এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হ্যামলিনের বাঁশিওলা

    ন্যাড়া লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৫ নভেম্বর ২০১৯ | ১৯৫১ বার পঠিত
  • হ্যামলিনের বাঁশিওলার গল্পটা জানিস তো? একটা শহরে খুব ইঁদুরের উপদ্রব হয়েছিল। ইঁদুরের জ্বালায় শহরের লোকের ত্রাহি ত্রাহি রব। কিছুতেই ইঁদুর তাড়ান যাচ্ছেনা। এমন সময়ে হ্যামলিন শহর থেকে একজন বাঁশিওলা বাঁশি নিয়ে এল। শহরের মেয়রকে বলল যে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে সে ইঁদুর তাড়ানোর বন্দোবস্ত করতে পারে। মেয়র এক কথায় রাজী। তখন বাঁশিওলা এমন সুর বাজাল যে সারা শহরের যত ইঁদুর, আনাচ থেকে, কানাচ থেকে, গোলা থেকে, সুড়ঙ্গ থেকে, ভাঁড়ার থেকে, আলমারির তলা থেকে - মানে যে যেখানে ছিল - সব দলে দলে বেরিয়ে বাঁশির সুর অনুসরণ করে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করল। ব্যস, কেল্লা ফতে। কথামতন তখন বাঁশিওলা গিয়ে মেয়রের কাছে গিয়ে পয়সা চেয়েছে। কিন্তু মেয়র পাল্টি খেয়ে বাঁশিওলাকে স্রেফ হাঁকিয়ে দিল। এমনকি এমন কথাও বলল যে সে-ই নাকি শহরে ইঁদুর আমদানী করেছিলে যাতে পরে ইঁদুর তাড়িয়ে পয়সা হাতাতে পারে। এই শুনে বাঁশিওলা রেগেমেগে শহর ছেড়ে চলে গেল। এরপরে একদিন যখন বড়রা সবাই চার্চে গেছে, সে শহরে এসে বাঁশির সুরে ভুলিয়ে সব ছোট ছেলেমেদের শহর থেকে নিয়ে চলে গেছিল।

    এটা হল রূপক গল্প। আসল গল্প অন্য। সে ঐতিহাসিক ব্যাপার। একেবারে ডকুমেন্টেড।

    চেঙ্গিজ খানের নাম শুনেছিস? মোঙ্গোলিয়ার সম্রাট ছিল। দোর্দন্ডপ্রতাপ। বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে দূরদূরান্তর অব্দি রাজ্যবিস্তার করেছিল। আর ছিল সেরকম ভয়ানক। কারুর ওপর রাগ হলে, তাকে যা শাস্তি দিত না, সে শুনলে ভিরমি খাবি।

    একবার চেঙ্গিজ খান সমরখন্দের সঙ্গে বাণিজ্য করবে বলে ৫০০ জন বণিক পাঠিয়েছিল। সমরখন্দ কোথায় জানিস তো? আফগানিস্তানে। তো সমরখন্দিরা সেই ৫০০ জনকেই চর সন্দেহে ধরে বন্দী করে ফেলে। সেই শুনে চেঙ্গিজ দুজন মোঙ্গোল আর একজন মুশলমানকে দূত করে সমরখন্দের শাহর কাছে পাঠিয়েছিল তাদের ছাড়াতে। শাহ সেই তিনজনের মধ্যে যে মুসলিম দূত, তাকে হত্যা করে। আর আরো যেটা সাঙ্ঘাতিক, অন্য যে দুজন মোঙ্গোল, তাদের চুল-দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে চেঙ্গিজের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। সঙ্গে মুসলিম দূতের কাটা-মুন্ডু। ব্যস, চেঙ্গিজের মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। এত বড় কথা! তেমুজিনের সঙ্গে পেঁয়াজি? চেঙ্গিজের আসল নাম তেমুজিন, বুঝলি? তখন চেঙ্গিজ হাজার-হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে রে-রে করে আক্রমণে সমরখন্দ দখল করে নিল। দখল করলেই তো আর হল না, তার মাথায় তো তখনও অপমানের আগুন জ্বলছে। মোঙ্গোলদূতের চুল-দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেওয়া!! চেঙ্গিজ রাজ্যের যত পুরুষ ছিল তাদের সব কটার চুল-দাড়ি-গোঁফ কেটে তো ফেললই, তার সঙ্গে এমন মোঙ্গোলিয়ান জড়িবুটি মাখিয়ে দিল যে আফগান পুরুষরা সব সেদিন থেকে মাকুন্দ। কারুর আর দাড়ি-গোঁফ গজায়না। আফগান সমাজে হায়-হায় পড়ে গেল। দাড়ি না হলে মোল্লাও কেউ হতে পারছে না। কেউ কারো কথা শোনেনা। পুরো সমাজ ভেঙে পড়ার মতন অবস্থা।

    এই সময়ে জার্মানির হ্যামলিন শহর থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বাঁশিওলা সমরখন্দে এসে উপস্থিত। এসে দেখে সারা রাজ্যে গভীর শোক। দাড়ি-গোঁফ চলে যাওয়া মানে পৌরুষ চলে যাওয়া। তাও আবার কাদের কাছে? না, মোঙ্গোলদের কাছে। সেই সময়ে মোঙ্গোলদের খুব দাড়ি-গোঁফ গজাত। কিন্তু প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কারুরই সেই দাড়ি-গোঁফ কাটার অনুমতি ছিল না। সব পুরুষেরি কিছু না হোক তিন-হাত চার-হাত লম্বা দাড়ি। সারা গায়ে পেঁচিয়ে রাখতে হত। সেই মোঙ্গোলদের হাতে দাড়ি-গোঁফ খোয়ানো মানে একবারে কাটা গোঁফে ফিটকিরির ছিটে। কিন্তু যুদ্ধে কচুকাটা হবার পরে কোন আফগান সাহসও করছে না চেঙ্গিজের কাছে গিয়ে ক্ষমাভিক্ষে করে গোঁফ-দাড়ির একটা গতি করে। এমন সময়ে বাঁশিওলাকে দেখে সমরখন্দিরা হাতে যেন স্বর্গ পেল। ঠিক করল জার্মান সায়েবকে দূত করে চেঙ্গিজের দরবারে পাঠিয়ে যদি কোনভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দাড়ি-গোঁফ গজানোর ওষুধ আনানো যায়!

    এদিকে, হবি তো হ', মোঙ্গোলদেশে তখন হঠাৎ খুব ছারপোকার উপদ্রব হয়েছে। সবাইকার দাড়ি-গোঁফেই ছারপোকা একেবারে কিলিবিল করছে। ওদিকে মোঙ্গোলরা দাড়ি-গোঁফ কামাবেও না। সে এক মহা মুশকিল। সারাদিন ছারপোকার কামড়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে। প্রজা লাফাচ্ছে, সৈন্য লাফাচ্ছে, সেনাপতি, পাত্র-মিত্র-অমাত্য-মন্ত্রী-সান্ত্রী সবাই লাফাচ্ছে। চেঙ্গিজও লাফাচ্ছে। এরকম সময়ে চেঙ্গিজের দরবারে হ্যামলিনের বাঁশিওলার প্রবেশ। বাঁশিওলা বলল ইনাম পেলে সে ছারপোকা নির্মূলের ব্যবস্থা করতে পারে। চেঙ্গিজ তো এক পায়ে খাড়া। বললে, যা ইনাম চাও তাই পাবে। তুমি ছারপোকার একটা গতি কর। তো বাঁশিওলা তখন রাজ্যের মাঝে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিল। আর অমনি সেই বাঁশির সুর শুনে রাজ্যের যেখানে যত ছারপোকা আছে, সব লাইন করে ট্যাঙ্গো-ট্যাঙ্গো জিঙ্গো-জিঙ্গো বলে নাচতে নাচতে অগ্নিকুন্ডে এসে 'জয় পতঞ্জলি, জয় পরমাতমা" বলে আগুনে আত্মাহুতি দিলে। এরকম কয়েকঘন্টা চলার পরেই মোঙ্গোলদেশ একেবারে ছারপোকা শূন্য। রাজ্যে শান্তি ফিরে এল। বাঁশিওলা তখন চেঙ্গিজের কাছে গিয়ে বলল, "সম্রাট তেমুজিন, আমার ইনাম?" চেঙ্গিজ খাঁ কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরোলেই পাজী। তার তখন ইনাম দিতে বয়ে গেছে। তিনটে তামার পয়সা দিয়ে সে বাঁশিওলাকে বিদায় দিল। তখন বাঁশিওলা চটে গিয়ে বাঁশিতে এমন সুর বাজাল যে মোঙ্গোলদের গাল থেকে চড়াৎ-চড়াৎ করে যত গোঁফ-দাড়ি, সব উপড়ে আকাশে মেঘের মতন ভাসতে ভাসতে দূরে মিলিয়ে গেল। সারা মোঙ্গোলদেশে শোকের ছায়া নেবে এল।

    আর এদিকে সমরখন্দের আকাশ কালো হয়ে এল। আফগানরা আকাশে চোখ মেলে দেখল, মেঘ নয় রাশি রাশি দাড়ি-গোঁফ মেঘের মতন ধেয়ে আসছে। আর সেই দাড়ির মেঘের ওপর বসে বাঁশিতে "মন মোর মেঘের সঙ্গী" বাজাতে বাজাতে আসছে হ্যামলিনের বাঁশিওলা। যেই সুর বদলে "আকাশে ছড়ান মেঘের কাছাকাছি, দেখা যায় তোমাদের দাড়ি" বাজিয়েছে, অমনি মোঙ্গোলদের উড়ন্ত সব দাড়ি-গোঁফ এসে আফগানদের গালে ফটাফট বসে গেল। সারা রাজ্যের খুশির বন্যা। শাহ রাজ্যের কোষাগার বাঁশিওলার সামনে হাট করে খুলে দিয়ে বললেন, ফরমাইয়ে জনাব। আর সেই তখন থেকে মোঙ্গোলদের দাড়ি-গোঁফ হয়না, আর আফগানদের মুখভরা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল।

    এসব একদম রিয়েল ইতিহাস। ফুললি ডকুমেন্টেড। বইয়ের নাম 'স্তোরিয়া দি মোগোরা পুঁদিচ্চেরি বোনানজা" বাই সিলিনি কামুচ্চি।
    -----------------------
    ফুটনোট: নারায়ন গাঙ্গুলি প্রখ্যাত 'চেঙ্গিস ও হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা' গল্পে এই বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে ইতিহাসের ছারপোকা অধ্যায়টুকু লিখেছেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৫ নভেম্বর ২০১৯ | ১৯৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ন্যাড়া | ***:*** | ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৫১48601
  • #
  • শঙ্খ | ***:*** | ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ০৫:৪৪48602
  • টেনিদার জন্য এক ঠোঙা চপসিল্পো আর বাদামভাজা। লেখা খুবই যাকে বলে মেফিস্টোফিলিস হয়েছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন