-কাল কোনো দূরকল্প প্রতীতী নয়, তা বস্তুর অস্তিত্বের পূর্ব শর্তও নয়; বরং বস্তুর অস্তিত্ব ও তার বিকাশের প্রক্রিয়া থেকেই দেশ-কালের উপলব্ধি উঠে আসে।” এইখানে এসে রায় আইনস্টাইনের দেশ কাল ও বস্তুর ওতপ্রোত সম্পর্কের প্রশ্নটিকে এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেন যে তা আজও আমাদের মনে সম্ভ্রম জাগায়: “দূর-কল্প দর্শনের সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশ হল বস্তুর ধারক। নিউটন দেশের এই অধিবিদ্যক কাল্পনিক ধারণাটিকে তুলে নিয়ে ক্ল্যাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে স্থাপন করে দেন। আইনস্টাইন দেখান যে, শূন্যস্থান একটি অর্থহীন অকল্পনীয় ধারণা। বস্তুর অস্তিত্ব আছে বলেই দেশেরও অস্তিত্ব আছে -- দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্বের অর্থে। অনুরূপভাবে দূরকল্প শূন্যে চলমান কোনো পরম সময়েরও অস্তিত্ব নেই। বস্তুর আনুক্রমিক বিকাশ থেকেই সময়ের ধারণা সম্ভব হয়। সময় হল দুটি ঘটনার, অর্থাৎ, কোনো বস্তুর পরিবর্তনের মধ্যবর্তী বিরতির উপলব্ধি।” [Ibid, 62-63]

    তিনি দেখান, নিউটন পরম দেশ ও কালের (absolute space and time) ধারণায় বিশ্বাস করলেও তাঁর বিজ্ঞানটি গড়ে উঠেছিল আপেক্ষিক গতি স্থিতি এবং আপেক্ষিক দেশ ও কালের ধারণার ভিত্তিতে। তাই তাঁর সরস মন্তব্য: “তিনি [নিউটন] যদি আজ পুনরায় বেঁচে উঠতেন তবে আপেক্ষিকতাবাদের গতিশীল বিশ্বের ধারণা তাঁকে অবাক করে দিত না। কারণ তিনি দেখতে পেতেন যে তাঁর সময়ের পর থেকে বিজ্ঞান তাঁরই প্রদর্শিত পথে চলে মহাশূন্যের সুদূর জগতে অনুসন্ধান চালিয়েও কোনো বস্তুকেই পরম স্থির অবস্থায় দেখতে পায়নি।” [Ibid, 73-74]

    আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বে শুধু দেশ ও কাল বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি, নিউটন কল্পিত পৃথক দেশ ও পৃথক কালের ধারণা মিলে মিশে এক হয়ে এক চতুর্মাত্রিক জগতে ব্যাপ্ত হয়ে গেছে। “গুণগতভাবে দুই ভিন্ন সত্তাকে এক সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া দেশ-কালের এই অভিনব ধারণা সত্যিই হতবুদ্ধিকর।” [Ibid, 76-77] তথাপি বিজ্ঞানে এটা সম্ভব হল কীভাবে? রায়ের মতে, “সময় সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা নির্ভর করে কোনো বস্তুর আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সম্পর্কের নিয়ত পরিবর্তনশীলতার উপর। সুতরাং দেশ-কালের পারস্পরিক নিভর্শীলতা একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঘটনা। গাণিতিক পদ্ধতিতে তাদের যা-হোক করে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। প্রকৃতির মধ্যেই তারা মিলেমিশে আছে। তাদেরকে স্বাধীন প্রতীতীরূপে কল্পনা করা, যেন তারা যে যার মতো নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করে চলতে পারে, একটা গাণিতিক বিমূর্ত ধারণা মাত্র। যখনই আমরা দেশ-কালের অস্তিত্ব অনুভব করি তখনই দেখি যে উভয়ে একইসঙ্গে মিশে আছে, তাই তাদের স্বাধীন সত্তারূপে ধারণা করাটা নিতান্তই জোর-জবরদস্তির ব্যাপার।” [Ibid, 77-78]

    লক্ষ করুন রায় কী বলতে চাইছেন: আমরা যে এতকাল দেশ ও কালকে আলাদা আলাদাভাবে অনুভব করেছি সেটাই আসলে ছিল অবভাস; আমাদের আপাত বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। বাস্তবে তারা মিলেমিশেই ছিল। আপেক্ষিকতাবাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সেই অবভাসের খোলস খুলে দিয়েছে, ভিতরের দেশ-কাল চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিকে আমাদের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে। আমাদের সামনে যা দলিল পত্র আছে তার ভিত্তিতে একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়, আইনস্টাইনও সম্ভবত তাঁর আবিষ্কারের এই ভৌত গূঢ়ার্থটিকে স্বয়ং এত প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি।

    এরপর রায় যা বলেছেন তা বঙ্গানুবাদে সঠিকভাবে প্রকাশ করা অসুবিধাজনক হওয়ায় আমি ইংরেজি থেকেই তুলে দিচ্ছি: “Having revealed the imaginary nature of absolute time, and consequently of absolute space, the theory of relativity merges space and time into a four-dimensional continuum. . . . Being is three-dimensional. But the world is a process of becoming. Pure being, that is, eventless existence is an abstraction. Becoming is four-dimensional, because it embraces existence and change—space and time. A process of becoming is a four-dimensional continuum.” [Roy 1947, 76 and 80]

    অন্যত্র তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের উপরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন: “The four-dimensional continuum is a kinematic totality -- an infinite number of the non-Galilean systems described by the special theory. . . . The kinematics of a particular region is determined by the local distribution of matter. It is the fundamental function of matter to create metric fields just as it is the function of a charge of electricity to create a magnetic field.” [Roy 1939, 26]

    এরই ভিত্তিতে তিনি মহাকর্ষ নামক পরিঘটনাটিকে দেশ-কাল জ্যামিতিক গঠনের ফল হিসাবে দেখাতে চান:` “Gravitational effects are produced by the structure of space. Gravitational field is a metric field, the potentials of which are determined by the distribution of matter.” [Roy 1940, 222-23]

    উপসংহারে এসে স্মরণ করি, আইনস্টাইনের এই তত্ত্বটিকে যাঁরা সেদিন ভাববাদের পক্ষে ব্যবহার কথা ভাবছিলেন, তাঁদের হতাশ করে দিয়ে তিনি যথার্থভাবেই আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বের দার্শনিক সারমর্মটি আমাদের কাছে খুব সংক্ষেপে অথচ সুন্দরভাবে উদ্ঘাটন করে দেন: “The theory of relativity reduces the entire cosmic scheme, including space, time, mass, motion, force, energy, to one single category -- matter.” [Roy 1939, 29]

    এই বিশ্লেষণগুলিকে পড়ে এবং সামনে রেখেই আমি ২০০৯ সালে প্রকাশিত আমার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিষয়ক একটা রচনায় বলেছিলাম, “As against the prevailing idealistic and positivistic interpretation, it must be acknowledged in all fairness, Manabendra Nath Roy (one of the earliest Marxist intellectuals of our country) had been the first to have correctly grasped the epistemological import of the theory to clearly sort out the philosophical significance in the switch-over from Newtonian concepts of space and time to those propounded by Einstein. His explanation remains till date not only the best critique of the idealistic interpretations of Russell and Eddington but also the best philosophical treatment of the subject.” [Mukhopadhyay 2009, 82]

    [৫] কোয়ান্টাম বলবিদ্যা

    ঠিক একইভাবে, ১৯২০-৩০-এর দশকে যখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তত্ত্ব গড়ে উঠল, লুই দ্য ব্রয়ের কণা-তরঙ্গ দ্বিত্ব, এরউইন শ্রোয়েডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ, হ্বারনার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র, ইত্যাদি, যার সাথে সম্ভাব্যতার তত্ত্ব যুক্ত হয়ে এল, যার দার্শনিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই ভাববাদী প্রত্যক্ষবাদী মত ব্যক্ত করতে লাগলেন, সেই সময় আমরা দেখেছি -- মানবেন্দ্রনাথ রায় সেসবের বিরুদ্ধেও সমালোচনা করেছেন, বস্তুবাদী অবস্থান থেকে যুক্তি তর্ক করে গেছেন। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতো এক্ষেত্রে অবশ্য তিনি সমস্ত জিনিস সমান সাফল্যের সাথে ব্যাখ্যা করতে পারেননি; কিন্তু তিনি যেভাবে আলোচনা করেছেন তাতে বস্তুবাদী ব্যাখ্যার দিকে একটা দিক-নির্দেশ অন্তত পাওয়া যায়।
    যেমন, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্রকে ধরে বলা হচ্ছিল -- নিল্‌স বোহ্‌র বা হাইজেনবার্গ তো বটেই, আরও অনেকে বলছিলেন -- এই সব তত্ত্বে কারণ-কার্য সম্পর্কের আর কোনো জায়গা নেই। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে পদার্থের একেবারে মূল ভিত্তিতে, অর্থাৎ, অবপারমাণবিক কণার জগতে, হৈতুকির কোনো স্থান নেই। সেই সময়, ১৯৩৯ সালে তাঁর একটি রচনায় এম এন রায় বলেন: হ্যাঁ, এটা ঠিক যে পারমাণবিক স্তরে একক কণার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, তাদের সম্পর্কে যা কিছু বলা যায় তার চরিত্র পারিসংখ্যানিক। কিন্তু তার দ্বারা সেখানে কারণকার্যের অনুপস্থিতি বোঝায় না। “The law of average is also a determinist law. Unless individual relations were causally determined, there would be no guarantee for the approximate accuracy of statistical predictions. Statistically predicted events do happen approximately as predicted. That is the decisive proof that at every stage physical processes are causally determined.” [Roy 1939, 4]

    আবার আমি পাঠকদের বলছি রায়ের যুক্তির ধারাটিকে লক্ষ করতে।

    রায় প্রশ্ন তুললেন, কারণ-কার্য পরম্পরা নেই অথচ এক গুচ্ছ কণার ক্ষেত্রে যা ভবিষ্যদ্বাণী করছি তা মিলে যাচ্ছে, এ জিনিস কীভাবে হয়? যদি দেখা যেত যে কখনও মেলে কখনও মেলে না, তাহলে বলা যেত, এখানে কোনো হৈতুকি নেই। যা কিছু ঘটছে এলোমেলোভাবে ঘটে যাচ্ছে। তা তো নয়। কেন না, পারিসংখ্যানিক নিয়মের মধ্যেও একটা পারম্পর্য রয়েছে। একটা নিয়ম রক্ষার ব্যাপার রয়েছে। আর নিয়ম রক্ষা সম্ভবই নয় যদি তার মধ্যে হৈতুকি কাজ না করে, নির্দিষ্ট কারণ থেকে নির্দিষ্ট ফল নিষ্পন্ন না হয়। এটাও যে একটা অসাধারণ যুক্তি তাতে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই।

    সম্ভাব্যতার প্রশ্নটিকেও রায় একইভাবে ধরেছিলেন। যারা মনে করছে বৈজ্ঞানিক সূত্রে সম্ভাব্যতার প্রয়োগ হলে তা অহৈতুকিতে পর্যবসিত হয়, তাদের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন তুললেন, একটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে মানেই তা কিছু একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ঘটার সম্ভাবনা আছে; তাই যদি হয়, কোনো কারণ ছাড়া তার ঘটার সম্ভাবনার কথাই বা আমরা বলি কী করে? তিনি দেখালেন যে হৈতুকি ছাড়া সম্ভাব্যতার কোনো অর্থ হয় না। “How could we say that a certain event is probable to happen if we did not believe that it would take place as the effect of certain definite cause?” [Roy 1939, 40] অর্থাৎ, কোনো একটা ঘটনার সম্ভাব্যতা যদি একটি ভৌত প্রক্রিয়ায় সর্বদা একই থাকে, তাহলে তার ঘটবার পেছনে তো কিছু একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে, যার দরুন সেই ঘটনাটির সম্ভাবনা একইরকম থেকে যাচ্ছে। সুতরাং তাঁর মতে সম্ভাব্যতার নিয়মকে দেখিয়ে কারণ-কার্য পরম্পরাকে অস্বীকার করা যায় না।

    এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যখন ১৯০৯ সালে বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত বইটি লেখেন [Lenin 1976], তখন অবধি সম্ভাব্যতার তত্ত্ব বিজ্ঞানে প্রয়োগ হলেও তা নিয়ে দর্শনের স্তরে খুব একটা সমস্যা দেখা দেয়নি। কেন না, তখনও নিউটনীয় কারণকার্য পরম্পরাকে সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়নি। সেই সময় তিনি বরং দর্শনে কারণকার্য ব্যাখ্যায় সম্ভাব্যতা তত্ত্ব ব্যবহারকে মন্ময়বাদী প্রবণতা হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। সেকালের আর এক প্রভাবশালী প্রত্যক্ষবাদী জার্মান দার্শনিক আভেনারিউস (একালে লেনিন বা প্লেখানভের বই ছাড়া তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না) যখন দাবি করেছিলেন, “অনিবার্যতা হচ্ছে কারণ থেকে ফল পাওয়ার বা সেই মতো প্রত্যাশার সম্ভাব্যতারই পরিমাপ”, লেনিন তার তীব্র সমালোচনা করেন, একে হৈতুকির প্রশ্নে নগ্ন মন্ময়বাদের ওকালতি বলে অভিহিত করেন। [Ibid, 181] উল্লেখিত বিতর্কের সংকীর্ণ পরিসরে লেনিনের আপত্তি সঠিক হলেও সম্ভাব্যতা সম্পর্কে লেনিনের মন্তব্যটি সাধারণভাবে সঠিক নয়। বরং এর থেকে বেরিয়ে এসেই আমাদের বর্তমান সমস্যাকে বুঝতে হবে। তখন আমরা দেখতে পাব, আভেনারিউসের কথাটিকেই বরং উলটে দিয়ে এই প্রশ্নে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে: “সম্ভাব্যতা হচ্ছে কারণ থেকে ফল পাওয়ার নিহিত অনিবার্যতারই বাহ্যিক পরিমাপ।”

    মানবেন্দ্রনাথেরও সম্ভাব্যতার বৈজ্ঞানিক ধারণা সম্পর্কে উপলব্ধি সেদিন যথাযথ ছিল না। অনেকটা প্রচলিত বা আক্ষরিক ধারণার বশবর্তী হয়েই তিনি মনে করেছিলেন, “The degrees of uncertainty of our knowledge are expressed in terms of probability. . . . In the utter absence of the element of uncertainty associated with the conception of probability, the conception must disappear.” [Roy 1947, 100, 101] তার ফলে তিনি এই জায়গায় খানিকটা ফর্ম্যাল লজিকের ভিত্তিতে যুক্তি স্থাপন করে দেখাতে চেষ্টা করেন: সমস্তটা না জানলে কোনো বিষয় সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না ধরে নেবার অর্থ হল জানার চেষ্টা শুরু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা এবং ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের জন্য অপেক্ষা করা। আমরা যতই জানি না কেন, জ্ঞানের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং সেই অর্থে সম্ভাব্যতা থাকেই। ইত্যাদি। [Ibid, 101] অর্থাৎ, রায় বলতে চেয়েছেন, বৈজ্ঞানিক বিচার অনুসারে আমরা যে ব্যাপারে যতটুকু জেনেছি তার ভিত্তিতেই এগোতে থাকব; আর আমরা যত জানতে থাকব, ততই অনিশ্চয়তা দূর হতে থাকবে এবং সম্ভাব্যতার গাণিতিক হাতিয়ার ব্যবহারের প্রয়োজনও ততই কমতে থাকবে। এই মতটা মেনে নেবার অর্থ হল, সম্ভাব্যতা আর অজ্ঞতাকে -- বলে বা না বলে -- সমার্থক ভেবে নেওয়া। যেটা একেবারেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

    আসলে, অন্যান্য অনেকের মতোই মানবেন্দ্রনাথের কাছেও তখন অবধি আধুনিক বিজ্ঞানে সম্ভাব্যতা তত্ত্ব প্রয়োগের তাৎপর্য সবটা ধরা পড়েনি। বস্তু জগতে অশৃঙ্খলা (randomness)–র কী ভূমিকা, কেন কখনই কোনো কিছুর কারণ-কার্য পরম্পরা একেবারে সঠিকভাবে জানা বা বলা সম্ভবই নয়, সম্ভাব্যতা কীভাবে আমাদের অজ্ঞতার ক্ষতিপূরণ নয়, জানার পদ্ধতিটাকেই উন্নত করে -- এগুলো আজও বিজ্ঞানের জগতে এবং দর্শনের মঞ্চে কজন বোঝেন তা হাত গুনে বলা যায়। সেদিন তো এই সংখ্যা একেবারেই মুষ্টিমেয়!

    সেইজন্যই এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে তিনি কিন্তু সম্ভাব্যতার ধারণাকে বাতিল করে দেননি, বরং কারণ-কার্য সম্বন্ধ এবং সম্ভাব্যতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি খোঁজেন, যা প্রায় আধুনিক উপলব্ধির কাছাকাছি এক স্তরে তাঁকে পৌঁছে দেয়। এক্ষেত্রে তিনি শুরু করেন একেবারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দার্শনিক ভিত্তিমূলের কাছাকাছি গিয়ে: “The laws of being are laws of strict causality, whereas the laws of becoming are laws of probability. Becoming presupposes being; therefore, statistical laws are based upon the assumption that the entities involved in a process are individually governed by strict causal laws. It would be impossible to work out any law of probability, except on this assumption. A collective order cannot be founded upon chaotic individuals. . . . Isolated or static being is a logical category. It has no physical reality. Therefore, in extreme cases, such as in the case of an isolated electron, strict law of causality may not be experimentally demonstrated. Nevertheless, it is logically incontestable.” [Ibid, 102]

    এটাও তিনি অত্যন্ত সঠিকভাবেই লক্ষ করেছিলেন, “By the very nature of its subject matter, wave-mechanics is bound to be statistical. It does not deal with isolated particles. It has reduced the ultimate constituents of nature to a state of collective becoming. Consequently, the laws governing matter, deep down in the foundation of its structure, must be statistical.” [Ibid, 102-03] ফলে আসল সমস্যা হল, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তাসূত্রের দার্শনিক ভাষ্য নির্মাণে যূথবদ্ধ কণাসমষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পারিসংখ্যানিক নিয়মকে জোর করে একক কণার উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে, যার থেকে সূক্ষ্মকণার জগতে কার্য-কারণ সম্বন্ধ অস্বীকার করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে: “The difficulty arises only when a necessarily statistical law is tested by mathematical experiments with individual electrons as ideally isolated particles.” [Ibid, 103] মনে রাখতে হবে, একেবারে হুবহু ঠিক এই কথাটাই আর একজনও বলবেন রায়ের ঠিক বিশ বছর পরে। সুবিখ্যাত বিজ্ঞান ভাষ্যকার। কোপেনহেগেন ভাষ্যের তীব্র সমালোচক, স্বনামধন্য কার্ল পপার [Popper 1967, 39-40]। পপার প্রচার পেয়েছেন, রায় কিন্তু পাননি।

    আবার, এই দূরদৃষ্টির সুবাদেই তিনি এক সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তে সেদিনই উপনীত হতে পেরেছিলেন: “Determinism and probability are not mutually exclusive conceptions. On the contrary, a synthesis of the two enables us to have a truer picture of the relations as they really exist in nature. Co-ordinated with the concept of probability, determinism loses its teleological connotation. On the other hand, statistical laws cannot have any validity if the principle of causality is totally denied. In short, probability is the dynamic view of determinism.” [Ibid]

    তাঁর এই সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে সম্ভাব্যতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বাস্তবতা সম্পর্কিত সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না, তবুও এটা মানতেই হবে যে এর মধ্যে একটা রাস্তার সন্ধান আছে। যা সেই সময় অনেকেই বলতে পারছিলেন না। এমনকি মার্ক্সবাদীরাও পারেননি। সোভিয়েত রাশিয়া থেকেও আমরা তখন অবধি কোনো পথনির্দেশ পাইনি। সেখানে বরং তখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেন ভাষ্যকে বিরোধিতা করতে গিয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গোটা কাঠামোকেই দর্শনের জগতে বিরোধিতা করা হচ্ছিল। লাইশেঙ্কো তখন (মাত্র এক বছর পরেই) সেখানে দাপটের সঙ্গে জীববিজ্ঞানের এক বৃহত্তর সম্মেলন-মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিজ্ঞানে সম্ভাব্যতা তত্ত্ব প্রয়োগের বিরুদ্ধে বলে যাবেন, “Science is the enemy of chance”, এবং তাতে বহুক্ষণ ধরে (মূঢ়তাপ্রসূত) হাততালির ঝড় বয়ে যাবে সেই সভায়। [Lysenko 1949, 615]

    কিন্তু সেই অবস্থার মধ্যে বসেও মানবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণাকে আরোহ যুক্তিপদ্ধতি ব্যবহার করতেই হয়। অর্থাৎ, কিছু সংখ্যক তথ্যের ভিত্তিতে বহুসংখ্যক তথ্যের সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার মধ্যে (ঠিক বা ভুল হওয়ার) সম্ভাবনা ঢুকে পড়বেই। পুরনো যান্ত্রিক নিরেট নিশ্চয়তাবাদ তার মধ্যে জায়গা পাবে কী করে? এই রকম জায়গায় সম্ভাব্যতা তত্ত্বই একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। আর তার মধ্য দিয়েই কারণ-কার্য সম্বন্ধ কাজ করে যেতে থাকে। “Rejection of the idea of causality -- that there are invariant relations in nature -- will mean blasting the very foundation of science. For, the point of departure of all scientific enquiry is the belief that the universe is a law-governed system, and that these laws can be discovered, understood and quantitatively stated. As long as predictions can be made, and events happen approximately as predicted, the principle of physical determinism stands.” [Roy 1947, 104-05]

    এইভাবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সমস্যা পর্যালোচনা করে রায় সেদিন যা বলতে পেরেছিলেন আজও তার গুরুত্ব অটুট: “Having pushed its investigation into regions, unknown previously, physics has discovered new and strange facts, facts that do not readily fit into the old theoretical structure. On the basis of the newly discovered facts, as soon as they are established as ontological facts, and are completely systematized, new theories will have to be developed. But they will not replace the old theories; they will only supplement the latter. Both together will compose the entire body of physical knowledge.” [Ibid, 53]

    \\সমস্ত গ্রন্থ সূত্র শেষ পর্বের শেষে দেওয়া হবে।//
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    এক | দুই | তিন
  • ব্লগ | ২৪ অক্টোবর ২০১৬ | ১৯৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন