এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অসভ্য চোখ (চলছে)

    Sayantani Putatunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ নভেম্বর ২০১৩ | ১৬২৪৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • | |
    ৭.
    --‘রোজ সকালে যদি আপনার একশো গ্রাম পায়খানা না হয়, তবে বুঝবেন সিস্টেম ক্লিয়ার হয়নি। পেটের ভিতরে দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়—ভদ্রসমাজ নাকে রুমাল দেয়। তাই ব্যবহার করুন গন্ধরাজ চুড়ন...!’
    ‘গন্ধরাজ চুড়ন’ এর ক্যানভাসারের চিৎকারে রোজ সকালে ঘুম ভাঙে লাটুর। আর ঘুম ভাঙতেই মুড ডুম হয়ে যায়! যদি ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই কাউকে একশো গ্রাম পায়খানার ফান্ডা শুনতে হয়, তবে মেজাজের পিন্ডি চটকে যাওয়াই স্বাভাবিক! তার উপর সম্প্রতি তার মেজাজ একটা বিশেষ কারণেই খারাপ হয়ে আছে। মা ফসসা হতে চলেছেন। সেটা দুঃখের কথা হলেও স্বাভাবিক নিয়ম। জীবনে অনেককে ফসসা হতে দেখেছে লাটু। নিজের বাপটাকে চোখের সামনে খচ্চা হতে দেখেছে। তাই জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে এত সহজে সেন্টু খেতে নেই। সেন্টু খায়ও না লাটু। কিন্তু সম্প্রতি মায়ের বিতিকিচ্ছিরি অন্তিম ইচ্ছের জ্বালায় জেরবার সে! কি? না, লাটুকে বিয়ে করতে হবে। মা বলেছেন—‘দ্যাখ্‌ লাটু, আমি তো ফৌত হচ্ছি। তারপর তোর কি হবে?’
    লাটু একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে—‘কি আবার হবে? যেমন চলছিল, তেমনই চলবে। তোলা, পার্লার, ডায়মন্ড হার্বারে হোটেলের ধান্দা—সব চলবে। অত মগজমারি কোর না। সব সেটিং হয়ে আছে। তুমি বিন্দাস শপিং করো’।
    --‘ধান্দার সেটিং আছে। কিন্তু তোর সেটিং?’ মা চিন্তিত—‘এখন আমি আছি। যখন থাকবো না তখন কে তোকে সেট করবে? শ্লা, মরদদের খুব চেনা আছে। একা মাল দেখলেই ফুটো হাতায়...’।
    --‘কার বাড়ায় অত জোর’! লাটু হাতা গুটিয়ে ফেলেছিল—‘আমি মাল নই মা। আমি মস্তান। বেশি বাড়াবাড়ি করলে গাঁড়ে অটোম্যাটিক বড়ি গুঁতিয়ে দেব’।
    --‘এটা কাজের কথা নয় লাটু’। মা চোখ বুঁজে বললেন—‘তুই এবার একটা পেম কর্‌। দুনিয়ায় কত ব্যাটাছেলে আছে। তাদের মধ্যে একটা নরম-সরম মাল দেখে লাটিয়ে নে! তাপ্পর বিয়ে কর্‌। আমি দেখে যাই’।
    লাটু লাটাবে! মানে, প্রেম করতে হবে! লাটুর মাথায় প্রায় গোটা ব্রহ্মান্ডটাই ভেঙে পড়ল! সে ক্যারাটের প্যাঁচে একসাথে পাঁচ-ছ’জনকে লাট করে দিতে পারে! অটোম্যাটিক রিভলবারের এক গুলিতেই মানুষকে টপকে দিতে পারে। কালীপুজোর সময়ে রামদার এক কোপেই ছাগলের মুন্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দিতে পারে। পুলিশের সাথে সেটিং করতে পারে। কলার তুলে বাইক চালাতে পারে। তোলা না দিলে হুম্‌কি দিতে পারে। সিগ্রেট, মদ খেতে পারে। বারে গিয়ে বিকিনি পরা চিক্‌নিদের নাচ দেখে আহ্লাদে লাউঘন্ট হতে পারে। দরকারে অপোনেন্টের বডিও ফেলে দিতে পারে।
    কিন্তু প্রেম! সেটা কি! কিভাবেই বা করে!
    --‘মা...!’ সে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল। তার আগেই মা বাজখাঁই গলায় বলেন—‘নো মা...নো মামা...ওনলি লভ্‌...আর-এই পচা...কি যেন?’
    --‘ম্যারেজ ভাই’।
    --‘ইয়েস’। মা শব্দটায় এমফ্যাসিস করলেন—‘ম্যা-রে-জ! হেপি ওয়েল্ডিং’।
    --‘ ভাই, গলতি’। পচা শুধরে দেয়—‘ওয়েল্ডিং আমাদের বিজনেসে হয়। ওটা ওয়েডিং’।
    --‘ঐ একই হল’। মা লাটুকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলেন—‘একদম প্রেগনেন্ট সেটিং’।
    --‘প্রেগনেন্ট নয় ভাই, পার্মানেন্ট’।
    --‘ধু-স্‌ শ্লা!’ মা পাইপে টান মেরে মুখ টুখ আলুভর্তার মত করে বললেন—‘কি কিচাইনের জবান রে! কোনটা পার্মানেন্ট কোনটা প্রেগনেন্ট...সব মাইরি ঘেঁটে যায়। সে যাই হোক, তোকে ঐ ম্যারেজ না ওয়েল্ডিং করতেই হবে। এটা আমার আখরি ইচ্ছা। লাস্ট উইচ’।
    --‘ভাই, উইচ মানে ডাইনি। ওটা উইশ!’
    --‘আবে চিরকুট...’ পায়ের জুতো খুলে পচাকে ঠ্যাঙাতে শুরু করলেন মা—‘ডায়লগ হচ্ছে আমার আর লাটুর মধ্যে। তুই বাল থেকে থেকে করাপ্ট করছিস কেন বে?’
    জুতো পেটা খেতে খেতেই ফের শুধরে দেয় পচা—‘করাপ্ট নয় ভাই, ইন্টারাপ্ট...’
    --‘শ্লা...তেরি তো...!’
    সেদিন বেচারা পচার ওয়াট লেগেছিল। আর লাটুরও ওয়াট লেগেছে। মানে এখনও লাগছে। মায়ের লাস্ট উইশ বলে কথা। অগত্যা সকলেই উঠে পড়ে লেগেছে তাকে ‘পেম’ করানোর জন্য!
    বাইরে তখনও ক্যানভাসারটা চিৎকার করে চলেছে—‘রোজ সকালে যদি আপনার একশো গ্রাম পায়খানা না হয়...’।
    লাটুর মাথায় দাবানল লেগে গেল। শালা, রোজ সকালে ‘একশো গ্রাম পায়খানা’র চিৎকারে ঘুম বরবাদ করে। আজ ওকে ‘নানি’ না মনে করিয়েছে লাটু...!
    সে পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরে শুয়েছিল। রোজ রাতে তাই শোয়। লুঙ্গিটাও যা তা ফ্যাৎরা নয়। রীতিমত বার্মিজ লুঙ্গি। অনেক কসরত করে আনিয়েছে। সেই বার্মিজ লুঙ্গির গিঁট ভালো করে বাঁধতে বাঁধতে উঠে বসল লাটু। একটা কিং সাইজ সিগ্রেট ধরিয়ে ডাকল—‘এই শালা পচা, কাবুল, সোনা, কোথায় বে শুয়োরের বাচ্চারা!’
    ‘ছোট ভাইয়ের’ হাঁকডাক শুনে সব ছুটে এল।
    --‘কি হয়েছে ভাই?’
    একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল লাটু—‘ঐ ক্যানভাসারের বাচ্চাটাকে ডেকে আন্‌ তো। হারামজাদার চিল্লানিতে রোজ ঘুমের পুঙ্গি বাজে। দেখি, ওর গন্ধরাজ চুড়নের দৌড় কত। ডেকে আন্‌ শালাকে। একটু চম্‌কে দিই’।
    চ্যালা চামুন্ডারা আদেশ পালন করতে চলে গেল। লাটু গম্ভীর মুখে সিগ্রেটে টান মারতে লাগল। মেজাজ পুরো খাস্তা হয়ে আছে। সামনে যাকেই দেখছে, ইচ্ছে করছে তাকেই একগাদা খিস্তি দিয়ে লাট করে দিতে। শালা, জীবনে আর কিছু করার পেল না, এখন প্রেম করতে হবে। দোর্দন্ডপ্রতাপ লাটু! সে কিনা প্রেম করবে! বিয়ে করবে! কোনওদিন বাঘের মুখে ‘মিঁউ’ ডাক কেউ শুনেছে? আরে, প্রেম কাকে বলে, তাই জানে না সে! মাঝেমধ্যে অবশ্য দেখেছে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’তে ছেলেমেয়েরা কিসব লোচা করে বেড়ায়। ঝোপে বসে চুম্মাচাটি করে। মেয়েরা কেমন ন্যাকেশ্বরী মার্কা হুলিয়া বানিয়ে ঐশ্বর্য রাইয়ের মত করে বলে—‘ইশ্‌শ্‌শ্‌শ্‌,...তুমি না একটা ইয়ে!’
    এই ‘ইয়ে’র মতলব আজও বুঝল না লাটু। ‘ইয়ে’ মানে কি অসভ্য? যদি অসভ্যই হয় তবে অত নেকিয়ে বলার কি হয়েছে? অসভ্যতা করলে দিতে হয় কানের গোড়ায় দুই কানচাপাটি...! তাহলেই শালাদের বিচি মাথায় উঠে যাবে। দুনিয়ায় কারুর অসভ্যতায় কেউ খুশি হয়েছে, আহ্লাদে গলে জল হয়েছে—তা এই প্রথম দেখছে লাটু। তার সাঙ্গোপাঙ্গরা অনেকবার তাকে প্রেমের ফিল্ম দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু লাটুর ভালো লাগে না। কি সব নায়িকারা রঙীন জামাকাপড় পরে ধেই ধেই করে নাচে! আর প্রেমিককে দেখলেই তার ঘাড়ে চড়ে বসে থাকে! ন্যাকাশশী! আবে, ওটা ব্যাটাছেলের প্যায়ার না পেয়ারাগাছ—যে চড়তে হবে! আর ছেলেগুলোও একেবারে গেঞ্জি পরে নায়িকাকে নিয়ে এমন কসরৎ করতে থাকে, যেন ওটা ফিমেল নয়, ডাম্বেল! লোকে আবার তা দেখে হাততালি দেয়! হাততালি দেওয়ার কি আছে! অমন কসরৎ তো লাটুও করতে পারে। সে নিজে ছ’ফুট লম্বা! অমন ডোলে শোলে তারও আছে। দাও না একটা ব্যাটাছেলে। লাটু তাকে নিয়ে রীতিমত ওয়েট লিফটিংও করতে পারে। তার কব্জির জোরও ফালতু নয়!
    লাটু সিগ্রেটে আরেকটা জব্বর টান কষিয়ে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করল। রোকড়া গচ্চা দিয়ে ওসব খাজা ফিল্ম দেখার কোনও মানে হয় না। বেঁচে থাক তার ফেভারিট ঝাড়পিট।
    ততক্ষণে পচা-কাবুল-সোনারা ক্যানভাসারটাকে ধরে এনেছে। একটা চারফুটি নাটা লোক! তার সিঁড়িঙ্গে চেহারা দেখে অবাক হয় লাটু। এই শুকনো পিঁয়াজকলি মার্কা বডি থেকে ঐরকম ক্যানেস্তারা পেটানো ভলিউম বেরোয়!
    --‘কি বে হাফটিকিট?’ সে ভুরু কুঁচকে বলে—‘বেশি চর্বি চড়েছে তোর?’
    ক্যানভাসারটা লাটুকে বোধহয় চিনতে পারেনি। সে সবিনয়ে বলে—‘মুখ দেখেই বুঝেছি দাদা। একদম ঠিক জায়গায় এসেছি। সকালে পেট সাফ না হলে মেজাজ বিগড়ে থাকাই স্বাভাবিক। একবার গন্ধরাজ চুড়ন ব্যবহার করেই দেখুন। দুমিনিটে সব সাফ হয়ে যাবে’।
    --‘সাফ হবে?’ লাটুর মুখ আরও গম্ভীর হল—‘ক’শিশি চুড়ন আছে তোর?’
    --‘পঞ্চাশ শিশি’। ক্যানভাসার উৎসাহিত—‘আপনি অর্ডার করলে আরও এনে দিতে পারি’।
    --‘পঞ্চাশ শিশিতেই হবে’। সে নির্লিপ্ত মুখে বলে—‘পঞ্চাশ শিশিই কিনব। কত মাল্লু বল্‌’।
    টাকা পয়সা বিনা প্রতিবাদেই মিটিয়ে দিল লাটু। তারপর হেঁকে বলল—‘ভোলা মুদির দোকান থেকে দাঁড়িপাল্লাটা নিয়ে আয় তো! বলবি আমি চাইছি, দাঁড়িপাল্লা বাটখারা একদম পারফেক্ট কন্ডিশনে থাকা চাই। পাল্লা বা বাটখারায় ঘাপলা দেখলে ওকে লাল করে দেব’।
    --‘আনছি ভাই...’।
    কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাল্লা বাটখারা এসে হাজির। লাটুর পন্টরেরা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, দাঁড়ি পাল্লা বাটখারা দিয়ে ভাই ঠিক কি করবে!
    লাটু প্রথমে পাল্লা বাটখারা নেড়েচেড়ে দেখল। নাঃ, কোনও ঘাপলা নেই। তারপর সিগ্রেটটাকে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে ক্যানভাসারের দিকে তাকিয়েছে—‘ এক শিশি গিললে একশো গ্রাম পায়খানা হয়? গ্যারান্টি?’
    --‘টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি স্যার। একবার ইউজ করেই দেখুন’।
    --‘দেখছি’। লাটু একটা শিশি কাবুলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে—‘নে এটা শালাকে গেলা!’
    কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ যেন বাজ এসে পড়ল ক্যানভাসারের মাথায়। একি! লোকটা নিজে খাবে না! উলটে তাকেই খাওয়াবে!
    সে লাফ মেরে পালাতে যাচ্ছিল। তার আগেই তাকে শাগরেদরা চেপে ধরে ফেলেছে।
    তারপর? তারপর আর কি! লোকটাকে পাকড়াও করে পুরো পঞ্চাশ শিশি গন্ধরাজ চুড়ন গেলাল লাটুর দলবল। যখন পঞ্চাশতম শিশি শেষ হল, ততক্ষণে সে বেচারা হেদিয়ে পড়েছে।
    --‘ওয়ে পাইরেটেড খুচরো পয়সা!’ লাটু উঠে দাঁড়িয়েছে—‘এক শিশিতে যদি একশো গ্রাম হয়, তবে পঞ্চাশ শিশিতে পাঁচ কিলো হোনে কা মাংতা হ্যায়। ঐ পাল্লা বাটখারা রেডি আছে। আগে তুই শালা পাঁচ কিলো হাগবি—তারপর এখান থেকে বেরোবি! যদি একগ্রামও এদিক ওদিক হয় তবে...’ সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সাপের মত চিকন নতুন পিস্তলটা বের করে এনেছে। সেটা ক্যানভাসারের মাথায় ঠেকিয়ে হিসহিসিয়ে বলল—‘তোর জিওগ্রাফি হিস্ট্রি—সব পালটে যাবে। যদি এখনই মায়ের ভোগে যেতে না হয় তবে পাঁচ কিলো হেগে দেখা। পালাবার চেষ্টা করলে আমার পন্টর্‌রা তোর লাশ ফেলে দেবে! খোপরিতে ঢুকল?’
    গান পয়েন্টে রেখে যদি কেউ একথা বলে তবে ‘না’ বলার হিম্মত কোনও তিস্‌ মার্‌ খাঁ-এরও নেই। ক্যানভাসার কোনমতে মাথা নাড়ল।
    --‘আর আমি কে সেটাও জেনে রাখ’। লাটু কোমরে হাত দিয়ে বলে—‘আমার নাম লাটু মস্তান। একদম অরিজিন্যাল। কোনও শাখা নেই। নাম শুনলে আচ্ছা আচ্ছা পাব্লিকও মুতে দেয়...’।
    সে আর বলতে! কাবুল ফিক করে হেসে ফেলল—‘মালটার প্যান্টুল পিলা হয়ে গেছে ভাই, এখনই মাপবো?’
    আধখানা চোখ করে তার দিকে তাকাল লাটু। চোখের ইশারায় তার দলবলকে লোকটার উপর নজর রাখতে বলে আস্তে আস্তে টয়লেটের দিকে চলে গেল। এখন তার অনেক কাজ। এই চব্বিশ বছরের জীবনে যা করেনি আজ তাই করতে যাচ্ছে। প্রথমে শাড়ি কিনতে হবে। আরও কি সব কিনতে হবে। বিউটি পার্লারে যাবে। সেখানে মোমপালিশ মারতে হবে। সে এক ভীষণ কান্ড! অবশেষে সেজেগুজে সন্ধ্যাবেলা একটা ছেলের সাথে মিট করতে যাবে। পচা--সোনারা ইন্টারনেট থেকে ছেলেটার প্রোফাইল বের করেছে। তার ফটো দেখে মা কাৎ। বলেছেন—‘এই মালটাকে দেখে আয় লাটু। বেশ ব্যোম্‌ ভোলানাথ ভাব। সাত বুলেটেও রা কাড়বে না’।
    অগত্যা! যেতেই হচ্ছে লাটুকে। মায়ের ‘লাস্ট উইচ’ বলে কথা! লাস্ট উইচের ধাক্কায় সে যে স্যান্ডউইচ হচ্ছে তা আর কে দেখে!
    কিন্তু মাঠে নেমেই লাটুর জান কয়লা। সে একা কোথাও যায় না। কিছু শাগরেদ সবসময়ই তার সাথে থাকে। কিন্তু শপিং মলে ঢুকে তারা একেবারে হুটোপাটি লাগিয়ে দিল। একজন একখানা নীল শাড়ি তোলে তো আরেকজন লাল শাড়ি। চতুর্দিক থেকে একডজন শাড়ি নিয়ে তারা লাফালাফি করছে—‘ভাই, এইটা পরে দেখো, মা কসম, পুরো রাপচিক আইটেম লাগবে তোমায়। একদম শ্রীদেবী’!
    এমন দিনও এল যেদিন মস্তানকে আইটেমও সাজতে হচ্ছে! যে মেয়েটি হাসি মুখে শাড়ি দেখাচ্ছিল সে বলল—‘কার জন্য কিনছেন দাদা? গার্লফ্রেন্ড?’
    চটাস করে একটা শব্দ! মেয়েটির কানের গোড়ায় ডাম্বেল ভাঁজা হাতের এক মোক্ষম কানচাপাটি বসিয়ে দিয়েছে লাটু—‘তোর গার্লফ্রেন্ডের ভাই হয়েছে! আমায় লেবু পেয়েছিস!’
    মেয়েটি চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময়ে তার চোখের পলক পড়ে না।
    --‘ধুস্‌ শালা। খালিপিলি দিমাগ চাটছে মালটা’। লাটু বলতে বলতেই পরণের শার্টটা খুলে ফেলেছে—‘দ্যাখ্‌ শালি। দেখেছিস্‌? এবার বল্‌ কার জন্য কিনছি...’।
    দলবলের মধ্যে হাঁ হাঁ করে ভীমা ছুটে এল—‘ভাই এটা পাব্লিক প্লেস! এখানে এমন করে শার্ট খোলে না!’
    --‘কেন?’ ভুরু কুঁচকে বলল লাটু—‘তোদের সলমন খান সবার সামনে শার্ট খোলে না? না তার একারই রাইট আছে!’
    --‘ভাই, সলমন খান ছেলে, তার ব্যাপার আলাদা! কিন্তু তুমি তো...’।
    কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল ভীমা। ভাই যেমন খেপে গেছে, কথাটা পুরো শেষ করলে তার জানের ফাঁড়া আছে।
    কিন্তু উপরওয়ালার অশেষ কৃপা। লাটু আস্তে আস্তে শান্ত হল। দেরি হলেও ব্যাপারটা বুঝেছে সে। আশেপাশের পাব্লিকরা হাঁ করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে তার তীব্র দৃষ্টি নরম হয়ে আসে।
    সেলস্‌গার্লের অবস্থা তখন খারাপ। তার মাথা রীতিমত বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। তবু চাকরিটা রাখতে হবে। কোনমতে বলল—‘নিজের জন্য কিনছেন দিদি’?
    --‘আমি তোর কোন্‌ নাগরের দিদি বে!’ লাটু ফের চটে গেছে। সে জানে যে সে মেয়ে। কিন্তু মানতে চায় না।
    বিপদ দেখে ভীমাই এগিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল—‘এ আইটেম, ভাইকে দিদি বললে ফের কানচাপাটি লাগিয়ে দেবে। ভাই বল্‌-ভাই’।
    মেয়েটি খাবি খেয়ে বলল—‘ও আচ্ছা। ভাই, আপনার জন্য শাড়ি দেখাবো?’
    --‘এতক্ষণ ধরে কি তোর সামনে আমি স্যাড সং গাইছি!’
    অনেক লোচা, কিচাইনের পর অবশেষে একটা টকটকে লাল রঙের শাড়ি পছন্দ হল লাটুর। হাই প্রোফাইলের মাল্লু। তবে চিজটাও হাই প্রোফাইল।
    সেল্‌সগার্ল ভয়ে ভয়ে বলে—‘ভাই, এর সাথে ম্যাচিং ব্রা, ব্লাউজ, শায়া আছে? না দিয়ে দেবো?’
    মুখ বিকৃত হয়ে গেছে লাটুর। শাড়ি কিনেও শান্তি নেই। বিরক্ত হয়ে বলল—‘যা যা দেওয়ার দিয়ে দে। দিমাগ চাটিস্‌ না’।
    --‘সাইজ কত?’
    সেরেছে! মা থাকলে বলতে পারত। কিন্তু ঘটনা যে লাটু পিস্তলের বুলেটের সাইজ থেকে তোপের গোলারও সাইজ জানে। অথচ নিজের ব্রায়ের সাইজটাই জানে না।
    --‘নো প্রবলেম ভাই। আমি মেপে নিচ্ছি’।
    মেয়েটি একটা ফিতে দিয়ে মেপে নিয়ে বলল—‘চৌত্রিশ’।
    --‘চৌত্রিশ হলে চলবে না রে চিকনি। ওটাকে আরও বাড়া’।
    ভীমার দিকে হাঁ করে তাকাল লাটু। বলে কি হারামী! বুকের সাইজ বাড়াতে হবে!
    --‘ভাই, তুমি আজকালকার চিরকুটগুলোকে চেনো না। হারামজাদারা মেয়ে দেখতে এলেই আগে বুকের দিকে তাকায়’। ভীমা বলে—‘স্পঞ্জ ব্রা নেই!’
    লাটু শপিংমলের ছাতের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল—ভীমাও কত কিছু জানে! ক’দিন আগেই বিয়ে করেছে কি না! ব্রা নিয়ে বোধহয় সে থিসিসই করে ফেলেছে! থিওরিটিক্যাল নয়, প্র্যাকটিক্যাল!
    অনেক হাঙ্গামার পর শপিং শেষ হল। শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ, ম্যাচিং জুয়েলারি, হিলজুতো—সব কিনে ফিরল লাটু। মা পরিয়েও দিলেন। কিন্তু ফের ঝঞ্ঝাট! শাড়ি পরে নড়তে চড়তেই পারে না সে! কখনও কুঁচি খুলে যায়, কখনও আঁচল লপাৎ লপাৎ করে খসে পড়ে আবার কখনও বা শাড়িতে পা বেজে হুড়ুম করে আছাড় খায়। তার উপর ব্রা নামের জিনিসটাও কি টেনশনপয়দাকারী মাল! জীবনে অনেক শক্ত শক্ত অস্ত্র অপারেট করেছে লাটু। কিন্তু এই সামান্য চিজটা কখন শাড়ির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়, কখন পৈতের মত উঁকিঝুঁকি মারে সেই ভেবেই ভয়ে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে আছে! স্পঞ্জ ব্রা পরে তার বুক দুটো যেন কেমন ভয়াবহ হয়ে আছে! মনে হচ্ছে দুখানা গ্রেনেড তার বুকের উপর কেউ বসিয়ে দিয়েছে! বেশ কয়েকবার আছাড় খেয়ে শেষে কাতর ভাবে মাকে বলল—‘মালকোঁচা মেরে পরা যায় না?’
    মা এমন করে তাকালেন যেন পারলে মেয়েকে জ্বালিয়ে দেন। তারপর থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছে লাটু। আজ তার কথা বলার দিন নয়।
    একা শাড়িতে রক্ষা নেই, তার উপর হিল জুতো দোসর। পরে হাঁটতেই পারে না! ত্রিভঙ্গমুরারি বা বাঁকা শ্যামের মত একবার এদিকে একবার ওদিকে বেঁকছে।
    --‘অত হিলছ কেন ভাই?’
    সোনার কথার উত্তরে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকে একবার মেপে নিল লাটু। হিলছে কি সে নিজের মনের আনন্দে! এই হতভাগা হিল তাকে হিলিয়ে ছাড়ছে! এর চেয়ে একজোড়া রণপা পরে গেলেও বোধহয় এত অসুবিধা হত না!
    --‘ভাই...ভাই...’ কাবুল আহ্লাদে দৈত্যকুলের পেহ্লাদ হয়ে বলল—‘আঁচলটা বুকের একসাইড দিয়ে ফেলো। মানে ক্লিভেজটা দেখাও। ফুলটু অ্যাটম বম্ব লাগবে মামা!’
    হায় ভগা! শেষ পর্যন্ত তার ব্যাটাছেলে পল্টনদের কাছ থেকে অ্যাডভাইস নিতে হচ্ছে! কটমট করে একবার তার দিকে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দিল সে।
    এরপর বিউটি পার্লার! সেখানে এক হতচ্ছাড়ি পুটুত পুটুত করে তার অমন সুন্দর ভুরুটার উপর দিয়ে প্রায় ট্র্যাক্টরই চালিয়ে দিল! মুখে কিসব মাখিয়ে, ভূত সাজিয়ে, ঠান্ডা গরম সেঁক দিয়ে অতিষ্ঠ করল। অনেক অত্যাচারের পর যখন ছাড়া পেল লাটু, তখন আয়নায় নিজের মুখ দেখেই আঁতকে উঠল! এই আইটেমটা কে রে ভাই! এই লাটু! ধুস্‌, এ তো হোর্ডিঙের চিকনিগুলোর মতই লাগছে! আবে শা-লি!...খানকিমাগী! এ কি করেছিস!
    মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ঘুঁষি বাগাচ্ছিল সে। কিন্তু তার আগেই আশেপাশের মেয়েগুলো হেসে বলল—‘দারুণ দেখাচ্ছে! একেবারে হিরোইন!’
    এত বড়ো কমপ্লিমেন্টের পর কি আর ঘুঁষোঘুঁষি করা যায়। অগত্যা রঙচঙ মেখেই বেরিয়ে এল সে। তার দলবল তাকে দেখে সিটি মেরে বলল—‘ওঃ ভাই...! পুরো রাপচিক আইটেম! ক্রেজি কিয়া রে! পাগলা ক্ষীর খা!’
    হাঁড়ির মত মুখ করে, কোনমতে বেঁকতে বেঁকতে সেদিন ছেলে দেখতে চলল লাটু মস্তান! যাওয়ার পথে মা কালীর মন্দির দেখে প্রণাম করল। সে প্রণাম তো প্রণাম নয়, রীতিমত হুমকি। কপালে হাতজোড় করে মনে মনে বলল সে—‘ উপরওয়ালা, মাকড়াটা যদি আমায় না-পসন্দ করে তবে জোড়া পাঁঠা দেব। আর যদি মালটা আমায় পছন্দ করে ফেলে তবে তোমায় শুদ্ধ মন্দিরটাই না উড়িয়েছি তো আমার নাম লাটু মস্তানই নয়!’

    ৮.
    সেদিন রাতে ফ্রাস্টু খেয়ে একটু বেশিই বড়ি খেয়ে ফেলেছিল বিশু।
    আসলে হয়েছে কি, সেরাতে তো ইপ্সিতাদির বাড়ির পিছনে সে ল্যাদ্‌ খেয়ে পড়েছিল। মা কসম্‌, একটুও পিপিং টম গিরি করেনি। শুধু কোমরভাঙা ঢ্যাম্‌না সাপের মতই পড়ে পড়ে ল্যাদ্‌ খাচ্ছিল! ওদিকে কোন্‌ হতভাগা কে জানে, ইপ্সিতাদির জানলায় উঁকি মেরে গেছে! আর ঐ হাড়ে হারামজাদা, হারামীর হাতবাক্স ঘোঁতন শেষমেষ তাকেই কেস খাওয়ানোর জন্য খুঁজে পেল! হবে না কেন! ফ্রাস্টুই ফ্রাস্টু চেনে।
    তারপর থেকেই বিশুর সাড়ে সব্বোনাশ হয়েছে! ক্লাবের ছেলেপিলেরা এসে তাকে চমকে দিয়ে গেছে। বলেছে—‘এরপর থেকে যদি কোনও মেয়ের বাড়ির একশো গজের মধ্যেও তোকে দেখি হতভাগা, কিলিয়ে মাখা সন্দেশ বানিয়ে দেব। মাথা থেকে ডান্ডা—সব শালা চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। পুলিশও আইডেন্টিফাই করতে পারবে না, এটা মেল না ফিমেল!’
    লেঃ হালুয়া! খায়া পিয়া কুছ নেহি, গ্লাস তোড়া চাল্লিস লাখ কা! একটা সিন দেখাও তার ভাগ্যে জুটল না, তার আগেই পাব্লিক এসে তাকে চমকাচ্ছে! একে কি বলবে বলো? শালা, ব্যাড লাকই খারাপ!
    তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন সবাই ইতিউতি ফিসফিসাচ্ছে। মেয়েগুলো তাকে দেখলেই এমন করে তাকায়, যেন এখনই সে বুক টিপে দেবে! এই তো, বিন্তিপিসির মত চিরকেলে বৈষ্ণব, অহিংস মানুষও সেদিন তাকে কলেজ যাওয়ার পথে বলেই ফেললেন—‘ বাবা বিশু, তুমি তো ভালো ছেলে ছিলে। আগে আইবুড়ো মেয়েদের দিকেই নজর দিতে! এখন বাপু এয়োদেরও ছাড়ছ না! কোন্‌দিন হয়তো বেধবাদের ঘরেও চোখ রাখবে! কি কলিকাল! হ-রে-কৃ-ষ্ণ!’
    বিশুর আর সহ্য হয়নি। দাঁত খিঁচিয়ে বলল—‘কাকে ডাকছেন পিসি? কৃষ্ণ! তিনি কি ভালো কাজটা করেছেন শুনি! রাধা কি আইবুড়ো ছিলেন? না চন্দ্রাবলীর বিয়ে হয়নি?’
    পিসি সেকথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন—‘মর্‌ মুখপোড়া! ভগবানের সাথে নিজের তুলনা করিস? তোর ঐ ভেঁটকিচোপায় নুড়ো না জ্বেলে দিয়েছি...!’
    বোঝো! ‘কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা’! ধরা না পড়লে কানু, আর ধরা পড়লেই পানু! কি দিনকাল পড়েছে!
    যাই হোকু, ভেঁটকিচোপা জিনিসটা কি সেটা সে বোঝেনি। কিন্তু পিসি যে খচে লাল হয়েছেন তা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি! অগত্যা মানে মানে সেখান থেকে মায়া হয়ে গেল বিশু! মানে প্রায় মিলিয়েই গেল পঞ্চভূতে!
    তারপর থেকেই তার মন খারাপ! মন এতই খারাপ যে দুটোর জায়গায় টপাৎ টপাৎ করে চারটে বড়ি খেয়ে ফেলেছে। একবার টেস্টপরীক্ষার সময়ে টেনশনে এতগুলো বড়িই খেয়ে ফেলেছিল সে। গুণে দেখেছিল যে চারটে বড়ি খেয়ে নেশা হতে হতে মিনিমাম আধঘন্টা লাগবে। তাই সময় নষ্ট করা আর কেন? পরীক্ষার সেকেন্ড হাফেই বড়ি চারটে গিলে ফেলেছিল। এরপরের ইতিহাস অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত! তার হাতের লেখা প্রায় ইসিজি মেশিনের লাইনের মত নাচতে নাচতে একসময় স্ট্রেট হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ মাল খালাস! এবং ফুটুর ডুম!
    কলেজের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট তাকে ডেকে বলেছিলেন—‘বাবা বিশু, গোটা কলেজ, প্রিন্সিপাল, এমনকি হস্তরেখাবিদও তোমার হাতের লেখা উদ্ধার করতে ফেল মেরেছেন! যদি তুমি এই যুযুৎসুলিপি উদ্ধার করতে পারো তবে লাড্ডু, নয়তো গাড্ডু!’
    সেই শেষ! সেই ঘটনার পর থেকে বড়ি খেলেও একসাথে চারটে বড়ি কখনও খায়নি সে। কিন্তু আজ মনের দুঃখে খেয়ে ফেলেছে!
    দুঃখ এতটাই ভসভসিয়ে উঠেছে যে টলতে টলতে সে রেলওয়ে ট্র্যাকের উপরে হাঁটতে লেগেছে! এই অর্থহীন জীবন রাখার কোনও মানে হয় না। এ তো জীবন নয়, শালপাতার ঠোঙা! অথবা চায়ের ভাঁড়! কেউ দিব্যি চুকচুক করে চা খেয়ে, বা নুলো বের করে বিন্দাস্‌ তেলেভাজা সাঁটিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে ডাস্টবিনে! শালা, সব জায়গাতেই ফেল্টুস! পরীক্ষায় ট্যারা হল, প্রেমে ভেড়া হল, এমনকি এক প্রেমিকার আবদারে মাথা মুড়িয়ে নেড়াও হয়েছে! জীবনে আর ক্যারা করতে বাকি কি রেখেছে বিশু! সবই তো হল। এবার হয় ট্রাক, নয় রেলওয়ে ট্র্যাক।
    নাঃ, উপরওয়ালা! তোমার উপর কোনও রাগ নেই বিশুর। যখন ওর ভাগ্যলিপি লেখার পালা এসেছিল, তখন বোধহয় তুমিও মেনকা ডট কম দেখে ফ্রাস্টু খাচ্ছিলে। তাই ভুল করে কপালে ফ্রাস্টু শব্দটাই লিখে ছেড়ে দিয়েছ! জন্ম থেকে আজ ইস্তক তাই ফ্রাস্টুই খেয়ে আসছে বিশু। ফ্রাস্টু খেতে খেতে বাঁচো। না পারলে মরো! ঐ ঘোঁতনের জীবনে তবু চিবোনোর জন্য কিছু হাড় আছে। বিশুর তো নিজের হাড় ক’খানা বাঁচানোই সমস্যা হয়ে উঠেছে! কোন্‌দিন উদো ফের জানলায় উঁকি মারবে, আর তার পিন্ডি বুধোর, তথা বিশুর ঘাড়ে চাপিয়ে পাড়ার ছেলেরা তার পিন্ডি চটকে পিন্ড বানিয়ে দেবে! ঈশ্বর, সেদিন দেখার জন্য বিশু বাঁচতে চায় না! তুমি বিশুকে মেরে ফেলো!
    --‘এত রাতে রেললাইনে কি করছিস্‌ বে?’ পিছন থেকে একটা গলার আওয়াজ আচমকা ভেসে এল। এমন বাজখাঁই গলার স্বর যে বিশুর পিলে চমকে গিয়েছিল। কোনমতে টলতে টলতে পিছনে ফিরল—‘কে?’
    --‘তোর বাপ’। পিলে চমকানিয়া কন্ঠস্বর বলল—‘কি করছিস রেললাইনে?’
    --‘প্যাভিলিয়নে ফিরছি’। বিশু আড়ষ্ট স্বরে উত্তর দেয়—‘অনেক খেলা হয়েছে। রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে গ্রীনরুমে ফেরার তাল করছি’।
    --‘তুই মাতাল না পাগল?’ কন্ঠস্বরটা বলল—‘এক্ষুনি ট্রেন এসে পড়বে। এখান থেকে ফোট্‌। নয়তো কাল সকালে টু-পিস হিসাবে বিকোবি!’
    --‘না, এখন আসবে না’। বিশু নিশ্চিন্ত স্বরে বলে—‘টাইম টেবিল দেখে এসেছি। ডাউনে ট্রেন আসতে এখনও সাত মিনিট বাকি। তার উপর শুনলাম ট্রেন লেট আছে’।
    কিছুক্ষণ ওপাশের স্বরটা চুপচাপ থাকল। তারপর আস্তে আস্তে বলল—‘আত্মহত্যা করছিস্‌? মানে সুইসাইড?’
    --‘ভাবছি করবো’।
    --‘কেন?’
    --‘এমনি’।
    কথা নেই বার্তা নেই, ঠাঁই করে একটা চড় এসে পড়ল তার গালে—
    --‘শা-লা। মাঝরাতে কেওড়ামি হচ্ছে! সুইসাইড করতে কেউ টাইমটেবিল দেখে আসে! আমায় ছাগল ঠাউরেছিস বোকাচোদা! ফের যদি চামচিকের মত চিকচিক করিস তাহলে তোর বডিপার্টের সবক’টা ফাইল এইসান করাপ্ট করবো যে বর্ণপরিচয় পড়েও চেনা যাবে না!’
    যাচ্চলে! এ কোন্‌ বাপের খপ্পরে পড়ল বিশু! এ যে রীতিমত ধমকাচ্ছে! শুধু ধমকাচ্ছেই না, রীতিমত হেডমাস্টারের মত পেল্লায় চাঁটিও হাঁকড়াচ্ছে! এ আবার নতুন করে কি কেলো!
    চড়টা খাওয়ার সময়ে রিনরিন করে একটা চাবি বা চুড়ির শব্দ পেয়েছিল সে। এখন থাপ্পড় খাওয়ার পরে মাথাটাও একটু পরিষ্কার হয়েছে। একটা মেয়েলি পারফিউমের গন্ধও পাচ্ছে বিশু। এর মানে কি? যে চড়টা মারল সে কি মেয়ে! কিন্তু মেয়েদের এমন মোক্ষম হাত হয় নাকি! হাত তো নয়—বাঘের থাবা! একটা খেয়েই আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার উপক্রম হচ্ছে। আরেকটা সাঁটিয়ে দিলে নির্ঘাৎ উপরওয়ালার কোলে বসে পিট্টু খেলতে হবে! তাছাড়া মেয়েরা কি এই ভাষায় কথা বলে! মেয়েদের কি এরকম খাম্বাজ কন্ঠস্বর হয়!
    চোখ পিটপিট করে ছায়ামূর্তিটাকে দেখার চেষ্টা করল বিশু! ওরে বাবা! এ তো বাপ নয়, মা বটে! রীতিমত লম্বা হিলহিলে চেহারা! আবছা অন্ধকারেও বুঝতে পারল মানুষটার পরনে আর যাই থাক্‌, শার্ট-প্যান্টুল নেই, বরং শাড়িই বলে মনে হচ্ছে! দেহরেখা বোঝা যাচ্ছে! জিনিস বটে! একেবারে সেভেন আপের কার্ভি বোতল!
    তার হঠাৎ করে কান্না পেয়ে গেল। আচমকা ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল বিশু। ছোটবেলায় মা একবার থাপ্পড় মেরেছিল। ছাতে শুকোতে দেওয়া আচার সবটা খেয়ে ফেলেছিল বলে। জীবনে মেয়েদের লাথি অনেকবার খেয়েছে। কিন্তু অল্পবয়েসে মা চলে যাওয়ার পর আর কোনও মেয়ে তাকে চড় মারেনি। হঠাৎ করে সেই ছোট্ট বিশুর কথা মনে পড়ে গেল। কি ছিল দিনগুলো! আর এখন কি হয়েছে!
    --‘আবে! এ তো মহা হালুয়া!’ মেয়েটি বলল—‘মেয়েছেলের মত নাকে কান্না কাঁদছিস কেন? চুপ কর্‌...নইলে দেব আরেক কানচাপাটি...’।
    কেলো করেছে! আরেকটা চাঁটি খেলে মরেই যাবে বিশু। সে কোনমতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে চুপ করল।
    মেয়েটার বোধহয় করুণা হয়। একটু নরম সুরে এবার বলে—‘মাইন্ড খাস্‌ না। আজ আমার মিটার ডাউন হয়ে আছে। কিন্তু তুই এখানে কি মাড়াচ্ছিস? সত্যি সত্যিই সুইসাইড করতে যাচ্ছিলি না কি!’
    --‘বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না!’ বিশু নাক টানতে টানতে বলে—‘চরিত্র মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ! তার থেকে বড় কিছু হয় না। সেটাই যখন চলে যায়...’।
    মেয়েটা একটা সিগ্রেট মুখে দিয়ে ফস্‌ করে লাইটার জ্বালাল। সেই আলোতেই তার মুখ দেখতে পেল বিশু। এ কে রে! স্বর্গ থেকে কোনও অপ্সরা নেমে এসেছে না কি! উর্ব্বশী না মেনকা! ছোট করে ছাঁটা চুল। লম্বাটে পানপাতা মুখ! চোখ যেন মিশরীয় তুলিতে আঁকা! এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনেও দেখেনি সে। ইপ্সিতাদিও এর সামনে নস্যি!
    --‘ তুই তো দেখছি মোবাইল-ঈশপের গপ্প! এই রাতদুপুরে কি তোকে জ্ঞান দিতে বলেছি?’ বলতে বলতেই সিগ্রেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়েছে সে—‘বিড়ি খাবি?’
    --‘না। আমি খাই না’।
    --‘খেলে যা!’ সে এবার হাসল—‘মামা, তুই কোথা থেকে আমদানি হয়েছিস বে? বিড়ি খাস্‌ না, টাইম টেবিল দেখে সুইসাইড করিস, কান চাপাটি খেয়ে বাচ্চাদের মত ফেউ ফেউ করে কাঁদিস, আবার ঢপের জ্ঞানও দিস্‌। তো কি হয়েছে তোর চরিত্রের? কেউ রেপ করেছে?’
    বিশু হাঁ করে কিছুক্ষণ সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে কি! তারও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিল—‘তুমিই বা কোথা থেকে এসেছ বাপু! রাতে একটা পুরুষের সাথে ট্রেনলাইনের উপরে দাঁড়িয়ে গজল্লা করছ! ভয় ডরের নাম নেই! কথায় কথায় বিরাশি সিক্কার চড় হাঁকাচ্ছ! দিব্যি ফুক্‌ফুক্‌ করে সিগ্রেট টানছ! তার উপর একজন পুরুষকে জিজ্ঞাসা করছ যে সে রেপড্‌ কি না!’
    কিন্তু আরেকখানা পেল্লায় থাপ্পড়ের ভয়ে চেপে গেল সে। মিউমিউ করে বলল—‘তুমি যেই হও, আমার থেকে একশো গজ দূরে দাঁড়াও। পাড়ার লোকেরা দেখলে আমার হাড় ভেঙে দেবে’।
    সুন্দরী সজোরে হেসে উঠল—‘আমাকে দেখলে হাড় ভাঙবে না। নিজেদের হাড় বাঁচানোর চেষ্টা করবে। এবার বল্‌ তো, কি হয়েছে?’
    কেন বলল জানে না বিশু। কাকে বলছে তাও জানে না। কিন্তু সব কথা বলেই ফেলল। ইপ্সিতাদির বাড়ির কেলোটা সবিস্তারে বলল। পাড়ার ছেলেদের হুমকি, লাঞ্ছনা, যন্ত্রণার কথা—সব বলল। এমনকি পাড়ার সবাই যে তাকে ‘অসভ্য চোখ’ বলে সন্দেহ করছে তাও জানাতে ভুলল না। বলতে বলতে যখন তার চোখে জল প্রায় আসতে চলেছে এমন সময়ই দেখে...—
    ট্রেন! সদ্য সদ্যই স্টেশন থেকে ছেড়েছে। এত রাতে লাইন ক্লিয়ারই থাকে। জোরালো সবুজ সিগন্যাল দেখে ট্রেনের ড্রাইভার মনের আনন্দে স্পিড তুলেছে... দ্রুত বেগে সাঁ সাঁ করে এই ট্র্যাকেই আসছে!
    প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল বিশু। ট্রেনটা যে স্পিডে আসছে তাতে মৃত্যুর সঙ্গে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে তারা। মেয়েটি তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। ট্রেনটা ওদিকে ক্রমশই এগিয়ে আসছে।
    কোনমতে ধরা গলায় বলল সে—‘ট্রেন!’
    --‘ট্রেন! কোথায়!’ সুন্দরী পিছন ফিরে দেখার আগেই জোরালো আলো আর জোরালো হুইস্‌ল্‌ জানান দিল-ট্রেন আসছে!
    --‘ট্রেন আসছে! আর তুই শালা দেবদাসগিরি করছিস!’ মেয়েটি চেঁচিয়ে বলে—‘আবে, সাইড হ। নয়তো ট্রেন তোকে সাইজ করে দেবে!’
    একটু আগেই মরার কথা ভাবছিল বিশু। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! এখন তার ফের বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন তার মধ্যে কখন যেন জন্ম নিয়েছে! সে রেলওয়ে ট্র্যাক থেকে বিদ্যুৎগতিতে সরে গেল।
    কিন্তু মেয়েটার কি হল? সে সরছে না কেন? এক্ষুনি ট্রেন এসে ওকে দুটুকরো করে দিয়ে যাবে! ও কি বুঝতে পারছে না যে ট্রেনের ধাক্কায় একমুহূর্তে ওর সুন্দর শরীরটা দলামোচা পাকানো একটা লাশে পরিণত হবে! নাকি মূর্তিমান মৃত্যুকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছে!
    --‘তুমি কি করছ?’ অসহিষ্ণু স্বরে বলল বিশু—‘ট্রেন আসছে যে!’
    ঠান্ডা গলায় জবাব এল—‘জানি’।
    --‘এই ট্র্যাকেই আসছে’।
    --‘আমার চোখ দুটো কি বোতাম বলে মনে হচ্ছে তোর?’ সে খিঁচিয়ে উঠল।
    --‘তবে সরছ না কেন?’ বিশু ফুঁসে ওঠে—‘ও-ও-ও! বুঝেছি! তুমিও আত্মহত্যা করতে চাও। একা একাই মরতে চাও। আমাকে দেখে হিংসে হয়েছে বলে ফোটাতে চাইছিলে! ওসব হবে না! রেলওয়ে ট্র্যাক কারও প্রাইভেট প্রপার্টি নয়। একা একা তোমায় আত্মহত্যা করতে দেবো না আমি। মরলে দুজনেই মরব’।
    বিশু ফের ট্রেনলাইনে উঠে পড়ে। মেয়েটি তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়—‘তুই কোথাকার গান্ডু রে! আত্মহত্যা করবো কেন? কিন্তু আমার এই ঢ্যামনা জুতোর হিলটা শালা লাইনে আটকে গেছে, তাই নড়তে পারছি না!’
    --‘জুতো আটকে গেছে! কি সর্বনাশ! কই দেখি!’
    বিশু প্রায় হুমড়ি খেয়ে তার জুতোর উপর পড়েছে। প্রাণপণে টেনেটুনে খোলার চেষ্টা করল। ট্রেনটা তখন প্রায় কয়েকহাত দূরত্বে এসে পড়েছে। মেয়েটি অসহায় ভাবে ট্রেনের দিকে তাকাচ্ছে। যে স্পিডে এগিয়ে আসছে তাতে হাত দেখালেও থামবে না। একমুহূর্তেই দুজনকে কচুকাটা করে চলে যাবে...!
    সে বিশুর দিকে তাকায়—‘তুই সর্‌, এ জুতো খোলা যাবে না। একদম খাপে খাপ আটকেছে!’
    --‘ওর বাপ খুলবে...’।
    কোথা থেকে এত জোর পেল বিশু কে জানে। সে তখন জুতোর বকলস ধরে টানাটানি করছে। মেয়েটাও হাত লাগিয়েছে তার সাথে... ওদিকে ট্রেন কয়েক হাতের মধ্যে এসে পড়েছে!...তার জোরালো আলোয় দেখা গেল দুটো মানুষ রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে জীবন-মরণ লড়াই লড়ছে...ট্রেন প্রায় ঘাড়ের উপর...বিশুর চোখ বিস্ফারিত...আসছে...আসছে...এসে পড়ল...।
    কু-উ-উ-উ... লম্বা সাপের মত গাড়িটা একটা বড় হুইস্‌ল্‌ ছাড়ল। তারপর হুড়মুড়িয়ে চলে গেল ট্র্যাকের উপর দিয়ে। দুটো লোকের কি হল তা জানতে তার বয়েই গেছে! হুশহাশ শনশন করতে করতে ট্র্যাক কাঁপিয়ে, ইলেক্ট্রিকের তার কাঁপিয়ে সে নিজের রাস্তাতেই চলে গেল!
    আর ঐ দুজনের? তাদের কি হল?

    ট্রেন চলে গেল। আস্তে আস্তে একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
    দুটো শরীর জড়াজড়ি করে পড়েছিল লাইনের পাশে। নিস্পন্দ! নিথর! প্রথম কয়েকমিনিট কোনও সাড়া নেই। একেবারে মৃতদেহের মতই পড়ে আছে।
    --‘ওয়ে চিরকুট!’ প্রথমে সাড়া দিল মেয়েটিই—‘আছিস? না খাল্লাস হয়ে গেলি?’
    কুঁইকুঁই করে উত্তর এল—‘আছি’।
    --‘তবে উঠছিস না কেন?’ সে ঝাঁঝিয়ে বলে—‘আমায় আয়েশা তাকিয়া পেয়েছিস না কি, যে আয়েশ করে বুকটাকে তাকিয়া বানিয়ে শুয়ে থাকবি! বডি তোল্‌’।
    বিশু একদম ছেলেমানুষের মত শুয়েছিল। অনেকদিন বাদে কোন নারীর বুকে এমন মাথা রেখে শুয়েছে সে। ছোটবেলায় ভয় পেলেই মায়ের বুকে এরকম মাথা গুঁজে শুয়ে থাকত। আজও তার বড় ভয় লেগেছে। ছুটে আসা ট্রেনটাকে দেখে হাল পাতলা হয়ে গিয়েছিল। আর অদ্ভুত ব্যাপার, মায়ের বুকে যে নিশ্চিন্ততার গন্ধ ছিল, এই নারীর বুকেও অবিকল সেই একই গন্ধ! এই গন্ধ বহুদিন পায়নি। এই গন্ধের জন্য কাঙাল হয়ে ছিল! ইপ্সিতা, রাণী, মৌমিতা, বসুধা, শিরিণ কিম্বা হালফিলের রঞ্জনা—কারুর বুকে এমন মায়াময় গন্ধ ছিল না! সেখানে শুধু মাংসের চটচটে গদগদে গন্ধ!
    কিন্তু এই নারী কে! মায়ের বুকের গন্ধ এর বুকে এল কি করে!
    --‘কি হল বে! একটা মেয়েছেলের সাথে ঘষাঘষি করতে খুব ভালো লাগছে না! উঠবি না...’।
    বিশু দু হাত তুলে দিয়ে ‘ভজ গৌরাঙ্গ’ হয়ে বলল—‘মেরো না...আমি তোমাকে ছুঁই নি। এই দ্যাখো...আমার হাত!’
    --‘তবে এখনও ল্যাদ্‌ খাচ্ছিস কেন? ওঠ্‌!’
    --‘আমার শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে’। বিশু পাশ ফিরে মেয়েটার চোখে চোখ রাখল—‘তোমায় একদম আমার মায়ের মত লাগছে। তুমি কে বলো তো!’
    --‘ধুস্‌ বাল! খালিপিলি সেন্টু খেতে লেগেছে!’ মেয়েটা ধড়মড় করে উঠে বসে। শাড়ি ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—‘যাঃ শালা! শাড়িটা মায়ের ভোগে গেল!’
    জুতোটা শেষমুহূর্তে অনেককষ্টে রেললাইন থেকে ছাড়াতে পেরেছিল বিশু। কিন্তু শাড়িটা বাঁচাতে পারেনি। আঁচলটা রেললাইনের পাশের কাঁটা গাছে আটকে গিয়ে পুরো ফেঁসে গেছে।
    --‘এইজন্যই এসব চাপের জিনিস পরতে চাই না!’ মেয়েটাকে একটু অসহায় দেখাল—‘কি ফান্টুস চিজ রে বাপ! একটু টান মারলেই ফড়ফড় করে ছিঁড়ে যায়!’
    বিশু পুরনো দিনের নায়কের মত নিজের উইন্ডচিটারটা খুলে দিল। রাতের দিকে এদিকে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দেয়। সেজন্যই পরে এসেছিল। বিশু যতই ন্যালা ক্যাবলা হোক্‌, মরার পর উপরওয়ালার দরবারে হাঁচতে হাঁচতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই উইন্ডচিটার!
    --‘নাও, এটা পরে যাও’। সে উইন্ডচিটারটা এগিয়ে দিয়েছে—‘অসুবিধে হবে না। পরে ফেরৎ দিয়ে দিও’।
    সুন্দরী চোখ বড় বড় করে বলল—‘তুই তো দেখছি এক নম্বরের ঘোঁচু! আমি থোড়াই তোর আস্তানা চিনি! ফেরৎ দেব কি করে?’
    --‘না পারলে দিও না!’ বিশু সহজ গলায় বলে—‘ শাড়িটা খুব বিচ্ছিরি ভাবে ছিঁড়ে গেছে। উপরে এটা চাপিয়ে চুপচাপ চলে যাও’।
    মেয়েটা এবার হো হো করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলল—‘ শালা আইটেম বটে একটা! আজ সারাদিন আমার মুড ঝুলে ছিল। কিন্তু এবার দাঁত না কেলিয়ে পারছি না! সত্যি করে বল্‌ মামা, তোকে কোন বোকাচোদা মাগীখোর বলেছে! এমন ন্যালাবোদা মাকড়া আমি সারাজীবনে দেখিনি! তুই যদি মাগীবাজ হোস্‌, তবে শালা মাগীবাজদের থুক্‌ ফেলে ডুবে মরা উচিৎ! হাঃ হাঃ হাঃ...’
    হাসতে হাসতেই উর্বশী উইন্ডচিটারটা গায়ে দিয়ে চলে গেল। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিল বিশু। মেয়েটা একদম ব্যাটাছেলেদের মত বুক চিতিয়ে হুড়ুম দুড়ুম করে হাঁটে। তা হোক্‌। তবু বড় মিষ্টি। ভারি সোজাসাপ্টা! আর সবচেয়ে ভালো কথা, এই একটা মানুষ পাওয়া গেল যে বিশুকে চরিত্রহীন ‘অসভ্য চোখ’ বলে মনে করে না!
    বুকের মধ্যে একটা চিড়িক চিড়িক টের পাচ্ছিল সে। আর কি দেখা হবে না? কে ছিল মেয়েটা? নামটা তো জানাই হল না! নবগ্রামে তো মেয়ের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এতদিন কোথায় লুকিয়েছিল এই মেয়ে!
    হঠাৎ খেয়াল হল, মেয়েটার একটা জুতো তার হাতেই রয়ে গেছে। এই জুতোটাই টেনেটুনে বের করে এনেছিল বিশু। ফেরৎ দেওয়ার কথা মনে নেই!
    জুতোটা যত্ন করে দুহাতে চেপে ধরল সে। কপালে থাকলে এই জুতোই আবার খুঁজে দেবে ওকে।
    বিশু মৃদু হাসল। বাঃ উপরওয়ালা, ফ্রাস্টু পাব্লিকের জীবনেও তবে রূপকথারা আসে। সে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মনে মনে ওর নাম দিল—সিন্ডারেলা!

    ৯.
    ক্র্যাও-ক্র্যাও-ক্র্যাও-ক্র্যাও-ট্যারাং-ট্যারাং...ঢিচক্যাও!
    কি আশ্চয্যি! থোবড়া অমন ঝুলে গেল কেন? আরে কিছু না! এট্টু ব্যাকগ্রাউন্ড মুজিক দিচ্ছি গো মামা! জেমস্‌ বন্ডের থিম আর কি!
    কারণ? আর কি! আমাদের পিকুল মাথায় টুপি পরে টিকটিকিগিরি করতে বেরিয়েছে। বাবার কালো ব্লেজার, কালো ট্রাউজার—দুটোই বেচারার গায়ে ঢিলে হয়েছে। হবে না-ই বা কেন? ওদের বাড়িতে একমাত্র বাবাই দুর্ভিক্ষের কারণ। বাকিরা সবাই ফলাফল! তাই বাবার পোষাক তার গায়ে এইসান ঢিলা হয়েছে যে আরেকটা লোককে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়!
    পিকুল কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, ঐ ঢিলেবল্টুওয়ালা বিশু এরকম দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে! অন্য কেসগুলো তবু মেনে নিতে রাজি ছিল। কিন্তু ইপ্সিতাদির বাড়ির জানলায় চোখ রাখার ধ্বক্‌ বিশের নেই! ঐ যন্তরকে যে চেনে সে জীবনেও জানলা দিয়ে উঁকি মারবে না! কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে মাগীর চিল্লানি শুনতে যাবে! তার উপর বিশে ইপ্সিতাদির এক্স বয়ফ্রেন্ড ছিল। দুজনে প্রচুর ‘ঢুকুঢুকু’ করেছে। বিশেও যন্তরপাতি নেড়েচেড়ে হাতের সুখ করেছে নিশ্চয়ই। যখন মর্নিং, ম্যাটিনি, ইভনিং শো দেখে দেখে দেখার আর কিছু বাকিই নেই, তবে ফের নাইট শো দেখতে যাবে কোন দুঃখে! তাও আবার ঐ ঝুলস্য ঝুল ধ্বজা মার্কা ফিল্ম!
    নাঃ বিশে নয়। অন্য কেউ। অন্য কোনও ছুপা রুস্তম! পিকুল মনে মনে ঠিক করেছে, আর সুব্রতদার ফান্ডা শুনবে না। প্রচুর ভাঁটিয়েছে মালটা। ভাঁটিয়ে ভাঁটিয়ে কান পাকিয়ে দিয়েছে। এখন আর ভাঁট শোনার সময় নয়। কিছু করতে হবে। করে দেখাতে হবে।
    ‘আঠের বছর বয়স কি দুঃসহ’! যদিও পিকুল আঠেরো নয়, উনিশ। তবু স্পর্ধা তার কিছু কম নয়! রাতের বেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে, নিজের ঘরে পাশবালিশকে স্লিপিং স্যুট পরিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, জলের পাইপ বেয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে নেমে এসেছে। রাতের অন্ধকারে কালো পোষাকে সে তদন্ত করতে চলেছে। অসভ্য চোখের পিছনের রহস্য খুঁজে বের করবে। করতেই হবে। নয়তো সমস্ত নবগ্রামের ছেলেপুলের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন।
    --‘আরে, পিকুল না!’
    বিন্তিপিসি এত রাতেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। রোজ রাতে কাজকর্ম সারার পর মহা শান্তিতে গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজেন তিনি। তারপর পাড়ার কলে গিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক খোঁয়াক খোঁয়াক করে সারা পাড়াকে জানিয়ে দেন যে তিনি এবার শুতে যাবেন! আজও গুড়াকুরাঙা দাঁত বের করে বললেন—‘এটা কি পরেছিস বাবা! তোকে যে কাকতাড়ুয়ার মত দেখায়!’
    এটা কি কমপ্লিমেন্ট! না অন্যকিছু! পিকুল বুঝে উঠতে পারে না থ্যাঙ্ক ইউ বলবে কি না! বিন্তিপিসিকে চটানোও ঠিক নয়। তাই উপায় না দেখে দাঁত কেলিয়ে ‘হেঁ...হেঁ...’ করল।
    --‘তা এত রাতে এরকম বিদঘুটে সেজেগুজে যাস কোথায়? থ্যাটারে না কি!’
    থিয়েটারই বটে। শখের ক্রিয়েটারের শকের থিয়েটার। স্বনিয়োজিত গোয়েন্দার প্রথম কদমেই এমন একখানা বুক ভেঙে দেওয়ার মত কমেন্ট। তবু কিছুতেই দমছে না পিকুল। হুঁ হুঁ বাবা, উনিশ বছর বয়স কি দুঃসহ!
    সে কান টান চুলকে বলল—‘এই যাচ্ছি একটু নজরদারি করতে...’।
    গুড়াকুর ডিবে থেকে আরেকটু তামাক তুলে নিয়ে দাঁতে ঘসতে ঘসতে বললেন বিন্তিপিসি—‘নজর রাখতে যাচ্ছিস? তা কার উপর নজর রাখবি বাপ’?
    --‘এখনও ঠিক করিনি’। সে চিন্তাণ্বিত—‘তবে যা শুরু হয়েছে নবগ্রামে...’।
    --‘যা বলেছিস’। পুচ্‌ করে খানিকটা থুতু ফেলে বললেন তিনি—‘পারলে ঐ হাড়গিলে হতচ্ছাড়া বিশেটার উপর নজর রাখ। এসব ফচকেমি ওরই। আমি পরশুও ওকে নবনীতাদের বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি। অনামুখো কোথাকার’।
    নবগ্রামেও তবে এমন একখানা মিস মার্পল আছেন! পিকুলের ভুরু কুঁচকে যায়। বিধবা বিন্তিপিসির বিশেষ কাজকর্ম কিছু নেই। বুড়ি বিন্দাস সাদাসিধে লাইফ লিড করে। পিসোর পেনশন আর একতলার ভাড়ার টাকা দিয়ে একলা মানুষের দিব্যি চলে যায়। ছেলে থাকে বিদেশে। সেখানেই মেম বিয়ে করে সেট্‌ল্‌ হয়ে গেছে। মাকে সে ও টাকা পাঠায়। অথচ বুড়ির জীবনযাপনে কোনও বিলাসিতা নেই। একখানা সাদা থান পরে থাকে। সিদ্ধ-ভাত নিজের হাতেই রেঁধে খায়। দিনভর আর কোনও কাজ নেই। জানলার সামনে বসে কুচকুচ করে সুপারি-ভাজা সুপারি জাঁতি দিয়ে কাটে, আর লোকজনকে লক্ষ্য করে। এটাই বুড়ির হবি। ওর চোখ এড়িয়ে নবগ্রামে একটা ভিনদেশি কাকও আসতে পারে না।
    গোয়েন্দার প্রথম কাজ তথ্য সংগ্রহ করা। আর সেকাজে হেল্প করতে পারে বিন্তিপিসি।
    ব্যস্‌। নিজের কাজে লেগে গেল পিকুল।
    --‘পিসি, একটু মনে করে দেখো তো...’ সে বলে—‘আর কাউকে দেখেছ যাকে তোমার সাস্‌পিশাস মনে হয়?’
    --‘কি পিশাচ!’
    কেলো করেছে! সাসপিশাসের বাংলা করে বলল পিকুল—‘পিশাচ নয়, সাস্‌পিশাস্‌--সন্দেহজনক’।
    --‘তা বাবা, বললিই যখন, তখন বলি’। প্রবল উত্তেজনায় আরও একটু গুড়াকু দাঁতে দিয়ে বললেন তিনি—‘ রাবণটাকেও আমার সন্দ হয়! ঐ যে কি ‘পিশাচ’ বললি না? ও হচ্ছে আস্ত একটা পিশাচ! রাতের বেলায় ওসব ছাইপাঁশ গিলে কি করে বেড়ায় কে জানে! সেদিন আমাদের বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। এমন হেঁড়ে গলায় গান গাইছিল যে রাধেগোবিন্দর নাম জপতেই পারি না। ওদিকে একতলায় শিবুর বৌটা রাতে একা থাকে। শিবুর নাইটডিউটি কি না!’
    --‘তারপর?’
    --‘তারপর আর কি?’ পিসি হাসলেন—‘বুদ্ধি থাকলে উপায় আসে। উপর থেকে দিলাম একবালতি জল ঢেলে ব্যাটার ঘাড়ে। তারপর থেকে আর এদিকের রাস্তা মাড়ায় না মিন্সে!’
    জল ঢালার কথায় পিকুলের মনে পড়ে গেল, একবার সে এমন করেই একবালতি জল ঢেলে দিয়েছিল বাবার বন্ধু সুবীরকাকুর টাকে! আসলে সুবীরকাকুর টাকটা তার লক্ষ্য ছিল না। নীচে দুটো বিড়াল বহুৎ রোঁয়া ফুলিয়ে কাজিয়া করছিল। মা বলেন বিড়ালেরা যখন ঝগড়া করে তখন মাথায় জল ঢেলে দিলে ঝগড়া নাকি আরও বেড়ে যায়। যদি আগের লাফড়ার কারণ মাছের কাঁটা হয়ে থাকে, তবে সেসব ছেড়ে জল নিয়ে ঝগড়া চলতে থাকে। একটা বিড়াল বলে—‘শালা, হুলোর বাচ্চা—তুই আমার গায়ে হিসি করে দিলি!’ অন্যটা বলে—‘হারামজাদা, হিসি তো তুই করেছিস’। এই নিয়ে তু তু ম্যাঁও ম্যাঁও চলতেই থাকে!
    সত্যিই তাই হয় কি না দেখতে গিয়েছিল পিকুল। কিন্তু জলটা বিড়ালদুটোর গায়ে না পড়ে পড়ল সুবীরকাকুর টাকে। ফলস্বরূপ তার তুমুল ব্যথা হয়েছিল। সে ব্যথার কথা না হয় এখন থাক। পরে জায়গামত বলা যাবে।
    --‘আর কেউ পিসি?’
    পিসি একটু ভেবে বলেন—‘এই ভোলা মুদিটাকেও সন্দ হয়! ওর চরিত্তির সুবিধার না। তাছাড়া তোদের ক্লাবের সুব্রত। বুড়ো বয়েসেও বিয়ে করেনি। কেন বল্‌ দিকিন! নিশ্চয়ই কোনো মেয়েছেলে রেখেছে। তারপর আমাদের শান্তনুর ছেলেটা...’।
    --‘কে? হুক্‌স্‌!’ পিকুল চোখ কপালে তুলে ফেলেছে। শান্তনুদার ছেলেটার মুখটা অনেকটা হুঁকোর মত বলে প্রথমে সবাই ওকে হুঁকো বলে ডাকত। সেটারই স্মার্ট সংস্করণ হুক্‌স্‌! কিন্তু...!
    --‘বল কি পিসি! হুক্‌সের তো মাত্র সাত বছর বয়েস!’
    --‘তাতে কি হয়েছে!’ পিসি বললেন—‘যার হয় তার সাত বছরেই হয়, যার হয় না সাতাশিতেও হয় না! জানিস? সেদিন বাসে উঠে দেখি ও ছোঁড়া বাবার কোল থেকে নেমে সিটের নীচে বসে কি যেন দেখছে! ওর বাপ জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘সামনের সিটের দিদিটা না লাল রঙের প্যান্টি পরেছে। তাই দেখছিলাম...’।
    বোঝো! আজকালকার বাচ্চাগুলোও সব একেকটা বিষ মাল! পিকুলের হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। কোনমতে হাসি চাপল।
    --‘ছোঁড়া তো নয়, বিষের গোড়া!...’ বিন্তিপিসি একের পর এক সবার পোল খুলতে শুরু করলেন। কবে হুলোদা কার বাড়িতে উঁকি মেরেছিল। শাঁকালুদার সাথে বৌদির বনে না। পাড়ার কোন্‌ পাব্লিক দুইখানা বিয়ে করে বসে আছে। কে তার বৌকে ধরে ঠ্যাঙায়। হাড়কাটা গলিতে কার সেটিং আছে...ব্লাঁ...ব্লাঁ...ব্লাঁ। শুনতে শুনতে পিকুলের ভয় লাগছিল। কখন তার নিজের বাপেরই কীর্তি শুনতে হবে কে জানে! যেভাবে বলতে শুরু করেছেন বিন্তিপিসি তাতে সাত বছরের হুক্‌স্‌ থেকে শুরু করে ইপ্সিতাদির কুকুর ঘোঁতনও বাদ যাবে বলে মনে হয় না!
    --‘ইয়ে...পিসি...আমি একটু এগোই...’। সে আমতা আমতা করে বলে—‘চতুর্দিকটা একটু চক্কর মেরে দেখি...’।
    --‘যা বাবা’। পিসি কলের দিকে এগোতে এগোতে বললেন—‘তবে যা যা বললাম মনে রাখিস। আর বিশেটার উপর কড়া নজর রাখিস’।
    --‘আচ্ছা...আচ্ছা...’। বলতে বলতে প্রায় ওখান থেকে কাল্টি মারল পিকুল। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা রীতিমত বিপজ্জনক। বিন্তিপিসি যে এমন পি এন পি সি মাস্টার তা কে জানত!
    এখন বেশ রাত হয়ে এসেছে। নবগ্রামের রাস্তা শুনশান। দু একটা ঘিয়েভাজা নেড়ি রাস্তায় মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে। পিকুলের পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু পাত্তা দিল না।
    পিকুল ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। নয়তো এই মুহূর্তে একটু ফোঁকাফুঁকি বিজনেসের দরকার ছিল। ইশ্‌শ্‌শ্‌, বাবার পকেট থেকে গোটা দুই তিন গোল্ড ফ্লেক ঝেড়ে দিলে মন্দ হত না। সিগ্রেটে টান না মারলে মাথাটা ঠিক সাফা হয় না। বাড়িতে সিগ্রেট খাওয়ার স্কোপ তেমন নেই। মা রোজ সরেজমিনে তদন্ত করে দেখেন তার পকেটে একটা সিগ্রেটের প্যাকেট বা দেশলাই পাওয়া যায় কি না! পেলেই অগ্নিকান্ড করবেন। সেই ভয়েই বাবার পকেট ঝেড়ে ঝেড়ে সাফ করে পিকুল। বাবার সাথে ডিল হয়েছে তার। দিনে তিনটে সিগ্রেটের বদলে মাসে একটা করে পায়রার জোগান দিতে হবে।
    তা মন্দ কি! সিগ্রেট খেলে তবু নিজেকে পুরুষ পুরুষ লাগে। নয়তো এখনও পাব্লিক তাকে বাচ্চা ছেলে বলেই চালাবার তাল করছে। এমনকি দেবীও বলেছিল পিকুলকে নাকি ‘বয়’ লাগে, ‘ম্যান’ লাগে না!
    হ্যাঁ, পিকুলকে ‘ম্যান’ লাগবে কেন? ‘ম্যান’ তো ঐ হারামীর হাতবাক্স পল্টু! দেবীর যে কি পছন্দ ওকে! এমন কি ‘ম্যান’ যে ওকে দেখলেই ট্যান খেয়ে পড়তে হবে! ঐ তো হাতের কতগুলো মাস্‌ল্‌ সম্বল! একবার পাঁঠার মাংসের দোকানে একটা কাটা পাঁঠাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লেগেছিল পিকুলের। পরে ভেবে দেখেছে, পাঁঠাটাকে অবিকল পল্টুর মত দেখতে। ঐরকমই ছাগুলে দাড়ি। ঐরকমই মাস্‌ল্‌ ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। ঠোঁটের তলায় গুজিয়া দাড়ি, তাগড়াই জুলপি আর খানকতক ফর শো মাস্‌ল্‌ থাকলেই কি পুরুষ হওয়া যায়! অত সহজ নাকি!
    দেবীর কথা মনে পড়তেই ব্যথাটা বড় প্রবল হয়ে উঠল। পিকুলের জীবনের প্রথম ও শেষ ব্যথা দেবী, ওরফে দেবাদৃতা। দেখলেই কিরকম ভয় লাগে। মনে হয়—এখনই বুঝি এসে জিজ্ঞাসা করবে—‘বল জাড্যাপহ মানে কি?’ অথবা ‘ক্যাটাক্লিজম কাকে বলে?’ ‘ধৃষ্টদ্যুম্ন কে ছিলেন?’, ‘কুজ্ঝটিকা বানান কি?’
    দেবী এরকমই। কম কথা বলে। নাকের উপর একটা ভারি পাওয়ারের চশমা। চশমার নীচ দিয়ে এমন করে তাকায় যেন কলেজের প্রিন্সি তাকাচ্ছে! অসম্ভব পড়ুয়া মেয়ে। রাগী রাগী ভারি চেহারা। পিকুল তো তার পাশে নেহাৎই খড়কে কাঠি। তবু ঐ মেয়েটাকেই ভালোবাসে সে। হোক্‌ না মোটা। হয়তো মড্‌ মেয়েদের মত সেক্সি নয়। কিন্তু ভালোবাসা তো রোগা মোটা সেক্সি বোরিং দেখে না। ওর মত গোলাপি ফুলো ফুলো পাঁউরুটির মত গাল তো ক্যাটরিনা কাইফেরও নেই। বিপাশা বসু কি অমন ভায়োলিন বাজাতে পারে? না ঐশ্বর্য রাই ধর্মঘটের সমাস বলতে পারবে? সেসব শুধু দেবীই পারে, আর কেউ না।
    অথচ ঐ মেয়েটা যে কি দেখল ছাগলদাড়ি পল্টুর মধ্যে তা ভগাই জানেন! পল্টু তো দেবীকে পাত্তাই দেয় না। ওর চেহারা নিয়ে ফিচলেমি করে। কখনও ‘হাতি’ বলে, কখনও ‘ডাইনোসোর’। ওর লাইন রাপচিক মডগুলোর সাথে ইনস্টলমেন্টে চলে। দেবী সব জানে, তবু পিকুলকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওকেই ভাও দেয়।
    দেবী কি বোঝে না যে পিকুলের কষ্ট হয়! পিকুল কি এমন অপরাধ করেছে? দোষের মধ্যে দেবীর বাবা, সুবীরকাকুর টাকে একবালতি জল ঢেলে দিয়েছিল! তাও তো সঙ্গে বালতিটাও ফেলেনি! বালতিটা ফেললে ক্রিমিন্যাল অফেন্স হত। কিন্তু শুধু জলটা ধর্তব্যই নয়। অথচ সেটাকেই ইস্যু করে তার পাতা কাট করে দিল দেবী। পিকুল অনেক অনুরোধ করেছিল। বলেছিল—‘আমার ভুল হয়ে গেছে দেবী, প্লিজ আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করিস্‌ না’।
    দেবী নিষ্ঠুরের মত উত্তর দিয়েছে—‘বাবার মাথায় বিনা কারণে জল ঢালার আগে মনে ছিল না?’
    সে কি বলবে ভেবে না পেয়ে অক্ষম যুক্তি দেয়—‘সে তো তোরাও বিনা কারণে ঝপ্‌ঝপ্‌ করে শিবের মাথায় গ্যালন গ্যালন জল ঢালিস। তা নিয়ে কি কার্তিক বা গণেশ কমপ্লেন করতে আসে?’
    দেবী তার মুখের উপর দমাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল! সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পিকুলের বুকেও চিড় ধরেছিল। আজও সেই চিড় মিলিয়ে যায় নি। ব্যথাটা আরও বেশি টনটনিয়ে ওঠে, যখন দেখে পল্টুর সঙ্গে এক বাইকে যাচ্ছে দেবী। হাসতে হাসতে দুজনে পাড়ার মোড়ে ফুচকা খাচ্ছে, কিম্বা মল থেকে শপিং করে ফিরছে।
    কেন দেবী? লঘু পাপে এমন গুরু দন্ড কেন? পল্টু কি তোকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারবে? প্র্যাকটিক্যালের খাতায় তোর নামের নামাবলী লিখে রাখতে পারবে? পল্টু কি তোর কথা ভেবে ভেবে রোগা হয়ে যেতে পারবে? তোর জন্য আমি কত কিছু করলাম। কচি কচি ঘাসের মত দাড়ি গোঁফগুলোকে বারবার শেভ করে বাঁশের মত করার চেষ্টা করলাম। গালপাট্টা রাখার চেষ্টা করলাম। বাইক কেনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। রাবণের কাছে মাস্‌ল্‌ বাগাতে পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু কে জানত রাবণ হীরালালবাবুর কেসটা ধরে ফেলেছে! হতচ্ছাড়া ডাম্বেল ছুঁড়ে মারল! তোর জন্য ডাম্বেল খেয়ে কি পল্টু মাথায় আলু গজাতে পারবে?
    ভাবতে ভাবতেই ফোঁৎ ফোঁৎ করে কয়েকটা বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিকুল। দেবী আর কখনও কথা বলেনি তার সাথে। আর কখনও দেখা হয়নি। অথচ সে দেবীকে এখনও ভালোবাসে। দেবীর ঐ পিপের মত গোলগাল চেহারার কথা ভাবলেই বড় ফ্রাস্টু খেয়ে যায়। মনে মনে, স্বপ্নে কতবার যে—‘আই লাভ ইউ দেবী’ বলেছে তার ইয়ত্তা নেই।
    তার দীর্ঘশ্বাসের সাথে নারকেল গাছের পাতাগুলোও তাল মিলিয়ে শিরশির করে ওঠে। রাস্তায় এখন একা পিকুল। চতুর্দিকে আর কেউ নেই। আশেপাশের বাড়িগুলোর আলোও নিভে গেছে। জ্যোৎস্নার আলোতে চারদিকটা ছায়া ছায়া লাগছে। অন্ধকারের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ আলো মুচকি হাসির মত ছড়িয়ে। তার মধ্যে পিকুল আর তার ছায়া হেঁটে চলেছে অজানার পথে!
    রবিকাকুর বাড়ির সামনে এসে আচমকা থমকে গেল সে! ও কে? চাঁদনি রাতে একটা ছায়ামূর্তি সুট্‌ করে চলে গেল না বাড়ির দিকে! দূর থেকে হলেও স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে পিকুল। একটা আস্ত মানুষের মূর্তি। পা টিপে টিপে গেট খুলে ঢুকে গেল ভিতরে। এতক্ষণে তো রবিকাকুদের শুয়ে পড়ার কথা! তবে ওটা কে!
    উত্তেজনায় পিকুলের মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে গেল। ওটা নির্ঘাৎ সেই ‘অসভ্য চোখ’! রবিকাকুর মেয়ে বুলা ক্লাস টুয়েলভে পড়ে। দেখতে শুনতেও মোটামুটি। ইনফ্যাক্ট ওর চোখদুটো রামট্যারা না হলে হয়তো সুন্দরীই বলা যেত! রবিকাকু মেয়েকে আগলে আগলে রাখেন। মেয়েদের ইস্কুলে পড়ান। ছেলেদের সাথে কথা বলা বারণ! কথা বললেই পিঠে কিল। এখনও মেয়েকে নিয়ম করে স্কুলে-কোচিঙে ছাড়তে যান। পাছে মেয়ে প্রেম করে, এই ভয়ে তাকে একা একা বাড়ি থেকে বেরোতেই দেন না! অন্যদিকে রবিকাকুর বৌ, মৃণাল কাকিমাও বেশ ডবকা! একজোড়া তুমুল বুকের অধিকারিনী! সে বুক এতোটাই ভয়ঙ্কর যে একবার পাড়ার ডাক্তার মৃন্ময়দা মহা বিপদে পড়েছিলেন! বেচারা ডাক্তার স্টেথোস্কোপ নিয়ে হার্টবিট শোনার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন! কিন্তু প্রত্যেকবারই আটকে যায়! স্টেথোস্কোপটা কোথায় রাখবেন ভেবেই পান না! অবশেষে লজ্জার মাথা খেয়ে ডাক্তার সাহেব বলেই ফেললেন—‘আপনার ও দুটো একটু সরাবেন প্লিজ?’
    কেলো বলে কেলো! পুরোপুরি ডেঙ্গি কেস!
    সেই বাড়িতেই ঢুকতে যাচ্ছে হতভাগা! দাঁড়াও...তোমার লোভনীয় সিন দেখা ঘোচাচ্ছি! ফুলপ্রুফ প্ল্যানের উপরে ফের একবালতি জল না ঢেলেছে পিকুল!
    পিকুলও অন্ধকারে মিশে গুঁড়ি মেরে রবিকাকুর বাড়ির সামনে চলে এল। চলো জওয়ান...টেক ইওর পজিশন! বদমায়েশটাকে একদম হাতে নাতে ধরতে হবে। যাকে বলে ‘রক্তাক্ত হস্তে’ পাকড়াও করা!
    ছায়ামূর্তিটা তখন রবিকাকুর মেয়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। বাড়ির সব আলো নেভানো। একটা গনগনে আগুনের শিখা দেখতে পেয়ে বুঝল, ব্যাটা সিগ্রেট ধরিয়েছে! পিকুলের মনটা উশখুশ করে উঠল! এইমুহূর্তে একটা সিগ্রেট পেলে বড় ভাল হত। বুকের ভিতরটা উত্তেজনায় ধুকপুক করছে। এবার সে ধরবে, ইনফ্যাক্ট ধরেই ফেলেছে ‘অসভ্য চোখ’কে! ঐ তো! হতচ্ছাড়া জানলায় উঁকিঝুঁকি মারছে। এইবার ক্যাঁক করে ধরলে হয় না?
    --‘ম্যাঁও...ম্যাঁও...ম্যাঁও...’
    যাচ্চলে! এমন বিড়ালের ডাক ডাকছে কেন? সিন দেখতে হলে চুপচাপ দ্যাখ্‌! অমন বিড়াল ডেকে সবার ঘুম ভাঙানোর উপক্রম করার মানে কি! এ তো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার!
    পিকুল আর সময় নষ্ট না করে সাঁৎ করে গিয়ে দাঁড়াল লোকটার পিছনে। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করল। লোকটা তার থেকে একহাত লম্বা! কি করে কায়দা করবে স্ট্র্যাটেজিটা ভেবে নিল। তারপরই বিদ্যুৎগতিতে লোকটার গলা ধরে ঝুলে পড়ল! চেঁচিয়ে উঠল—‘পে-য়ে-ছি...পে-য়ে-ছি...’।
    লোকটা প্রথমে ভ্যাবচ্যাক্‌ হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটা বুঝতে পেরেই প্রায় খন্ডযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে পিকুলের সঙ্গে। প্রাণপণে তাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পিকুলও বাঘের বাচ্চা! সে একেবারে লোকটার গলা জড়িয়ে ধরে সেঁটে আছে। যতই ষাঁড়ের মত লম্ফঝম্প করো না কেন, এত সহজে ছাড়ছে না।
    লোকটার গলা ধরে ঝুলতে ঝুলতেই সে তখনও হেঁকে যাচ্ছে—‘পে-য়ে-ছি...পে-য়ে-ছি-ই-ই-ই!’
    চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘরের ভিতরে আলো জ্বলে উঠল। রবিকাকু লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে ‘কি হল...কি হল’ বলতে বলতে বেরিয়ে এসেছেন। একটু দূরেই লাঠি হাতে পাড়ার ছেলেরাও ছিল। তারাও চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে এসেছে। এসে দেখে ভয়ঙ্কর কান্ড! একটা হ্যাট কোট পরা লোক আরেকটা লোকের সাথে প্রবল মারপিট করছে!
    পাহারাদার দলের কনিষ্ঠতম সদস্য বাবাই কি করবে ভেবে না পেয়ে হাতের লাঠিটাই গদাম করে বসিয়ে দিয়েছে কোট পরা লোকটার উপরে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে—‘আবে হেপাটাইটিস বি, আমাকে ঠ্যাঙাচ্ছিস কেন? আমি পিকুল’।
    ততক্ষণে অন্য লোকটাকে পাড়ার ছেলেরা ধরে সাইজ করে দিয়েছে। পিকুল কোনমতে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—‘ঐ লোকটা কাকুদের জানলা দিয়ে উঁকি মারছিল। আরও কিছু করার তালে ছিল। আমি ধরে ফেলেছি’।
    মৃণাল কাকিমাও চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এসেছেন। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি হাঁ। রবিকাকুকে বললেন—‘আরে, এতো তারক!’
    রবিকাকুও এবার লোকটাকে ভালো করে দেখলেন—‘তাই তো! আমাদের তারক! তুই এতোরাতে এখানে কি করছিস্‌?’
    পিকুল উত্তর দেয়—‘আপনাদের জানলা দিয়ে উঁকি মারছিল কাকু, শুধু তাই নয়—বিড়ালের ডাকও ডাকছিল!’
    তারক রবিকাকুদের ড্রাইভার। রবিকাকুর জেনটা সে-ই চালায়। প্রথমে তো কিছুতেই মুখ খুলবে না! কিন্তু পাড়ার ছেলেদের দাওয়াই পড়তেই সব গলগল করে উগরে দিল।
    সে কারুর জানলায় চোখ রাখার তালে ছিল না। স্রেফ পালাবার তালে ছিল। একা একা নয়, সহচরী সমেত! এবং সেই সহচরীটি অন্য কেউ নয়, স্বয়ং রবিকাকুর মেয়ে বুলা! বিড়ালের ডাকটা সিগন্যাল ছিল। এই হতভাগা পিকুল ঘাড়ে এসে না পড়লে এতক্ষণে তারা ভোঁ ভাঁ হয়ে যেতে পারত।
    রবিকাকু কথাটা শুনে হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না! বুলা নিজেও ততক্ষণে ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সমস্ত ঘটনা দেখে-শুনে আকাশপ্রমাণ হাঁ করে কান্না জুড়ল! রবিকাকু একটা কানচাপাটি বাগিয়ে তেড়ে গেলেন মেয়ের দিকে—‘তোকে এত চোখে চোখে রাখি। আর তুই তলে তলে এই চিন্দিচোরটার সাথে ভাগবার তাল করছিস্‌? আজ তোর সবক’টা হাড় না ভেঙেছি...’।
    বুলার কপালে দুঃখ ছিল। পিকুলই বাঁচাল। এমনিতেই এঁচোড়ে পাকা হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। আজ সেই সুনামের সদ্ব্যবহার করল সে। কাকুকে থামিয়ে বলল—‘কাকু, কিছু মনে করবেন না! ফ্যামিলির ড্রামা গুলো চার দেওয়ালের মধ্যে থাকলেই ভালো হয় না? পাব্লিকলি মারপিট করে লাভটা কি হবে? আপনার মেয়ে কি শুধরোবে? যদি চাঁটা খেয়েই সবাই শুধরোত, তবে পুলিশের ট্রিটমেন্টেই এতদিনে সব চোর-লুচ্চাগুলো সাধু-সন্নিসি হত। ’
    বলতে বলতেই তার মুখ গম্ভীর হল—‘তাছাড়া মেয়েকে চাঁটানোর আগে নিজেকে চাঁটান। বুলার থেকে বেশি দোষ আপনার নিজেদের। মেয়েকে ছেলেদের সাথে মিশতে দেবেন না, কথা বলতে দেবেন না, সবসময় আগলে আগলে রাখবেন! এভাবে আটকে রাখলে ও বুঝবে কি করে যে ছেলেরা শুধু লাইন মারতেই জানে না, দোস্তি করতেও জানে। ছেলেরা দাদা হয়, ভাই হয়, বন্ধু হয়। এসব কিছুই জানে না বুলা। শুধু জানে ছেলে মানেই ই.টি! ফুলটু ব্যান্‌ড জিনিস। আর এই বয়েসে নিষিদ্ধ মালের দিকেই ছেলেমেয়েরা বেশি ঝোঁকে। ওকে যদি সমুদ্র, নদী না দেখান, তবে তো ও পচা ডোবা দেখলেও সমুদ্র ভেবে লাফিয়ে পড়বে! ভালো ছেলেদের সাথে কখনও মেশেনি বলেই এই হারামী তারকটাকেই দেবদূত বলে মনে হয়েছে। এতে বুলার যতটা দোষ, তার থেকে অনেক বেশি দোষ আপনাদের। কথাটা ভেবে দেখবেন’।
    রবিকাকুর হাতের চড়টা হাতেই রয়ে গেল। কেমন যেন ‘বর্গীয় জ’ এর মত মুখ করে তাকিয়ে আছেন পিকুলের দিকে।
    --‘একটা সিগ্রেট দে তো’। পাঁচুর কাছ থেকে একটা ক্লাসিক নিয়ে হাসল সে—‘আসি’।
    গুরুজনদের সামনে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়া উচিৎ নয়। তাই পিছন ফিরে সিগ্রেটটা ধরিয়ে আপনমনেই হাসতে হাসতে ফেরার পথ ধরল পিকুল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল—
    দেখে যা দেবী, তোর জন্য আমি সমাজ সংস্কারকও হয়েছি। প্রেম যে মানুষকে কি কি বানায়!

    (ক্রমশ)

    ১০.

    --‘হীরালালবাবু আছেন?’
    সকাল থেকে এই নিয়ে ন’ নম্বর ফোন! খিস্তি দিতে দিতে ল্যাদ্‌ খেয়ে পড়েছে বাবন। এই মুহূর্তে তার আর কাঁচা খিস্তি দিতে ইচ্ছে করল না। ধ্রাম করে টেলিফোনটা ক্র্যাড্‌লে নামিয়ে রেখেছে সে। আগের রাতের হ্যাং ওভার কাটেনি। লাল লাল চোখ করে বেডকভারটার দিকে তাকাল সে। ধুস্‌ শালা, অনেক হয়েছে। এবার ঝুলে পড়লেই হয়। অন্তত বেজম্মা হীরালালটার নাম এ জন্মে আর শুনতে হবে না।
    বোধহয় সত্যি সত্যিই ঝুলে পড়ত, কিন্তু তার আগেই বাধা! কতগুলো দানবের মত লোক তার ঘরে গদাম গদাম করে ঢুকে পড়েছে। এমন করে পা ফেলে ঢুকল যেন মানুষ নয়, ইয়েতি ঢুকছে!
    --‘কি ব্যাপার!’ বাবন ঘাবড়ে গিয়ে বলল—‘আপনারা কারা!’
    --‘চুপ বে!’ একজন বলে—‘চিল্লামিল্লি ভাইয়ের পছন্দ নয়!’
    ভাই! কোন্‌ ভাই! সে আকাশ থেকে পড়তে পড়তেও ঘুড়ির মত গোঁত্তা খায়! কার ভাই! কোথাকার ভাই!
    --‘আবে গান্ডু, বড় ভাইয়ের কথা বলছি’।
    বলতে বলতেই বড় ভাই এসে ঢুকলেন। এইবার মনে পড়ল বাবনের। সেরেছে! এতো লাটু মস্তানের মা! এলাকার বড় ভাই! আজ পরণে একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি। যথারীতি হাতা গোটানো। চোখের সানগ্লাসটা আগের বার কালো ছিল। এবারেরটা নীল! ঠোঁটের একপাশে পাইপ ঝুলছে। গলায় সোনার হার। হাতের হীরের আঙটি, বার্মিজ চুনী, পান্না ঝলমল করছে।
    কেসটা কি? আগেরবার মাল খেয়ে বাওয়াল করে ফেলেছিল। তারই বদলা নিতে এসেছে নাকি! বাবন ভয়ে ভয়ে তাকায়। নির্ঘাৎ চ্যালাচামুন্ডা নিয়ে পেঁদিয়ে তাকে পরোটা বানাবার জন্য এসেছে।
    বড় ভাই কিন্তু ঝাড়পিটের কোনও লক্ষণ দেখালেন না। বরং বাবনের সামনের সোফাটায় আরাম করে বসে পড়লেন। চোখ থেকে রোদ চশমাটা সরিয়ে গুলগুল করে তার দিকেই তাকাচ্ছেন। ভালো করে মাপছেন।
    --‘এই, চিরকুটেরা, তোরা এবার ফোট্‌। আমি পার্মানেন্টলি এখন কথা বলব’।
    পার্মানেন্টলি কথা বলবেন! বাবন ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। পার্মানেন্টলি কথা বলার অর্থ কি! পার্মানেন্টলি খচ্চা করে দেবে! সে এক মুহূর্তেই আশঙ্কায় ল্যাম্পপোস্ট হয়ে গেল।
    --‘ওঃ ভাই’। পচা বলল—‘পার্মানেন্টলি নয়, পার্সোনালি’।
    --‘শ্লা, তোর পার্মানেন্ট, প্রেগনেন্ট, পার্সোনালের গাঁড় মারা গেছে’। প্রায় তেড়েই গেলেন বড় ভাই—‘ফুটবি না ফোটাতে হবে’।
    অতবড় গন্ডারের মত লোকগুলো পিঁপড়ের মত সুড়সুড় করে কেটে পড়ল।
    --‘যতসব গান্ডু পাব্লিক’। বড় ভাই এবার বাবনের দিকে তাকালেন—‘মাইন্ড খাস্‌ না। এগুলোর বডির মত ভেজাগুলোও নিরেট। দাঁড়িয়ে আছিস্‌ কেন? লাশ ফেল্‌’।
    অ্যাঁ! লাশ ফেলবে! কি চাপের কথা! এমনি এমনি কি করে লাশ ফেলবে! আত্মহত্যা করতে বলছে না কি!
    --‘ওয়ে, কানখাজুরা! কি হল? বস্‌’।
    ও! বসতে বলছেন তিনি! বাপরে! এমন ভাবে বলছেন যেন বাড়িটা তারই। বাবন সেখানে বেড়াতে এসেছে!
    ভিজে বেড়ালের মত গুটিশুটি বসল সে, মানে লাশ ফেলল!
    বড় ভাই তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পিটপিটালেন। তারপর বললেন—‘কি কেস বে?’
    --‘অ্যাঁ?’
    --‘তোর কেসটা কি?’ তিনি আয়েশ করে পাইপে টান মারলেন—‘বকে ফ্যাল্‌, আজ কাজ নেই। শুনি, তোর কি লোচা!’
    --‘লোচা!’ বাবন ঢোঁক গিলল। এ আবার কি জাতীয় আবদার! কি বলবে সে!
    --‘দ্যাখ্‌ বাড়া, আমি কচি চিকনি নই’। বড় ভাই বলেন—‘সেদিন মাল খেয়ে কি বক্‌ছিলি যেন, বাঁচতে ভয় করে, মরতে ভয় করে—আরো কি সব ভাঁটাচ্ছিলি...’।
    --‘ভুল হয়ে গেছে বড় ভাই’। সে প্রায় গলবস্ত্র হয়ে বলে—‘ খুব ভুল হয়ে গেছে। মদ খেয়ে ভুলভাল বকে ফেলেছি। কথা দিচ্ছি আর কখনও মদ খাবো না...’।
    --‘মাল খাবি না সে তো ভালো কথা’। তিনি মাথা নাড়ছেন—‘মাল জিনিসটা বহুৎ খানকি চিজ। একবার ধরলে চিপ্‌কেই থাকে। প্রথমে তুই মাল খাবি, তারপর মাল তোকে খাবে’। বলতে বলতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—‘আমারও না খাওয়াই উচিৎ। না খেলে হয়তো লাশ ফেলার আগে আরও টাইম পেতাম। কিন্তু...’।
    থেমে গেলেন তিনি—‘ছাড়্‌ ওসব খেজুর। তোর কথা বল্‌। তোর ক্যাঁচালটা কি? বৌ বডি ফেলেছে? না ভেগে গেছে?’
    --‘পালিয়ে গেছে’। বাবন মুখ নীচু করে বলে।
    --‘কেন বে?’
    ভয়ে ভয়ে অনিন্দিতার ইতিহাস বিবৃত করে বাবন। সব শুনে আফসোসসূচক চুকচুক শব্দ করলেন বড়ভাই—‘ ম্যাড...রিয়েলি ম্যাড...’।
    বাইরে থেকে আওয়াজ এল—‘স্যাড ভাই, ওটা স্যাড হবে’।
    --‘শুয়োরের বাচ্চা!’ বাইরের আওয়াজ লক্ষ্য করে শব্দভেদী বাণের মত নিজের জুতোজোড়া ছুঁড়ে দিলেন বড়ভাই—‘হারামী, বলেছি না ফুটে যেতে। তুই বোকাচোদা, বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা মাড়াচ্ছিস! চুতিয়া.....’
    বাইরে থেকে ফের আওয়াজ এল—‘সরি ভাই সরি...’।
    --‘সরি নয়, এবার সর্‌। নয়তো মাইরি একেবারে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেব তোকে। বাঞ্চোত কাঁহিকা’। বড়ভাই আরও একচোট গালাগালি দিয়ে অবশেষে থামলেন। একটু দম নিয়ে বললেন—‘হ্যাঁ, তোর স্টোরি জারি রাখ্‌, শুনছি’।
    --‘স্টোরি আর কি ভাই। সে ঐ হীরালালটার সঙ্গে চলে গেল। ব্যস্‌’।
    --‘যাঃ শালা। মালটা চলে গেল, আর তুই যেতে দিলি!’ বড় ভাই উত্তেজিত—‘আরে, সে মাগী তোর নাইফ ছিল!’
    নাইফ! ছুরি! অনিন্দিতা কি ছুরি ছিল! বাবন একটু ভাবল। হ্যাঁ, ছুরিই বটে। বুকটা একেবারে ফালাফালা করে দিয়ে গেছে...।
    সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই বাইরে থেকে ফের আওয়াজ—‘ওয়াইফ’।
    --‘তবে রে শ্লা!...তোর ইঞ্জিরির এইসি কি তেইসি...’ বড়ভাই প্রায় তেড়ে গেলেন দরজার কাছে। বাবন সভয়ে দেখল একটা মুষকো ষন্ডা ইঁদুরের মত পাঁই পাঁই করে পালাচ্ছে! দৃশ্যটা দেখে তার ব্যাপক হাসি পেয়ে গেল! কিন্তু হাসলে বড়ভাই যদি মাইন্ড খান্‌। তাই মুখে কুলুপ এঁটেই থাকল।
    --‘হ্যাঁ...কি বলছিলাম যেন’। বড়ভাই ফের এসে বসেছেন সোফায়—‘ তুই তোর বৌকে খোঁজার চেষ্টা করিস্‌নি?’
    --‘না’।
    --‘তুই কিরকম মরদ বে?’ তিনি উত্তেজিত—‘তোর মাল কোথায় গেল খুঁজবি না! আমাদের লাইনের মরদ হলে ঠিক পাকড়াও করে ধরে আনত। তারপর হয় দানা নয় চিকনি ঢুকিয়ে দিত বুকে, ব্যস্‌ সব ছেনালিপনা খতম। আজকালকার চ্যাংড়া ছোঁড়াগুলোকে দেখিস্‌ না? সব কচি কচি পাব্লিক। বয়েস উনিশ কি কুড়ি। স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে। কিন্তু কি দম একেকটার! মেয়েছেলেগুলো বেশি ছেনালিপনা করলে মেরে পুঁতে দেয়! খবরের কাগজ পড়িস্‌ না? এই তো কালও একটা ছেলে তার রসের মাগীকে খুন করেছে! মাগী অন্য নাগরের সাথে ঢলাঢলি করছিল। ব্যস্‌, দিয়েছে একেবারে গলা টিপে!’ বলতে বলতেই হাসলেন—‘ও ছেলে বড় হলে মস্ত ভাই হবে মাইরি!’
    বোঝো! কি ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী! বাবন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে বলে—‘তাতে কি হয় ভাই? বড়জোর গায়ের ঝাল মেটে। কিন্তু ভালোবাসার নাম কি গায়ের ঝাল মেটানো? ধরুন অনিন্দিতা আমায় দাগা দিয়েছে বলে আমি ওকে খুন করে বসলাম। তাতে আমার রাগ মিটল। তারপর? আমি কি পাবো? অনিন্দিতার ভালোবাসা পাবো? ওর লাশটা আমায় ভালোবাসবে? প্রেম, ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা গায়ের জোরে, বা টাকার জোরে পাওয়া যায় না। বড়জোর কাউকে খুন করতে পারি। কিন্তু যদি সত্যিই আমি ওকে ভালোবেসে থাকি, তবে আসলে তো নিজের হাতেই নিজের ভালোবাসাকে খুন করলাম। যাকে সিঁদুর পরিয়ে এনেছি, ভালোবেসেছি, তার রক্ত দেখি কি করে ভাই? সে যদি আমার কাছে না থাকতে চায়, তবে তাকে মুক্তি দেওয়াই ভালো নয়? সে যদি সিঁদুরের ভালোবাসার মূল্য না বোঝে তাতে তো তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যায় না।’
    --‘হুম্‌, হর ঔরত কা খোয়াব হোতা হ্যায় এক চুটকি সিন্দুর! হর সুহাগন কি সর্‌ কা তাজ হোতা হ্যায় এক চুটকি সিন্দুর!...’ বলতে বলতেই বড় ভাইয়ের শ্বাস জোরে জোরে পড়তে লাগল। চোখ দুটো লাল হয়ে গেল। কয়েকমুহূর্ত নিস্তব্ধতা। পরক্ষণেই হা হা করে কেঁদে উঠলেন।
    কেলো করেছে! ভাই কাঁদছেন! এই দৃশ্য তার পন্টরেরা দেখলে নির্ঘাৎ বাবনের লাশ ফেলে দেবে! হঠাৎ করে ভাই এমন সেন্টু খেয়ে গেলেন কেন কে জানে! শুধু তাই নয়, সে সভয়ে দেখল, মহিলার নাক বেয়ে টপটপ করে কাঁচা রক্ত পড়ছে!
    সর্বনাশ! এখানেই টপকাবেন নাকি মহিলা! তাহলে ভগবানও বাবনকে বাঁচাতে পারবেন না! সে দ্রুত এগিয়ে গেল ভাইয়ের কাছে—‘ভাই, কি হল?’
    ভাই ততক্ষণে কাৎ হয়ে পড়েছেন। তবু বললেন—‘ ওম শান্তি ওমের ডায়লগ। এতবার দেখেছি যে শ্লা পুরো ভেজায় রেকর্ড হয়ে গেছে!চাপ নিস না...তোর বাথরুমটা কোথায়?’
    --‘এই তো...এইদিকে...’ সে ব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন—‘আপনি একা যেতে পারবেন? ডাক্তার...অ্যাম্বুলেন্স ডাকবো’?
    --‘ধুস্‌ হলকট্‌!’ মহিলার কষ্ট হচ্ছিল। তা সত্বেও কষ্ট করে হাসলেন—‘ডাক্তার নয়, পারলে যমদূতকে ডাক। সে ছাড়া আর কোনও শ্লা আমায় ঠিক করতে পারবে না’। বলতে বলতেই অতিকষ্টে উঠে বসেছেন—‘লাইফে অনেক লাল দেখেছি রে, একটা লাল ছাড়া। এইটুকু রক্ত আমার বাল ছিঁড়তেও পারবে না। তোর বাথরুমটা...’
    বাবন হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল। ভাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। সে ধরতে গেলে বললেন—‘ধরিস্‌ না। পারবো’।
    অগত্যা। সে ভয়ে ভয়ে সোফাতেই বসে থাকল। মহিলা যদি তার বাথরুমেই পটল তোলেন, আর তার চ্যালারা এসে দেখে তাদের ভাই বাবনের বাথরুমেই বডি ফেলেছেন, তবে বাবন কি আর আস্ত থাকবে! তার ভয়ানক রিষ্টি এসে উপস্থিত হবে!

    ভাবতেই ভয়ে পুরো ইয়ে খাড়া হয়ে গেল বাবনের। ওদিকে বাথরুমে জলের কলকল আওয়াজ। হল কি? মহিলা স্নান করছেন নাকি!
    পুরো পাঁচ মিনিট যম যন্ত্রণা ভোগ করার পর, অবশেষে বড় ভাই বেরিয়ে এলেন। এখন তাকে খানিকটা সুস্থ লাগছে। সোফায় এলিয়ে পড়ে আদেশ করলেন—‘ঘরে মাল আছে?’
    এঃহে, নবগ্রামের দোর্দন্ডপ্রতাপ বড় ভাই তার ঘরে পায়ের ধুলো ফেলেছেন, অথচ তাকে কোনরকম খাতির করা হয়নি! বড্ড ভুল হয়ে গেছে। বাবন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়—‘কি খাবেন বলুন ভাই, চা-কফি...?’
    --‘চা-কফি তোর বাপকে খাওয়াস। রাম আছে?’
    সে ঢোঁক গিলল—‘আছে ভাই’।
    --‘নিয়ে আয়। আর বাইরে গান্ডুগুলো দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ্‌। ওদের বল্‌ চিকেন তন্দুর নিয়ে আসতে’। পাঞ্জাবীর হাতায় মুখ মুছলেন তিনি—‘খালিপিলি দিমাগ চাটলে এক থাবড়া লাগিয়ে দিস্‌’।
    কে কাকে থাবড়া লাগায়! তবু সে আমতা আমতা করে বলে—‘আচ্ছা ভাই’।
    কিছুক্ষণের মধ্যেই রাম আর চিকেন তন্দুর চলে এল। বেশ কয়েক পেগ পেটে পড়ার পর ভাই বেশ ঢুলুঢুলু হলেন। আয়েশ করে সোফার উপরে আধশোওয়া হলেন—‘তুই মাইরি ভালো মাকড়া আছিস্‌। গুড্‌...ভেরি গুড্‌। এ জম্মে কম তো মরদ দেখলাম না। কিন্তু যেদিন বাজারে লাট খাচ্ছিলি সেদিনই মনে হয়েছিল, তুই মালটা অন্যগুলোর মত ঢ্যাম্‌না নোস্‌। তোর বৌটা একটা খানকি। শা-লি সিঁদুরের ভাঁও বুঝল না! আর কত পাব্লিক আছে মার্কেটে, যারা ঐটুকুর জন্য হেদিয়ে মরছে!...হর ঔরত কি খোয়াব হোতা হ্যায় এক চুটকি সিন্দুর...!’
    ফের শুরু হল ওম শান্তি ওম! ব্যাপারটা কি রে বাবা! মহিলা ঘুরে ফিরে একই ভাঙা গ্রামাফোন রেকর্ড বাজাচ্ছেন কেন?
    লাইনটা প্রায় মুখস্থ বলে একটু চুপ করলেন তিনি। আস্তে আস্তে বললেন—‘তুই খুব চম্‌কে যাচ্ছিস্‌--তাই না? ভাবছিস, শ্লা, এই জাঁহাবাজ মাগী কি সব ভাঁটিয়ে দিমাগের দই বানাচ্ছে! কিন্তু আমি মানুষ চিনি। পারলে তুই-ই পারবি। তুই আমায় মদত কর্‌। এ তল্লাটের মাকড়াগুলো তোর কাছেই বডি ফোলাতে আসে না? পাড়ার-বেপাড়ার অনেক ছোঁড়াদের চিনিস তুই। আমায় মদত দে। জবান দিচ্ছি মরার আগে তোকে আমির করে দিয়ে যাবো। আর যদি না পারিস্‌ তবে চুল্লুভর্‌ জলে ডুবে ফৌত হব’।
    এইবার বোঝা গেল ব্যাপারটা! মহিলা কোনও দরকারে এসেছেন। ওরেঃ শালা! কাউকে খরচা করতে হবে না তো! বাবন বাইরেই এমন যমরাজের মত দেখতে। কিন্তু তার অত ধ্বক নেই। মহিলা কি সুপারি দিতে এসেছেন নাকি! তবে মরেছে বাবন!
    সে ভয়ে ভয়ে বলে—‘কি করতে হবে’।
    --‘হে-পি-ও-য়ে-ল্ডিং’।
    ওয়েল্ডিং কি করে হ্যাপি হয় তা অনেক ভেবেও চাঁদিতে ঢুকল না। অবশ্য বেশিদূর ভাবতেও হল না। মহিলা নিজেই বুঝিয়ে দিলেন—‘বিয়ে শাদি বুঝিস্‌? তাই করাতে হবে। লাশ ফেলার আগে এটাই আমার লাস্ট উইচ’।
    এই বয়েসে বিয়ে করবেন! মরার আগে বিয়ে করার শখ হয়েছে! সে কি বলবে ভেবে পেল না! কি ডেঞ্জারাস লাস্ট উইচ!
    --‘দ্যাখ্‌, আমি জীবনে অনেক খুন-খারাপি দেখেছি’। তিনি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন—‘বললাম না, অনেক লাল দেখেছি। কিন্তু একটা লাল কখনও দেখিনি। সিঁদুর! সিঁদুর পরার নসিব ছিল না বুঝলি। ছিলাম কয়েক পয়সার ছেনাল। লাটুর বাপের পছন্দ হল। একদিন ঘাড়ে করে, দালালগুলোর লাশ ফেলে দিয়ে ঘরে নিয়ে এল। তোরা কি যেন বলিস্‌, লিভ টুথ...কি যেন...’
    --‘লিভ টুগেদার?’
    --‘হ্যাঁ। ঐ সেটিংই ছিল। বিয়ে শাদি হয়নি। লাটুর বাপটা ছিল এক নম্বরের ট্যারা মাল। রান্ডির সাথে শোবে, কিন্তু বিয়ে করবে না! ওর আরেকটা মাগী ছিল। সেটার সিঁদুর জুটেছিল। কিন্তু থাকত মাকড়া আমার সাথেই’।
    বাবন চুপ করে শুনছিল। বড় ভাই কেন এসব কথা তাকে বলছেন তা সে এখনও বুঝতে পারেনি! তবু মহিলার কথার মধ্যে কি যেন একটা বেদনা ছিল।
    --‘দ্যাখ্‌ বে, আমার নসিবে যা হওয়ার, হয়েছে। লাটুর বাপটা মরার পর বুঝেছি এইসব বডি ফেলে দেওয়ার কাজ বহুৎ পাপের কাজ’। মহিলার চোখ চিকচিকিয়ে ওঠে—‘তুই দশটাকে টপকাবি, আরও দশটা এসে তোকে টপকাবে। যতই রোয়াব দেখাস না কেন, ফৌত তোকে হতেই হবে! হয় পুলিশ আম সড়কে মেরে লাশ হাপিশ করবে, শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে, নয়তো দুশমনরা মেরে দিয়ে চলে যাবে। উপরওয়ালা সব হিসাব রাখে। তুই কারুর নামে সুপারি খাবি, সেও তোর নামের সুপারি খাবে। খুনের শোধ তোকে জান দিয়েই চুকতা করতে হবে। বুঝলি?’
    --‘বুঝেছি ভাই’।
    মহিলা ভেজা চোখে হাসলেন—‘জানি তুই বুঝবি। সেদিন তোর কথা শুনেই বুঝেছি। একটা কথা সাফ সাফ শুনে রাখ্‌। এ লাইনে তুই যত বড় শের হ, মরবি সেই কুত্তার মওত! বলেছিলি না ‘বাঁচতে ভয় করে কি না’? করে। এ লাইনে বেঁচে থাকাটাই ভয়ের। নিজের জন্য শ্লা, মগজমারি নেই। ভয় হয় লাটুর জন্য। লাটুটার জন্য বিন্দাস মরতেও পারছি না। আমার আখ্যা লাইফে যা হয়েছে, হয়েছে—কিন্তু লাটুর কিসমত আমার মত হবে না। ওর কপালে সিঁদুর জুটবে। জুটিয়েই যাব আমি ’।
    এতক্ষণে প্রসঙ্গটা বুঝল বাবন। মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখল, তিনি কাঁদছেন! এই প্রথম মনে হল, বড় ভাই নয়, লাটুর মা বসে আছেন তার সামনে!
    --‘লাটুটার মেজাজ ওর বাপের মতই। কিন্তু উপরওয়ালার কিরে, ও খারাপ নয়’। কাতরস্বরে বললেন তিনি—‘হারামের দুনিয়া ওকে অমন বানিয়েছে। সিঁদুর পেলে শুধরে যাবে। একবারই মেহেন্দি লাগিয়েছে হাতে। শুয়োরের বাচ্চা নুটু মন্ডলটাকে টপকেছে। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত আর কোনও বডি ফেলেনি। মেরে বডি পার্টস হিলিয়ে দিয়েছে, থোবড়ার জিওগ্রাফি পাল্টেছে। কিন্তু মা কসম্‌, জানে মারেনি। মেয়েছেলের মত মানুষ হয়নি, তাই ব্যাটাছেলেদের মত হাবভাব। তবু, আমি জানি, ও বদলাবে। আমাদের মত আনপড় মাগী নয় তো, এগারো ক্লাস অবধি পড়েছে। বুঝতে টেম(টাইম) লাগলেও বুঝবে, এ হারামের লাইনে কোন লাইফ নেই, মরা ছাড়া রাস্তা নেই। তাই...’।
    ভেজা ভেজা চোখজোড়া তুলে তাকালেন লাটুর মা—‘তুই মদত করবি না?’
    বাবন কি বলবে ভেবে পায় না! লাটু মস্তানের জন্য ছেলে দেখার চেয়ে বাঘের গলায় মালা দেওয়া সহজ! কিন্তু লাটুর মায়ের মুখ চেয়ে ‘না’ বলতে পারল না সে। বলল—‘চেষ্টা করবো’।
    লাটুর মা হাসলেন—‘জানতাম তুই বুঝবি। সেটিং শুরু করে দে। আবার দুদিন পরে এসে জেনে যাবো কতদূর কি করেছিস্‌’।
    দুদিন পর আবার আসবে! ওঃ ঈশ্বর! ততদিনে কি সেটিং করবে বাবন! নিজেই না সেট হয়ে যায়!
    --‘ওকে বড়ভাই’।
    --‘শিউলি’। লাটুর মা মিষ্টি হাসলেন—‘ওটাই আমার নাম বে!’

    ১১.
    --‘ধুর বিশুদা, প্রেমের ভাই হয়েছে! ভালোবাসার ভাই হয়েছে। দুনিয়ায় ভালোবাসার কোনও মানে নেই। প্রেমিককে আজীবন স্রেফ লাথ খেতে হয়! তুমি ভালোবাসলে, আর তোমার লাইফও মায়ের ভোগে গেল’।
    এই দার্শনিক ফ্রাস্ট্রেশনের ইলাজ কি করে করবে বিশু ভেবে পায় না। এ কথা তার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ জানে না। সারাজীবন তো প্রেমের লাথ খেয়েই এল। এ যে কতবড় বাস্তব তার এগজাম্পল স্বয়ং সে নিজেই!
    কিন্তু আজকাল তার মনে হয়, এর বাইরেও অন্য কোনও বাস্তব আছে। আরও কিছু আছে। নয়তো সে তো তার ফ্রাস্ট্রেটেড লাইফের দি এন্ড করতেই যাচ্ছিল। আরেকটু হলেই—‘ইতি বিশু’ হয়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ করে তবে নয়া চ্যাপ্টার খুলে গেল কি করে? সিন্ডারেলা এল কেন? আগে ভাবত—এই জীবন নিয়ে কি করবে? কি করতে হয়? এখন বুঝেছে, অপেক্ষা করতে হয়। সঠিক সময়ের অপেক্ষা। সঠিক মানুষের অপেক্ষা। জীবন একটা নদীর মত। কোনও বাঁকে ধূ ধূ বালির চড়া, আবার কোনও বাঁকে সবুজ ধানের ক্ষেত! কোথাও মরীচিকা, কোথাও সত্যিই টলটলে জলের হ্রদ। দুদিকই তোমাকে দেখতে হবে। কারণ জীবন আদতে জার্নি! মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিলে অনেক কিছুই অধরা, অদেখা থেকে যায়! ব্যর্থ জীবন বলে কিছু নেই। জীবন তখনই ব্যর্থ হয়, যখন তাকে জোর করে বোকার মত মানুষ থামিয়ে দেয়।
    --‘সিগ্রেট খাবে?’ পিকুল দেবদাস ভঙ্গিতে বলল—‘আমার কাছে পাঁচপিস আছে। সকালেই বাবার ট্যাঁক থেকে ঝেঁপেছি’।
    --‘আমি সিগ্রেট খাই না’। বিশু ভুরু কুঁচকেছে—‘কিন্তু পাঁচপিস কেন? আগে তো তিনপিসেই তোর চলে যেত’।
    --‘প্রেমে ল্যাঙ খেয়ে কোটা বাড়িয়েছি’। পিকুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল—‘তোমার কাছে বড়ি থাকলে দাও। খেয়ে দেখি। শা-লা, এ অপমান আর সহ্য হয় না!’
    --‘বড়ি খাবি কোন্‌ দুঃখে?’ সে অভিভাবক সুলভ ভঙ্গিতে বলে—‘এই বয়েসে তোর বড়ি খাওয়ার কি হল? পিকুল, তুই একদম ঠিক কাজ করছিস না। এরপর তো রাবনের কাছে গিয়ে মদ খাবি, তারপর গাঁজা, তারপর ড্রাগস! লাইফ পুরো মায়ের ভোগে!
    --‘মায়ের ভোগে যেতে আর বাকি কি আছে? দেবীই আমার লাইফ। দেবী নেই তো কেউ নেই!’
    এ জ্বালা বোঝে বিশু। শুধু বিশুই নয়, তামাম ব্যর্থ প্রেমিক সমাজ বোঝে! বুকে যখন চিড়বিড় করে আগুন জ্বলে তখন শত স্তোকবাক্যেও নেভে না! কাঁচা বয়েসের ব্যথা তো আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। মনে হয় দুনিয়ায় আর কোথাও কেউ নেই। আজন্ম যারা চোখের সামনে ঘুরে বেরিয়েছে, আহ্লাদ দিয়েছে, বকেছে, ভালোবেসেছে, তারা সব অপ্রয়োজনীয়। কেরিয়ার—পড়াশোনা—চাকরি সবক’টা শব্দই বেবাক মায়া! অল্পদিনের প্রেমে ব্যথা যে কখন আজীবনের স্বপ্নগুলোকেও ভেঙেচুরে দেয় তা টেরই পাওয়া যায় না! যতদিনে আসল ঘটনাটা টের পাওয়া যায়, ততদিনে লাইফ ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে!
    --‘জানিস পিকুল...’ বিশু আস্তে আস্তে বলে—‘যখন ইপ্সিতাদির সাথে আমার ব্রেক-আপ হল তখন আমিও তোর মতই ল্যাদ্‌ খাচ্ছিলাম। তার আগে আমার স্বপ্ন ছিল, কলেজের প্রোফেসর হবো। মা যতদিন বেঁচে ছিল, কানে ফুস্‌মন্তর দিয়ে গেছে—যে করেই হোক্‌ বাবা, তোকে দাঁড়াতেই হবে। ইপ্সিতাদির প্রেমে পড়ার আগে সবই মনে ছিল। কিন্তু তারপর সব শালা ছড়িয়ে ছিয়াশি! কলেজের প্রোফেসর হওয়া হল না, ক্লার্ক হয়েই থেকে গেলাম। এবার বল্‌ দেখি, আসল ব্যাপারটা ঠিক কি হল?’
    পিকুল ব্যাপারটা ঠিক বুঝল না। অবাক হয়ে বলে—‘কি হল’?
    --‘ইপ্সিতাদি ড্যাং ড্যাং করে ভালো ঘর, ভালো বর বাগিয়ে চলে গেল। আর আমি শা-লা বোকাচোদার মত সব কিছুর গাঁড় মেরে দিলাম। তখন তোর মত আমারও মনে হয়েছিল—ইপ্সিতা জীবন, ইপ্সিতা মরণ, ইপ্সিতা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু নেই! অথচ কয়েকমাস পরেই বুঝলাম, ইপ্সিতাকে ছাড়াও আমি দিব্যি বেঁচে আছি। কেরিয়ার, কলেজের পরীক্ষা, পার্সেন্টেজ, চাকরি ইপ্সিতার রেয়াত করে না। ওর জন্য থেমে থাকে না। কিন্তু ঐ কয়েকমাসেই যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে’। বিশু নাক টেনে বলে—‘ সবাই যেখানে থাকার, সেখানে ঠিকঠাকই আছে। একটা লোক মাঝখান দিয়ে তার রিক্রিয়েশনের জন্য আমায় নাচিয়ে মারল। আর আমিও ফ্রাস্টু খেয়ে নিজের স্বপ্ন টপ্ন গাধার গাঁড়ে দিয়ে এলাম। তার চেয়ে যদি—‘যা খানকি, তুই ছাড়া আর মাগী নেই নাকি দুনিয়ায়! ফাক্‌ ইউ বিচ!’ ভেবে একচোট খিস্তিখাস্তা দিয়ে মন শক্ত করে নিতে পারতাম, তবে তোর বিশুদা, ক্লার্ক বিশে না হয়ে প্রোফেসর বিশ্বনাথ গুপ্ত হত। কি বুঝলি?’
    কি বুঝল পিকুল তা সে নিজেই জানে। তার বুক ফেটে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বিশ্বনাথ বাবার বাণী কতদূর কানে ঢুকল জানা নেই। শুধু চোখের সামনে দেবীর হিংস্র মুখটাই ভাসছে। আর মনে পড়ছে তার বলা নিষ্ঠুর কথাগুলো—
    --‘ইউ...ইউ রাস্কাল! তোর সাথে কথা বলতেও আমার ঘেন্না হয়,... ইনফ্যাক্ট তোকে আমি সহ্যই করতে পারছি না...আই জাস্ট হেট ইউ...হেট ইউ...’। বলতে বলতেই দৌড়ে চলে গিয়েছিল দেবী। একবারও ফিরে তাকায় নি পিকুলের দিকে। দেখেনি পিকুল সর্বহারার মত দাঁড়িয়ে আছে ওখানেই! তার হাত থেকে খসে পড়েছে তার অতিপ্রিয় লাকি ব্যাটটাও!
    ঘটনাটা আর কিছুই নয়, নবগ্রাম প্লেটোনিক ক্লাবের সাথে শিবাজী সঙ্ঘের ক্রিকেট ম্যাচ ছিল গতকাল। পিকুল চিরকালই জাঁদরেল ব্যাট্‌স্‌ম্যান। প্লেটোনিক ক্লাবের ধোনি! কাল যখন সে মাঠে নামছে তখন অলরেডি প্রথম দুই ওভারে শূন্য রানে তিন উইকেট পড়ে গেছে। সুব্রতদা কানের কাছে এসে বলেছিলেন—‘এখন নবগ্রামের মান ইজ্জত সব তোর হাওয়ালে পিকুল। দেখিয়ে দে—তুই-ই শেষ কথা! বুঝিয়ে দে—নবগ্রামের ছেলেরা হাতে চুড়ি পরে বসে থাকে না...বুঝিয়ে দে--......’।
    সে তো শুধু উত্তেজক ভাষণ নয়—রীতিমত ভোক্যাল টনিক। আর সেই ভোক্যাল টনিকেই বার খেয়ে শহীদ হয়ে গেল পিকুল!
    উত্তেজনায় কান ভোঁ ভোঁ করছিল। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে শক্ত করে ব্যাটের হাতলটা চেপে ধরেছিল সে। শিবাজী সঙ্ঘের বোলারগুলোকে সর্ষেফুল দেখিয়েই ছাড়বে। প্রথম ওভারটা ঠুকঠুকিয়ে সামলে খেলল। শিবাজী সঙ্ঘের ফিল্ডারগুলোর হাত তো হাত নয়, কড়াই! বোলিঙ ও হচ্ছে তেমনি। অসাবধানে একটা ক্যাচ উঠলে, বা বাইরের বলে খোঁচা মারলেই পুরো চিত্তির। তাই প্রথম ছ’টা বল খুব সাবধানে খেলল পিকুল!
    দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটা ফুল টস পেয়েই স্টেপ আউট করে একদম ‘বাপি বাড়ি যা!’ প্লেটোনিক ক্লাবের ছেলেপুলেরা হৈ হৈ করে উঠল। কিন্তু দর্শকদের ভিড় থেকে আওয়াজ এল—‘গেল...গেল...’।
    কে গেল? কোথায় গেল? কে আর যেতে পারে! গেল পিকুলের কপাল! সুবীরকাকু বাজার থেকে ফেরার পথে একসাইডে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন। পড়বি তো পড়, পিকুলের মারা বল ফুল ভেলোসিটি নিয়ে তার টাকেই পড়েছে! সে একেবারে রক্তারক্তি কান্ড।
    খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল পিকুলের। সুবীরকাকুর এ কি অন্যায়! তার সাথে ভদ্রলোকের কি দুশমনি আছে বলো দেখি! পিকুল জল ফেলুক, কি বল—তিনি ঠিক তার নীচেই টাকটি পেতে বসে থাকবেন। আর সব গালিগালাজ জুটবে তার কপালে!
    ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে মাঠে ওরা সেলিব্রেট করছিল। পিকুলের ব্যাটের জোরে ম্যাচ প্লেটোনিক ক্লাবের পকেটে ঢুকে গেছে। সবাই তাকে ঘাড়ে নিয়ে লাফালাফি করছে এমন সময়ই দেবীর আয়লা এন্ট্রি। সঙ্গে ঐ পাঁঠা পল্টু। কোনও ভূমিকা- টূমিকা নেই। সোজা পিকুলের কাছে এসে বলল—‘বাবা তোর কি ক্ষতি করেছে? কেন বাবার পিছনে লেগেছিস্‌ তুই?’
    সে কোনমতে জবাব দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই পল্টু ব্যা ব্যা করে বলল—‘পাঁচটা স্টিচ পড়েছে কাকুর। তুই বল মারার আর জায়গা পাস্‌নি?’
    পিকুল আবার কিছু বলতে চায়। তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে দেবী—‘একটা কথাও বলবি না তুই! কোন কথা শুনতে চাই না! ইনফ্যাক্ট আমিই বা তোর সঙ্গে কথা বলছি কেন?...ইউ...ইউ রাস্কাল! তোর সাথে কথা বলতেও আমার ঘেন্না হয়,... ইনফ্যাক্ট তোকে আমি সহ্যই করতে পারছি না...আই জাস্ট হেট ইউ...হেট ইউ...’।
    বল পড়ল সুবীরকাকুর মাথায়। আর কপাল ফাটল পিকুলের! কাল মাঠে খেলার শেষে লুচি-আলুর দম-ডিমসেদ্ধ স্পর্শও করে নি সে। বাড়ি ফিরেও চুপ করে বসেছিল। মনমরা হয়ে বইয়ের পাতায় মন দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু একটি অক্ষরও তার মাথায় ঢোকেনি। শেষপর্যন্ত নিজের অতিপ্রিয় ব্যাটটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বাইরে। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। দেবী...আর কখনও ক্রিকেট খেলব না আমি...কোনওদিন ধোনি হওয়ার স্বপ্ন দেখব না...তুই ফিরে আয়...তুই শুধু একবার আমায় ক্ষমা কর্‌... কথা বল্‌ আমার সঙ্গে!
    কিন্তু কান্নাই সার! দেবী আসেওনি, কথাও বলেনি!
    --‘পিকুল, এত ফুঁকিস না! শেষে গোটা লাইফটাই ফুঁকে দিবি রে ভাই’।
    বিশুর কথায় হুঁশ ফিরল পিকুলের। সে অবাক হয়ে দেখে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে কখন যেন আপনমনে পাঁচ-পাঁচটা সিগ্রেটই বেমালুম ফুঁকে দিয়েছে।
    বিশু তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এরকম ব্যাপার তার কাছে নতুন নয়। এই বয়েসটা একদিন তার নিজেরও ছিল। এই উনিশ-কুড়ি বছর বয়েসটা বড় বিপজ্জনক। সব কিছুই এই সময় এক্সট্রা লার্জ! হাসি, কান্না, প্রেম, ধোকার জ্বালা, রোমিওগিরি, দেবদাসত্ব! সব কিছুই বেশি বেশি। ছেলেদের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘বলদা পঁচিশ’। পঁচিশ বছরের পর ছেলেরা ম্যাচিওর হয়। তার আগের সময়টা কঠিন। বিশেষ করে টিন এজটা। ম্যাচিওর ছেলে-মেয়েরা প্রেম করে। অনেক বেছেবুছে, ভালো মন্দ বুঝে—মস্তিষ্ক দিয়ে মেপে নিয়ে তবেই মাঠে নামে। আর টিন এজে প্রেম হয়! মাথা থেকে নয়, বুক থেকে ডাইরেক্ট প্রেম এসে গোঁত্তা মারে। সে প্রেম ভালো-মন্দ বোঝে না। ঠিক-ভুল বোঝে না। বাউন্ডারি বোঝে না! উন্মত্তের মত তার রোখ! তাই তার বেদনাও অনেক বেশি।
    এই বয়েসেই বিশুর কেরিয়ার ধেড়িয়েছিল। তাই সে পিকুলকে চেতিয়ে দেয়—‘ভাই, তোর পড়াশোনায় কনসেনট্রেট কর্‌। ছাই ওড়াচ্ছিস্‌ ভালো কথা। কিন্তু নিজেকে ছাই করে দিস্‌ না। মেয়ে অগুনতি আছে। সেমিস্টার অগুনতি নেই। বুঝলি?’
    মাথা নাড়ল পিকুল। অন্য সময় হলে ‘জ্ঞান দিও না মামা’ বলে থামিয়ে দিত। কিন্তু বিশু যা বলছে তা ভুল নয়।
    --‘ছাড়ো ওসব’। সে বলল—‘তোমার কারেন্ট গার্লফ্রেন্ড কে?’
    বিশু হেসে বলে—‘সিন্ডারেলা’।
    --‘তোমারও লাক্‌ বটে। কাকের মতন’। পিকুল বলে—‘ কোকিলার ডিম তিনমাস ধরে তা দিয়ে দিয়ে গরম করো। তারপর আরেক হতচ্ছাড়া কোকিল এসে সেই গরম ডিমের পোচ বানিয়ে খায়!’
    --‘জানি তো’।
    --‘জানো যখন তখন এ বিজনেস খতম করো না কেন?’
    --‘খতম তো করে দিয়েছি’।
    খবরটা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল পিকুল। এতক্ষণের বিষাদ হতাশা ঝেড়ে ফেলে বলল—‘সেকি গুরু! এত বড় নিউজ ফুলটু চেপে গেছ! তবে তুমি ফাইনালি ওপেন রিলেশনশিপ ছেড়ে কমিটেড স্টেটাসে গেলে! তাহলে সিন্ডারেলা কে? পার্মানেন্ট?’
    --‘সিন্ডারেলা কে সেটা যদি জানতাম তাহলে তো হয়েই গিয়েছিল’।
    পিকুলের মুখ একতাল হালুয়ার মত হয়ে গেল—‘লেঃ হালুয়া, লাইন মারছ, অথচ মেয়েটা কে জানোনা!’
    --‘জানি না’। বিশু বলল—‘তবে যেদিন জানতে পারবো সেদিন তোদের বিশুদা সংসারী হবে’।
    --‘খুড়ো-ও-ও-ও! তলে তলে এ-ত-দূ-উ-উ-উ-র’। পিকুল এমন উত্তেজিত হয়ে উঠল, যেন বিশু নয়—তারই ফাইনাল সেটিং হয়ে গেছে—‘কেসটা কি খুলে বলো তো। দেখি তোমায় হেল্প করা যায় কি না!’
    লজ্জা লজ্জা মুখ করে সেরাতের কথা খুলে বলল বিশু। সিন্ডারেলার সাথে তার দেখা, প্রতিটা মুহূর্তের কথা বর্ণনা করে বলল। কি করে ভুলবে তার সেই হাঃ হাঃ হাসি। ছেলেদের মত বুক চিতিয়ে হাঁটা। তার মিষ্টি গালিগালাজ। এমনকি বাজের মত থাপ্পড়ও!
    পিকুল লক্ষণগুলো শুনতে শুনতে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে—‘ইয়ে...বিশুদা...তুমি ঠিক জানো ওটা মেয়ে! হিজড়ে নয়? আজকাল কিন্তু হিজড়েদেরও ছেলে বা মেয়ে বলে আইডেন্টিফাই করা শক্ত...’।
    --‘হিজড়ে কেন হবে?’ সে প্রতিবাদ করে—‘আমি হিজড়ে দেখিনি? হিজড়ে নয়। একটা হাই ভোল্টেজ মেয়ে। শুধু হাবভাবটা ছেলেদের মত’।
    পিকুল ‘হাই ভোল্টেজ’ শুনে ‘লো ভোল্টেজ’ গলায় বলে—‘গে নয়তো! অথবা সেক্স চেঞ্জ করেছে এমন কোনও পুরুষ!’
    এবার বিশু একটু থমকাল। বিড়বিড় করে বলল—‘গে নয়। হলে কি আর আমায় সহজে ছাড়ত! তবে সেকেন্ড সম্ভাবনার কথাটা উড়িয়ে দিতে পারছি নারে পিকুল। কিন্তু নবগ্রামে এমন পুরুষ আছে নাকি যে সেক্স চেঞ্জ করেছে?’
    --‘আলবাত আছে’। নিজের হাঁটুর উপর ঘুঁষি মেরে উঃ উঃ করে উঠল পিকুল—‘তাছাড়া নবগ্রামে এমন কোনও মেয়ে এখনও পর্যন্ত দেখেছ যে ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা! দীপিকা পাড়ুকোন ফিগার! অমন ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে থাকলে এতদিনে চোখে পড়ত না?’
    --‘তা পড়ত’। বিশু কনফিউজড হয়ে মাথা নাড়ায়। পিকুলের কথা একদম ঠিক।
    --‘জুতোটা কই। দাও তো দেখি’।
    ভরত যেমন রামের খড়ম সামলে রেখেছিলেন, ঠিক তেমন করেই সযত্নে জুতোর পাটিটাকে রেখে দিয়েছিল বিশু। পিকুল সেটা দেখে বিচক্ষণের মত মাথা নাড়ল—‘ও বিশুদা, এ মেয়ে বলে মনে হয় না। মেয়েদের এত বড় পা হয় না কি! এতো প্রায় দশ নম্বরের জুতো বলে মনে হচ্ছে। যদি এ মাল সত্যিই মেয়ে হয় তবে এর পারফেক্ট বয়ফ্রেন্ড কিংকং’।
    --‘যে ছ’ফুট লম্বা, তার জুতো দশ নম্বরের তো হতেই পারে’।
    --‘তা পারে’। পিকুল কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভাবে—‘নাঃ, তদন্ত করে দেখতেই হচ্ছে। সিন্ডারেলার ব্যাপার হাইলি সাস্‌পিশাস বলে মনে হচ্ছে আমার। ওটা নির্ঘাৎ কোনও পুরুষ। সেক্স চেঞ্জ করেছে। নবগ্রামেই এক পিস আছে। শান্তনুদাকে চেনো তো’।
    --‘হ্যাঁ। চিনি’।
    --‘শান্তনুদার ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে সেটা শুনেছ?’
    --‘না তো!’ বিশু আকাশ থেকে পড়ে। আজকাল নবগ্রামের খবর সে কমই রাখে। শান্তনুদার ভাই অতনুকে সে বারকয়েক দেখেছে। বেশ ছিপছিপে লম্বা সুন্দর দেখতে। একটু মেয়েলি মেয়েলি হাবভাব। কিন্তু রঙ যেন একেবারে ফেটে পড়ছে। চোখদুটোও সুন্দর টানাটানা। কথায় কথায় ব্যাপক খিস্তি দিত। ব্যাটা চেইনস্মোকার ছিল। ফস্‌ ফস্‌ করে সিগ্রেট ধরাত! একটা বিরাট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে এখন চাকরি করে। মাসের মধ্যে পনেরো দিনই বিদেশে থাকে।
    সেই অতনুর ডিভোর্স হয়ে গেছে! ওর বিয়েই তো হল মাত্র দুবছর আগে!
    --‘আরে ওখানেই তো লোচা। ছ’মাস আগে অতনুদা আমেরিকা গিয়েছিল এক মাসের জন্য। একমাস পরে যখন ওর বৌ ওকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেছে, তখনই ফুলটু কেলো। দেখে ওর বরের জায়গায় একজন ব্যাপক সুন্দরী মহিলা একটা হ্যান্ডি বিদেশি ছেলের সাথে নামছে। চোখে গোগো সানগ্লাস! আসল ঘটনাটা জানতেই ওর বৌ গোঁ গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল’। পিকুলের চোখ গোলগোল হয়ে গেছে—‘ওর বর তখন আর ওর বর নেই, অন্য একজনের গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেছে। আই মিন, বেমালুম সেক্স চেঞ্জ করে ফেলেছে। পুরো ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল’ কেস!’
    বলে কি! এ তো পুরো চাপের কেস।
    --‘তাই বলছিলাম...’ সে বলে—‘তোমার সিন্ডারেলা ঐ অতনুদা...ধুস...অতনুদি...দূর ছাই—ঐ হাইব্রিড মালটা নয়তো?’
    বিশুর মুখটা ঠিক মুরলীথরনের বোলিং অ্যাকশনের মত হয়ে গেছে। চোখদুটো ট্যারা। মুখটা হাঁ। যেন কেউ এখনই ওর মুখে পাঁচটাকার রসোগোল্লা পুরে দেবে!
    --‘হতেও পারে...’। বিশু আমতা আমতা করে বলে—‘মানে, হওয়াটা অসম্ভব নয়’।
    বেচারি পুরো ডুম হয়ে গেল। এতদিন জুতোটাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছে সে। সিন্ডারেলার স্বপ্ন দেখেছে। দেখেছে পানপাতায় মুখ ঢেকে লজ্জায় মুখ নীচু করে আছে সিন্ডারেলা, আর বিশু তার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে দিচ্ছে। শেষপর্যন্ত সিন্ডারেলার এই হাল!
    --‘চুপচাপ না বসে থেকে চলো পাতা লাগাই’। পিকুলের আবার এই এক দোষ। সে বড্ড কৌতুহলী। সুযোগ পেলেই গোয়েন্দাগিরি করতে বসে।
    --‘কি করে পাতা লাগাবি?’
    --‘সিম্পল্‌’। পিকুল বলল—‘অতনুদা...অতনুদি...হোয়াট এভার...ঐ কম্বাইন্ড মালটাকে এই একপাটি জুতো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবো যে এটা ওর কি না’।
    বিশুর সংশয় তবু কাটে না—‘যদি ক্ষেপে গিয়ে ঐ জুতো দিয়েই আমাদের জুতোপেটা করে! একটা ছেলেকে মেয়েদের জুতো দেখিয়ে...ইয়ে, ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?’
    --‘ও আর ছেলে আছে কই? সব মালপত্তর ট্রান্সফার করে মেয়ে হয়ে গেছে’। পিকুল ভুরু কুঁচকে বলল—‘আর তুমি ঐ মুখ দেখলে চিনতে পারবে তো?’
    --‘খুব পারবো। একেবারে লাল টুকটুকে ঠোঁট। আপেলের মত গাল। টানাটানা চোখ!’
    --‘ধুস্‌, ও তো মেক-আপ! অমন মেক-আপ মারলে আমাদের কাজের বৌ মালতীকেও মাধুরী দীক্ষিত লাগবে। ওটা কাজের কথা নয়’। সে বলল—‘ মেক-আপ ছাড়া দেখলে চিনতে পারবে?’
    বিশু কনফিউজড হয়ে মাথা নাড়ায়। সে এখন কিছুই জোরের সঙ্গে বলতে পারছে না।
    --‘ঠিক আছে। চলো, আজ মালটাকে বাড়িতেই পাবো। রবিবার ওর অফিস থাকে না’। পিকুল উঠে দাঁড়াল—‘চলো একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখি’।
    --‘চল্‌’। বিশু অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়ায়। শেষমেষ সিন্ডারেলার খোঁজে তাকে একজন পুরুষের, না ঠিক পুরুষের নয়...একজন মহিলার...দূর ছাই, শান্তনুদার ভাই...থুড়ি বোন...নিকুচি করেছে—কারুর একটা বাড়িতে যেতে হচ্ছে! তাও একটা জুতো হাতে নিয়ে!
    --‘তবে মামা... তোমাকেও আমার একটা ফেভার করতে হবে’। পিকুল মিচকে হাসি হাসে—‘তোমার সিন্ডারেলার খোঁজ আমি লাগাবো। কিন্তু তোমাকেও আমার সঙ্গে আরেকটা ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করতে হবে’।
    --‘কি ব্যাপারে?’
    --‘টি. বি. সি’।
    বিশু ঘাবড়ে গেল—‘টিউবারকুলোসিস্‌! ওরে বাবা, ব্যাপক ছোঁয়াচে রোগ! আমি নেই!’
    --‘ধুস্‌ মামা!’ সে একটা হাইক্লাস হাসি হাসল—‘তুমি এক নম্বরের ইয়ে। টিউবারকুলোসিস হবে কেন? টি.বি.সি এর ফুল ফর্ম টু বি কন্টিনিউড!’

    শান্তনুর ভাই...ইয়ে...বোন...ধুত্তোর,... কিছু একটা, তথা অতনু তখন বাড়িতেই ছিল। তাকে দেখেই প্রায় পিলে চমকে গেল বিশুর! এটা কে! অতনু! ছ’ফুট লম্বা লোকটার মাথায় কতগুলো খিমচি ক্লিপ বসানো, কানে মনুমেন্ট সাইজের দুল লুড়লুড় করছে, চোখে মোটা করে লাইনার, ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক, পরনে সাদা রঙের নাইটি! এমন করে হেঁটে এল যেন দোলনায় দোল খাচ্ছে!
    --‘মাকড়াটা এমন স্লো মোশনে হাঁটছে কেন রে?’ ফিসফিসিয়ে পিকুলকে বলল বিশু।
    --‘ক্যাটওয়াক করছে’। পিকুল চাপা গলায় বলে—‘মেয়েরা কোমর দুলিয়ে হাঁটে—দেখোনি!’
    --‘কোমর দুলিয়ে হাঁটতে দেখেছি’। সে বলে—‘ কিন্তু এ মালটার তো সবই দুলছে!’
    --‘আ-হা!’ পিকুল আড়চোখে তাকিয়েছে—‘নতুন নতুন জিনিসপত্তর বাগিয়েছে না? তাই একটু শো-অফ করছে!’
    --‘শো-অফের চোটে যে আমিই অফ হয়ে যাচ্ছি’।
    --‘আরও কিছুক্ষণ অন থাকো। তারপর দেখা যাবে’। সে ইশারায় বিশুকে চুপ করতে বলে।
    অতনু এমন ভাবে সোফায় বসে পড়ল যেন রবিনা ট্যান্ডন শাড়ি উড়িয়ে নাচছে! উঃ! কি চাপ!
    --‘ও মা-ই...মা-ই!’ সে গালে হাত দিয়ে বলে—‘বিশু না? কতদিন পরে! আজকাল তো তোকে দেখাই যায় না! শুনেছি মাঝেমধ্যে বাথরুমে বা বেডরুমে উঁকি দিয়ে যাস!’ অতনু লজ্জায় লাল হয়ে যায়—‘ন-টি পিপিং টম! আমার বাড়িতে আসিস্‌ না কেন রে দুষ্টু?’
    উপ্‌প্‌প্‌স! বিশু যে কোথায় যায়!
    --‘ইয়ে, অতনুদা...মানে দিদি...মানে...’।
    সম্বোধনেই পিকুলের পিন আটকে গেছে। অতনু দেবদাসের ঐশ্বর্য রাইয়ের ভীমরুল তাড়ানোর মত করে হাত নাড়ায়—‘ওসব ডাকিস না! কল মি মিস্‌ তনু’। ফস্‌ করে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে কটাক্ষে তাকিয়ে বলল সে—‘ডোন্ট মিস্‌ দ্য মিস্‌স্‌স্‌...’।
    হিস্‌স্‌স্‌! ঐ নামে মল্লিকা শেরাওয়াতের একটা ফিল্ম ছিল না! যেখানে মল্লিকা দিদি সাপের ঠোঁটে দেদার চুমু খেয়েছিলেন! অতনু ওরফে মিস্‌স্‌ তনুর সিগ্রেটে টান দেওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, সিগ্রেট নয়, চুমু খাচ্ছে।
    --‘ওকে তনুদিদি’। পিকুল জুতোটা বের করে দেখায়—‘এটা একটু দেখো তো’।
    --‘ওঃ, কা-ম-অ-ন! দুজন হ্যান্ডসাম সেক্সি অ্যান্ড নটি বয় আমার বাড়িতে এসেছে’। বিরক্ত হয়ে অতনু এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল—‘সাথে ফুল চকোলেট বা নিদেনপক্ষে কন্ডোম আনলে তবু বুঝতে পারি। কিন্তু এক পাটি চটি নিয়ে আমি কি করবো? চিবোবো?’
    --‘কেলো করেছে। চিবোবে কেন?’ পিকুল বলল—‘আসলে বিশুদা এই একপাটির মালকিনকে খুঁজছে’।
    --‘ও মা-ই...মা-ই’। এমনভাবে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকল অতনু যেন এক্ষুনি মিস ইউনিভার্স খেতাব পেয়েছে—‘সো রো-ম্যা-ন্টি-ক! খুঁজছে! ওঃ সো অ্যাডভেঞ্চারাস, খুঁজি খুঁজি নারি, যে পায় তারি...!’
    বিড়বিড় করে বলল পিকুল—‘বড় বাড়াবাড়ি!’
    অতনু তথা তনুদিদি বেসুরো গলায় গেয়ে ওঠে—‘খুঁ-জ-বে আমায় সেদিন, যেদিন আমি থাকবো না’।
    পিকুল ফের বিড়বিড়ায়—‘ন্যাকাশশীপনা!’
    বেশ কিছুক্ষণ আবৃত্তি, গান ও অনেক নাটুকেপনার পর বলল সে—‘বাই দ্য ওয়ে...এই জুতোটা কার, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। এইটুকু বলতে পারি, এটা আমার নয়! তবে যারই হোক্‌, তার স্টাইল সেন্স একদম নেই! এরকম লাল টকটকে জুতো এখন ব্যাকডেটেড’।
    বিশু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। জুতোটা যে অতনুর নয় এই তথ্যটা পেয়েই সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। সিন্ডারেলা যে অতনু নয়, এর থেকে বড় খুশির খবর আর কিছু হতেই পারে না।
    যা জানার ছিল, জানা হয়ে গেছে। আরও মিনিট দুয়েক খেজুর-টেজুর করে অবশেষে দুজনে বেরিয়ে এল।
    --‘বাপ্‌রে! বড় বাঁচা বেঁচেছি!’ পিকুল শ্বাস টানতে টানতে বলে—‘ ভেবেছিলাম পড়াশোনা কমপ্লিট করে মালটার কাছে চাকরির তদ্বির করতে আসবো। ভুলেও আর এ রাস্তা মাড়াচ্ছি না!’
    বিশু বলল—‘যদি সিন্ডারেলা মিস্‌স্‌স্‌স্‌ তনু হত, মাইরি বলছি পিকুল, আমি নির্বীজকরণ, মানে নস্‌বন্দী করে নিতাম’।
    বলতে বলতেই রাস্তায় এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল সে। আর হাঁটবেই না বা কেন? তার মনের উপর দিয়ে প্রায় স্টিম রোলার চলে গিয়েছে। সামলে নিতে একটু সময় নিচ্ছিল বিশু। হঠাৎ কোথা থেকে এক বাইক আরোহী হুড়মুড় করে আচমকা এসে পড়ল তার উপর। পিকুল ভয়ে চিৎকার করে উঠল। রাস্তার লোকেরা ‘গেল গেল’ রব তুলল। বিশুও ধেয়ে আসা বাইকটাকে দেখে লাফিয়ে উঠেছে-
    --‘গে-ছি...গে-ছি...’।
    কিন্তু কপালগুণে কোথাও গেল না সে। অদ্ভুত কৌশলে বাইক রাইডার তাকে কাটিয়ে গেল। রীতিমত হর্স রাইডিং মুভমেন্ট! আরোহীর মুখ দেখা গেল না। হেলমেটে গোটা মুখ ঢাকা। কিন্তু সে যে বাইক র্যায়লিতে এক্সপার্ট লোক, তা তার একটা মুভমেন্টেই বোঝা গেল।
    --‘আবে, চোখ দুটো খুলে হাঁটতে কি ট্যাক্স লাগে বোকাচোদা!’
    কমেন্টটা পাস করেই হুশশ করে বাইকশুদ্ধ ভোঁ ভাঁ হয়ে গেল বাইকরাইডার।
    --‘শালা...হারামী...শুয়োরের বা...’। বিশু মুখখিস্তি করতে শুরুই করেছিল। পিকুল তাড়াতাড়ি তাকে থামায়—‘কি সর্বনাশ! বিশুদা, চুপ করো...চুপ করো...’।
    --‘কেন চুপ করব রে?’ সে তেড়িয়া—‘নিজে শালা বাইকে চেপে নিজেকে পাইলট ভাবছে আর...’।
    --‘চুপ করো বিশুদা!’ পিকুল ফিসফিসায়—‘প্রাণে বাঁচতে চাইলে চেপে যাও। জানো না ওটা কে?’
    --‘কে? কার বাপ?’
    --‘বাপ নয়, ভাই’। সে বলল—‘এ তল্লাটের ভাই। নামকরা গুন্ডা! লাটু মস্তান। বেশি কিচাইন করলে স্ট্রেট লাশ ফেলে দেবে মামা। রোজই তো বাইক হাঁকিয়ে যায়। দেখোনি আগে’।
    বিশু লাটু মস্তানের পিছন দিকটাই দেখতে পাচ্ছিল। গুন্ডা শুনেই তার মুখ বিতৃষ্ণায় কালো হয়ে গেছে। দুনিয়ায় এই একটি প্রজাতিকে সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।
    --‘লাশ ফেলবে না বাল ফেলবে’! সে বলল—‘যত্তসব ভীতুর ডিম। দেখলি না, খিস্তি দিয়ে কেমন পালিয়ে গেল! ওর চেয়ে আমার সিন্ডারেলার সাহসও অনেক বেশি। বুঝলি?’

    ১২.
    তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা!
    বিন্তিপিসি প্রাত্যহিক অভ্যাসমতই দাঁত মাজছিলেন। দাঁত মাজতে মাজতে গজল্লা করা তার প্রিয় হবি। একটু আগেই দেবীর মায়ের সাথে কথা হচ্ছিল। দেবীর মা তার স্বামীর বিষয়ে দুঃখপ্রকাশ করছিলেন। সুবীরবাবু চিরকালই দুর্ঘটনাপ্রবণ! তার কোষ্ঠীতে নাকি লেখা আছে, লাইফের পদে পদে রাহু আর শনি বসে চোখ কটমটাচ্ছে! কথায় আছে, ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়। একই কথা টাকলুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। আর বিশেষ করে সুবীরবাবুর মতো পুরোপুরি ‘অবাক পৃথিবী’ পাব্লিকের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি লাগসই। আর এই ‘লাগসই’ কথাটাই বারবার ‘টাকসই’ হচ্ছে। সুবীরবাবুকে বেলতলায় যেতে হয় না, তিনি যেখান দিয়ে যান, সেখানটাই বেলতলা!
    এই তো, সেদিন ভদ্রলোক নিজের ঘরে বসে পেপার পড়ছিলেন। কোথাও কোনো বিপদের আশঙ্কা ছিল না। হঠাৎ কোথা থেকে এক হতভাগা বোলতা এসে টাকে হুল ফুটিয়ে ভেগে গেল! সে এক কান্ড! আর এই যে দেবীর পোষা বিড়াল মজন্তালি—দিব্যি শান্তশিষ্ট ভদ্র মেনি। তারও কি মতিভ্রম হল কে জানে। সুবীরবাবুর টাকটাকে একদিন রাতে সে বোধহয় ঘুমের ঘোরে খেলার ফুটবল বলে মনে করেছিল। ফলস্বরূপ ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে দিয়ে দিল কয়েকটা আঁচড়! শুধু তাই নয়! আরও আছে! একবার স্বয়ং তিনি লোডশেডিং এর সময়ে দেবীর সাথে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে মোমবাতিটা স্বামীর টাকের উপরই পেস্ট করতে যাচ্ছিলেন! সবে গলা মোমের একফোঁটা ফেলেছেন—অমনি একেবারে হাঁইমাই কান্ড!
    কত আর বলবেন? বলতে শুরু করলে আস্ত একটা মহাভারত হয়ে যাবে! তবুও বলা শেষ হবে না। এর মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনা পিকুলের ছক্কার ধাক্কা! বলটা অন্য কোথাও অনায়াসেই পড়তে পারত! কিন্তু না, পড়তে হল সেই সুবীরবাবুরই টাকে! প্রাণীদের কথা বলাই বাহুল্য, একেবারে নিষ্প্রাণ নিরীহ একটা ডিউস বল, সেও কি না এসে পড়ল যথাস্থানে! দোষ পিকুলের নয়, দোষ সুবীরবাবুর মাথাজোড়া কপালের!
    বিন্তিপিসি মুখ গম্ভীর করে সব কথা শুনছিলেন। তারপর মুখ খুললেন—‘বাড়িতে একটা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করাও গো বৌ। গ্রহের শান্তি হলে মানুষেরও শান্তি!’
    --‘কত করিয়েছি দিদি’। দেবীর মা করুণ মুখ করে বললেন—‘কিছুতেই কিছু হয় না! এই তো সেদিন যজ্ঞ করছিলাম। পুরোহিত ঠাকুর মেঝেতে একটা নারকেল আছাড় মেরে ভাঙলেন। নারকেল তো ভাঙলই না, উল্টে ছিটকে গিয়ে লাগল দেবীর বাবার টাকে! সে আরেক কেলেঙ্কারি’।
    --‘হুম্‌’। মুখ আরও গম্ভীর হল—‘তাহলে একবার ঘামেশ্বর বাবার কাছে গিয়ে দেখো বৌ। কিছু করতে পারলে তিনিই পারবেন!’
    ঘামেশ্বরবাবা! কি বদখত নাম! ভদ্রলোক কি সবসময় ঘামেন নাকি!
    সেকথা বলতেই জিভ কেটে কান চেপে ধরেছেন বিন্তিপিসি—‘অমন বলে না গো দেবীর মা, বাবা সাক্ষাৎ ভগবান। বজরংবলীর কাছ থেকে স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন। বেশ কিছু বছর হিমালয়ে তপিস্যে করে এখন এখানে এসে আখড়া করেছেন। সবাই বলে তিনি নাকি সিদ্ধপুরুষ! মন্ত্রবলে করতে পারেন না, এমন কোনও কাজ নেই! এমনকি বজরংবলীর জাতকেও নিজের পোষ্য করে রেখেছেন। তার পায়ের কাছে একটা গোদা হনুমান বসে থাকে, দুধ-কলা নারকেল খায়! হরিনাম করে!’
    --‘হনুমানে হরিনাম করে!’
    --‘নয়তো আর বলছি কি!’ তিনি বলতে লাগলেন—‘শুধু তাই নয়, সে নাকি শুদ্ধ সমোস্কিতও বলতে পারে!’
    দেবীর মা ঢোঁক গিললেন। হনুমান সংস্কৃত বলতে পারে তা জীবনে এই প্রথম শুনছেন! সত্যিই ঘামেশ্বরবাবা চমৎকারী পুরুষ! হনুমানকে দিয়ে সংস্কৃত বলানো চাট্টিখানি কথা নয়! কিন্তু দেবীর মায়ের সন্দেহ তবু যায় না।
    --‘কিন্তু হনুমানটাকে সংস্কৃত বলতে কেউ শুনেছে কি?’
    --‘নাও ঠ্যালা, শুনবে কি করে?’ বিন্তিপিসি বললেন—‘যখন দর্শনার্থীরা যায় তখন তো হনুমানটা মৌনী নিয়ে বসে থাকে। সারাদিন মৌনব্রত নিয়ে থাকে। তারপর রাত্তিরে যখন বজরংবলীর পুজো হয়, তখন সে দুধ-কলা দিয়ে সাবুমাখা খেয়ে হনুমান চল্লিসা পাঠ করে’। তিনি হনুমানের কীর্তি থামিয়ে এবার ঘামেশ্বরবাবার মহিমা বর্ণনা করতে শুরু করলেন—‘ বাবার অপার ক্ষমতা! গা বেয়ে সবসময় ঘাম বেয়ে পড়ে বুঝলে বৌ! সে ঘাম কি তোমার আমার মত ঘাম! সে একেবারে জলপ্রপাত!’
    অ্যাঁ! জলপ্রপাতের মত ঘাম! দেবীর মা কি বলবেন ভেবে পেলেন না! কিছুক্ষণ থম্‌ মেরে থেকে বলবেন—‘এতো ঘাম! কত গ্যালন জল খান দিনে? ডিহাইড্রেশন হয়ে যায় না?’
    --‘ধুর পাগলি’। লালচে কালো দাঁত বের করে হাসলেন বিন্তিপিসি—‘ও কি আর ঘাম! বাবা গঙ্গাকে নিজের দেহে ধরেছেন! সেই জলই পড়ে! বাবা সাক্ষাত শিবের অবতার।’ বলতে বলতেই গুড়াকুশুদ্ধই হাতটা কপালে ঠেকালেন—‘কত ভক্ত সেই ঘাম বোতলে করে ভরে নিয়ে যায়। বাবার তো চন্নামৃত নেই, ঘামামৃত! ঘামামৃত খেয়ে কত লোকের যে রোগমুক্তি হয়েছে তার হিসাব নেই’।
    --‘ঘামামৃত!’ ভাবতেই দেবীর মায়ের বমি পায়। ঘাম মানুষ খেতে পারে? তিনি তো ঘামের গন্ধ সহ্যই করতে পারেন না।
    বিন্তিপিসি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘামেশ্বরবাবার মহিমা কীর্তন শেষ করার আগেই ফ্যাচাং! বিন্তিপিসির বাড়ির একতলা থেকে চিলচিৎকার ভেসে এল! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিন্তিপিসির একতলার ভাড়াটে, শিবুর বৌ শ্যামলী নাইটি পরে পড়িমড়ি করে ছুটে এল। তার মাথার চুল তখনও ভেজা। কোনমতে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—‘ও পিসি...ও পিসি...’।
    তার ছুটে আসা দেখে ঘাবড়ে গেছেন বিন্তিপিসি। দেবীর মা চমকে উঠেছেন।
    --‘কি হয়েছে?’
    --‘শোবার ঘরের জানলায়...দুটো চোখ...ভয়ঙ্কর চোখ...’। শ্যামলী চোখ বড় বড় করে বলে—‘চোখের মণি দুটো একদম সাদা পিসি! কি ভয়ঙ্কর! ও কোনও মানুষের চোখ নয়...মানুষের চোখ নয়...!’
    --‘কই, চল্‌ তো দেখি। এসো তো বৌ’।
    অসীম সাহস বিন্তিপিসির! বয়েসের ভারে প্রায় হাফকুঁজো, তবু কি স্ট্যামিনা মাইরি! বুড়ি একেবারে ফেলুদার মত গটগটিয়ে শ্যামলীদের বেডরুমে গিয়ে ঢুকল।
    --‘কোন দিকের জানলায় দেখেছিস?’
    --‘পিছনদিকের জানলায়!’
    বিন্তিপিসি এগিয়ে গিয়ে গোটা জানলাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আশ্চর্য ব্যাপার! জানলার উপর একটা হাতের ছাপ এখনও জ্বলজ্বল করছে। হাতের ছাপটা কোনও ভূতের নয়, মানুষেরই বটে!
    --‘আশ্চয্যি!’ তার কপালে বলিরেখাগুলো আঁকিবুকি কেটে মর্ডার্ণ আর্ট তৈরি করেছে—‘ ভূতের হাতে পাঁচটা আঙুল থাকে, তার ছাপও পড়ে, এমন কথা তো কখনও শুনিনি! তুই ঠিক কি দেখেছিলি বল্‌ তো?’
    শ্যামলী বলে—‘আরে, রোজকারের মত আমি তো ছান-টান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বগলে পাউডার লাগাচ্ছি। হঠাৎ শুনি একটা ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ! যেমন চেনের আবাজ হয়, ঠিক তেমনি। তারপরই একটা কুকুর খুব চেঁচাতে শুরু করল। আমি ভাবি, কুকুরটা এত ডাকে কেন! তাপ্পর ভাবলাম কুকুরের কাজ ডাকা, তা ডাকুক গে। কতক্ষণ আর ডাকবে। গলা ব্যথা হলেই চুপ যাবে...’।
    বেশ কিছুক্ষণ কুকুরের ডাকের বর্ণনা চলল। দেবীর মা বিরক্ত হচ্ছিলেন। কুকুরের বর্ণনা আর শেষই হয় না! অনেকক্ষণ শুনে টুনে শেষে বিরক্ত হয়ে বললেন—‘তুই কুকুর দেখেছিস্‌ না চোখ দেখেছিস আগে ঠিক কর্‌’।
    --‘চোখই দেখেছি বৌদি’। শ্যামলী ড্যাম্‌ কনফিডেন্ট—‘তাপ্পর শোনো না। কুকুরটা তো চেঁচিয়েই চলেছে। আমি ভাবি থামে না কেন! ও মা! তারমধ্যেই দেখি জানলার তলায় খচমচ খচমচ শব্দ! যেই না উঁকি মেরে দেখেছি অমনি...’। সে হঠাৎ একটা মোক্ষম হিক্কা তোলে—‘বাপ রে...দেখি একজোড়া চোখ পুরো আমার নাকের সামনে! সে কি চোখ! একদম সাদা! মণিতে লাল, নীল, কালো, বাদামী কোনও রঙই নেই!...’
    বলতে বলতেই গায়ে কাঁটা দিল তার! দেবীর মা দেখলেন সে এখনও ঘামছে! চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট! নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝলেন যে শ্যামলী মিথ্যে কথা বলছে না।
    --‘সর্‌ তো!’
    পিছনের দিকের জানলার পাশে একটা দরজাও আছে। সামনের দিকের দরজা রাস্তার উপরে। আর পিছনের দরজাটা খুললেই দত্তদের বিরাট আমবাগান। রাতের বেলা পুরো অন্ধকার থাকে! দেখলেই কেমন বুক ঢিপঢিপ করে। মনে হয় আমবাগান নয়, আমাজন! সচরাচর এই দরজাটা শিবু বা শ্যামলী—কেউই খোলে না! খোলা বারণ আছে। এই আমবাগানে কতকিছু থাকতে পারে। পাগলা কুকুর থাকতে পারে, বিষাক্ত কীট পতঙ্গ থাকতে পারে। এমনকি সাপ-খোপ থাকাও আশ্চয্যি নয়।
    কিন্তু সেসব কিছুর তোয়াক্কা না করেই পিসি একহাতে একটা খ্যাংড়া ঝাঁটা নিয়ে গট্‌গট্‌ করে হাঁটা দিলেন বাগানের দিকে। ভূত হোক্‌, কি মানুষ—ঝাঁটার বাড়িতেই তাকে যমের বাড়ি পাঠাবেন। শ্যামলীও পিছন পিছন আসছিল। তাকে বারণ করলেন—‘রাতের বেলা নাইটি পরে খোলাচুলে কি ভূতকে রঙ দেখাতে যাবি? ঘরেই থাক্‌। তুমি এসো তো বৌ’।
    দেবীর মা ভয়ে ভয়ে পিসির পিছন পিছন গেলেন। তার যে খুব যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তা নয়। কিন্তু পিসি বয়স্ক মানুষ। একা সামলাতে পারবেন না। তাই তাকে সাপোর্ট দিতেই গেলেন। অবশ্য যদি সত্যিই কেউ আমবাগানে লুকিয়ে থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করা মুস্কিল! বিশাল বিশাল আমগাছগুলো প্রায় দৈত্যের মত দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগোতে গেলেই পায়ে জঙলী লতাপাতা জড়িয়ে যাচ্ছে। বাগানের ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার! যেন রূপকথা বর্ণিত দৈত্যের বাড়ি। কিছুক্ষণ থাকলেই মনে হয় এক্ষুনি বুঝি কেউ নাকি সুরে বলে উঠবে—‘যাঁকে পাঁই তাঁকে খাঁই!’
    ভয়ে ভয়ে পা বাড়ালেন দেবীর মা। আমগাছগুলো এতটাই কম ফারাকে দাঁড়িয়ে আছে যে একটার ডালপালা আরেকটার উপরে গিয়ে পড়েছে। এখান থেকে আকাশ দেখার উপায় নেই। পুরোটাই অন্ধকার! তেমন কোনও আওয়াজ নেই। শুধু ঝি ঝিঁর ডাক একঘেয়ে রিঙটোনের মত বেজেই যাচ্ছে!
    তার ভিতরেই হঠাৎ শোনা গেল কুকুরের ডাক! একটা কুকুর প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে! কেন চেঁচাচ্ছে! সন্দেহজনক। খুব সন্দেহজনক! কুকুরের ডাকটাও কেমন হিংস্র! কি হল! ভয়ঙ্কর বা অদ্ভুত কিছু দেখেছে না কি!
    --‘কুকুরের ডাকটা কোথা থেকে আসছে বৌ’?
    পিসির কথার উত্তর দিতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল দেবীর মায়ের—‘বোধহয় বাগানের ভিতর থেকে’।

    --‘দূর ছাই, এত চেঁচাচ্ছিস কেন বে! চুপ কর্‌ না!’
    ঘোঁতন দাবড়ানি খেয়েও চুপ করল না। বরং উলটে ল্যাজ ঝাপ্টে, গাছের দিকে মুখ উঁচিয়ে, শিরা ফুলিয়ে, তারস্বরে ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করতে লাগল।
    --‘কুত্তাটা ডোবাবে দেখছি’। বিশু ফিসফিস করে বলে—‘শা-লা! তোর আমাকে কেস খাওয়ানো ছাড়া আর কোনও কাজ নেই? তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি?’
    --‘কাকু...’। পাশ থেকে পিকুল ফিসফিসায়—‘ঘোঁতনকে চুপ করানোর উপায় নেই!’
    হারাধন চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। পিকুলের প্রশ্নে মাথা নাড়লেন। আমবাগানে আসা ইস্তক মশার কামড়ই খেয়ে যাচ্ছেন! এমনিতেই মন-মেজাজ খারাপ। তার উপর এই ভীমরুল সাইজের মশার কামড়! বোধহয় শরীরের সব রক্তই খেয়ে ফেলল।
    --‘মারো তো ব্যাটার পোঁদে তিন লাথি!’ পিকুল ক্ষেপে গিয়ে বলে—‘জ্বালিয়ে খেল হতচ্ছাড়া! যেরকম ডেসিবেলে চেল্লাচ্ছে, কেংটি বুড়ি ঠিক আমাদের এসে পাকড়াও করবে! তারপর পাড়ার ছেলেদের ডেকে আড়ং ধোলাই দেবে!’
    --‘ওর আগে তোর পোঁদে তিন লাথি মারা উচিৎ’। বিশুও চটে গেছে—‘ না তোর টি.বি.সি প্রস্তাবে কান দিতাম, না আমার এই জন্ডিস্‌... না না...টিউবারকুলোসিস কেস হত! শালা, বুড়ো বয়েসে গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্টগিরি করতে গিয়ে প্রাণ যাওয়ার উপক্রম!’
    --‘ভেরি ব্যাড বিশুদা!’ পিকুল শুকনো মুখ করেছে—‘যখন সিন্ডারেলার খোঁজে মিস্‌ তনুর মত একটা বিষ মালের বাড়ি জানটাকে হাতে রেখে ঢুকলাম, তখন তো গুরু খুব জোশ দেখাচ্ছিলে। আর এখন কাল্টি মারার তাল করছো। এটা কি ভালো হচ্ছে? ধম্মে সইবে না, খুড়ো’।
    --‘ধম্মের গাঁড় মারা গেছে’। মশা মারতে গিয়ে চটাস্‌ চটাস্‌ করে নিজেকেই গুচ্ছের চাঁটিয়ে সে বলে—‘ এখন এখান থেকে বেরোনোর মতলব ভাঁজ। আগামী পাঁচ মিনিটে যদি এখান থেকে বেরোতে না পারি...তোকেই খরচা না করেছি...’।
    ঘোঁতন এতক্ষণ দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আধহাত জিভ বের করে হ্যা হ্যা করছিল। এবার কানখাড়া করে কি যেন শুনল। তারপরই—ভৌ...ভৌ...গর্‌র্‌র্‌র্‌......!
    আসলে কোনও ঘটনাই ঘটত না, যদি না হারাধনকাকু রাতের বেলায় ঘোঁতনকে নিয়ে চড়তে বেরোতেন। আজই ইপ্সিতারা চলে গেল। সেজন্য মন খারাপ ছিল। কবে আবার মেয়ে আসবে কে জানে! থাকে তো সেই কোন্‌ মুলুকে! ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে কিনা কে জানে! তিনি চোখে দেখতে পান না ঠিকই, কিন্তু মেয়েকে স্পর্শ করে বুঝেছেন—ইপ্সিতার চেহারা খারাপ হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছিল—কি জানি, মেয়েটা ভালো আছে তো? অবনী অবশ্য ভালো ছেলে, কিন্তু বাপের মন...!
    ভাবতে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া খেতে ইচ্ছে করছিল। তার মধ্যে ঘোঁতনটাও চেঁচামেচি জুড়েছে। তারও হয়তো ছোট বা বড় বাইরে পেয়েছে। অগত্যা তাকে নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন হারাধন।
    এই অবধি সবই ঠিকঠাক ছিল। সমস্ত কেলো করল এই হতচ্ছাড়া ঘোঁতনটা। বিন্তিপিসির বাড়ির ঠিক সামনে এসেই ব্যাটা আর নড়তে চায় না! বরং উলটে কি দেখে যেন উত্তেজিত হয়ে গাঁক গাঁক করে ডাকতে শুরু করল। হারাধন তাকে যতই ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন, সে তত জোরে চিৎকার করে। ঐ ভাবে চেঁচাতে চেঁচাতেই আচমকা হাতের চেইন ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেল।
    হারাধন তার চেইন সামলাতে না পেরে উলটে পড়লেন। তার চোখ থেকে চশমাটা ছিটকে পড়ল। তিনি তখনও বুঝতে পারেননি ঠিক কোথায় আছেন! অসহায় ভাবে মাটি হাতড়ে হাতড়ে গগলস্‌টা খুঁজছেন, এমন সময় মনে হল খুব কাছেই কে যেন দাঁড়িয়ে ফোঁৎ ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলছে! ভাবলেন, তাকেই একটু চশমাটা খুঁজে দিতে বলবেন। এই ভেবে যেই না উপরের দিকে মুখ তুলেছেন, অমনি একটা মেয়েলি গলায় তারস্বরে চিৎকার! হঠাৎ কানের কাছে এই ভাবে ক্যাঁচাল করার অর্থ ঠিক কি বুঝে উঠতে পারেননি। কারণটা জিজ্ঞাসা করতেই যাচ্ছিলেন, তার আগেই—‘ওরে বাবারে, মা-রে, খেয়ে ফেলল রে’ বলে কে যেন রাম চিৎকার করে উঠল। পরক্ষনেই দুড়দাড় করে একটা আওয়াজ!
    কে যে কাকে খেয়ে ফেলল তা বোঝার আগেই তাকে দুদিক দিয়ে কারা যেন চেপে ধরল।
    --‘কাকু, আপনি কেলো করেছেন!’
    হারাধন নিজেই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই একটা কন্ঠস্বর তাকে আশ্বস্ত করল—‘এতরাতে এখানে কি করছেন?’
    --‘ঘোঁতনকে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম’। তিনি বললেন—‘বিশু না? কি হয়েছে?’
    বিশু উত্তর দিল না। বরং পাশ থেকে আরেকটা গলার আওয়াজ ভেসে এল। এ তল্লাটের বেশিরভাগ লোকের গলাই তার চেনা, এটা পিকুল।
    —‘ বিশেষ কিছু না। আগের বার যেমন বিশুদা কেস খেয়েছিল, এবার তেমনি আপনিও খেতে যাচ্ছিলেন। কেংটি বুড়ির ভাড়াটের বৌ আপনাকে দেখে ভয় পেয়েছে’।
    --‘আমাকে দেখে!’ তিনি অবাক।
    --‘ঠিক আপনাকে নয়। ইনফ্যাক্ট আপনার চোখ দেখে’। পিকুল থেমে যোগ করে—‘ও আপনাকে ‘অসভ্য চোখ’ ভেবেছে!’
    এবার ব্যাপারটা বুঝলেন হারাধন। আসলে তিনি মেয়েটির ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে চশমা খুঁজছিলেন। মুখ তুলতেই তার চশমাহীন আজন্ম বিকৃত সাদা চোখজোড়া দেখে সে ভয় পেয়েছে। তারই আফটারএফেক্ট এই চেঁচামেচি!
    --‘তাহলে...তাহলে এখন কি হবে?’ ভয় পেয়ে বললেন হারাধন।
    --‘চটপট গা ঢাকা দিতে হবে’। পিকুল বলল—‘কেংটি বুড়ি তো বুড়ি নয়, সাক্ষাৎ পোলদারোগা! আপনার কপালে কি আছে জানি না, আমাদের কপালে রামপ্যাঁদানি। বিশেষ করে বিশুদার...’।
    ব্যস্‌, তারপর থেকেই এই বনবাস! এই ভুতুড়ে আমবাগানে নির্বাসিত হয়েছে তিনজনে। ঘোঁতন আগেই এদিকে চলে এসেছিল। এবার বাকি তিনমূর্তিও জুটল!
    --‘কিন্তু তোমরা দুজন এখানে এতরাতে কি করছ?’ হারাধন কৌতুহলী।
    --‘নজর রাখছি কাকু’। পিকুল ঠাঁই করে নিজের গালেই একটা থাপ্পড় হাঁকাল—‘আমরাও ‘অসভ্য চোখে’র খোঁজে আছি’।
    --‘কিন্তু তার জন্য তো পাড়ার ছেলেরা নজরদারি করছে!’
    --‘পাড়ার ছেলেদের কম্মো নয়’। সে গম্ভীর হয়ে বলে—‘ওরা হচ্ছে পুলিশ বা ফায়ার ব্রিগেডের মতন। সব কেস হয়ে ফাইল গুটিয়ে যাওয়ার পর আসে, আর ভুলভাল লোকের ঘাড়ে দোষ চাপায়! ওরা গোয়েন্দাগিরির কি জানে! ক্লু দেখে না, এভিডেন্স দেখে না! খালি ভুলভাল অ্যাসাম্পশন করে, আর লোককে চমকে বেড়ায়’। বলতে বলতেই থুৎনি চুলকুতে লাগল পিকুল—‘কিন্তু বিশুদা, একটা জিনিস খুব গড়বড়ে লাগছে। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’
    --‘এতরাতে কি ডালে লাল দেখবি? লাল আম ঝুলিয়ে রাখবে কেউ!’ বিশু খিঁচিয়ে ওঠে—‘অন্ধকারে সব ডালই কালো লাগে!’
    --‘আরে! এ ডাল সে ডাল নয়। এ হচ্ছে খাওয়ার ডাল। রাষ্ট্রভাষা বলছি’।
    --‘কেন বলছিস্‌?’ সে খ্যাঁক খ্যাঁক করে ওঠে—‘তোকে এখন রাষ্ট্রভাষা আওড়াতে কোন্‌ গাধা বলেছে? বাঙালীর বাচ্চা হয়ে তোর মাথায় এই সঙ্কটকালে রাষ্ট্রভাষা আসছে!’
    --‘ধুর বাল্‌! এত আদিম হয়ে যাচ্ছ কেন?’ পিকুল বলে—‘বুদ্ধি খাটাও মামা। ইপ্সিতাদির বেলায়, আর এবার কোনও কিছু কমন পাচ্ছো?’
    --‘এ কি তোর সেমিস্টারের সাজেশন পেয়েছিস্‌ যে কমন পড়বে?’
    --‘খামোখা গোঁসা খাচ্ছ কেন? একটু ভেবে বল দেখি’।
    --‘কমন আর কি?’ বিশু মুখটাকে ফাটা ঠোঙার মত করে বলে—‘থাকার মধ্যে আছে ঐ হতভাগা ডিপ্লোডোকাস, ব্রন্টোসোরাস, নরকের নারকেল, সমুদ্রের উকুন ঘোঁতন। ওর জন্য আগেরবার আমি কেস খেয়েছিলাম। আর এবার হারাধনকাকু ফেঁসেছেন!’
    হারাধনকাকু এতক্ষণ ধ্যানস্থ বকের মত চুপ করে ছিলেন। এবার হঠাৎ বলে উঠলেন—‘তাইতো! শুধু ঘোঁতন নয়, গাছটাও কমন ফ্যাক্টর!’
    --‘এগজ্যাক্টলি’। পিকুল বলল—‘দেখলে বিশুদা। কিছু শেখো...কিছু শেখো। খালি হাতে ছেঁড়া চপ্পল ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ালেই হবে?’
    --‘কি শিখব শুনি?’
    --‘সিম্পল অঙ্ক। অ্যারিথমেটিক’।
    --‘আমি নেই!’ বিশু তিন পা পিছিয়ে গেল—‘তোর অ্যারিথমেটিক গোল্লায় যাক। ঐ ফুটো চৌবাচ্চার ফান্ডায় আমি আর পড়ছি না!’
    --‘তা পড়বে কেন?’ পিকুল ফিচলেমি মার্কা হাসি হাসে—‘এখন অন্য ফুটো চিনেছ যে! যাই হোক্‌, ব্যাপারটা খুলে বলি। ইপ্সিতাদির দিনও ঘোঁতন জানলার পাশের আমগাছটার দিকে বারবার তেড়ে তেড়ে যাচ্ছিল। আর আজও ও আমাদের আমবাগানে টেনে এনেছে। আর বারবার সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে চেঁচাচ্ছে। অর্থাৎ আমগাছটায় কিছু আছে!’
    --‘নিশ্চয়ই আছে’। বিশু বলল—‘আম আছে। ঘোঁতনের নোলা সম্পর্কে আমি খুব ভালো ওয়াকিফ! যে হতচ্ছাড়া আফটারশেভ পর্যন্ত চাটে, সে আমের আঁটি চাটতে চাইতেই পারে!’
    --‘না বস্‌’। সে বলে—‘আম নয়, অন্য কিছু আছে। এমন কিছু আছে যা আমাদের রহস্যসন্ধানে হেল্প করতে পারে। ওঠো বীরজায়া, বাঁধো কুন্তল...’।
    --‘রাষ্ট্রভাষা ছেড়ে এখন সাধুভাষা ধরলি কেন বাওয়া! আর বীরজায়া বলছিস্‌ কাকে? আমাদের মধ্যে কার বুব্‌স্‌ আছে শুনি?’
    --‘ওটা কথার কথা’। পিকুল রহস্যময় হাসি হাসে—‘আসলে তোমাকে উঠতে বলছি। চুল বাঁধার জন্য নয়। চুপচাপ ঐ গাছটায় উঠে যাও’।
    --‘হা-মি!’ বিস্ময়ে বিশুর মুখ থেকেও রাষ্ট্রভাষা বেরুল—‘মানে আ-মি! আমি কেন?’
    --‘তবে কি হারাধনকাকু গাছে চড়বেন? আরে বুজুর্গদের হাড্ডির কথাও একটু ভাবো!’
    --‘কি আশ্চর্য! তুই তো বুজুর্গ নোস্‌’। সে গলা চড়ায়—‘তুই চড়ছিস না কেন গান্ডু’?
    --‘ভলিউম কম করো’। পিকুল বলল—‘নয়তো কেংটি বুড়ি এসে ধরল বলে। আমি গাছে চড়তে পারি না! তাছাড়া এখন আমার থিঙ্ক করার আছে’।
    --‘এতক্ষণ তো থিঙ্ক করলি, তাতেও হল না!’
    --‘না হয়নি। তুমি গাছে চড়বে কি না!’
    বিশু বুঝল গাছে না চড়ে উপায় নেই। পিকুলের পাল্লায় পড়েই অন্যায় হয়েছে। হতভাগা গাছে চড়িয়ে মই লোপাট করে দেওয়ার ব্যাপারে এক্সপার্ট!
    --‘কি ভাবছ? উঠে যাও। ‘বোকারা গাছে চড়লে বুদ্ধি খোলে’ এটা চাইনিজ প্রবাদ! তোমারও বুদ্ধি খুলল বলে। কোনও চাপ নেই মামা। একদম বিন্দাস চড়চড়িয়ে উঠে যাও’।
    বিন্দাস শুনেই বিশুর ইচ্ছে করল ঠাস্‌ ঠাস্‌ করে পিকুলকেই চড়াতে। কিন্তু উপায় নেই। চড়তেই হবে। পিকুলের মাথায় যখন ভূত চেপেছে তখন তাকে গাছে না উঠিয়েই ছাড়বে না!
    সে মাথার উপরের আমগাছটার দিকে তাকাল। কি ঢ্যাম্‌না গাছ রে বাবা। গুঁড়িটা এইসান মোটা যে পা রেখে ওঠার উপায়ও নেই।
    --‘পিকুল, তুই আমায় কান্ধা দে’।
    পিকুল কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে—‘লেঃ হালুয়া! তুমি তো এখনও পটল তোলনি। তবে কান্ধা দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে’?
    --‘আরে খেজুর!’ বিশু দাঁত খিঁচিয়ে বলে—‘আমি সেই কান্ধা দেওয়ার কথা বলছি না। তোর কাঁধে ভর না দিয়ে আমি উঠবো কি করে। এ শালার গাছের গা পুরো সিল্ক! পা রেখে ওঠার উপায় নেই!’
    --‘ বাচ্চার জান না নিয়ে তুমি ছাড়বে না! আচ্ছা...দাঁড়াও...’।
    পিকুল গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়—‘সাবধানে উঠো। আমার কাঁধটা ভেঙো না’।
    --‘বেশি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করলে তোর মুন্ডু ভাঙবো। চুপ করে দাঁড়া। নড়িস্‌ চড়িস্‌ না!’
    অতএব পিকুল একেবারে ল্যাম্পপোস্টের মত দাঁড়াল। তার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল বিশু। পিকুলের কাঁধে উঠতেই ‘ছপ্‌ ছপাৎ’ করে গাছের ডাল এসে বাড়ি মারল তার নাকে!
    --‘উঃ...শালা...তোর জন্য আমার নাকটাই...’। বলতে বলতেই চুপ করে গেল সে। গাছের ডালের মধ্যে যেন ঘন অন্ধকার জমে আছে। কিন্তু তার মধ্যেই হীরের টুকরোর মত কি যেন জ্বলছে! অদ্ভুত কিছু একটা! সে একহাতে গাছের ডালটা সরাতেই চকচকে জিনিসটা আরও স্পষ্ট হল!
    ঘোঁতনও সম্ভবত জিনিসটাকে দেখতে পেয়েছে। সে হিংস্র দাঁত বের করে গর্জন করে উঠল—‘গর্‌র্‌...ঘ্যাঁক...ঘ্যাঁক...’।
    বিশু এবার ভয় পেয়ে গেল! ওটা কি! ভূত টূত নয়তো! কিম্বা সাপ! গল্পে টল্পে পড়েছে সাপের চোখ না মাথার মণি নাকি জ্বলে! তবে ওটা...!
    --‘আরে, এতো নড়ছ কেন?’ নীচ থেকে পিকুল অধৈর্য হয়ে বলে—‘উঠে যাও না মামু—হারি আপ্‌। আমি কি আইফেল টাওয়ার—যে মাথায় চড়ে ভিউ দেখবে?’
    বিশু এর উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই খ্যানখ্যানে গলায় কে যেন চেঁচিয়ে উঠল—‘কোথায় রে মুখপোড়া ড্যাক্‌রা! কোথায় লুকিয়েছিস? মরদের বাচ্চা হয়ে থাকিস্‌ তো সামনে আয়!’
    --‘সর্বনাশ! কেংটি বুড়ি!’ পিকুল কেঁপে ওঠে—‘গয়া ভঁইস পানি মে!’
    কেংটি বুড়ি, তথা বিন্তিপিসি হাতে খ্যাংরা ঝাঁটা নিয়ে এদিকেই আসছেন। পিছন পিছন দেবীর মা! দেবীর মায়ের অবস্থা অনেকটা লাস্ট ব্যাটসম্যানের মত। ব্যাট করতে পারে না। হয়তো প্রথম বলেই উলটে পড়বে! তবু প্যাড, হেলমেট সব ধরাচূড়ো পরে নাক বাঁচানোর জন্য ফিল্ডে নেমে পড়েছে। মনে মনে ভাবছে, শালা, প্রথম বলটাই যদি বাউন্সার হয়, তবে স্ট্রেট প্যাভিলিয়নের দিকে দৌড়বো! দেবীর মায়ের ঠিক সেই অবস্থা! যদি সেই ভয়ঙ্কর চোখ সামনে এসে পড়ে তবে কি করবেন তাই ভাবছিলেন! বিন্তিপিসির হাতে তবু খ্যাংরা ঝাঁটা আছে। তাঁর হাতে তো একটা দেশলাই কাঠিও নেই!
    --‘হতভাগা!...কোথায় তুই! ক্ষ্যামতা থাকে তো সামনে আয়!’
    কি সর্বনাশ! একেবারে ওপেন চ্যালেঞ্জ! ওদিকে কুকুরের ডাকের আওয়াজ ক্রমশই বাড়ছে। মনে হচ্ছে কয়েক হাত দূরেই ডাকছে কুকুরটা! তার উপর বিন্তিপিসির চ্যালেঞ্জ! যদি ভূতটার প্রেস্টিজ জ্ঞান প্রবল হয়ে থাকে! যদি সত্যিই সামনে চলে আসে?
    ওদিকে বিন্তিপিসির বাজখাঁই গলার চিৎকার শুনে বিশুর হাড় হিম হয়ে গেছে। এ ফুলটু ‘মাতাহারি’ কেস! এ আমবাগানে ঢুকেই আত্মহত্যা করে ফেলেছে তারা। উপরে হয়তো ‘ন্যাজা ন্যাজা’ ন্যাজ দোলাচ্ছে। চটপট গাছের ডালে উঠে মায়া হয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তার উপর নীচে কেংটি বুড়ি অ্যানাকোন্ডার মত ধেয়ে আসছে। তার ‘হালুম হালুম’ শুনে স্পষ্ট মালুম হচ্ছে যে মালটা একদম এই ডিরেকশনে আসছে।
    --‘আরে বিশুদা...’। নীচ থেকে অধৈর্য হয়ে বলল পিকুল—‘তুমি আমার কাঁধে উঠে কি বাল ছিঁড়ছো? গাছে উঠে পড়ো না!’
    --‘ওঠা যাবে না’। বিশু ধরা গলায় বলে—‘উপরে ন্যাজা ন্যাজা বসে আছে বোধহয়! চোখ জ্বলছে!’
    --‘ন্যাজা ন্যাজা! মানে গোখরো!’ পিকুল কেমন নারকেলি কুলের মত মুখ লম্বা করেছে—‘সাপ! তুমি কি পাগলু হলে! সাপের চোখ কখনও জ্বলে! সাপের চোখে ফসফরাস থাকে না! জ্বলবে কি করে?’
    --‘চোখ না হলে মাথার মণি জ্বলছে! যাই হোক্‌, আমি এখনই খাটিয়া ধরতে চাইনা’।
    পিকুল মুখটাকে প্রায় একতাল বেগুনভর্তার মত করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মূর্তিমান বিপদ সামনে এসে হাজির! বিন্তিপিসি, সাথে খ্যাংরা! ঠিক একহাত দূরেই একদম ঝাঁটা হাতে মূর্তীমতি শাড়ি পরা যম! খ্যানখ্যানিয়ে বললেন—‘হ-ত-ভা-গা! কোথায় লুকিয়ে ব-সে আ...’।
    --‘হা-রে-রে-রে...’। পিকুলের মাথায় তখন হয় ডাকাত, নয়তো চেঙ্গিজ খাঁ এর প্রেতাত্মা ভর করেছে। সে কিছু না ভেবে চিন্তেই বিশুকে ঘাড়ে নিয়ে লাফ মেরে এগিয়ে গেল বিন্তিপিসির সামনে—‘হামকো চ্যালেঞ্জ করতা হায়...হামকো! আবেদন নিবেদন মে কাজ নেহি হোগা তো লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান। রা-মা হো-ও-ও-ও-ও-ও!’
    ডায়লগ শুনে বিশুর পিলে চমকে গেছে! এসব কি বলছে পিকুল! কি অসীম সাহস!
    --‘ভূ-উ-উ-ত!’
    অন্যদিকে বিন্তিপিসিও আঁৎকে উঠেছেন! দেবীর মা ভয়ে স্পিকটিনট! এ কি! সামনে এ কে! মানুষ! কেমন মানুষ! আবছা আবছা ঠ্যাংদুটো মাটিতে! কিন্তু মুন্ডুটা সিধে আমগাছে গিয়ে ঠেকেছে! অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এ মানুষ নয়! এত লম্বা মানুষ হয়! নির্ঘাৎ ব্রহ্মদত্যি! বিন্তিপিসির চ্যালেঞ্জ যে ভারি পড়ে গেল!
    বিশু পিকুলের ঘাড়ে বসে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না! অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না! পিকুলের ভয়াবহ রাষ্ট্রভাষায় ঠিক কি এফেক্ট হল বোঝার উপায় নেই! কিন্তু একটা গোঁ গোঁ শব্দ আর পরক্ষণেই ধপাৎ করে কিছু পড়ার আওয়াজ শুনে ঘাবড়ে গেল! কেলো করেছে, বিন্তিপিসি কি হার্টফেল করলেন!
    সে পিকুলকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই...!
    সড় সড়াৎ করে আমগাছ থেকে কি একটা যেন এসে পড়ল তার ঘাড়ে! একটা সরুমতন, পাতলা, লম্বা চাবুকের মত কিছু! হিলহিল করে নড়ছে তার মাথার উপরে। সর্বনাশ! ন্যাজা ন্যাজা! এক্ষুনি ফোঁস করে ছুবলে দিল বলে! শা-লা, এক ছোবলেই ছবি!
    --‘আঁ-আ-আ-আ!’ একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে সে পিকুলের মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ল মাটিতে! কিন্তু ঠিক মাটিতে পড়ল না...! পড়ল নরম নরম একটা কিছুর উপরে! মুহূর্তের মধ্যে আরও একটা গগনভেদী চিৎকার—‘খেয়ে ফেলল রে-এ-এ-এ!’ তারপরই ধপাৎ করে আরও একটা শব্দ!
    --‘কি হল...?...কি হল...?’
    কি আবার হবে? অন্ধকারে বিশু আর পিকুলের কম্বাইন্ড লম্বা মূর্তি দেখে দেবীর মা আগেই ফেইন্ট হয়ে পড়েছিলেন। বিন্তিপিসি তবু উইকেটে টিঁকে ছিলেন কোনওমতে! কিন্তু বিশু লাফ মেরে পড়বি তো পড়, একদম তার ঘাড়ে! এবং পিসি স্টাম্প্‌ড্‌! একদম তেকাঠি ফাঁক কেস।
    --‘কি হল তা পরে দেখবে বিশুদা!’ পাশ থেকে পিকুল উত্তেজিত স্বরে বলে—‘এখন দুই ঠ্যাঙের উপর ভ্যানিশ হও। পাড়ার ছেলেরা যদি চিৎকার চেঁচামেচি শুনে এসে পড়ে, তবে চারপায়ায় যেতে হবে। কাকু...কোথায়...?’
    হারাধন বিপদ বুঝেই ছুট লাগিয়েছেন। কিন্তু উল্টোদিকে! তাকে চেপে ধরল পিকুল।
    --‘ আরে ওদিকে নয়—আপনি উলটো ট্র্যাকে যাচ্ছেন কাকু। তাড়াতাড়ি এদিকে আসুন...’।
    সে শুধু এইটুকুই বলতে পেরেছিল। আরও কিছু বলার আগেই বাগানের বাইরে জব্বর শোরগোল। কয়েকটা টর্চের আলোর ঝলকানি! সম্ভবত আমবাগানের ভিতরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছিল শ্যামলী। সে ছুটে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের ডেকে এনেছে! তারা এসে আসল ঘটনা আবিষ্কার করার আগেই ভোগা দিতে হবে।
    অন্ধকারের মধ্যেই হাত ধরাধরি করে প্রায় ঝড়ের বেগেই মানে মানে ভেগে গেল তিনজন। পিছন পিছন দৌড়ল ঘোঁতন!
    বিন্তিপিসি বা দেবীর মা কেউই হার্টফেল করেননি। মেয়েমানুষের বড় কড়া জান। কয়েক বোতল জল ছেটানোর পর তাদের কাছ থেকে ‘অসভ্য চোখে’র বর্ণনা পাওয়া গেল! সে কি বর্ণনা! শ্যামলী জানাল, যে লোকটার চোখ দুটো একদম সাদা! মণি আছে কি নেই বোঝা যায় না! দেবীর মা জানালেন—ওটা কোনও মানুষই নয়! আসলে ওটা ভূত। প্রায় দশ বারো ফুট লম্বা! হাইট একটা বিশালকায় আমগাছের গুঁড়ির সমান! বিন্তিপিসি বললেন—শুধু তাই-ই নয়! ভূতটা তাকে গদাম করে এক রদ্দাও মেরেছে! অমন মোক্ষম রদ্দা কোনও মানুষ মারতে পারে না! সে দুশো বিরাশি সিক্কার রদ্দা খেয়ে তিনি মুচ্ছো গিয়েছিলেন। তার সাথে এ ও জানালেন, ওটা কোনও সাধারণ ভূত নয়! নির্ঘাৎ কোনও ভোজপুরী সৈনিকের প্রেতাত্মা! যেভাবে ‘লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান’ বলছিল তাতে সে কারগিলের কোনও মৃত জওয়ানের আত্মা না হয়েই যায় না! তার উপর যে ভূত নিজের মুখেই ‘রামা হো’ বলে রামনাম করে সে খুব সহজ ভূত নয়!
    সব শুনে ছেলেরা কিছুক্ষণ হাঁ করে পরস্পরের মুখ দেখল। শুধু সুব্রতদার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে শুধু বললেন—‘হুম...!’

    ১৩.
    --‘উঁহু... ভাই...হচ্ছে না...হচ্ছে না! কোমরটা আরেকটু হিলাও। নরম নরম করে মিনি বিড়ালের মত ঠ্যাঙ ফেলো। অত লম্বা লম্বা ঠ্যাঙ ফেললে চলবে না!’
    --‘ভাই... তোমার কানচাপাটি খেয়ে আগের মাকড়াটা ভেগে গিয়েছিল। এবারের মাকড়াটাকে কিন্তু ইমপ্রেস করতেই হবে। একটা প্রীতি জিন্টা মার্কা সুইট সুইট স্মাইল দাও। খুব টেম্পার চড়ে গেলে ঐরকম করে দাঁত কেলাবে। কিন্তু খবর্দার, কানচাপাটি একদম নয়!’
    --‘ও কি রকম বগার মত ঠ্যাঙ ফেলছ। মেয়েদের মত হাঁটো না! ‘ময়না ছলাৎ ছলাৎ’ ইস্টাইল!’
    --‘ভাই, তুমি এমন ভাবে হাসছ যেন তোমার গাঁড়ে ওয়াট লেগেছে—মানে কনস্টিপেশন হয়েছে। ঠিক করে দাঁত কেলাও। বিলকুল বিন্দাস লুজ মোশনের মত!’
    মহা কিচাইন! যার জিরাফের মত লম্বা লম্বা ঠ্যাঙ, সে বিড়ালের মত ছোট ছোট পা ফেলে কি করে! শুধু তাই নয়, কোমর ‘হিলিয়ে’ ‘ময়না ছলাৎ ছলাৎ’ স্টাইলে হাঁটতে হবে। লুজ মোশনের মত হাসতে হবে! রাগ হলে কানচাপাটি মারা যাবে না! বরং উলটে দাঁত দেখাতে হবে! এ আবার কি নিয়ম!
    ভিতরে ভিতরে মহা বিরক্ত হচ্ছিল লাটু! সবাই মিলে তাকে মেয়ে বানিয়েই ছাড়বে! না, সে পারে না! সে লিপস্টিকের সাথে লুবড়ি মাখা হাসি হেসে কারুর মন ভোলাতে পারে না। রঙ্গের রাধিকার মত পঁচাত্তর ডিগ্রীতে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটতে পারে না। মাকড়াগুলোরও কত রকমের আবদার দেখো। আগের নমুনাটার কথাই ধরো না! নিজে তো চ্যাগাই কাত্তিক! অথচ কিসব ডিম্যান্ড! বৌকে সুন্দরী হতে হবে, পড়াশোনা জানতে হবে, পাছা অবধি চুল থাকতে হবে, গান-বাজনা জানতে হবে। এতকিছু থাকার পর তাকে কি করতে হবে? না হাউসওয়াইফ হতে হবে! বাসন মাজতে হবে, ঘর ঝাঁটপাট করতে হবে, হেঁসেল ঠেলতে হবে। মানে কমপ্লিট দাসীগিরি! আবে গান্ডু! সুন্দরী, শিক্ষিতা, গানবাজনা জানা মেয়েকেই যদি ঘরে তুলবি, তবে তাকে ঘরের বাঈ করে রাখবি কেন বে? আর যদি ঘরের বাঈ করতেই হয়, তবে নিজের বাড়ির ‘ঝি’টাকেই বিয়ে কর্‌ না! দিব্যি বিনাপয়সায় ঘরের কাজকর্ম করে দেবে! কোনো ক্যাওড়া না করে ছানাপোনা বিইয়ে পাঁচী-পেঁচোর মা হবে! বিন্দাস প্রবলেম সলভড!
    এতসব অদ্ভুতুড়ে কথা শুনে আগেরবার লাটুর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। মালটার কানে এক কানচাপাটি মেরে বলেছিল—‘শা-লা কেরোসিনের ফাটা বোতল! বিয়ে করবি না মাগনার ঝি রাখবি! এখনই সামনে থেকে ফোট্‌, নয়তো...’। বলতে বলতেই ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একখানা প্রমাণ সাইজের চাকু বের করে এনেছিল—‘ বাড়া কেটে হাতে দিয়ে দেবো’।
    লোকটা সেই যে পালিয়ে গিয়েছিল, পিছন ফিরেও দেখেনি। এমনকি নিজের পার্স আর মোবাইলের মায়াও ছেড়েছিল!
    এক আপদ যেতে না যেতেই আরেক আপদ এসে জুটেছে! ইন্টারনেট ছেড়ে মা এখন কোথা থেকে এক ঘটক ধরেছে কে জানে! সে মালটা একটা ছেলের ঠিকানা দিয়ে বসে আছে। এখন ফের তাকে দেখতে যেতে হবে লাটুকে! আগের মত কেস যাতে না হয়, সেজন্য আগেভাগেই তাকে তালিম দিতে শুরু করেছে পন্টরবৃন্দ। ‘ভাই, স্লাইট দাঁত বের করো’... ‘ভাই কোমর দুলিয়ে হাঁটো,’... ‘ভাই, লাজুক লাজুক মুখ করে তিরছি লুক মারো’... হাজার হাঙ্গামা!
    কোনওদিন শুনেছ কোনও ভাই তিরছি লুক মেরে দাঁত কেলিয়েছে! তোলা তুলতে, অপোনেন্টের রোয়াব ঠান্ডা করতে, কারুর থোবড়া বিগড়াতে কিম্বা সপারিষদ গুন্ডাগর্দি করতে দাঁত কেলানোর প্রয়োজন হয় না! তাই এতদিন দিব্যি সুখেই ছিল লাটু। কিন্তু মায়ের মাথায় কি যে ভূত চাপল! সাফ সাফ বলে দিল—‘ওসব আমি জানি না লাটু, মরার আগে তোর কপালে সিঁদুর দেখেই মরবো। ‘এক চুটকি সিন্দুর কি কিমত তুম ক্যায়া জানো রমেশবাবু?’
    লাটু অবাক—‘রমেশ কোন্‌ শুয়োরের বাচ্চার নাম? নতুন ভাই এসেছে না কি!’
    --‘আরে না না... ওটা ওম শান্তি ওমের ডায়লগ!’
    শালা, সব মুসিবতের জড় এই ‘ওম শান্তি ওম’! যেদিন থেকে এই ফিল্মটা রিলিজ করেছে, সেদিন থেকেই লাটুর জীবনে শান্তি নেই। হলে গিয়ে পঁচিশবার ফিল্মটা দেখেছে মা। তা দেখুক, ক্ষতি নেই! কিন্তু কানের কাছে সবসময়ই ঐ ‘এক চুটকি সিন্দুরের’ ফান্ডাটা না আওড়ালে হয় না!
    লাটু ফের প্রতিবাদ করতে গিয়েও আটকে যায়। মা ফের বললেন—‘দ্যাখ্‌ লাটু, এসব ঝাড়পিটের ধান্দা একটা টেম অবধি ভালো। কিন্তু একদিন বুঝবি, আসলে শ্লা, আখ্যা লাইফটাই গাধার গাঁড়ে গেছে। পাশে একটা লোক থাকবে না, তোকে কেউ ভালোবাসবে না, সোহাগ করবে না, সাথ দেবে না—তুই একা হয়ে যাবি। সিম্পিল্‌ হয়ে যাবি’।
    --‘ভাই, সিঙ্গল্‌’। পচা ফের শুধরে দেয়।
    --‘ঐ একই হল’। মা বললেন—‘খামোখা প্রচুর লোচা বাঁধিয়ে একদিন আমার মত বা তোর বাপের মত ফৌত হয়ে যাবি! যখন মরতে বসবি তখন বুঝবি পাশে একটা লোক থাকা বহুত জরুরী। তুই মায়ের ভোগে গেলে শিয়াল-কুত্তা কাঁদতে আসবে না, কাঁদলে ঐ একটা লোকই কাঁদবে’।
    --‘কেন?’ নিজের সাঙ্গোপাঙ্গদের দেখিয়ে বলেছিল লাটু—‘এতগুলো লোক তো পাশে আছে—তাতেও হচ্ছে না!’
    --‘দূর মাগী। ভাতারের সাথে চ্যালাদের তুলনা হয়! তোর বাপেরও তো চ্যালাচামুন্ডা ছিল। তা’লে মাকড়াটা আমায় মাগ করে ঘরে তুলল কেন?’
    মাথা চুলকুচ্ছিল লাটু। এ তো বড় জটিল ব্যাপার স্যাপার।
    --‘ম্যালা দিমাগ চাটিস্‌না লাটু। আমার দোস্ত এই ছেলেটার খবর দিয়েছে। চুপচাপ দেখে আয়। বেশি মগজমারি করলে আমিই তোকে মায়ের ভোগে পাঠাবো’।
    দোস্ত! মায়ের আবার দোস্ত কোথা থেকে এল! এতদিন তো এই পচা-সোনা-কাবুল-পটলাদের সাথে নিয়ে ঘুরত। কিন্তু এই নয়া দোস্ত কোথা থেকে আমদানি হল!
    লাটু চোখ সরু করল—‘দোস্ত?’
    --‘দোস্ত...মানে ট্রেন্ড!’
    --‘ফ্রেন্ড!’ পাশ থেকে ফের হেঁড়ে গলায় বলে ওঠে পচা। মা ক্ষিপ্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন—‘ওয়ে পকেট ডিকশেনারি! শ্লা, মুখ স্টিচ করতে কত নিবি!’
    পচা চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের এই ফ্রেন্ডের ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢোকেনি লাটুর। সে লক্ষ্য করেছে মায়ের মুখটা ইদানীং একটু ফর্সা ফর্সা লাগছে। পার্লারে যায় না কি! আজকাল বেশ সাজুগুজুও চলছে। কখনও চোখে মাস্কারা, কাজল। পাঞ্জাবি ছেড়ে শাড়ি। এমনকি গয়না গাঁটিও টুকটাক পরছে। মাঝেমধ্যেই চ্যালাচামুন্ডাদের ছাড়া একাই হাওয়া হয়ে যায়! জানতে চাইলে বলে—‘একা গিয়েছি তো কি? কচি টুসকি না কি যে গুম হয়ে যাবো!
    কেসটা কি? এই নতুন ফ্রেন্ডটা কে? লোচাটা কি? মাকে জিজ্ঞাসা করলেই মুখে কিছু বলছে না। উলটে কেমন যেন পিঁয়াজের খোসা মার্কা স্মাইল দিচ্ছে!
    যাক্‌ গে! নিজের লাইফেই প্রচুর চাপে আছে লাটু। মায়ের দোস্তকে নিয়ে ভেজা ফ্রাই করার সময় নেই। এমনিতেই সে নিজেই পিনিক খেয়ে আছে। এই ব্যাড প্যাচের সময় আর কাউকে নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।
    --‘ভাই, হাসছো না দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছ তাই-ই বোঝা যাচ্ছে না!’ সোনা বলল—‘স্মাইলটা ভালো করে দাও। দেখলেই যেন সব শালার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়!’
    --‘শা-লা, খালিপিলি কনফিউজ করছিস কেন বে!’ লাটুর আর সহ্য হল না। সে রদ্দা বাগিয়ে তেড়ে যায়—‘ একবার বলছিস লুজ মোশনের মত হাসতে, একবার বলছিস ঘামোনিয়া প্রুফ পাউডারের মত হেসে কলিজা ঠান্ডা করতে। মাজাকি হচ্ছে!’
    --‘ভাই’। এবার ভীমা মুখ খুলল—‘তুমি যদি এইভাবে কথায় কথায় খচে যাও তাহলে কি করে তোমায় ট্রেইন করবো? এরকম মদ্দামার্কা যদি হয়ে থাকো তবে তোমায় কোন্‌ চিরকুট শাদি করবে! সোনা তো তোমায় স্মাইল দিতেই বলেছে, মিসাইল লঞ্চ করতে তো বলেনি!’
    --‘ধুত্তোরি! যতসব মাজরা! স্মাইলের ছেঁড়া গেছে...’। লাটু বিরক্ত হয়ে বলে—‘এই খানদানি থোবড়া দেখেছিস্‌? এই থোবড়ায় কোনওদিন স্মাইল এসেছে যে আজ আসবে?’
    বলতে বলতেই চোখ পড়ল সেই উইন্ডচিটারটার দিকে। ঐ রেলওয়ে ট্র্যাকের মাকড়াটা দিয়েছিল! উইন্ডচিটারটা দেখলেই আজকাল তার কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। একটা হাল্কা হাল্কা ব্যথার মত কি যেন একটা সুড়সুড়ে ভাব! এখন রাতে ঘুমোতে গেলেও মাকড়াটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় রেললাইনের উপরের মুহূর্তগুলো!...হঠাৎ ট্রেনের এসে পড়া...দুজনের জড়াজড়ি করে ছিট্‌কে পড়া... পাব্লিকটা কেমন কচি ছেলের মতন তার বুকে মাথা রেখে শুয়েছিল...হলকটটা আবার বলে কি না—‘তোমাকে মায়ের মত লাগছে...’।
    লাটু যতবার কথাটা ভেবেছে, তত অবাক হয়েছে! তাকে গুন্ডার মত লাগতে পারে, ভাইয়ের মত লাগতে পারে, কষাইয়ের মত লাগতে পারে, যমদূত লাগতে পারে...এমনকি অধুনা পন্টরদের ভাষায় ‘রাপচিক আইটেম’ও লাগতে পারে।
    কিন্তু মা! মায়ের মত কি আদৌ লাগতে পারে লাটুকে! লোকটাকে বেছে বেছে ‘মা’ শব্দটাই বলতে হল! এর চেয়ে যদি বলত বাপের মত লাগছে, তাহলে এত ভাবত না সে! এখন ভাবে, তার মধ্যে এমন কি দেখল ব্যাটা, এমন কি অনুভব করল যে মায়ের সাথে তুলনা করে বসল? ওর মা কি ওকে এমন বিরাশি সিক্কার চাঁটি হাঁকাতো! না এই ভাষায় কথা বলতো! মা বলতে ঠিক কি বুঝিয়েছিল সে?
    লাটু বুঝতে পারে, সে নিজেই আদ্যোপান্ত কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে। মাকড়াটার সাথে দেখা হয়ে কি ভালো হল? না ঠিক হল না? কেন ও বলল, ‘মায়ের মত লাগছে’? কেন উইন্ডচিটারটা দিয়ে দিল? উইন্ডচিটারটা তো ফেরৎ দেওয়ারও উপায় নেই। মালটাকে দিনের আলোয় দেখলেও চিনতে পারবে না লাটু! তাহলে কোন্‌ বিশ্বাসে উইন্ডচিটারটা দিল সে! আজকের জমানায় বিনা স্বার্থে কোনো শালা একটা খড়কে কাঠিও দেয় না! আর এ তো আস্ত একটা নতুন উইন্ডচিটার!
    রাত্রে মাঝেমধ্যেই বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে সে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও না মনে করে পারে না মালটার কথা। হতভাগা নিজের নামটাও বলে যায়নি যে খুঁজে বের করবে। ব্যাটা বেঁচে আছে তো! সত্যিই দুঃখী লোক। একবার ব্যর্থ হয়ে ফের মায়ের ভোগে যাওয়ার তাল করেনি তো! ভাবতে ভাবতেই মনে পরে যায় উইন্ডচিটারটা এগিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিটা। কি ছিল সেই ভঙ্গিতে? নিছক একটা মেয়েছেলেকে বিপদ থেকে রক্ষা করার দিখাওয়া! হিরো হতে চেয়েছিল নাকি? নাঃ। বারবার ভঙ্গিটাকে মনের মধ্যে রিওয়াইন্ড করে করে দেখে লাটু। সেসব কিছু ছিল না। যদি কিছু থাকে তা হল যত্ন ও চিন্তা! মালটা তার জন্য চিন্তা করছিল! ছেঁড়া শাড়ি পরে একটা মেয়ে কিভাবে হেঁটে যাবে, সেই চিন্তা করেই উইন্ডচিটারটা দেওয়া! একেই পচারা ইংরেজিতে বলে ‘কেয়ার’।
    কিন্তু কেন? কেন কেয়ার করল ব্যাটা? লাটু অন্য কারুর কেয়ার থোড়াই করে! তাহলে তার জন্য কেয়ার করতে হতভাগাকে কে দিব্যি দিয়েছিল? সে তো কখনও কারুর কেয়ার চায়নি। সারাজীবন নিজেকে নিজেই সামলে এসেছে। কারুর সাহায্য কখনও দরকার পড়েনি! কেউ সাহায্য করতে চাইলে তাকে ফুটিয়ে দিয়েছে! অথচ ঐ লোকটার উইন্ডচিটারটা বিনা প্রতিবাদে নিয়ে নিল কেন?
    প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বিস্মিত হয়েছে লাটু। আবিষ্কার করল, নিজের অজান্তেই কখন যেন এই যত্নটুকু তার ভালো লেগেছে! শুধু যত্ন নয়, আরও কিছু আছে ঐ উইন্ডচিটারটার মধ্যে যা সে বুঝতে পারছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না! কি যেন একটা ‘ধরি ধরি’ করেও ধরতে পারছে না। বারবার ফস্কে যাচ্ছে হাত থেকে!
    ভাবতে ভাবতেই তার মুখে একটা প্রশান্ত হাসি ভেসে ওঠে। আপনমনেই হাসতে হাসতে বিড়বিড় করে বলে—‘শালা হলকট্‌’।
    --‘আরে...আরে...ভাই!’ সাঙ্গোপাঙ্গরা সব হৈ হৈ করে উঠেছে—‘এই তো হয়েছে! এই তো বিন্দাস স্মাইল দিচ্ছ গুরু! একদম মধুবালা স্মাইল! চোখে ডায়মন্ড চমক! গালে লালি! চোখের পাতা ঝুঁকিয়ে একেবারে কয়ামত স্মাইল দিচ্ছ! এটাকেই হোল্ড করো। মাকড়াটা এই স্মাইলেই হেজে যাবে, পুরো ফিদা হয়ে যাবে ভাই!’
    লাটু অবাক হয়ে তাকায়! সামনের আয়নায় তাকাতেই চমকে উঠল! মাকড়া হেজবে কি, তার আগে সে নিজেই হেজে গেছে! এমন করে হাসতে লাটু মস্তান কবে শিখল! চ্যালা চামুন্ডারা নেহাৎ ভুল বলেনি! এ তো একেবারে বলিউডের হিরোইনের স্মাইল! লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া হাসি! এমন হাসি কি করে এল তার মুখে!
    লাটু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! এটা ঠিক কি হল?

    রাতের বেলায় অন্য মাকড়াটার সাথে অ্যাপো সেরে ফিরছিল লাটু। যথারীতি মিটিং ফ্লপ। মধুবালা মার্কা হাসি, ক্যাটওয়াক দিয়েও ফিল্ম হিট করানো গেল না! এটাকে অবশ্য কানচাপাটি হাঁকড়াতে হয়নি। মালটা হেভি বাতেলা দিচ্ছিল। সামনে মেয়ে দেখলে অনেকেই নিজেকে গব্বর সিং ভাবে। বলছিল—‘জানেন, আমি আমাদের কলেজের রেসলিং চ্যাম্পিয়ন ছিলাম! আচ্ছা আচ্ছা পালোয়ানকে পটকেছি...’।
    লোকটার ষাঁড়ের মত চেহারা দেখে বোর হয়ে বড় বড় হাই তুলছিল সে। অনেক বারফাট্টাই শুনে বিরক্ত হয়ে বলেছিল—‘এগুলো কি ফেকছিস্‌? গাপ্পু দেওয়ার জায়গা পাস্‌নি? তুই যদি রেসলিং চ্যাম্পিয়ন হয়ে থাকিস তবে আমিও ব্রুস লি!’
    কথাগুলো হেভি ইগোয় লেগেছিল মাকড়াটার। বলেছিল—‘আমি গুল দেব কেন? যা সত্যি তাই বলছি’।
    --‘সত্যি? তাহলে আমার সঙ্গে একহাত ফাইট করে দেখা’। লাটু তুড়ি মেরে হাই তোলে—‘এমনিতে শালা, শাড়ি পরে আজ ব্যাকগিয়ারে আছি। তবু ফাইট দিতে পারবো’।
    লোকটা গুহাপ্রমাণ হাঁ করে খ্যাক্‌খ্যাক্‌ করে হাসল—‘ম্যাডাম, আপনি কি পাগল হলেন? আমার সাইজ দেখেছেন? তাছাড়া মেয়েরা মারপিট করে না। নরম হাতে চোট পাবেন’।
    লাটু তার চোখে চোখ রেখেছে—‘মেয়েরা মারপিট করে না, মেয়েদের বাপ করে। আমার হাতের ফিকর্‌ ছাড়্‌ বে, নিজের হাতে চুড়ি না থাকলে পাঙ্গা নিয়ে দ্যাখ্‌’।
    পাঙ্গা নিয়েছিল লোকটা। ফলস্বরূপ দুমিনিটেই মাটি ধরতে হয়েছিল তাকে। শেষপর্যন্ত লাটুকেই ফোনে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হয়েছে।
    ভাবতেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল তার। কিসব স্যাম্প্‌ল্‌ এক একটা। এইসব নমুনাগুলোর জন্য মা তাকে পাকড়াও করে শাড়ি পরাচ্ছে! ক্যাটওয়াক শিখতে হচ্ছে, দাঁত কেলাতে হচ্ছে! কোনও মানে হয়! শালা, দু পয়সার ক্ষমতা নেই, লম্বা লম্বা ফেকছে! রেসলিং চ্যাম্পিয়ন...এতগুলোকে পটকেছে...অমুক তমুক...যত্তসব বকরম্‌বাজ!
    এসব ভেবেই তার মেজাজ চড়ে গেল! শালা, জিন্দেগিটাই হেল হয়ে যাচ্ছে! এসব কি ফান্ডা বোঝে না সে! ব্যাটাছেলে মার্কা, ঢিসুম ঢিসুম করা ফাইটমাস্টার মেয়ে কোনও ছেলে বরদাস্ত করবে না! ছেলে যদি করে, তার বাপ-মা করবে না! এমন বাপ-মা থাকারই বা দরকার কি? দুটো বুলেটেই খচ্চা করে দিলে হয় না?
    বিয়ের মগজমারিতে জেরবার হয়ে নানারকম হিংসাত্মক প্ল্যান ভাঁজছিল লাটু। এরপরের বার কোনও স্যাম্প্‌লের দেখা করার সময় আঁচলে গোটা দুয়েক গ্রেনেড বেঁধে গেলে হয়! কিম্বা আস্ত একটা রামদা ঘাড়ে করে দেখা করার প্ল্যানটা কি রকম? অথবা তার নতুন কেনা পিস্তলটা...!
    --‘উঃ...! বাঁচাও... বাঁচাও...’।
    এতসব কল্পনা করতে করতেই এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল লাটু। রাস্তা অন্ধকার! বোধহয় লোডশেডিং হয়েছে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সত্যি বলতে কি, এখন এমন অবস্থা যে দিনে মিনিমাম চারঘন্টা লোডশেডিং না হলে পাব্লিক অসন্তুষ্ট হয়! ভাবতে শুরু করে, বিদ্যুৎবিভাগের চিরকুটগুলো নির্ঘাৎ নাকে তেল দিয়ে ঘুম দিচ্ছে! অথবা ব্যাটাদের মাথায় কেমিক্যাল লোচা হয়েছে। হতভাগারা নিজেদের বৌয়ের নাম ভুলতে পারে, লোডশেডিং করতে ভোলে না!
    চতুর্দিকে আলোর একফোঁটা রশ্মিও নেই! অন্ধকারের মধ্যেই প্রায় হুমড়ি খেতে খেতে ফিরছিল সে। এই হিলজুতোর জ্বালায় তার প্রাণ যাওয়ার উপক্রম! একটার একপাটি গিয়েছিল, হাঁফ ছেড়েছিল লাটু। কিন্তু রক্ষা নেই, মা আবার একখানা রণপা কিনে এনেছে! এটা আবার আগেরটার চেয়েও ভয়াবহ মাল। ঐ পেন্সিল হিল না কি যেন বলে! সেটা পরে লাটুর নিজেরই হাতে পেন্সিল দশা!
    তবু কোনওমতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটছিল বেচারি। হঠাৎ একটা লোক কোথা থেকে লাফ মেরে এসে পড়ল তার ঘাড়ের উপরে! দুহাতে তাকে জাপটে ধরে বলল—‘প্লিজ্‌...বাঁচান দাদা...ঐ কুকুরটা...ঐ কুকুরটা আমায় ছিঁড়ে খাবে...!’
    লেঃ হালুয়া! কোথাও কিছু নেই, মালটা এসে পড়ল তার উপরই! লোকটা হাঁকপাক করতে করতে তার ঘাড়ে চড়ার উপক্রম করতে লেগেছে!
    --‘ওয়ে, পাকুড় গাছ পেয়েছিস যে ডালে চড়বি?’ সে হাঁকার দিয়ে বলে—‘একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়া—নয়তো দেব একদম কানের গোড়ায়...!’
    লোকটা একদম স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বিস্মিত গলায় বলে—‘কানের গোড়ায়! এ তো সেই ভলিউম...সেই টোন...সিন্ডারেলা!’
    --‘সিন্ডারেলা! বেশি ক্যাওড়ামি করলে গাঁড়ে স্যান্ডল ঢুকবে তোর!’
    --‘আমায় চিনতে পারছো না!’ লোকটা এমন করে বলল যেন কতদিনের চেনা! তার কন্ঠস্বরে আনন্দ মিশল—‘আরে, আমি...ঐ যে! সেদিন রেললাইনের উপরে দেখা হয়েছিল...মনে নেই...!’
    আরে! মনে থাকবে না মানে! খুব মনে আছে! এ তো সেই মালটা! যার উইন্ডচিটার লাটুর ঘরের শোভাবর্ধন করছে! অবাক হয়ে বলল সে—
    --‘আবে, তুই! তুই এখনও ফৌত হোস্‌নি!’
    --‘মানে?’ লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে—‘আমি মরে গেলে তুমি খুশি হতে?’
    যাঃ শালা! এ তো বিনিপয়সায় সেন্টু খেতে লেগেছে। লাটুর রেগে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আশ্চর্য! একটুও রাগ হল না তার! বরং অদ্ভুত একটা মায়া হতে লাগল! বেচারা—দুঃখী লোক। এভাবে ওকে কথাটা বলা উচিৎ হয়নি।
    --‘মাইন্ড খাস্‌ না’। সে গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে বলে—‘আসলে এভাবে কথা বলে বলে, এটাই আদত হয়েছে। আমার জবানটাই এরকম চুতিয়া। ধুয়ে ফ্যাল্‌’।
    অন্ধকারের মধ্যেই মনে হল, লোকটা হাসছে। স্নিগ্ধ গলায় বলল—‘চুতিয়া জবান হবে কেন? তোমার মুখে এই ভাষাটা শুনতে আমার খুব মিষ্টি লাগে!’
    বোঝো! এ পাব্লিক কোথা থেকে এসেছে! লাটুর মুখের খিস্তিখেউড় তার ভালো লাগে! জীবনে এ ধরণের কমপ্লিমেন্ট এই প্রথম শুনছে সে!
    --‘মামা, একটা কথা বল্‌’। লাটু হেসে বলল—‘তুই কোথাকার ডেলিভারি বে! এই দুনিয়ার? না চাঁদের মডেল?’
    --‘হোম ডেলিভারি’। ব্যাটা ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলল—‘মায়ের পেইন যখন ওঠে তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কেউ ছিল না। তাই আমার ডেলিভারি হোমেই হয়েছে’।
    --‘কেন? তোর বাপ ছিল না?’
    --‘বা-প!’ সে বিষণ্ণ হাসল—‘তাকে তো জীবনে চোখেই দেখিনি! আমি পয়দা হওয়ার আগেই লোকটা কেটে পড়ল’।
    --‘কেটে পড়ল? ইয়ানি ভেগে গেল?’
    --‘ভেগেই গেল। তবে উপরওয়ালার কাছে’। লোকটা হাসতে হাসতেই বলল—‘আমি যে পয়দাই কেন হয়েছিলাম বুঝি না! বাপটা জন্মের আগেই চলে গেল। মা টা উনিশ বছর বয়েসে। অভাবের সংসারে খাওয়া জুটত না! মা পরের বাড়িতে বাসন মেজে যা আনত তাতে দুটো পেট চলে না। তার উপর আমার পড়াশোনার খরচা ছিল। মা রোজ আমাকে খাইয়ে নিজে খাওয়ার অ্যাক্টিং করত! আমি এমন পাগলাচোদা ছিলাম, যে কোনওদিনও বুঝিনি, ওটা খাওয়া নয়, খাওয়ার প্রাণপণ অভিনয় হচ্ছে।’
    একটা অব্যক্ত বেদনা তার গলা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। নাক টানার জোরালো শব্দ শুনে লাটু বুঝল, লোকটা কাঁদছে!
    --‘তারপর একদিন আমার চোখের সামনেই লিভার পচে মাও চলে গেল! আমি ভ্যাদার মত দেখলাম মা মরছে! রোজ একটু একটু করে রক্তবমি করে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে’। সে নিজের মাথার চুল ধরে টানল—‘আমি শালা বোকাচোদার মত ডাক্তারের পা ধরলাম, কম্পাউন্ডারের পা ধরলাম, হাসপাতালের লাথ খেলাম—দোরে দোরে গেলাম টাকা চাইতে। ইনফ্যাক্ট, চাওয়া নয়, ধার নয়, ভিক্ষা চাইলাম...! সবাই মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিল...তখন ভাবলাম ডাকাত হয়ে যাব, কালো ধান্দা করবো, চুরি করবো, কেপমারি করবো—তবু মা’র চিকিৎসা করাবো। কিন্তু সাহসে কুলোল না। আই অ্যাম আ কাওয়ার্ড! কাপুরুষের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম, মা’টা বিনা চিকিৎসায় মুখে রক্ত তুলে তুলে মরে গেল। কিচ্ছু করতে পারিনি...কিচ্ছু না...!’ বলতে বলতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছে সে—‘ শেষ সময়ে মুখে আগুন দিতে ঘেন্না হয়েছিল আমার...নিজের উপর ঘেন্না...ভীষণ ঘেন্না...!’
    লাটুর কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছে লোকটা। অন্যসময় হলে তার কপালে দুঃখ ছিল। একটা মোক্ষম কানচাপাটি তো কপালে নাচছিলই। কিন্তু অবাক কান্ড! লাটুর চোখ বেয়ে গরম নোনতা কিছু একটা পড়ছে! লাটুও কাঁদছে! এ কি জাতীয় অনুভূতি! দুঃখ ঐ লোকটার! কাঁদছে ঐ লোকটা! লাটুর কেউ না ও। কোনও ওয়াস্তা নেই! তবে তারও চোখে জল আসে কেন! তার নিজের মা ও তো মরতে চলেছে! কই, একফোঁটা চোখের জলও তো ফেলেনি লাটু! তার ধারণা হয়েছিল জীবনের কোনও দুঃখই আর তাকে কাঁদাতে পারে না! তবে আজ ‘দিল’টা এরকম মুচড়ে মুচড়ে উঠছে কেন? ঐ লোকটার অসহায় কান্না কেন বহুবছরের পাথুরে হৃদয়টাকে গলিয়ে দিচ্ছে! ‘দিল’ এর এ কিরকম ‘দিল্লাগি’! যখন একজনের কষ্টে আরেকজনেরও চোখে জল আসে, তখন তাকে কি বলে...!
    --‘আমি একটা ইডিয়ট, একটা মোস্ট বোকাচোদা!’ লাটুর কাঁধে মুখ ঘষতে ঘষতে নিজেই নিজেকে খিস্তাচ্ছে সে—‘এক নম্বরের লুজার! যাকে ভালো লাগে, সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। যাকে আঁকড়ে ধরি, সে-ই পিছলে যায়! কেরিয়ার ডুম হল। ঠিকমত একটা চাকরিও জোটাতে পারলাম না! লাইফ আমাকে শুধু মেরে যায়। আমি খুঁটিতে বাঁধা গরুর মত মার খেয়ে যাই...। ...আজ কি হয়েছে শুনবে...?’
    লাটুর কাঁধ থেকে মুখ তুলে অসীম হতাশার জ্বালায় বলল সে—‘অতিকষ্টে একটা টিউশনি জুটিয়েছিলাম। বাড়তি ক’টা পয়সা আসত। ক্লাস টু’র ছেলেকে পড়াতে হবে। আজই প্রথম দিন ছিল। সে এমন বিচ্ছু ছেলে যে আমি বাড়িতে ঢুকতেই কুকুর লেলিয়ে দিল! একটা পেল্লায় গ্রে হাউন্ড! এমন দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এল যেন পারলে এখনই চিবিয়ে খায়!... তার ভয়ে কোনমতে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে এসেছি...!’
    --‘ও!’ লাটু বুঝল তার ওভাবে ঘাড়ে এসে পড়ার কারণটা কি! এই ভীতু ভীতু, অসহায় লোকটা পিছন ফিরেও দেখেনি কুকুরটা তাড়া করছে কি না! প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে দৌড়েছে।
    --‘কুত্তাটা এখন তোর পিছনে নেই রে’। লাটু বলল—‘থাকলে ওর বত্রিশ পাটি খুলে তোর হাতে দিয়ে দিতাম। তুই এমন সব বিষ-বকাটে ছানাপোনাদের পড়াতে যাস্‌ কেন? অন্য কোনও ধান্দা নেই?’
    লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল—‘খুব হয়েছে। আর যাবো না। নেহাৎ বেশি টাকা দিচ্ছিল বলে...! ঐ টাকাটা পেলে আমার খুব সুবিধা হত। কিন্তু...’।
    লাটু কয়েকমুহূর্ত ভাবে। নবগ্রামে এরকম বিষ-মাল বাচ্চা একটাই আছে। শান্তনু হালদারের সাত বছরের ছেলেটা। ঐ মালটাই ক্লাস টু তে পড়ে। তার সাথে গ্রে হাউন্ডের ব্যাপারটাও মিলে যাচ্ছে! ওর জ্বালায় প্রাইভেট টিউটরগুলো দুদিনেই ভেগে যায়। ঐ মালটাই হবে। নবগ্রামের চাপ্পা চাপ্পা লাটুর জানা আছে।
    --‘এরপর কবে তুই ফের মালটার বাড়ি ভাঁটাতে যাবি?’
    --‘আর যাই আমি!’ লোকটা বলল—‘আমার মরার শখ নেই!’
    --‘এই যে বললি টাকাটা পেলে তোর মস্তি হবে?’
    --‘আর মস্তি! খুব হয়েছে! প্রাণে বেঁচে থাকি। মস্তি আমার মাথায় থাক্‌। আর আমি ও রাস্তা মাড়াচ্ছি না’।
    --‘আ-ল-বা-ত মাড়াবি!’ লাটু জোরালো গলায় বলে—‘কদ্দিন ভেগে বেড়াবি বে? যত ভাগবি তত পাব্লিকগুলো তোর ওয়াট লাগাবে। এরপর কবে সেটিং আছে?’
    --‘পরশু’। লোকটা ভয়ে ভয়ে বলে—‘কিন্তু ফের যদি কুকুর লেলিয়ে দেয়! ও তো কুকুর নয়! পেল্লায় বাঘ!’
    --‘দেবে না’। তার কন্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস—‘কুত্তাটা আর ও বাড়িতে থাকবে না। টেনশন লেনে কা নেহি বীরু, দেনে কা হ্যায়। ভেজায় ঢুকল’?
    লোকটার ভয় তখনও যায়নি। তবু আমতা আমতা করে বলল—‘আচ্ছা, যখন তুমি বলছো...তখন যাবো!’
    লাটু হাসল। নরম সুরে বলল—‘তোর আস্তানায় ফিরবি না? না এখানেই দাঁড়িয়ে আমার সাথে ভ্যানতারা করবি? যা ফোট্‌।’
    --‘না, বাড়ি যেতে হবে। আজ আসি...’। লোকটা তাড়াহুড়ো করে পা বাড়িয়েই কাৎরে উঠল—‘উঃ! মাগো!’
    --‘মা তো খচ্চা হয়ে গেছে’। সে বলে—‘এত রাতে তাকে ডাকছিস্‌ কেন? কি মাজরা?’
    --‘হাঁটতে পারছি না!’ যন্ত্রণাকাতর গলায় ব্যাটা বলল—‘কুকুরের তাড়া খেয়ে দৌড়নোর সময়ে বার দুয়েক পড়ে গিয়েছিলাম। এখন পা ফেলতেই পারছি না! হাড় ভাঙল কি না কেজানে!’
    --‘না, ফ্র্যাকচার কেস না’। লাটু এমনভাবে মাথা নাড়াচ্ছে যেন সে ডাক্তার। আসলে লোকের হাত-পা ফ্র্যাকচার করে করে সে ফ্র্যাকচারের ধাত বুঝে গেছে। হাড় ভাঙলে এত দূর মাকড়াটা দৌড়ে আসতে পারত না।
    --‘তোর পায়ে মোচ লেগেছে’। সে একটু চিন্তাণ্বিত স্বরে বলে—‘হাঁটতে না পারলে ঘরে ফিরবি কি করে?’
    লোকটা হাঁটতে গিয়ে ফের কাতরে উঠল। কোনমতে বলল—‘ফিরবো না। আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব। তুমি যাও। দেরি কোর না। তোমার বাড়ির লোক চিন্তা করবে’।
    এবার হেবি হাসি পেয়ে গেল লাটুর। ব্যাটা তাকে ভদ্দরঘরের টুনটুনি মেয়ে ভাবছে। লাটু মস্তান তাড়াতাড়ি ফিরলেই বরং লোকে চিন্তায় পড়ে। দেরি হওয়াটা তো তার রুটিন!
    --‘তুই আমার জুতো জোড়া ধরতে পারবি?’
    কথাটা শুনে ঘাবড়ে গেল লোকটা। ফুলটু হাকলাতে হাকলাতে বলল—‘জুতো...কেন?...আমি তো তোমার গায়ে হাত দিই নি। তোমায় অন্যায় কিছু বলিনি...’।
    --‘ধুর্‌ বাল। জুতো ধরতে পারবি কি না বল্‌’। বলতে বলতেই পায়ের হিলজুতোদুটো খুলে ফেলেছে সে। জুতো জোড়া ব্যাটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল—‘নে ধর্‌’।
    বেচারা কি আর করে! জুতোদুটো শক্ত করে ধরল।
    --‘চল্‌, ডাব্‌ল্‌ওয়াক করি’। কিছু বোঝার আগেই লোকটাকে পাঁজাকোলা করে অতি সহজেই তুলে নিয়েছে লাটু। হবেই বা না কেন? সে কি যেমন তেমন মেয়ে? একটু আগেই একজন রেসলারকে পট্‌কে দিয়ে এসেছে! রীতিমত ঢাই কিলোর হাত তার! আর এই লোকটা তো একেবারে পালকের মত হাল্কা! দিব্যি একটা চাদর গায়ে দেওয়ার মতন করে অনায়াসেই তুলে নিয়েছে। তাকে ঘাড়ে নিয়েই লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা লাগাল। যেন আস্ত একটা পুরুষমানুষ নয়, স্রেফ পোষা একটা বিড়াল বা খরগোশ কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে!
    আর লোকটাও অদ্ভুত! দিব্যি নিশ্চিন্তে গলা জড়িয়ে ধরল লাটুর! অদ্ভুত নিরাপত্তায় তার বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছে। ফিল্মে নায়ক নায়িকার সিনে এমন হয়ে থাকে। এখানেও হচ্ছে। তবে উলটোটা!
    --‘জানো, তোমায় একদম আমার মায়ের মতন লাগে!’ লোকটা বিড়বিড় করে বলতে থাকে—‘ছোটবেলায় ভয় পেলেই মায়ের কোলে, বুকে মুখ গুঁজে দিতাম। ভীষণ নিশ্চিন্ত লাগত। মা নেই, কিন্তু আমি এখনও ভয় পাই। ভয় পাওয়ার অভ্যেসটা এখনও যায়নি জানো...। কিন্তু তুমি আমার কাছাকাছি থাকলেই মনে হয়, কোথাও ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক আছে...কোথাও কোনও সমস্যা নেই! মা কে আমি খুব ভালোবাসতাম...’। সে একটু থামল। মনে মনে কিছু যেন বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুক্ষণ থেমে থেকেই ফের বলল—‘আমি বড় দুর্বল সিন্ডারেলা, লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। সবসময় আশ্রয় খুঁজে বেড়াই... একজন পুরুষের ক্ষমতা, সাহস, শক্তি—যা যা থাকা উচিৎ, তার একটাও আমার মধ্যে নেই...। কিন্তু...তবু...আমি তোমাকে...আমি তোমাকে...’। বিদ্যুতের মত সে অমোঘ শব্দটা উচ্চারণ করল—‘আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি সিন্ডারেলা। একরাতের দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি। জানিনা, তুমি আমার সম্পর্কে কি ভাবো। হয়তো ফালতু, বেকার একটা লুজার ভাবো। কিন্তু তুমি যে-ই হও, তোমার নাম যা-ই হোক্‌, যেমনই হও... আমি তোমায় তেমনভাবেই ভালোবেসেছি...সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছি...প্লিজ...আমায় থাপ্পড় মেরো না...আমি তোমায় ভালোবাসি’।
    লাটু মস্তান...দোর্দন্ডপ্রতাপ ভাই স্তম্ভিত হয়ে থম্‌কে দাঁড়াল। কি শুনল সে? কি বলল লোকটা? হঠাৎ ফের কান্না আসছে কেন?
    লোকটা নিজেকে ভীতু বলে। কিন্তু আজ সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছে! নবগ্রামের নামকরা গুন্ডা লাটু মস্তানকে প্রপোজ করে ফেলেছে!

    ১৪.

    --‘আচ্ছা পচা, তোমার বড় ভাই যে তোমায় জুতোপেটা করেন, তোমার লাগে না?’
    --‘আরে না...না ভাইদাদা’। পচা প্রায় কান এঁটো করা হাসি হাসে—‘ও তো মার নয়! আদর!’
    --‘আদর!’ বাবন চোখ কপালে তুলে ফেলেছে—‘জুতোপেটাটা আদর!’
    --‘হ্যাঁ ভাইদাদা’। পচা হাসছে—‘আপনি জুতোটাই দেখেছেন। কিন্তু জুতোর হিলটা দেখেননি। ঐ হিল দিয়ে মারলে, মা কসম্‌ মাথা ফেটে ফাটা ফুটি হয়ে যেত! কিন্তু ভাই কখনো জুতোর হিল দিয়ে মারে না। সবসময় নরম জায়গাটা দিয়েই মারে। ভাইকে দেখতে অমন শক্তপোক্ত হলে কি হবে? আসলে মানুষটা তালশাঁসের মত নরম!’
    তা যে নরম সেকথা বাবন এতদিনে বুঝেছে। বড় ভাই, তথা শিউলির সাথে দোস্তি হয়ে গেছে তার। দুজনের মধ্যেই অনেক কমন ফ্যাক্টর আছে। প্রথম মোলাকাতের পর যত দিন গড়িয়েছে, ততই দুজনে দুজনের ভিতরে মিল খুঁজে পেয়ে অবাক হয়ে গেছে! দুজনেই জোরে জোরে হাসতে ভালোবাসে। দুজনেই সমান খাদ্যরসিক! সমান গাঁতিয়ে খেতে পারে! একবার পাল্লা দিয়ে ফুচকা খাওয়ার কম্পিটিশন লাগিয়েছিল। পচা-কাবুল-সোনারা ফুচকাওয়ালাটাকেই ধরে সোজা নিয়ে এসেছিল বাবনের বাড়িতে। তারপর চলল প্রতিযোগিতা। কে ক’টা ফুচকা খেতে পারে তারই কম্পিটিশন! মজার কথা, প্রতিযোগিতায় বাবন বা শিউলি—কেউ হারেনি! হেরে গিয়েছিল ফুচকাওয়ালাটা! তার সমস্ত ফুচকা সেদিন শেষ! দুজনেই সমান আমুদে! শিউলি লং ড্রাইভে যেতে ভালোবাসে। বাবনও তাই। শিউলি শপিং করতে ভালোবাসে। আর বাবন ব্যাগ-বোঝা টানতে। দুজনেই মাতাল হয়ে বাওয়াল করতে ভালোবাসে। দুজনেই রোম্যান্টিক ফিল্ম দেখে, আর সেন্টু খেয়ে ফোঁচফোঁচায়!
    মোটের উপর, দুজনের স্বভাবই একরকম। এখন তো শিউলির অনুরোধে সে লাটুর জন্য ছেলেও খুঁজতে শুরু করেছে। লাটু মস্তানের জন্য তো আর যেমন তেমন ছেলে খুঁজলে চলবে না। সিংহের মত পুরুষমানুষ চাই। লাটুকে বিয়ে করার ধ্বক তার মধ্যে থাকতে হবে। তেমন ছেলে পাওয়া আজকাল মুশকিল। তবু এক পিস পেয়েছিল বাবন। ছেলেটার চেহারাটা ভালো। বেশ কালোকোলো পালোয়ানের মত। কাজকর্ম তেমন কিছু করে না। বেকারই বলা যায়। তবে লাটুর বরের কিছু না করলেও চলবে! শুধু একটা জোরালো পুরুষমানুষ হওয়াই তার ক্রাইটেরিয়া!
    কিন্তু সেই ক্রাইটেরিয়াও যে কম টেরিয়া নয়, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাবন। লাটু মস্তান তার মায়ের মত অত ফ্রেন্ডলি লোক নয়। তার সামনে বেশি পালোয়ানগিরির ফল কি হয়েছে তা বলাইবাহুল্য! মেয়ে দেখতে গিয়ে সে ছেলে সোজা নার্সিংহোমে পৌঁছে গেছে! সারা গায়ে অগুনতি ফ্র্যাকচার! ডাক্তার পেশেন্টকে চেক করে অবাক! স্তম্ভিত গলায় বললেন—‘কলার বোন, ফিমার বোন ভেঙে গেছে! তাও খুব খারাপ ভাবে! এমন অবস্থা হল কি করে? ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে নাকি!’
    কোন্‌ ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে সে তো খুব ভালোভাবেই জানা আছে! যাই হোকু, শিউলি ডাক্তারবাবুকে বলেছে—‘শোন্‌ মামু, যা যা করার কর্‌। ছুরি কাঁচি চালাবি তো চালা, কিন্তু মাকড়াটাকে খাড়া কর্‌। খচ্চার টেনশন নিস্‌ না। কিন্তু মালটা যদি টেঁসে যায়, তবে তুই খচ্চা হবি’।
    বাবন কোনমতে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ডাক্তারবাবু ভয়েই সাদা হয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে নার্সিংহোমের করিডোরের একধারে টেনে নিয়ে বোঝাল—‘কিছু মনে করবেন না। উনি ছেলের মা। খুব টেনশনে আছেন কি না!’
    ডাক্তারবাবু ধরা গলায় বললেন—‘এই টেনশনের নমুনা! উনি তো উলটে আমাকেই টেনশনে ফেললেন! দাদা, অন্যের প্রাণের চেয়েও নিজের প্রাণটা বেশি দামী। বোঝেন তো?’
    সে ডাক্তারকে আশ্বস্ত করে। যদিও তিনি বিশেষ নিশ্চিন্ত হলেন বলে মনে হল না! বিড়বিড় করে বললেন—‘এ তো মা নয়! শাড়ি পরা মোগ্যাম্বো’।
    ওদিকে পাত্র বেচারার অবস্থা সঙ্গীন। মেয়ে দেখতে গিয়ে ঘুঘু আর ফাঁদ দুই-ই দেখে ফেলেছে। সারা গায়ে প্লাস্টার জড়িয়ে সে একেবারে নেবুচাডনেজারের মমির মত শুয়েছিল! বাবনকে ঢুকতে দেখে ট্রাকের তলায় পিষে যাওয়া নেবুর মতই কুঁইকুঁই করে বলল—‘বাবনদা, মালা পরাতে বলেছিলে, কিন্তু সেটা যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে পরাতে হবে, তা তো বলনি!’
    --‘চুপ কর্‌ শালা!’ বাবন তাকে চমকে দেয়—‘একটা মেয়েকে সামলাতে পারিস্‌ না! আবার গাল ফুলিয়ে ডায়লগ দিচ্ছিস! কে বলেছিল তোকে লাটুর সামনে মাস্তানি করতে। ও মেয়ে তোর মত দশটা পিসকে কুত্তা বানিয়ে ঘোরে, আর তুই কিনা গেছিস তার সামনে রেসলিংগুরু সাজতে!’
    --‘কি করে বুঝবো যে ও মেয়ে মেয়ে নয়, আন্ডারটেকারের মহিলা সংস্করণ!’ ছেলেটা বলতে বলতেই কুঁইকুঁই করে ওঠে—‘শালা, এমন আন্ডারকাট দিল, যে থান্ডার খেয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছি! একদম থাম্‌স্‌ আপ কেস! টেস্ট দ্য থান্ডার অ্যান্ড গেট ঠান্ডা!’
    --‘যাক গে!’ সে আস্তে আস্তে বলে—‘যতটুকু গচ্চা গেছিস্‌ তার ভরপাঈ হয়ে যাবে! কিন্তু মুখ যদি খুলেছিস, তবে চারপাই-ই ভরসা! মাথায় রাখিস্‌’।
    --‘পাগল!’ পেশেন্ট উঁহু আহা করতে করতে বলে—‘একটা মেয়ে আমায় এমন গুছিয়ে সাইজ করেছে একথা বলতে যাই! পুলিশকে বললেও খ্যাঁক খ্যাঁক করে দলবল নিয়ে হাসবে! লোকে প্যাঁক দেবে! নিজের প্রেস্টিজে নিজে গ্যামাক্সিন হারগিস দেবো না আমি! আমার ট্রাকই ভালো’।
    ওদিককার সেটিং করে শিউলির কাছে ফিরল বাবন। শিউলি চিন্তিত মুখে করিডোরে চক্কর মারছিল। তাকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
    --‘কি নিউজ বে? মালটা টিঁকে যাবে তো?’
    সে একটা ‘হাইক্লাস’ হাসি দিয়ে বলল—‘হ্যাঁ। এ যাত্রা টিঁকে যাবে। তুমি টেনশন নিও না’।
    বলতে ভুলে গিয়েছি, এর মধ্যেই দুজনের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। শিউলি যদিও ‘তুই’তেই স্টিক করে আছে, কিন্তু বাবন এখন তাকে ‘শিউলি, তুমি’ বলেই ডাকে।
    --‘বাঁচালি’। শিউলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল—‘চ, দুটো গিলে আসি। সারা সকাল লেট করে করে পেটে বাঘ ডাকছে মাইরি’।
    যথারীতি পচার সংশোধন—‘লেট না ভাই, ওয়েট!’
    শিউলির মুখ বিরক্তিতে বেগুনভাজার মত হয়ে যায়—‘তুই যে বললি ওয়েট মানে ওজন’?
    --‘হ্যাঁ ভাই, ওয়েট মানে ওজনও হয়, আবার অপেক্ষাও হয়!’
    --‘একি মাজরা রে বাপ! জবানও শালা পার্টি বদলাচ্ছে! এক জিনিসের এত নাম হয় কি করে!’
    --‘শুধু তাই নয় ভাই, ওয়েট মানে ভেজাও হয়!’
    --‘ভেজা মানে!’ মাথায় হাত রেখে বলল শিউলি—‘মুন্ডু?’
    --‘না...না...ভেজা মানে গিলা...!’
    --‘ধুত্তোরিকা!’ শিউলি বিরক্ত হয়ে বলে—‘ওয়েটের ভাইপো হয়েছে! আমার পেট খিদেয় শ্লা খচমচাচ্ছে, আর তুই শ্লা ফান্ডা নিয়ে নখরা মারতে বসেছিস!
    --‘ওকে ভাই’।
    অগত্যা পেটপুজো করতে যেতেই হল, তথা গিলতে যেতে হল। এয়ারকন্ডিশন্‌ড্‌ রেস্তোরাঁয় বসে মুর্গীর ঠ্যাঙে জব্বর একখানা কামড় বসিয়ে বলল শিউলি—‘বুঝলি বাবন, এভাবে হবে না। উংলি টেরি করতে হবে’।
    --‘উংলি টেরি!’ বাবন বিষম খায়—‘মানে?’
    --‘দ্যাখ্‌’। সে খেতে খেতে বলল—‘যে সব স্যাম্পেল এখনও পেশ করেছিস্‌, সেগুলো তেমন টেঁকসই না!’
    বোঝো, ছেলে নয়, যেন ব্র্যান্ডেড হাওয়াই চপ্পল!
    --‘এ মাকড়াগুলোর ওয়্যারান্টি নেই বুঝলি’। তার বক্তব্য—‘লাটু একটু টান মারতেই দেশলাই কাঠির মত ভেঙে যাচ্ছে। ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাওয়া পাব্লিক’।
    লাটু ফুল! তাহলে তো বাবন পাখির পালক! অথবা খরগোশের লোম!
    --‘তাহলে উপায়?’ সে কনফিউজ্‌ড্‌--‘তুমি বুঝছো না শিউলি, এরা সব রীতিমত শক্তপোক্ত লোক। কিন্তু লাটু এদের থেকেও জাঁদরেল! এখন দেখছি আন্ডারটেকার-ট্রিপ্‌ল্‌ এক্স এর মতন চ্যাম্পিয়ন, বা জাপানি সুমো আমদানি করতে হবে’।
    শিউলির মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ভেসে ওঠে—‘তা বটে, আমার লাটু স্লাইস কড়ক ছাপ!’
    পিছনের টেবিল থেকে হাঁকার এল—‘স্লাইট!’
    --‘হ্যাঁ...হ্যাঁ...’। সে এবার মেজাজ হারায় না, বরং নির্লিপ্ত মুখ করে বলে—‘হেভি ঝাঁঝালো মাল বুঝলি। একেবারে আগমার্ক সর্ষের তেলের মত!’
    এইবার ঠিক বলেছে! সর্ষের তেলই বটে! ঝাঁঝের চোটে নাকের জলে, চোখের জলে করে ছাড়ছে সবাইকে!
    --‘তাহলে ঝাঁঝালো চিজের জন্য আরও ঝাঁঝালো চিজ লাগবে। তাইতো?’
    --‘ন্যাঃ’। একটু অবজ্ঞার সাথে বলল শিউলি—‘আমাদের গলতিটা ওখানেই হচ্ছে। পরেশানিটা ওখানেই। আমরা ভাবছি আরও কড়ক মাল লাগবে। কিন্তু আসলে লাগবে ঠিক উল্টোটা। ঝাঁঝালো গরমদিমাগ মেয়ের জন্য পুরো ঠান্ডা ছেলে চাই। একদম অহিংস ছাগল ছাগল মাকড়া। সাত বুলেটেও রা কাড়বে না! টোট্যাল অপোনেন্ট!’
    --‘অপোজিট’! ডিকশেনারি থেকে শব্দ উঠে এল।
    --‘আবে...’। সে রেস্টোর্যা্ন্টের মধ্যেই প্রায় ঘুঁষি বাগিয়ে তেড়ে যায় পচার দিকে—‘শ্লা...তোর জবান তো নয়, এক নম্বরের পনৌতি। একেবারে নাক মে দম করে রেখেছে। নিজের মশা আর ফান্ডা নিজে মার! আমার দিমাগ চাটছিস কেন বে? দেখছিস এখানে মগজমারির চোটে পিয়ারলেস কেস হচ্ছে...’
    পচা তিন লাফ মেরে পালাতে পালাতেই বলে গেল—‘পিয়ারলেস নয় ভাই, প্যারালাইসিস...’।
    এমন চ্যালাদের নিয়ে কি করা যায়! কি করা উচিৎ! ব্যাটারা শত খিস্তিখেউড়েও শুধরোয় না! জুতোপেটা খেয়েও নিজের ডিউটি ঠিক করে যায়! শিউলি তার পালানোর ভঙ্গিটা দেখে ফিচ্‌ করে হেসে ফেলে। ফের নিজের চেয়ারে এসে বসতে বসতে বলে—‘মালটা বহুত হারামি বুঝলি? একেবারে কুত্তার দুম! যতই সিধা করার চেষ্টা কর্‌, টেরি কি টেরিই থাকবে’।
    পচা সম্পর্কে কৌতুহলবোধ করছিল বাবন। এত মার খেয়েও মালটা ভুলভাল ইংরেজি শুধরোনোর প্রচেষ্টা ছাড়ে না কেন? এ কি নিরক্ষরতা দূরীকরণের এক ধরণের স্টাইল!
    --‘আচ্ছা, তুমি যে ওকে এত খিস্তি দাও, এত জুতোপেটা করো—ও কিছু মনে করে না?’ সে বলল—‘ইনফ্যাক্ট, ওর জায়গায় আমি থাকলে তো ধুত্তোর বলে গ্যাংই ছেড়ে দিতাম’।
    --‘হ্যাঁ, তুই ছাড়তি’। শিউলি খুব মিষ্টি করে হাসে—‘কারণ তুই বেজন্মা নোস্‌। কিন্তু পচাটা তাই’।
    বাবনের ভুরুতে ভাঁজ পড়েছে। শিউলির মুখটা বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে—‘মালটা কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে শুয়ে কাঁদছিল। বড়জোর একদিনের পিল্লা! তখন লাটু সবে পয়দা হয়েছে। লাটুর বাপ সকালে তোলা তুলতে গেল! ফিরল হারামীটাকে বুকে নিয়ে! বাপ-মা কে কেউ জানে না! সকাল থেকে মুখে একটু জলও পড়েনি। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে গলা ভেঙে গেছে! ঐটুকু পিল্লা, ময়লার মধ্যে শুয়েছিল, বাঁচে কি না ঠিক নেই। লাটুর বাপ ওকে তুলে তো আনল, কিন্তু কি করবে তা নিয়ে ফের মগজমারি! লাস্টে আমিই ভাবলাম, উপরওয়ালা যদি ঐ নান্না জানকে আমার কাছে পাঠিয়ে থাকে, তা’লে ঢ্যামনা কিছু ভেবেই পাঠিয়েছে। তখন আমার বুকে দুধ ছিল বুঝলি? লাটু একা টেনে খতম করতে পারত না...তাই...!’ বলতে বলতেই সস্নেহ হাসল সে—‘লাটু আর পচা এক পেটে পয়দা হয়নি, কিন্তু এক বুকের দুধ খেয়েছে। একসাথে বড় হয়েছে। যখন লাটুর বাপটা খতম হল, তখন পচা ঘরে ছিল না। থাকলে জান দিয়ে দিত, কিন্তু লাটুর বাপটাকে অত সহজে মরতে দিত না! যখন ফিরল তখন সব খতম। লাটুর বাপের মরা মুখে ও-ই আগুন দিয়েছিল। লাটু যখন জেলে গেল, তখন পচাই ঐটুকু বয়েসে সব দেখভাল করেছে। ‘ভাই’ বলে ডাকে ঠিকই, কিন্তু ও আমার ছেলেরও বাড়া! ওকে জুতোপেটা করার ফুলটু হক্‌ আমার আছে। কি বুঝলি?’
    বুঝল বাবন। তবে একসাথে অনেক কিছুই সে বুঝল না! যেমন বুঝল না নিষ্ঠুরতা কাকে বলে? একটা লোক গুন্ডাগিরি করছে, তোলা তুলছে, দরকার পড়লে লাশ ফেলছে—এটা নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুরতা। কিন্তু একটা একদিনের বাচ্চাকে কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়াটাও কি নিষ্ঠুরতা নয়? একটা একদিন বয়েসের শিশু, যার আত্মরক্ষার ক্ষমতা নেই, যে নিজের ইচ্ছেয় পৃথিবীতে আসেনি—তাকে কেউ নিজেদের ভোগের ফসল হিসাবে এনেছে, সে-ই শিশুটাকে মরার জন্য ফেলে যাওয়া কি ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে না! আর সেই মানুষটিই বা কেমন যে শিশুটির জাতধর্ম বিচার করতে বসল না, সে অবৈধ বলে নাক সিঁটকালো না, তার রক্তে কতটা নোংরামির বীজ আছে তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা করল না, বিনা প্রতিবাদে তাকে বুকে তুলে নিল! নিজের সন্তানের সাথে বুকের অমৃতধারা তাকেও ভাগ করে দিল নির্বিকারে! সেই রমণীকে ঠিক কি বলা যায়!
    তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল অনিন্দিতার কথা। সন্তানহীনতার হতাশায় যখন ভুগছিল সে, তখন বাচ্চা অ্যাডপ্ট করার প্রস্তাব দিয়েছিল বাবন। অনিন্দিতা কিছুতেই রাজি হয়নি! বারবার বলেছিল—‘না...না...! অ্যাডপ্ট করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই! কোন্‌ পাপের রক্ত কে জানে! বড় হয়ে গুন্ডা বদমাশ হবে! তাছাড়া নিজের পেটের সন্তানের ব্যাপারটাই আলাদা!’
    সত্যিই আলাদা! দুজন কত আলাদা! অনিন্দিতা ভদ্রবংশের আধুনিকমনস্কা শিক্ষিতা মেয়ে ছিল। আর লাটুর মায়ের শিক্ষাদীক্ষা নেই! প্রথম জীবনে যৌনকর্মী ছিল, তারপর এক গুন্ডার রক্ষিতা।
    বাবন পূর্ণদৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকায়। তার কালো কষ্টিপাথরের মত মুখে কি যেন এক অলৌকিক আলো খেলা করে বেড়াচ্ছে! এই প্রথম মনে হল, মহিলা সুন্দরী। অল্পবয়েসে নিশ্চয়ই আরো সুন্দরী ছিল, কিন্তু এমন পরিপূর্ণতার সৌন্দর্য বোধহয় এই বয়েসেই আসে!
    তার বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। অনিন্দিতা, তুমি গর্ভে সন্তান ধরতে পারো। কিন্তু মা হতে পারবে না! ‘মা’ শব্দের অর্থ কি, তা আজ লাটুর মা বুঝিয়ে দিল। তুমি পারবে না, পারো নি—লাটুর মা পেরেছে!

    ১৫.
    --‘আমরা সবাই প্রয়াত গগনবিহারীর আত্মার শান্তি কামনা করি’। পিকুলের বাবার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। একহাতে চোখ মুছে বললেন—‘তার মত বন্ধু আমি কখনও পাইনি। সবসময়ই পাশে পাশে থাকত সে। কখনও কোনওরকম দুর্ব্যবহার করেনি। অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ছিল। প্রতিবেশী হিসাবে তার তুলনা নেই। সাথী হিসাবে, অবসর বিনোদনে তার জুড়ি ছিল না। পরিবেশপ্রেমিক, মিশুকে, ভদ্র স্বভাবের গগনবিহারীকে আমরা কখনও ভুলবো না। ভুলতে পারি না। বন্ধুগণ, তার জন্য আমরা একমিনিট নীরবতা পালন করবো। ঈশ্বর তার আত্মাকে শান্তি দিন...’।
    বলতে বলতে বাবা একেবারে গলদশ্রু। গলা ধরে এসেছে। ভাষণ শেষ করে চুপ করে গেলেন। সম্ভবত এক মিনিটের মৌনতা পালন করছেন।
    পিকুলের কলেজের দুজন বন্ধু দোতলায় বসে ভাষণ শুনছিল। শোকসভা হচ্ছে ছাতে। একসাথে পড়াশোনা করার ফাঁকে ফাঁকে পিকুলের বাবার বক্তৃতাও কানে আসছিল তাদের। অনেকক্ষণ ধরে শোনার পর অবশেষে না বলেই পারল না—‘কে মারা গেছে রে আভোগ?’
    পিকুল বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল। সেমিস্টারের আর দেরি নেই। এখন পড়াশোনা না করলে কেরিয়ার ডুম হবে। বিশুদা ঠিকই বলেছিল। ‘মেয়ে অগুনতি আছে, সেমিস্টার অগুনতি নেই’! তাই দেবীর চিন্তা মাথা থেকে প্রায় ‘ধুত্তোর’ বলে বের করে দিয়ে বইয়ে কনসেনট্রেট করেছে। বন্ধুদের প্রশ্ন শুনে চোখ না তুলেই বলল—‘ গগনবিহারী’।
    --‘গগনবিহারী কে? কাকুর বন্ধু?’
    পিকুল অন্যমনস্ক হয়েই উত্তর দেয়—‘হুম্‌’।
    দুই বন্ধুর চোখেও বিষণ্ণতার ছাপ পড়ে—‘ তাই কাকু এত কাঁদছেন! গলাটা কেমন ধরা ধরা লাগছিল। বোধহয় ভদ্রলোক কাকুর বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন’।
    --‘মোটেই ভদ্রলোক নয়। তবে বেস্টফ্রেন্ড এটা ঠিক’।
    --‘ভদ্রলোক নয়!’ পিকুলের এক বন্ধু বলে—‘বলিস কি! অভদ্রলোক...আই মিন ছোটলোক ছিল?’
    --‘একনম্বরের হারামী শালা!’ সে বিড়বিড় করে বলে—‘ছোটলোক বলে ছোটলোক!’
    আরেক বন্ধুও অবাক—‘আভোগ, মৃত মানুষ সম্পর্কে এমন কমেন্ট করিস্‌ না। এটা ভদ্রতা নয়...!’
    --‘ধুস্‌! ভদ্রতার ছেঁড়া গেছে! কম জ্বালিয়েছে হারামজাদা?’ পিকুল এবার গরম খেয়ে গেছে—‘যখনই আমি মাথায় শ্যাম্পু করে চুল শুকোতে ছাতে যেতাম তখনই মাথা নোংরা করে দিত। কাকের মত কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, জম্মের নোংরা—ঢ্যাম্‌না শা-লা!’
    --‘এভাবে ভদ্রলোকের আত্মাকে...’।
    তার বন্ধু কথাটা শেষ করার আগেই সে বিরক্ত হয়ে বলে—‘ধুর ব্যাঙ! ভদ্রলোক বলছিস কাকে? গগনবিহারী কোনও মানুষের নাম নয়! ওটা বাবার পোষা পায়রা ছিল! সে ব্যাটাই বাজের ঠোকর খেয়ে পটল তুলেছে। আর বাবা অন্য সমস্ত পায়রাদের নিয়ে তারই শোকসভা করছে, নীরবতা পালন করেছে। এবার ক্লিয়ার হল?’
    --‘পায়রা!’
    --‘হ্যাঁ’। পিকুল বলল—‘ওরাই বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড। বাবা আবার একেকটার একেক নাম রেখেছে। এটার নাম ছিল গগনবিহারী। আরেকটা আছে সাদা রঙের। সেটার নাম আকাশবিহারী। একটা বাচ্চা—সেটার নাম নভোবিহারী। খয়েরি রঙেরটার নাম শূন্যবিহারী! এছাড়াও ব্যোমবিহারী, অনন্তবিহারী, দিগন্তবিহারী...’
    সে গোটা নামের লিস্ট শেষ করার আগেই বন্ধুরা বাধা দেয়।
    --‘আভোগ, একটা কথা বলবো? মাইন্ড খাবি না তো?’
    --‘বকে ফ্যাল্‌’।
    --‘তোরা কি মাইরি পাগলখানা খুলে বসেছিস্‌?’
    পিকুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওদের দোষ নেই। বাইরে থেকে দেখলে যে কেউ তাই ভাববে। বাড়িতে ঢোকার মুখেই দুই বুড়ো দুই আলাদা আলাদা টপিক নিয়ে গুজুর গুজুর করছে! একজন গাছ নিয়ে কথা বলছে, আরেকজন নাচ নিয়ে। মা এই ভরসন্ধ্যায় বাথরুমে ঢুকে সাবান মাখতে মাখতে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে গণসঙ্গীত গাইছেন! আজ পল রবসনকে ছেড়ে জন হেনরিক কে ধরেছেন! বাবা ছাতের উপরে বসে মৃত পায়রার দুঃখে শোকসভা করছেন। পাগলের বাড়ি ছাড়া এটাকে আর কি বলা যেতে পারে?
    বন্ধুরা চলে গেলে পর রাতের খাওয়া শেষ করে ছাতে চলে এল পিকুল। মনের দুঃখে একটা সিগ্রেট ধরাল। তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। একেই সেমিস্টারের চাপ! তার উপর দেবী তার পাতা কেটে দিয়েছে! এই পরিস্থিতিতে যে পড়েনি সে কখনও জ্বালাটা বুঝবে না। ডাঙায় বাঘ, জলে কুমীর! কি চাপ! এর থেকে হাতকাটা জগন্নাথ হয়ে জন্মালে ভালো হত। হাত নেই, সুতরাং সেমিস্টার দেওয়ার চাপ নেই। ক্রিকেট খেলতে কেউ বলবে না! বিড়াল শত ঝগড়া করলেও জল ঢালার উপায় থাকবে না! এই হাতই হল যত নষ্টের গোড়া! এই হাত দুটো আছে বলেই যত জ্বালা!
    --‘পি-কু-ল!’ নীচ থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে এল—‘এতরাতে ছাতে কি করছিস?’
    --‘হাওয়া খাচ্ছি মা’।
    --‘হাওয়া খাচ্ছিস না ধোঁয়া খাচ্ছিস্‌?’
    কি কেলো! মা কি করে পাতা লাগালেন? এইবার একটা সত্যি কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল পিকুল। এতদিন ভাবত গোয়েন্দা সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দার সংখ্যা এত কম কেন? আজ জবাবটা পেল সে। মহিলাদের আলাদা করে গোয়েন্দা হিসাবে প্রোজেক্ট করার কিছু নেই! তারা বর্ন ডিটেকটিভ! জন্ম থেকেই গোয়েন্দাগিরির পাঠ পড়ে এসেছে। বাবা যতই টাকা পয়সা লুকিয়ে রাখুন না কেন, মা ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করে গোটা কয়েক পাত্তি গাপ করবেনই! পিকুল যদি বাইরে ফাস্টফুড খেয়ে আসে, তাহলেও তার মুখ দেখেই বুঝে যাবেন ভদ্রমহিলা! এমনকি বাবার নতুন সেক্রেটারি যে কোনও পুরুষ নয়, বরং একজন তরুণী মেয়ে, এবং সে যে পিঙ্ক কালারের লিপস্টিক মাখে, তা বাবার টিফিনবাক্স দেখেই বুঝে গেছেন মা! মেয়েটি একদিন বাবার সাথে টিফিন শেয়ার করেছিল। স্টিলের চামচে পিঙ্ক লিপস্টিকের দাগ দেখে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললেন তিনি। শেষমেষ বাবাকে সব কথা খুলে বলতেই হল।
    হাতের সিগ্রেটটা পিছনে লুকিয়ে ফেলল পিকুল। বলা যায় না! মা যদি সোজা উপরে উঠে আসেন! তাহলেই আরেক কুরুক্ষেত্র! চেঁচিয়ে বলল—‘না, মা। এই মাথাটা একটু গরম হয়ে গেছে, তাই ঠান্ডা হাওয়া লাগাচ্ছি’।
    --‘আচ্ছা। নীচ থেকে উত্তর আসে—‘বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকিস না। ঠান্ডা লাগবে। সামনে সেমিস্টার। মনে আছে তো?’
    --‘একটু পরেই আসছি’।
    জবাব দিয়ে সিগ্রেটটায় কনসেন্ট্রেট করল পিকুল। জব্বর একটা সুখটান মেরে আকাশের দিকে তাকাল সে। আজ আকাশটা সাফ আছে। দু একটা তারা ফাজলামি করে চোখ টিপছে। চাঁদটাকে কেউ যেন ঠিক কেক কাটার মত একফালি করে রেখেছে! আজ আকাশটা কি রোম্যান্টিক! অথচ পিকুলের মনে সুখ নেই! দেবী এমন করে তার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দেবে কে জানত! পিকুলকে যদি পছন্দ না হয়, তবে মিনিমাম একটা পাতে দেওয়ার মত আইটেম নিয়ে ঘুরে বেড়া! তা নয়, শেষমেষ ঐ পাঁঠামূর্তিধারী পল্টুটাকেই পেলি তুই! অন্য কেউ হলে বুকে এমন ফার্নেস জ্বলত না পিকুলের। কিন্তু পল্টু! চিরকালই লাস্ট বেঞ্চের পাব্লিক! পড়াশোনায় পান্ডিত্যের বিশপাহাড়ি! পিকুল স্কুলের গুড বয়। আর পল্টু অল্পবয়েসেই বাট্‌লি চ্যাম্পিয়ন। অবশ্য মালটা ভালো অ্যাথলিটও ছিল। স্পোর্টসে হাতভরে পুরষ্কার পেত। আর পিকুল চিরকালই স্পোর্টসে ধেড়িয়ে এসেছে। কনসোলেশন প্রাইজ ছাড়া আর কিছু তার বরাতে জোটেনি! তা সত্বেও মাস্টারমশায়েরা পিকুলকেই একটু বেশি ভালোবাসতেন। সেই নিয়ে বহুত জ্বলন ছিল পল্টুর। হতভাগা দলবল নিয়ে কত যে প্যাঁক মেরেছে তার হিসাব নেই! সেই পল্টু দেবীর বয়ফ্রেন্ড!
    ধুস্‌। জিন্দেগিটাই বরবাদ হয়ে গেল পিকুলের। স্যারেরা সবসময়ই বলতেন—‘বাবা, তুমি অনেক দূর যাবে। আমাদের সবার, তোমার মা-বাবার, গোটা নবগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে...’। আর সেই বার খেয়ে খেয়েই ঝাড়িতে চড়েছিল পিকুল! এখন মনে হয়, বার না খেয়ে বরং ফলিডল খেলেই ভালো হত! কি হল উচ্চমাধ্যমিকে অত ভালো রেজাল্ট করে? কি হল জয়েন্টে র্যা ঙ্ক করে? ক্ষীর খেয়ে গেল তো সেই বাট্‌লি চ্যাম্পিয়নটাই!
    ফ্রাস্টু খেতে খেতে ক্রমশই ল্যাদ্‌ খেয়ে পড়ছিল পিকুল! দুঃখের চোটে সিগ্রেটটাও মৌজ করে খেতে পারল না। বিশুদা যাই বলুক—এ ফ্রাস্টেশনের শেষ নেই! কিছুতেই এ কষ্ট গিলে ফেলা যাচ্ছে না! হজম করা যাচ্ছে না!
    চাঁদের আলো চতুর্দিকে আবছা আভায় পড়ে চিকচিক করছিল। আশেপাশের বাড়িগুলোর লাইট নিভে গেছে। একটু আগেই রাণাজীকাকু গামছা পরে ছাতে চক্কর কাটছিলেন। এখন তিনিও নেমে গেছেন। তাদের বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় শুয়েই পড়েছেন সপরিবারে।
    হাতের সিগ্রেটটা শেষ করে সিঁড়ির দিকেই পা বাড়িয়েছিল সে। নাঃ, আর রাত করা ঠিক নয়। প্রচুর পড়াশোনা করেছে আজ। মাথাটা আর চাপ নিতে পারছে না। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই ভালো। যদিও পিকুল রাত জেগেই পড়ারই বেশি পক্ষপাতি। ঐ সাতসকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখে পড়তে তার ভালো লাগে না। তার চেয়ে বরং রাতে পড়ে সকালে দেরি করে ওঠাটা অনেক সেফ।
    কিন্তু আজ মাথাটা ধরে আছে। তাই শুয়ে পড়া মনস্থ করেই ছাত থেকে নেমে আসতে যাচ্ছিল সে। তার আগেই...
    ওকি! ওটা কি! পিকুল বিস্ময়ে চোখ কচলায়! যাঃ শালা! দেবীর দুঃখে ইল্যুশন হচ্ছে না কি! না যা দেখছে—তা বাস্তব? সে চোখ টোখ কচলে আবার তাকাল। নাঃ, ইল্যুশন নয়। যা দেখেছে, ঠিকই দেখেছে! যদিও রাতের অন্ধকারে ঠিকভাবে দেখা সম্ভব নয়। তবু আবছা ছায়া ছায়া প্রেক্ষাপটে যা দেখল, তাতেই মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল তার! একটা লোক, পরণে পায়জামা—অন্ধকারের মধ্যে মিশে একেকটা বাড়ির ছাতের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে! প্রথমে রাণাজীকাকুদের বাড়ির ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ল পিয়ালীদিদের বাড়ির ছাতে। সেখান থেকে আরেকলাফে ‘মান্ডবী অ্যাপার্টমেন্টের’ ছাতে! স্পাইডারম্যানও এমন লাফ মারতে পারে কিনা সন্দেহ!
    উত্তেজনায় পিকুলের নাক ফের সুলসুল করতে লেগেছে। কে ভাই—রাতের বেলায় ছাতে ছাতে লাফালাফি শুরু করেছ! হাইলি সাশ্‌পিশাস্‌! অন্য সময় হলে সে কি করত কে জানে। কিন্তু তার মনে হল, এই ব্যাটাই সেই ‘অসভ্য চোখ’!
    এমনিতে নবগ্রামের এই অঞ্চলটা একটু ঘিঞ্জি। বাড়িগুলো পরপর ঘনসন্নিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ছাতগুলো প্রায় পাশাপাশিই। কিন্তু ছাতে ছাতে লাফ মেরে দৌড়ে বেড়ানোর ধ্বক্‌ খুব কম লোকেরই আছে! পিকুল কোন কথা না বলে সোজা নেমে গেল নীচে। দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে তাকে নেমে আসতে দেখে মা অবাক!
    --‘দৌড়চ্ছিস্‌ কেন?’
    --‘পরে বলছি মা’। সে ন্যানো উত্তর দিয়ে প্রায় গোটা তিনেক সিঁড়ি একসাথে লাফিয়ে নেমে গেল নীচে। বিদ্যুৎবেগে দৌড়ল ‘মান্ডবী অ্যাপার্টমেন্টের’ দিকে। ওখানেই শেষ দেখেছিল লোকটাকে। স্পিড বাড়াল পিকুল। লোকটা এর মধ্যে ভেগে না যায়!
    ‘মান্ডবী অ্যাপার্টমেন্টের’ দিকে প্রাণপণে ছুটতে ছুটতেই সে দেখতে পেল অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলার আলো জ্বলে উঠেছে। তার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ার্ত চিৎকার! যা ভেবেছিল ঠিক তাই। এই সে! অসভ্য চোখ! হারামজাদা মান্ডবী অ্যাপার্টমেন্ট ভিজিট করে গেছে! পিকুল অ্যাপার্টমেন্টের ছাতের দিকে তাকায়! ঐ তো! মালটা এখনও কার্নিশে দাঁড়িয়ে! পালায়নি এখনও। কিন্তু তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আবার লাফ মারল বলে!
    অ্যাপার্টমেন্টের নীচে দরোয়ানের সাইকেলটা দাঁড় করানো ছিল। পিকুল দেখল সাইকেলটায় তালা লাগানো নেই! এই সুবর্ণসুযোগ! লোকটা ইতিমধ্যেই মান্ডবী অ্যাপার্টমেন্টের ছাত থেকে লাফ মেরে পড়েছে বুলাপিসিদের ছাতে! সেখান থেকে ফের লাফিয়ে পড়ল সুব্রতদাদের বাড়ির কার্ণিশে! কি স্পিড ভাবা যায় না! শালা, মানুষ না হৃত্বিক রোশনের ‘ক্রিশ’! দৌড়ে ওর সাথে এঁটে উঠবে না পিকুল। একমাত্র উপায় সাইকেল নিয়ে ওকে চেজ করা।
    দরোয়ানের সাইকেলটায় চড়ে বসে সে সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাড্‌ল্‌ করল। সাইকেলটা ভালো কন্ডিশনে আছে! সাঁইসাঁই করে বাতাস কেটে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গেল। পিকুলের ডানদিকের বাড়িগুলোর উপর দিয়ে লাফ মেরে মেরে যাচ্ছে লোকটা। আর সাইকেল নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাকে অনুসরণ করছে পিকুল।
    নবগ্রামের রাস্তাঘাটে সাইকেল বা বাইক চালাতে হলে আগে লাইফ ইনশিওরেন্স করা দরকার। নিদেনপক্ষে মেডিক্লেম! কর্পোরেশন এখানে ল্যাম্পপোস্ট লাগিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এখানকার চোরগুলোকে গিনতির মধ্যে ধরেনি। ফলস্বরূপ নতুন ল্যাম্পপোস্ট আমদানি হওয়ার সাতদিনের মধ্যেই বাল্বগুলো অনির্দিষ্টের পথে রপ্তানি হয়ে গেল। এখনও পোস্টগুলো আছে—তবে ল্যাম্প নেই!
    তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন নবগ্রামের দাঁত ছরকুটে থাকা রাস্তা! শালা, রাস্তা তো নয়, ইন্ডিয়ার ম্যাপ! এই হাঁই হাঁই করে হিমালয়ে উঠছে তো এই ধপাৎ করে পড়ল ভারত মহাসাগরে! সাইকেলটা কাঁই কাঁই করে উঠছে, টায়ারের তলায় খানাখন্দ ভালোবেসে ‘আয় আয়’ করে ডাকছে! ঝাঁকুনির চোটে পিকুলের কঙ্কালটাই কুলের আঁটির মত বেরিয়ে আসার উপক্রম! তবু হাল ছাড়ল না সে। ডানদিকে অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় লোকটাকে কখনও দেখা যাচ্ছে, কখনও যাচ্ছে না। যখন লোকটা দৌড়চ্ছে তখন অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু যখনই লাফ মারছে, তখন ছায়ামূর্তিটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পিকুল।
    সাঁৎ সাঁৎ করে কালো ছবির মত দুপাশের দৃশ্যপট সরে সরে যাচ্ছে। এতজোরে সাইকেল কখনও চালায়নি পিকুল! হু হু করে হাওয়া কেটে যাচ্ছে দুদিক দিয়ে। সে পায়ের জোর আরও বাড়াল। হতভাগা যে স্পিডে দৌড়চ্ছে তাতে ওকে অলিম্পিকে পাঠিয়ে দিলে ম্যারাথনের গোল্ডমেডেল নির্ঘাৎ ইন্ডিয়ার পকেটে আসবে!
    --‘আজ তোকে ছাড়বো না’। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে সে—‘দেখি, তুই কতবড় তিস মার খাঁ!’
    লোকটা বিদ্যুৎবেগে চিড়িক চিড়িক করে তিনটে লাফ মারল। তারপরই গিয়ে পড়ল সটান দেবীদের বাড়িতে! পিকুল সাইকেল শুদ্ধ বাড়ির গেটে আছড়ে পড়েছে। দেবীদের বাড়ির পিছনে বিরাট পুকুর! আশেপাশে আর কোনও বাড়ি নেই। ওখান থেকে পালাতে হলে লোকটাকে অনেক পাঁপড় বেলতে হবে! লম্ফ মেরে ছাত পার করার ফান্ডা চলবে না! গাছ বেয়ে নামার উপায়ও নেই। বাড়ির সামনে একটা গাছ আছে বটে। কিন্তু সেটা একটা পেল্লায় ক্যাকটাস! এক যদি পাইপ বেয়ে পালায় তবে অন্য কথা!
    সাইকেলে ব্রেক কষতে গিয়ে সাইকেলশুদ্ধই মুখ থুবড়ে পড়ল সে। হাঁটুটায় প্রচন্ড জোরে লাগল! হাতটা বোধহয় কেটেই গেছে! অন্ধকারেও চটচটে রক্তের ধারা টের পেল পিকুল। কিন্তু এখন থামলে চলবে না। সে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মত দৌড়ে যায় দেবীদের বাড়ির দিকে। ডোরবেল টিপতে টিপতেই চিৎকার করতে শুরু করে—‘সুবীরকাকু, কা-কু-উ-উ-উ...!’
    সুবীরকাকুরা বোধহয় শুয়ে পড়েছিলেন। ডোরবেলের একটানা শব্দে আর পিকুলের চিৎকার চেঁচামেচিতে তাড়াতাড়ি কাকু-কাকিমা বেরিয়ে এলেন। অন্য জানলা দিয়ে উঁকি মারল দেবী। ঘুম ঘুম ফুলো ফুলো চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে এমনভাবে তাকাল যেন পারলে এখনই অভিশাপ দেয়।
    পিকুল ভ্রুক্ষেপও করল না। এখন দেবীর অভিশাপে তার বয়েই গেছে। লাইফটাই তো আস্ত একটা অভিশাপ। অভিশাপের সংখ্যা না হয় আরও একটা বাড়বে! তাতে তার মস্ত এলো গেলো!
    --‘কি হয়েছে রে পিকুল’? কাকিমা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন—‘এতরাতে হাঁকাহাঁকি করছিস যে!’
    --‘কাকিমা...দরজাটা খুলে দিন... বলছি... সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার!’
    এবার মুখ খুলল দেবী—‘একদম দরজা খুলবে না মা। অসভ্য কোথাকার! বাবার মাথা ফাটিয়েও তোর শান্তি হয়নি! এত রাতে এসে ফের জ্বালাচ্ছিস্‌! নির্লজ্জ, বেহায়া!’
    যা খুশি বল্‌ দেবী। আজ আমি যা করবো তা তোর পেয়ারের পল্টুও পারবে না!
    --‘কাকিমা দরজাটা খুলে দিন...’ সে দেবীর কথায় কর্ণপাত না করেই বলে—‘লোকটা আপনাদের ছাতে এসে লুকিয়েছে!’
    --‘আমাদের ছাতে!’ সুবীরকাকু আতঙ্কিত—‘কে?’
    --‘দরজাটা শিগ্‌গিরি খুলুন। সব বলছি!’
    কাকু নীচে নেমে এসে দরজা খুলে দিতেই পিকুল হুড়মুড়িয়ে উপরের দিকে ছুটল। ছাতে যাওয়াই তার মুখ্য উদ্দেশ্য! কিন্তু ছাত যে তালাবন্ধ!
    কাকু-কাকিমা, এমনকি দেবীও তার পিছন পিছন উঠে এসেছে ছাতের সিঁড়িতে। কাকু কনফিউজ্‌ড্‌ হয়ে বললেন—‘কি ব্যাপার পিকুল? কে ছাতে?’
    পিকুল সব কথা খুলে বলল। ‘অসভ্য চোখ’ তাদের ছাতে উঠে বসে আছে শুনে দেবী ঝাঁঝিয়ে ওঠে—‘ বাজে কথা বলিস্‌ না। ড্যাম্‌ লায়ার! এতরাতে এসে একটা গপ্পো বানিয়ে শোনাচ্ছিস! উৎপাত করার আর কোনও রাস্তা পাস্‌নি?’
    --‘বাজে কথা বল্‌ছি?’ পিকুল ক্ষেপে গিয়ে বলে—‘এতক্ষণ ধরে আমি মালটাকে চেজ করে আসছি। পরিষ্কার দেখলাম তোদের ছাতে উঠেছে...’।
    --‘চেজ্‌ করছিস্‌ তো কি? তোপ দাগতে হবে?’ দেবী কটকটিয়ে বলে—‘পরমবীরচক্র দেব?...না... না। অ্যাকচুয়ালি তুই নোবেল ডিজার্ভ করিস্‌! যা কাজকর্ম শুরু করেছিস তাতে কয়েকদিন পরেই পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে যাবে। বেল দেবে না। মানে নো-বেল। বুঝেছিস?’
    সুবীরকাকু তার ফেট্টি বাঁধা টাকটাতে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন—‘আহা, এত রাতে আবার বেলের কথা কেন? চল্‌ পিকুল, বরং ছাতটাই দেখে আসি’।
    --‘বাবা...ও মিথ্যে বলছে’।
    --‘চুপ কর্‌ দেবী’। সুবীরকাকু বললেন—‘এত রাতে কেউ প্র্যাকটিক্যাল জোক করার জন্য আছাড় খেয়ে হাত পা কাটে না! তাছাড়া আমিও ছাতের উপর একটা ধুপ্‌ করে শব্দ শুনেছি!’
    বলতে বলতেই স্পষ্ট শোনা গেল ছাতের উপর কারুর একটা পায়ের আওয়াজ! কেউ যেন থুপথুপিয়ে হাঁটছে। পায়চারি করছে!
    দেবীর মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া একটা ভূতের গল্প। একটা লোকের পা কাটা গিয়েছিল। তারপর থেকে তার প্রেতাত্মা একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছাতে পায়চারি করত—হেঁটে বেড়াত। তার সাথে মায়ের বলা বর্ণনাটাও মনে পড়ে গেল। দত্তদের আমবাগানে মা ‘অসভ্য চোখ’কে দেখে ফেইন্ট হয়ে পড়েছিল! তার নাকি ইয়া লম্বা তালগাছের মত চেহারা! বিন্তিপিসিকে এমন চাঁটি হাঁকিয়েছিল যে তিনদিন তার ঘাড়ের, চোয়ালের ব্যথা কমেনি! শিবুর বৌ শ্যামলী বলেছিল, তার চোখদুটো একদম ফকফকে সাদা! মণি আছে কি নেই বোঝাই যায় না!
    সেই মূর্তিমান আতঙ্ক তাদের বাড়ির ছাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ভাবতেই ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল দেবীর! কাকিমা হাঁউমাউ করে উঠে জড়িয়ে ধরেছেন কাকুকে—‘ওগো, এ কি সর্বনাশ হল! আমার বিন্তিপিসির সাথে যাওয়াই ভুল হয়েছে। বিন্তিপিসির চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্ট করে নিয়েছে ভূতটা। সেইজন্য দেখা দেওয়ার জন্য বাড়ি ধাওয়া করে ঠিক আমাদের বাড়ির ছাতে এসেই হাঁটছে! ও আমাকে ছাড়বে না...’!
    সুবীরকাকু কি করবেন বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ থম্‌ হয়ে বসে থেকে বললেন—‘পিকুল, চল্‌ ছাতটা দেখে আসি। যে-ই হোক্‌, সে এখনও আমাদের ছাতের উপরেই আছে। পালাতে পারেনি। হাত গুটিয়ে বসে না থেকে একবার দেখা দরকার!’
    কাকিমা বললেন—‘পাড়ার ছেলেদের খবর দেওয়া উচিত। ওরা আসুক, তারপর যেও’।
    --‘নাঃ। ততক্ষণে দেরি হয়ে যাবে’। সুবীরকাকুর মুখ শক্ত—‘সুব্রতর মোবাইল নম্বর জানো তো। ওকেই ফোন করে বলো। আর এত রাতে তোমাদের বেরিয়ে কাজ নেই! দেবী, তুই নিজের ঘরেই থাক্‌। বেরোবি না। চল্‌ পিকুল’।
    দুজনেই গুটিগুটি পায়ে ছাতের দিকে এগোল। সুবীরকাকুর বাঁ হাতে টর্চ, ডানহাতে ছাতের চাবি। তিনি সাবধানে তালা খুললেন।
    --‘শুনছ?’ ভয়ে ভয়ে কাকিমা বললেন—‘বলছি যে হেলমেটটা পরে যাবে না কি!’
    --‘হেলমেট?’ সুবীরকাকুর ভুরু কুঁচকে গেছে। তিনি হেলমেটের তাৎপর্য ঠিক বোঝেন নি। কিন্তু পিকুল বুঝেছে। কাকুর টাকটার উপর দিয়ে বর্তমানে খুব ফাঁড়া যাচ্ছে। সেইজন্যই হেলমেটের প্রসঙ্গ।
    --‘পরে নিন কাকু’।
    কাকু বিনাপ্রতিবাদে হেলমেট পরে নিলেন। তারপর ছাতের দরজা খুললেন। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে এমন জমাট অন্ধকার যে তার বর্ণনা করাই অসম্ভব! চাঁদটা এতক্ষণ তবু মিটমিট করে দাঁত কেলাচ্ছিল। এখন মেঘের এক চিলতে ওড়না টেনে ঘোমটাবতী হয়ে বসে আছে। সুতরাং কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইনফ্যাক্ট, নিজেকেই কেমন চলমান অশরীরী বলে মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে নিজের মুন্ডুটা ছাড়া বাদবাকিটা নেই!
    হঠাৎ কোথায় যেন মোবাইল বেজে উঠল। জোরালো গলায় রিংটোন বাজিয়ে চিলচিৎকার করছে ফোনটা! কিন্তু কোথায় বাজছে? কার মোবাইল?
    --‘কাকু?’
    সুবীরকাকু ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ালেন—‘শ্‌শ্‌শ্‌, আমার ফোন না।—তোর?’
    --‘নাঃ! এরকম বদখত রিংটোন আমি লাগাই না!’
    --‘তাহলে?’
    তাহলে আর কার? কারই বা হতে পারে? ঐ হারামীর হাতবাক্স মাকড়াটার ছাড়া। পরমোৎসাহে আস্তিন গোটাল পিকুল। একবার হতভাগাকে হাতের কাছে পেলে হয়! মোবাইল যখন আছে তখন সে মাকড়াও আশেপাশেই আছে নির্ঘাৎ।
    --‘টর্চটা একটু জ্বালান তো কাকু। মোবাইলটা কোথায় বাজছে একটু দেখে নিই’।
    টর্চ জ্বলে উঠল। কিন্তু ঠিক তখনই মোবাইলের আওয়াজ থেমে গেছে।
    --‘যাঃ বাবা! থেমে গেল যে...’। বলতে বলতেই ফের বেজে উঠল সেই প্রাণান্তকর রিংটোন! এরকম বিকট রিংটোন আগেও কোথাও শুনেছে পিকুল! কিন্তু কোথায়, সেটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারল না!
    --‘পেয়েছি...এই দ্যাখ্‌’। টর্চের আলো ছাতের এককোণে ফেলে বললেন কাকু—‘ঐ দ্যাখ্‌, মোবাইলটা দেখতে পাচ্ছিস্‌?’
    পিকুল এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা তুলে নিয়েছে। একটা বড় মুষকো কালো রঙের মোবাইল! আলো দপদপিয়ে জ্বলছে নিভছে। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সে অবাক। কিছুক্ষণ কি বলবে ভেবে পেল না। তারপর ঢোঁক গিলে বলল—‘কাকু...এইটা দেখে যান...’।
    --‘কি রে?’ বলতে বলতেই সুবীর কাকু ডিসপ্লেতে চোখ রেখেছেন। ব্যাপারটা দেখে হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না! কি আশ্চর্য! কি অদ্ভুতুড়ে কান্ড! ডিসপ্লেতে দপদপ করে জ্বলছে কলারের নাম—‘সুবীরদা কলিং...!’
    --‘আমি ফোন করছি!’ কাকুর চোখ প্রায় টাকে চড়াৎ করে চড়ে গেছে—‘আমি কি করে...!’
    এই অবধিই বলতে পেরেছিলেন। তার পরেরটুকু বলার আগেই এল অতর্কিতে আক্রমণ! ছাতের একপাশে কতগুলো মাটির খালি টব ছিল। তাদের মধ্যেই একটা ঠাঁই করে লাগল সুবীরকাকুর ঠিক টাক লক্ষ্য করে! ভাগ্যিস্‌ হেলমেটটা পরা ছিল। নয়তো স্রেফ ‘রাম নাম সত্য’ হয়ে যেত!
    ঘটনাটা কি হচ্ছে বোঝার আগেই আরেকখানা টব সাঁই করে ছুটে এল পিকুলের নাক লক্ষ্য করে। সে তিন লাফ মেরে সরে দাঁড়িয়ে কোনমতে বাঁচল। সুবীরকাকুর হাত থেকে টর্চটা মাটিতে পড়ে গেছে। গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুবীরকাকু মাটিতে বসে পড়েছেন। সম্ভবত তখনও হেলমেটের উপরে টবের বাড়ি খাওয়ার শক থেকে বেরোতে পারেননি।
    পিকুল অজান্তেই ছাতের একদম ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ তার সামনে দুটো দপদপে চোখ কোথা থেকে লাফ মেরে এসে দাঁড়াল! কথা নেই বার্তা নেই, খপ্‌ করে টিপে ধরল তার গলা!
    টর্চের সাথে টর্চের আলোটাও মেঝের উপরে সরলরেখায় গড়াগড়ি দিচ্ছিল। সেই আলোয় যা দেখল, তাতে ভয়ে হার্টফেল করতে যাচ্ছিল পিকুল! দুটো বীভৎস রোমশ হাত! এরকম রোমশ হাত সে আগে কোথাও দেখেছে! কোথায় দেখেছে...!
    আর কিছু মনে করার আগেই কোথায় যেন পেল্লায় শব্দ করে বাজি ফাটল! রোমশ হাত দুটো যেন ঘাবড়ে গিয়ে পিকুলকে ছাত থেকে ঠেলে ফেলে দিল!
    পিকুল একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে। কয়েকসেকেন্ডের জন্য তার মনে হল সে বোধহয় আর বেঁচে নেই! একদম দোতলা থেকে সটান নীচে পড়ে তার চ্যাপ্টার ক্লোজড! এক্ষুনি ধাঁই করে আছড়ে পড়বে নীচে! হাড়-পাঁজরা ভেঙে খানখান হবে! বাবাকে আর কেউ পায়রা এনে দেবে না! আর কেউ প্যাকেট থেকে সিগ্রেট ঝেড়ে দেবে না! মায়ের সন্দেহের লিস্ট থেকে একটা নাম কমবে! লাট খেতে খেতে নীচের দিকে পড়তে পড়তে তার মনে হল, দেহের ওজন ক্রমশই কমছে। নীচে পড়লেই প্রাণপাখি ফুড়ুৎ! ভয়ের চোটে চোখ বুঁজে ফেলেছিল সে!
    কিন্তু কেসটা কি হল! পড়তে এত সময় লাগছে কেন? নাকি কখন পড়ল টেরই পায়নি? অ্যাঁ, মরা এত সহজ! কই, ব্যথা ট্যথা তো কিছুই মালুম হল না!
    --‘ অ্যাই গর্দভ! চোখ বুঁজে আছিস কেন?’
    এ কার গলা! যমরাজের! কিন্তু যমরাজের গলা এত কোমল! নাকি রাবণের মত তারও কিছু পোষা চেড়ি-টেড়ি আছে!
    ভয়ে ভয়ে একখানা চোখ খুলল পিকুল! সামনে...চেড়ি নয়, চেরিব্লসম! দেবী! তার ঘরের জানলাটা খোলা!যখন উপর থেকে নীচের দিকে পড়ছিল সে তখন বোধহয় চিৎকার শুনে জানলার সামনে চলে এসেছিল। তাকে পড়তে দেখে প্রাণপণে হাত টেনে ধরেছে! ফলস্বরূপ নীচে আছড়ে পড়েনি পিকুল, দেবীর জানলার সামনে ঝুলছে!
    পায়ের দিকে তাকিয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল! পড়লে একদম সোজা পড়বে সুবীরকাকুর যমদূতের মত টাটা সুমোটার উপরে। দেবী যদি একটু আলগা দেয়...!
    --‘দেবী!’ সে প্রাণপণে কাতর অনুরোধ করে—‘কাকুর মাথায় বলটা আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি। তুই রিভেঞ্জ নিতে চাইলে আমার মাথায় একটা আস্ত কাঁচের গ্লোব ছুঁড়ে মারিস্‌, কিন্তু হাতটা ছাড়িস্‌ না!’
    দেবীর চোখে রাগ ঘন হয়ে আসে—‘একে বলে জন্মের মর্কট! ছাড়বো বলে হাত ধরেছি না কি!’
    যদিও ঝুলন্ত অবস্থায় প্রেম জিনিসটা ঠিক তেমন আসে না। তবু দেবীর কথা বড় মিষ্টি ঠেকল তার কানে!

    ফোঁচ ফোঁচ করতে করতে পিকুলের কাটা ঘায়ের শুশ্রুষা করছিল দেবী। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পা অনেকটা কেটে গেছে। হাতের চামড়াও জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। উপর থেকে পড়ার সময় মাথার একপাশে গুঁতো লেগেছিল। এখন সেই জায়গায় একটা ছোট্ট আলু হয়েছে। কালসিটেও পড়েছে।
    --‘আউচ...আউচ...’। দেবীর হাতের তুলোয় ডেটল। কাটা জায়গায় লাগতেই চিড়বিড় করে উঠেছে। কাতর গলায় বলল পিকুল—‘দেবী, এভাবে রিভেঞ্জ নেওয়ার চেয়ে তুই বরং আমাকে ফেলেই দিতি। রামজ্বলছে মাইরি’।
    দেবী ঝাঁঝিয়ে ওঠে—‘চুপ কর্‌ মর্কট! ‘অসভ্য চোখকে’ তাড়া করার সময় মনে ছিল না? তখন তো খুব খাঞ্জা খাঁ বনেছিলি! এখন বুঝি পরতায় পোষাচ্ছে না! হাত না ধরলে এতক্ষণে কোথায় থাকতি! ভালোই হত। তোর প্যাঁকপ্যাঁক আমায় শুনতে হত না!’ বলতে বলতেই ফের ফোঁচফোঁচ!
    পিকুল ভয়ে ভয়ে দেবীর দিকে তাকায়। ওর মুড বোঝাই দায়! কখনও ফোঁসফোঁস করছে, কখনও ফোঁচফোঁচ!
    --‘কি হল? অমন জুলজুল করে কি দেখছিস?’ সে আবার কান্না থামিয়ে খিঁচিয়ে ওঠে—‘আজ কিছু একটা হয়ে গেলে কি হত? কে বলেছিল এত বীরত্ব দেখাতে? তোর কিছু হয়ে গেলে কাকিমার কি হত? কাকুর কি হত? আমার...?’
    কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই চুপ করে গেল দেবী। তার ফর্সা মুখ, নাক লাল হয়ে উঠেছে। পিকুল আড়চোখে তার মুখের দিকে তাকায়। ডায়লগটা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে না?
    --‘তোর আবার কি হত?’ পিকুল নির্বিকারে বলে—‘তুই তো ড্যাং ড্যাং করে পল্টুর হাত ধরে ঘুরে বেড়াতি!’
    --‘হ্যাং ইওর পল্টু’! রাগে দেবীর মুখে ঘাম জমেছে। সে চড়া গলায় বলে—‘ ছোটবেলা থেকে পল্টু কি আমার সাথে খেলা করেছে? আমার জিততে ভালো লাগত, বলে ইচ্ছে করে কে হেরে যেত? যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, তখন দুবেলা এসে পাশে বসে থাকত কে? বাড়ি থেকে কুলচুর চুরি করে রোজ কি পল্টু আমাকে খাওয়াতো? আমার হোমওয়ার্ক করে দেওয়ার জন্য নিজের হোমওয়ার্ক না করে বেত কে খেয়েছিল? ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে সরস্বতী পুজোর দিন আমার হাত ধরে কে বলেছিল—‘দেবী, তুই খুব সুন্দর!’ পল্টু কি বলেছিল আমি হাসলে প্রীতি জিন্টার মত টোল পড়ে?’ এবার অভিযোগের সাথে কান্না মিশল—‘চিরদিন শুনে এসেছি আমি মোটা, হাতির মত, গন্ডারের মত। আমার চশমাটা দিদিমনির মত! আমার কম খাওয়া উচিৎ। তুই বোঝালি যে আমি যেমনই হই, তেমনই সুন্দর! আমি আমার মত করেই সুন্দর। লোকের চোখে সুন্দর হওয়ার জন্য মুখে এনামেল করে মোমপালিশ হওয়ার দরকার নেই! তুই-ই বলেছিলি পিকুল—এর একটাও পল্টু বলেনি! আর আজ তুই আমাকে পল্টু দেখাচ্ছিস?’
    পিকুল হাঁ! দেবীর সব মনে আছে! এতক্ষণ ডেটলের জ্বালায়ও তার চোখে জল আসেনি। এবার তার চোখ ভিজে এল—‘তোর সব মনে আছে? তুই সব মনে রেখেছিস দেবী! তবে পল্টু...?’
    --‘ওকে কি আমি নিজের শখে সাথে নিয়ে ঘুরছি?’ দেবী আরও হিংস্র—‘তুই একটা গাম্বাট! তাই ওকে দিয়ে তোকে জেলাস ফিল করাচ্ছিলাম! যদি হিংসের জ্বালায় আসল কথাটা তোর মুখে ফোটে, এই আশায় ঐ মাথামোটাটাকে নিয়ে ঘুরছিলাম’।
    --‘দেবী...দেবী...’। তার হাতদুটো নিজের বুকে চেপে ধরল পিকুল—‘ তুই আমার উপর রাগ করিস না! আসলে আমি তোকে খুব ভয় পাই। কাকুর মাথায় জল ঢালার ইচ্ছে আমার একদম ছিল না, বিশ্বাস কর্‌। আর বলটা অ্যাক্সিডেন্টালি...আমি আর কখনও ক্রিকেট খেলবো না। বিশ্বাস কর্‌। ব্যাটে হাতই দেবো না! আর কখনও তোকে কমপ্লেন করার স্কোপ দেব না। প্লিজ তুই একবার বল্‌, আমায় ক্ষমা করেছিস্‌’।
    --‘দাঁড়া’। দেবী উঠে গিয়ে তাক থেকে কি যেন একটা নামিয়ে আনল। জিনিসটা দেখে পিকুল হতবাক! এ তো সেই ব্যাটটা! যেটা দিয়ে ছক্কা মেরে সুবীরকাকুর টাক ফাটিয়েছে সে! ব্যাটটা তো সেদিনই বাইরে ফেলে দিয়েছিল! দেবীর কাছে এল কি করে!
    --‘ক্ষমা তো তোকে করাই উচিৎ নয়!’ দেবী রাগতস্বরে বলে—‘একে তো বাবার মাথা ফাটিয়েছিস্‌, তার উপর ব্যাটটা বাইরে ফেলে দিয়েছিস্‌। আমি চুপিচুপি সময়মতো কুড়িয়ে এনেছিলাম বলে এটা এখনও ঠিকঠাক আছে। তোর এতবড় সাহস হয় কি করে? এই ব্যাট নবগ্রাম প্লেটোনিক ক্লাবকে জিতিয়েছে। হাউ ডেয়ার ইউ! নিজের এতদিনের সাথীকে যদি ফেলে দিতে পারিস্‌, তবে আমাকেও ফেলে দিবি না তার গ্যারান্টি কি?’
    কি বলল দেবী! কি বলল! পিকুল এবার দেবীর কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ওঠে। আজ বড় সুখে কান্না পেয়ে গেছে তার!

    ১৬.

    লাটুরও আজকাল কথায় কথায় চোখে জল এসে পড়ে। এ যে কি জাতীয় রোগ বুঝে উঠতে পারে না সে। যেদিন থেকে ঐ কপালপোড়াটার সাথে দেখা হয়েছে, সেদিন থেকেই নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত বদল বুঝতে পারছে। এখন বিজনেসের কাজে মন লাগে না তার। হফতা তোলা, অপোনেন্ট গ্যাঙের হুমকি, কিছুই যেন স্পর্শ করে না তাকে। শুধু কে যেন হাওয়ায় হাওয়ায়, ঘড়ির কাঁটার শব্দে, জলের টুপটাপে একনাগাড়ে বলে যায়—‘তুমি যেই হও, ... যেমনই হও। আমি তোমাকে ভালোবাসি...ভালোবাসি...ভালোবাসি...!’
    ‘ভালোবাসা’ শব্দটা বহুবার শুনেছে সে। রোম্যান্টিক ফিল্মে দেখেছে, নায়ক নায়িকাকে একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে, তাকে খুব করে বার খাইয়ে, হাওয়া টাওয়া দিয়ে ‘ভালোবাসি’ বলে। আর এ মাকড়াটা তো তাকে ঠিকমত দেখেওনি। লাটুও দেখেনি তাকে। তবে কি করে অত সহজে বলে দিল—‘তোমাকে ভালোবাসি!’ কি অনায়াসে উচ্চারণ করল শব্দগুলো! আর সেই লোকটার জন্যই বা লাটুর মন কেমন করে কেন? যখন ও কাঁদে, তখন লাটুরও কান্না পায়! যখন বলে—‘তুমি একদম আমার মায়ের মতন’, তখন অদ্ভুত একটা আনন্দ ছুঁয়ে যায় তাকে। কেন? কই, লাটু তো কখনও এমন ছিল না! এমন অনুভূতিপ্রবণ তো সে কখনই নয়! তবে এই মানুষটা তাকে আকুল করে তুলল কেন?
    এই ঘটনার কথা সে কাউকে জানায় নি। এমনকি মাকে ও নয়। মা আজকাল তার নয়া ফ্রেন্ডের সাথে খুব অ্যাপো করে বেড়াচ্ছে। কে জানে লাভ-শাভ, ইন্টু-পিন্টু করছে কি না! করলেও লাটুর আপত্তি নেই। সারাজীবন তো একা থেকেই গেল মা। লাটুর জন্য সবসময়ই ভেবে গেল। এখন শেষ সময়ে যদি কারুর সঙ্গ পায়, তবে ক্ষতি কি?
    তবু একবার মাকে আমতা আমতা করে বলেছিল—‘মা, এসব ভালোবাসা-টালোবাসা কি চিজ বল তো? লভ করলেই কি মানুষ ধেই ধেই করে ডান্স মারে! কিম্বা ঢলাঢলি করে বেড়ায়?’
    --‘ধুর্‌ বাল্‌’। মা সস্নেহ হাসে—‘ওসব ফিলিমে হয়। লাইফে হয়না’।
    --‘তবে কি হয়? কি করে পাব্লিক বোঝে যে ঐ পেম নামের ঘোঁটালাটা হয়ে গেছে? তুমি কি করে বুঝেছিলে?’
    --‘তাবলি কাঁহিকা!’ মা একটু কি যেন মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—‘আমার কি পেম করার কপাল? তোর বাপের আগে রোজ রাতে একটা করে মরদের সাথে শুয়েছি! পেম ফেম কিস্যু ছিল না বুঝলি?-বক্‌ওয়াস্‌! মেয়েছেলের মাংসের খরিদ্দারের সাথে ধান্দা চলে, পেম না! তারপর তোর বাপটা ছিল ডবডবে জোয়ান। একরাতে আমার ঘরে এল। মাকড়াটার আমাকে ভালো লেগে গেল। ব্যস্‌, গায়ের জোরে তুলে নিয়ে গেল। তারও পেম ছিল না। আমি বেওয়ারিশ ছিলাম। ঐ হারামী আমার বাঁধা বাবু হল। খেতে দিল, পরতে দিল, বিছানায় নিয়ে রঙ্গরালিয়াঁ করল, তার বাচ্চার মা বানাল। কিন্তু পেম...?’
    তার বুক ভেঙে হতাশার নিঃশ্বাস পড়ল—‘একেও পেম বলে না! পেম-লভ কাকে বলে তা আমি জানি না! তোর মত আমিও লাইফে ঐ চিজটা দেখিনি। তাই তো ভাবি, আমি যা পাইনি—সব তোর নসিবে জুটুক। সিঁদুর, পেম, মনের মত মরদ—সব’।
    লাটু অবাক হয়েছিল—‘বাবার সাথে তোমার তবে ভালোবাসা ছিল না মা?’
    --‘না রে। ভালোবাসার এখানে কোনও সিন নেই। লভ হবার জন্য যতটুকু পহচান দরকার, তোর বাপের সাথে সেটুকু পহচান ছিল না আমার। আমার কাছে তার কি জরুরত জানতাম। কিন্তু, মালটা কখনও আমার জরুরতের পরোয়াই করেনি! কেয়ারই করেনি। একটা মেয়েছেলেকে ঘরে রেখেছে, খেতে পরতে দিচ্ছে—যেন বাঁধা মাগী পুষছে। যেমন লোকে কুতিয়া পোষে। এর মধ্যে লভ কোথায় বল্‌? এও তো একরকম ধান্দা!’
    সে বিস্মিত হয়ে মায়ের কথা শোনে। বলে কি মা! তাহলে ভালোবাসাটা আসলে কি? একটা পুরুষের সাথে নারীর জৈবিক সম্পর্ক মাত্র? না তার থেকেও বেশি কিছু! এই যে মদ্দাটা মাগীদের মত ভেউ ভেউ করে কাঁদে, নরম সরম কাতর একটা পাব্লিক—তাকে তো চোখেও দেখেনি লাটু। তাহলে জৈবিক সম্পর্কের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? তাহলে জৈবিক সম্পর্কের বাইরে সে যা অনুভব করছে—তাকে কি বলে?
    অনেক ভেবেও এ প্রশ্নের কোনও উত্তর পায়নি। চিরকুটটা সেদিন দিব্যি বলে বসে থাকল—‘ভালোবাসি’। আর সে কথা টুকু শুনেই কেমন যেন হেজে গেল সে! ব্যোম্‌কে গেল। লোকে বলে, ব্যাটাছেলের মত মেয়েদের কেউ ভালোবাসে না। কিন্তু মাকড়াটা তাকে কেমন করে ভালোবেসে ফেলল? তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মোমপালিশ, মধুবালা মার্কা স্মাইল বা ক্যাটওয়াক—কিছুরই প্রয়োজন হয়নি! তবু সে ভালোবাসল! সে রাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল সে—‘হয়তো আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য নই। কিন্তু, আমায় যোগ্য হওয়ার সুযোগ দাও। সিন্ডারেলা, তোমায় আমি সব সুখ হয়তো দিতে পারবো না। তবু তোমায় ভীষণ ভালোবাসব। তুমি যা বলবে, মেনে নেবো। একটু কষ্টও দেবো না। সিন্ডারেলা, তুমি আমার হবে? সবাইকে হারাতে পারি, তোমাকে হারাতে পারবো না সিন্ডারেলা!’
    উত্তর দিতে পারেনি লাটু। কান্নায় তার কন্ঠস্বর বুঁজে এসেছিল। লোকটা একেবারে হাবাগোবা! বড় ভালো মানুষ! সে জানেও না কাকে প্রপোজ করছে। যাকে ভদ্রঘরের মেয়ে ভাবছে, সে আসলে এক মাস্তান আর এক বেশ্যার অবৈধ সন্তান! অল্পবয়েসেই খুন করে বর্তমানে লাটু মস্তান নামে নবগ্রাম কাঁপাচ্ছে! জানতে পারলে কি আর ভালোবাসত! ভালোবাসত না। বরং ঘেন্না করত!
    জীবনে কখনও গুন্ডাজন্মের প্রতি আফসোস করেনি লাটু। সেই প্রথম তার ভীষণ রাগ হয়েছিল উপরওয়ালার প্রতি। কেন?...কেন এভাবে তার লাইফটাকেই ঘেঁটে ‘ঘ’ করার তাল মালটার! লাটু কি একটা ভদ্রঘরে জন্ম নিতে পারত না? কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে একটা ভালো ভদ্র লাইফ লিড করতে পারত না! কি দরকার ছিল এই খুনোখুনি, গুন্ডাগর্দির মধ্যে তাকে পয়দা করার! যদি গুন্ডাগিরিই করার ছিল তবে লাইফে এ আবার কিরকম ট্যুইস্ট? এতদিন তো দিব্যি সুখেই ছিল লাটু। একে মেরে, তাকে ধরে, ভয় দেখিয়ে, ব্যবসা চালিয়ে মাল্লু তুলছিল। যদি এমন জীবনই তার জন্য বেছে ছিলে ঈশ্বর, তবে এই ন্যালাক্ষ্যাপা লোকটার আসার কি দরকার ছিল? কি দরকার ছিল ‘ভালোবাসি’ বলার? এখন লাটু কি করে? তার যে খালি কান্না পায়! ঐ ভালো মানুষটার জীবন নষ্ট করতে পারে না সে। বৌ যদি মস্তান হয়, তবে সমাজ কি ওর মত ভীরু, অসহায় মানুষের মুখে থুতু ছেটাবে না? ওকে ভুলতেও পারে না। ওর জীবনে যাওয়ার উপায়ও নেই। অথচ ওর কথা মন থেকে মুছে ফেলতেও পারে না লাটু। শুধু অমোঘ মন্ত্রের মত মনে পড়ে—‘ভালোবাসি...তোমাকে ভালোবাসি...’।
    সেরাতে তার বুকে মুখ গুঁজে বলেছিল লোকটা—‘তোমায় এখনই জবাব দিতে বলছি না। যদি আমার কথায় বিশ্বাস রাখতে পারো, যদি বিশ্বাস করো আমাকে, তোমার যদি সম্মতি থাকে, তবে বুধবার রাত দশটায় স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়িও। জোর করছি না। তোমার ইচ্ছের মর্যাদা আমার কাছে আছে। যদি আসতে হয়, নিজের ইচ্ছেতেই এসো। আমি তোমার জুতোজোড়া নিয়ে অপেক্ষা করব। তুমি আমার উইন্ডচিটারটা নিয়ে এসো। তাহলেই দুজনেই দুজনকে চিনতে পারবো’।
    ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল লাটু। আজই বুধবার। এখন সাড়ে ন’টা বাজে। তার কি যাওয়া উচিৎ? না গেলে হয়তো লোকটা অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে ফিরে যাবে। অথচ ওকে যে ফেরাতে ইচ্ছে করে না লাটুর। মানুষটা বড় ভালো, বড় অসহায়। ওর হাত ধরে নতুন একটা জীবন শুরু করার লোভ তার মনের মধ্যে কখন যেন অঙ্কুরিত হয়ে গেছে। সে লোভ বড় অমোঘ! তার মূলোচ্ছেদ নিজের হাতে কি করে করবে লাটু! অথচ ওদের দুজনের মিলন কখনই সম্ভব নয়—তা লাটুর চেয়ে ভালো আর কে জানে! যে চোখে ভালোবাসা খেলে বেড়াচ্ছে, সে চোখে নিজের জন্য কুৎসিত ঘেন্না কি করে দেখে!
    তার চোখ বেয়ে টপ্‌টপ্‌ করে জল গড়িয়ে পড়ে। মনে হল, তার কেউ নেই! মনে হল, ভগবান—এ জন্ম আমাকে কেন দিলে? এ যন্ত্রনার চেয়ে তো মৃত্যুও ভালো!
    নিজের যন্ত্রণার মধ্যেই ডুবে ছিল সে। হঠাৎ একটা জোরালো শব্দে সচকিত হয়ে উঠল। জন্মাবধি এই কানফাটানো শব্দ শুনে আসছে লাটু। আজন্মপরিচিত শব্দটাকে চিনতে ভুল করেনি। বম্বিং হচ্ছে! এবং তাও খুব কাছেই! তার এরিয়ার মধ্যেই! কার এতবড় দুঃসাহস, তার এরিয়ার মধ্যে এসে বোম ফেলে!
    সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে। ঘোঁটালাটা কি? দেখতে হচ্ছে।
    তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল লাটু। মা ও আওয়াজটা শুনতে পেয়েছেন। ত্রস্তব্যস্ত হয়ে এসে বললেন—‘কি মাজরা রে লাটু? বোম পড়ছে কেন বে?’
    --‘জানি না মা’। তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আশঙ্কা কাজ করছিল। কয়েকদিন আগেই তার অপোনেন্ট গ্যাঙের সর্দার দোদো হুমকি চিঠি পাঠিয়েছিল যে খুব তাড়াতাড়িই লাটু আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা খতম হতে চলেছে। উত্তরে নিজের মাথার একটা চুল ছিঁড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল লাটু। দোদো আর লাটুর মধ্যে প্রায়ই গোলমাল লেগে থাকে! লাটু মেয়ে বলে দোদো তাকে পাত্তাই দিতে চায় না। অথচ মুখোমুখি গ্যাং ওয়ারে সে যে কতবার হেরে ভূত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই!
    নবগ্রাম আর নতুন পল্লীর মাঝখানে একটা ছোট্ট অংশ আছে। লোকে সেটার নাম রেখেছে—‘সোনার গাঁ’। সেটার দখল নিয়েই দুই পক্ষের মারপিট। কারণ সোনার গাঁয়ে বেশিরভাগ দোকানই জুয়েলারির। এছাড়া, জায়গাটায় নতুন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনও হচ্ছে। ফ্ল্যাট কালচার যাকে বলে আর কি! লাটুর মত মস্তানদের কাছে প্রায় সোনার খনি। তার দলবল হফতা হিসাবে একটা মোটা টাকা তোলে। এছাড়া প্রোমোটারদের কাছ থেকেও প্রচুর আমদানি হয়। এগুলো একধরণের সওদাও বটে। লাটু মস্তানকে খুশি রাখলে কোনরকম বিপদ-আপদের সম্ভাবনা নেই। ঘটনাটা বাস্তবে অনেকটা তাই। আজ পর্যন্ত সোনার গাঁয়ে কোনওরকম চুরি-চামারি, লুটপাট হয়নি। লাটুর আশ্রয়ে সোনার গাঁ নিরাপদ।
    কিন্তু সেটা সহ্য হচ্ছে না দোদোর। লাটু মেয়ে হয়ে এত উন্নতি করবে কেন? এত দবদবা কেন তার? অনেকবার লাটুর কাজে বাগড়া দিতে চেয়েছে সে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। এখন সোনার গাঁ নিয়ে দুজনের ইগোর লড়াই চলছে। অনেকটা আমারিকা ভার্সাস ইরাকের মত। লাটুকে অনেকবার হুমকি দিয়েছে সে—‘মাগী হয়ে এত তেজ ভালো নয় লাটু’।
    লাটু মুচকি হেসেছে। সে দোদোর সোনার চেইনে ঝুলে থাকা লকেটে মা কালীর ছবির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছে—‘ওঁকে এই ডায়লগটা মেরেছিস কখনও? কালীপুজোর সময় তো দেখি একটা তেজি মাগীর পায়ে পড়েই পাঁঠার মত ম্যা ম্যা করিস্‌। তখন তোর এই শানপাত্তি কোথায় থাকে বাড়া?’
    --‘জাদা হুলপট্টি নয় লাটু!’
    দোদো ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে—‘নয়তো এখান থেকেই তোর মাইয়ত শুরু হবে’।
    --‘ফোঁস ফোঁস যত খুশি কর্‌’। লাটু তার গালে আলতো করে একটা ঠোনা মেরে বলে—‘ঢ্যাম্‌না সাপের ফোঁসফোঁসানি যদি না থাকে, তবে কি আর থাকল!’
    দোদো সেদিন রাগে জ্বলে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। সে হয়তো ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছিল বড় কোনও আঘাত দেওয়ার জন্য।
    আরেকখানা বোম পড়ার শব্দ। মা অসহায়ের মত লাটুর দিকে তাকালেন—‘ লাটু...কিছু লোচা হচ্ছে...আজ সোনার গাঁয়ে যাওয়ার কথা ছিল না?’
    --‘সে তো কাবুল, পচারা...!’ বলতে বলতেই সে থেমে গেল। নিশ্চুপ হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কাবুল-সোনাদের দেখতে পেয়েছে সে। তারা দৌড়তে দৌড়তে এদিকেই আসছে।
    --‘ভাই...ভাই...’।
    কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই তাদের পরিষ্কার দেখা গেল। প্রাণপণে দৌড়তে দৌড়তে এসে ঢুকল লাটুর দলবল। সোনার মাথা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। কাবুলের হাত জখম, ঘাড় বেয়ে জমাট রক্তের ধারা! তবু তারা ঠিকঠাক আছে। কিন্তু কাবুলের পিঠে পচা নিষ্পন্দ!
    লাটু শুধু নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পচা! পচা নড়ছে না কেন?
    --‘পচার কন্ডিশন ডেঞ্জার ভাই’। কাবুল কোনমতে বলল—‘একের পর এক বোমা ছুঁড়ছিল ওরা। দোদো দলে ভারি ছিল। সোনা একা পড়ে গিয়েছিল। দোদো ওকে মেরেই ফেলত। কিন্তু পচা গিয়ে দোদোর কাঁধে ভোজালি বসিয়ে সোনাকে বাঁচাল। ওরা টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েই আসছিল, কিন্তু একটা বোমা...’। বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল সে।
    কাবুলের পিঠ থেকে পচাকে ততক্ষণে নামিয়ে নিয়েছেন মা। তার সর্বাঙ্গ পুড়ে গেছে! মুখের একদিকটার বীভৎস অবস্থা! একটা হাত উড়ে গেছে...! সম্ভবত বোমার ধাক্কাতেই হাতটা গেছে! তবে সে তখনও বেঁচে আছে। বুক ওঠানামা করছে।
    --‘লাটু...অ্যাম্বুলেন্স ডাক্‌’। পাগলের মত চেঁচিয়ে উঠলেন মা। দুহাতে পচার মুখ ধরে উন্মত্তের মত কাঁদতে কাঁদতে ডাকছেন—‘পচা...পচা রে...!
    অতিকষ্টে চোখ মেলল পচা। তার মুখটা একটু বেঁকল—‘ভাই, কেঁদো না। এখনও ফৌত হইনি’।
    --‘ফৌত হবে তোর দুশমন’! মা বললেন—‘তুই ডুম হলে আমাকে ইঞ্জিরি শেখাবে কে? জুতোর বাড়িই বা কে খাবে? তোকে শ্লা, টপকাতে দিচ্ছি না। এখনই হাসপাতালে...’।
    --‘ভাই...’। খুব কষ্ট করে টেনে টেনে বলল পচা—‘কোথাও যাবো না। তোমার কোলে মাথা রাখতে দেবে?’
    মা তার মাথাটা কোলে টেনে নিলেন। পচা কোলে মুখ গুঁজে যেন ভীষণ শান্তি পেল। ফের তার চোখ বুঁজে আসে...।
    --‘পচা, শ্লা, তুই চোখ বুঁজবি না!’ মায়ের বুকফেটে কান্না বেরিয়ে আসে—‘শুয়োরের বাচ্চা! তোকে আমি বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি—আমার হুকুম—আমার অডর—তুই চোখ বুঁজবি না’।
    পচা অসম্ভব কষ্টে চোখ খুলে ফের হাসার চেষ্টা করে—‘ব-ড়-ভা-ই...’।
    তিনি প্রবল কান্নাকে বুকে চেপে বলেন—‘বল্‌’।
    --‘অডর্‌ মানে বদবু। ওটা অর্ডার হবে’।
    --‘শ্লা—হারামীর হাতবাক্স, কুত্তার দুম...দেব এক...’। বলতে বলতেই স্থির হয়ে গেলেন মা। এ কি! পচার মাথাটা এমন ঝুলে পড়ল কেন? তিনি বড়বড় চোখ করে লাটুর দিকে তাকালেন। লাটু পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে...? তার মানে...!
    গোটা ব্যাপারটা বুঝতে তার সময় লাগল। যখন বুঝলেন, তখন তার চোখ দিয়ে জল পড়ল না! নাক দিয়ে টপটপ করে কাঁচা রক্তের ধারা পড়তে লাগল পচার ঠোঁট ছুঁয়ে। একদিন এই রক্তই দুধ হয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল। মৃত্যুর পরও সেই রক্ত তার সঙ্গ ছাড়ল না।
    আস্তে আস্তে অবশ হয়ে যাচ্ছিলেন লাটুর মা! বুকে একটা তীব্র যন্ত্রণা...! তার মধ্যেই কোনমতে বললেন—‘যা শ্লা! পালিয়ে গেলি! আমিও কয়েকদিন পরে আসছি। তখনই জুতোপেটা করবো। জাহান্নমে দেখা হবে...’।

    লাটু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছিল।
    মায়ের অবস্থা সিরিয়াস। তাকে আর পচাকে নিয়ে লাটুর দলবল নার্সিংহোমে দৌড়েছে। আপাতত বাড়িতে লাটু একাই। যা করার তাকেই করতে হবে। দোদোর সঙ্গে তার বোঝাপড়া করার আছে। পচার মৃত্যু ব্যর্থ যাবে না! ওর মৃত্যুর শোধ দিতেই হবে। হয় লাটু নিজের জান দিয়ে ওর হিসাব চুকিয়ে দেবে। নয়তো দোদোর জান নিয়ে...!
    এই হারামীর দুনিয়ায় ক্ষমা বলে কিছু হয় না! জানের বদলে জান, খুনের বদলা খুন। এই আপ্তবাক্যের উপরেই এই দুনিয়া টিঁকে আছে।
    কালো লেদার জ্যাকেটে, কালো চাপা ট্রাউজারে লাটুকে মৃত্যুরই আরেকনাম বলে মনে হচ্ছিল। সরু কোমরে স্টিলের বেল্টটা ঝকমক করছে। মৃত্যুর অনেকগুলো হুলিয়া আছে। সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর হুলিয়া এটাই। যতটা সুন্দর, ততটাই খতরনাক! তার চোখে শুধু জিঘাংসা ঝলসাচ্ছে! উদ্যত হাতদুটো পারলে এখনই দোদোর গর্দন টিপে ধরে! মসৃণ হিলহিলে কালসাপের মত শরীরে বিদ্যুৎ তুলতে তুলতে এগিয়ে গেল লাটু! তার কোমরে পয়েন্ট চুয়াল্লিশ রাশিয়ান রিভলভার উদ্যত ফণা গুটিয়ে বসে আছে। দোদোকে সামনে পেলেই ছোবল বসিয়ে দেবে! বুকে নয়, পিঠে নয়! একেবারে দুই ভুরুর মাঝে! সোজা ভেজায়!
    বাইকে ওঠার আগে হেলমেট পরতে গিয়েই ফের নজর পড়ল উইন্ডচিটারটার দিকে! বুকের মধ্যে একটা পিন ফোঁটার মত ব্যথা! মাকড়াটা আজ হয়তো অনেক আশা নিয়ে আসবে। দাঁড়িয়েও থাকবে! কিন্তু কার জন্য? সেই মেয়েটার জন্য, যে চিরকালই বদনাম! কোন মেয়েটাকে ভালোবাসে সে? সমাজের চোখে যে ঘৃণিত? দশবছর বয়েসে যে খুন করে লতিকা থেকে লাটু মস্তান হল, আজ আবার আরেকটা খুন করতে যাচ্ছে, বা খুন হতে যাচ্ছে! তাকে কি ভালোবাসা যায়?
    লাটু একমুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবল। তারপর উইন্ডচিটারটা তুলে নিল হাতে। নাঃ, মালটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তার লাইফে আর কতটুকু বাকি আছে কে জানে! হয়তো আজই দোদোর হাতে নিকেশ হয়ে যাবে। ওকে আজ এই চূড়ান্ত মুহূর্তে সব কথা খুলে বলবে। সব কথা খুলে বলা দরকার। ওর জানা দরকার, ও কাকে ভালোবাসে।
    উইন্ডচিটার আর সোনার গাঁ থেকে আনা টাকার ব্যাগটা নিয়ে বাইকে উঠল লাটু। সজোরে গর্জন করে উঠল তার বাইক!

    ১৭.

    বিশু তখন একজোড়া জুতো নিয়ে রেলস্টেশনের সামনে অপেক্ষারত। এর মধ্যে সে পিকুলের কাছ থেকে প্রেম সম্পর্কে অনেক জ্ঞান তথা ফান্ডা নিয়ে নিয়েছে। পিকুল এখন সফল প্রেমিক। তাই তার কাছ থেকে একটু টিপ্‌স্‌ তো নিতেই পারে বিশু। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই তার নিরেট খোপরিতে ঢুকছে না! প্রেমের নিদর্শন হিসাবে অনেকেই অনেক কিছু দেয়। বিশুর পূর্বপ্রেমিকারা কেউ নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে দিয়েছে, কেউ গিফট্‌ দিয়েছে, কেউ বা নিজের অন্তর্বাস দিয়েছে। এছাড়াও হিস্টোরিক্যাল রেফারেন্স বলছে, তাম্বুল, মানে পান, ফুল-টুল দেওয়ারও রেওয়াজ ছিল।
    কিন্তু জুতো! প্রেমের নিদর্শন হিসাবে জুতো দেওয়ার কথা কখনও কেউ শুনেছ? জুতো কি প্রেমের প্রতীক? একমাত্র সিন্ডারেলা ছাড়া আর কারুর ক্ষেত্রে জুতোর রেফারেন্স পায়নি সে! কিন্তু তাও ঠিক অতটা রোম্যান্টিক নয়!
    শুনে পিকুল বলেছে—‘ ধুত্তোর বিশুদা! তোমার লাভস্টোরিটাই তো বিলকুল মগজমারিওয়ালা! ছেলের সাথে প্রেম করছ না মেয়ের সাথে তাও জানো না! দশ নম্বরের জুতোর মালকিন কোনও মেয়ে হয় কি না, ধারণা নেই! মালটাকে ঠিকমত দেখোও নি। সে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষায় কোনও মেয়ে কথা বলে ব’লে আজ পর্যন্ত শুনিনি। তার উপর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা, যখন তোমার পা মচকে গেল, তখন সে তোমায় কোলে করে নিয়ে এসেছিল! যা যা একজন পুরুষের করার কথা, তার সবই তোমার সিন্ডারেলা করছে! মামু, গোটা কেসটাই গড়বড়ে! তুমি সেসব নিয়ে চিন্তা না করে জুতো হাতে বসে আছ!’
    --‘পুরুষ কি মেয়ে জানি না!’ বিশু কনফিডেন্ট—‘এমনকি অ্যালিয়েন হলেও আমার কোনও আপত্তি নেই! আমি ওকেই বিয়ে করবো’।
    --‘তাহলে আর কি? এগিয়ে যাও’।
    পিকুল আর কথা বাড়ায়নি। বরং বিশুকে আজ সে নিজেই সাজিয়ে গুজিয়ে পাঠিয়েছে। নতুন সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরে তাকে একদম নতুন বর লাগছে। তার উপর ফ্যাঁচর ফ্যাঁচর করে একগাদা পারফিউম ছিটিয়েছে পিকুল। এমনভাবে পারফিউম দিচ্ছিল যেন গোটা শিশিটাই তার উপরে ঢালবে। তার কান্ডকীর্তি দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছিল বিশু। জীবনে কোনও মেয়ের সাথে দেখা করতে এত টেনশন হয়নি তার! বারবার ভাবছে—সিন্ডারেলা কি পরে আসবে? শাড়ি না অন্যকিছু? আদৌ আসবে তো? তাকে দেখে কি লজ্জা পাবে? নাঃ, অমন লজ্জাবতী লতা সে নয়। লজ্জা পেলেই বরং আশ্চর্য হবে। যেটুকু সময় তাকে দেখেছে, তাতে মনে হয় টিপিক্যাল মেয়েলি সেন্টিমেন্টগুলো ওর নেই!
    তাছাড়া সিন্ডারেলা যা বলে সব সত্যি হয়! পরদিন যখন সে আবার শান্তনুদাদের বাড়িতে হুক্‌স্‌কে পড়াতে গিয়েছিল, তখন সত্যিই গ্রে হাউন্ডটা ও বাড়িতে ছিল না! কারা যেন তাকে গভীর রাতে চুপিসাড়ে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে! শান্তনুদার বৌ খুব কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু বিশু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। মনে হয়েছিল, ঈশ্বর এতদিনে তার মুখের দিকে তাকিয়েছেন।
    বেশি টেনশন হলে, বেশি বেশি জলতেষ্টা পায়। আর বেশি বেশি জল খেলে বেশি হিসি পাওয়াই স্বাভাবিক! ঠিক যখন বেরোতে যাচ্ছে, দশটা বাজতে দশ মিনিটে একেবারে ব্লাডার ঝেঁপে হিসি এল। সে বেরোতে গিয়েই অ্যাবাউট টার্ন মেরে সোজা ঢুকে গেল টয়লেটে!
    পিকুল অধৈর্য হয়ে হাঁক পাড়ল—‘আরে গুরু! ফের টয়লেটে! আবার মাইনাস! কি শুরু করেছ মামা! এই তো গেলে!’
    বাথরুম থেকে আওয়াজ আসে—‘কি করব। পেল যে!’ বলতে বলতেই গান শুরু হল—‘ভরা থাক্‌ ভরা থাক্‌ স্মৃতিসুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি...’।
    --‘তোমার কিছু হওয়ার নয়!’ পিকুল বিরক্ত—‘খালি হতে না হতেই ভরা থাক্‌ ভরা থাক্‌ গাইছ...’।
    --‘তোর জিভটা বহুত লম্বা হয়েছে পিকুল’। বাথরুম থেকেই বলে বিশু—‘কথায় কথায় চেটে দিচ্ছিস’।
    --‘চাটাচাটি পরে হবে। আগে বেরোও তো বাপু! কতক্ষণ ধরে ঢুকে বসে আছো! তোমার ইয়েটা কি হোস্‌পাইপ? না টালার ট্যাঙ্কটা তুমিই ভরেছ?’
    এমন কথা বলার পর আর বাথরুমে বসে থাকা যায় না। অগত্যা বেরিয়ে এল বিশু। মানে বেরোতেই হল তাকে! আর তারপরই দুরুদুরু বুকে স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সিন্ডারেলার জুতো। একটা একটা করে মেয়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে, আর সে কৌতুহলী হয়ে তাকাচ্ছে। ঐ গোলাপি রঙের শাড়ি পরা মেয়েটা? নাঃ, বড্ড বেঁটে। সিন্ডারেলা বিরাট লম্বা! তাহলে কি ঐ কমলা রঙের সালোয়ার স্যুট পরা লম্বা মেয়েটা? নাঃ, বড় কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে হাঁটছে। সিন্ডারেলা অত ললিতলবঙ্গলতাও নয়! তবে কোন্‌টা? হলুদ কুর্তি? নাঃ ওর হাতে কোনও উইন্ডচিটার নেই!
    ঘড়িতে আস্তে আস্তে রাত দশটা বাজল। তারপর সাড়ে দশটা। তারপর একটু একটু করে ঘড়ির কাঁটা পৌনে এগারোটার দিকে এগোল। অনেক মেয়ে সামনে দিয়ে এলো। যত তৎপরতায় এলো, ঠিক তত তৎপরতাতেই গেল। আস্তে আস্তে স্টেশনের সামনেটা ফাঁকা হয়ে এলো। আশেপাশের পান, বিড়ি, সিগ্রেটের দোকানগুলো ঝপ ঝপ করে বন্ধ হচ্ছে।
    ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল বিশুর। হতাশাতেও মানুষের ক্লান্তি আসে। সে হতাশ। বুঝে গেছে সিন্ডারেলা আর আসবে না। আসলে সে ও প্রত্যাখ্যান করল বিশুকে! অন্যান্য মেয়েদের মত তাকে ছেঁড়া চপ্পলের মত ফেলে গেল! নাঃ, সিন্ডারেলার কোনও দোষ নেই। বিশু যখন প্রপোজ করেছিল তাকে, তখন সে চুপ করে গিয়েছিল। কোনও আশা দেয়নি। হয়তো মুখের উপর রিফিউজ করতে খারাপ লেগেছিল বলেই চুপ করেছিল। আর তার নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ ভেবে আশায় বুক বেঁধেছিল বিশু। ভুল করেছিল।
    দুপ্‌ করে বুকের আশার বাল্বটা ডুম হয়ে গেল। বুকে বড় আগুন জ্বলছিল। অথচ বড়িও ধারেকাছে কোথাও নেই। এমন সম্ভাবনার কথা মাথাতেই আসেনি বিশুর। আসলে সাথে গোটা কয়েক বড়ি নিয়ে আসত। আর তারপর রেললাইন তো কাছেই...!
    যেহেতু বড়ি নেই, সেহেতু পান সিগ্রেটের দোকানের দিকেই এগোলো বিশু। বড়ি নেই তো কি আছে, সিগ্রেটই ধরবে। টোব্যাকো কজেজ ক্যানসার! দেবদাস পার্বতীর জন্য লিভার পচাতে পারে, আর সে সিন্ডারেলার জন্য ফুসফুস পচাতে পারে না! সিন্ডারেলার জন্য শহীদ হয়ে যাবে সে। সেই উদ্যোগ নিয়েই কয়েক প্যাকেট সিল্ককাট কিনে নিল।
    একটা সিল্ককাট মুখে গুঁজে মনে পড়ল, দেশলাই নেই! ওদিকে হতচ্ছাড়া দোকানি ঝাঁপ ফেলার প্রায় ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। শালা, ব্যাডলাকটাই খারাপ!
    হঠাৎ নাকের কাছে একটা লাইটার ফস্‌ করে জ্বলে উঠল! একটা লেদার জ্যাকেট পরা হাত তার দিকে লাইটার এগিয়ে ধরেছে!
    --‘থ্যাঙ্কস দাদা’। সে হাতের মালিকের দিকে তাকায়। এক বাইক আরোহী। হেলমেটে মুখ ঢাকা। বিশু শুনতে পেল লোকটা বলছে—‘তবে যে সেদিন বলেছিলি, বিড়ি খাস্‌ না! গাপ্পু মারছিলি?’
    বিস্ময়ে বিশুর হাত থেকে সিগ্রেটটা পরে গেল! এ কার কন্ঠস্বর শুনছে সে! সিন্ডারেলা! বাইকের উপরে বসে!
    তার সমস্ত সন্দেহের মুখে তালা ঝুলিয়ে বাইক আরোহী এগিয়ে দিল তার উইন্ডচিটারটা। বিশু হাঁ। কোনমতে বলল—‘তুমি...তুমি...ছেলে!’
    --‘ছেলে হবে তোর বাপ!’ বলতে বলতেই হেলমেটটা খুলে ফেলেছে সিন্ডারেলা! হ্যাঁ, সেই তো! এই তো সেই মিশরীয় চোখ! নিটোল সুন্দর মুখ! আর বাজি ধরে বলতে পারে বিশু এ মুখ কোনও ছেলের নয়! তবে এ কি ধরণের মাঞ্জা!
    --‘সিগ্রেটটা তো উলটো করে ধরেছিলি বাল’। সিন্ডারেলা হাসল—‘ থোবড়া পুড়ে গেলে কি হত? যা হাতে ধরতেই জানিস না, তা নিয়ে রঙবাজি করতে যাস্‌ কেন?’
    --‘আমার মুখ পুড়লে তোমার কি?’ প্রায় মেয়েদের মত অভিমান করেছে বিশু—‘আমি তোমার কেউ নই। নয়তো এত দেরি করে কেউ আসে? আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে প্রায় হেরিটেজ হয়ে গেলাম...’।
    --‘শোন্‌ মাকড়া’। সিন্ডারেলা বলল—‘ তোর ভ্যানতারা শোনার মত সময় নেই। যা যা বলছি ধ্যান দিয়ে শোন্‌। আমি কোনও সিন্ডারেলা-ফেলা নই। তুই ভুল লোককে ভালোবেসেছিস্‌। আমার পরিচয় জানিস তুই? আমাকে সবাই ‘লাটু মস্তান’ নামে একডাকে চেনে! আমি বহুত খতরনাক গুন্ডা। আমার বাপটা ছিল মাস্তান—মা রান্ডি।...’
    বিশু স্তম্ভিত! এর থেকে তো মাথায় বাজ পড়লেও ভালো ছিল! এই তবে লাটু মস্তান! এই তার সিন্ডারেলা! যখন অতনুর বাড়িতে সিন্ডারেলার খোঁজে গিয়েছিল, তখনই ফেরার পথে এই লাটু মস্তানেরই বাইকের তলায় চাপা পড়ছিল সে! গালাগালিও দিয়েছিল! নবগ্রামের ত্রাস, সবার ভাই লাটু মস্তান—তার সিন্ডারেলা! একজন ভাই তার স্বপ্নের প্রেয়সী—রূপকথা! হে ভগবান!
    --‘অনেককে টপকেছি, অনেককে মায়ের ভোগে পাঠিয়েছি! এখন যাচ্ছি দোদোর কাছে। বদলা নেব। হয় মরবো, নয় মারবো’। লাটুর চোখ জ্বলে ওঠে—‘এবার বল্‌, ভালোবাসিস আমায়? ভালোবাসা কাকে বলে বুঝিস? একটা মাস্তানকে ভালোবাসার মানে বুঝিস তুই?’
    বিশু তখনও প্রায় দুই পাউন্ডের হাঁ করে আছে! তার মুখের চোয়ালটা হঠাৎ আটকে গেছে কি না সন্দেহ হয়!
    --‘বল্‌ না!’ অদ্ভুত রাগে চেঁচিয়ে উঠল লাটু—‘ভালোবাসিস? এখনও পেয়ার মহব্বতের ব্যান্ড বাজাবি কানের কাছে?’
    আর প্যায়ার মোহব্বতের ব্যান্ড! বিশুর নিজেরই তখন ব্যান্ড বাজছে! সে তখনও নিরুত্তর! ধপাস্‌ করে শক্তিহীনের মত মাটিতেই বসে পড়েছে! লাটু তার দিকে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে দেয় উইন্ডচিটারটা। তার বাইক গর্জন করে উঠল। অসহায়ের মত বসে থাকা বিশুর দিকে তাকিয়ে তার ভীষণ রাগ হয়! মনে হয়, খুন করে ফেলে লোকটাকে! দোদোকে নয়, এখনই এই পাব্লিকটাকে টপকে দেয়! রাগে, দুঃখে তার চোখে জল এসে পড়েছে। চোখের জল ঢাকতেই হেলমেটটাকে মুখের উপরে নামিয়ে আনল সে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তারপর লাটু চলে গেল। একরাশ ধুলো বিশুর মুখের উপরে উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল তার বাইক!
    বাইকের স্পিড বাড়াতে বাড়াতেই ঝাপ্সা দুচোখে আকাশ দেখল লাটু মস্তান! হঠাৎ মনে হল, তার কেউ নেই! সব আছে, তবু অদ্ভুত একটা শূন্যতা তাকে গ্রাস করছে নিরন্তর! নাঃ, রাগ করে লাভ নেই। লোকটা বড় ভালো মানুষ! শরিফ লোক। ওর ভালো হোক্‌।
    শুধু অন্তর্যামী জানলেন দোর্দন্ডপ্রতাপ লাটু সত্যিই কাউকে ভালোবেসে ফেলেছিল! সে যে যন্ত্রণা ভোগ করছে—তাকেই বলে ভালোবাসা!

    দোদো মস্তানের আজ মেজাজ খুব শরিফ!
    ঐ লাটু নামের খানকি মাগীটাকে একহাত নেওয়া গেছে! সোনার গাঁয়ের টাকার ব্যাগটা অবশ্য হাত ছাড়া হয়ে গেল! কিন্তু ওর চ্যালাচামুন্ডাদের খুব চমকে দিয়েছে সে। একটা বোধহয় খচ্চাই হয়ে গেল। তা যাক্‌, তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই দোদোর। হাতের কাছে পেলে ঐ ঘমন্ডি শালির মুন্ডুটাও ধড় থেকে আলাদা করে দিত! দোদোকে নিয়ে মাজাকি! মাথার চুল ছিঁড়ে পাঠানো! মানে, বাল ছেঁড়া গেছে! বাল ছেঁড়াচ্ছি হারামজাদী।
    বিদেশী মদের বোতলে তৃপ্তিসূচক কয়েকটা চুমুক দিল সে। এমনিতে সে ‘বাংলু জিন্দাবাদেই’ বিশ্বাসী। কিন্তু আজ বিশেষ দিন। সেলিব্রেট করতে হবে না? মাগী হয়ে মদ্দাবাজি! দেখলেই গা চিড়বিড় করে দোদোর! খুব একচোট বদলা নেওয়া হয়েছে। খানকি নিশ্চয়ই এখন নাকের জলে চোখের জলে হচ্ছে।
    ধুস বাল্‌। মাল খেয়ে মস্তি হচ্ছে না! আরেকটু চিল্‌ দরকার। ওদিকে কাঁধের ব্যথাটাও টনটনাচ্ছে। হারামের পিল্লা পচা ভোজালির এক কোপ বসিয়ে দিয়েছিল। যদিও জখম তেমন সাঙ্ঘাতিক নয়। ব্যান্ডেজ মেরে দিয়েছে কোনমতে। তবু শালা দবদবাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে সে চেঁচায়—‘ নন্দু...পদু...কোথায় মরে গেলি শালা...বরফ দিয়ে যা...। মাল তো চায়েরও অধম হয়েছে!’
    --‘কেউ আসবে না বে!’ দোদো যেখানে বসেছিল, ঠিক তার সামনেই টেবিলের ওপ্রান্তে অন্ধকার জমে আছে। সেলিব্রেট করার জন্য বেশি ঝিনচ্যাক পছন্দ করে না সে। বরং অন্ধকারে বসেই মাল খাওয়াই তার বেশি পছন্দের। সেই অন্ধকারই যেন হিস্‌হিস্‌ করে বলল—‘সব কটাকে আগেই ঠিকানা লাগিয়ে এসেছি!’
    ঠিকানা লাগিয়ে এসেছে! একটু একটু করে নেশা ধরছিল দোদোর। এ কথায় আমেজটা চুরমার হয়ে গেল! ঠিকানা লাগিয়ে দিয়ে এসেছে মানে!
    সামনের ছায়ামূর্তিটা সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বিনা অনুমতিতেই বসে পড়ল—‘টেনশন খাস না বীরু। ফৌত হয়নি। স্রেফ একটু যন্তর-পাতি তোড়ফোঁড় করেছি। মেরামত হবে’।
    --‘লাটু...তুই...!’ দোদো কথা বলতে বলতেই বিদ্যুৎগতিতে টেবিলের নীচ থেকে বন্দুকটা বের করে এনেছে। কিন্তু যত দ্রুত গতিতে সে অস্ত্রটা বের করে আনল তার থেকেও দ্রুতগতিতে একটা ছুরি এসে পড়ল তার হাতের উপর। পুরো তালু এফোঁড় ওফোঁড় করে টেবিলের গায়ে গেঁথে গেছে! যন্ত্রণায় পাগলের মত চিৎকার করে উঠল দোদো। হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে! হাত নাড়ানোর উপায় নেই! অবশ হাত থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটা খসে পড়ল লাটুর পায়ের কাছে!
    --‘খামোখা লাফড়াবাজি করছিস কেন বে?’ লাটু তার অস্ত্রটা তুলে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছে—‘কি বে বাড়া, এ কে ফরটি সেভেনের যুগে দেশি কাট্টায় কাজ চালাচ্ছিস খানকির ছেলে? ছোঃ! নেহাৎ তোদের যন্তরটা আমার নেই, নয়তো এটার উপর পেসাব করতাম’।
    --‘ফের হুলপট্টি?’ দোদো কাতরাতে কাতরাতেই বলে—‘লাটু...খানকি...!’
    --‘গাঁড় মারা গেছে তোর হুলপট্টির!’ লাটু ঠান্ডা গলায় বলে—‘এসেছি তোর সাথে একটা সেটিং করতে। ছেনালিপনা করতে আসিনি। তুই খামোখা ক্যাওড়া করছিস্‌ কেন বে?’
    --‘কিসের সেটিং’?
    সোনার গাঁয়ের টাকা ভরা কালো ব্যাগটা টেবিলের উপর ধপাস্‌ করে ফেলে দেয় সে। ব্যাগ ভর্তি টাকা।
    --‘এই টাকার জন্যই পচাকে উড়িয়েছিস্‌ না?’ লাটুর চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। তার হাতে মসৃণ পয়েন্ট ফরটি ফোর ফণা তুলেছে। একদম সোজা গান পয়েন্টে দোদোকে রেখে হিস্‌হিস্‌ করে বলল সে—‘লেঃ, টাকা ফেরত দিলাম। এবার পচাকে ফেরত দে হারামী। পারবি ফেরত দিতে?’ প্রচন্ড রাগে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল লাটু—‘পারবি ফেরত দিতে? পারবি পচাকে এনে দিতে শালা, খানকির ঔলাদ!’
    দোদো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তার মুখের ভিতরে রিভলবারের নলটা ঢুকিয়ে দিয়েছে লাটু। উদ্যত আঙুল ট্রিগারে! ছড়্‌ছড়্‌ খল্‌খল্‌ করে একটা শব্দ! দোদোর প্যান্ট ভিজে গেছে!
    --‘যাঃ শা-লা!’ সে অট্টহাসি হেসে ওঠে—‘মুতে দিলি? চোখের সামনে যমরাজকে দেখলে সকলেরই প্যান্ট গিলা হয়! কিন্তু তুই তো শালা মরদের বাচ্চা! একটা মাগীর সামনে মুতে প্যান্ট ভাসাচ্ছিস!’ বলতে বলতেই বাঁ হাতে একটা সিগ্রেট ধরাল। দোদোর মুখ থেকে বের করে আনল বন্দুকের নল। কিছুক্ষণ তার দিকে বন্দুক তাক করে রাখল লাটু। দোদোর মুখের উপরে চুপচাপ ধোঁয়া ছাড়ছে। কোনও কথা বলছে না। আস্তে আস্তে তার চোখে রক্ত জমছে! পচার ক্ষতবিক্ষত মুখটা মনে পড়ছে...হাতটা উড়ে গিয়েছিল...ছোটবেলায় সে আর পচা একসাথে খেলত... মায়ের ভুলভাল ইংরেজি ঠিক করে দিত সে...জুতোপেটা খেয়েও থামত না...সেই পচা মায়ের কোলে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলল...!
    --‘শা-লা মাদারচোদ’। প্রচন্ড আক্রোশে সে চেয়ার থেকে টেনে তুলল দোদোকে। এতসহজে ওকে মেরে ফেললে তো কাম তামাম হয়ে যায়। কিন্তু এত সহজে ওকে মারবে না লাটু! পচার এক একটা ঘায়ের বদলা নেবে সে! প্রথমে হাত দিয়ে শুরু করল ধোলাই। লাটু ক্যারাটে এক্সপার্ট। সে জানে কিভাবে মারলে হাড় ভাঙে। একটার পর একটা মারে দোদোর হাড় ভেঙে চুরমার করছিল। শোন্‌ শালা, হাড় যখন ভাঙে তখন কেমন শব্দ হয়! দ্যাখ্‌, মার খেতে কেমন লাগে! তাকে তুলে টেবিলের উপড়ে প্রচন্ড জোরে আছড়ে ফেলল লাটু! টেবিলটা ভেঙে খানখান। সঙ্গে সঙ্গে দোদোর কোমরও। মালটা সাপের মত বুকে ভর দিয়ে এদিক ওদিক পালানোর চেষ্টা করছে দেখে ওর পিঠে চেয়ারটাও আছড়ে ভাঙল লাটু!
    দোদোর দম নেই লাটুর সাথে লড়ার! যতই সে পুরুষ হোক, লাটুর মত ট্রেনিং তার নেই! খালি হাতে সে ঐ মেয়েটার সামনে দাঁড়াতেই পারবে না! দলবল সঙ্গে থাকলে অন্যকথা—কিন্তু একা লড়ার ধ্বক নেই! ফলস্বরূপ যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করতে করতে, শূলে চড়ানো শুয়োরের মত পরিত্রাহি চিৎকার করে একতরফা মার খেয়ে যাচ্ছে।
    মার খেয়ে যখন তার অর্ধমৃত অবস্থা তখন দোদোর বুকের উপর পা রেখে রণচন্ডীর মতই দাঁড়াল লাটু! হাতে রিভলবারটা উদ্যত! তার মুখে থুঃ করে একদলা থুতু ফেলে বলল সে—‘শা-লা, তোকে টপকাতেই এসেছিলাম। কিন্তু ঢ্যাম্‌না সাপ মেরে কোনও লাভ নেই! তোর সোনার গাঁ দরকার। নে! তোকে টাকাটাও দিয়ে গেলাম। সবকটাকে মেরামত করতে দরকার লাগবে। কিন্তু এরপর কোনও মেয়েছেলেকে ‘খানকি’ বলার আগে, পাঙ্গা নেওয়ার আগে মনে রাখিস্‌, একটা খানকিই তোর এই হালত করেছে। ইচ্ছে করলে, উপরে প্রোমোশনও করে দিতে পারত! এরপর যে লাইফটা চেয়ারে বসে কাটাবি, সেটা তোকে এই খানকিই ভিখ দিয়েছে! যাতে ভুলে না যাস্‌, তাই তোর কোমর আর পিঠের দফারফা করে গেলাম। এবার দ্যাখ্‌ শালা, কোমর ভাঙলে কেমন লাগে!’
    এর চেয়ে চূড়ান্ত অপমান আর হতেই পারে না! অন্তত দোদোর কাছে তো নয়ই। এর চেয়ে বোধহয় মৃত্যু ও ভালো!
    তাকে একটা লাথি মেরে ফেরার পথ ধরল লাটু। তার আর কিছু ভালো লাগছে না! দোদোকে মারতেই এসেছিল। কিন্তু মাঝপথে মাকড়াটার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পরই মনটা কেমন বদলে গেল। কি হত দোদোকে মেরে? পচা ফিরে আসত? একটা খুনের বদলে বরং পালটা খুন হত! খুনের বদলে খুনের সিলসিলা চলতেই থাকত যতদিন না দুই দলই কুত্তার মওত মরছে! এটা কি একটা লাইফ! কিসের জীবন এটা!
    মায়ের বলা কথাগুলো মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিল সে। সত্যিই এই জীবনে কিছু রাখা নেই! লোকে তোমায় ভয় করবে, শ্রদ্ধা করবে না! পাত্তা দেবে, যত্ন করবে না! সেলাম ঠুকলেও প্রণাম করবে না! সর্বোপরি ‘ভাই ভাই’ করে চাপলুশিগিরি করলেও—কেউ বলবে না ‘ভালোবাসি’।
    অব্যক্ত যন্ত্রনায় ভিতরে ভিতরে কাঁদছিল লাটু। সে দোদোর দিকে পিছন ফিরে হেঁটে যাচ্ছে। হতাশ, ব্যর্থ—ক্লান্ত লাটুর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না যে দোদো কোমরে ভর দিয়ে ঘেঁষটে ঘেঁষটে তার দেশি কাট্টার কাছে পৌঁছেছে। কোনমতে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছে বন্দুকটা! তার বন্দুকের নল অব্যর্থভাবে লাটুর মাথা তাক করেছে! সামনাসামনি না পারুক, পিছন থেকেই খাল্লাস করবে খানকিটাকে! যুদ্ধে অন্যায় বলে কোনোকিছু নেই! তার কোমর ভাঙার শোধ তুলতেই হবে।
    লাটু বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেশি কাট্টা গর্জন করে উঠল! সে থম্‌কে গেল! ব্যাপারটা কি হল তখনও বুঝতে পারেনি। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে পিছনদিকে তাকাল। এ কি! দোদো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে! মাথা চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে! তার হাতে তখনও দেশি কাট্টা ধরা! বাঞ্চোত তবে পিছন থেকে তাকে তাক করে গুলি চালিয়েছিল! ঢ্যাম্‌না, মাদারচোদ শালা! সামনাসামনি মোকাবিলা করার হিম্মত নেই! পিছন থেকে গেম খেলছে শুয়োরের বাচ্চা!
    কিন্তু গুলিটা লাগল না কেন? দোদোর টিপ যথেষ্টই ভালো! এতক্ষণে কাট্টার গুলিতে লাটুর ভেজা উড়ে যাওয়ার কথা! তবে!
    চোখ কুঁচকে ওদিকে ভালো করে দেখতেই ব্যাপারটা আয়নার মত সাফ হয়ে গেল। একটা লোক দোদোর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে! তার হাতে একটা ডান্ডা মতন কিছু! সম্ভবত একটা হুড়কো। যখন দোদো গুলিটা চালাতে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই লোকটা ধাঁই করে ওর মাথায় হুড়কোর মোক্ষম বাড়ি বসিয়েছে! ফলস্বরূপ গুলিটা ঠিক জায়গায় না লেগে হাওয়ায় ফায়ারিং হয়েছে!
    কে বাবা এই ওয়েলউইশার! লোকটা হুড়কোটাকে ফেলে একটু এগিয়ে আসতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল লাটুর। কোনমতে বলল—‘তুই!...তুই এখানে! কি করে এলি!’
    --‘তোমার পিছু নিয়ে, আই মিন ফলো করে’। বিশু বলল—‘আমার সিন্ডারেলা যেমনই হোক্‌, সে তো আমারই। তাকে একা কি করে বিপদের মধ্যে যেতে দিতে পারি? তাই তুমি চলে আসার পরই একটা অটো করে তোমায় ফলো করতে করতে চলে এসেছি। এসে দেখি এই হারামীর পো তোমায় পিছন থেকে শ্যুট করতে যাচ্ছে। তাই হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে হুড়কোটাই বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়!’ সে ভয়ার্ত গলায় বলে—‘লোকটা মরে গেল না কি!’
    জোরে হেসে উঠল লাটু—‘ধুস্‌ মাকড়া, এত যদি ভয় খাস্‌ তবে ওর মাথায় হুড়কোটা বসালি কেন?’
    --‘বা-রে!’ বিশু বলল—‘ও যে তোমায় মারতে যাচ্ছিল! তাই...’।
    --‘তাই বেবাক বসিয়ে দিলি!’ হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে পড়ল—‘জীবনে তো একটা ককরোচও মারিস্‌নি। আজ ঠ্যাঙালি কি করে?’
    --‘কি জানি! মনে হল আমি যদি ওকে না মারি—তবে ও তোমাকে মারবে। আর তোমায় মারলে আমিও বাঁচবো না!’ বিশুর গলা ধরে এসেছে—‘সিন্ডারেলা, তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে লাটু মস্তানকে ভালোবাসতে পারব কি না! ভালোবাসা কাকে বলে জানতে চেয়েছিলে! উত্তর কি দিতে পেরেছি?’
    উত্তর! এর থেকে বড় উত্তর আর কি হতে পারে! যে বিশু কোনওদিন একটা মশাও মারেনি, সে আজ হাতে অস্ত্র তুলল! শুধু অস্ত্র তুললই না—একটাকে মায়ের ভোগেও পাঠাল!
    লাটু এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না। বরং একটু চিন্তিত হয়ে বলে—‘কিন্তু মামা, কাজটা ঠিক করিস্‌নি। তুই শরিফ লোক। এসব খেলনা নয় বে! এ জিনিস তোর হাতে মানায় না’।
    --‘আমি তোমার জন্য সব পারবো। আমি তোমায় ভালোবাসি লাটু’। লাটুর পায়ের কাছে বসে পড়েছে বিশু—‘আমায় ফিরিও না’।
    লাটু মুচকি হাসছে। তার চোখে জল। মুখে কান্নামাখা হাসি। বড় সুখে কাঁদছে-হাসছে সে। মমতা মাখা স্নিগ্ধ স্বরে বলল—‘আঃ মাকড়া, তোকে নিয়ে যে কি করি। তোর জন্য শা-লা, আমাকে ধান্দাই পাল্টাতে হবে বুঝলি? শরিফ ধান্দা করতে হবে। তোকে বিশ্বাস নেই। এবার ডান্ডা হাতে নিয়েছিস্‌, পরের বার হয়তো রামদা নিয়েই মাঠে নামবি!’
    --‘লাটু...তাহলে!’
    --‘লাটু না’। সে বিশুর দুহাতে হাত রেখেছে—‘লতিকা বল্‌’।
    অনেকদিন এমন আনন্দ পায়নি বিশু। তার মনে হল, সে এই পৃথিবীর রাজা! সিন্ডারেলা...থুড়ি লতিকাও তবে তাকে ভালোবাসে...লতিকা তাকে ভালোবাসে...ওঃ ঈশ্বর!

    ১৭.
    --‘এই মোবাইলটাকে চিনতে পারছ কেউ?’
    সুবীরকাকুর বাড়িতে সেদিন ‘অসভ্য চোখ’ যে মোবাইলটা ফেলে রেখে পালিয়েছিল, সেই মোবাইলটাকে দেখিয়ে বললেন সুবীরকাকু—‘এই ফোনটা আমার বাড়ির ছাতে পাওয়া গেছে’।
    হুলোদা অনেকক্ষণ সরু চোখ করে মোবাইলটাকে মাপলেন। তারপর ফের বিসর্গ জুড়ে বললেন—‘এটা থোঃ...’!
    তিনি শেষ করার আগেই পিকুল বলল—‘সুব্রতদার মোবাইল। তাই না সুব্রতদা?’
    সুব্রতদা হাঁ করে মোবাইলটার দিকে তাকিয়েছিলেন। এখন তাকে আর শার্লক হোম্‌স্‌ বা মিস্‌ মার্পল বলে মনে হচ্ছে না! বরং সদ্য ধরা পড়া কয়েদীর মতই মনে হচ্ছে! একদম চোরের চাকর যাকে বলে আর কি! কোনমতে থুতিয়ে থুতিয়ে বললেন—‘হ্যাঁ...ওটা...আমারই...কিন্তু...সুবীরদার বাড়ির ছাতে গেল কি করে!’
    --‘যেমন করে তুমি গিয়েছিলে!’ পিকুল চোখ কটমট করে বলে—‘এতদিন সবাইকে সন্দেহ করে বেড়াচ্ছিলে! কখনও বিশুদা, কখনও রাবণ! সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স! সাইকোলজি! আরও কত কি! এবার বল? তোমার মোবাইল সুবীরকাকুর ছাতে গেল কি করে?’
    --‘কি জ্বালা!’ সুব্রতদা মুখটাকে বেগুনের ফালির মত লম্বাটে করে বললেন—‘আমি কি করে বলব? মাইরি বলছি...আমি নই!’
    --‘তুমি বললেই তো হবে না!’ পিকুল গম্ভীর—‘আই উইটনেস আছে’।
    --‘আই উইটনেস? সেটা কে?’
    --‘আমি’।
    --‘তুই?!’ সুব্রতদা একেবারে তেড়েফুঁড়ে একসা হলেন—‘তুই আমায় দেখেছিস?’
    --‘ দেখেছি’।
    --‘স্বচক্ষে দেখেছিস আমাকে?’
    পিকুল মৃদু হাসল—‘তোমায় না দেখলেও চলে! তোমার হাত দেখাই কাফি!’
    --‘হাত দেখা কাফি মানে!’ তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন—‘তুই কি জ্যোতিষী? না আমার হাতে লেখা আছে যে আমিই ‘অসভ্য চোখ’!’
    --‘তোমার হাতেই লেখা আছে!’ পিকুল বলল—‘ যখন ছাতে আমার গলা টিপে ধরেছিলে তখন তোমার হাত দেখতে পেয়েছিলাম। এ তল্লাটের কারুর হাতে অমন বনমানুষের মত লোম নেই! এরকম কঙ্গো হাত একমাত্র তোমারই আছে! তাছাড়া গত মেলায় তুমি একটা ফসফরাস দেওয়া চশমা কিনেছিলে তাই না?’
    --‘কি বলছিস্‌ যা তা!’ সুব্রতদা অসহায়ের মত বললেন—‘বিলিভ মি...! আমি এসব করিনি!’
    --‘আচ্ছা? তাহলে বলো, মজুমদার বাড়ির বৌভাতে রাবণ আর বিশে দুজনেই লেটে এসেছিল তাই না? তুমি দুজনকেই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলে। তার মানে তুমিও অনেক রাত অবধি ওখানে ছিলে। ইয়ানি তোমারও ফুল স্কোপ ছিল লাইভ পানু দেখার!’
    --‘কি বলছিস!’
    পাশ থেকে পাঁচু বলল—‘তাহলে বলো কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে? রোজ রাতে তুমি আমাদের সঙ্গে পাহারা দাও। কাল রাতে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেলে! আর তোমার মোবাইলটা সুবীরকাকুর ছাত অবধি পৌঁছল কি করে?’
    --‘আরে কাঁচকলা, আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি না!’ সুব্রতদার মাথায় হাত পড়ল—‘কাল রাতে আমি বাড়ি ছিলাম না...মানে বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম। মোবাইলটায় চার্জ ছিল না বলে জানলার পাশে চার্জারে বসিয়ে চলে গিয়েছিলাম। ফিরেছি অনেক রাতে, তাই খেয়াল করিনি। আজ সকালে দেখলাম মোবাইলটা নেই!’
    আশেপাশের সবাই ‘হাইলি সাশ্‌পিশাস্‌’ ভঙ্গিতে থোবড়া লটকে বসে আছে। অর্থাৎ কেউ সুব্রতদার কথায় বিশ্বাস করছে না। কথায় দম নেই!
    --‘আচ্ছা’। পিকুল ভুরু কুঁচকে বলে—‘তুমি লং জাম্প চ্যাম্পিয়ন ছিলে না? ছাত থেকে ছাতে লাফিয়ে যেতে পারো?’
    --‘হ্যাঁ, লং জাম্প চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। কিন্তু সে তো...!’ সুব্রতদা বললেন—‘ওঃ পিকুল, প্লিজ্‌, বিশ্বাস কর্‌। ওটা আমি ছিলাম না। আমি কোনমতেই ছিলাম না! কাল বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন ছিল। সেটাই অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিলাম। তাই কাল আসতে পারিনি’।
    --‘কোথায় বিয়ে বাড়ি ছিল’?
    --‘ওঃ নো পিকুল!’ তার প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা—‘এভাবে তোরা আমাকে সন্দেহ করিস না! আমি কিছু করিনি! একটা নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে এভাবে সন্দেহ করতে কষ্ট হচ্ছে না তোদের?’
    --‘তোমার হয়েছিল?’ পিকুল তীব্রস্বরে বলে—‘যখন বাবন আর বিশুর মত দুটো নিরীহ লোককে চমকানোর প্ল্যান করেছিলে, বিশুকে চমকেছিলে, তখন কষ্ট হয়নি? এখন নিজের গাঁড় মারা যাচ্ছে বলে খুব কষ্ট হচ্ছে—তাই না?’
    সুব্রতদার টানটান গোঁফজোড়া কেমন যেন ঝুলে পড়ল। কয়েকমুহূর্ত গুম মেরে বসে থাকলেন। তারপরই বাচ্চা ছেলের মত হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন—‘ওরে, আমি আর কখনও কাউকে সন্দেহ করবো না...এই ঘাট মানছি...নাক মুলছি...কান মুলছি...আর কখনও কথায় কথায় পাব্লিককে চমকে বেড়াবো না...কারুর দিকে আঙুল তুলবো না...শালা, উংলি করার আগে উংলি কেটেই ফেলবো...কিন্তু বিশ্বাস কর্‌... আমি কিছু করিনি...আমি অসভ্য চোখ নই...আমি নই...!’
    বলতে বলতে অত বড় লোকটা, শার্লক হোম্‌স আর মিস্‌ মার্পলের গুষ্টির তুষ্টি করতে করতে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগল!

    ১৮.
    বাবনের মনে হল—একটা ট্রেন তার কানের সামনে হুইস্‌ল্‌ দিতে দিতে চলে যাচ্ছে! একটা ঘড়ি ক্রমাগত টিকটিক করে করে কাঁটা সরিয়ে সরিয়ে সময়ের পরিমাপ করে চলেছে! এইমাত্র ডঃ মিত্র বালিঘড়িটাকে উলটে দিয়ে গেছেন। বালি ক্রমশই ঝুরঝুর করে পড়েই যাচ্ছে। ইশারা করছে—সময় শেষের পথে!
    এখন শিউলি অনেকটাই ভালো। কিন্তু এ ভালো ভালো নয়। প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে যেমন শেষবারের মত একবার দপ করে জ্বলে ওঠে—এই সুস্থতা অনেকটা সেই রকম।
    আগের দিন ডঃ মিত্র বলছিলেন—‘ওঁর হাতে আর বেশি সময় নেই। বড়জোর একমাস বাঁচবেন। আজই ওকে রিলিজ করে দিচ্ছি। বাড়ি নিয়ে যান। দেখবেন শেষের কটা দিন যেন আনন্দে থাকেন উনি। যেন বেশি উত্তেজিত না হন্‌’।
    --‘ডাক্তারবাবু, এখন কিছুই কি করার নেই?’
    --‘নাঃ!’ ডঃ মিত্র মোলায়েম গলায় বলেন—‘শরীরের যা অবস্থা তাতে পেশেন্ট অপারেশন টেবিল অবধি বাঁচবেন না। অ্যানাস্থেশিয়াই নিতে পারবেন না। তার চেয়ে বরং বাড়িতে নিয়ে যান। আপন মানুষদের মধ্যেই শেষ দিনটা কাটুক’।
    বাবনের কানে আবার ট্রেনের হুইস্‌ল্‌। দিনের শেষ ট্রেনটা যেমন ক্লান্ত ভাবে সিটি দিতে দিতে চলে যায়, ঠিক সেভাবেই সময় চলে যাচ্ছে। অথচ কিছু করার নেই! কালকে ডাক্তারবাবু বললেন শিউলিকে আনন্দে রাখতে। আপনজনের মধ্যে রাখতে। কিন্তু কিভাবে?
    এর মধ্যে অবশ্য একটা ভালো খবর আছে। লাটু অবশেষে বিয়ে করার জন্য রেডি হয়েছে। পাত্র বড়িখোর বিশু! বাবনের মনে হয় লাটুর জন্য এর থেকে ভালো বর পাওয়া সম্ভব ছিল না। বিশু ভীষণ ভালো ছেলে। লাটুকে ভালো রাখবে। তাছাড়া লাটু ঠিক করেছে গুন্ডাগিরি ছেড়ে দেবে! বিশুর জন্যই ছাড়বে! বিশুর কথা ভেবেই তার এই সিদ্ধান্ত! শুধু বিউটি পার্লার আর হোটেলের কারবারটাই থাকবে। বাট নো মোর কালা ধান্দা! প্রেম যে মানুষকে কি থেকে কি করে! একটা মানুষ ভালোবাসা পেলেই আমূল পালটে যেতে পারে। লাটু কালকে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল শাড়ি পরে! তাকে দেখে হাঁ বাবন! কোথায় সেই বাইক হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ানো মাচো টমবয়! চলাফেরায় নরম ছন্দ এসেছে! চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক! কানে দুল, হাতে একগাদা চুড়ি ঝুমুর ঝুমুর করছে! পায়ে নূপুরের ঝমঝম! চোখ নামিয়ে লাজুক লাজুক হাসছিল। তার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল বিশু! কোথায় সেই ন্যালাক্ষ্যাপা পাব্লিক! রীতিমত ক্লিনশেভড আস্ত একটা চকচকে ঝকঝকে পুরুষ! আর তিনদিন পরেই ওরা বিয়ে করছে! কয়েকদিনের পরিচয়ের জল অবশেষে বিয়ে অবধি গড়াল। কিন্তু প্রেমটা যে ঠিক মত করা হল না! বিশুর সপ্রতিভ উত্তর—‘কেন বিয়ের পর কি প্রেম কন্টিনিউ হয় না? আমাদের প্রেম টি.বি.সি’।
    বাবন আঁৎকে উঠে বলে—‘টি.বি.সি? টিউবারকুলোসিস?’
    --‘টু বি কন্টিনিউড!’ বিশুর দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসে বলল লাটু—‘তাই না?’
    --‘লাটু’। বাবন বলে—‘অবশেষে বিয়ের ফুল ফুটল?’
    --‘লাটু নয়’। সে ফের হাসছে—‘লতিকা!’
    বাবন অবাক! ঐ দোর্দন্ডপ্রতাপ ভাইয়ের মধ্যে এই সুন্দরী মেয়েটা এতদিন ছিল কোথায়! শিউলি ঠিকই বুঝেছিল, লাটু প্রেম পেলে পালটে যাবে। সত্যিই বিশুর ঐকান্তিক ভালোবাসা ওকে পালটে দিয়েছে! হয়তো ভবিষ্যতে আরও পাল্টাবে!
    ওরা দেখা করে বেরিয়ে আসার পর বাবন শিউলির সামনে গেল। বাবনকে দেখেই তার চোখে জল চিকচিকিয়ে ওঠে—‘বাবন, এসেছিস্‌? তোর অপেক্ষাই করছিলাম। শুনেছিস্‌? আমার লাটু...আমার লাটুর কপালে সিঁদুর জুটবে। মনের মত মরদ জুটবে। পেম জুটবে!’
    আনন্দের চোটে তাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদল শিউলি। তার কাঁধে মাথা রেখে পরম সুখে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল শার্ট! বাবন কোনরকম ইতস্তত না করে তার মাথায় হাত রাখল। যেন একটা বাচ্চা মেয়েকে আদর করছে।
    --‘তুই আমার জন্য হেবি লাকি বে!’ কাঁদতে কাঁদতেই বলে শিউলি—‘তুই আমার জিন্দেগিতে এলি। আর আমার প্রলবেম খতম হল’।
    বাবন গলা খাঁকারি দেয়—‘ভাই, প্রলবেম নয়, ওটা প্রবলেম হবে!’
    তার বুকে একটা কিল মেরে বলল শিউলি—‘হারামজাদা!’
    --‘শুধু হারামজাদায় হবে? জুতো কই?’
    জোরে হেসে উঠেছিল সে। বাবন তার হাসি হাসি মুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। এই হাসিভরা মুখটা কবে যেন তার বড় আপন হয়ে গিয়েছে। সে বুঝতেও পারেনি। হয়তো বুঝতেও পারত না! কিন্তু জীবন যখন নোটিস দিয়ে দিল তখনই যেন কে এক ঝটকায় জাগিয়ে দিয়ে গেল বাবনকে। শিউলির জন্য রাতের পর রাত জাগা...আই সি ইউর বাইরে থেকে তাকে একঝলক দেখা...মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষার প্রতিটি মুহূর্ত সে তার পাশ ছেড়ে একমুহূর্তের জন্যও নড়েনি। যেন সে সরলেই শিউলি তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে!
    এতদিন বাবন একটা নেশার মত দিন কাটাচ্ছিল। শিউলির সাথে কথা বলতে ভালো লাগত। অনিন্দিতার সঙ্গও তাকে কখনও এত আনন্দ দিতে পারেনি। শিউলির আমুদে স্বভাব, সবসময় জীবনকে উপভোগ করার ফান্ডা তাকে যেন জীবনের আরেক রূপ দেখিয়েছিল। শিউলি যখন তার উপর নির্ভর করত তখন নিজেকে খুব দামি মনে হত বাবনের। এই নারী কখনও কোনও অভিযোগ করেনি। শুধু জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তার সাথে শেয়ার করেছে। অনিন্দিতা কি কখনও করেছিল? নাঃ, করেনি!
    --‘আমি কতদিন টিঁকবো রে? আমার লাটুর সিঁথিতে সিঁদুর দেখে যেতে পারবো তো?’
    তার হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলেছিল বাবন—‘খুব দেখে যাবে’।
    --‘কিন্তু...’। সজল চোখে বলল শিউলি—‘কিন্তু লাটুটার কন্যাদান কে করবে? ওর বাপ মাকড়াটা তো...’।
    --‘তুমি চিন্তা কোর না। সব ঠিক হয়ে যাবে’।
    পরম শান্তিতে বাবনের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়েছিল শিউলি! সে স্পর্শে কি নির্ভরতা! অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা! বাবনের কথাই যেন বেদবাক্য! সে যখন বলেছে, তখন সবই হবে।

    ভিজিটিং আওয়ার্সে শিউলির সাথে দেখা করতে এসে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। সব ঠিক করে ফেলেছে। এখন শুধু শিউলিকে এখান থেকে বের করতে পারলেই হয়।
    কাবুল-সোনারা ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে টাকা মেটাচ্ছিল। সব ফর্মালিটি শেষ করে এসে বলল—‘ভাইদাদা, সব হয়ে গেছে। গাড়ি রেডি। তুমি বড়ভাইকে নিয়ে এসো। টেনশন নিও না মামা! একদম যেরকম বলেছ, সেরকম হবে।’
    --‘টেনশন নেবো না বলছিস?’
    কাবুল একগাল হাসল—‘আরে মামা, ফুলটু বিন্দাস হয়ে যাও। কোনও লোচা নেই’।
    সোনা কথাবার্তা নেই ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল—‘মামু...আমার হেবি কান্না পাচ্ছে...নাক শুড়শুড় করছে...’।
    --‘ওয়ে সেন্টুর বাক্স!’ কাবুল খিঁচিয়ে ওঠে—‘ভাইদাদা সেটিং করতে যাচ্ছে আর তুই শালা পনৌতি খাড়া করছিস্‌! নাকে কান্না থামা!’
    দুরুদুরু বুকে শিউলির কেবিনে ঢুকল বাবন। একটু ভয় ভয় যে করছে না, তা নয়। তবু প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে ঠিক রাখার। মাথার চুলে একবার হাত বোলাল। গলা সাফ করে নিল। পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল, জিনিসটা আছে কি না!
    শিউলি বোধহয় উদগ্রীব হয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখেই বলল—‘তুই এসেছিস? আমি শ্লা কখন থেকে টেম দেখে মরছি। এত দেরি হল কেন বে?’
    বাবন আস্তে আস্তে উত্তর দেয়—‘ইয়ে, মানে লাটুর কন্যাদানের বন্দোবস্ত করছিলাম কি না!’
    --‘লাটুর কন্যাদানের বন্দোবস্ত!’ সে ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। বাবন একমুহূর্ত তার দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারপর হেসে বলে—‘এক চুটকি সিন্দুর কা মতলব তুম ক্যায়া জানো বড়ভাই!’
    শিউলি স্তম্ভিত হয়ে দেখল বাবন পকেট থেকে একটা নতুন সিঁদুরের কৌটো বের করে এনেছে। সে ব্যাপারটা বুঝেও বোঝে না! ওটা কার জন্য? লাটুর জন্য? না অন্য কিছু?
    তাকে ঐ সসেমিরা অবস্থাতেই রেখে মুহূর্তের মধ্যে বাবন সিঁদুর নিয়ে পরিয়ে দিল শিউলির সাদা সিঁথিতে! শিউরে উঠল শিউলি। রোমাঞ্চে, সুখে, বিস্ময়ে থরথর করে কাঁপছে সে! যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না! ঠিক কি ঘটল ঘটনাটা!
    বাবন তার স্তম্ভিত মুখের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসছে—‘এরপর আমরা মন্দিরে গিয়ে আনুষ্ঠানিক বিয়ে করবো। ফটো তুলবো। এখন আমিই লাটুর বাবা। ওর কন্যাদান করার রাইট আমার। অতএব তোমার ‘প্রলবেম’ সলভড!’
    --‘কি করলি!...এ তুই কি করলি বাবন...!’ পরম সুখে তার বুকে মাথা রেখে কাঁদছে শিউলি—‘আমি ক’দিন পরেই টপকাবো! তখন তুই কি নিয়ে থাকবি!...কি করলি তুই!...এমন উল্লুর মত কাজ করলি কেন পাগলাচোদা...’!
    --‘বেশ করেছি’। বাবন তার চিবুক ধরে মুখটা তুলে দেয়—‘শিউলি, তোমার কাছ থেকেই আমি একটা খুব দামি জিনিস শিখেছি। আমরা ‘জীবন জীবন’ করে যতই হেদিয়ে মরি, জীবন আসলে আমাদের লাইফের মত বড় নয়! জীবন শুধু কয়েকমুহূর্তের। লোকে গোটা আয়ুটা কোনমতে ‘থোড় বড়ি খাড়া’ করে কাটায়। কিন্তু নিজেদের জীবন বেঁচে নেয় শুধু কয়েকটা বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে! আসল বাঁচাটা শুধু খুব কম সময়ের জন্যই হয়—বাদবাকিটা স্রেফ জাবর কাটা’।
    বলতে বলতেই ভীষন আদরে সে দুহাতে শিউলির মুখ ধরল। তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল—‘যতদিন তুমি থাকবে, ততদিনে আমরা গোটা লাইফটাই বেঁচে নেব। একমুহূর্তও বাদ রাখব না। প্রাণভরে খাবো দাবো। হাওড়া ব্রিজে উঠে মাতলামি করবো। মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে ফিল্ম দেখে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদব। পাল্লা দিয়ে ফুচকা খাবো। রোজ সকালে নিজের হাতে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেব। তোমায় নিজের মত করে সাজাবো। তুমি শপিং করবে, আমি ব্যাগ বইবো। তোমার জন্য রাত জাগবো। তোমার ভুলভাল ইংরেজি শুধরে দেবো। তোমার জুতোপেটা আমি সারাজীবন ধরে খেয়ে যাবো শিউলি। মন খারাপ হলে নষ্টামি করে মন ভালো করে দেবো। আমি তোমার সাথে সবসময় থাকবো। যতক্ষণ তুমি আমি পাশাপাশি আছি, ততক্ষন যমদূতের নোটিসও আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না!’
    শিউলির আবার কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু আরও জোরে একটা কান্নার শব্দ পেয়ে সে থেমে যায়। এত জোরে জোরে কাঁদছে কারা? সে কৌতুহলী হয়ে এক পা দু পা করে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
    কেবিনের বাইরে কাবুল আর সোনা বসেছিল। সেই জগাই-মাধাই দুটোই গলা জড়াজড়ি করে কান্না জুড়েছে। একদম সেন্টু খেয়ে গেছে। কাবুল বলছে—‘এত খুশ আগে কখনও হইনি রে সোনা। খুশির মারে কান্না পেয়ে যাচ্ছে! দোদোর দলকে একহাত ঠ্যাঙালেও এত খুশি পাবো না! ছোটভাইয়ের লাইফ সেট। বড়ভাই ও...!’
    --‘ঢ্যাম্‌না! নৌটঙ্কি শালা!’ শিউলি পায়ের জুতো খুলতে শুরু করেছে—‘কেবিনের বাইরে বসে জাসুসি করছিস্‌। মেরে মেরে বিচি মাথায় না তুলেছি তো...!’
    পালোয়ান দুটো তিনটে লাফ মেরে হুড়মুড় করে চোঁ চা ভেগে গেল!

    অবশেষে হে-পি ও-য়ে-ল্ডিং!
    কার আবার? আমাদের বিশু আর লাটু...থুড়ি লতিকার! সাতদিন ধরে ধুমধাম চলল! নবগ্রাম এত বড় বিয়ে আগে কখনও দেখেনি! বিয়েতে লাইভ কনসার্টের বন্দোবস্ত হয়েছিল। বাইরে থেকে কনসার্ট তো এসেছিলই। এমনকি মেহেন্দি উপলক্ষে পাড়ার মেয়েরাও নাচাগানা করেছে! বিশুর প্রাক্তন প্রেমিকারা সব প্রায় পুড়ে ধোঁয়া! যে ছেলেটাকে লাইফ থেকে ক্লিন বোল্ড করে আউট করেছিল, সে যে এরকম ডাব্‌ল্‌ সেঞ্চুরি হাঁকাবে তা কে জানত! শুধু রাজপাটই নয়, সেরা সুন্দরীটিকেও কব্জা করেছে! মেয়ে তো মেয়ে নয়, সাক্ষাৎ উর্বশী! ছেলেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে—‘কে জানত ঐ বড়িখোর, ফ্রাস্টু খাওয়া, চিরকেলে দেবদাস বিশুটার বরাতে এমন একটা হাই ভোল্টেজ মেয়ে নাচছে! শালার কি বরাত!’
    বিশুরও বডি ল্যাঙ্গোয়েজ পুরো অন্যরকম। অনেকটা ‘উলটে দেখুন পালটে গেছে’ কেস! এখন তাকে দেখলে কে বলবে—একদিন সে-ই বড়ি খেয়ে ল্যাদ্‌ খেয়ে বেরিয়েছে চতুর্দিকে! ছড়িয়ে ছত্রিশ করেছে! আজ সে বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী পুরুষ! মাঝেমধ্যেই আড়চোখে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছে! বৌও কখনও হাসতে হাসতে চোখ মেরে দিচ্ছে! কি দুষ্টু বল দেখি!
    বিয়ের দিন বাবনই কন্যাদান করল। শিউলি দু চোখে জল নিয়ে দেখছিল মেয়েকে! বেনারসী, সোনার গয়নায় মোড়া মেয়ে যেন রাজেন্দ্রাণী! বরটা একটু রোগাসোগা বটে। কিন্তু দেখতে ভালো।
    --‘শুনছ?’
    বাবন এখন তার স্বামী। স্বামীকে তো আর ‘তুই’ বলা যায় না। অগত্যা দুজনেই অধুনা ‘ওগো হ্যাঁগো’!
    --‘বলো’।
    --‘ছেলেটা বড় প্যাংটা!’ শিউলি স্মিত হাসল—‘ওটাকে একটু তাগড়াই করতে হবে। এটা তোমার ডার্টি...!’
    --‘কেলো করেছে’। বাবন বলল—‘বড়ভাই, ওটা ডিউটি, ডার্টি মানে নোংরা’।
    শিউলি হেসে ফেলল।
    এমনিতে বিয়েতে তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। শুধু একটাই চাপের ব্যাপার। বিয়ের লগ্ন রাত তিনটেয় পড়েছিল!রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলেছে! লাটু প্রায় রক্তচক্ষু করে পুরুতের দিকে তাকিয়ে! পারলে এখনই আঁশবটি নিয়ে তেড়ে যায়। বিশু ঢুলছে এবং বিড়বিড় করে ভুলভাল মন্ত্র পড়ছে।
    পুরুতমশাই মন্ত্র থামিয়ে বাবনের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘ একটা কলা...’
    বিশুও সঙ্গে সঙ্গে বললো—‘একটা কলা...’!
    কি কেলো!
    ওদিকে বাবন চোখটিপে ইশারা করছে—‘পুরুত ঠাকুর, যতটা শর্টকার্টে হয় সারুন।‘
    কিন্তু কে শোনে কার কথা? পুরুতঠাকুর সমস্ত দেবদেবীদের ডাকাডাকি শুরু করেছেন। শিবস্তোত্র, চন্ডী, দুর্গা, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ মায় তার ইঁদুরটা পর্যন্ত কেউ বাকি নেই! শুধু সরস্বতী ছাড়া বাদবাকিরা নেমন্তন্ন পেয়ে গেছেন, এখন—‘জয় জয় দেবী চরাচরসারে...’ই বাকি আছে!
    শেষমেষ অবশ্য সরস্বতীই বাদ পড়লেন। ভোর ছ’টায় পুরুতঠাকুর ঘোষণা করলেন যে বিবাহ শেষ। ততক্ষণে প্রায় সকলেই ল্যাদ খেয়ে পড়েছে!
    এই হল বিয়ের ধারাবিবরণী।
    পিকুল সাতপাক ঘোরার সময়ে দেবীর মাথায় ফুল ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল। দেবী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই বলল—‘কবে যে আমাদেরও এমন দিন আসবে!’ উত্তরে দেবী আধহাত জিভ কেটে ভেংচি কাটল!
    বাবন ও শিউলি পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে বিয়ে দেখল। লাটুটার কপাল থেকে নাকের উপর সিঁদুর পড়েছে! মেয়েটা ভাতারসোহাগী হবে! তার বড় সুখের দিন আজকে! বড় আনন্দের দিন! এমন দিনে বোধহয় মরে যেতেও ভালো লাগে!
    কিন্তু গল্পের তখনও কিছু বাকি ছিল!
    বিয়ে শেষ হওয়ার পর যখন বর-বৌ বাসরে গিয়ে বসেছে ঠিক তখনই...!
    একজোড়া চোখ! সেই একজোড়া অসভ্য চোখ!
    লাটু আর বিশু পাশাপাশি বসে সবার সঙ্গে কথা বলছে। লাজুক লাজুক হাসছে। বড়দের দল রসিকতা করছেন। ছোট আর সমবয়সী পার্টি পানু জোক্‌স্‌ ছাড়ছে। সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ!
    এর মধ্যেই বিন্তিপিসি একটু আড়ালে গিয়ে গুড়াকু মাজতে শুরু করেছেন। এটাই তার এনার্জি সাপ্লাইয়ের মূল রাস্তা। সারা রাত জেগে থাকাটা তো কম ধকলের নয়! মনের আনন্দে দাঁত মাজতে মাজতে জানলার সামনে গিয়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন।
    হঠাৎ চোখে পড়ল জানলার সাইডে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে! তার চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে অন্ধকারেও জ্বলছে! লোকটা জানলা দিয়ে এদিকেই উঁকি মারছে!
    সঙ্গে সঙ্গে খাঁই খাঁই করে উঠলেন বিন্তিপিসি!
    --‘ভূ—ত, ভূ—ত!’ কোনমতে দৌড়ে এসে জানালেন—‘সেই ভূতটা...সেই অসভ্য চোখ জানলা দিয়ে উঁকি মারছে!’
    পাড়ার ছেলেরা সবাই তখন সেখানেই ছিল। লাফ মেরে দৌড়ল ভূত ধরতে।
    ‘অসভ্য চোখ’ বোধহয় আশা করেনি যে তাকে ধরার জন্য সারা পাড়ার লোক ঘাপ্টি মেরে ওখানেই বসে আছে! ভেবেছিল ফাঁকে তালে একটু সিন-টিন দেখে টুক করে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু একেই তো সারা পাড়ার ছেলেরা ওখানেই আছে। তার উপর লাটুর চ্যালাচামুন্ডাগুলোও দৌড়ল তার পিছনে। বেশ কয়েকবার চুককি দিয়েও পালাতে পারল না ব্যাটা। সোনা-কাবুলরা তাকে জাপ্টে কষে ধরল! তারপর নিয়ে এল বিয়ের আসরে!
    ‘অসভ্য চোখে’র আসল পরিচয় এতদিনে ফাঁস হল! সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে! যেন ভাবতেই পারেনি এ ‘অসভ্য চোখ’ হতে পারে! পিকুল স্তম্ভিত! সুবীর কাকু ‘থ’। দেবী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল—‘পিকুল, তবে এর হাতেরই রামথাপ্পড় খেয়েছিলি তুই!’
    পিকুল বলল—‘হ্যাঁ। এবার বিশুদার সাপ, ঘোঁতনের চিৎকার, আমগাছ আর ছাতে ছাতে হাইজাম্পের রহস্য একসাথে রিলেট করতে পারছি!’
    ‘অসভ্য চোখের’ কিন্তু কোনও তাপ-উত্তাপ নেই! সে সবার দিকে নিপাট ভালোমানুষের মত জুলজুল করে তাকাচ্ছে। ভাবটা এমন যেন বলছে—‘আমায় ধরেছ কেন বাপু! আমি তো ভাজা মাছের উলটো পিঠটা চিনিই নে!’
    বিশুও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখল ব্যাটাকে। তারপর চেঁচিয়ে উঠল—‘মর্কট কাঁহিকা! ঐ ল্যাজ দেখিয়েই আমায় ভয় দেখিয়েছিল! ওর ল্যাজটাকেই আমি সাপ ভেবেছিলাম। দে তো হতভাগার ল্যাজ কেটে!’
    ল্যাজই বটে! রীতিমত প্রমাণ সাইজের ল্যাজ! অ্যাঁ! না... না...মানুষ টানুষ নয়! পেল্লায় সাইজের একটা মুখপোড়া হনুমান! হরিনাম লেখা একখানা পায়জামা পরে আছে। তার পিছন থেকে উঁচিয়ে আছে ল্যাজটা!
    এরই জ্বালায় জ্বলছে নবগ্রাম! হতভাগা গাছের উপর দিয়ে আসে। ভয় দেখিয়েই সুট করে লাফ মেরে পালিয়ে যায়। তাই তাকে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। ধরাও যায়নি। আর অন্ধকারে তার চোখ দুটো আগুনের মত জ্বলে! সেই চোখ দেখেই সবার হাল পাতলা হয়ে গেছে!
    পিকুল রে রে করে এগিয়ে গেছে—‘একটা পেল্লায় চড় তোকে আমিও না মেরেছি!...হনুমানের বাচ্চা...বদমায়েশ...!’
    সুবীরকাকুও হাতা গোটাচ্ছেন—‘আমার টাকে টব ছোঁড়া...!’
    সুব্রতদা এতক্ষণ কোথায় ঘাপ্টি মেরে বসেছিলেন কে জানে। এবার এগিয়ে এসে বললেন—‘এই পামরের জন্য আমি কেস খেয়ে যাচ্ছিলাম। শালা কঙ্গো হাত দেখিয়ে আমায় বঙ্গছাড়া করার ষড়যন্ত্র...!’
    হনুমানটার কপালে নির্ঘাৎ দুঃখ ছিল। বাঁচালেন বিন্তিপিসি। এগিয়ে এসে বললেন—‘আ-হা! মারিস্‌ নি! জানিস এ কে! ঐ দ্যাখ্‌ কেশব মাধব লেখা প্যান্টুল পরে আছে!’
    --‘থাকুক’। পিকুল ক্ষেপে গিয়ে বলে—‘শুধু কেশব মাধব কেন? যাদব, উদ্ধব, ধবধব, গর্দভ লেখা প্যান্টুল পরলেও ছাড়ছি না!’
    --‘আ-হা!’ পিসি দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করেন—‘এ কি যেমন তেমন হনুমান! এ হল ঘামেশ্বর বাবার পোষা হনুমান। সমোস্কিত বলতে পারে। হনুমান চাল্লিসা পড়তে পারে। মারিস্‌ নি বাবা। পাপ হবে...!’
    সোনা-কাবুলরা ঘাবড়ে গিয়ে হনুমানটাকে ছেড়ে দিয়ে গড় করল। বজরংবলীর জাত কি না! বিন্তিপিসির কি অসীম সাহস! দিব্যি হনুটার কাছে গিয়ে বললেন—‘বাবা, ওদের মাফ করো, ওরা তো জানে না যে তুমি কে। তা বাবা, এমন শুভ সময়ে এসে যখন পড়েছ তখন একটু সমোস্কিত বলে যাও। আমরাও একটু শুনে পূণ্যি করি...। বলো বাবা, জয় হনুমান জ্ঞানগুণসাগর...!’
    হনুমানটা কি যাচ্ছেতাই! সমোস্কিত তো বললই না, উলটে এক খামচা মেরে পিসির হাত থেকে গুড়াকুর ভর্তি ডাব্বাটা নিয়ে একলাফে গাছে চড়ে বসল।
    ব্যস্‌! ভক্তি টক্তি কোথায় গেল পিসির কেজানে! তিনি তিন লাফ মেরে নাচতে শুরু করলেন—‘হতভাগা, মুখপোড়া ড্যাক্‌রা! আমার তামাকের ডিবে নিয়ে গেলি! ভোলা মুদির দোকান থেকে আজই ভর্তি কৌটো এনেছি! সবটা নিয়ে গেলি! তোর মুখে পোকা পড়ুক! হাতে কুষ্ঠ হোক্‌! সমোস্কিত পড়তে পারে না কচু!...যত্তসব ঢ্যাম্‌নার দল! আমার ডিবে দিয়ে যা বলছি! নয়তো...!’
    হনুমানটা দাঁত বের করে উত্তরে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কচু কচু বলে আরেক লাফে কোথায় হাপিশ হয়ে গেল!
    লেঃ হালুয়া! কি ছোটলোক দেখেছ!

    (সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • ব্লগ | ২২ নভেম্বর ২০১৩ | ১৬২৪৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গরল - Sayantani Putatunda
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • siki | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৩ ০৭:০৪45928
  • পেম পেম পেম পেম পেম পেম পেম পেম পেম পেম পে-পেম

    ডবোল নোংরা হচ্ছে মাইরি।
  • কল্লোল | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৩ ১১:১১45929
  • কি হলো? চলবে লেখা নেই তো!!!!
  • aranya | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৩ ০৩:১৪45939
  • কিঁচ কিঁচ কিঞ্চিৎ কাঁচালঙ্কা। যদি বলি এক্কেরে প্রথম দিকে, বোধায় দ্বিতীয় এপিসোডেই মনে হয়েছিল অসভ্য ব্যাটা এক হনু, আপনেরা কি বিশ্বাস করবেন? গপ্পো-টা যাতে নষ্ট না হয়, তাই আর লিখি নি।
    নাঁতেল পাব্লিক হিসেবে দিব্য লাগল, সায়ন্তনীর অক্ষয় দোয়াত-কলম ইয়ানি কি কম্পু, কি বোর্ড ইঃ হোক।
    লাটু বে-র জন্য ছেলে দেখে রেললাইন ধরে ফিরছিল কেন - ওটা কি শর্টকাট রাস্তা? বই হিসেবে বেরোলে ওরম কোন একটা ব্যাখা যোগ করে দিতে পারেন।
    আবার বলি - হুল্লাট হয়েছে। গুরুতে যেন নিয়মিত দেখি আপনার লেখা।
  • aka | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৩ ০৩:৩৮45941
  • পুরো রাপচিক মাল নেমেছে গুরু।

    গপ্পো বলার হাতটা খাসা। উপন্যাস লেখার মেটিরিয়াল।
  • সিকি | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৩ ০৪:৫৬45940
  • কিঁচ কিঁচ কিঞ্চিত কাঁচাগোল্লা।

    শালিক, নাকি হাঁড়িচাঁচারা এইভাবে গান গেয়েছিল জোলার বিয়েতে। উপেন্দ্রকিশোর মনে পড়ে গেল। :)
  • শঙ্খ | ***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৩৯45942
  • জব্বর হয়েছে!!

    হ্যাঁ, হয়তো বেশ প্রেডিকটেবল, কিন্তু তাতে কিছু ছেঁড়া যায়না। সুখপাঠ্য মশলাদার লেখা, তরতরিয়ে পড়ে ফেলা যায়। এই বাজারে সেটাই অনেক।

    এবার সায়ন্তনীকে একটা রিকোঃ লাটুর ক্যারেকটারটা খুব ইউনিক হয়েছে, আর মোটামুটি সবাই-ই লাটুকে ভালোবেসে ফেলেছে। এই ক্যারেকটারটাকে হারিয়ে যেতে দিলে খেলবো না।
    সিকোয়েলের সব রসদই আছে কিন্তু। কোমর ভাঙা দোদো ভিলেন, লতিকা-বিশুর একটু অ্যাডাল্ট রোমান্স, তারপরে লাটু রিটার্নস উইথ নানচাকু (ছবি সোসেন এঁকে দেবে), ইপ্সিতাদির সিডিউসিং পার্ট টু ইত্যাদি প্রভৃতি। মোটকথা এর একটা পার্ট টু হতেই পারে, এবং হোক, সেই দাবী জানিয়ে গেলুম।
  • Sayantani Putatunda | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:১৪45943
  • শঙ্খ, চেষ্টা করবো ভাই। সবাইকে ধন্যবাদ। :)
  • khilli | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:২০45944
  • জ্জিও গুরু চালিয়ে খেল
  • de | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:২৯45945
  • সত্যি, লাটুকে বড় পছন্দ হয়েচে! বাকি গপ্পোটা মজার। বিশাল কোন মেসেজ দেওয়ার ছিলোও না -- নেইও - তা নিয়ে কিছু বলারও নেই!
  • কল্লোল | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:৪১45946
  • আমার সিক্যুয়েলে আস্থা নাই। বরম, এটাকে আবার লেখা হোক। আবার আবার আবারো লেখা হোক ও এটি উপন্যাসে রূপান্তরিত হোক। উপন্যাসের সমস্ত উপাদান মজুত আছে থরে ত্থরে। এটি যদি উপন্যাস না হয় তো বাঙ্গলা ভাষার ক্ষতি, এই বলে দিলুম।
  • কল্লোল | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:৪৪45947
  • আমার মনে হয় শিউলি আর লাটুর বাপের মোকালাত দিয়ে শুরু হতে পারে উপন্যাসটি।
  • Sayantani Putatunda | ***:*** | ২৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৮:০০45948
  • :D dekha jaak. tobe osobhyo chokh kintu ei boimelatei dey book store e pawa jabe. novella hisabe. ichchhe korle songrohe rakhte paren. :)
  • কল্লোল | ***:*** | ২৭ নভেম্বর ২০১৩ ০১:০১45949
  • সেটা খুবই ভালো খবর। তবে এট্টু আশাহত হলুম। এটি একটি আরবান নীলকন্ঠ পাখীর খোঁজে হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।
    একই লেখা দুইবার ছাপানো হয় না সাধারণতঃ। তবে এটিকে সাধারণ দিয়ে বিচার না করলেও চলবে।
  • AD | ***:*** | ২৭ নভেম্বর ২০১৩ ০২:৫২45950
  • যাকে বলে টোটাল নোংরা ব্যাপার। পেত্থম দিক তা একটু ঝুল লাগছিল বটে, কিন্তু তারপরে জমে ক্ষীর। পুরো ঘ্যাম চ্যাক মাল নেমেছে।যাকে বলে ফিলিং ফুরফুরে। sequel এর সব উপাদান মজুত তো বটেই তবে বিশেষ করে ওই ইপ্সিতা দি র আঁচল তা বড্ড কান্নাকাটি করছে, ওই ফলের দোকানেই পড়ে আছে কিনা। ফলঅলা ও হা করে সাইজ দেখছে। সেগুলোর কিছু ব্যবস্থা হবে না?
  • debu | ***:*** | ২৮ নভেম্বর ২০১৩ ০৮:০৩45951
  • মারাত্বক ছবি হবে
  • কৌশিক ঘোষ | ১৯ অক্টোবর ২০২১ ০০:৫৮499782
  • অনেকদিন আগে, সে ধরো ছ' সাত বছর তো হবেই, নেট ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় -চন্ডালীর ল-এ দিঘ‍্যির জায়গায় ৯ (লি) অক্ষরটা দেখে সাইটটা খুলেছিলাম। খুলেই সামনে দেখি অসভ‍্য চোখ। লিখেছে কে এক সায়ন্তনী পুততুন্ড, না কি যেন অমনি একটা নাম।
    রাত বাড়ে, বৌ তাড়া দ‍্যায়, আমি আর মনিটরের সামনে থেকে উঠতে পারিনা। পড়ছি। আর ইপ্সিতার বিছানায় কুকুরকে বুকে নিয়ে শুয়ে ডিপ্রেশনে কষ্ট পাওয়া পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই শিওর হয়ে গেছি যে স্লা, লেখক মালটা পুরুষ মানুষ। ছদ্মনামে লিখেছে।
    ছেলের তখন ক্লাস এইট। মেয়ের সিক্স। 
     
    সায়ন্তনী চাঁদের পাহাড় নামান নি। সায়ন্তনী বিষবৃক্ষ বা শেষের কবিতারও লেখক না। কিন্তু গল্পটা ভুলিনি। ক'দিন আগে ভাটিয়ালিতে প্রশ্ন করলাম গল্পটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে। ওঁরা সাহায্য করলেন।
    ছেলেমেয়েকে গল্পটার কথা বলেছিলাম। আজ পড়তে শুরু করার পরে দেখি ছেলের হোএ্যাপে টাইপ করা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়ে চিৎ হয়ে ছিলো, পাশ ফিরে আমার দিকে মুখ করে শুলো। গাঁড় আর বাঞ্চোত জাতীয় শব্দ এতোদিনে আরো ছ' সাত বছর বুড়িয়ে যাওয়া বৌএর মুখে অস্বস্তির ছাপ ফেলছে। 
    শুনতে শুনতে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র ছেলে লাইটার তুলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো, এক সেকেন্ড পরেই ফিরে এসে বললো, "উঁহুঃ, বারান্দা থেকে ভালো শোনা যাচ্ছে না, পরে খাবো, তুমি পড়ো। কিন্তু শেষ না করে ঘুমিয়ে পড়ো না বাবা।"
    ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছেলের মা বললেন, "ইন্টারেস্টিং গল্পটার মাঝখানে ডিস্টার্ব করিস কেন ?" তাকিয়ে দেখি ওঁর মুখে অস্বস্তির মেঘ কেটে গেছে।
    সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী আমার মেয়ে ঘেঁষে এসেছে আমার কোলের কাছে। লাটু এইমাত্র মরতে মরতে বাঁচলো একটুর জন‍্য। ক‍্যাবলা হলে কি হবে, লাটুর প্রেমিকপ্রবরের বুদ্ধি তার প্রেয়সীর বিপদের সময় কাজ করেছে ঠিকঠাক।
    আমাদের এখন কফি ব্রেক। লাটুর দু'হাত বিশুর হাতে। কফি শেষ করে ছেলেমেয়েকে আর তাদের মা-কে শোনাবো সুব্রতদা কিভাবে ধরা পড়লো অসভ‍্য চোখ হিসেবে।
     
    সায়ন্তনী, এতো বছর পরেও লাটুকে ভুলিনি। আমি জানি আমার ছেলেও ভুলবে না।
    সায়ন্তনী, আপনি আপনার পাঠকদের ভুলে গেলেন কি করে ? আর লিখলেন না তো !
  • Nirmalya Nag | ২০ অক্টোবর ২০২১ ১৪:১৮499877
  • জাস্ট যা তা হয়েছে, পুরো রাপচিক। 
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন