ইতিহাসের নিষ্ঠুর কৌতুক এই যে হাজার হাজার বছরের বহতা নদীতে বাঁধ পড়ল; জ্যামিতি থেকে উঠে আসা এক বক্ররেখা তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধি ও অস্তায়মান শাসকের প্ররোচনা হয়ে প্রান্তর, বনরাজি ও ফসলের খেত জুড়ে মানুষের কান্না বুনে দিল। পুরাকালের জম্বুদ্বীপ থেকে জেগে ওঠা শকুন্তলা পুত্রের নামাঙ্কিত এই উপমহাদেশ ছিন্ন শরীরের মতো তিন টুকরো হয়ে পড়ে থাকল ইতিহাসের রুধিরাক্ত মানচিত্রে তবু বাঙালি মেধা তেমন বিচলিত হল না। পশ্চিম প্রান্তে পাঞ্জাব সীমান্তে সাদাত হাসান মান্টো, ভীষ্ম সিং সাহনি-সহ অজস্র শব্দজীবী পাওয়া যায় যারা আগুন আর রক্ত, রক্ত আর অশ্রুর বিস্তারকে হৃদয়ের পানপাত্রে ধরে রেখেছেন। কিন্তু পূর্বপাড়ে বঙ্গভূমিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তেমন নজরে পড়ে না। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ আমাদের যাত্রা অনেক পরে; কেয়াপাতার কোনো নৌকা কিন্তু পঞ্চাশ দশকেও আমাদের আশ্রয় ছিল না। সত্তর দশকে পাকিস্তান কিংবদন্তির অবসান হলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির যে আবেগ দেখা যায় তা স্মৃতিবিধুরতা থেকে জাত। এমনকি দুঃখের হলেও সত্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুর্বলতা থেকে জাত উল্লাস বা সামরিক বিজয়ের মাদকতা। এখন বাংলা কাব্য বা সংস্কৃতিতে যে পার্টিশন চর্চা তা অনেকটাই অ্যাকাডেমিক অথবা স্থিরতর উপকূলে পা রাখার পরে অতীতের মায়াবী পুনরাবলোকন। কলকাতার পতনশীল মাঝারিয়ানা যে নস্টালজিয়াকে নোয়ার ভেলা ভাবতে চায়, পূর্ব বাংলার স্মরণরেখা তার অন্যতম সম্বল হতে বাধ্য। ঋত্বিক ঘটক বা নিমাই ঘোষ এবং নারায়ণ সান্যাল প্রমুখ কয়েকজনকে বাদ দিলে বঙ্গ বিভাজনের সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া হতাশাব্যঞ্জক। হতে পারে পাঞ্জাবের মতো দ্রুততায় আমাদের নাড়ির বাঁধন কাটেনি, হতে পারে একটি ধারাবাহিক উপন্যাসের মতো জেগে থাকা গমনপথ আমাদের জ্বলন্ত নিয়তি উপহার দেয়নি। পাঞ্জাবে জনবণ্টনের পরে রুদ্ধদ্বার হয়ে যায়। বাংলায় ধর্মের ভিত্তিতে লোক বিনিময় হয়নি। দেশ বিভাজনের অনেক পরেও ফজলুল হক ও বিধান রায় যৌথ জনসভা করেছেন। যে দ্বিধাকম্পিত হৃদয়ে পূর্বপ্রান্তের হিন্দু ও মুসলমান দ্বিজাতি তত্ত্বের শিকার হয়েছেন তা অন্য স্তরে বিবেচ্য। কিন্তু স্মর্তব্য যে এমনকি ঋত্বিক ঘটকের ছবিও উত্তর-বিভাজন মনোবিকলনের কথাই বলে। দেশবিভাগের দলিল একমাত্র নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’। আজ যে স্মৃতিকথা সমারোহ, পশ্চিমবাংলায় উদ্বাস্তু মানুষের প্রথম পদধ্বনিতে তেমন চিন্তার পরিসর রচিত হয়নি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাঙালি শরণার্থীর দল
এখানেই তানভীর মোকাম্মেল-এর স্বাতন্ত্র্য। দেশবিভাগের অনেক পরে জন্মানো সত্ত্বেও বিধবার সিঁথির মতো র্যাডক্লিফ সাহেবের কলমের আঁচড় তাকে শুধু কাঁদায় না, ভাবায়ও। একদা যে জেলার কবি মধুসূদন দূর প্রবাসে লিখেছিলেন—“সতত হে নদী তুমি পড়ো মোর মনে”, সেই জেলার মানুষ তানভীর গভীর বেদনায় ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ দাঁড়িয়ে থাকেন। একজন শিল্পী হিসেবে তিনি শুধু এই অভিসম্পাতের স্মৃতি বহন করেন না, জানতে চান যে রাতে সময়ের দুয়ার ভেঙে এমন ঝড় প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে সেই রাত্রির জরায়ু কোথায়। বেহুলার বাসরঘরে কী করে এমন গরল ছিদ্র রচিত হল। মূলত চলচ্চিত্রকার বলে তিনি কাহিনিচিত্রে ও প্রামাণ্যচিত্রে অবিরত অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। তাঁর শিরায় শিরায় এই উপলব্ধি যে এই খননকার্য শুধু অতীতের প্রত্ন-সম্পদ উদ্ধারের অভিযান নয়, জীবনানন্দ দাশ যাকে বলেন ইতিহাসচেতনা তা পাহারায় না থাকলে কোনো শিল্পকর্মই মহাকালের সিলমোহর পাওয়ার অধিকার অর্জন করে না। ফলে তানভীর যুগপৎ হয়ে ওঠেন ইতিহাসের ধারাভাষ্যকার। আর আমার মনে হয় আমাদের স্মৃতির মহাফেজখানায় তাঁর সংগৃহীত উপাদান একদিন যথাযোগ্য সম্মান পাবেও।
এই মুহূর্তে অবশ্য আমরা তাঁর তিনটি লিখিত আখ্যান আলোচনা করব। ‘কীর্তিনাশা’, ‘চিত্রা নদীর পারে’ ও ‘দুই নগর’—যাদের তিনি উপন্যাস হিসেবেই পাঠকসমীপে নিবেদন করেছেন। এই কাহিনিত্রয়ের মধ্যে ‘চিত্রা নদীর পারে’ প্রথম ছায়াছবি হিসেবেই নির্মিত হয়েছিল। পরে লেখক চিত্রনাট্যটিকেই উপন্যাসে রূপান্তরিত করেছেন। এরকম প্রয়াস ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’ ছবিটিকে নিয়েও হয়েছে। ছবিটির একটি উপন্যাসরূপ ছেপেছিল সে যুগের জনপ্রিয় সাপ্তাহিকী উল্টোরথ। ‘দুই নগর’ উপন্যাসের ভূমিকায় তানভীর সঠিক ভাবেই লিখেছেন, “সব ধরনের বিরাগ সৃষ্টি হয় অজ্ঞতা থেকে। পরস্পরকে না জানা থেকে।” আজ এই উপমহাদেশে এর থেকে সত্য বাক্য আর নেই।
কিন্তু কোন্ ধরনের জানা? খবরের কাগজের পাতায় যা উৎকীর্ণ থাকে? সেরকম জানা তো লেখকের ভাষায়, ‘দুই নগর’ উপন্যাসে যেমন লেখা আছে, “দেশভাগের ইতিহাসটা তো জটিল নয়—১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা, মুসলমানদের পৃথক স্বার্থের দাবিদাওয়া তোলা; ১৯১৩ সালে হিন্দু মহাসভা গঠন, ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট যা ১৯২৫-এ চিত্তরঞ্জন দাশের অকালপ্রয়াণে আর কার্যকর হতে পারল না, ১৯৩৭-এ ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টির সঙ্গে ঐক্য না করে কংগ্রেসের ফজলুল হককে মুসলিম লিগের দিকে ঠেলে দেওয়া, ফজলুল হকের নানারকম সুবিধাবাদী দোদুল্যমানতা, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টে কলকাতার সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা—দি গ্রেট কলকাতা কিলিং। পরে ১৯৪৬-এই নোয়াখালি ও বিহারে ভয়াবহ সব দাঙ্গা এবং ৪৭-এ এসে দেশবিভাগ।” তবু লেখক জানেন ঘটনার এই বয়ানের আড়ালে রয়ে গেছে আর-এক বয়ান। পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে, গাঙ্গেয় উপত্যকা, মেঘনা, ধলেশ্বরী থেকে ভেসে ওঠে মৎস্যকন্যা। তিনি চলে যান নাস্তিক পণ্ডিতের বজ্রযোগিনী গ্রামে, চলে আসেন ইছামতীর নৌকা যুদ্ধে, কত পরাণকথা বটের ঝুড়ির মতো নেমে গেছে ইতিহাসের ঘন অন্ধকারে! এই যে ‘কীর্তিনাশা’ আখ্যানে টিচার্স রুমে কালিকাপ্রসাদ বাবু বলে ওঠেন, “যদি একসঙ্গে খাইতে পারতাম, হয়তো একসঙ্গে থাকতেও পারতাম।” এ কি কথার কথা? শ্রী নগর বাজারের আদর্শ হোমিয়োহল কি গান্ধি-জিন্না বৈঠকের চাইতে কম গুরুত্বের জায়গা? যোগেন মণ্ডল চলে এলেন। তানভীর, তাঁর চরিত্র রসিকলালের বকলমে ছড়া কাটেন—“জিন্নাহ গেল করাচি/গান্ধি গেল মারা/বর্ণ হিন্দু গেল কইলকাতা/আমি চাঁড়াল পড়লাম ধরা!”
না ব্রাহ্মণ, না নমশূদ্র, না মুসলমান, কারও হিসেবের খাতাই মেলেনি। তানভীর মোকাম্মেলের তিনটি লেখা শেষ করে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকা আমার। বঙ্কিমচন্দ্র কবে বলেছিলেন হাশিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্তের মঙ্গল না হলে কার মঙ্গল? আমরা না বুঝতে পেরে আলেয়ার মায়ায় সাড়া দিয়েছি। তানভীর আমাকে বাসমতী চালে ভেজা শাদা হাতখানির কথা মনে করিয়ে দিলেন। আহা! আমি তো সেই জেলারই মানুষ যেখান থেকে বেহুলার স্বর্গাভিযান।
তানভীরের উপন্যাস ত্রয়ী শিল্পরূপের সাফল্য কতটা অর্জন করতে পারল তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে, কিন্তু যে অশ্রুসজল ইতিবৃত্তকে তিনি কেন্দ্র ও পরিধি থেকে দেখলেন তাও এক ঐতিহাসিক কর্তব্য। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
মনোগ্রাহী আলোচনা