পবিত্র মুখোপাধ্যায় (১৯৪০ – ২০২১)। ছবি সৌজন্য: রাজীব সিংহ
মানুষ যে কবিতা লেখার মতো অকিঞ্চিৎকর কর্ম কেন বেছে নিয়েছিল তা বলা দুরূহ। বাল্মীকি অন্তত রামচন্দ্রের মাহাত্ম্য বর্ণনার জন্য রামায়ণ রচনা শুরু করেননি। তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন দুটি পাখির প্রণয়লীলায় তাঁর মর্মন্তুদ শরক্ষেপণে। কালিদাস গুপ্তসম্রাট বিক্রমাদিত্যের মনোরঞ্জন নিয়ে কতটা চিন্তিত ছিলেন জানি না, কিন্তু দিগন্তে কারও কালো আঁখি জলে ভেসে যেতে দেখলে তিনি শব্দের মায়ায় জড়িয়ে মেঘকেই দূত হিসেবে অমরাবতীতে পাঠিয়ে ছিলেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায় খাতাকলমের হিসেবে বরিশাল থেকে আসা দূরাগত এক অনামি শরণার্থী। পারিবারিক আভিজাত্য তাঁর ছিল না। ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণত্বের সুবাদে তিনি যে ভাতকাপড়ের সুবন্দোবস্ত করতে পারবেন এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও ছিল না। তবু কী অলৌকিক কারণে তাঁর মনে হল, “চাঁদ যেন ব্যাধিগ্রস্ত ঈশ্বররের মুখ।” তিনি কবিতার উঠোনে পা রাখলেন। আজ বৈশাখের এই খরতাপে জীবনের করুণ রঙিন পথ দিয়ে তিনি চলে গেলেন চুল্লির প্রহরে। হাজার বছরের বাঙলা কবিতার ইতিহাস তাঁকে কতখানি মনে রাখবে তা জানি না, কিন্তু আজ অলৌকিক পশ্চাদ্ভ্রমণের পর মনে পড়ে পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কবিপত্র’ ছিল আমাদের দীর্ঘতম শৈশব। প্রথম চুম্বন। ম্যাজিক বাস্তবতা। পবিত্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ষাটের দশকের শেষে আমদের পক্ষে এক হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা, যাঁর সঙ্গে মিশতে শুরু করলে কবিতার অতলে না তলিয়ে গিয়ে আর উপায় নেই।
তাঁর পাড়ার স্কুল চেতলা স্কুলে তিনি আমাদের বাঙলা পড়াতেন। তিনি জানতেন না যে একজন কিশোর তাঁর সঙ্গে সৌন্দর্যের স্তর থেকে স্তরান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেদিন খেয়াল করলেন, ডেকে নিলেন কবিপত্রে। নিষিদ্ধ প্রদেশে। সে-ই আদি পাপ। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, ‘কবিপত্র’ আমাদের অক্লান্ত অভিভাবক। পবিত্র মুখোপাধ্যায় আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। ২২ বি প্রতাপাদিত্য রোডে পবিত্রদার ঘরে ঢুকলে তখন সত্যিই মনে হত কবিতার জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা যায়; কোনো কিছুর জন্যই কবিতাকে ত্যাগ করা যায় না। তাঁর কথাবার্তায় একধরনের দ্রাক্ষারস ছিল, তাঁর কবিতা মাতলামির বীজ বুনে দিত, মনে হত সমুদ্রমেখলা চিহ্নিত এই পৃথিবী কবিতার জন্যই বেঁচে আছে। কবিতার মধ্যেই একদিন মিলিয়ে যাবে।বোদলেয়ার আর জীবনানন্দ ছাড়া কাউকে মানুষ বলে মনে হত না। এরই মধ্যে রাসবিহারীর মোড়ে বিষ্ণু দের পায়ে হাত দিয়ে দেখলাম মধুবাতা ঋতায়তে। আমি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম। কিন্তু কখন ঈশ্বর ছোড়ে দীর্ঘতম স্বপ্ন কে বা জানে—আমার জীবনে সাহিত্য ঘনঘোর বর্ষার মতো নেমে এল। কবিতা লিখলাম না। কিন্তু অন্যরকম হয়ে গেলাম।
এভাবেই পবিত্রদা গত প্রায় সাত দশক ধরে নানা তরুণকে স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছেন, নিজে তারুণ্যে অবিচল থেকেছেন। অবশেষে বিদায় নিলেন—তাও তরুণদের সান্নিধ্যেই। নিশ্চয়ই কবিতার সংগঠক হিসেবে, নানা কাব্য আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। তিনি চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার মতো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার মতো তাঁর সম্পাদিত ‘কবিপত্র’ হয়ে উঠবে সফল ও অসফল, খ্যাত ও অখ্যাত নানা কবির আবাসস্থল। নিজেকে তিনি খানিকটা বুদ্ধদেব বসুর ছাঁচে ঢেলেও ফেলতে চাইতেন, এই অর্থে যে যুগপৎ তিনিও শিল্পী ও শিল্পের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায় যে কবিতা লেখার পাশাপাশি অবিরত প্রবন্ধ লিখেছেন তা খানিকটা তিরিশের দশকের বুদ্ধদেব ও সুধীন দত্তদের ভ্রমণসূচির কথা মনে রেখেই। ষাটের দশকের শুরুতে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দর্পণে অনেক মুখ’ প্রকাশ পায়। সেখানে এক মাতৃহারা কিশোরের কী সরল স্বীকারক্তি ছিল—“দর্পণে অনেক মুখ, মার মুখ মনেও পড়ে না।” সদ্য অতিক্রান্ত কৈশোরের অপরিণত মানসিকতা নিয়ে পবিত্র পৃথিবীর অক্লান্ত দহনকে অর্থহীন ভেবেছেন, ফিরে যেতে চেয়েছেন নির্মেঘ শরৎ আকাশের পুষ্পিত স্মৃতিতে। কোথাও উদ্বাস্তু জীবনের মালিন্য ছোটো এই কবিতার বইটিকে স্পর্শ করেনি। এমনকি সুনীল বা শক্তির মতো তিনি নৈরাজ্যের বন্দনাও করেননি। প্রথম যৌবনে তাঁর বরং আরাধ্য ছিলেন অলোকরঞ্জন ও আলোক সরকারের মতো অগ্রজেরা। এই বইয়ের একটি অনুচ্ছেদ অন্তত ভবিষ্যৎ পবিত্র মুখোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করে: “আপাতত হে নৈঃশব্দ আমার অস্তিত্ব ঘিরে থাকো/ সংগমেও শান্তি নেই, প্রেম যেন স্থূল রসিকতা/ কীসে তবে তৃষ্ণা মেটে? কবরের নিঃসীম মৌনতা/ নেমে আসে বিশ্বজয়ী সৈনিকের মতো লাখো লাখো।” ছোটো এই পুস্তিকা অভিনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু বলার কথা যে ইতিমধ্যে বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার অনুবাদ সম্পন্ন হয়েছে। এই অনুবাদকাব্য ও তার ভূমিকা হিসেবে অনবদ্য ‘শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতা’ প্রবন্ধটি তরুণ পবিত্রকে একেবারে বন্দি করে নিয়ে গেল আধুনিকতার অন্য এক প্রদেশে।
প্রকাশিত হল তাঁর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ বহু নন্দিত ও বহু বন্দিত ‘শবযাত্রা’। অত্যন্ত ধ্রুপদি মাত্রাবিন্যাসে লেখা এই ‘শবযাত্রা’ কোনো বিশেষ ঋতুর কাব্য নয়, ইতিহাসের কোনো কালবেলার আত্মার সে স্থবির ক্রন্দন, ক্রমাগত হিমীভূত হয়ে পড়েছে তার সংহত বিস্তার। এই কবিতা অলোকরঞ্জন ও আলোক সরকারের দ্বারা সবিশেষ অভিনন্দিত হয়। এমনকি সেযুগের পক্ষেও এই দীর্ঘ কবিতা অপ্রত্যাশিত ছিল। ‘শবযাত্রা’ এক বন্ধ্যা সময়ের জরায়ু থেকে উদ্ভূত একথা সত্য। কিন্তু সময়ের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি নয়। এর প্রতিটি শব্দ স্বেচ্ছাকৃত ভাবে প্রাচীন, প্রতিটি আঙ্গিক বিস্তারে সচেতন অতীত অনুবর্তন। অনেকে ‘শবযাত্রা’র প্রধান বৈশিষ্ট্য এর নায়ক নির্বাচনে এবং সর্গসৃষ্টির মধ্যে লক্ষ করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, পবিত্রদা ‘ক্লাসিকিয়ানা’র তবকে মুড়ে দিতে চেয়েছিলেন আধুনিক যন্ত্রণা। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘হেমন্তের সনেট’ পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সনেট চর্চার সাক্ষ্য, কিন্তু তা এমন কোনো স্বাক্ষর নয় যে বিশেষ ভাবে উল্লিখিত হবে। বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য সনেট চর্চা পবিত্রর আগে ও পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদার যথেষ্ট সফল ভাবেই করেছেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায় বড়োজোর তাঁদের সহযাত্রী।
আজ তাঁর কবিতাবলির দিকে তাকিয়ে মনে হয় যদি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের যাবতীয় রচনা ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাসে নষ্টও হয়ে যায়, তাহলেও পাঠকের স্মৃতিতে পরম আদরে থেকে যাবে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘আগুনের বাসিন্দা’র প্রথম দশটা কবিতা, ‘ইব্লিসের আত্মদর্শন’ নামক দীর্ঘ কবিতা যা আমাদের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিতে তাতার দস্যুর চকিত অথচ অব্যর্থ হানাদারি এবং ‘অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সংক্রান্ত’ নামের কাব্যসংকলনের কয়েকটি কবিতা এবং ‘বিযুক্তির স্বেদরক্ত’ কাব্যগ্রন্থটির দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত। পবিত্র মুখোপাধ্যায় ‘আগুনের বাসিন্দা’র উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, “বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আমার যন্ত্রনাময় উপলব্ধি শূন্য-শব্দের স্বর্ণপাত্রে ঢেলে দিই।” দেখা যাবে, কবিদের যা যুগে যুগে স্বভাব স্থিতাবস্থাকে ভঙ্গুর করে দেওয়া, আমাদের দেখার চোখের আয়তন না পালটেও অনুভবের বিন্যাসটিকে পালটে দেওয়া—পবিত্র মুখোপাধ্যায় এই তিন চার বছরে তা সম্ভব করেছিলেন। মৃত্যুর ছায়াময় উপত্যকার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করতে চাইছিলেন, নতুন অর্থে জারিত এক ভাষা।
কী থাকে অনন্তকাল? আমরা অন্তত জাতিস্মরের মতো আমাদের যন্ত্রণা ধারণ করে থাকি। সেসময় এখানে দূরে কাছে ইতিহাস ভেঙে পড়ছে। হ্যানয় থেকে সায়গন—প্রতিদিন রক্তপতনের শব্দে ভোর হয়। ‘ইব্লিসের আত্মদর্শন’-এর মধ্যে এমন একটা আগুনের বিস্তার ছিল, দূষিত, সংক্রমিত, পচনগ্রস্ত সময়ের এমন হাহাকার ছিল যে আমি উনসত্তর সালে বইটি ছাপা হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশ পাতার একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলি। ছোটো পাইকায় ছাপা সে বই আমার হাতের কাছে নেই। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে আমার ব্যাখ্যায় উছ্বাস ছিল, উদ্ধৃতি ছিল প্রচুর, তবু আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। প্রয়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেখা হলেই, এই লেখাটি নিয়ে স্নেহভরে আমায় ঠাট্টা করতেন। আজও মনে আছে, ষোলো বছরের একটি কিশোর কীভাবে শিরদাঁড়ায় আতঙ্ক অনুভব করত, যখন সে ‘ইব্লিসের আত্মদর্শন’-এর থেকে পড়ে যেত “ঈশ্বরের মুখ মনে করতেই পারি না/ ঈশ্বরের মুখ ভাবলে চিন্তায় বা অনুভবে/লোমশ যোনির ছবি ভাসে” অথবা পবিত্র মুখোপাধ্যায় যেখানে অশনি সংকেতের মতো প্রশ্নে বিদ্ধ করছেন আমাদের, “শব্দ কি পর্বত? স্থির? অপরিবর্তিত? বেয়াকুব?/ শব্দ কি জলের মতো আদ্যন্ত আদিম?/ শব্দ কি শটিত শব? নিরক্ত নিষ্প্রাণ চিহ্নমালা?”
আজ দীর্ঘদিন পরেও পবিত্রদার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “ইবলিস! আগুন চুরি করে আনো/ পোড়াব পৈতৃক ঘর-বাড়ি/ বংশতালিকার কিংবা হিসেবের নথিপত্র পোড়াব আগুনে/ আমার জন্মের কোনো ইতিহাস নেই” একটা সম্পূর্ণ প্রজন্মের মনে হয়েছিল যে এই কবি সব প্রান্তরের শেষে যে প্রাচীন পরিখা, তা ভেঙে দিতে চাইছেন। গর্জমান তরঙ্গের ফণায় দাঁড়িয়ে চলে যেতে চাইছেন ঐশ্বরিক বেদনার কাছে। আমি, তুষার চৌধুরী ও অন্যন্য রায় তাঁর ভক্ত হয়ে গেলাম। তবু বলতেই হবে, যে এই আগুন ক্ষণপ্রভ ছিল। আমার বিনীত ধারণা পবিত্র মুখোপাধ্যায় ধীরে ধীরে সামাজিক হিতৈষণার দিকে মন দিলেন। নৈরাজ্যের ইস্তাহারের বদলে তাঁর কাম্য হয়ে উঠল লাবণ্যখচিত আখ্যান। আমি বলতে চাইছি না, যে পবিত্রদা তারপরে আর ভালো বা উত্তম কবিতা লেখেননি। তিনি আমাদের কাব্যপ্রবাহে স্বাভাবিক উপনদী হিসেবে যোগদান করতে সফল হয়েছিলেন। তবু আমরা যারা পরপর বিস্ফোরণে মথিত হয়েছিলাম, তাদের ঈষৎ মনোভঙ্গ হল। মনে হল, পবিত্রদা আর মনে করতে চাইছেন না— যে-কোনো শিল্পই হবে রক্ত দিয়ে ফোটানো গোলাপ। স্বয়ংবর সভায় দময়ন্তী অবশেষে আবিষ্কার করেছিলেন, আগন্তুক ছদ্মবেশী দেবতাদের মধ্যে নলই একমাত্র স্বেদযুক্ত, তার মালাই মলিন, কেননা তিনি মানুষ। মহাকাব্যের নায়িকা অন্যরকম। তার স্বপ্ন ভাঙেনি। আমরা তা নই। আমদের কিছু অভিমান হয়তো বা জন্ম নিয়ে থাকবে।
তবু আজ জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে গত পঞ্চাশ বছরের দিকে তাকালে মনে হয় কবিতার কাছে এমন সর্বতো ভাবে নিবেদিত পুরুষ আর কই? শোকে ও উল্লাসে, কলহে ও মিত্রতায়, রাস্তায়, গৃহে, দাম্পত্যে ও জীবনের আনাচে কানাচে তিনি আমৃত্যু এমন এক স্বপ্নসুন্দরীর সহবাস করে গেলেন যার নাম কবিতা হওয়াই যুক্তিযুক্ত। আমার মনে হয়, আমাদের সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস তাঁর জন্য একটি আসন ছেড়ে রাখবেই।