এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কাঁটা রিভিজিটেড

    Sayantani Putatunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১২৭৭৪ বার পঠিত
  • কাঁটা রিভিজেটেড
    সায়ন্তনী পূততুন্ড

    আবার ডানকুনিতে ট্রাক চালকের রহস্যময় মৃত্যু—ডানকুনি জংশন মরণফাঁদ

    নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গভীর রাতে ডানকুনির শুনশান রাস্তায় পাওয়া গেল আরেক ট্রাক চালকের মৃতদেহ। এই নিয়ে তৃতীয়বার কোনও হতভাগ্য ট্রাকচালকের মৃত্যু ঘটল অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে। মৃত্যুর কারণ এখনও অজানা। এভাবে একের পর এক, লাগাতার ট্রাক ডাইভারেরা কেন খুন হচ্ছে, কিভাবেই বা খুন হচ্ছে সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। সি আই ডি অফিসাররা এ বিষয়ে কোনও আলোকপাত করতে পারেননি। তদন্তকারী অফিসার দেবাশিস জানা জানিয়েছেন ‘তদন্ত চলছে। কোনরকম প্রোগ্রেস হলে জানানো হবে’।
    গোপন সূত্রে খবর, সি আই ডির সন্দেহ যে এই অদ্ভুত হত্যাকান্ডের পিছনে কোনও অতি ধূর্ত সাইকো কিলারের মাথা কাজ করছে। যদিও মার্ডার ওয়েপনের খোঁজ পাওয়া যায় নি। বোঝা যায়নি মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ। পূর্ববর্তী মৃতদেহগুলির মতোই এবারেও মৃত ব্যক্তির দেহে কোনও চোট, আঘাত বা রক্তপাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডঃ অসীম চ্যাটার্জী এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে নারাজ। তিনি এককথায় জানালেন—‘দেহের আভ্যন্তরীণ রক্তপাতই প্রতিটি মৃত্যুর কারণ’।

    অন্যদিকে সি আই ডি ডানকুনি নিবাসী স্বর্গীয় কর্ণেল তড়িৎ আচার্যের ভাই তপন আচার্যকে গ্রেফতার করেছে। তাদের দাবি একজন প্রত্যক্ষদর্শী ভদ্রলোককে অকুস্থলে দেখেছে। সেই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের ভিত্তিতেই তপন আচার্যকে গ্রেফতার করা হল। অথচ বহুবছর আগেই একটি মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে তাঁর হাতদুটো কাটা যায়। এই শারীরীকভাবে অক্ষম ভদ্রলোককে সাইকো কিলার হিসাবে সন্দেহ করার কষ্টকল্পনা সি আই ডি কেন করছে তা জানা যায় না। কে তাদের প্রত্যক্ষদর্শী সে বিষয়েও অফিসার দেবাশিষ জানা নিশ্চুপ।

    ডানকুনি অঞ্চল সম্পর্কেও ট্রাক ড্রাইভারদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হাইওয়ে এখন তাদের কাছে মরণ ফাঁদের সমতুল্য। এ সম্পর্কে এক ট্রাক ড্রাইভার শিবনাথ সিং এর বক্তব্য—‘ প্রাণ হাতে করে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হাইওয়ে পার হতে হচ্ছে। পেটের দায়ে ড্রাইভারি তো ছাড়তে পারি না। শুনেছি তিনজন ড্রাইভার এখানে মারা গেছে! তবু কাজ করে যাচ্ছি সাব। চেষ্টা করি ডানকুনি জংশন দিনের বেলাতেই ক্রস করার। কিন্তু সবসময় সম্ভব হয় না। রাত হলেই উপরওয়ালার নাম জপ করতে করতে যাই। সব ড্রাইভারই ভয় পায়। তবু পেটের দায়ে গাড়ি চালায়’।
    ক্রমশই ট্রাক ড্রাইভারদের মধ্যে ডানকুনি জংশনের আতঙ্ক শাখাপ্রশাখা ছড়াতে শুরু করেছে। এভাবে আর কতদিন? এ প্রশ্নের উত্তর সি আই ডি দিতে পারে নি। উত্তর দিলেন শিবনাথ সিং। বললেন—‘ভগবান জানেন’।

    ১.
    --‘কি হবে তা ঈশ্বরই জানেন অসীম, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’। পাব্লিক প্রসিকিউটার বিকাশ সেনগুপ্ত ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ অসীম চ্যাটার্জীর দিকে অসহায় ভাবে তাকালেন—‘ এ কেস কোর্টে দাঁড়াবেই না! দু মিনিটেই ডিফেন্স লয়্যার লোকটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। মোটিভ নেই, মার্ডার ওয়েপন্‌ নেই, শুধুমাত্র একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে কতক্ষণ টানবো? তুমি কিছু হেল্প করো প্লিজ’।

    ডঃ অসীম চ্যাটার্জী তদন্তকারী সি আই ডি অফিসার দেবাশিষ জানার দিকে তাকান। সেও উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। বেচারার উপর প্রচুর চাপ। তপন আচার্যর মত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে গ্রেফতার করে বিপদে পড়েছে। এখন যদি ভদ্রলোক বেকসুর খালাস পেয়ে যান, তবে তার বিরুদ্ধে নির্ঘাৎ মানহানির মোকদ্দমা ঠুকবেন। উল্টোদিকে উপরওয়ালা ভ্রূকুটি করে বলবেন—‘কেসটা ঠিকমত সাজাওনি বলেই লোকটা ছাড়া পেয়ে গেল। তুমি একটি অপদার্থ!’
    অগত্যা সে ও ডঃ অসীম চ্যাটার্জীর শরণাপন্ন হয়েছে।
    --‘আমার কাছে কি চাও?...হ্যাঁ...হাঁ...হ্যাঁ-চ্ছু-উ-উ-উ!’ বলতে বলতেই একখানা পেল্লায় হাঁচি হেঁচে ফেললেন ডঃ চ্যাটার্জী। তার আবার নাক মোছার স্টাইলটা ভয়ঙ্কর। সে স্টাইল দেখে পাবলিক প্রসিকিউটার এবং তদন্তকারী অফিসার প্রায় তুরীয় দশায় অবতীর্ণ হতেই চলেছিলেন। তার আগেই ফোঁৎ ফোঁৎ করতে করতে বললেন—‘আমি এই বুড়ো বয়েসে গোয়েন্দা গিরি করতে পারি না! যেটুকু করার করে দিয়েছি। ফরেনসিক রিপোর্ট তোমাদের হাতে আছে’।
    --‘কিন্তু স্যার...’ দেবাশিষ বলে—‘সেটুকু যথেষ্ট নয়। আপনার রিপোর্টে যা আছে তা দিয়ে তপন আচার্যর বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করা যাবে না! আপনি মৃত্যুর সময়, মৃত্যুর কারণ বলেছেন। কিন্তু মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌? সেটা কি? কি হতে পারে তার কোনও আন্দাজই নেই!’
    --‘গাড়োলের মত তপন আচার্যকে গ্রেফতার করে বসার আগে একথা মনে পড়েনি?’ আক্ষরিক অর্থেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে ওঠেন ডঃ চ্যাটার্জী—‘ লোকটাকে হাজতে পাঠানোর আগে কি আমার সাথে পরামর্শ করেছিলে? যত্তসব মাথামোটার দল। হ্যাঁ-চ্‌-চ্‌-চ্‌-ছো-ওওওও’।
    দেবাশিষ তাঁর কড়া কড়া কথায় বিশেষ পাত্তা দেয়নি। সি আই ডির দরোয়ান থেকে উপরমহলের সকলেই ভদ্রলোকের দাঁত খিঁচুনির সাথে পরিচিত। যিনি কর্তাব্যক্তিদেরও রেয়াত করেন না, তিনি দেবাশিষের মত চুনোপুঁটিকে ‘গাড়োল’ বলতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে ভদ্রলোক কথায় কথায় তার মুখের উপরই হাঁচবেন, সেটা সহ্য করা যায় না!
    সে একটু তফাতে সরে গিয়ে বলল—‘স্যার, টিস্যু দেবো’?
    --‘একটু বিষ দাও—পটাসিয়াম সায়ানাইড!’ ফোঁচ ফোঁচ করে আরও এক সিরিজ হেঁচে নিয়ে অবশেষে বললেন ডঃ চ্যাটার্জী—‘একেই সর্দির চোটে মরছি, তার উপর তোমরা দুই যমদূত এসে প্রায় আমার টাকের উপর উঠে বসে আছো! যেটুকু গ্রে ম্যাটার প্লাজমা সহ এখনও নাক দিয়ে বেরিয়ে যায়নি সেটুকুও ফ্রাই না করে তোমাদের শান্তি নেই। ওঃ’। বলতে বলতেই তিনি টানটান হয়ে সোফার উপরই শুয়ে পড়েছেন। যেন এখনই নির্বিকল্প সমাধি নেবেন।
    পাব্লিক প্রসিকিউটার বিকাশ সেনগুপ্ত বুঝলেন যে দেবাশিষকে দিয়ে হবে না। অসীমকে যতদূর চেনেন তাতে সে বেচারা ঝাড় খেয়ে খেয়েই আজ মরে যাবে। অগত্যা তাঁকেই মাঠে নামতে হল—‘অসীম, সামান্য হেল্প তো তুমি করতেই পারো। অন্তত মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌ সম্পর্কে যদি একটু ধারণাও দিতে পারো, তবে দেবাশিষের কাজ একটু সহজ হয়। ও ভদ্রলোকের ঘর সার্চ করে জিনিসটা বের করতে পারে’।
    --‘কচু পারে’। এবার লাফ মেরে উঠে বসেছেন ডঃ চ্যাটার্জী—‘যদি পারত তাহলে কথাই ছিল না। তোমার কি মনে হয়? ভদ্রলোক ঘরের ডাইনিং টেবিলে অস্ত্রটা সাজিয়ে রেখেছেন? ও জিনিস খোঁজা, আর খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা, একই। ও ওর কম্মো নয়’।
    --‘তবে?’
    --‘ধারালো মাথা লাগবে। এত যখন ইনসিস্ট করছো, তখন বলছি শোনো’। অসীম চ্যাটার্জী সেন্টার টেবিলের কাঁচের নীচ থেকে একগাদা ফটো বের করে এনেছেন। তাঁর এই অদ্ভুত শখ। ইন্টারেস্টিং কেস পেলেই মৃতদেহের ছবি তুলে রাখেন। আর সেগুলো শোভা পায় সেন্টার টেবিলের কাঁচের নীচে! যেন অমূল্য সম্পদ!
    ফটোগুলো সামনে সাজিয়ে বললেন তিনি—‘ছবিতে প্রত্যেকটা লাশের মাথার পিছনের অংশ আছে। যতক্ষণ বডির মাথায় চুল ছিল ততক্ষণ বোঝা যায় নি। কিন্তু আমি মাথা ন্যাড়া করে ছবি তুলেছি। তাই পিঞ্চের দাগটা দেখা যাচ্ছে। খুব মন দিয়ে দেখো, মাথার ঠিক পিছনেই—যেখান থেকে স্পাইনাল কর্ড শুরু হচ্ছে ঠিক তার একটু উপরেই...’।
    দেবাশিষ ও বিকাশ-দুজনেই এনলার্জড ফটো গুলো খুব মন দিয়ে দেখছেন। সত্যিই ঘাড়ের উপরে একটা খুব সূক্ষ্ম সূঁচ ফোটানোর দাগ! সিরিঞ্জ ফোটালে অনেকটা এইরকম দাগ পড়ে।
    --‘শরদিন্দু বাবুর ‘পথের কাঁটা’ বা ‘সজারুর কাঁটা’ পড়েছ?’ তীব্রদৃষ্টিতে দুজনকে মাপলেন তিনি। দুজনের মুখই কেমন বেগুনের মত লম্বাটে হয়ে গেছে! ডঃ চ্যাটার্জী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এই জাতীয় মূর্খ লোকেরা কেন অপরাধজগতে আসে!
    --‘তোমরা পড়োনি—কিন্তু শ্রীযুক্ত, শ্রীল হত্যাকারী মহোদয় পড়েছেন। এবং অ্যাপ্লাই ও করেছেন’। আস্তে আস্তে বললেন—‘ওদুটো গল্প পড়া থাকলে জানতে যে খুন করার জন্য শুধু বন্দুক, পিস্তল, ছুরি-ছোরাই ঘাড়ে করে ঘুরতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। সামান্য একটা গ্রামাফোন পিন বা সজারুর কাঁটা ব্যবহার করেই আস্ত একটা মানুষকে মারা যায়। অবশ্য যদি সেই সূক্ষ্ম জিনিসটা ব্যবহার করার মত দক্ষতা খুনীর থাকে, তবেই এটা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে খুনীর সে দক্ষতা আছে। মানতেই হবে যে লোকটা শিক্ষিত’।
    অফিসার ও পাব্লিক প্রসিকিউটার-দুজনেরই তখন করুণ দশা। অসীম চ্যাটার্জী যে মাঝেমধ্যে হিব্রু ভাষাতেও কথা বলেন তা তাদের জানা ছিল না!
    ডঃ চ্যাটার্জী ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। নাঃ, দুজনের কাউকে দিয়েই হবে না! দুজনই এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন অঙ্কের ক্লাস করতে এসে আকবর আর হিমুর যুদ্ধের বিবরণ শুনছে। অর্থাৎ তিনি কষ্ট করে বৃথাই এত কথা বলে গেলেন! কোনও কথাই এ দুটোর খুলির ভিতরে ঢোকেনি।
    --‘থাক’। তিনি হাল ছেড়ে দিলেন—‘এমনিতেই মহাকাশে চলে গেছ। আর বেশি বললে মঙ্গলগ্রহে গিয়ে থামবে! খুলি দুটো তোমাদের সুন্দর ঠিকই। কিন্তু তার ভিতরের জিনিসটাকে কেন একটু নাড়াচাড়া করো না, ভেবে পাই না! সোজা কথাতেই আসি। মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌ খুঁজবে বলে যখন উঠে পড়ে লেগেছ, তখন তার সম্ভাব্য বিবরণটাই বলি। জিনিসটা খুব স্লিক, তীক্ষ্ণ, শক্ত...’
    --‘ছুরির মতো?’ দেবাশিষ তার কথার মধ্যেই বলে ওঠে।
    --‘তোমার মাথার মতো নয়!’ অসীম চ্যাটার্জীর ভুরুদুটো জড়ো হয়ে একেবারে শুঁয়োপোকা মূর্তি ধারণ করেছে—‘হলে ঐ জম্মের ভোঁতা জিনিসে লোকের নাকও কাটত না, খুন তো দূর!’
    বিকাশ সেনগুপ্ত চোখের ইশারায় দেবাশিষকে থামতে বললেন। সে চুপ করে যায়। ডঃ চ্যাটার্জী রুমালে একচোট নাক ঝেড়ে নিয়ে ফের বলতে শুরু করলেন—‘গ্রামাফোন পিনের মতোই খানিকটা। কিন্তু গ্রামাফোন পিন নয়। ছোট্ট একটা কাঁটার মত। ম্যাক্সিমাম সেটা দু-ইঞ্চি লম্বা’।
    --‘কাঁটা!...মাত্র দু ইঞ্চি লম্বা কাঁটা দিয়ে খুন!’ দেবাশিষের চোখ প্রায় ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ঠেকেছে।
    --‘তোমাকে ব্ল্যাক ফিল্মের রাণী মুখুজ্যের রোলটা করতে বলা হয়নি’। ডঃ চ্যাটার্জী গম্ভীর ভাবে বলেন—‘মাত্র বলছ কাকে? একটা ছোট্ট কাঁটাই আস্ত জ্যান্ত হাট্টা কাট্টা লোককে যমের দোরে পাঠানোর জন্য যথেষ্ট। শুধু জানা দরকার যে সেটা কোন পয়েন্টে ফোটাতে হবে। সেখানেই খুনী মাস্টার স্ট্রোক খেলে দিয়েছে। শরদিন্দুবাবু হার্টে কাঁটা ফুটিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিলেন। এ আবার আরেক কদম এগিয়ে স্ট্রেট মেডালা অবলাঙ্গেটায় কাঁটা ফুটিয়েছে। তার মানে বোঝো, লোকটার কি মারাত্মক দক্ষতা! এক ধাক্কাতেই একেবারে চামড়া, মাংস ভেদ করে কাঁটা সোজা মেডালা অবলাঙ্গেটায় ঢুকে গেছে। কোথাও ধাক্কা খায়নি! একবার এদিক থেকে ওদিক হয়নি। একদম অব্যর্থ নিশানা! মাখনের মত মসৃণ!’
    --‘কিন্তু কাঁটাই কেন? পিন, এমনকি সূঁচও তো হতে পারে’।
    বিকাশবাবুর কথায় মাথা নাড়লেন তিনি—‘মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। মেডালায় একটা সূঁচ ফোটালেও মানুষ শুধু তার শকেই মরে যেতে পারে। কিন্তু খুনী কোনও মেটালিক জিনিস ইউজ করেনি। কোনও প্রাণীর কাঁটাই ব্যবহৃত হয়েছে। তাও অমেরুদন্ডী প্রাণীর!’
    পাবলিক প্রসিকিউটার তার অভ্যাসবশতই প্রায় লাফিয়ে ওঠেন—‘অবজেকশন...অমেরুদন্ডী প্রাণীর কাঁটা থাকবে কি করে? যার স্পাইনাল কর্ডই নেই তার কাঁটা থাকা অসম্ভব!’
    --‘অবজেকশন ওভাররুলড উকিল বাবু’। ডঃ চ্যাটার্জী হাসেন—‘একদিনেই আপনি প্রকৃতির সমস্ত খামখেয়ালিপনা বুঝবেন কি করে? অমেরুদন্ডী প্রাণীর ও কাঁটা থাকে। এমনকি তার রক্তে হিমোসায়ানিনও থাকতে পারে!’
    --‘বাট্‌...’
    --‘বাটের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ওনলি ফরেনসিক সায়েন্স’। তিনি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন—‘প্রথম দুটো কেসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়নি। অস্ত্রটা সম্পর্কে আমারও একটু কৌতুহল ছিল। তাই প্রত্যেকবার ক্ষত’র ভেতরের ক্লটেড রক্ত, চামড়া নিয়ে পরীক্ষা করছিলাম। এবার ফাট্‌কাটা লেগে গেল। উন্ডের ক্লটেড ব্লাড স্যাম্পেল পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি জমে থাকা ব্লাডের ভিতরে ফরেন স্যাম্পল আছে! মানুষের ব্লাড ছাড়া অন্য প্রাণীর ব্লাডও আছে। স্যাম্পলে হিমোসায়ানিনের ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে! হিমোসায়ানিন কোনও মানুষের রক্তে থাকে না। সুতরাং বোঝা গেল ওটা বাইরে থেকে এসেছে। সম্ভবত অস্ত্রটা থেকেই ব্লাড ট্রেস কোনও ভাবে লেগে গেছে’।
    --‘কিন্তু অমেরুদন্ডী কিভাবে বুঝলে......!’
    --‘ওটা তেমন সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার কিছু নয়। ক্লটেড ফরেন ব্লাড স্যাম্পল থেকে ডি এন এ সিকোয়েন্সিং করতে হয় প্রথমে, এবার সেই তথ্য থেকে কতগুলো স্পেসিফিক সিকোয়েন্স সিলেক্ট করে অ্যালাইনমেন্ট টুলের সাহায্যে ওটার ফাইলোজেনি ডিটারমাইন্ড করলাম । প্রথমে জানা গেল যে কাঁটার মালিক আর্থ্রোপোডার ম্যান্ডিবুলাটা ফাইলামভুক্ত। ক্লাস-মেরোস্টোমাটা। এবার আর্থ্রোপোডা কি সেটাও বুঝিয়ে বলতে হবে?’
    --‘পতঙ্গ!’ বিকাশ সেনগুপ্ত স্তম্ভিতভাবে বললেন—‘একটা পতঙ্গের কাঁটা এত শক্ত!’
    --‘হ্যাঁ’। ডঃ চ্যাটার্জী হাসছেন—‘ কাঁটাটা ম্যাক্সিমাম দু ইঞ্চি লম্বা। মার্ডারার মাথা খেলিয়েছে বলতে হবে। আর এমন অস্ত্র ব্যবহার করেছে যেটা খুঁজে পাওয়াই কঠিন! সজারুর কাঁটা বা গ্রামাফোন পিনের মতোই অভিনব কিছু। কিন্তু কথা হচ্ছে, সেটা কিসের কাঁটা?’
    --‘মাছের কাঁটা হতে পারে’। দেবাশিষ এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার আলটপকা মন্তব্য করে বসল—‘তপন আচার্যের কিন্তু সুন্দরবনে মাছের ভেড়ি আছে’।
    --‘অত সহজ হলে তো হয়েই গিয়েছিল’। ডঃ চ্যাটার্জী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন—‘মাছকে পতঙ্গ বলে মনে হয় তোমার? বিকাশ, এটাকে কোথা থেকে আমদানি করেছ? এক্ষুণি যাদুঘরে রেখে এসো...’।
    --‘আহা, অসীম...’। বিকাশ সেনগুপ্ত তাঁকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন—‘নতুন ছেলে। একেই চাপে আছে। তার উপর তুমি আবার ঘাবড়ে দিচ্ছ...’।
    --‘আমি ঘাবড়ে দিচ্ছি!’ তিনি উত্তেজিত—‘বরং আমারই মনে হচ্ছে যে এতদিন যা পড়ে এসেছি তা সব ভুল! মাছ পতঙ্গ! ওঃ ভগবান!’
    --‘ও সব ছাড়ো’। পাব্লিক প্রসিকিউটার প্রসঙ্গ পাল্টালেন—‘এতদূর পর্যন্ত যখন এগিয়েছ, তখন ওটা কিসের কাঁটা তা কোনভাবে বের করতে পারো না? তোমার পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। কেউ পারলে তুমিই পারবে’।
    এইবার ওষুধ ধরল। কিঞ্চিৎ তৈল প্রদানে নরম হলেন ডঃ চ্যাটার্জী। মৃদু হাসলেন—‘হ্যাঁ। বের করিনি কে বলল? বললাম তো, যে ফাইলোজেনি ডিটারমাইন্ড করেছি’।
    --‘ বের করেছ?’ বিকাশ অবাক—‘তাহলে এতক্ষণ ধরে রহস্য করছো কেন?’
    --‘কারণ আস্ত একটা রাত জেগে যা বের করেছি তা কোনও অপদার্থের হাতে তুলে দিতে ইচ্ছে করে না’। তিনি আলতো হাই তোলেন—‘ যাই হোক, কাঁটার মালিক এক প্রজাতির কাঁকড়া। কিন্তু কোন্‌ প্রজাতির তা বলতে পারবো না। ডাটাবেসে ঐ বিশেষ জাতীয় কাঁকড়া সম্পর্কে কোনও তথ্য ছিল না। এতে আমার কোনও দোষ নেই’।
    কাঁটাওয়ালা কাঁকড়া! দেবাশিষের মুখ শুকনো পাঁপড়ের মত দেখাচ্ছিল। কাঁকড়ার দাঁড়া থাকে তা সে জানে। কিন্তু কাঁটাও থাকতে পারে তা তার কল্পনার উর্ধ্বে।
    --‘ডাটাবেসে না থাকলে তুমি সেটা খুঁজে বের করতে পারবে না, এ ঢপ অন্য কারুর কাছে মেরো। জিনিসটা কি?’
    ডঃ চ্যাটার্জী আরও ভিজলেন—‘তোমরা শহরের লোকেরা কাঁটাওয়ালা কাঁকড়ার থিওরি শুনেই মুচ্ছো যাচ্ছ। বাকিটুকু বললে তো হার্টফেল করবে...’ বলতে বলতেই দেবাশিষের দিকে তাকালেন—‘কি হে খোকা, স্মেলিংসল্ট দেবো? না এখনই ফেইন্ট হয়ে পড়ার প্ল্যান করছো?’
    বিকাশ বুঝলেন আজ দেবাশিষের কপালে দুঃখ আছে।
    --‘আ-হা! কেন ওর পিছনে লাগছ অসীম?’ তিনি কোনমতে সামলে নিলেন—‘আসল কথাটা বল’।
    --‘রাজকাঁকড়ার নাম শুনেছ?’ ডঃ চ্যাটার্জী একগাল হেসে বললেন—‘শোনোনি নিশ্চয়ই। সুন্দরবনে গুচ্ছ গুচ্ছ পাওয়া যায়। একবার গিয়ে দেখে এসো। ছ’জোড়া পা থাকে। একজোড়া কম্পাউন্ড আই। বর্মে ঢাকা বপু। আর পিছনে লম্বা, শক্ত, তীক্ষ্ণ একটা কাঁটা। দেখার মতই চেহারা বটে। ইংরেজীতে প্রাণীটাকে বলে হর্স শু ক্র্যাব। সাধারণ বৈজ্ঞানিক নাম লিমুলাস পলিফেমাস। তবে ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে যেটা পাওয়া যায় সেটার বৈজ্ঞানিক নামটা আরেকটু খটোমটো। কার্সিনোস্করপিয়াস রোটান্ডিকডা। সেই প্রাণীর কাঁটাই ব্যবহার করেছে খুনী। হল?’
    --‘রাজকাঁকড়ার কাঁটা! সেটাই মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌!’
    --‘নো ডাউট—সেটাই’। আয়েশ করে একটা সিগ্রেট ধরালেন তিনি—‘আন্ডার এস্টিমেট কোরো না। সুন্দরবনের লোকেরা সড়কির মাথায় ঐ কাঁটা লাগিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কুমীর পর্যন্ত মারতে পারে। রোটান্ডিকডার কাঁটা এতটাই শক্ত! সেই জিনিস যদি মানুষের মেডালা অবলাঙ্গেটায় ঢোকে তো মৃত্যু অবধারিত’।
    --‘তপন আচার্য অনায়াসেই তবে ওয়েপ্‌ন্‌টা জোগাড় করতেই পারেন’। এবার দেবাশিষ মুখ খোলে—‘ওনার সুন্দরবনে মাছের ভেড়ি আছে’।
    --‘তা করতে পারেন’। এই প্রথম ডঃ চ্যাটার্জী তার যুক্তি মেনে নিলেন—‘দিস ইজ দ্য ফ্যাক্ট, সুন্দরবনেই রাজকাঁকড়া সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। মাছ ধরার জালে গাদা গাদা ওঠে। যার মাছের ব্যবসা, সে কাঁকড়াও ধরে নিশ্চয়ই। তারপর তার কাঁটাটা কেটে নিয়ে একটু শুকিয়ে নিলে তো কথাই নেই। স্টিং রে’র কাঁটার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে’।
    --‘কিন্তু ভদ্রলোকের বাড়ি সার্চ করে তো তেমন কোনও কাঁটা দেখিনি’। সে আত্মস্থ হয়েই বলে—‘অবশ্য স্টিংরের কাঁটার চাবুক দেখেছি একটা। কিন্তু কাঁকড়ার কাঁটা তো...’
    --‘স্টিংরের কাঁটার চাবুকের কাঁটাগুলো যে স্টিংরে’রই তা তোমায় কে বলল?’
    --‘তপনবাবুই বললেন...’
    --‘তপনবাবু কি যুধিষ্ঠির?’ তিনি ফের সোফায় শুয়ে পড়ে রুমালে নাক ঝাড়ছেন—‘একটা সাজেশন দিই। চাবুকটা তুলে ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে এসো। পরীক্ষা করে দেখি যে ওগুলো স্টিংরে’র কাঁটা না রোটান্ডিকডা’র’।
    --‘থ্যাঙ্কস্‌ স্যার...’। গদগদভাবে বলে দেবাশিষ—‘মেনি মেনি থ্যাঙ্কস’।
    অসীম চ্যাটার্জী স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। ছেলেটার জন্য এই প্রথম তাঁর খারাপ লাগল। বড্ড অল্পেই খুশি হচ্ছে সে। কেসটা অত সহজ নয়। যে কোনও মুহূর্তেই মোড় ঘুরে যেতে পারে উল্টোদিকে, তা এখনও বেচারা জানে না।
    --‘দেবাশিষ...’ তিনি এবার সামান্য সদয় কন্ঠস্বরে বলেন—‘এখনই অত খুশি হয়ো না। ওটা যদি সত্যিই স্টিংরে’র চাবুক হয় তবে তুমি কিন্তু আবার সেই একই অন্ধকারে! যদি তপন আচার্য সত্যিই খুনী হয়ে থাকেন, তবে তাঁর মস্তিষ্কের জোরটাও নেহাৎ ফ্যালনা নয়। যে এরকম একটা অভিনব অস্ত্র বের করতে পারে, সে এত প্রকাশ্যে জিনিসটা রাখবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া যদি ধরেও নিই চাবুকের কাঁটাগুলোই আসল ওয়েপ্‌ন্‌, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। তপন আচার্য জাতে ব্যবসায়ী। ডাক্তারিও পড়েননি। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি অ্যানাটমি এক্সপার্ট নন। তবে মেডালা অবলাঙ্গেটার পজিশন জানলেন কি করে? যদি জেনেও থাকেন, তাহলেও অত স্মুদলি সেখানে একবারেই কাঁটা ফোটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় দুটো কারণে’।
    ডঃ চ্যাটার্জী একটু থামলেন। দেবাশিষ ও বিকাশ দুজনের চোখেই তখন জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
    --‘প্রথমত, এত স্মুদলি আর নিখুঁত ভাবে যে কেউ কাঁটা ফোটাতে পারে না। তিনটে কেসেই কাঁটাটা একবারেই আসল জায়গায় পৌঁছেছে। ভিকটিম নড়াচড়ারও সুযোগ পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই এটা কোনো অ্যানাটমি জানা লোকের কাজ। কোনও নবিশের নয়। দ্বিতীয়ত, যাঁর দুটো হাতের একটাও নেই তিনি কাঁটা ফোটাবেন কি ভাবে? শরদিন্দুবাবুর গল্পে খুনী কখনও বাইসাইকেল, কখনও হাত ব্যবহার করেছিল। যার হাত নেই সে কোন্‌ প্রসিডিওর নেবে? বাইসাইকেল, রিভলবার, স্প্রিংগান---কিছুই তার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। আর শুধু অস্ত্রের তীক্ষ্ণতা নয়, ভেলোসিটিটাও ম্যাটার করে। ঘাড়ের চামড়া, মাংস চিরে ঢুকে যাওয়ার মত ভেলোসিটি কাঁটাটা পেল কোথা থেকে?’
    দেবাশিষ মুখ চুন করে বসে থাকে। এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। তার শুকনো মুখ দেখে এবার সত্যিই করুণা হল ডঃ চ্যাটার্জীর।
    --‘তুমি আলটপকা ঐ ভদ্রলোককেই গ্রেফতার করে বসলে কেন বল দেখি?’ তিনি জানতে চান—‘খবরের কাগজে দেখছি বারবার বলা হচ্ছে একজন প্রত্যক্ষদর্শী আছে। কিন্তু তাকে তো এখনও চোখে দেখলাম না! কে সে? কি দেখেছে?’
    --‘দেখবেন স্যার?’ সে উৎসাহিত—‘নীচেই বসিয়ে এসেছি। যদি অনুমতি দেন তো ডেকে আনি’।
    --‘অফকোর্স’।
    দেবাশিষ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল।
    --‘কি মনে হয় অসীম?’ বিকাশ ডঃ চ্যাটার্জীর দিকে তাকালেন—‘আশার আলো কিছু আছে?’
    --‘আমি খুব আশাবাদী নই’। তিনি আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন—‘রাজকাঁকড়ার কাঁটা অবধি পৌঁছনো যত সহজ, খুনী অবধি পৌঁছনো ততটাই কঠিন। খুনীর ক্যারেক্টার যা বুঝেছি তাতে সে যথেষ্ট চালু, ঠান্ডা মাথার বদমায়েশ। সহজে ধরা দেবে না। এই ম্যাদামারা অফিসারটির কাজ নয়। একমাত্র একটি মহাত্যাঁদড়, ঝকঝকে মস্তিষ্কের অধিকারী ও ততোধিক ঠান্ডা মাথার বদমায়েশ অফিসারই টেক্কা মারতে পারে এ কেসে’।
    পাবলিক প্রসিকিউটার হাসলেন—‘মহাত্যাঁদড়, বুদ্ধিমান আর ঠান্ডা মাথার বদমায়েশ অফিসার বলতে কি আই জি অধিরাজ ব্যানার্জীকে বোঝাচ্ছ?
    --‘ঐ তিনটে বিশেষণ আর কারুর ক্ষেত্রে এত পারফেক্ট নয়’। তিনি বললেন—‘কখনও দেখেছ অধিরাজকে?’
    --‘নাঃ। দেখবো কোথায়? তিনি তো উপরতলার লোক। সহজে তাঁকে দেখা যায় না। তবে কীর্তিকলাপ শুনেছি। সি আই ডির মির্যাাক্‌ল্‌ ম্যান’।
    --‘আঃ, শুধু শুনেছ?...দেখোনি?’ ডঃ চ্যাটার্জী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন—‘তুমি যদি অষ্টমাশ্চর্য দেখে থাকো, তবে অধিরাজকেও দেখেছ! একমাত্র সে-ই পারে এই কেসে মির্যাকক্‌ল্‌ ঘটাতে। আর কারুর সাধ্য নয়’।
    --‘কিন্তু তিনি কি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাইবেন? দেবাশিষকেই চেনেন কিনা কে জানে! আর তাঁর আন্ডারে এমন কেস গুচ্ছ গুচ্ছ পড়ে আছে। সেসব ছেড়ে কি...?’
    --‘মাথা ঘামাতে পারবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া সে বোধহয় এখন এখানেও নেই। মাউন্টেনিয়ারিং করতে গেছে’। তাঁর কন্ঠস্বরে হতাশা—‘সেইজন্যই বলছি—আশাবাদী নই’।
    দুটো জুতোর আওয়াজ শুনে ডঃ চ্যাটার্জী কথাটা বলতে বলতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়েছেন। প্রথমেই চোখে পড়ল দেবাশিষকে। সে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাকে যেন বলছে—‘এসো, ভয় কি?’
    কৌতুহলে তাঁর চোখ কুঁচকে গেছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দেবাশিষের সাথে যে সসঙ্কোচে ঘরে ঢুকল তাকে দেখেই চক্ষুস্থির! তিনি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বিস্ময়মাখা গলায় বলেন—‘এই তোমার প্রত্যক্ষদর্শী!’
    --‘ইয়েস স্যার’।
    ডঃ চ্যাটার্জী কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষদর্শীটির দিকে দেখলেন। কি যেন মনে মনে ভাবছেন।
    --‘আই উইদ্‌ড্র বিকাশ’। তিনি আস্তে আস্তে বলেন—‘ আমি ভুল বলেছিলাম। অধিরাজ এই কেসটায় মাথা ঘামাবে। ঈশ্বর তোমাদের সাথে রয়েছেন’।
    বিকাশ অবাক—‘কেন? হঠাৎ করে তাঁর ইন্টারেস্টের কি এমন বস্তু খুঁজে পেলে তুমি?¬¬¬’
    ডঃ চ্যাটার্জী নতুন মানুষটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন—‘ঐ যে। ও একাই অধিরাজকে মাথা ঘামাতে বাধ্য করার জন্য যথেষ্ট। ফিলোজফিক্যাল ব্যাপার। তুমি বুঝবে না’।

    ২.

    ফরেনসিক ল্যাবে তখন নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ছিল!
    ডঃ চ্যাটার্জী উপস্থিত না থাকলে ল্যাব এমনিতে শান্তই থাকে। সবাই একমনে নিজের কাজ করে যায়। যন্ত্রপাতির টুংটাং শব্দ ছাড়া আর বিশেষ কোনও শব্দ থাকে না।
    কিন্তু ভদ্রলোক থাকলেই বিপদ! পান থেকে চুন খসলেই তাঁর মেজাজের চোটে টেঁকা যায় না। লম্ফঝম্প করে, গরগর করতে করতে সবাইকেই প্রায় কাঁটা করে তোলেন। এই মুহূর্তে তাঁকে ল্যাবের ভিতরে দেখা যাচ্ছে না। তাই ল্যাব সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।
    তাঁর নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাদা অ্যাপ্রণ পরে ব্লাড ট্রেস বের করার জন্য ল্যুমিনল টেস্ট করছিল। ল্যুমিনল পাউডার, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আর হাইড্রক্সাইড মিশিয়ে একটা সলিউশন তৈরি করা হয়। রক্তের হিমোগ্লোবিনে যে আয়রন থাকে তার টাচে এই সলিউশন এলেই নীল রঙের দাগ ছাড়ে। দাগটা ত্রিশ সেকেন্ড অবধি স্থায়ী হয়। খুব সামান্য রক্তের দাগ থাকলেও ল্যুমিনল টেস্টে অব্যর্থভাবে ধরা পড়ে।
    মুখ নীচু করে সে সলিউশনটাই তৈরি করতে ব্যস্ত। চতুর্দিকে শুধু টেস্টটিউবের টুংটাং। আর জল গরম করার টগবগ।
    তার মধ্যেই হঠাৎ একটা ব্যারিটোন ভলিউম শুনে ঘাবড়ে গেল সে।
    --‘ডঃ চ্যাটার্জী আছেন?’
    বেচারা মুখ তুলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতভম্ব হয়ে যায়। গ্রীক পুরাণ থেকে তরুণ অ্যাপোলো সামনে নেমে এসেছেন নাকি! একটা চমৎকার দীর্ঘ চেহারা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মসৃণ বাদামী রঙের ত্বক, গ্রীক ভাস্কর্যের মত শরীরের গড়ন। লোকটার চোখদুটো অপূর্ব। ছেলেদের চোখের পাতা এত ঘন হতে পারে তা তার জানা ছিল না। চাউনিটা বেশ রাগী রাগী! অথচ একদম চোখা চোখা ধারালো মুখে কমনীয় ছেলেমানুষী হাসি। কয়েকমুহূর্তের জন্য মনে হল মানুষ নয়, তার সামনে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর নতুন কোনও ভাস্কর্য এসে দাঁড়িয়েছে।
    অ্যাপোলো তার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত উত্তরের অপেক্ষা করছেন। মুগ্ধতায় সে বেচারার বাক্‌শক্তি হারিয়ে গিয়েছিল। কোনমতে মাথা নেড়ে জানায়—‘জানি না...!’
    গ্রীক দেবতার দয়া হল। ব্যারিটোন ভলিউমেই ফের বললেন—‘নতুন নাকি?’
    সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
    তার কাঁধে হাত রাখলেন অ্যাপোলো—‘বুঝেছি। আর বলতে হবে না। আমি নিজেই ডঃ চ্যাটার্জীকে খুঁজে নিচ্ছি। জাস্ট এক সেকেন্ড’।
    বলতে বলতেই ঐ বাজখাঁই গলায় হাঁক পাড়লেন—‘দু-র্বা-সা! দু—র্বা–সা—কোথায়?’
    কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপরই সাঁই করে পিছনদিক থেকে তাঁর মাথা লক্ষ্য করে একটা কাঁচের পেপারওয়েট উড়ে এল। অ্যাপোলোর চোখ তখনও সামনেই স্থির। কিন্তু অদ্ভুত কৌশলে মাথার পিছনে হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলেছেন উড়ে আসা জিনিসটাকে।
    বেচারা অ্যাসিস্ট্যান্টের চোখ ছানাবড়া! কি রিফ্লেক্স লোকটার! একেবারে চিতার ক্ষিপ্রতায় ধরে ফেলল পেপারওয়েটটাকে!
    --‘গুড ক্যাচ—তাই না?’ হাসতে হাসতেই বললেন দেবতা—‘এনি ওয়ে...থ্যাঙ্কস। ডঃ চ্যাটার্জী পিছনে...আই মিন, তাঁর কেবিনেই আছেন’।
    লম্বা লম্বা পা ফেলে চতুর্দিক আলো করে গটগটিয়ে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সে তখনও হাঁ করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। তার পাশের সহকর্মীটি অভ্যস্ত হাতে নিজের কাজ করছিল। কোনমতে তাকে জিজ্ঞাসা করল—‘উনি...উনি কে?’
    --‘চেনো না?’ পাশের লোকটি ঠান্ডা গলায় বলে—‘উনি আই জি, সি আই ডি, অধিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখে রাখো। এ এলাকার অন্যতম দর্শনীয় বস্তু’।
    দর্শনীয় বস্তুই বটে!

    স্তম্ভিত লোকটাকে পিছনে ফেলে গট্‌গট্‌ করে ডঃ চ্যাটার্জীর পার্সোনাল কেবিনে ঢুকে পড়ে অধিরাজ। এদিক থেকেই উড়ে গিয়েছিল পেপারওয়েটটা। সুতরাং এখানেই ফরেনসিক এক্সপার্টের উপস্থিতি অবধারিত। ঐ একজন ছাড়া আর কেউ ‘দুর্বাসা’ বিশেষণ শুনে তার মাথা ফাটানোর চেষ্টা করবে না।
    --‘আপনার শখের টাক গড়ের মাঠ হতে পারে। কিন্তু আমার মাথাটা যে চাঁদমারি, সে তথ্য আপনাকে কে দিল ডঃ...—একি! ’
    প্রথম কথাটা ডঃ চ্যাটার্জীকে লক্ষ্য করেই। কিন্তু পরের বিস্ময়সূচক শব্দটা ওঁর অবস্থা দেখে। অধিরাজ কেবিনের ভিতরে ঢুকে দেখল ডঃ চ্যাটার্জী একটা টাওয়েলে মুখ ঢেকে বসে আছেন! প্রায় ঘোমটায় মুখ ঢেকেই বসে আছেন বলা চলে।
    সে কোন শব্দ না করেই গুটিগুটি গিয়ে বসে পড়ে তাঁর মুখোমুখি। আস্তে আস্তে বলে—‘কয়েকদিন কলকাতায় ছিলাম না। তার মধ্যেই কি এমন কান্ড ঘটিয়েছেন ডক্টর, যে লজ্জায় কাউকে আর মুখ দেখাতে পারছেন না!’
    উত্তরে ডঃ চ্যাটার্জী বুঁ বুঁ করে কি যেন বলেন। অধিরাজ মনে মনে হাসছে। কিন্তু গম্ভীরভাবে বলে—‘কি হয়েছে বলুন তো? বাই এনি চান্স, টাকে চুল গজিয়ে যায় নি তো?’
    আর পারলেন না ভদ্রলোক। সজোরে মুখের উপরের টাওয়েলটাকে ছুঁড়ে ফেলে প্রায় গর্জন করে ওঠেন—‘আই জাস্ট হেট ইউ রাজা। শান্তিতে ভেপারও নিতে দিচ্ছ না! মনে হয় এই মুহূর্তেই তোমায় খুন করি!’
    ডঃ চ্যাটার্জী ভেপার নিচ্ছিলেন! সর্দিটা বড্ড ভোগাচ্ছে। তাই উষ্ণ জলের সাথে ইউক্যালিপ্টাসের নির্যাস মিশিয়ে ধোঁয়া টানছিলেন। কিন্তু অধিরাজের জ্বালায় সব ভোগে গেল।
    সে আধহাত জিভ কাটে—‘উউপ্‌প্‌প্‌স্‌স্‌! সরি...সরি...। অমন ঘোমটা টেনে বসে থাকতে দেখে আমি ভাবলাম বোধহয় কোনওভাবে আপনার প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন লেগেছে। তাই কাউকে মুখ দেখাচ্ছেন না! কি করে বুঝবো যে...’।
    --‘তোমার বুঝেও কাজ নেই’। ডঃ চ্যাটার্জী রাগত গলায় বলেন—‘এসে যে হাজির হয়েছ এই অনেক। এতদিন কি হিমালয়ে ছিলে?’
    --‘ইয়েস’। অধিরাজ হাসছে—‘রক ক্লাইম্বিঙে যে কি সুখ তা যদি জানতেন ডক্টর’।
    --‘আমি আমার বাড়ির সিঁড়ি ক্লাইম্ব করেই খুশী। রক তোমার মাথায় থাক’। চেয়ারটা সজোরে ঠেলে উঠে পড়েছেন তিনি—‘চলো, কাজের জিনিসটা দেখে নাও আগে। ঘটনাগুলো জানো তো?’
    --‘হ্যাঁ। কেস ফাইল অলরেডি পড়ে নিয়েছি’। তার মুখ এবার গম্ভীর হয়ে গেল—‘ সিরিয়াস কেস। তিন তিনটে খুন হয়ে গেছে। ভিকটিমরা প্রত্যেকেই ট্রাক ড্রাইভার। মৃত্যু একইভাবে হয়েছে। একই জায়গায়। একই অস্ত্রে। ওয়েপ্‌ন্‌ হর্স শু ক্র্যাবের কাঁটা। স্বাভাবিক ভাবেই খুনী একই। এ ছাড়া আরও কিছু কমন ফ্যাক্টর থাকলে আপনি বলবেন’।
    --‘কমন ফ্যাক্টর আরও কিছু আছে’। ডঃ চ্যাটার্জী ল্যাবের দিকে এগিয়ে গেলেন—‘এসো, বলছি এবং দেখাচ্ছি’।
    ল্যাবের একটা নির্দিষ্ট টেবিল থেকে কিছু স্ক্যান প্লেট তুলে নিয়েছেন তিনি। ভিউ বক্সে বসিয়ে বললেন—‘দেখো, কাঁটাটা একদম সরাসরি মেডালা অবলাঙ্গেটায় গিয়ে ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। ভিকটিমেরা মারা গেছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। মৃত্যুর সময় কেউই বসে বা শুয়ে ছিল না। থাকলে ইন্সট্যান্ট ডেথের পর রিগর মর্টিসে ধরা পড়ত। মেডালা অবলাঙ্গেটায় কাঁটা ফুটলে মানুষের বসে পড়ার উপায়ও থাকে না। তিনটে বডিই একদম স্ট্রেট ছিল। মাস্‌লে রিগর মর্টিসের ছাপ ছাড়া এমন কোনও ভাঁজ নেই যাতে মনে হয় যে সে নড়াচড়ার চেষ্টা করেছিল। তিনটে কেসেই তাই। আর একদম এক উচ্চতায়। নীচ থেকে উপরের ডাইরেকশনে বা উপর থেকে নীচের দিকে নয়। স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ডিরেকশন’।
    অধিরাজ খুব মন দিয়ে স্ক্যান প্লেট গুলো দেখছিল। চিবুকে হাত রেখে আস্তে আস্তে বলল—‘মানে আপনি বলতে চাইছেন যে নীচ থেকে বা উপর থেকে কাঁটাটা আসেনি। এসেছে সোজাসুজি। অর্থাৎ যদি কোনও লোকের হাত না থাকে তবে পা দিয়ে তার পক্ষে কাঁটা ফোটানো বা ছোঁড়া সম্ভব নয়’।
    --‘এগজ্যাক্টলি। ঠিক তাই’। ডঃ চ্যাটার্জী খুশি হলেন। এইজন্যই এই ছেলেটাকে ভালো লাগে তাঁর। বয়েস ছাব্বিশ সাতাশ হলে কি হবে! বুদ্ধিতে অনেক বয়স্ক অফিসারকেও টেক্কা দেয়। হাঁ করলেই বুঝে যায় হাওড়া বলা হচ্ছে, না হাওয়াই! নিতান্ত ফ্লুকেই সে এত কমবয়েসে আই জি হয়ে বসে নেই!
    --‘তাহলে তো মুশকিল হল! তপন আচার্যের যে আবার হাতই নেই!’ সে চিন্তিতভাবেই বলে—‘দুম্‌ করে ভদ্রলোককে গ্রেফতার করে বসাটা বোধহয় ভুল হল! যাই হোক্‌, প্লিজ কন্টিনিউ ডক্টর’।
    তিনি একতাড়া কাগজ ধরিয়ে দিলেন তাকে—‘আরও একটা মেজর কমন ফ্যাক্টর হচ্ছে—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ভিকটিমের মৃত্যু হয়েছে রাতের খাবার খাওয়ার ঠিক পরেই। প্রত্যেকের পেটে যে খাবার পাওয়া গেছে তা সবে হজম হতে শুরু করেছিল। কিন্তু ইন্সট্যান্ট ডেথের ফলে পাচনতন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে খাবার খুব সামান্য মাত্রাতেই জীর্ণ হয়েছে। এবং আরও একটা কমন ফ্যাক্টর হল—এদের প্রত্যেকের পেটেই অ্যালকোহল পাওয়া গেছে’।
    --‘হুঁ’। চিন্তার আবেশে ডুবে গেছে অধিরাজের চোখ—‘খাবারটা কি জাতীয় তা বলতে পারেন?’
    --‘নিশ্চয়ই পারি’। সোৎসাহে বলেন ডঃ চ্যাটার্জী—‘প্রচুর পরিমাণে তেল, ঘি দেওয়া চর্বিজাতীয় খাদ্য। পরোটা বা রুটি জাতীয় কিছু ছিল। রাইস নয়। কারুর পেটে চিকেন পাওয়া গেছে, কারুর পেটে আবার পনীরের ট্রেস, তার সাথে প্রচুর মটরশুঁটি, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা’।
    --‘মটরপনীর! পরোটা! তেল, ঘি দেওয়া খাবার! পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা!’ সে আপনমনেই বিড়বিড় করে যেন অঙ্ক মেলাচ্ছে—‘পাঞ্জাবী খাবার। মানে পাঞ্জাবী ধাবা! খুনীর বেস অব অপারেশন পাঞ্জাবী ধাবা!’
    তার কথাগুলো শুনে চমৎকৃত হলেন ফরেনসিক এক্সপার্ট! এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল কি করে ও!
    --‘স্রেফ দুয়ে দুয়ে চার ডক্‌’। অধিরাজ আপনমনেই বলে—‘অন্য খাবারে তেল, ঘি, মশলা তেমন থাকে না। বাঙালি ভাত মাছের হোটেল হলে কারুর না কারুর খাদ্যতালিকায় ভাত বা মাছ থাকত। পনীরের তরকারি সাধারণ বাঙালি হোটেলে পাওয়া যায় না। এরা সব ট্রাক ডাইভার—কোনও মাল্টিকুইজিন রেস্টোর্যা ন্টে খেয়ে পয়সা গচ্চা দেবে না। অতএব আপনার বলা খাদ্যতালিকা একমাত্র পাঞ্জাবী ধাবায় পাওয়া যেতে পারে’।
    --‘কিন্তু ওটাই বেস অব অপারেশন কেন?’
    --‘সিম্প্‌ল্‌। আপনার রিপোর্ট অনুযায়ী ডিনার করার খুব অল্পসময়ের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। আর এটা অন্যতম কমন ফ্যাক্টর’। অধিরাজ চোখ বুঁজে বলে—‘মৃত্যুগুলো খালি পেটেও তো হতে পারত। কিন্তু হয়নি! লোকগুলো ভরপেট খেয়েছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে যে কোনও ধাবাতেই খেয়েছে। কিন্তু তারপর আর ট্রাক অবধি পৌঁছয়নি। অথচ তাদের মৃতদেহগুলো ট্রাকের কাছাকাছিই পাওয়া গেল। তার মানে যা হয়েছে তা ঐ ধাবা থেকে ট্রাক অবধি আসার সময়টুকুতেই ঘটেছে। একই ঘটনা ধাবার দিকে যাওয়ার সময়েও ঘটতে পারত। যে খুন করবে, ভিকটিমের পেট খালি আছে না ভরা, সেটা তার ভাবার বিষয় নয়। অত রাতে রাস্তাও ছিল শুনশান। তবে সে খাওয়ার আগেই শিকারকে মারল না কেন?’
    --‘কেন?’
    --‘কারণ তার আগে খুনী সম্ভাব্য শিকারকে চিনতই না! শিকারকে সে ধাবা থেকেই টার্গেট করেছে। আর এখানেই আপনার আরেকটা কমন ফ্যাক্টরের যৌক্তিকতা। কি দেখে সে টার্গেট করল বিশেষ লোকটিকে? অনেক ড্রাইভারই নিশ্চয়ই সেখানে খায়। তবে এই বিশেষ তিনটে লোকই কেন?’
    ডঃ চ্যাটার্জী টাক চুলকে বললেন—‘হয়তো ঐ তিনটে লোকের মুখ তার পছন্দ হয়নি’।
    অধিরাজ হেসে ফেলেছে—‘ঐ যুক্তিটা আপনার ক্ষেত্রে খাটে। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। খুনী আসলে দেখছিল ট্রাক ড্রাইভারদের মধ্যে কোন জন্‌ নেশাগ্রস্ত। সেইজন্যই তিনজনের পেটেই অ্যালকোহল পেয়েছেন আপনি’।
    ফরেনসিক এক্সপার্ট অবাক হলেন। একদম অকাট্য যুক্তি! অধিরাজ যেন খুনীর মন পড়ছে! প্রত্যেকবারই সে এরকম করে! কি করে পারে ভগবানই জানেন।
    --‘কিন্তু বেছে বেছে নেশাগ্রস্ত ড্রাইভারদের খুন করার কি যুক্তি রাজা? সমাজ সংস্কারের ভূত মাথায় চেপেছে নাকি লোকটার?’
    অধিরাজের মুখে ফের সেই কমনীয় হাসিটা ভেসে ওঠে—‘সমাজ সংস্কার হতেই পারে। কিন্তু তার পাশাপাশি আরও একটা জোরদার যুক্তি থাকার সম্ভাবনা আছে। মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস—প্রতিশোধ, রিভেঞ্জ’।
    সে জিনসের পকেট থেকে একটা খবরের কাগজের কাটিং বের করে এগিয়ে দেয় ডঃ চ্যাটার্জীর দিকে।
    --‘আপনি ফোন করার পরই প্রথম যে কাজটা করেছিলাম তা হল তপন আচার্য সম্পর্কে হোমওয়ার্ক। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। নানা জায়গায় মাছ এক্সপোর্ট করেন। অবিবাহিত। এমনিতে তার জীবনে ইন্টারেস্টিং কিছু নেই। বি কম অবধি পড়েছেন। আপনার কথা অনুযায়ী অ্যানাটমি পড়েননি। কিন্তু সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং সাইড হল তার অ্যাক্সিডেন্টটা’। অধিরাজের মুখে ঠান্ডা হাসিটা লেগেই আছে—‘ ঠিক তিনবছর আগে, তপন আচার্য, কর্নেল তড়িৎ আচার্য-তাদের মা, এবং কর্নেল তড়িৎ আচার্যের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী গাড়ি করেই ফিরছিলেন। ড্রাইভ করছিলেন কর্নেল। এই ডানকুনি জংশনে এসেই তাদের অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে। খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী অসম্ভব জোরে ছুটে আসা একটা বিশালবপু ট্রাকের ধাক্কায় গাড়িটা উলটে যায়। গাড়িতে আগুনও ধরে যায়। তপন আচার্য কোনওমতে জানলা দিয়ে গাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন বলে তিনিই শুধু বেঁচেছেন। বাকি তিনজন মারা গিয়েছিলেন। এমনকি তাদের দেহ এমনভাবেই পুড়ে গিয়েছিল যে শনাক্ত করাই মুস্কিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তপন আচার্য প্রাণে বাঁচলেও হাতদুটো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। মুখ এবং গোটা শরীর বীভৎস ভাবে পুড়েও গিয়েছিল। অনেকদিন হাসপাতালের আই সি ইউতে সঙ্কটজনক অবস্থায় পড়েছিলেন। অবশেষে অনেক যমে মানুষে টানাটানির পর বেঁচে গেলেন। কিন্তু হাতদুটো অ্যাম্পুট করতে হল। ফলস্বরূপ তার দুটো হাতের একটাও নেই। এটা ফ্যাক্ট। তবে এর চেয়েও ইন্টারেস্টিং রিপোর্টারের লেখা শেষ লাইনদুটো। পুলিশের সন্দেহ যে ট্রাক ডাইভার নেশাগ্রস্ত ছিল। এবং ঘটনার পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি!’
    ডঃ চ্যাটার্জী হাঁ করে অধিরাজের প্রত্যেকটা কথা শুনছিলেন। খবরের কাগজের কাটিংটা পড়েও দেখলেন। সে যা বলছে, গোটাটাই সত্যি।
    --‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে ভদ্রলোক এইভাবে তাঁর পরিবারের মৃত্যুর রিভেঞ্জ নিচ্ছেন! প্রত্যেকটি খুনের পিছনে তপন আচার্যেরই হাত আছে’!
    --‘হাত কোনওভাবেই নেই!’ অধিরাজের চোখদুটো চকচক করে ওঠে—‘তবে পা থাকতে পারে। অথবা মাথা থাকারও সম্ভাবনা। যাই হোক না কেন, জোরালো মোটিভ আছে এটা মানতেই হবে। তাছাড়া অকুস্থলে ভদ্রলোককে দেখাও গেছে। তার প্রত্যক্ষদর্শীও আমাদের কাছে আছে। ভাবছি, দুটো ঘটনাই কি কো-ইনসিডেন্স? কো-ইনসিডেন্সের জোর কতদূর হতে পারে!’
    --‘এই কমন ফ্যাক্টর গুলো ছাড়াও আরেকটা কমন ফ্যাক্টর আছে রাজা’। ডঃ চ্যাটার্জী বললেন—‘ যদিও মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। তাই রিপোর্টে লিখিনি। কিন্তু আরেকটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে। তুমি আগুনে পুড়ে যাওয়ার কথা বললে বলে হঠাৎ মনে পড়ে গেল’।
    তিনি টেবিলের ড্রয়ার থেকে কয়েকটা ফটো বের করে এনেছেন। মৃত ব্যক্তির হাতের ছবি। ছবিতে বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাথা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটা ছবিতেই আঙুল দুটোর মাথায় ছ্যাঁকার দাগ! কারুর আঙুলে ফোস্কা পড়েছে। কারুর পড়েনি। কিন্তু ছ্যাঁকার দাগটা তিনজনের আঙুলেই আছে।
    --‘স্ট্রেঞ্জ!...ভেরি স্ট্রেঞ্জ!...’। অন্যমনস্ক হয়ে বিড়বিড় করেই আপনমনে বলে অধিরাজ—‘এক্সট্রিমলি স্ট্রেঞ্জ! ছ্যাঁকার দাগ কেন? মৃত্যুর সাথে এর কোনও সম্পর্ক আছে?’
    --‘নাঃ। কোনও সম্পর্কই নেই’।
    ডঃ চ্যাটার্জীর উত্তরে যেন ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারল না অধিরাজ। তার চোখে সংশয়! সত্যিই কি কোনও সম্পর্ক নেই? তবে তিনজনের হাতেই একরকম ছ্যাঁকার দাগ কেন? সে আস্তে আস্তে গোটা ঘটনাটা মেলানোর চেষ্টা করে। তপন আচার্যকে গ্রেফতার করেছে দেবাশিষ। তাকে অকুস্থলে দেখেছে এমন সাক্ষীও আছে। তার মোটিভও আছে। যে লোকটার গোটা পরিবারই মারা গেল একটা ট্রাক ড্রাইভারের কান্ডজ্ঞানহীনতায়, সে কি কখনও ভুলে যেতে পারে সেই দুর্ঘটনার কথা? যে প্রজাতির জন্য তার জীবন ছারখার হয়ে গেল, শারীরীক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়ল লোকটা, সে কি এত সহজে ক্ষমা করতে পারে? বরং তার মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠাই স্বাভাবিক। যদিও এই প্রতিশোধস্পৃহা কোনভাবেই সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়। কিন্তু যে ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে মানুষটা গিয়েছে, তার পক্ষে এই জিঘাংসা কোনভাবেই অসম্ভব নয়।
    অন্যদিকে আবার দুর্বাসার কথা অনুযায়ী এ কোনও অ্যানাটমি জানা লোকের কাজ। তপন আচার্য অ্যানাটমি জানেন না। হাত ছাড়া এমন ভাবে কার্যোদ্ধার করা সম্ভবও নয়! কাঁটা একদম সরাসরি গিয়েছে। যদি স্প্রিং গান ও ব্যবহার করা হয়, তবে তপন আচার্য সেটা পা দিয়ে ব্যবহার করবেন। সেক্ষেত্রে কাঁটার ডিরেকশন হবে নীচ থেকে উপরের দিকে। ঘটনাচক্রে তা হয়নি। মারণাস্ত্রের অভিমুখ সোজাসুজি ছিল! যদি উনি নিজে কাজটা না করে অন্য কাউকে দিয়েও করিয়ে থাকেন, তবে কাঁটা ফুটিয়ে খুন করবে এমন পেশাদার খুনী কলকাতায় নেই। পেশাদারদের অস্ত্র মূলত বন্দুক। কখনও ছুরি। কিন্তু এমন সূক্ষ্মভাবে খুন কোনও সুপারি কিলার করবে না।
    --‘অস্ত্রটার নমুনা একটা আনিয়ে রেখেছি। দেখবে নাকি?’
    ডঃ চ্যাটার্জীর কথায় তার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে যায়।
    --‘শিওর’।
    রাজকাঁকড়ার একটা কাঁটা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ডঃ চ্যাটার্জী। নমুনা জোগাড় করা খুব কষ্টকর নয়। যারা মূলত মাছের কঙ্কাল, সাপের চামড়া বা হাঙরের খুলি বিক্রি করে, তাদের কাছেই এ জিনিস পাওয়া যায়। এই কাঁটাটা বেশ বড়! প্রায় পাঁচ-ছ ইঞ্চি লম্বা!
    অধিরাজ জিনিসটাকে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। কাঁটার মুখটা দেখলেই ভয় করে। যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনই শক্ত। এই জিনিস মেডালায় ফুটলে আর রক্ষা নেই।
    --‘এত বড় কাঁটা ইউজ করেছে খুনী!’
    --‘কত বড় কাঁটা আর দেখছ!’ ডঃ চ্যাটার্জী তার হাত থেকে নমুনাটা নিয়ে নিয়েছেন—‘এর ডাব্‌ল্‌ সাইজের কাঁটাও থাকে। এটা ছোট কাঁকড়ার কাঁটা। আট ইঞ্চি লম্বা কাঁটা তো কোন ব্যাপারই নয়! তবে খুনী গোটা কাঁটাটা ব্যবহার করেনি। মুখের সরু অথচ সবচেয়ে শার্প অংশটা কেটে নিয়েছে’।
    --‘এ জিনিস কাটা তো চাট্টিখানি কথা নয়!’ সে অবাক—‘এর জন্য রীতিমত করাত লাগবে!’
    --‘অথবা সার্জিক্যাল স’। ডঃ চ্যাটার্জী বললেন—‘সম্ভবত সার্জিক্যাল স দিয়েই কাটা হয়েছে। সাধারণ করাত দিয়ে কাটলে এবড়োখেবড়ো হত। তীক্ষ্ণতাও এত থাকত না। কিন্তু অস্ত্রটার শার্পনেস অবিকৃত’।
    অধিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যে লোকটা খুন করার জন্য এত পরিশ্রম করে তাকে মেডেল দেওয়া উচিৎ। এমন প্রতিভাবান অপরাধী পাওয়াই দুষ্কর!
    --‘আপাতত এইটুকু এভিডেন্সই আছে। এর বেশি জোগাড় করার দায়িত্ব তোমার’।
    সে অন্যমনস্ক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল—‘দেবাশিষ কি স্টিংরে’র হান্টারটা এনে দিয়েছে আপনাকে?’
    --‘হ্যাঁ। কিন্তু ওটা নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। হান্টারের কাঁটাগুলো স্টিংরে’রই। রোটান্ডিকডার নয়’।
    --‘জানতাম’। অধিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে—‘ তবু আমি কিছুতেই তপন আচার্যকে ক্লিন চিট দিতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোথাও একটা কিছু আছে যেটা আমরা ওভারলুক করে যাচ্ছি। রাজকাঁকড়ার কাঁটা জোগাড় করা তার কাছে ছেলেখেলা। নেশাগ্রস্ত ট্রাক ড্রাইভারদের খুন করার মোটিভ যথেষ্টই আছে। লাশগুলো যেখানে পাওয়া গেছে, সেখান থেকে ভদ্রলোকের বাড়ি কয়েক মিনিটের দূরত্বে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী আছে। এবং আমার দৃঢ় ধারণা আমি যদি এই মুহূর্তে স্পটে গিয়ে খুঁজে দেখি, তবে ওনার বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই অন্তত একটা পাঞ্জাবী ধাবা পাবো। দেবাশিষ জেনে হোক্‌, না জেনে হোক্‌ সঠিক লোককেই ধরেছে বলে মনে হয়। তবে গ্রেফতার করার আগে সলিড প্রমাণ জোগাড় করে নেওয়া উচিৎ ছিল’।
    --‘বটে?’ ডঃ চ্যাটার্জীর ভুরু কুঁচকে যায়—‘তাহলে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও। যার দুটো হাতই কাটা-সে কিভাবে সরাসরি মেডালা অবলাঙ্গেটায় কাঁটা ফোটাতে পারে? তুমিই একটু আগে বলেছ, ফরেনসিক রিপোর্ট ও বলছে যে পা দিয়ে অস্ত্রটা চার্জ করা হয়নি। তবে? তাছাড়া যে লোকটা সারাজীবনে অ্যানাটমির ‘অ্যা’ নিয়েও চর্চা করেনি, সে এত সহজে মেডালা অবলাঙ্গেটা খুঁজে পায় কি করে? শুধু তাই নয়, উনি নিশ্চয়ই একটা দুটো কাঁটা নিয়ে মাঠে নামেননি। অন্তত একডজন কাঁটা তার কাছে থাকা উচিৎ। সেগুলো গেল কোথায়? দেবাশিষ অন্তত কমপক্ষে তিনবার ওনার বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে। কাঁটা তো দূর—কাঁকড়ার কোনও ট্রেস পায়নি। এ প্রশ্নের কোনও জবাব আছে?’ তিনি মাথা নাড়লেন—‘আমি এ প্রশ্নগুলো করছি না। ডিফেন্স কাউন্সিল এই প্রশ্নগুলো করবেন। কি উত্তর দেবে তাঁকে?’
    অধিরাজ মনোরম গ্রীবাভঙ্গি করে হাসল। তার দুচোখে কৌতুক ঝিকমিক করছে—‘সেটা আমার উপরই ছেড়ে দিন। ডিফেন্স কাউন্সিলকে ঘোল খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার। আপাতত আমাদের প্রত্যক্ষদর্শীর দর্শন করে আসি। প্রভু কোথায়?’
    --‘নীচের ফ্লোরে। চলো’।
    উপর থেকে নেমে আসতে আসতে অধিরাজ মোবাইলে তার জুনিয়র অফিসার অর্নবকে ফোন করে—‘হ্যাঁ,অর্নব। রেডি?’
    --‘রেডি স্যার’।
    --‘আমাকে জানলায় দেখতে পেলেই অ্যাকশন শুরু করবে। গট ইট্‌?’
    --‘ইয়েস স্যার’।
    কথাগুলো শুনে ডঃ চ্যাটার্জীর ভুরুতে ভাঁজ পড়ল—‘কোন অ্যাকশনের কথা হচ্ছে?’
    সে উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসল।

    ৩.

    ছ বছরের ছেলেটা ম্লান মুখ করে বসেছিল।
    একেই চোখের সামনে বাবার ভয়ানক পরিণতি দেখেছে, তার উপর পুলিশের জেরায় সে বিধ্বস্ত! খাবারে তার রুচি নেই। কাল থেকে তাকে কিছু খাওয়ানো যায়নি। শত চেষ্টাতেও একদানা খাবারও সে মুখে তোলেনি।
    বাচ্চাটা বড় বড় চোখ করে সব দেখছিল। ভাবছিল, এরা তাকে বাবার কাছে যেতে দিচ্ছে না কেন? খালি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেই বা কিজন্য? সে তো সব কথাই বলেছে। ট্রাকে বসে দেখেছিল, ঐ হাতকাটা লোকটা তার বাবার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর তারপরই বাবা মাটির উপর পড়ে গেল! আর কথা বলল না। চোখ মেলে তাকাল না! কবে থেকে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে। তা সত্বেও এরা তাকে ছাড়ে না কেন?
    দেবাশিষ তার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে—‘আজ বড় সাহেব তোমার সাথে কথা বলবেন। সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দেবে, কেমন?’
    ‘বড় সাহেব’ শব্দটা শুনে সে যেন আরও সিঁটিয়ে যায়। এই গোমড়ামুখো লোকগুলোর আবার ‘বড় সাহেব’ও আছে! এরাই এমন ভয়ঙ্কর! বড় সাহেব না জানি আরও কত ভয়ঙ্কর হবেন! তাঁর নাক দিয়ে আগুন বেরোয় কি না কে জানে! বাবা বলত সব বড় সাহেবই নাকি রাবণের মত দেখতে। তাঁরা পারলেই আস্ত লোককে ধরে ধরে মুখে ফেলে চিবোতে শুরু করেন!
    তার ভয় হল, যদি সে সব কথা ঠিকমত বলতে না পারে তবে বোধহয় এই বড়সাহেবও তাকে মুখে ফেলে চিবোবেন। বেচারার অন্তরাত্মা কুঁকড়ে গেল। গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোবার নাম করছে না। কোনমতে বলল—‘জল...’।
    --‘জল পরে খেও। ঐ তো, বড় সাহেব আসছেন’।
    দুটো ভারি জুতোর শব্দ। তারপরই দুজন লোক গট্‌গট্‌ করে ঘরে ঢুকল। এর মধ্যে টাকলু লোকটাকে সে আগে দেখেছে। কিন্তু তার পাশের লম্বা, অল্পবয়সী ঘনচুলওয়ালা লোকটাকে দেখে অবাক হল। কই! এর তো রাবণের মত দশটা মাথা নেই! বরং তার দিকে তাকিয়ে লোকটা ভারি মিষ্টি হাসছে। এই বড়সাহেব!
    বড়সাহেব, তথা অধিরাজ প্রত্যক্ষদর্শীর দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকাল। কি কপাল ছেলেটার! এই বয়েসে বাবাকে হারাল! তার উপর পুলিশি অত্যাচার!
    --‘হি ইজ দ্য ওনলি আই উইটনেস স্যার’। একটা লম্বা স্যালুট ঠুকে দেবাশিষ গদগদ ভাবে বলে—‘আপনি আসবেন আমি ভাবিনি...আমার সৌভাগ্য’।
    সে তখনও বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা দু চোখে বিস্ময় আর ত্রাস মিশিয়ে তাকে দেখছে।
    অধিরাজ মুখে একটা মিষ্টি হাসি মাখিয়ে দেবাশিষের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। বিড়বিড় করে নীচুস্বরে বলল—‘ছেলেটা আগে থেকেই শুকিয়ে আমসি হয়ে আছে। ওকে আর ভয় দেখিও না। স্যালুট পরে ঠুকবে। এখন নর্মাল বিহেভ করো’।
    --‘ওকে স্যার...’।
    --‘স্যার ট্যার বলার দরকার নেই’। সে ছেলেটাকে দেখতে দেখতেই বলে—‘ওর পেটে কিছু পড়েছে? না খালি পেটেই রেখেছ?’
    --‘কাল থেকে কিছু খাচ্ছে না’। দেবাশিষের মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল—‘পরশুও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কাল থেকে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে’।
    --‘সবসময় ডান্ডার সামনে রাখলে গলা দিয়ে খাবার না নামাই স্বাভাবিক। আফটার অল হি ইজ আ কিড’। নীচুস্বরে কথাগুলো বলেই সে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে যায়। ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে আরও কুঁকড়ে গেল। তার ভয়ার্ত দৃষ্টি এদিকে ওদিকে অসহায় ভাবে আশ্রয় খুঁজছে। বলা যায় না! যদি বড়সাহেব তাকে কামড়ে দেন!
    বড়সাহেব কিন্তু তাকে কামড়ালেন না। বরং গায়ের কোটটা খুলে সরিয়ে রাখলেন। তারপর তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন।
    --‘তোমার নাম কি সোনা?’
    বাচ্চাটা ফ্যাকাশে ঠোঁট চাটল। আবার বলল—‘জল’।
    --‘জল খাবে? আচ্ছা’। সে দেবাশিষের দিকে তাকায়। দেবাশিষ একগ্লাস জল নিয়ে এল। ছেলেটা এক চুমুকে সব জলটাই শেষ করে ফেলে। অধিরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। বাচ্চাটার নির্ঘাৎ খিদে পেয়েছে। কিন্তু ভয়ের চোটে বলছে না।
    --‘আমার নাম কি জানো?’ সে পুঁচকিটাকে কোলে তুলে নিয়েছে—‘আমার নাম রাজা। তোমার নাম কি গো?’
    ছেলেটা আস্তে আস্তে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে জানায়—‘আমার নাম বাদশা!’
    --‘বাদশা!’ অধিরাজ তাকে মজাদার ভঙ্গিতে কুর্ণিশ করে—‘ওরে বাবা! আমি রাজা! আপনি বাদশা! সেলাম কবুল করুন জাঁহাপনা!’
    বাদশা এই প্রথম ফিক করে হেসে ফেলে। অতবড় লম্বা লোকটা তাকে সেলাম জানাচ্ছে! হাসি পাওয়ারই কথা!
    --‘তা জাঁহাপনা কাল থেকে কিছু খাননি কেন?’ সে দেবাশিষকে দেখিয়ে বলে—‘ঐ লোকটা আপনাকে খেতে দেয়নি? ভাত মাছ-মাংস কিছু দেয়নি?’
    বাদশা এবার অনেকটা সহজ হয়েছে। সে আস্তে আস্তে বলল—‘আমার খেতে ভালো লাগছে না’।
    --‘তাই তো!’ অধিরাজ চোখ গোল গোল করেছে—‘যে সে লোক নয়! সাক্ষাৎ বাদশা বলে কথা! হুজুরের ভাত মাছ খেতে ভালো লাগবে কেন? এই কে আছ? শিগগিরি জাঁহাপনার জন্য বিরিয়ানির বন্দোবস্ত করো। তার সাথে চাউমিন, কেক, মিষ্টি, চকলেট—আরও যা যা ভালো ভালো জিনিস আছে জলদি জলদি লাও। হুজুরের যেটা মর্জি উনি সেটাই খাবেন। তাড়াতাড়ি করো’।
    অসীম চ্যাটার্জী হাঁ করে গোটা ব্যাপারটাই দেখছিলেন। এই বাচ্চাটা একটু আগেও খাচ্ছিল না! অথচ সে এখন বেশ স্বাভাবিক! হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সম্ভবত খাবে।
    --‘আর রসোগোল্লা...’ বাদশা বায়না ধরল—‘রসোগোল্লা খাব’।
    --‘হ্যাঁ...রসোগোল্লা’। অধিরাজ দেবাশিষের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়েছে—‘রসোগোল্লাও লাও...কুইক’।
    দেবাশিষ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। বড়কর্তার হুকুম যখন হয়েছে তখন তামিল তো করতেই হবে।
    --‘খাবার আসতে তো একটু সময় লাগবে’। বাচ্চাটার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলল সে—‘ততক্ষণ হুজুর কি করবেন? লুডো খেলবেন? কিংবা কানামাছি, লুকোচুরি?’
    --‘লুকোচুরি’।
    অসীম চ্যাটার্জীর বিস্মিত চোখের সামনেই শুরু হল লুকোচুরি খেলা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাদশা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে দৌড়ে দৌড়ে কখনও চেয়ারের পিছনে লুকোচ্ছে। কখনও টেবিলের তলায়। সুরেলা মিষ্টি স্বরে বলছে—‘টু-কি-ই-ই-ই’।
    অধিরাজ তাকে দেখতে পেলেও না দেখার ভান করে। যেন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না এমন ভাব করে চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায়। সে যে জায়গায় লুকিয়ে আছে, সেই জায়গাটাকে সন্তর্পণে বাদ দিয়ে এদিক ওদিক খোঁজে। আর বলে—‘হুজুর কোথায় গেলেন?...কই কোথাও নেই তো!...এখানেও নেই...ওখানেও নেই...’।
    খোঁজার অভিনয় করতে করতেই সে অসাবধানে বাদশার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই বাচ্চাটা কচি কচি হাত দিয়ে তাকে জাপ্টে ধরে। খিলখিল করে হেসে উঠে বলে—‘ধ-প্পা-আ-আ-আ!’
    খেলা চলতে চলতেই চলে এল খাবারও। অধিরাজ দিব্যি হাতা গুটিয়ে তাকে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। বাদশা ফের আবদার করে—‘গল্প বল...’।
    --‘গল্প? আচ্ছা’। সে তাকে খাওয়াতে খাওয়াতেই বলে—‘ তবে শোনো। এক দেশে এক রাজা ছিল’।
    --‘বাদশা’।
    --‘আচ্ছা। এক দেশে এক বাদশা ছিল। তার রাজ্যে ঘোড়া ছিল, হাতি ছিল, বাঘ ছিল...’
    --‘সিংহ ছিল না?’
    --‘হ্যাঁ...সিংহ ও ছিল। গন্ডারও ছিল। আর ছিল এক দুষ্টু ভূত!’
    --‘না...ভূত নয়...’ বাদশা প্রতিবাদ করে—‘রাক্ষস ছিল’।
    --‘না...না... রাক্ষসই ছিল। তারপর একদিন হয়েছে কি...!’
    গল্প শুনতে শুনতেই সে গোটা খাবারটা খেয়ে নিল। ফরেনসিক এক্সপার্ট এবং জুনিয়র অফিসার, দুজনেরই চক্ষু চড়কগাছ! আই জি, সি আইডি একটা বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে, নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন! তার দাবিমত গল্প বলছেন। গল্প বলতে বলতে কখনও হাতির শব্দে ডাকছেন, কখনও বিড়ালের মত মিউমিউ করছেন। বাদশা হাসতে হাসতে তার কোলে গড়াগড়ি দিচ্ছে। চোখ গোল গোল করে মহা উৎসাহে গল্প শুনছে। অন্যদিকে খাবারের প্লেটও আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

    অবশেষে বাদশা আর রাক্ষসের যুদ্ধে বাদশাই জিতল। তারপর মহা সুখে রাজত্ব করতে লাগল। ইতিমধ্যে বাদশার খাওয়াও শেষ।
    অধিরাজ তার মুখ ধুইয়ে এনে চেয়ারে বসায়—‘এবার জাঁহাপনা কি করবেন?’
    --‘ছবি আঁকবো’।
    অসীম চ্যাটার্জী বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করলেন—‘এবার ড্রয়িং ক্লাস শুরু হল’।
    --‘কার ছবি আঁকবে?’
    বাদশা ডঃ চ্যাটার্জীর দিকে দেখায়।
    --‘টাকলুদাদুর ছবি আঁকবে?’ অধিরাজ হাসি চেপে বলে—‘টাকলুদাদু, চেয়ারে বসে পড়ুন। আপনি এখন বাদশার মডেল’।
    ডঃ চ্যাটার্জী মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে গিয়ে চেয়ারে বসলেন। যদিও দেঁতো একটা হাসি তাঁর মুখে লেগে আছে। কিন্তু এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকাচ্ছেন, যেন পারলে এখনই তাকে হাঁড়িতে ফেলে সেদ্ধ করেন!
    বেশ কিছুক্ষণ ছবি আঁকাআঁকি চলল। বেলা অনেকটাই গড়িয়ে এসেছে। বিকেল হতে যায়। দেবাশিষ অধৈর্য হয়ে ওঠে। স্যার এখনও ছেলেটাকে জেরা করছেন না কেন? সমস্ত সময়টা কি ছেলেমানুষী করেই কাটবে! কতক্ষণ চলবে এই ড্রয়িং সেশন!

    প্রায় আধঘন্টা ধরে অনেক ছবি এঁকে ক্লান্ত হয়ে পড়ল বাদশা। অধিরাজ তাকে কোলে তুলে নিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়।
    --‘এবার একটু ঠান্ডা হাওয়া খাওয়া যাক্‌’। বলতে বলতেই সে কাঁচের জানলা খুলে দিয়েছে—‘জাঁহাপনা হাওয়া খেতে ভালোবাসেন না?’
    বাদশা মাথা নাড়ে। ঠান্ডা হাওয়াটা তার ভালো লাগছিল। এসির যান্ত্রিক বদ্ধ পরিবেশে থাকতে থাকতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।
    বাইরে তখন অজস্র মানুষ রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। তার থেকেও বেশি গাড়ির ভিড়। ফুটপাথে বসে হকাররা জিনিস বিক্রি করতেই ব্যস্ত! কেউ কিনছে। কেউ বা আবার নেড়েচেড়ে দেখছে, দরদাম করছে।
    সামনের একটা বিশাল হোর্ডিঙে সুন্দর একটা গাড়ির ছবি। সেদিকে তাকিয়ে আপনমনে হাসল বাদশা। বড় হলে সে এমন একটা গাড়ি চালাবে।
    রাস্তায় তখন মানুষের লম্বা লাইন সিগন্যালে আটকে ছিল। সিগন্যালের রঙ লাল হতেই পিলপিল করে রাস্তা পেরোতে শুরু করল।
    আলস্যভরা চোখে সেদিকে দেখতে দেখতেই সে হঠাৎ আঁৎকে উঠল! ও কি! ভিড়ের মধ্যে সেই লোকটা না! অবিকল সেই লোকটা! দু হাত কাটা! শার্টের হাতা দুটো ঝুলঝুল করে ঝুলছে! এ দিকে পিছন ফিরে রাস্তা পেরোচ্ছে।...এক্ষুণি হয়তো আরেকটা লোক পড়ে যাবে...যেমন তার বাবা পড়ে গিয়েছিল...!
    সে ভয়ার্ত শব্দ করে জাপ্টে ধরল অধিরাজকে। তার বুকে মুখ গুঁজে কাতরভাবে কেঁদে ওঠে। বুকে অসহায় ভাবে মুখ ঘষতে ঘষতে চিৎকার করে ওঠে—‘ঐ লোকটা...ঐ লোকটা...!’
    --‘কি হয়েছে?’ অধিরাজ তার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। এবার তার চোখের উপর চোখ রেখে বলল—‘কে? কাকে দেখেছ? কোন লোকটা?’
    বাদশা আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করে। সে তখন অধিরাজের বুকের মধ্যেই থর্‌থর্‌ করে কাঁপছে—‘ঐ লোকটা...ঐ লোকটা...’।
    অধিরাজ ততক্ষণে মোবাইলের ওয়্যারলেস ব্লুটুথ ইয়ারসেট পড়ে নিয়েছে। বাদশার নির্দেশিত দিকে তাকিয়েই সে আস্তে আস্তে বলে—‘অর্নব। এদিকে একবার ফেরো’।
    রাস্তার লোকটা নির্দেশ পেয়ে এবার এদিকে ফিরেছে। এখান থেকে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। অধিরাজ বাদশার মুখ সেদিকেই ঘুরিয়ে দিয়ে বলল—‘দেখো তো বাবা, সেদিন ঐ লোকটাকেই দেখেছিলে?’
    বাদশা একবার সেদিকে তাকিয়েই আঁকড়ে ধরেছে তাকে—‘হ্যাঁ...ঐ লোকটা...ঐ লোকটাই...!’
    অধিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গেছে। এই বাচ্চাটার বয়ানে বিশেষ কাজের কাজ কিছু হবেনা। সে শুধু হাতকাটা লোকটার পিছনটাই দেখেছে। মুখটা দেখেনি। মুখ দেখলে রাস্তার লোকটা যে আলাদা, সেটা বুঝতে পারত। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে উকিলের সওয়ালের সামনে বিভ্রান্ত হবে। ঠিক যে পদ্ধতিতে সে অর্নবকে শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, তেমনভাবেই বেশ কয়েকটা লোককে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে ডিফেন্স কাউন্সিল। বাদশা সবাইকেই ‘সেই লোক’ বলে শনাক্ত করবে। ওর বয়ান কোর্টে বিবেচিতই হবে না!
    --‘ঠিক আছে। হাত দুটো বের করো’।
    অর্নব তখন শার্টের ভিতর থেকে হাত বের করে ফেলেছে। অধিরাজ সেদিকেই নির্দেশ করে বলে—‘না সোনা, এটা ঐ লোকটা নয়। এই লোকটার হাত আছে। দেখো...’।
    বাদশা একঝলক আবার তাকাল। এবার সে যেন আশ্বস্ত হয়। কিন্তু ধাক্কা থেকে তখনও বেরোতে পারেনি। ক্লান্ত ভঙ্গিতে অধিরাজের কাঁধে মাথা রেখে সে নেতিয়ে পড়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেও।
    আরও কিছুক্ষণ তার সাথে থেকে, তাকে ঘুম পাড়িয়ে বেরিয়ে এল সে। তার সাথে সাথে দেবাশিষ আর ডঃ চ্যাটার্জী।
    --‘দেবাশিষ, বাচ্চাটাকে ধরে আর টানাটানি কোর না। ও বেচারা লোকটার মুখ দেখেনি। শুধু এমন একজনকে দেখেছে, যাকে দেখে ওর মনে হয়েছে যে, লোকটার হাত নেই। কিন্তু ডিফেন্স লয়্যার দু মিনিটেই ওকে হেনস্থা করে প্রমাণ করে দেবে ওর দেখাটা ভুল। অনেক হাতওয়ালা লোককেও দেখার ভুলে হাতকাটা বলে মনে হতে পারে। সুতরাং ওর দেখা লোকটার যে হাত ছিল না—এই বক্তব্যের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই’।
    --‘তবে স্যার...?’
    --‘অন্য রাস্তা ধরতে হবে’। সে আত্মবিশ্বাসী হাসি হাসে—‘ডিফেন্স লয়্যার যাই বলুন, আমি বাচ্চাটার কথাকে উড়িয়ে দিচ্ছি না। ও ঠিকই দেখেছে। লোকটার সত্যিই হাত ছিল না। বাচ্চারা ভগবানের আরেক রূপ। তারা মিথ্যে বলে না। ওর কথাটা আমার কাছে ক্লু। এভিডেন্স নয়’।
    --‘তবে এরপরের স্টেপ?’ ডঃ চ্যাটার্জী উৎসুক।
    সে দেবাশিষের দিকে তাকায়—‘তপন আচার্য কি কাস্টডিতে? না জামিনে আছেন?’
    --‘জামিনে আছেন স্যার। তবে কলকাতা ছেড়ে কোথাও যান নি’।
    অধিরাজ ঘড়ি দেখছে। বিকেল পাঁচটা বাজতে যায়।
    --‘তাহলে এখন তাকে বাড়িতেই পাওয়া যাবে। তাই তো?’ সে ডঃ চ্যাটার্জীর দিকে তাকিয়ে হাসে—‘তাহলে এই ফাঁকে জগন্নাথ দর্শনও করে আসি। বলা যায় না। তার কৃপায় কেসটা সহজও হয়ে যেতে পারে। কি বলেন টাকলুদাদু?’
    অসীম চ্যাটার্জী প্রায় লাফিয়ে ওঠেন—‘ফের আমায় টাকলু বলা! মেরে ফেলবো...কেটে ফেলবো...খু-উ-ন করে ফেলবো...!’

    ৪.

    তপন আচার্যের বাড়িটা বেশ বড়। চট করে দেখলে প্রথমেই পরিত্যক্ত বাড়ি বলে মনে হয়। লোকটার পয়সা কিছু কম নেই। তা সত্বেও বাড়ির মেরামতি কেন করায় না কে জানে। বিরাট রংচটা দেহ নিয়ে গোটা বপুটা দাঁড়িয়ে আছে। জানলা খোলা। অথচ ভেতর থেকে সামান্য আলোর রশ্মিও বাইরে আসছে না। পুরো বাড়িটাই অন্ধকারে ডুবে! যেন এ বাড়ির বাসিন্দারা সারাজীবনে কখনও আলো দেখেনি!
    বাড়ির ঠিক সামনেই একটা বড়সড় আমগাছ দোতলার জানলা অবধি পৌঁছেছে। অধিরাজ খুব মন দিয়ে আমগাছটাকে মাপছিল।
    --‘আমগাছটা কিভাবে দোতলার জানলার কাছে পৌঁছেছে দেখেছ অর্নব?’ সে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে—‘তেমন ওস্তাদ চোর হলে দিব্যি গাছ বেয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। কেউ জানতেও পারবে না!’
    অধিরাজের জুনিয়র অফিসার অর্নব আতঙ্কিত হয়। স্যারকে বেশির ভাগ সময়ে সে—ই অ্যাসিস্ট করে। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভালো। তাই স্যারের মনোভাব সে অনেকের থেকে বেশি ভালো বোঝে। যেমন এখন বুঝল যে, তিনি আমগাছটা দেখে রাখলেন। এরপর প্রয়োজন পড়লে ঐ গাছ বেয়ে চোরের মতন এ বাড়িতে ঢুকতে দ্বিধাও করবেন না! অন্য কেউ হলে এ আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু লোকটার নাম অধিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যে কি পারেন, আর কি পারেন না—তা ঈশ্বরও জানেন না!
    --‘ভদ্রলোক কি বাড়িতে নেই?’ সে শুকনো গলায় বলে—‘ঘরে এত অন্ধকার কেন? কারুর সাড়াশব্দও পাচ্ছি না!’
    --‘ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভা—ই!’ অধিরাজ মুচকি হাসে—‘তুমি দেখছি ‘শোলে’র এ কে হাঙ্গল সাহেবের মতন ডায়লগ দিচ্ছ! যে মানুষটা পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা, শারীরীকভাবে অক্ষম—সে লোকটার ঘরে কি পার্টি চলবে? ‘শোলে’র কথা যখন উঠলই—তখন সঞ্জীবকুমারের ক্যারেক্টারের কথা ভেবে দেখো। যতদূর জানি, ফিল্মে হাত কাটা যাওয়ার পর তিনি আর নাচাগানা করেননি। আমাদের ভদ্রলোকও বাড়িতেই আছেন। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখছ না?’
    --‘তবে?’
    --‘উনি কি স্নিফার ডগ, যে গন্ধ শুঁকেই বুঝবেন আমরা এসেছি’? সে সিগ্রেটটায় শেষ টান দিয়ে ফেলে দেয়—‘কলিংবেল বাজাতে হবে’।
    অর্নব স্যারের হুকুম তামিল করে বাড়ির কলিংবেল বাজায়। বেল বাজাতে গিয়ে রীতিমত কারেন্ট খাওয়ার ভয়ই হচ্ছিল। একেবারে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে কলিংবেলের সুইচটার! তার থেকেও ভয়ানক বেলের শব্দ! বোতাম টিপতেই ভিতরে ‘ক্যাঁও...ক্যাঁও...’ করে কলিংবেল বেজে উঠেছে। শব্দটা শুনেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়।
    --‘এ বাড়িতে একমাত্র একটা পার্টিই হতে পারে। হ্যালুইন পার্টি’। অধিরাজ হাসছে—‘দরজা থেকেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা শুরু হল! বাড়ির মালিকের সাক্ষাৎটাও ভয়াবহই হতে চলেছে। অজ্ঞান হয়ে যেও না অর্নব’।
    উপরওয়ালার খোঁচা খেয়ে অর্নব নির্বিকার মুখেই দাঁড়িয়ে থাকে। এমন ফোড়ন খেয়ে খেয়ে তার হজমক্ষমতা বেড়ে গেছে। সে জানে, স্যারের এটা অদ্ভুত একটা স্বভাব। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিলেও বোধহয় তিনি জহ্লাদের ভুঁড়ি নিয়ে ফোড়ন কাটতে শুরু করবেন। এবং তাকে ডায়েট চার্ট প্রেসক্রাইবও করবেন!
    কলিংবেল বাজানোর ঠিক দু মিনিট বাদে দরজা খুলে গেল। যিনি বেরিয়ে এলেন তিনি নিঃসংশয়ে তপন আচার্যই। লম্বা চেহারা। মাথায় চুল নেই! ভুরু নেই! সারামুখ বীভৎসভাবে পোড়া! চোখদুটো মাছের চোখের মত স্থির! যদি ওনার দুর্ঘটনার কথা জানা না থাকত তবে বোধহয় ‘বাপরে’ বলে লাফিয়েই উঠত অর্নব। বর্তমানে তার লাল মাংস ঠেলে বেরিয়ে আসা দগদগে বীভৎস মুখ দেখে বোঝাই সম্ভব নয়—একসময়ে তাকে ঠিক কেমন দেখতে ছিল।
    ভদ্রলোক আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন। পরণের পাঞ্জাবীর হাতার শূন্যতা দেখে অর্নবের ভয়ই করছিল। স্যার ঠিকই বলেছেন। এ বাড়িতে একমাত্র একটা পার্টিই হতে পারে। হ্যালুইন পার্টি। যেমন ভয়াবহ বাড়ি, তেমনি তার মালিক!
    --‘কি চাই?’ খরখরে উঁচু স্বরে বললেন তপন আচার্য। একটু থেমে স্থির দৃষ্টিতে তাদের দুজনকে দেখলেন। বলা ভালো—মাপলেন!
    অধিরাজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই একটা অদ্ভুত হাসি ভেসে ওঠে ভদ্রলোকের মুখে—‘ওঃ! স্বয়ং আইজি সাহেব! এখানে কি মনে করে! বাড়িটা আরেকবার সার্চ করতে চান বুঝি?’
    অর্নব স্তম্ভিত! তপন আচার্য স্যারকে চেনেন! কি করে চিনলেন! অধিরাজ ব্যানার্জীর নামটা মানুষের কাছে যত পরিচিত, চেহারাটা ঠিক ততটাই অচেনা। কারণ অন্যান্য অফিসারদের মত স্যারকে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশিয়ে দেওয়া যায় না। তার চেহারাটাই আশ্চর্য! যে একবার দেখেছে, সে ঠিক মনে রাখবে।
    সে পাশে তাকাল। অধিরাজও অবাক হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের প্রকাশ তার মুখে নেই।
    --‘ধরে নিন্‌, আবদারটা তেমনই’।
    দুজনেই দুজনকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপছে। তপন আচার্য ফের হাসলেন—‘সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?’
    --‘নাঃ’।
    --‘তবে আমি আমার বাড়ি সার্চ করতে দেবো কেন?’
    অধিরাজের মুখে ছেলেমানুষী হাসিটা ভেসে ওঠে—‘না দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই ছানাটাকে সঙ্গে এনেছি দেখছেন না? ওকে সার্চ ওয়ারেন্ট আনতে পাঠিয়ে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার সাথে একটু প্রেমালাপ করব। আধঘন্টার মধ্যেই অর্নব সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে ফিরে আসবে। এই আধঘন্টায় আপনি আর এমনকি বাঘ মারবেন? হ্যাঁ, কয়েকডজন মশা অবশ্য আপনি আর আমি দুজনেই মারতে পারি।’
    দুজনের মধ্যে ফের দৃষ্টি বিনিময় হল। কুস্তি লড়ার আগে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বীরা পরস্পরকে দেখে নেয়, ঠিক তেমনই দুজনের হাবভাব! এক কথায়—সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
    তপন আচার্যের মুখে বিচিত্র হাসিটা ফুটে উঠছে—‘নাঃ। বাঘ কিম্বা মশা, কোনটাই মারার ক্ষমতা আমার নেই। হাত না থাকার এই ট্র্যাজেডি! আসুন। ভিতরে আসুন’।
    বাড়ির বাইরেটা যতটা ভয়ঙ্কর, ভিতরটা কিন্তু তুলনায় বেশ সুদৃশ্য। সুন্দর মার্বেলের মেঝে, রুচিসম্মত আসবাবে সাজানো ড্রয়িংরুম, পাথরের মূর্তির বিদেশী ভাস্কর্যে আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ছে। ভদ্রলোক বেশ শৌখিন বলেই মনে হয়।
    --‘চমৎকার!’ অধিরাজ মুগ্ধ চোখে মূর্তিগুলো দেখছিল—‘মূর্তিগুলোর মেটিরিয়াল কি? মার্বেল?’
    --‘ঠিকই ধরেছেন। মার্বেলের সাথে গ্র্যানাইটও আছে’। তপন আচার্যের কন্ঠস্বর সুন্দর নয়। তার উপর তিনি যেন একটু হাই পিচেই কথা বলেন—‘ তবে গ্রীক ভাস্কর্যের সৌন্দর্যই আলাদা! আপনার চেহারার তারিফ আগেই শুনেছিলাম, আজ স্বচক্ষে দেখেও নিলাম। সম্ভব হলে আপনাকেই দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতাম। চমৎকার মানাত’।
    কি ভয়াবহ কমপ্লিমেন্ট! অর্নব ভাবছিল, তপনবাবু কি স্যারের চেহারার প্রশংসা করছেন? না, তাকে কাঁটাবিদ্ধ করে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার কথা ভাবছেন! সে দিব্যচোখে দেখল, স্যার যীশুর মত হাত পা ছড়িয়ে তপন আচার্যের বাড়ির দেওয়ালে আটকে আছেন। তার হাতে পায়ে রাজকাঁকড়ার কাঁটা বিঁধে আছে। মাথায় কাঁটার মুকুট!
    অধিরাজ যেন ঠিক তার মনের কথাটাই বলল—‘কি দিয়ে টাঙাতেন? পেরেক টেরেক হলে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। তবে কার্সিনোস্করপিয়াস রোটান্ডিকডার কাঁটার মত অভিনব কিছু হলে প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে পারি’।
    তপন আচার্য সজোরে হেসে উঠেছেন—‘বুঝলাম। আপনি বোধহয় ওই জিনিসই খুঁজছেন। কিন্তু আমার বাড়িতে তো ঐ জিনিস পাবেন না। অর্ডার দিলে আনিয়ে দিতে পারি’।
    --‘আরেকটা জিনিস হলেও আমার আপাতত চলে যাবে’। সে দু চোখে সরল কৌতুক মাখিয়ে বলল—‘একটা সার্জিক্যাল স’।
    তপনবাবুর বীভৎস মুখটা এবার শক্ত হয়ে উঠল। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেছে—‘আমার ভদ্রতার উপর এবার কি একটু বেশি অত্যাচার হয়ে যাচ্ছে না?’
    --‘কি করবো? আমার স্বভাবটাই অত্যাচারী! আহ্লাদী হুলোর মত। কেউ ভদ্রতা দেখালেই মাথায় চড়ে বসি’। অধিরাজ হাসতে হাসতে অর্নবের দিকে তাকায়—‘উপায় নেই গোলাম হোসেন। মিঃ আচার্য আমাদের চা খাওয়াবেন না। অগত্যা লেগে পড়ো’।
    অর্নব তপন আচার্যের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। কি হিংস্র দেখাচ্ছে ভদ্রলোককে! তার সামনে দাঁড়িয়ে স্যার মিষ্টি মিষ্টি হাসছেন। তার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। ভাগ্যিস লোকটার হাত নেই। নয়তো এই মুহূর্তেই স্যারের মস্তবড় ফাঁড়া ছিল।

    এরপর শুরু হল খোঁজাখুঁজি। দেবাশিষ গোটা বাড়িটা তিনবার খুঁজে গেছে। তা সত্বেও অর্নব আলসেমি করল না। সে রীতিমত বাড়ি তোলপাড় করে খুঁজতে শুরু করেছে। দেরাজ, আলমারি তছনছ করল। খাটের তোষক উলটে পালটে, বালিশের ভিতরে হাত দিয়ে, এমনকি দেওয়াল ঠুকে গুপ্ত কুঠুরীর খোঁজ করেও দেখল সে। কিন্তু কোথাও কিছুই নেই। কাঁটা তো দূর, একটা ছোট আলপিনও নেই!
    মোটামুটি গোটা বাড়ির তল্লাশি শেষ করে যখন সে আবার বসার ঘরে ফিরে এল, তখন তপন আচার্য সোফার উপরে বসে ধূমপান করছেন। দুই পায়ের সাহায্যে চুরুট ধরিয়েছেন তিনি! স্যার ঘুরে ঘুরে তার ঘরটা দেখছেন আর প্রশংসা করে যাচ্ছেন। দেওয়ালের একদিকে বিরাট বিরাট কয়েকটা বাঁশি ঝোলানো ছিল। সেগুলোকে দেখে বাঁশি কম, বাঁশ বেশি মনে হয়! ক্ল্যারিওনেট, স্যাক্সোফোনও সাজানো আছে।
    --‘বাঃ! আপনার বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহটা বেশ!’ অধিরাজ দেখতে দেখতেই বলে—‘ক্ল্যারিওনেট, স্যাক্সোফোন কে বাজায়? আপনি?’
    তপন আচার্যের মুখে একটা বর্মী চুরুট। সেটাকে মুখের একপাশে সরিয়ে বললেন—‘কেন? আমি বাজাতে পারি না?’
    --‘কিন্তু আপনার তো হাত...’।
    --‘নেই’। তিনি ভাবলেশহীন ভাবে বললেন—‘তবে পা তো আছে’।
    --‘আপনি পা দিয়ে ফ্লুট, আড়বাঁশি, ক্ল্যারিওনেট, স্যাক্সোফোন সব বাজাতে পারেন!’ অধিরাজ বিস্মিত—‘জাস্ট ভাবা যায় না’।
    --‘শুধু ফ্লুট বাজানো নয়। পা দিয়ে আমি সব কাজই করি। চামচ, কাপ, ডিশ—সব এই পায়েই ধরি, খাই, স্নান করি, স্মোক করি। সব পা দিয়ে করতে পারি আমি’।
    --‘বিশ্বাস হয় না’।
    --‘বিশ্বাস করতে চান?’ ফের সেই তিতো হাসিটা ফিরে এসেছে তার মুখে—‘চলুন আপনার বিশ্বাসের বাউন্ডারিটাকে আরেকটু বাড়ানো যাক্‌’।
    এরপর যা ঘটল তা এককথায় অবিশ্বাস্য! তপন আচার্য পা দিয়েই চুরুটটাকে অ্যাশট্রেতে রেখে দিলেন। তারপর রীতিমত ওস্তাদের মত ক্ল্যারিওনেট, স্যাক্সোফোন, আড়বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন। একবারের জন্যও মনে হল না যে তার হাত নেই! পা এর ব্যবহার যে কখনও কখনও হাতের প্রয়োজনীয়তাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে—তা এই প্রথম অনুভব করল অর্নব। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনে হতে লাগল এ লোকটা পা দিয়ে পারে না, এমন কোনও কাজ নেই! এমনকি হাত দিয়ে মানুষ যা যা করতে পারে, এই ভদ্রলোক বোধহয় পা দিয়ে তার দ্বিগুণ কাজ করতে পারেন!
    তার বাজানো শেষ হলে অধিরাজ আড়বাঁশিটার দিকে হাত বাড়ায়—‘এটা কি পেতে পারি?’
    এরকম উদ্ভট আবদারে তপন আচার্যের মৃত মাছের মত ভাবলেশহীন চোখদুটো কুঁচকে গিয়েছে। যেন প্রতিপক্ষের মতলব বোঝার চেষ্টা করছেন।
    --‘আমারও অনেকদিনের বাঁশি বাজানোর শখ। তাই ভাবছিলাম আপনার বাঁশিটা দিয়েই ট্রেনিং শুরু করি’।
    ভদ্রলোক তার হাতের দিকে তাকিয়েছেন। সি আই ডি অফিসারের হাতে শোভা পাচ্ছে সাদা গ্লাভস্‌।
    --‘ট্রেনিঙের জন্য হাতে গ্লাভস্‌ পরতে হয়, তা এই প্রথম দেখছি’। তপন আচার্য বাঁকা হাসি হাসলেন।
    তার সপ্রতিভ জবাব—‘আফটার অল আপনি গুরুদেব মানুষ। পায়ের ধুলো পেলে বর্তে যাই। বাঁশিটায় আপনার ফুটপ্রিন্ট আর ধুলো, দুটোই আছে। এমন মহামূল্য জিনিস কি আমি নষ্ট হতে দিতে পারি?’
    দুজনেই সমান বিনয়ের নলকূপ! অর্নব টেনিস খেলা দেখার মত একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। দুই খেলোয়াড়ের খেলাই বেশ জমে উঠেছে। এবার গ্র্যান্ডস্লামটা কে জেতে সেটাই দেখার।
    আড়বাঁশিটা নীরবে অধিরাজের দিকে এগিয়ে দিলেন তপন আচার্য—‘নিন্‌’।
    --‘এটা কি ফেরৎযোগ্য?’
    --‘নাঃ’। তার মুখে রহস্যময় হাসি—‘আপনাকে উপহারই দিলাম’।
    --‘থ্যাঙ্কস আ লট’। অধিরাজ সসম্মানে তাকে একটা বাও করে—‘এমন সুন্দর উপহারের পরিবর্তে আপনাকে কি দিতে পারি?’
    তপনবাবু একটা বজ্জাতি মার্কা মিটমিটে হাসি হাসছেন—‘একটা খেলা খেলবেন? একা একা বড্ড বোর হচ্ছি। মনে হয় আপনিই যোগ্যতম লোক’।
    --‘কি জাতীয় খেলা?’
    --‘আপনি বোধহয় সন্দেহ করছেন যে খুনগুলো আমিই করেছি, তাই না?’
    --‘আপনি মহানুভব মানুষ। ঠিকই ধরেছেন’।
    --‘লেটস গো ফর আ ফেয়ার গেম’। তিনি বললেন—‘ আপনার সন্দেহ দূর করে দিচ্ছি। খুনগুলো আমিই করেছি! প্রত্যেকটা খুনই আমার করা। মোটিভ যথারীতি—রিভেঞ্জ! যারা আমার গোটা পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে, আমার এই হাল করেছে—আমি মনে করি না তাদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার আছে। এবং সেজন্য আমার কোনও অনুশোচনা নেই। মেরেছি, বেশ করেছি। পারলে আরও মারবো। ’
    কিছুক্ষণের জন্য অর্নব যেন অসাড় হয়ে গেল। কি বললেন ভদ্রলোক? এইমাত্র যা বললেন তা কি সত্যি? না সে স্বপ্ন দেখছে?
    অধিরাজের মুখের কোনও ভাবান্তর নেই। সে আপনমনেই ভদ্রলোকের চুরুটের বাক্স ঘেঁটেঘুঁটে দেখছে।
    --‘আহা! খাসা বর্মী চুরুট! কোথা থেকে আনিয়েছেন?’
    এবার ভদ্রলোকের মুখে রাগের প্রকাশ ঘটেছে—‘আপনি কি আমাকে ইগনোর করছেন?’
    --‘একদম না। সব শুনছি’। সে একটা বর্মী চুরুট নিয়ে মন দিয়ে শুঁকছে—‘এটা যদি আপনার কনফেশন হত তাহলে অন্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু আপনি আমার কাছে অপরাধ কবুল করছেন না! আর যে জিনিসটা শুরু থেকেই জানি, সেটা বারবার শুনে কি করব? নতুন কিছু বললে বরং কাজের কাজ হত’।
    --‘বেশ, এবার তবে নতুন কিছুই বলি’। তপন আচার্যর মুখে হাসিটা ফের ফিরে এসেছে—‘আপনার ব্লেজারের পকেটে একটা মিনি রেকর্ডার আছে, তা আমি জানি। আপনি বুদ্ধিমান। সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন না, তা অসম্ভব। কিন্তু বড়ই দুঃখের কথা, রেকর্ডারটা আপনাকে এখানেই রেখে যেতে হবে’।
    --‘কেন?’ অধিরাজ বিমর্ষ মুখ করে বলে—‘এত কষ্ট করে রেকর্ড করলাম কি এখানে রেখে যাওয়ার জন্য?’
    --‘আপাতত এখানেই থাক। বরং আসুন, আমরা ভদ্রলোকের মত একটা খেলা খেলি’। তিনি বললেন—‘আমি আমার তরফ থেকে স্বীকার করেছি যে খুনগুলোর দায় আমার। আপনি যদি আপনার তরফ থেকে এই জিনিসটাই প্রমাণ করতে পারেন, খুঁজে বের করতে পারেন মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌, একটা ডাক্তারিশাস্ত্রে অজ্ঞ, অক্ষম লোক কি করে এই জাতীয় খুন করে—কিভাবেই বা করে—সমস্ত ঘটনাকে যুক্তিযুক্ত ভাবে প্রমাণ করে দেখিয়ে দেন, তবে আমিই আপনাকে এই রেকর্ডারটা ফেরৎ দেব। এবং পুলিশের কাছে, কোর্টে নিজের স্বীকারোক্তিও দেবো। নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টাই করবো না। বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিলাম আপনাকে। প্রুভ করুন। ওন্‌লি সেভেন্টি টু আওয়ার্‌স্‌। আর যদি না পারেন, তবে ঠিক বাহাত্তর ঘন্টা পর আপনাকে স্টাফ্‌ড্‌ করে ঐ দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে চাই আমি’। তার চোখমুখ ক্রুর হয়ে ওঠে—‘রোটান্ডিকডার কাঁটা শোভিত করেই রাখব। দিস ইজ মাই ওয়ার্ড টু ইউ’।
    সে স্মিত হাসল—‘বেশ, ভদ্রলোকের মত খেলতে যখন বললেন, তখন তাই হোক্‌’।
    অধিরাজ পকেট থেকে ছোট্ট রেকর্ডারটা বের করে রেখে দেয় ভদ্রলোকের কোলের উপরে—‘বাই দ্য ওয়ে। একটু সাবধানে রাখবেন। এটাতে ব্যাটারি নেই, ইনফ্যাক্ট ক্যাসেটও নেই। আপনি এত কথা বলবেন জানলে অবশ্য দুটোই ভরিয়ে আনতাম। যাই হোক্‌, তা সত্বেও এটার দাম আমার কাছে অনেক’।
    তপন আচার্য পুরো হতভম্ব! তার মুখে এখন আর হাসি নেই। বরং কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
    --‘আমায় এতটা ওভার এস্টিমেট করার জন্য থ্যাঙ্কস এগেইন’। সে আবার নম্রভাবে বাও করে। দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে দেখায়—‘ওখানে মিনিমাম ছ’ফুট চার ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা রাখবেন। ওটাই আমার হাইট!’

    ৫.

    তপন আচার্যের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেও প্রায় মিনিট তিনেক কোনও কথা বলতে পারেনি অর্নব। তার বারবার মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক ঠিক কি জাতীয় মানুষ! এক কথায় তাকে ঠিক কি বলা যায়! পাগল! ছিটেল! দাম্ভিক! না টিপিক্যাল ঠান্ডা মাথার খুনী!
    কথাটা অধিরাজকে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে—‘এক কথায় হতভাগ্য ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না ওকে। জিনিয়াসদের যখন মাথা খারাপ হয়, তখন তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই!’
    অর্নব মনে মনে স্যারের কথাটাকেই সমর্থন করল। লোকটার দুটো হাতই দুর্ঘটনায় কাটা পড়েছে। মশা মারার ক্ষমতাও নেই। অথচ সেই লোকটাই একের পর এক মানুষ খুন করে যাচ্ছে! নিজেই স্বীকার করছে তার অপরাধ! অথচ সেটাই প্রমাণ করে দেখানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে। জিনিয়াস ছাড়া আর কি বলা যায় তাকে!
    --‘কাঁটাটা উনিই ফুটিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভদ্রলোক নিজেও খুনগুলোর দায় স্বীকার করেছেন’। অর্নব আস্তে আস্তে বলে—‘কিন্তু কিভাবে? ডঃ চ্যাটার্জী বলছেন কাঁটার ডিরেকশন একদম ডাইরেক্ট। ঘাড়ের উচ্চতায় সোজাসুজি ঢুকেছে। একমাত্র হাত দিয়েই ওভাবে কাঁটা ফোটানো যায়। স্প্রিং গান ব্যবহার করলে সেটাও তো হাত দিয়েই করতে হবে। অথবা পা দিয়ে। কিন্তু পা থেকে কাঁটা চার্জড হলে জিনিসটা নীচ থেকে উপরের দিকে আসবে। এক্ষেত্রে সেটাও হয়নি। তবে কাঁটাটা উনি চার্জ করলেন কি ভাবে? কোন কৌশলে?’
    --‘তোমার কি মনে হয়?’ অধিরাজ গাড়ি চালাতে চালাতেই সকৌতুকে তাকায় তার দিকে—‘কিভাবে কাঁটাটা ফুটিয়েছেন উনি?’
    তার মাথায় একটা আবছা সম্ভাবনার কথা আসছিল। সে আমতা আমতা করে বলে—‘স্যার, এমন যদি হয় যে, উনি ‘শোলে’র সঞ্জীবকুমারের কনসেপ্টটাই নিয়েছেন। হয়তো ভদ্রলোকের জুতোয় কাঁটা লাগানো থাকে...’
    --‘আর উনি ঘিপ্‌ করে পা টা ক্যারাটে এক্সপার্টের মত তুলে ভিকটিমের ঘাড়ে বসিয়ে দেন...’। অর্নবের অসমাপ্ত কথাটা শেষ করে দেয় অধিরাজ। হো হো করে হেসে উঠে বলে—‘ওঃ অর্নব, তুমিও একটি জিনিয়াস! চতুর্দিকে জিনিয়াস নিয়ে ঘর করছি আমি! কেউ আমাকে স্টাফড করে দেওয়ালে টাঙাতে চায়! কেউ কাঁটাওয়ালা জুতোর থিওরি শোনায়! কোথায় যে যাই!’ হাসতে হাসতেই সে আড়বাঁশিটা এগিয়ে দিয়েছে অর্নবের দিকে—‘এ জিনিস বাজিয়েছ কখনও? বাজিয়ে দেখ’।
    কোথায় কাঁটার থিওরি, আর কোথায় বাঁশি! অর্নব মনে মনে ক্ষুণ্ণ হয়। স্যার তার কাঁটার থিওরিটা পাত্তা তো দিলেনই না, উপরন্তু এখন বাঁশি বাজাতে বলছেন!
    --‘বাজাও...বাজাও...’। অধিরাজ হেসে উঠে বলে—‘কাঁটার কৌশল বের করার চেয়ে এ বাঁশি বাজানো অনেক বেশি কঠিন। বাজাতে না পারো, অ্যাট লিস্ট ট্রাই তো করে দেখো’।
    অর্নব বিরক্ত হয়ে বাঁশিতে দায়সারা ফুঁ দেয়। কি আশ্চর্য! বাঁশি সম্পূর্ণ নীরব! সে আরেকবার চেষ্টা করে। এবার অনেক বেশি সিরিয়াসলি। কিন্তু বাঁশি বাজল না! একটা সামান্য বাঁশি। অথচ তার কি অটুট নীরবতা! যেন কিছুতেই বাজবে না পণ করে বসে আছে। অর্নব গাল ফুলিয়ে, শরীরের সমস্ত অক্সিজেন বুকে ভরে প্রাণপণ সেটাকে বাজানোর চেষ্টা করছে! কিন্তু তার হুশহাশ করাই সার! দম ফুরিয়ে গেল, বংশীবাদকের মুখ লাল হয়ে গেল, ঘাম বেরিয়ে গেল, তবু বাঁশি বাজল না।
    --‘থাক, হয়েছে’। অধিরাজই শেষপর্যন্ত তাকে বাঁচায়—‘আর বেশি চেষ্টা করলে আস্ত ফুসফুসটাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। তবু বাঁশি বাজবে না! তুমি একটা জোয়ান, শক্তপোক্ত লোক হয়েও যেটা বাজাতে পারছ না, সেটাই ঐ ভদ্রলোক অনায়াসে বাজিয়ে দিলেন! ফারাকটা বুঝেছ?’
    ফারাক! হ্যাঁ, বুঝেছে বৈকি! সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে—‘উনি এক্সপার্ট লোক’।
    --‘শুধু এক্সপার্ট নয়! ওনার ফুঁয়ের জোর আর দম তোমার থেকে কয়েকশো গুণ বেশি। ইনফ্যাক্ট অমানুষিক জোর। অ্যান্ড দ্যাট্‌স্‌ দ্য মেইন পয়েন্ট!’
    --‘মানে!’ অর্নব বিস্মিত
    --‘মানে ভদ্রলোকের হাত নেই বলে তোমরা তার মাথা থেকে পা অবধি সবজায়গাতেই কাঁটা লঞ্চার থাকার আশঙ্কা করছ। স্প্রিংগান থেকে শুরু করেছিলে, হয়তো রকেট লঞ্চারে গিয়ে থামতে!’ সে হাসছে—‘কিন্তু আসল জায়গাটাই বাদ দিয়ে গেলে। ভদ্রলোকের মুখ। যেখানে একটা ব্লো পাইপ থাকার প্রবল সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি। ওটাই আসলে কাঁটাটার নিক্ষেপণ যন্ত্র! তপন আচার্যের দম আর ফুঁ এর জোর তো নিজের চোখেই দেখলে। রাজকাঁকড়ার কাঁটা ঐ এক মোক্ষম ফুঁয়েই ফুল ভেলোসিটিতে বেরিয়ে শিকারের মেডালা অবলাঙ্গেটায় ঢুকে গেছে’।
    ব্লো পাইপ! অর্নব থমকে যায়। কথাটা ভুল বলেননি স্যার। একমাত্র ব্লো পাইপ ব্যবহার করলেই কাঁটা সরাসরি যাবে। কারণ তপন আচার্যের মুখ আর ভিকটিমের ঘাড় প্রায় সমান্তরালে থাকার কথা!
    কিন্তু ওনার ঘরে তো কোনও ব্লো পাইপ পাওয়া যায়নি! পাওয়া যায়নি ব্লো পাইপের মত দেখতে কোন বস্তুও।
    --‘ব্লো পাইপ আছে’। অধিরাজ বলল—‘তুমি দেখতে পাওনি’।
    --‘সেকি! কোথায়?’
    --‘কোথায় আছে জানলে কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম?’ তার মুখে এবার চিন্তার ছাপ—‘কিন্তু ব্লো পাইপ আছেই। আমার অনুমান এত সহজে ভুল হয় না। আমার মন বলছে, কাঁটা না পাওয়া গেলেও ও বাড়িতে ব্লো পাইপ একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে’।
    একটু খোঁজা! প্রথমে দেবাশিষ, পরে অর্নব নিজে গোটা বাড়িটা প্রায় গরুখোঁজা খুঁজে দেখেছে! তাতেও স্যারের ‘একটু খোঁজা’ হল না!
    --‘শোনো অর্নব’। অধিরাজ আস্তে আস্তে বলে—‘বেরোবার আগেই জায়গাটার লোকেশনটা দেখে নিয়েছি। এই অঞ্চলের কাছাকাছি মেইন রোডের উপরে গোটা তিনেক ধাবা আছে। আমি গাড়ি থেকে নামব না। তুমি প্রত্যেকটা ধাবায় গিয়ে প্রথমে মৃতব্যক্তিদের ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবে যে, তারা কখনও সেখানে খেয়েছিল কি না। তারপর তপন আচার্যের ফটো দেখিয়ে জানতে চাইবে, এই হাতকাটা সাহেব কখনও এখানে এসেছেন কি না’।
    --‘ওকে স্যার’। বলেই হঠাৎ তার খেয়াল হল—‘কিন্তু তপন আচার্যের ফটো পাবো কোথায়?’
    অধিরাজ ভুরু নাচাল। সে মোবাইলটা এগিয়ে দেয় অর্নবের দিকে। অর্নব অবাক হয়ে দেখে, মোবাইলের পর্দায় তপন আচার্যের সম্পূর্ণ অবয়বের ছবি!
    --‘ভদ্রলোককে লুকিয়ে অনেক কায়দা করে তুলেছি’। সে হাসছে—‘আর কোনও প্রশ্ন?’

    অর্নব কথামতো কাজই করল। প্রত্যেকটা ধাবায় নেমে খোঁজ করে দেখল। প্রথম ধাবার মালিক কাউকেই চিনল না। দ্বিতীয় ধাবার মালিক তপন আচার্যকে চেনে। কিন্তু মৃত ড্রাইভারদের কাউকেই চেনে না। হাতকাটা সাহেব সম্পর্কে জানাল যে, তিনি নিজে খুব কমই আসেন। এই জায়গাটা তার বাড়ি থেকে একটু দূরে বলে নিজে তেমন আসেন না। তবে তাঁর অ্যাটেন্ডেন্ট মদন মাঝেমধ্যেই এ ধাবা থেকে খাবার নিয়ে যায়।
    তৃতীয় ধাবার নামটা বেশ মজাদার। বেবি সিং দা ধাবা! একটা বিরাট-দশাসই চেহারার দাড়ি গোঁফ-গালপাট্টাওয়ালা পাগড়ি বাঁধা শিখ ঘুরেঘুরে তদারকি করছিল। তার নামই নাকি বেবি সিং! তাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে হাউমাউ করে জানাল—হ্যাঁ, হাতকাটা সাহেব রোজ রাতেই তার ধাবায় আসেন। খাওয়া দাওয়া করেন। লস্যি টস্যি ‘পিয়েন’! তারপর চলে যান। আর মৃত তিন ড্রাইভার? হ্যাঁ, তাদেরও দেখেছে বটে। এদের মধ্যে একজন তো এমন ‘পিয়ে ছিল’ যে খাবারের দাম না মিটিয়েই চলে গিয়েছিল! কিন্তু এসব খুনটুনের ব্যাপারে সে কিছুই জানে না! ‘ওয়াহেগুরুর’ কিরে!
    --‘বেবি সিং এর ধাবাতেই তবে আমাদের কাঁটাবাবা তার কীর্তি কলাপ চালাচ্ছেন’। সব বৃত্তান্ত শুনে বলল অধিরাজ—‘কিন্তু ভাগ্নে মদনের কেসটা তো ঠিক বুঝলাম না!’
    --‘ভাগ্নে কোথায়! অ্যাটেন্ডেন্ট তো!’
    সে অর্নবের দিকে তাকায়—‘গাড়ি চালায় বংশীবদন, সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন! বংশীবদনকে তো দেখে এলাম। কিন্তু ভাগ্নে মদনকে দেখলাম না! এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় কি করে?’
    --‘হয়তো কোথাও বেরিয়েছিল’।
    --‘হবে হয়তো’। অধিরাজ এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না—‘বাদ দাও। আপাতত দুটো কাজ করার আছে। একটা তুমি করবে, অন্যটা আমি’।
    --‘কি কাজ?’
    --‘আরেকটু অন্ধকার হলেই আমরা ফের ফিরে যাবো তপন আচার্যের বাড়িতে। আমি সেখানে নেমে যাবো। আর তুমি গাড়ি নিয়ে সটান ফিরে আসবে বেবি বাবার ধাবায়। এখানে একটু আড়ালে বসে তন্দুর-মুর্গী সাঁটাবে। আর চতুর্দিকে নজর রাখবে। তপন আচার্য রোজ রাতেই যখন ডিনার করতে এখানে আসেন, তখন আশা করা যায় যে আজও আসবেন। তিনি বাড়ি থেকে বেরোনোমাত্রই ফোন করবো। তিনি এখানে পৌঁছনো মাত্রই একদম কড়া নজর রাখবে তার উপরে। এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের আড়াল করবে না’। তার মুখে এবার দুশ্চিন্তার ছাপ—‘ভীমরুলের চাকে আজই ঢিল মেরেছি। উত্তেজিত হয়ে কিছু ভুল কাজ করেও ফেলতে পারেন। বিশেষ করে ভাগ্নে মদনের অনুপস্থিতিটা একটু বেশিই ভাবাচ্ছে। সে আজ বাড়িতে ছিল না। অতএব জানে না যে, আজ স্বয়ং আই জি, সি আই ডি মাঠে নেমে পড়েছেন ’।
    --‘আর আপনি?’ অর্নব অবাক হয়ে বলে।
    --‘আমি ততক্ষণ ওনার বাড়ির আমগাছটা পরীক্ষা করে দেখি’। সে হাসল—‘তবে ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার পর ডাইরেক্ট ওনার ঘরেই ঢুকবো। তার আগে গাছে বসে কাঠপিঁপড়ে গোনা ছাড়া উপায় নেই!’
    অর্নব নতুন করে আর বিস্মিত হতে পারে না। অধিরাজের সঙ্গে থেকে থেকে তার বিস্ময় নামক এক্সপ্রেশনটা ক্রমশই বড় একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে।
    --‘অপরাধীদের নিয়মই হচ্ছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখামাত্রই প্রমাণ লোপাট করে ফেলা’। অধিরাজ আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল—‘মদনের জন্য চিন্তা না করে পারছি না। সতর্ক থেকো অর্নব’।
    --‘ইয়েস স্যার’।

    ৬.

    তপন আচার্যের ভুতুড়ে বাড়ির ঠিক সামনে, আমগাছটার উপরে চুপ করে বসেছিল অধিরাজ। তার কানে ব্লুটুথ ওয়্যারলেস ইয়ারসেট। হাতের বাইনোকুলারটা নাইটমোডে আছে। আমগাছটার মগডালে উঠে সে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল চতুর্দিকে। তপন আচার্য এখনও ঘরে আছেন। চতুর্দিক অন্ধকার হলেও ভিতরের একটা ঘরে আলো জ্বলছে। অধিরাজ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, ভদ্রলোক বিছানায় বসে আছেন। বিশেষ নড়াচড়া করছেন না। পা দিয়ে একটা চুরুট ধরিয়েছেন। সেটাতে টান মারতে মারতে কি যেন নিবিষ্ট মনে ভাবছেন। এমনিতেই ভুরু ছাড়া লোকদের মুখ ভাবলেশহীন বলেই মনে হয়। কিন্তু তপনবাবুর মুখটা যেন আরও বেশি ভাবলেশহীন লাগছে। মনে হচ্ছে, ওটা কোন মানুষের মুখ নয়, মুখোশ! চুরুটে টান দেওয়ার ভঙ্গিটা একটু উত্তেজিত।
    অধিরাজের সন্দেহ হয়, লোকটা আরেকটা খুন করবে। সম্ভবত তার প্ল্যানই বানাচ্ছে। যেভাবে ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়ছেন, তাতে মনে হয় কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন তিনি।
    এখন কটা বাজে কে জানে। অধিরাজের হাতের ঘড়িটায় রেডিয়াম ছিল বলে সেটা অর্নবের কাছেই রেখে এসেছে। আমগাছের মগডালের অন্ধকারে রেডিয়ামওয়ালা ঘড়ি জ্বলজ্বল করছে দেখলে তপনবাবু কি ছাড়বেন! এমনিতেই তার উপর অল্পবিস্তর লোভ আছে লোকটার। পারলে এখনই দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখেন। একেই মা মনসা! তার উপর ধুনোর ধোঁয়া দিয়ে কাজ নেই। এর শেষ অবধি না দেখে দেওয়ালে চড়তে চায় না অধিরাজ।
    আমগাছের পাতার একটা মজাদার টকটক গন্ধ আছে। হাল্কাভাবে সেই গন্ধটাই নাকে আসছিল তার। গাছে ওঠার সময়েই লক্ষ্য করেছে মগডালে একটা বিরাট বোলতার চাক আছে। চাকটা ঠিক তার পেছনেই। একটু নড়লেই ধাক্কা লাগবে। জমাট অন্ধকারে মিশে একদম স্থির হয়ে বসেছিল অধিরাজ। যে ডালে বসে আছে সেটা বেশ স্লিপারি। তাই একদম নড়াচড়া করছে না। এখান থেকে পিছলে নীচে পড়লেই বিপদ।
    ওখানে স্থির হয়ে বসেই কতক্ষণ কাটল কে জানে! অন্য কেউ হলে অধৈর্য হয়ে পড়ত। কিন্তু যে লোকটা খাড়া পাহাড়ে চড়তে ভালোবাসে, বরফে ঢাকা দুর্গম পথে ট্রেকিং করা যার শখ, স্বাভাবিক ভাবেই তার ধৈর্যের বহর অনেক বেশি। সে এক জায়গায়, একই রকম ভাবে, বিন্দুমাত্রও না নড়ে চুপ করে বসে রইল।
    এভাবেই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছে অধিরাজ। ঘড়ি না দেখলেও বোঝা যায়, এখন বেশ রাত। চতুর্দিকে কোনও শব্দ নেই। শুধু নিস্তব্ধতার বুকে ঝিঁ ঝিঁর একটানা ডাক। দু একটা পাতা খসার শব্দ। কখনও একটা দুটো বোলতা তাকে ছুঁয়ে বোঁ বোঁ করতে করতে চলে যাচ্ছে। কখনও গায়ে এসে বসছেও। তবু অধিরাজ নড়ে না।
    আশেপাশে তখন জমাট অন্ধকার! অন্যান্য বাড়ির আলো সব নিভে গেছে। কিন্তু তখনও তপন আচার্য ঘরে পায়চারি করে যাচ্ছেন। একটার পর একটা চুরুট খাচ্ছেন। অধিরাজ হিসেব করে দেখল—এর মধ্যে কমসে কম হাফ ডজন চুরুট টেনে ফেলেছেন। ভদ্রলোক দিনে ক’প্যাকেট চুরুট খান!
    অবশেষে এই যন্ত্রণাদায়ক প্রতীক্ষার অবসান হল। ঘরের আলো নিভে গেল। কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। তারপরই সে দেখল ভদ্রলোক নীচের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। বেশ কষ্ট করে পা দিয়ে কৌশলে দরজায় তালা লাগালেন।
    সে অর্নবের নম্বর ডায়াল করল। ফিসফিস করে বলল—‘হ্যাঁ। তৈরি থাকো। উনি বেরোচ্ছেন’।
    --‘ওকে স্যার’।
    তপন আচার্য বেরিয়ে যাওয়ার পরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল সে। বলা যায় না। যদি কোনও কারণে ভদ্রলোক ফিরে আসেন! তাহলেই কেলোর কীর্তি!
    কয়েক মিনিট এভাবেই চুপচাপ কাটিয়ে দেওয়ার পর সে নিশ্চিন্ত হয়। যাক্‌, উপস্থিত তিনি আর ফিরবেন বলে মনে হয় না। এই সুযোগেই কাজ সেরে নেওয়া যাক।
    আমগাছের যে ডালটা সরু হয়ে বাড়ির উপরের জানলা অবধি চলে গেছে সেটাকে দেখলেই ভয় করে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই পতন অনিবার্য! অধিরাজ কিন্তু অদ্ভুত কৌশলে ডাল ধরেই একটা ভল্ট খেল। সোজা গিয়ে পড়ল জানলার তলায় কার্নিশে।
    বাড়ির জানলায় কোন শিক ছিল না। কাঁচের জানলাটা খুলতে পারলেই ভেতরে ঢোকা যাবে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তপন আচার্যকে কাল এই জানলাটা মেরামত করাতে হবে। আশা করা যায় ভদ্রলোক মাইন্ড করবেন না।
    গ্লাস কাটার সঙ্গে নেই। কিন্তু তাতে কি! হাত তো আছে। বিরাশি সিক্কার এক ঘুঁষিতেই ঝন্‌ঝন্‌ করে ভেঙে পড়ল কাঁচ। হাতটাও কাটল বটে। তবে যে হাত কাঠের টালি ভেঙে অভ্যস্ত তার কাছে এ যন্ত্রণা কিছুই নয়। অধিরাজ তার আহত হাতটা একটু নেড়েচেড়ে দেখে। দর্‌দর্‌ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু সে পাত্তা দিল না। বরং জানলা খুলে ঢুকে গেল ভেতরে।

    বাড়ির ভিতরে তখন জমাট অন্ধকার। ঠিক কোথায় এসে পড়েছে তা প্রথমেই বুঝতে পারল না। দু-একটা আসবাবে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নিয়েছে। সম্ভবত এটা দোতলার কোনও একটা ঘর। এ ঘরগুলো সে দেখেনি। তবে দেবাশিষ আর অর্নব—দুজনেই এই ঘরগুলো আঁতিপাতি করে খুঁজেছে। এখানে তার আর কিছু দেখার নেই। শুধু তপন আচার্যের বসার ঘরটাই দ্রষ্টব্য বিষয়। কিছু পাওয়া গেলে ওখানেই পাওয়া যাবে।
    অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে ঠিক সিঁড়ি অবধি পৌঁছে গেল। পকেটে একটা মিনিটর্চ আছে ঠিকই। তবু চান্স নিতে পারছে না। বাড়ির মালিক না ফিরুক, তার অ্যাটেন্ডেন্ট চলে আসতে পারে। সাবধানের মার নেই।
    তাই অন্ধকারেই পা টিপে টিপে অধিরাজ উপর থেকে নীচে নেমে এল। সিঁড়ি থেকে নামলেই বসার ঘর। আলোয় একবার দেখে গেছে। অথচ অন্ধকার হয়ে গেলে সবই অচেনা লাগে।
    অধিরাজ বুঝল এবার তাকে রিস্ক নিতেই হবে। টর্চ ছাড়া সঠিক জায়গাটা খুঁজে বের করা শুধু শক্তই নয়, অসম্ভব! পকেট থেকে মিনিটর্চটা বের করে জ্বালাল সে। আলতো আলোয় এবার স্পষ্ট হল বসার ঘরটা!
    আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করার কোনও চেষ্টাই তার মধ্যে দেখা গেল না। সে শুধু তপন আচার্যের বসার টেবিলটা পরীক্ষা করে দেখছে। টেবিলের উপরে একটা ছবি। দুই সুদর্শন পুরুষ আর দুই মহিলার ছবি। এর মধ্যে আর্মির ড্রেস পরা শক্তপোক্ত গড়নের মানুষটি নিঃসন্দেহে কর্নেল তড়িৎ আচার্য। তার তেজোদীপ্ত ভঙ্গিই জানিয়ে দেয় যে ইনি আর্মির লোক। পাশের হাসিমুখের লোকটিই তপন আচার্য! বয়স্কা মহিলাটি তাদের মা, আর সুন্দরী ভদ্রমহিলা কর্নেল আচার্যের স্ত্রী।
    অধিরাজের কষ্ট হচ্ছিল। পরিবারটিকে ছবিতে কি সুখীই না দেখাচ্ছে! তপন আচার্যও কি চমৎকার হাসছেন। এই মানুষটাই পুড়ে যাওয়ার আগে এমন সুন্দর দেখতে ছিলেন, কেউ বলবে! এমন সুন্দর হাসিখুশি পরিবারটা কি নির্মমভাবে শেষ হয়ে গেল! ছবির সহাস্য, শান্ত মানুষটিও শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কবিকৃত খুনীতে পরিণত হলেন। এর নাম সময়! মানুষকে দিয়ে কি কি কাজই না করায় সে!
    নাঃ। ইমোশনাল হয়ে পড়লে চলবে না। কাজ সারতে হবে।
    সে এবার তপন আচার্যের টেবিলটা ভালো করে খুঁজে দেখতে শুরু করে। ভদ্রলোক জাত স্মোকার। বাঁদিকে ড্রয়ারের মধ্যে গাদা গাদা চুরুটের বাক্স, গোটা তিনেক লাইটার, গোটা পাঁচেক ইন্ডিয়া কিং সিগ্রেটের প্যাকেট, তিনটে অব্যবহৃত শৌখিন অ্যাশট্রে। সম্ভবত আইভরির। ধূমপানের শখ আছে বটে!
    বাঁদিকের ড্রয়ার খুলতেই চমক! যা খুঁজছিল তা এত সহজে পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। পরপর সাজানো কয়েকটা ব্লো পাইপের কাটা অংশ! অধিরাজ গুনে দেখল মোট চারটে আছে। লম্বা পাইপ থেকে সামান্য অংশ কেটে নেওয়া হয়েছে! শুধু ব্লো পাইপই নয়, ব্লো পাইপে সচরাচর যে কাঁটা বা ডার্ট ব্যবহৃত হয়, তাও আছে! তার পাশেই আরও দুটো অপ্রত্যাশিত জিনিস! একটা হুইস্‌ল্‌। আর একটা নীল রঙের ইনহেলার! খুব সযত্নে রক্ষিত। জিনিসগুলোয় একটুও ধুলো পড়েনি।
    ব্লো পাইপ আর কাঁটাগুলো সে প্লাস্টিকের এভিডেন্স ব্যাগে ভরে নেয়। কি মনে করে যেন হুইস্‌ল্‌ আর ইনহেলারটাও নিয়ে নিয়েছে। তপন আচার্যের টেবিলে হুইস্‌ল্‌ আর ইনহেলার কি করছে, সে বিষয়ে তার একটু সংশয় ছিল। তাই ওদুটোও এভিডেন্স ব্যাগে ভরে নিল অধিরাজ।
    গোটা ঘর খুঁজে আর তেমন সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। টেবিলের পিছনের দেওয়ালে শুধু বাঁশির সারি! কতরকমের আর কত সাইজের বাঁশি যে সেখানে আছে তার হিসেব নেই! অধিরাজ খুব মন দিয়ে বাঁশিগুলো দেখছিল। এই লম্বা লম্বা বাঁশির মধ্যেই কোথাও আস্ত একটা ব্লো পাইপ লুকিয়ে নেই তো! অনেক সময় ব্লো পাইপগুলোকে বাঁশির মতই দেখতে লাগে। তেমনই হয়তো আপাত নিরীহ বাদ্যযন্ত্রের মধ্যেই ছদ্মবেশে বসে আছে প্রাণঘাতী হাতিয়ার!
    হঠাৎই তার বুক পকেটের মোবাইলটা সজোরে নড়েচড়ে উঠল। ভাইব্রেটরে ঘঁ ঘঁ করছে যন্ত্রটা।
    অধিরাজ ব্লু টুথ ইয়ারসেট অন করল—‘ইয়েস’।
    ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল অর্নবের গলা—‘স্যার, আপনি কোথায়?’
    তার কন্ঠস্বরে উত্তেজনা আর উদ্বেগ মাখানো। অধিরাজের খট্‌কা লাগে। অর্নব এত উত্তেজিত কেন?
    --‘আমি তপন আচার্যের বাড়িতে’। সে বলল—‘কেন বল তো? কি হয়েছে?’
    --‘তাড়াতাড়ি বেবি সিঙের ধাবায় চলে আসুন স্যার’। অর্নবের গলা কাঁপছে—‘এইমাত্রই এখানে আরেকটা খুন হয়ে গেছে! একদম আমার চোখের সামনে...!’

    অর্নব স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ঘটনাটা এমন ঘটবে!
    এমনিতেই তার স্যার সম্পর্কে একটু দুশ্চিন্তাই ছিল। তাকে তপন আচার্যের বাড়িতে ড্রপ করে দিয়েও শান্তিতে থাকতে পারেনি সে। তখনই গাড়ি নিয়ে চলে না এসে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, প্রায় প্যান্থারের ক্ষিপ্রতায় লাফ মেরে মেরে গাছে উঠে যাচ্ছেন মার্শাল আর্ট এক্সপার্ট। এমন ভঙ্গিতে সাঁই সাঁই করে গাছে উঠতে সে এর আগে চাইনিজ ফিল্মে জেট লি কে দেখেছে। শাওলিন প্যান্থার বা লিওপার্ড স্টাইলে শিক্ষিত লোকেরা এমনভাবেই গাছে উঠতে পারে। আর এই দুরূহ বিদ্যায় অধিরাজ ব্যানার্জী মাস্টার লোক।
    স্যার গাছে উঠে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই সে ফিরে এসেছিল বেবি সিঙের ধাবায়। নির্দেশ আছে ওখানে বসে থাকার। কিন্তু খালি টেবিলে তো বসে থাকা যায় না। অগত্যা প্রথমে তন্দুরী চিকেন আর লস্যি দিয়েই শুরু করল অর্নব। তন্দুরী চিকেন যতখানি স্লো মোশনে খাওয়া যায়, ঠিক ততটাই আস্তে আস্তে খাচ্ছিল। বারবার অধৈর্য হয়ে ঘড়িও দেখছিল। একটা ফুল প্লেট তন্দুরী চিকেন খাওয়ার পরে পেটে বিশেষ জায়গা থাকার কথা নয়। তার প্লেট দেখতে দেখতেই খালি হয়ে গেল। অথচ তপন আচার্যর দেখা নেই!
    একটা ভয়াবহ ঢেঁকুর তুলে অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকায় অর্নব। স্যার এ কি শাস্তি দিয়ে গেলেন তাকে! খাওয়া শেষ হয়ে গেলে এরা বসে থাকতেও দেবে না! আশেপাশে দু একজন দাঁড়িয়ে টেবিল খালি হওয়ার অপেক্ষা করছে। অথচ এখন তার প্রায় সদ্য হরিণ গেলা অজগরের মত দশা! ওদিকে নিজে বোধহয় আমগাছের মগডালে বসে পেটে কিল মারছেন। আর অর্নব একাই প্রায় চারজনের খাবার খেয়ে পেট ফুলিয়ে বসে আছে!
    আস্তে আস্তে ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজল। বেবি সিং এতক্ষণ ঘুরে ঘুরে সবার তদারকি করছিল। এখন তাকে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় সে ও বাড়ি গেছে। ধাবাও প্রায় ফাঁকা। ওদিকে স্যারেরও কোনও সাড়াশব্দ নেই। এদিকে ধাবার কেয়ারটেকার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে। শেষপর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিয়ে একটা পরোটা আর মাট্‌ন্‌ তরকার অর্ডার দিয়েই দিল। অর্ডারটা দিয়েই মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে শুরু করেছে। আরও এক প্লেট খাবার খেলে সে এমনিই মরে যাবে! রাজকাঁকড়ার কাঁটার দরকারও পড়বে না!
    পরম করুণাময় ঈশ্বর বোধহয় তখন কাছেপিঠেই ইভনিং ওয়াক করছিলেন। অর্নবের প্রার্থনা তাঁর কানে গেল। ঠিক তখনই স্যার ফোন করে জানালেন, তপন আচার্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। সে মেরুদন্ড খাড়া করে টানটান হয়ে বসে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ। দৃষ্টি সতর্ক।
    তখন আস্তে আস্তে রাস্তা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। দু পাশে স্ট্রীটলাইট জ্বলছে বটে। কিন্তু তাতেও খুব স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না। এখন না গরম, না ঠান্ডা। ওয়েদার চেঞ্জ হচ্ছে। তবু রাতের দিকটায় বেশ ঠান্ডাই লাগে। অল্প অল্প পাতলা ধোঁয়াশাও ছড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তা জুড়ে। মনে মনে প্রমাদ গোনে অর্নব। ধোঁয়াশাটা যেভাবে পড়তে শুরু করেছে তাতে একটু পরে হয়তো সব দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যাবে না।
    ঠিক সোয়া এগারোটা নাগাদ তপন আচার্যকে দেখতে পেল সে। ধোঁয়াশা ভেদ করে এদিকেই আসছেন। অস্পষ্ট আলোতেও দিব্যি চেনা গেল তাকে। গায়ে পাতলা একটা র্যা পার। তাই পাঞ্জাবীর হাতা দেখা যাচ্ছে না। গলায় একটা বড় ব্যাগ ঝোলানো।
    তাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় অর্নব। কয়েক ঘন্টা আগেই ভদ্রলোকের বাড়ি সার্চ করে এসেছে। ফের ওকে মুখ দেখানোর কোনও ইচ্ছে নেই তার।
    তপন আচার্য ধাবার কাউন্টারে গিয়ে জানালেন যে, আজ তিনি এখানে খাবেন না। খাবার যেন প্যাক করে গলায় ঝোলানো ব্যাগটায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কাউন্টারের ছেলেটি হুকুম তামিল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাবেভাবেই বোঝা গেল যে এ খদ্দেরের গুরুত্ব তাদের কাছে আছে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই খাবার প্যাক করে ডেলিভারি দিয়ে দিল। তপন আচার্যর ব্যাগটার মধ্যেই টাকা ছিল। সেখান থেকে টাকা নিয়ে যেভাবে ছেলেটি চেঞ্জটা ফের ব্যাগে ভরে দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট সে এই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত।
    টাকা আর খাবার গলায় ঝুলিয়ে ভদ্রলোক এবার ফেরার পথ ধরেছেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! তার পিছন পিছন আরেকটা লোকও হনহন করে এগিয়ে গেল। লোকটা এতক্ষণ ধাবার একসাইডেই বসেছিল। এবার তপন আচার্যর পিছু নিয়েছে! অর্থাৎ অর্নবের মত সেও এতক্ষণ ওরই অপেক্ষা করছিল।
    ব্যাপারটা কি হয় দেখার জন্য অর্নবও টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
    --‘সাব, আপনার অর্ডার...!’
    প্রশ্নকর্তার দিকে চটজলদি উত্তর ছুঁড়ে দেয় সে—‘প্যাক করে দিন। আমি এক্ষুনি এসে নিয়ে যাচ্ছি’।
    তাকে আর কোনও কথা বলতে না দিয়ে হনহন করে এগিয়ে যায় অর্নব। তপন আচার্যর থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। ভদ্রলোক মেইন রোডের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছন পিছন সেই লোকটাও।
    মেইন রোডের ঠিক সামনে এসেই দাঁড়িয়ে পড়লেন তপন আচার্য। পিছনের লোকটাও এগিয়ে গেছে তার দিকে। চাপাস্বরে কথাবার্তা চলছে দুজনের মধ্যে। হাবেভাবে স্পষ্ট যে দুজনেই পরস্পরের পরিচিত। অজ্ঞাত লোকটা হাত পা নেড়ে কি যেন বলছে।
    দুজনে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তার থেকে দশ বারো হাত দূরত্বে একটা পান-সিগ্রেটের দোকান। অর্নব সেই দোকানে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট কিনতে ব্যস্ত। হাতে একটা নোট। কান অন্যদিকে। দুজনের নিভৃত আলাপচারিতা শোনার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুজনেই এত নীচুস্বরে কথা বলছে যে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
    আড়চোখে তাকিয়ে সে দেখল, কথা বলতে বলতেই লোকটা তপন আচার্যর পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়াচ্ছে। মিঃ আচার্যর পিঠ এদিকে। তাই ব্যাপারটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। কি করছে লোকটা? পকেট থেকে কি বের করছে? টাকা? না অন্যকিছু?
    ততক্ষণে তাদের আবার ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে ধোঁয়াশার পাতলা চাদর। সামনের দৃশ্যটা সামান্য ঝাপ্সা হয়ে গেছে।
    --‘স্যার, আপনার সিগ্রেট’।
    --‘হ্যাঁ’।
    সিগ্রেটের প্যাকেট নিয়ে অর্নব আবার সেদিকেই তাকায়। দুজনের মধ্যে তখনও কথাবার্তা চলছে। ধোঁয়াশা সত্বেও হঠাৎ একটা মৃদু আলোর আভাস দেখতে পেল সে। সেই হাল্কা আলোয় উল্টোদিকের লোকটার মুখ দেখা যায়। গোঁফ দাড়ি আচ্ছন্ন একটা মুখ। একটু যেন উত্তেজিত।
    --‘খুচরোটা নেবেন’। দোকানদার তার দিকে চেঞ্জ এগিয়ে দিয়েছে। একমুহূর্তের জন্য তার দিকেই মুখ ফেরাল অর্নব।
    আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটল ঘটনাটা!
    দূর থেকেই একটা বাইকের হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল। দুরন্ত গতিতে ক্রমশই কাছে আসছে সেটা। এটা এমনকিছু অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়। মেইনরোড দিয়ে বাইক, ট্যাক্সি, গাড়ি যাওয়াই স্বাভাবিক।
    কিন্তু তারপর যা ঘটল তা ভয়ঙ্কর! বাইকটা হঠাৎ যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হুড়মুড় করে এসে পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা দুই ব্যক্তির উপরে। তপন আচার্য চেঁচিয়ে উঠলেন—‘কি সর্বনাশ! এ কি!’
    উল্টোদিকের লোকটা বিদ্যুৎগতিতে পিছনে ফিরেছে। ততক্ষণে বাইক একেবারে তার ঘাড়ের উপরে! আরোহী সজোরে ব্রেক কষেছে ঠিকই। কিন্তু তা সত্বেও বাইকটা এসে ধাক্কা মারল উল্টোদিকের লোকটার পায়ে! লোকটা টাল সামলাতে না পেরে পুরো তপন আচার্যর উপর টলে পড়ে।
    --‘এ-ই!’ অর্নব খুচরো ফেলে দিয়ে উর্ধশ্বাসে দৌড়য় সেদিকেই! বাইক আরোহী তাকে ছুটে আসতে দেখে বাইক সাইড করে নিয়েছে। তারপরই বিদ্যুতের মত সাঁৎ করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
    --‘রো-ক্‌!...স্টপ আই সে!...’
    হেলমেট পরা লোকটা তার দিকে একবার দেখেই মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। বাইকের গতিবেগ আরও বাড়ল। অর্নব বুঝতে পারে, বাইকের সাথে দৌড়ে সে পারবে না। তার নিজের গাড়িটাও খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু গাড়িটা আনতে আনতে বাইকটা বেরিয়ে যাবে। সে আর ভাবনাচিন্তা না করেই কোমরের বেল্ট থেকে বের করে এনেছে সার্ভিস রিভলবার।
    --‘হল্ট...’।
    বাইকটা দাঁড়ায় না। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বন্দুক গর্জন করে উঠেছে। টায়ার লক্ষ্য করেই গুলি করেছিল। কিন্তু ফস্কে গেল! বাইক ও তার আরোহী মুহূর্তের মধ্যেই বিন্দু হতে হতে মিলিয়ে গেল।
    ব্যর্থ হয়ে হতাশ ভাবে পিছন দিকে তাকায় অর্নব। কিন্তু কি আশ্চর্য! তপন আচার্য সেখানে নেই! অথচ অন্য লোকটা রাস্তার উপর টানটান হয়ে পড়ে আছে!
    সে লোকটার দিকে দৌড়ে যায়—‘আপনি ঠিক আছেন? বেশি লাগে নি তো!...’
    বলতে বলতেই তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু লোকটাকে ছুঁয়েই তড়িৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল অর্নব! লোকটার শ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে না! সে বুকে, কব্জিতে হাত দিয়ে দেখল। কিন্তু নেই! কোনও প্রাণের স্পন্দন নেই দেহটায়!
    অর্নবের মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। তার চোখের সামনেই আরেকটা খুন হয়ে গেল! আরেকটা খুন করে বেরিয়ে গেলেন তপন আচার্য!

    অধিরাজ যতক্ষণে স্পটে পৌঁছল ততক্ষণে লাশের প্রাথমিক শনাক্তকরণ হয়ে গেছে। ধাবার ছেলেটা তাকে তপন আচার্যর অ্যাটেন্ডেন্ট মদন বলে চিনতে পেরেছে। অধিরাজ হাতে গ্লাভস পরে ঝুঁকে পড়ে মৃতদেহ উল্টেপাল্টে দেখছিল। তার মুখ গম্ভীর। চিন্তার ছাপ প্রকট।
    --‘এই ভয়টাই করছিলাম’। সে বিড়বিড় করে—‘ছেলেটা কিছু জানত। অষ্টপ্রহর সে ঐ লোকটির সঙ্গে থাকত। নির্ঘাৎ এমন কিছু জেনে ফেলেছিল যা বিপজ্জনক! তাই ওকে সরিয়ে দেওয়া হল।’
    অর্নব মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। তার আর কিছু বলার মুখ নেই। চোখের সামনেই মদন খুন হয়ে গেল, অথচ সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
    --‘অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছ? বডি ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তবে এবারও ওয়েপ্‌ন্‌ যথারীতি রাজকাঁকড়ার কাঁটা’। অধিরাজ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অর্নব অবাক হয়ে দেখে তার হাতের সাদা গ্লাভস লাল হয়ে গেছে!
    --‘স্যার, আপনার হাত...’।
    --‘ও তেমন কিছু না। কাঁচে সামান্য কেটে গেছে’।
    --‘তবে তো এক্ষুনি টিটেনাস নিতে হবে। দেখি কতটা কেটেছে’।
    অধিরাজ গ্লাভস খুলে রক্তাক্ত হাতটা দেখায়। অর্নবকে উদ্বিগ্ন হতে দেখে বলে—‘চিন্তা কোর না। টিটেনাস নিয়ে নেবো। কিন্তু তুমি ঠিক কি দেখেছিলে বলো তো?’
    অর্নব সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলে। সব শুনে অধিরাজের কপালে ভাঁজ—‘একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর! একা তপন আচার্য কি কম উৎপাত ছিলেন, যে আরেক বাইক আরোহী আমদানি হল! বাইকের নম্বরটা দেখতে পেয়েছিলে?’
    সে মুখ কালো করে মাথা নাড়ায়।
    --‘দেখা উচিৎ ছিল’। অধিরাজ হতাশ হয়ে বলে—‘আনতাবড়ি গুলি না ছুঁড়ে বরং সেটাই দেখলে কাজের কাজ করতে। বাইক রাইডার ফস্কে গেল। কিন্তু একগাদা কনফিউশন রেখে গেল। এতক্ষণ ভাবছিলাম তপন আচার্য নিজেই খুনগুলো করছেন। বাট্‌, এবার আরও একজন দাবিদার যুক্ত হলেন! কে যে কি করে বেড়াচ্ছে, ভগবানই জানেন!’ সে আপনমনেই বিড়বিড় করে—‘সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু বাইক আর তার মালিক মাঝখানে টপকে পড়ে সব ঘেঁটে দিল দেখছি। এখন দুর্বাসার কৃপার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই!’
    অর্নব দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

    ৭.

    --‘এতক্ষণ ধরে জল ফুটছে কেন? চায়ের পাতা ফেলে দেবো? চা হবে?’
    ফরেনসিক ল্যাবের নতুন অ্যাসিস্ট্যান্টের মহা বিপদ হয়েছে। তার কোন কাজই ডঃ চ্যাটার্জীর পছন্দ হয় না। দোষের মধ্যে সে বার্নারে বসিয়ে জলটা একটু বেশিই ফুটিয়ে ফেলেছিল। সে জন্যই ভদ্রলোক চ্যাটাং চ্যাটাং করে কয়েকটা কথা শোনালেন। আরো হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই তাঁর ফোন বেজে উঠেছে।
    ডঃ চ্যাটার্জী দেখলেন অধিরাজ ফোন করছে।
    --‘হ্যাঁ বলো’।
    ও পাশ থেকে অধিরাজের উদ্বিগ্ন স্বর শোনা গেল—‘আপনি কোথায়?
    তিনি ঘাবড়ে গেলেন—‘ল্যাবে। কেন?’
    --‘আপনি ল্যাবে! আর এদিকে আপনার রাঁধুনী সনৎ আপনাকে গরুখোঁজা খুঁজছে’।
    তার বলার ভঙ্গিতে উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠেন তিনিও। সনৎ তাকে খুঁজছে কেন? বাড়িতে কিছু দুর্ঘটনা ঘটল না কি!
    --‘আমায় খুঁজছে কেন? কি হয়েছে?’
    --‘আরে, আপনি আজ সকালে বাজার থেকে যে ল্যাটা মাছগুলো নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলো সব পালিয়ে গেছে। এবার কি রান্না হবে!’
    ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে কয়েক সেকেন্ড লাগল অসীম চ্যাটার্জীর। পরক্ষণেই তিনটে লাফ মেরে চিৎকার করে উঠলেন—‘ফিচেল ছোঁড়া! এই সাতসকালে ফাজলামি হচ্ছে! ইয়ার্কি মারার জায়গা পাও না!পাজি বাঁদর কোথাকার!’
    ক্ষেপে গিয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছেন তিনি। পাশের নতুন সহকারীটি সমস্ত কথোপকথনই শুনতে পেয়েছিল। সে মিনমিন করে বলে—‘স্যার, ইয়ার্কি তো নাও হতে পারে। ল্যাটা মাছ এমনিতেই বেশ পিছল! হাত ফস্কে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়!’
    ডঃ চ্যাটার্জী তার দিকে কটমটিয়ে তাকালেন—‘আরে, পালাবে কি করে? আমি তো মাছগুলো কাটিয়ে এনেছি! কাটা মাছ কখনও পালায়!’
    সহকারীটি থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। তিনি ভয়ানক ভ্রূকুটি করে বিড়বিড় করে বললেন—‘কিন্তু ব্যাটা জানল কি করে যে আজ আমি বাজার থেকে ল্যাটা মাছ এনেছি!’
    --‘সিম্পল্‌’। এবার ডঃ চ্যাটার্জীর তথাকথিত পাজি, বাঁদরটি সরাসরি ফরেনসিক ল্যাবে ঢুকে পড়েছে—‘ আমার বাবা আজ সকালেই আপনাকে বাজারে ল্যাটা মাছ দর করতে দেখেছেন। সেই সূত্রেই জেনেছি। এতে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই!’
    তিনি কটমট করে তার দিকে তাকিয়েছেন। পারলে এখনই যেন ধরে জ্বালিয়ে দেন।
    --‘তোমার সেই চক্ষুষ্মান অন্ধ লেজুড়টিকে কোথায় রেখে এলে!’ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন ফরেনসিক এক্সপার্ট—‘যে ব্যাটা ভিকটিমকে বাইকের ধাক্কা খেতে দেখেছিল!’
    --‘তাকে একটা বিশেষ কাজে পাঠিয়েছি। এখন থেকে চব্বিশ ঘন্টা অবধি সে তপন আচার্যকে ফলো করবে’। অধিরাজ হাসল—‘তার কোটার দাঁতখিঁচুনিটা আমাকেই দিতে পারেন। আপত্তি নেই’।
    --‘দাঁতখিঁচুনি তো খেতেই হবে’। তিনি ফায়ার হয়ে বলেন—‘একটা কেস সলভ করতে গিয়ে প্রায় লাশের স্তূপ বানিয়ে ফেলছ! উল্টোপাল্টা দেখছ! ভুলভাল স্টেটমেন্ট দিচ্ছ। তাতেও রক্ষা নেই। যত বিটকেল বিটকেল জিনিস এভিডেন্স ব্যাগে পুরে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাচ্ছ। আর্মির হুইস্‌ল্‌, ব্লো পাইপের কাটা টুকরো, ডার্ট, বাঁশের মত দেখতে লম্বা বাঁশি, ইনহেলার! পেয়েছটা কি? এটা ফরেনসিক ল্যাব না ভাগাড়!’
    --‘রাগ করছেন কেন?’ অধিরাজের মুখে ঠান্ডা হাসি—‘ বাঁশিটা বাজিয়ে দেখেছেন? জব্বর জিনিস কিন্তু’।
    --‘শিওর। আমি বাঁশি বাজাচ্ছি’। বলতে বলতেই তিনি কেবিনের দিকে হাঁটা মেরেছেন—‘লাশের পোস্টমর্টেমটা তুমিই করে নিও’।
    অধিরাজ হাসতে হাসতেই চেপে ধরে তাঁর হাত—‘খুলির ভিতরে এত গরম থাকলে বাইরে খরা হওয়াটাই স্বাভাবিক ডক্টর। কুল ডাউন...কুল ডাউন...। রোজ সকালে জলজিরা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করুন—তবেই তো ফসল ফলবে। আর আমরাও আপনার জন্মদিনে চিরুনি গিফট করার সৌভাগ্য লাভ করব’।
    ডঃ চ্যাটার্জী একটা অগ্নিদৃষ্টি তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ক্ষান্ত দিলেন। ফরেনসিক ল্যাবের একদিকেই শায়িত ছিল মৃতদেহটা। সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতেই বললেন—‘জলজিরা আমার সহ্য হয় না। খেলেই গা বমি বমি করে’।
    --‘দুনিয়ার কোনও ভালো জিনিসই আপনার সহ্য হয় না’।
    --‘কি?’
    --‘কিছু নয়’। নিরীহ মুখ করে চেপে গেল অধিরাজ—‘বডিটা...’।
    --‘হ্যাঁ, সেটার কথাতেই আসছি’। ডঃ চ্যাটার্জী লাশের উপরের সাদা চাদরটা সরিয়ে দিয়েছেন—‘মৃত্যু যথারীতি একই ভাবে হয়েছে। মেডালা অবলাঙ্গেটায় রাজকাঁকড়ার কাঁটা ফুটেই মারা গেছে লোকটা। তবে এই প্রথম কিছু কমন ফ্যাক্টর মিসিং। এই লাশের পেটে কোনও খাবার পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি অ্যালকোহলের ট্রেসও। তবে হাতে ছ্যাঁকার দাগটা আছে। আর মজার কথা, ওর হাতে কিছু মোমের ট্রেসও আছে’।
    অধিরাজ লাশের হাতটা দেখল। অবিকল সেই একই রকম ছ্যাঁকার দাগ দুটো আঙুলে! তার মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। প্রত্যেকটা লাশের হাতেই এমন ছ্যাঁকার দাগ কেন!
    --‘তোমার তিস্‌ মার খান্‌ জানিয়েছিল যে একটা বাইক এসে লোকটাকে ঠুকে দিয়েছিল’। তিনি বললেন—‘কিন্তু ফরেনসিক বলছে যে আসলে তেমন কিছুই হয় নি। এই দেখো লোকটার হাঁটু আর তলপেট’। আঙুল দিয়ে হাঁটু আর তলপেটের অংশটা দেখালেন ফরেনসিক এক্সপার্ট—‘কোনও উন্ড, দাগ বা কালসিটে দেখছ? একটা বাইক ফুল ভেলোসিটিতে এসে ঠুকে দিলে এরকম অক্ষত থাকত? ইনফ্যাক্ট আমি এক্সরে করিয়েও দেখলাম। হাড়ে কোনও ক্র্যাক নেই! লোকটার পরনের জামাকাপড়ও পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে কোথাও একটা সুতোও ওঠেনি। তুমি নিজেও তো বাইক চালাও। কি মনে হয়? একটা গোদা বাইকের ধাক্কা খেলে একটা লোকের দেহ এরকম স্পটলেস থাকতে পারে?’
    অধিরাজ চিন্তিত মুখে ঘাড় নাড়ায়। সত্যিই বাইকের ধাক্কা খাওয়ার পর এমন অক্ষত দেহ থাকার কথা নয়। অর্নব তবে কি দেখল? নাকি আরোহী আদৌ মদনকে আঘাত করতেই চায় নি। কিন্তু অর্নবের কথা অনুযায়ী সে একেবারে হুড়মুড় করে এসে পড়েছিল ওর উপরে। এমন ওস্তাদ বাইক রাইডার খুব কমই আছে, যারা সঠিক সময়ে বাইক থামাতে পারে। অর্নবের কথা সত্যি হলে এ কোনও ওস্তাদ বাইক রাইডারেরই কাজ। যে আদৌ মদনকে ঠুকে দিতে চায় নি। শুধু তার ঘাড়ের উপর এসে পড়েছিল। অথচ অত্যন্ত কৌশলে গায়ে একটা আঁচড়ও লাগতে দেয়নি।
    তবে তার উদ্দেশ্য কি ছিল? কাঁটা ফোটানো! তপন আচার্য তবে কি মিথ্যে বললেন? খুনগুলো সরাসরি তিনি করেননি, সঙ্গে অন্য কেউ আছে? তৃতীয় ব্যক্তি কেউ আছে এর মধ্যে।
    --‘আর বাঁশিটা? সেটা পরীক্ষা করে দেখেছেন?’
    --‘দেখেছি। ওটা সাধারণ একটা বাঁশিই। অন্য কিছু নয়। ব্লো পাইপ তো নয়ই’। তিনি একটু থেমে ফের বলতে শুরু করেন—‘আর যে ব্লো পাইপগুলো এনেছ, অন্তত এক যুগ ওগুলো কেউ ব্যবহারই করেনি। কোনও স্যালাইভা বা লালার নমুনা পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি হুইস্‌লেও। এই জাতীয় ডার্ট বা কাঁটায় কিউরারি বিষ ব্যবহৃত হত। কিন্তু এই ডার্টগুলোয় কোনও বিষ নেই। শুধু দুটো জায়গায় স্যালাইভার নমুনা পাওয়া গেছে। বাঁশিতে দুটো নমুনা। তার মধ্যে একটা তোমার লেজুড় অর্নবের। আরেকটা স্যাম্প্‌ল্‌ আন্‌নোন্‌। ইনহেলারটাতেও যে স্যালাইভা পাওয়া গেছে, সেটাও আন্‌নোন্‌’।
    নীল রঙের ইনহেলারটা তুলে ধরেছেন ডঃ চ্যাটার্জী—‘এটা স্যালবুটামল মিটারড ইনহেলার। সচরাচর অ্যাজ্‌মার অ্যাটাক হলেই ইউজড হয়। এটাতে যে স্যালাইভা পাওয়া গেছে, তার সাথে কিছু সেলও ছিল। যদিও নমুনা অনেক পুরনো। এর মালিক অনেক আগে এটা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই পুরনো নমুনাতেও কিছু কিছু জিনিস পাওয়া গেছে। বিশেষত পাওয়া গেছে নাইট্রিক অক্সাইড সিন্থেস ওয়ান বা এন ও এস ওয়ান। একজাতীয় এনজাইম বলতে পারো। মানুষের ক্ষেত্রে বলা হয় এন ও এস ওয়ান জিন। যার স্যালাইভা, তার অ্যাজমা, স্কিজোফ্রেনিয়া, রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম, বা বাইপোলার ডিস অর্ডারের সম্ভাবনা থাকতে পারে। এর মধ্যে অ্যাজমা তো ছিলই। নয়তো আর ইনহেলারটা এলো কোথা থেকে’।
    --‘ঐ চারজনেরই কারুর হবে’।
    --‘না—দুজনের কারুর’। ডঃ চ্যাটার্জী মাথা নাড়লেন—‘বাঁশিতে যে স্যালাইভা আছে তাতেও একটা দুটো সেল চলে এসেছে। ইনহেলারের স্যালাইভার সেল আর বাঁশির সেল এক লোকের নয়। কিন্তু ডি এন এ টেস্টিং করে দেখলাম যে দুজনের ডি এন এ একজাতীয়। অর্থাৎ অদ্ভুত মিল আছে দুটো ডি এন এ তে। মা, বাবা, ভাই, বোনের মধ্যেই একমাত্র এরকম মিল দেখতে পাওয়া যায়’।
    --‘তাহলে স্যাম্পল দুটো মা-ছেলের হওয়ার সম্ভাবনা আছে’।
    --‘নাঃ। ভুল হল। স্যাম্পল দুটো দুই ভাইয়ের’। তিনি টাক চুলকোচ্ছেন—‘ইনহেলারের স্যাম্পলটা কোনও পুরুষের। ক্যারিওটাইপিং করে দেখেছি। জেনোটাইপ এক্স ওয়াই। কোনও সন্দেহই নেই যে ইনহেলারের মালিক কোনও পুরুষ। এবং তিনি বংশীবাদকের ভাই’।
    অধিরাজ যেন মহাকাশ থেকে পড়ে! তপন আচার্যরা কয় ভাই! এতদিন জানত যে দুই ভাই। কিন্তু ইনহেলারের মালিক যদি মিঃ আচার্যের সহোদর হয়ে থাকেন, তবে আবছা ভাবে আরেক ভাইয়ের অস্তিত্বও টের পাওয়া যাচ্ছে! তপন আচার্যের অ্যাজ্‌মা নেই। থাকলে আর আড়বাঁশি বা ক্ল্যারিওনেট বাজাতে হত না। স্রেফ হার্টফেল করেই মারা যেতেন। প্রয়াত কর্নেল তড়িৎ আচার্যেরও অ্যাজমা থাকাই সম্ভব নয়। আর্মির একজন উঁচুস্তরের অফিসার অ্যাজ্‌মার রোগী—একথা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না! তবে? নিশ্চয়ই আরেক ভাইও আছে! কে সে! সেই কি তবে অজ্ঞাত বাইক রাইডার?
    যত ভাবছিল অধিরাজ, ততই সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। তবু একটা বিষয় অবধারিত ভাবে বুঝতে পারছে। এর মধ্যে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির হাত অবধারিত ভাবে আছে! তপন আচার্য একা নন্‌। আরও কেউ আছে। কিন্তু কে?
    --‘থ্যাঙ্কস্‌ ডক্‌’। সে আর কথা না বাড়িয়ে ফরেনসিক ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসে। নীচে দেবাশিষ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে আসতে দেখেই সন্ত্রস্ত হয়ে স্যালুট ঠুকল। তাকে দেখে অধিরাজ কিন্তু দাঁড়ায়নি। বরং দেবাশিষই তার পিছন নিয়েছে।
    --‘স্যার, বর্ধমান থেকে জীবন দাস এর ফ্যামিলি এসেছে। আই মিন, বাদশার মা, মামারা...’।
    গটগট করে হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর দিল অধিরাজ—‘বডি দিয়ে দাও’।
    --‘বাদশাকে কি আর রাখার দরকার আছে?’
    --‘নাঃ। ওকে যেতে দাও’। কি ভেবে যেন থমকে দাঁড়াল অধিরাজ—‘তবে জেনে নিও, ওরা কলকাতা ছেড়ে কবে যাচ্ছে। বাদশার সাথে কয়েকমিনিট কথা বলার দরকার। কয়েকটা জিনিস জানার আছে’।
    --‘আমি জেনে নেবো স্যার?’
    --‘নাঃ, শুধু বাদশাকে বলে দিও যে ওর বন্ধু ওর সাথে দেখা করতে চায়’। অধিরাজ চোখে সানগ্লাসটা চাপিয়ে নিয়েছে—‘আরেকটা কাজ করো। পুলিশ রেকর্ড ঘেঁটে বের করো, শহরে কতজন ওস্তাদ বাইকার ক্রিমিন্যাল আছে। সবার প্রোফাইল, ছবি সহ গোটা কেস হিস্ট্রি আমাকে ই-মেইল করে দাও। উইদ ইন টু আওয়ার্‌স্‌ সব ইনফরমেশন আমার চাই’।
    --‘ওকে স্যার’।
    আজ আর নিজে ড্রাইভিং করবে না অধিরাজ। তার ড্রাইভার এসেছে। সে পিছনের সিটে উঠে বসতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
    একটা সিগ্রেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলল সে—‘ডানকুনি চলো’।
    এই মুহূর্তে তপন আচার্যর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল অধিরাজ। লোকটা ক্রমাগতই বিভ্রান্ত করছে। প্রথমে তার অপরাধ কবুল করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। তারপর মদনের মৃত্যু। সেই সঙ্গে এক রহস্যময় বাইক আরোহীর আবির্ভাব! তার সাথে ডঃ চ্যাটার্জীর যুগান্তকারী আবিষ্কার! তপন আচার্য’র অ্যাজ্‌মার রোগী ভাই। সেই ভাই কোনভাবেই প্রয়াত কর্নেল আচার্য হতে পারেন না! তবে কে? ঘটনাগুলো কি সব আলাদা? না একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে? তপন আচার্য কি কাউকে লুকোতে চাইছেন?
    একের পর এক সিগ্রেট পোড়াতে পোড়াতে সে অর্নবকে ফোন করল।
    --‘ইয়েস স্যার’।
    --‘কোথায় আছ?’
    --‘ডানকুনিতেই। মিঃ আচার্যর বাড়ির সামনে’।
    --‘ফাইন’। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল অধিরাজ—‘বলার মত ঘটনা কিছু আছে?’
    --‘কিচ্ছু না স্যার’। অর্নব জানায়—‘ সকাল থেকে ও বাড়িতে তান্ডব হচ্ছে! যে মেয়েটি ও বাড়িতে ঠিকা কাজ করে, সে বেচারি আজ ঝাড় খেয়ে মরেছে! সেই বৃত্তান্তই শুনছি।’
    অধিরাজ তার কথায় বেশ মজা পেয়েছে—‘ঝাড়ের বৃত্তান্ত কে শোনাল তোমায়?’
    --‘মিঃ আচার্যর বাড়ির ড্রাইভার। তার সাথে দোস্তি পাতিয়ে নিয়েছি। কাল সে চলে গিয়েছিল। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি তার ডিউটি। পাঁচটার পর আর বেরোন না মিঃ আচার্য। বড়জোর কাছে পিঠে একটু হাঁটেন। তাই ড্রাইভারের প্রয়োজনও পড়ে না’। সে বলল—‘মালিকের উপর প্রচুর ক্ষার আছে লোকটার। পেটের দায়ে ড্রাইভারি করে বটে, তবে মালিককে দুচক্ষে দেখতে পারে না’।
    --‘বাঃ। ক্ষার থাকা ভালো। খবর বের করতে সুবিধে হয়’।
    --‘আর খবর স্যার!’ সে বিমর্ষ গলায় বলে—‘ ব্যাটা আমায় চাকরির জন্য ধরে পড়েছে। দুমিনিট এদিক ওদিক হলে, বা ডিউটিতে আসতে একটু দেরি হলেই ওর মালিক নাকি যাচ্ছেতাই করে। ইংরেজীতে ভুলভাল গালাগালি দেয়। আমাকে একজন শান্তশিষ্ট, নিরীহ মালিক খুঁজে দিতে বলছে। আমি এখন শান্তশিষ্ট মালিক কোথায় পাই বলুন তো!’
    --‘চিন্তার কি আছে?’ অধিরাজ হাসল—‘ওকে আমাদের ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ অসীম চ্যাটার্জীর কাছে পাঠিয়ে দাও। দুদিনেই ‘ক্ষ্যামা দে’ বলে পুরনো মালিকের কাছেই ফিরে যাবে’।
    অর্নবও হেসে ফেলল।
    --‘ ড্রাইভারের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ভালোই করেছ। ভিতরের খবর জানতে সুবিধে হবে’। অধিরাজ সিগ্রেটের অবশিষ্টাংশ গাড়ির মেঝেতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলে—‘তবে এখন কোনও অজুহাতে ওখান থেকে কেটে পড়ো। আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে পৌঁছচ্ছি’।
    --‘ওকে স্যার’।

    তপন আচার্যর বাড়িটা দিনের বেলায় অতটা ভয়ঙ্কর লাগে না। বরং রাতের বেলায় এর বিষণ্ণতাটা তেমন টের পাওয়া যায় না। এখন দেখলে বোঝা যায় যে, একসময় খুব ভালো সময় দেখেছে বাড়িটা। এখন যেন বেদনার বোঝা নিয়ে চুপ করে আছে। তার গায়ে সময়ের কালশিটে। ছোপ ছোপ শ্যাওলার দাগ অতীতের রঙ বিবর্ণ করে রেখেছে।
    মিঃ আচার্য বাড়িতেই ছিলেন। তাদে দেখেই হাসিমুখে স্বাগত জানালেন। ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘এখনও চব্বিশ ঘন্টা হয়নি। এর মধ্যেই হাত কেটে বসলেন! বাহাত্তর ঘন্টার পর আর কি কি কাটবেন?’
    --‘আর কি কি কাটা যাবে জানি না’। বাঁশিগুলোর দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বলল অধিরাজ—‘তবে যেটা প্রথমেই কাটা যাবে, সেটা হল নাক’।
    তপন আচার্য সজোরে হেসে উঠলেন—‘আই লাইক ইওর সেন্স অব হিউমার। তা সকাল সকাল কি মনে করে?’
    --‘কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর না জেনে ব্রেকফাস্ট হজম হচ্ছিল না। তাই এসে পড়লাম’।
    তিনি ভ্রূহীন মুখে একটা বঙ্কিম ভঙ্গি করেছেন—‘প্লিজ, প্রসিড’।
    --‘আপনি কি জানেন যে আপনার অ্যাটেন্ডেন্ট মদন কাল রাতে মারা গেছে?’
    ভাবলেশহীন ভাবেই উত্তর এল—‘শুনেছি’।
    --‘আপনি দুঃখিত নন্‌?’
    তার মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হল। এবার একটু রাগতস্বরেই বললেন—‘বিন্দুমাত্রও না। এক নম্বরের শয়তান। মরে গেছে ভালোই হয়েছে। দুনিয়ার একটা পাপ কমেছে’।
    অধিরাজ ভারি সুন্দর ভ্রূভঙ্গি করে—‘আপনার দুঃখের পরিমাণ দেখে সত্যিই দুঃখিত হলাম। লাশ শনাক্ত করতে কি যাবেন? না তাতেও আপত্তি আছে?’
    --‘আপনি কি এই সব প্রশ্ন করার জন্যই এসেছেন?’ তার চোখের সামনেই পা দিয়ে একটা চুরুট ধরালেন তিনি—‘আমাকে একটু পরেই বেরোতে হবে। একটা আর্জেন্ট মিটিং আছে’।
    --‘না না...আপনার বেশি সময় নেবো না’। অধিরাজ বিনয়ের অবতার—‘আর শুধু দুটো প্রশ্ন করার ছিল’।
    --‘করে ফেলুন’।
    --‘আপনার কোন্‌ ভাইয়ের অ্যাকিউট অ্যাজ্‌মা আছে?’
    তপন আচার্য যেন এই প্রথম চমকে উঠলেন। তবে মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিয়েছেন। তার মুখে ফের বজ্জাতিমার্কা হাসিটা ফিরে এসেছে।
    --‘তার মানে কাল আপনারই এ ঘরে শুভাগমন হয়েছিল’। আস্তে আস্তে বললেন—‘অত কষ্ট করতে গেলেন কেন? আমাকে বললেই দরজা খুলে রাখতাম। জানলা ভেঙে ঘরে ঢোকাটা আর যাই হোক, পুলিশোচিত কাজ হয়নি। টিটেনাস নিয়েছেন তো?’
    --‘আজ্ঞে হ্যাঁ’। সে আরও বিনীত—‘আপনার জানলাটার জন্যও দুঃখিত। আশা করি এর মধ্যেই মেরামত করে ফেলবেন। যাই হোক্‌, প্লিজ বলুন, আপনার কোন ভাইয়ের অ্যাকিউট অ্যাজ্‌মা আছে’?
    তপন আচার্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। কি উত্তর দেবেন, ভাবছেন। বেশ কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিলেন—‘এখন নেই। তবে আগে ছিল। আমার’।
    অধিরাজ তার দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার বলার ভঙ্গিতেই স্পষ্ট যে, তিনি মিথ্যে বলছেন। তার জন্মেও অ্যাজমা ছিল না। থাকলে স্যালাইভার স্যাম্পলেই ডঃ চ্যাটার্জী তার ট্রেস পেতেন।
    --‘আপনারা ক’জন ভাই?’
    --‘হাস্যকর প্রশ্ন’। তপন আচার্য বিরক্ত হয়ে বলেন—‘আপনার জেরা শেষ হয়ে থাকলে এখন আসতে পারেন’।
    অনুরোধ নয়, একেবারে স্পষ্ট আদেশ। অধিরাজ বুঝল তিনি কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। সে আর কথা বাড়ায় না। শুধু বাঁশিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলল—‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তবে পাঁচ মিনিট আমি বাঁশিগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখতে পারি?’
    ভদ্রলোক হেসে ফেললেন—‘বাঁশির প্রতি আপনার এত অনুরাগ দেখে ভালো লাগল। পাঁচ মিনিট কেন? আপনি ওগুলো অফিসে বা বাড়িতেই নিয়ে যেতে পারেন। দাঁড়ান...। শিবু...শিবু...!’
    হাঁকডাক শুনে ড্রাইভার ছুটে এল। তার দিকে সহাস্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন—‘এখানে যে ক’টা বাঁশি আছে, সবগুলো খুব সাবধানে এই সাহেবের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো। দেখো, যেন একটাও পড়ে গিয়ে ভেঙে না যায়। ভাঙলে আমি তোমার মাথা ভাঙবো। বুঝেছ?’
    শিবু মাথা নেড়ে জানায়, সে বুঝেছে।
    --‘নিজের হাতে আপনার গাড়িতে তুলে দিতে পারলে ভালো লাগত’। তপন আচার্য বিষণ্ণ হাসলেন—‘কিন্তু আমি অক্ষম লোক। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড’।
    অধিরাজ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল—‘এগুলো নিশ্চয়ই ফেরৎযোগ্য?’
    --‘হ্যাঁ। ফেরৎযোগ্য। তবে আরও কয়েক ঘন্টা পর’। তার চোখে কুটিলতা—‘আপনিও তো ফেরৎযোগ্য। আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমার সম্পত্তি। ভদ্রলোকের এক কথা’।
    --‘অফকোর্স’। অধিরাজের মুখে মোলায়েম হাসি—‘গোটা ব্যাপারটাই ভাইস ভারসা। চিন্তা করবেন না’।

    ৮.

    চিন্তিত মুখে নিজের কেবিনে বসেছিল অধিরাজ। কিছুতেই যেন মিলছে না গোটা ঘটনাটা! তপন আচার্যর মত একজন সাধারণ মাছের ব্যবসায়ী কি করে খুঁজে পান মেডালা অবলাঙ্গেটার মত দুরূহ জায়গা! যার হাত নেই, সে কিভাবেই বা রাজকাঁকড়ার কাঁটা ফুটিয়ে খুন করতে পারে? ব্লো পাইপ দিয়ে? তবে ব্লো পাইপটা আছে কোথায়? বাঁশিগুলোর একটা কি? তাই বা কি করে সম্ভব! বাঁশি বাজাতে বাজাতে কেউ খুন করতে পারে! ঐ অজ্ঞাত বাইক আরোহীর ভূমিকা কি? সে-ই কি আসল খুনী? তবে তপন আচার্য নিজেই খুনের দায় নিলেন কেন? অ্যাজ্‌মার রোগ আচার্য ফ্যামিলির কোন্‌ ছেলের আছে? দুজনের একজনও ঐ রোগটায় আক্রান্ত নয়। তবে? তৃতীয় কেউ? তপন আচার্য এখানেও রোগটা নিজের ঘাড়েই নিলেন! এই অভাবিত স্যাক্রিফাইসের মানে কি?
    সে চিন্তায় চিন্তায় ক্রমশই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিল। দেবাশিষ ইতিমধ্যেই বাইক এক্সপার্ট ক্রিমিন্যালদের লিস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। ইমেল খুলে তাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড অন্যমনস্ক চোখে দেখছে। এদের মধ্যে সাতজন ছেলে। একজন মেয়ে। প্রিয়াঙ্কা বর্মা। মেয়েটি আগে ফিল্মে নায়িকার স্টান্ট করত। কিন্তু ফিল্মে নায়িকারা সচরাচর বাইকে চড়ে না। বাধ্য হয়েই সে বাইক ট্রেনিং সেন্টার খোলে। তাতেও বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় চলে আসে অপরাধজগতে। ব্যাঙ্ক লুট, কেপমারি, কিডন্যাপিং—অপরাধের লিস্ট নেহাৎ কম নয়। গত বছর সে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখন কোথায় আছে, কি করছে জানা নেই।
    এছাড়াও আরেকটা প্রোফাইল তার বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। গুরুদেব সিং নামের একটি ছেলে আগে সার্কাসে বাইকের খেলা দেখাত। বন্ধ লোহার খাঁচায় বাইক স্টান্ট করত। কিন্তু স্টান্ট করতে গিয়েই গুরুতর আহত হয় সে। সার্কাসের দল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরই অপরাধ জগতে পদার্পন। লিস্টও লম্বা। দু বছর আগে তারও জেল খাটার মেয়াদ শেষ হয়েছে। গুরুদেব সিঙের পাত্তা এরপর আর পাওয়া যায়নি।
    বাদবাকিদের এখনও জেল থেকে বেরোবার সময় হয়নি। শুধু এই দুজনই বাইরে আছে। আর এই দুজনের আচার্য ফ্যামিলির সাথে কোনও সম্পর্ক নেই!
    অধিরাজ মন দিয়ে প্রিয়াঙ্কা বর্মা আর গুরুদেব সিঙের ফটো দেখছিল। একেবারেই নিরীহ বিশেষত্বহীন চেহারা। দেখলে মনে হয় না যে দুজনেই ওস্তাদ বদমায়েশ! তবে যতই দুষ্কর্ম করে থাক, দুজনের একজনও এখনও পর্যন্ত মার্ডার করেনি।
    --‘বন্ধু’।
    একটা মিষ্টি গলার স্বর শুনে সে সচকিত হয়ে ওঠে। বাদশা তার কেবিনের দরজা খুলে উঁকি মারছে। পিছনে অপ্রস্তুত মুখে দেবাশিষ।
    --‘আপনার সাথে দেখা করার জন্য বড্ড জেদ করছিল স্যার। তাই নিয়ে এলাম’।
    অধিরাজ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সস্নেহ হাসে—‘বেশ করেছ। আসুন জাঁহাপনা’।
    সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। বাদশার হাবভাব একটু সন্ত্রস্ত। জমকালো কেবিন দেখে বোধহয় একটু ঘাবড়েই গেছে।
    বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বলল অধিরাজ—‘জাঁহাপনার মা এসেছেন শুনলাম। এবার তো বন্ধুকে ছেড়ে টা টা বাই বাই করে চলে যাবেন হুজুর। কখনও মনেও পড়বে না’।
    বাদশা বলল—‘আমি বড় হলে একা একা চলে আসবো তোমার সাথে দেখা করতে’।
    --‘হুজুর যতদিনে বড় হবেন, ততদিনে এই বন্ধুটা বুড়ো হয়ে মরে যায় যদি?’
    তার মুখ চেপে ধরল বাদশা। মাথা নেড়ে বলে—‘ওকথা বলতে নেই’।
    অধিরাজ হো হো করে হেসে উঠেছে। তাকে কোল থেকে নামিয়ে নিজের চেয়ারে বসিয়ে দিল। সকৌতুকে জানতে চাইল—‘সকালবেলা হুজুর আজ কি খেলেন? চাউমিন না মোগলাই?’
    --‘চাউমিন’। সে বন্ধুর গলা জড়িয়ে ধরেছে—‘আচ্ছা। তুমি কি বড়সাহেব?’
    --‘উঁহু’। অধিরাজ মাথা নাড়ল—‘তুমি বড়সাহেব’।
    --‘আমি না। তুমি। সবাই তোমায় বড়সাহেব বলে’।
    --‘যার খুশী, সে বলে। আমি তো তোমার বন্ধু’। বাচ্চাছেলের মত ঘাড় কাৎ করে বলল সে—‘তাছাড়া আমি এখন বড়সাহেব নই। এখন তুমি বড়সাহেব’।
    ব্যাপারটা ছেলেটার ছোট্ট মাথাটায় ঢুকল না। অধিরাজ তাকে বুঝিয়ে বলে—‘যে চেয়ারটায় তুমি বসে আছো—ওটা বড়সাহেবের চেয়ার। আমি এতক্ষণ বসেছিলাম। তাই সবাই বড়সাহেব বলছিল। এখন কে বসে আছে?’
    বাদশা বলল—‘আমি’।
    --‘তবে বড়সাহেব এখন কে হল?’
    সে খিলখিলিয়ে হাসে। সুর করে বলে—‘আ-মি’।
    --‘তবে?...তবে?’ অধিরাজ তাকে কাতুকুতু দিতে দিতে বলে—‘কে বড়সাহেব?... কে বড়সাহেব?...’
    বাদশা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কখনও ছদ্মরাগে গাল ফোলাচ্ছে। কখনও বন্ধুকে জড়িয়ে ধরছে। বেশ কিছুক্ষণ খুনসুটি করার পর দুজনেই শান্ত হল।
    --‘আচ্ছা বন্ধু’। বাদশার ঘেঁটে যাওয়া চুল সযত্নে গোছাতে গোছাতে বলল সে—‘তুমি বাবার সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলে কেন বলো তো?’
    বাবার কথা বলতেই বাদশার মুখ বিষণ্ণ হয়ে আসে—‘আমি শহর দেখতে এসেছিলাম’।
    বাদবাকিটা অধিরাজ নিজেই বুঝে নেয়। বাবার হাত ধরে কলকাতা দেখতে এসেছিল বাচ্চাটা। কিন্তু তার বরাতে কলকাতা দেখা নেই!
    সে একমুহূর্ত কি যেন ভাবল। সামনে তখনও কেসহিস্ট্রিগুলো খোলা আছে। টেবিলে পড়ে আছে গুচ্ছ কেসফাইল। সব তাকে দেখতে হবে। তা সত্বেও একটু চুপ করে থেকে বলল—‘বন্ধুর সাথে কলকাতা দেখবে সোনা?’
    বাদশা প্রায় লাফিয়ে ওঠে—‘দেখবো...দেখবো...তুমি দেখাবে?’
    --‘নিশ্চয়ই দেখাবো’।
    দেবাশিষ তখনও দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে বলল অধিরাজ—‘হুজুরের মাকে জিজ্ঞাসা করো। বলো যে, আমি বাচ্চাটাকে কলকাতাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে চাই। উনি কি পারমিশন দেবেন?’
    বাদশার মায়ের পারমিশন পেতে খুব অসুবিধে কিছু হল না। স্বামীকে হারিয়ে কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে বসেছিলেন মহিলা। শোকটা এখনও সামলে উঠতে পারেননি। ছেলেটাকে সামলাতে পারছিলেন না। তার সামনে কাঁদতেও পারছিলেন না। কারণ বাদশা জানে না যে, তার বাবা আর নেই। ফরম্যালিটি হিসাবে শনাক্তকরণও করতে হবে। বাচ্চাটাকে নিয়ে লাশও শনাক্ত করা মুশকিল। এমতাবস্থায় ছেলে বড়সাহেবের সাথে বেড়াতে যেতে চায় শুনে আপত্তি করলেন না।
    অধিরাজ তার সমস্ত কাজ কর্ম ছেড়ে বাদশাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল কলকাতা ঘুরতে। গোটা দিন ধরে তারা শুধু ঘুরে বেড়াল। গঙ্গায় নৌকো চড়ল। গঙ্গার বুক থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু দেখতে পেয়ে বাদশার কি নাচানাচি! তারপর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, ইডেনগার্ডেন, যাদুঘর—একে একে সব দেখা হল। শপিংমলে ঢুকে বাচ্চাটার পছন্দমতন খেলনাও কেনা হল। নিক্কোপার্কে হরর’স হাউস দেখে বাদশা ভয়েই ঠান্ডা। ‘বাবা রে...বাছা রে’ করে তাকে বোঝাতে হল, ভূত গুলোও আসলে সব খেলনা! একটাও আসল নয়। একই অবস্থা সায়েন্সসিটিতেও! ডাইনোসোর দেখে সেই যে লাফ মেরে অধিরাজের কোলে চড়ে বসল, আর নামার নাম নেই!
    অবশেষে সারাদিন নেচেকুঁদে, বাইরে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া করে রাত্রে দুজনে ফিরছিল। বাদশা খুব খুশী। তার কলকাতা দেখা হয়েছে। সে আজ একটা মস্তবড় হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেয়েছে। কি ঝকঝকে মসৃণ মেঝে! প্রায় ধপাস করে পড়ার উপক্রম! আর কতগুলো লাল জামা পরা লোক মাথায় কেমন জরি দেওয়া পাগড়ি পরেছে! এরা খাবারের সাথে কত চামচ দেয়! বাদশা তো ভেবেই পায় না কোন চামচটা দিয়ে খাবে। আর চামচ দিয়ে কেউ ভাত খায় নাকি! সে জুলজুল করে দেখছিল, বন্ধু-বড়সাহেব তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাতা গুটিয়ে নিয়েছে। হাত দিয়েই ভাত খাচ্ছে! তাকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। কিন্তু তখনও বিস্ময় বাকি ছিল! খাওয়ার পর আইসক্রিমের বহর দেখেও তার চক্ষু চড়কগাছ! কলকাতার লোকেরা এত বড় বড় আইসক্রিম খায়! এত বড় আইসক্রিমের গোটাটা সে একা খাবে! ভাবতেই অবাক লাগে বাদশার।
    অধিরাজ মাঝেমধ্যেই আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছিল। কলকাতার রাস্তায় গাড়ির সাথে সাথে বাইকেরও সমাগম। ছেলেটা বাইক দেখলেই কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছে। সে এতক্ষণ ধরে কিছু বলেনি। শুধু বাচ্চাটার রি-অ্যাকশন দেখে যাচ্ছে। বাইক দেখলেই কি অদ্ভুত আশঙ্কায় বারবার অধিরাজের গা ঘেঁষে আসছে। যেন এক্ষুণি বাইকটা এসে ধাক্কা মারবে!
    ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর থেকেই সে আরও বেশি করে বাইকগুলোর গা ঘেঁষে গাড়ি চালাচ্ছিল। বাদশা তার ছোট্ট হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে অধিরাজের হাত।
    --‘কি হল? ভয় লাগছে?’
    --‘হুঁ’। স্তিমিত গলায় বলে বাদশা।
    --‘কেন?’
    --‘ঐ ভটভটিগুলো যদি ধাক্কা মারে?’
    ভটভটি মানে বাইক। অধিরাজ বুঝতে পারে তার সন্দেহ একদম সঠিক রাস্তায় যাচ্ছে। বাদশার বাবার মৃত্যুর পিছনেও বাইক আরোহীর ভূমিকা আছে।
    --‘কেন ধাক্কা মারবে?’ সে ইচ্ছে করেই তর্ক জুড়ে দেয়—‘ভটভটিগুলো কাউকে ধাক্কা মারে না’।
    --‘তবে বাবাকে কেন মারল?’ বাদশা উঁচুস্বরে বলে—‘ধাক্কা মারল বলেই তো বাবা ঐ লোকটার গায়ে গিয়ে পড়ল’।
    --‘কোন লোকটার?’
    --‘ঐ হাতকাটা লোকটার!’ সে জানাল—‘তারপর লোকটা পাশ দিয়ে চলে যেতেই বাবা পড়ে গেল’।
    অধিরাজ আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে—‘আচ্ছা বাদশা, তুমি ভটভটিতে বসে থাকা লোকটাকে দেখেছ?’
    --‘না তো। মুখোশে মুখ ঢাকা ছিল’। মুখোশ মানে সম্ভবত হেলমেট। বাদশা আপনমনেই বলে—‘কিন্তু ভটভটিতে একটা মেয়ে ছিল’।
    --‘মেয়ে ছিল!’ অধিরাজ বিস্মিত—‘এই যে বললে মুখ দেখোনি! তবে বুঝলে কি করে যে মেয়ে?’
    --‘মেয়ে ছাড়া কারুর অত বড় চুল থাকে? মেয়ে ছাড়া কেউ হাতে চুড়ি পরে? তুমি কিচ্ছু জানো না!’
    --‘সত্যি বন্ধু...আমি কিচ্ছু জানি না। পড়াশোনা করিনি তো-তাই’। অধিরাজ উৎসুক হয়ে বলে—‘কিন্তু মুখোশে তো গোটা মাথাটাই ঢাকা থাকে। তুমি চুল দেখলে কোথায় বাবা?’
    --‘ভটভটিটা যখন বাবাকে ধাক্কা মারল, তখন ভটভটিটা লাফিয়ে উঠেছিল। মুখোশটা একটু হেলে গিয়েছিল। তখনই দেখেছি’। বাদশা চোখ গোলগোল করে বলে—‘এত্ত বড় লম্বা চুল। বিনুনি করা! হাতে চুড়ি’।
    --‘হাতে চুড়ি! কতগুলো চুড়ি!’
    বাদশা একটু ভাবল। যেন দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করছে—‘একটাই চুড়ি ছিল। মোটা’।
    লম্বা চুল! বিনুনি করা! চুড়ি! সে বাদশার দিকে কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাচ্চারা অনেকসময় কাল্পনিক কথা বলে। কিন্তু বাদশা বানিয়ে বলছে বলে মনে হয় না। অর্নবের চোখের সামনে যে খুনটা হয়েছে, সেখানে এক বাইক আরোহীর ভূমিকা ছিল। বাদশার বাবার মৃত্যুর ক্ষেত্রেও সেই বাইক আরোহী যথারীতি উপস্থিত! অন্যান্য কমন ফ্যাক্টরের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত এই রহস্যময় লোকটির অস্তিত্বও অন্যতম কমন ফ্যাক্টর!

    বাদশাকে তার মায়ের কাছে ছেড়ে চিন্তান্বিত মুখে বাড়ি ফিরে এল অধিরাজ। কিন্তু নিরিবিলিতে চিন্তা করার উপায় নেই! বাড়িতে তখন কুরুক্ষেত্র চলছে। সে জুতো খুলতে খুলতেই শুনতে পেল বাবা কুঁইকুঁই করে বলছেন—‘তুমি কি আগের জন্মে ব্রিগেডিয়ার ছিলে! দু মিনিট তো মাত্র দেরি হবে! তাতেই এমন ফায়ারিং?’
    মা’র গলা বেশ চড়া—‘ দুমিনিট মানে? দুমিনিটে আমি বইয়ের আলমারির মাথাটা দিব্যি পরিষ্কার করে ফেলতে পারি। রাজ্যের জঞ্জাল জমা করতে তোমার কয়েক সেকেন্ড লাগে, আর একটা মই জোগাড় করতে দু মিনিট!’
    --‘জাস্ট দু মিনিট দাও। আমি এনে দিচ্ছি...’ বাবার কাতর অনুনয়।
    --‘দুঘন্টা ধরেও তোমার দু মিনিট শেষ হল না!’ মা আরও ক্ষেপে গেছেন—‘কখন আমি আলমারির মাথাটা গুছোবো, কখন রান্না করবো! আমার কি কুড়িটা হাত আছে!’
    বাবা বিড়বিড় করছেন—‘কুড়িটা হাত থাকলে কি আর রক্ষে ছিল! অন্তত কুড়িবার গলা টিপে মারতে!’
    --‘বিড়বিড় করে আমার নিন্দে করে লাভ নেই। কাজের কাজ কিছু করো’।
    অধিরাজ আন্দাজ করল মই নিয়ে ফের দুজনের লেগেছে। মা ইদানীং ‘জঞ্জাল হটাও’ অভিযানে নেমেছেন। বাবার স্বভাবই হল গুচ্ছের অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আলমারির মাথায় জমা করে রাখা। কোন কিছুই ফেলতে তাঁর ইচ্ছে করে না। ছেঁড়া মোজা থেকে শুরু করে ভাঙা ফুলদানি, ছেঁড়া স্কার্ফ—সব কিছু জমিয়ে রাখেন। পাছে মা সেগুলো টান মেরে ফেলে দেন সেই ভয়ে যেখানে যেখানে তাঁর হাত পৌঁছয় না, সেইসব জায়গায় গুঁজে রাখেন। কিন্তু মা আজ সকাল থেকেই প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন, জঞ্জাল সরাবেনই। মইটা থাকলে এতক্ষণে সরিয়েও ফেলতেন। সম্ভবত সেই আশঙ্কাতেই বাবা ওটাকে কোনও গুপ্ত জায়গায় পাচার করেছেন।
    --‘আর এক মিনিটের মধ্যে মই না এলে আমি আত্মহত্যা কোরবো বলে দিলাম’।
    মায়ের চিরাচরিত ডায়লগ! রেগে গিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই দুটো শক্ত হাত তাকে অনায়াসে তুলে নিল। সযত্নে বসিয়ে দিল কাঁধে।
    --‘রাজা!’ মা অবাক হয়ে নীচের দিকে তাকিয়েছেন—‘তুই অফিস থেকে কখন ফিরলি’!
    অধিরাজ স্মিত হাসল—‘এইমাত্রই। ফিরেই শুনলাম মই নিয়ে তোমরা খন্ডযুদ্ধ করছ। বাড়িতে একটা জ্যান্ত ছ’ফুট চার ইঞ্চির মই থাকতে এত চিন্তা কিসের?’
    --‘কিন্তু তুই এইমাত্রই অফিস থেকে ফিরলি...’। মা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন—‘কোথায় রেস্ট নিবি তা নয়...’।
    --‘আমাদের কি রেস্ট থাকতে আছে মা?’ সে ছেলেমানুষের মত হাসে—‘ এতক্ষণ মই মই করে চেঁচাচ্ছিলে। এখন মই হাজির। তবে রেস্টের অজুহাত দিচ্ছ কেন? নাকি পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছ?’
    মা মৃদু হাসেন—‘তোর কাঁধ থেকে কোনওদিন পড়েছি যে এখন ভয় পাবো?’
    বাবা আড়চোখে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখলেন। মন্তব্য করলেন—‘ব্রিগেডিয়ারের নাতনির ভয়ে আমি তো চিরকালই ল্যাম্পপোস্ট হয়ে থাকলাম। আজ তুইও মই হলি! ঘরের শত্রু বিভীষণ!’
    অধিরাজ উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। মা দিব্যি তার কাঁধের উপর আরামসে বসে পা দোলাচ্ছেন। এমন নিশ্চিন্তে বসে আছেন, যেন কোনও মানুষের কাঁধে নয়, সত্যিই একটা কাঠ বা স্টিলের মইয়ে চড়েছেন। আলমারির মাথা হাতড়াচ্ছেন আর একের পর এক বের করছেন অদরকারি জিনিসপত্র।
    --‘এটা কি’! একজোড়া অতি পুরোনো ছেঁড়া জগার্স শু বের করে বাবার নাকের সামনে ধরেছেন তিনি—‘এটাকে এখনও ফেলে দাওনি কেন?’
    --‘না, ভাবছিলাম যদি দরকার পড়ে...’।
    --‘দরকার পড়বে!’ মা চোখ কপালে তুলে ফেলেছেন—‘যার সকাল ন’টার আগে ঘুম ভাঙে না, তার জগার্স শু’র কি দরকার?’
    --‘না, রাজা তো জগিং করে। যদি ওর দরকার হয়’?
    --‘রাজার নিজস্ব জগার্স শু আছে’।
    --‘যদি কখনও ওরটা ছিঁড়ে যায়!’
    --‘ছিঁড়ে গেলেও ও এই রদ্দিমার্কা শতছিন্ন জগার্স শু কখনই পড়বে না। বরং আরেকটা কিনে নেবে। তাছাড়া তোমাদের দুজনের পায়ের মাপও এক নয়। তবে?’
    বাবা আর কোনও অজুহাত খুঁজে পেলেন না। বাধ্য হয়েই কাঁচুমাচু মুখ করে তাকে জুতোটা ফেলে দিতেই হল।
    মাকে কাঁধে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সব কথাবার্তাই শুনছিল অধিরাজ। শুনতে শুনতেই কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ তার চোখ বিস্ফারিত। আপনমনেই কি যেন ভাবতে ভাবতে ফিসফিস করে উঠল—‘তাই তো!...তাই তো!’
    --‘কি তাই তো!’ বাবা কেঁউমেউ করে উঠলেন—‘এই মহিলা আমার সব প্রিয় জিনিস গুলো ফেলে দিচ্ছে। রীতিমত বসিং করছে। আর তুই মাতৃভক্ত হনুমানের মত তাকে ঘাড়ে তুলছিস্‌’!
    --‘মেয়েদের বসিং মেনে নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই বাবা’। সে হাসল—‘ইনফ্যাক্ট মেয়েরা অনেকক্ষেত্রেই ছেলেদের থেকে ভালো বস্‌ হয়। বিশ্বাস না হয়, পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমি অলরেডি করে দেখেছি’।
    --‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল!’ গজগজ করতে করতে তিনি চলে গেলেন।
    প্রায় আধঘন্টা ধরে সাফাই পর্ব চলল। তারপর সান্ধ্যকালীন স্নান সেরে অধিরাজ নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। মায়ের সামনে সে সচরাচর স্মোক করে না। তাই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে একটা সিগ্রেট ধরাল। এখন তার পরনে ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। গায়ে ভুরভুর করছে ফরাসী সৌরভ। সে চিরকালই ভীষণ শৌখিন। প্রচন্ড কষ্ট যেমন করতে পারে, তেমনি বিলাসিতায়ও তার জুড়ি মেলা ভার!
    নিজের ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল অধিরাজ। অদ্ভুত কিছু একটা তার মনে পড়ে গেছে। কিন্তু শুধু মনে পড়লেই হবে না। এখনও সে যুক্তিসঙ্গত অনুমানে পৌঁছতে পারেনি। একটা সন্দেহ মাথায় ঘুরছে। সেটাকে আরেকটু শক্তপোক্ত করে তুলতে হবে।
    সে মোবাইলটা তুলে নেয়। অস্থির আঙুলে অর্নবের নম্বরটা প্রেস করল। ওপ্রান্তে কিছুক্ষণ রিং। ঠিক পনেরো সেকেন্ডের মাথাতেই ফোন ধরল অর্নব।
    --‘বলুন স্যার’।
    --‘তুমি এইমুহূর্তে কোথায়?’
    অর্নবের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এল—‘মিঃ আচার্যর বাড়ির সামনেই এখনও থাবা পেতে বসে আছি’।
    --‘এনি প্রোগ্রেস?’
    --‘নো স্যার’।
    সে একমুহূর্ত কি যেন ভাবল—‘তোমার আর পাহারা দেওয়ার দরকার নেই। এক কাজ করো। স্ট্রেট ঢুকে যাও মিঃ আচার্যর বাড়িতে’।
    অর্নব প্রায় ভির্মি খেতে খেতে বাঁচল। ঢোঁক গিলে বলে—‘সোজা ওনার বাড়ি ঢুকবো? ঢুকে কি করবো?’
    --‘বিশেষ কিছু না’। অধিরাজ একটু থেমে বলে—‘শুধু ছাই ফেলার জন্য উনি যে অ্যাশট্রেটা ব্যবহার করেন, সেটাই চেয়ে নিয়ে আসবে’।
    --‘অ্যাশট্রে!’ সে আরও অবাক—‘শুধু অ্যাশট্রেটাই আনবো? উনি দেবেন?’
    --‘নিশ্চয়ই দেবেন। ওনার আরও গোটা তিনেক অব্যবহৃত অ্যাশট্রে আছে। একটা অ্যাশট্রে চেয়ে আনলে কিছু মনে করবেন না’।
    অর্নব ভেবে পাচ্ছিল না-এত কিছু থাকতে অ্যাশট্রেই কেন! আমতা আমতা করে বলে—‘যদি উনি না দেন?’
    --‘ইন দ্যাট কেস, শুধু অ্যাশট্রের ভিতরের ছাইটা এভিডেন্স ব্যাগে ভরে আনবে। এনে কাল সকালেই সোজা জমা দেবে ফরেনসিক ল্যাবে। ডঃ চ্যাটার্জীকে বলবে ছাইয়ের স্যাম্প্‌ল্‌টা পরীক্ষা করে দেখতে। তার ভিতরে কোনও ফরেন স্যাম্প্‌ল্‌ আছে কি না সেটা জানা দরকার’।
    অর্নব যদিও মাথামুন্ডু কিছু বুঝল বলে মনে হল না। তা সত্বেও বলল—‘ওকে স্যার। হয়ে যাবে’।
    অধিরাজ ফোন কেটে দিয়ে বিছানার উপর শুয়ে পড়েছে। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে কি যেন ভাবছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ফের উঠে বসল। এবার টেনে এনেছে তার ল্যাপটপ। ই-মেইলের মধ্যে তখনও দেবাশিষের পাঠানো প্রিয়াঙ্কা বর্মা আর গুরুদেব সিঙের ছবিদুটো রয়েছে।
    সে ছবিদুটো ওখান থেকে ডেক্সটপে সেভ করল। প্রিয়াঙ্কা বর্মার মাথায় ছেলেদের মত ছোট করে ছাঁটা চুল। গুরুদেব সিঙের চুলে আবার আর্মি ছাঁট! কিছু না ভেবেই অধিরাজ দুটো ফটোকেই ফটোশপে ফেলল। ছবির উপরে নিজের মনে আঁকিবুকি কাটছে। ছবিদুটোকে নতুন রূপে সাজাচ্ছে।
    সাজানো শেষ হয়ে গেলে সে খুব খুঁটিয়ে ফটোদুটো দেখল। দেখতে দেখতেই তার মুখে একটা পাতলা হাসি ভেসে ওঠে। আপনমনেই বলে—‘বোঝো!’

    ৯.

    এভিডেন্সের বহর দেখেই নাচতে শুরু করলেন ডঃ চ্যাটার্জী! রাগে আগুন হয়ে, তেলে ফেলা বেগুনের মত চড়বড় করতে করতে বললেন—‘তোমরা শুরুটা কি করেছ? একজন কালকে একডজন বাঁশি দিয়ে গেছে। আর তুমি আজ কতগুলো ছাই নিয়ে এসে হাজির হয়েছ! তোমরা গুরু আর চ্যালা মিলে আমায় জোকার ভেবেছ? আমি কি গায়ে ছাইভস্ম মেখে বাঁশি বাজাবো!’
    অসীম চ্যাটার্জীকে দেখে মনে হচ্ছিল, বাঁশি নয়, হাতে ডমরু থাকলে তাঁকে বেশি মানাত! কিন্তু সে কথা অধিরাজ ব্যানার্জীর মুখে বেশি মানায়। অর্নবের সেকথা বলার এক্তিয়ার নেই। সে আস্তে আস্তে বলে—‘স্যার আপনাকে ছাইটা টেস্ট করে দেখতে বলেছেন’।
    --‘কেন শুনি?’ তিনি আরও চটে গিয়ে বললেন—‘তোমার স্যার কি রবিঠাকুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন নাকি? ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো...’।
    --‘রাজকাঁকড়ার কাঁটা’। আপ্তবাক্যটা শেষ করার আগেই ব্যারিটোন ভলিউমে উত্তর এল। অধিরাজ লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় হুড়মুড় করে অসীম চ্যাটার্জীর ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে—‘ও বেচারাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন? ওকে আমিই ছাইটা আনতে বলেছিলাম’।
    অসীম চ্যাটার্জী ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপরই সজোরে এলো তার উত্তর—‘হ্যাঁচ্ছো-ও-ও-ও-ও!’
    --‘সেরেছে’। অধিরাজ কয়েক কদম সরে গিয়েছে। রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল—‘ আপত্তি থাকলে ‘পারবো না’—বললেই তো হত। রাগপ্রকাশের জন্য নাকের জলে মুখ ভিজিয়ে দেওয়া খুব জরুরী ছিল?’
    --‘ছিল। তোমার ঐ মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তির উপর আমার একটু রাগই আছে। ভালো শোধ নেওয়া গেছে। এবার রুমালটা দাও’। ফ্যাঁচফোঁচ করে নাক টানতে টানতে বলেন তিনি—‘নাক মুছবো’।
    --‘নাক ঝাড়ার জন্য আমার রুমালটাই দরকার আপনার! নিজের রুমাল নেই?’
    --‘ল্যাবে ছাই আনার আগে মনে ছিল না!’ ডঃ চ্যাটার্জী গরগর করলেন—‘আমার শখ হয়েছে। তোমার রুমালেই নাক ঝাড়লে গায়ের জ্বালা মিটবে আমার’।
    --‘এর কোনও যুক্তি আছে!’
    --‘আছে। আমার নাক সোনা দিয়ে বাঁধানো’। খরখরে গলায় উত্তর এলো—‘তাই সিল্কের রুমাল না হলে চলছে না’।
    অগত্যা বিনাবাক্যব্যয়ে সে রুমাল এগিয়ে দেয়। ভঁচভঁচ করে রুমালে একচোট নাক ঝেড়ে বললেন ডঃ চ্যাটার্জী—‘আঃ, এতক্ষণে শান্তি হল। বলো, কি জানতে চাও’।
    রুমালটা অধিরাজের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সে শান্ত স্বরে বলে—‘ওটা আপনার কাছেই থাক ডক্‌। প্রয়োজন পড়লে মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে ওর ভিতরের ব্যাক্টিরিয়ার শোভা দেখবেন। ধরে নিন—আমার গিফট’।
    --‘বেশ’। রুমালটাকে টেবিলের উপরে রাখলেন তিনি—‘আগে আসি বাঁশির কথায়। একডজন বাঁশি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখেছি। ওর মধ্যে কোথাও ব্লো পাইপ নেই। ইনফ্যাক্ট থাকার সম্ভাবনাই নেই। কোনও লুকোনো পকেট দেখিনি। অতএব ওগুলো বাঁশিই। অন্যকিছু নয়’।
    --‘জানি’।
    --‘জানো!’ ডঃ চ্যাটার্জী অবাক—‘তাহলে আমায় খামোখা জ্বালিয়ে মারলে কেন?’
    --‘সরি’। অধিরাজ হাসল—‘কারণ কাল রাতের আগেও জানতাম না ব্লো পাইপটা ঠিক কোথায় আছে’।
    --‘তুমি জানো ব্লো-পাইপটা কোথায়?’
    --‘শুধু আমিই নই। সম্ভবত আজকের মধ্যে আপনিও জেনে যাবেন’।
    --‘বলো কি!’ চাপা উত্তেজিত স্বরে বললেন তিনি—‘তুমি সব জেনে ফেলেছ’!
    --‘আশি শতাংশ জেনেছি। বাকিটা আজ রাতে জানবো’। সে বলল—‘যাই হোক্‌, আপনি এই ছাইটাকে অ্যানালিসিস করে দেখুন। দেখুন ওর মধ্যে টোব্যাকো অ্যাশ ছাড়া আর কোন জিনিসের ছাই আছে কি না। আর যে ছাইটা আছে সেটা কি বস্তুর তা বলা যাবে?’
    ডঃ চ্যাটার্জী হাসলেন—‘ছাই শুঁকেই তো বোঝা যাচ্ছে এ কোন মানুষের ভস্ম নয়। কিছু তামাক পুড়েছে। কিন্তু তোমার যখন এতই কৌতুহল, তখন জানাই, সবকিছুই বলা যাবে। স্পার্ক সোর্স মাস স্পেকট্রোগ্রাফিক অ্যানালিসিস করলেই বেরিয়ে যাবে টোব্যাকো অ্যাশের মধ্যে কি কি আছে। অরগ্যানিক কোনও বস্তু আছে কি না। অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রির প্রয়োগ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু একটু সময় দিতে হবে। প্রথমে অরগ্যানিক বস্তু সরানোর জন্য ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ অফিশিয়াল অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্টস’ এর ১৩.০০৬ মেথড অনুযায়ী...’।
    --‘রক্ষে করুন’। অধিরাজ হাত জোড় করে বলে—‘আমাদের রেজাল্টটা জানালেই হবে। মেথড জেনে কাজ নেই’।
    --‘বেশ’। ডঃ চ্যাটার্জী অ্যাপ্রণ পরতে পরতে বললেন—‘তাহলে একটু ঘুরে এসো। দুপুরের মধ্যেই জানিয়ে দিতে পারবো, এর মধ্যে কি কি আছে’।
    সে কৌতুকমাখা হাসি হেসে অর্নবের দিকে তাকায়। ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে বলে—‘বেশ। কিন্তু দুপুরেই যেন জানতে পারি। দেখবেন, আপনার পরীক্ষার চোটে বাহাত্তর ঘন্টা না পেরিয়ে যায়’।

    ফরেনসিক ল্যাব থেকে বেরিয়ে অধিরাজ অর্নবকে নিয়ে সোজা ডানকুনি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাজির। ডানকুনি পুলিশ স্টেশনের ও.সি প্রশান্ত গুপ্ত দুই মূর্তিকে খুব ভালোই চেনেন। রীতিমত খাতির করে বসালেন।
    --‘স্যার, একটু চা, বা কফি...?’
    --‘আপাতত একটু হেল্প’। অধিরাজ মুচকি হাসল—‘তারপর সময় থাকলে চা বা কফিও চলবে’।
    প্রশান্তবাবু অত্যন্ত অমায়িক লোক। এই মুহূর্তে আরও বেশি অমায়িক হয়ে বললেন—‘এনিথিং ফর ইউ স্যার। বলুন, কি সাহায্য করতে পারি?’
    --‘তিনবছর আগে ডানকুনি জংশনে কর্নেল তড়িৎ আচার্য ও তাঁর পরিবার একটি ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা যান’। অধিরাজ নিজে একটা সিগ্রেট নিয়ে প্যাকেটটা অফিসার গুপ্তর দিকে এগিয়ে দিয়েছে—‘আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই’।
    প্রশান্ত গুপ্ত অম্লানবদনে একটি সিগ্রেট তুলে নিয়ে জানালেন—‘হ্যাঁ। মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। একমাত্র মিঃ তপন আচার্য ছাড়া আর কেউ বাঁচেননি। ইন ফ্যাক্ট, প্রত্যেকেই এত বিশ্রিভাবে পুড়ে গিয়েছিলেন যে লাশ আইডেন্টিফাই করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল! নেহাৎ তপন আচার্যের ওয়ালেটে ড্রাইভিং লাইসেন্স, তার নামের আধপোড়া ভিজিটিং কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ছিল। নয়তো তাঁকেও শনাক্ত করা যেত না’।
    --‘স্বাভাবিক’। সে গম্ভীর স্বরে বলে—‘অমন বীভৎসভাবে পুড়ে গেলে কাউকে চেনাও সম্ভব নয়। তপন আচার্যের বয়ান পেতে নিশ্চয়ই অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল আপনাদের’।
    --‘সে আর বলতে!’ অফিসার বললেন—‘ভদ্রলোক যে বাঁচবেন তা কেউ আশাই করেনি। অথচ ঘটনাটা কি হয়েছিল, তা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ বলতে পারত না। অতরাতে রাস্তাও ছিল শুনশান। প্রত্যক্ষদর্শী কেউ ছিল না। আর বাকি তিনজন মৃত। উনিই একমাত্র আসল ঘটনাটা বলতে পারতেন। প্রায় তিনমাস কোমায় ছিলেন! ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তাঁর কোমা থেকে ফেরাটা একটা মির্যানক্‌ল্‌! কিন্তু তিনমাস পর যখন কোমা থেকে ফিরলেন, তখনও তাঁর বয়ান নেওয়া যায়নি। তিনি ঠিকমত কথাই বলতে পারছিলেন না। সবকথা মনেও করতে পারছিলেন না। প্রায় ছ’মাস ট্রিটমেন্ট চলার পর যখন কথা বলার মত অবস্থায় এলেন তখনই সব জানা গেল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিছু করা গেল না। ’ তিনি আফসোসে মাথা নাড়েন—‘ব্যাড লাক’।
    --‘হুঁ’। অধিরাজ একটু ভাবল—‘ কর্নেল তড়িৎ আচার্য, ওঁর ওয়াইফ আর মায়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কপি পেতে পারি?’
    --‘নিশ্চয়ই’।
    তিন বছর আগেকার ফাইল। খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল নয়। কিন্তু সেটা পেতে পেতেই প্রায় একঘন্টা কেটে গেল। কেস ফাইল ক্লোজড হয়ে গেলে তার আর কোনও যত্ন নেওয়া হয় না! রাশি রাশি ফাইলের স্তূপে কোথায় যে চাপা পড়ে যায় কে জানে!
    যদিও অধিরাজের কপাল ভালো যে, প্রয়োজনীয় ফাইলটা পাওয়া গেল। প্রশান্ত গুপ্ত সেটার ধুলো ঝেড়ে টেড়ে অর্নবের হাতে তুলে দিলেন। অধিরাজ তার হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে গম্ভীর মুখে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ফাইলের পিছনদিকেই পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো ছিল। পড়তে পড়তেই তার মুখ বিষণ্ণ হয়ে আসে। মিসেস আচার্যর গর্ভে ছ’মাসের একটি পুত্রসন্তানের মৃত ভ্রূণ পাওয়া গিয়েছে! সত্যিই কি দুর্ভাগ্যজনক! আর কয়েক মাস পরেই যে শিশুটা পৃথিবীর আলো দেখত, তার জীবন অন্ধকারেই শেষ হয়ে গেল!
    সমস্ত রিপোর্টগুলো পড়া হয়ে গেলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পুরো ঘটনাটাই দুর্ভাগ্যজনক। একটা ট্রাক ড্রাইভারের লাগামছাড়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মাশুল গুনতে হল একটা পরিবারকে! শুধু তাই নয়। এই ঘটনার মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে বাদশাদের মত বাচ্চাদের। তাদের এই বয়েসেই পিতৃহীন হতে হচ্ছে!
    অধিরাজের চোখদুটো অদ্ভুত ঘোরে আচ্ছন্ন। হ্যাঁ, তারও মানবিকতা আছে। সে বুঝতে পারে লোকটার যন্ত্রণা কোথায়! কিন্তু অপরাধ তো অপরাধই! লোকটাকে সে সমবেদনা দিতে পারে, কিন্তু ছেড়ে দিতে পারে না। এই কাঁটার খেলা এবার বন্ধ করতে হবে। নয়তো বাদশার মত আরও অনেক শিশুর ভবিষ্যৎ অকালেই অন্ধকার হয়ে যাবে।
    সে এবার অফিসার গুপ্ত’র দিকে তাকিয়ে হাসল—‘থ্যাঙ্কস্‌’।
    --‘এবার একটু চা বলি?’
    --‘নাঃ’। সে আস্তে আস্তে বলল—‘ইচ্ছে করছে না। আজ থাক’।
    ডানকুনি পুলিশ স্টেশন থেকে সোজা অফিসে ফিরে এল অধিরাজ। নিজের কেবিনে ঢুকে চুপ করে কিছুক্ষণ নিজের চেয়ারে বসে কাটাল। এখন সে একটু একা থাকতে চায়। স্খলিত দেহটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে আছে। জীবনে অনেক জটিল কেস সলভ করেছে। এবারও প্রায় গোটা ছবিটাই তার কাছে পরিষ্কার। তপন আচার্যর ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জে অবধারিত ভাবেই অধিরাজ জিতবে। অথচ সেজন্য কোনও আন্তরিক তৃপ্তি, আনন্দ অনুভব করছিল না সে। বরং একটা অদ্ভুত বিষাদ তাকে গ্রাস করছিল। মনে হচ্ছিল, এমন পরিসমাপ্তি কি খুব জরুরী ছিল?
    আধঘন্টা এভাবেই কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল অধিরাজ। নাঃ। মনকে শক্ত করতেই হবে। এখনও অনেক কাজ বাকি।
    টকটক করে প্রয়োজনীয় কয়েকটা ফোন সেরে নিল সে। দেবাশিষকে ফোনে ধরে বলল—‘দেবাশিষ, আমার একটা ট্রাক চাই’।
    এই ধরনের অদ্ভুত আবদারে দেবাশিষ একটু ঘাবড়েই গেল—‘কবে চাই স্যার?’
    --‘আজ রাতেই। রাত দশটার সময়। যেভাবেই হোক জোগাড় করো’।
    --‘ওকে স্যার’।
    --‘আর বেবি সিঙের ধাবায় রাত দশটায় সাদা পোষাকের পুলিশের একটা টিম যেন হাজির থাকে’। তার কন্ঠস্বরে উত্তেজনার ছাপ—‘আজই একটা চান্স নেবো। দেখি জালে কাঁকড়া ওঠে কি না’।
    --‘ওকে স্যার’।

    ফোনটা কেটে দিয়েই সে ফের হাজির হল ফরেনসিক ল্যাবে। ডঃ চ্যাটার্জী তখন সবে নিজের কেবিনে গিয়ে বসেছেন। তাঁর সহকারী রিপোর্ট তৈরি করছে।
    --‘এসো বীরপুঙ্গব’। অধিরাজকে দেখেই তিনি সোল্লাসে বললেন—‘তোমার কাজ হয়ে গেছে’।
    অধিরাজ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। ডঃ চ্যাটার্জী হাসতে হাসতেই বললেন—‘তোমার সন্দেহের উপরে একবালতি জল ঢালতে চলেছি। ছাইয়ের মধ্যে রাজকাঁকড়ার কাঁটার ছাই নেই। ওনলি টোব্যাকো অ্যাশ। বর্মী চুরুটের ছাই। এছাড়া কিছু পোড়া দেশলাইকাঠির অবশিষ্টাংশ রয়েছে। তাছাড়া আর কিছুই নেই’।
    সে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়—‘গোটা স্যাম্প্‌ল্‌টাই পরীক্ষা করেছেন তো?’
    --‘পুরো ছাই উড়িয়ে দেখেছি’। ডঃ চ্যাটার্জী ফিচফিচ করে হাসলেন—‘ শুধু বর্মী চুরুটের ছাই ছাড়া আর কিছুই নেই। ভদ্রলোক দিনে ক’টা চুরুট খান বল দেখি! অন্তত ঐ ছাই অ্যানালিসিস করতে করতে মনে হয়েছে, মিনিমাম দশ প্যাকেট চুরুটের ছাই তো এখানেই আছে!’
    --‘চুরুটের ছাই ছাড়া আর কিছু নেই!’ অধিরাজের চোখ চকচক করে ওঠে—‘স্ট্রেঞ্জ!...ভেরি স্ট্রেঞ্জ!...এক্সট্রিমলি স্ট্রেঞ্জ!’
    --‘অ্যাশট্রের ছাইয়ের মধ্যে যে চুরুটের ছাইই থাকবে এতে এত স্ট্রেঞ্জের কি আছে?’ তিনি অবাক—‘বরং এটাই ন্যাচারাল’।
    --‘হুঁ’। সে অন্যমনস্কভাবে জবাব দেয়—‘ডক্‌, আপনি জীবনে কখনও অ্যাকটিং করেছেন?’
    এবার ডঃ চ্যাটার্জীর মুখটা হাঁ হয়ে গেছে! এ আবার কি প্রশ্ন! রাজকাঁকড়ার কাঁটার সাথে তাঁর অভিনয় করার কি সম্পর্ক?
    --‘মানে?’
    --‘মানে কখনও অ্যাক্টো-ট্যাক্টো করেছেন?’ অধিরাজ কৌতুকে ভুরু নাচায়—‘বলাইবাহুল্য আপনাকে কেউ হিরোর রোল দেবে না! অন্তত ভিলেনের রোল করেছেন? যেমন রামায়ণে রাবণের রোল, কিংবা ভাগবতে কংসের। নিদেনপক্ষে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স হিসাবে দুর্বাসার রোল...’।
    ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ উঠে এসে অধিরাজের গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছেন—‘এই মুহূর্তেই ওথেলোর অ্যাকটিং করবো ভাবছি। আর তুমিই আমার ডেসডিমোনার পুরুষ ভার্সান !’
    সে হেসে ফেলল—‘আমার গলা টিপতে হলে আপনাকে টুল আনতে হবে ডক্‌। এক ইঞ্চি গোড়ালি এরমধ্যেই উঠে গেছে দেখছি। আপত্তি না থাকলে আপনাকে কোলে তুলে নিই?’
    ডঃ চ্যাটার্জী গলা টেপায় ক্ষান্ত দিলেন। অসহায় ভাবে বলেন—‘তুমি কি আমায় না জ্বালিয়ে থাকতে পারো না? তোমার কোন্‌ ধানক্ষেতে আমি মই দিয়েছি?’
    --‘ইয়ে...মই এর কথায় মনে পড়ল...’ অধিরাজ মুচকি হেসে বলে—‘কাল আমার ঘাড়ে চড়ে মা আলমারির মাথা পরিষ্কার করেছেন। তাই আজ বাড়িতে আমার অনারে ডিনারে বিরিয়ানি হচ্ছে। আপনার নেমন্তন্ন রইল। ঠিক ন’টায় হাজির হয়ে যাবেন। নয়তো আপনার ফেভারিট ম্যাঙ্গো সিরাপ মিস হয়ে যাবে কিন্তু’।
    ডঃ চ্যাটার্জী ভ্রূকুটি করে আছেন। অধিরাজের বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকলেই তাঁর ভয় লাগে। ছেলেটার মাথায় সবসময় বদমায়েশি বুদ্ধি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর আগের বার ম্যাঙ্গো সিরাপে হতভাগা ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে দিয়েছিল! তার আগের বার মাট্‌ন্‌ কষায় একটা মানুষের হাতের হাড় রেখে দিয়েছিল সে! একটা কামড় মেরেই সন্দেহ হয়েছিল ডঃ চ্যাটার্জীর! পরক্ষণেই যখন বুঝলেন, ওটা পাঁঠার নয়, মানুষের হাড়, তখন এক কেলেঙ্কারিয়াস কান্ড! পরে অবশ্য আবিষ্কৃত হয়েছিল যে ফরেনসিক ল্যাবের কঙ্কালগুলোর মধ্যে একটার আঙুলের হাড় মিসিং!
    তিনি সন্দিগ্ধ গলায় বলেন—‘হারগিস্‌ নয়। তুমি ফের কিছু শয়তানি করবে’।
    --‘কিচ্ছু করবো না। প্রমিস্‌’।
    --‘ম্যাঙ্গো সিরাপে ক্যাস্টর অয়েল মেশাবে না!’
    অধিরাজ জিভ কাটল—‘একদম না’।
    --‘মাংসের হাড়ের মধ্যে কঙ্কালের হাড় রাখবে না!’
    --‘তোবা...তোবা...!’ সে ভালোমানুষের মত মুখ করেছে—‘আমি কি তাই করতে পারি!’
    --‘তুমি কি করতে পারো তা আমার খুব ভালো জানা আছে’। তিনি কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের নতুন অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে বললেন—‘ওহে, দ্যাখো তো, ল্যাবের কঙ্কালগুলোর সবক’টা হাড় ঠিকঠাক আছে কি না!’

    দুর্জনের ছলের অভাব হয় না!
    ডঃ চ্যাটার্জী এই প্রবাদবাক্যটার মর্মার্থ খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারলেন সে রাত্রে। অধিরাজের নেমন্তন্ন স্বীকার করে তার বাড়িতে ডিনারে গিয়েছিলেন তিনি। গিয়ে দেখলেন সেখানে অর্নবও রয়েছে। রীতিমত একটি হর্ত্তেল ঘুঘুর মত তার হাবভাব!
    --‘রাজা, নো মোর শয়তানি’।
    অধিরাজ হাসতে হাসতেই আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুহাত তুলে দিয়েছে—‘বলেছি তো, ক্যাস্টর অয়েল মেশাবো না। তাছাড়া আজকে আপনাকে কোনও খাবার আমি দেবো না। সব অর্নব এনে দেবে’।
    নিশ্চিন্ত হতে গিয়েও পারলেন না ভদ্রলোক। ম্যাঙ্গো সিরাপের বোতলের পাশে ওটা কিসের বোতল?
    --‘রাজা!’
    --‘ইয়ে, ওটা বড়দের ড্রিঙ্ক। আপনি ম্যাঙ্গো সিরাপ খান। অর্নব...’।
    অর্নব বাধ্য ছেলের মত ম্যাঙ্গো সিরাপের গ্লাস এনে দিয়েছিল। কয়েকমিনিট সেটাকে শুঁকলেন ডঃ চ্যাটার্জী। নাঃ, সন্দেহজনক কিছুর গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটু যেন ঝাঁঝালো। ম্যাঙ্গোসিরাপে অনেক সময় অনেক রকম মশলা থাকে। তারই স্বাদ হয়তো এরকম।
    নিশ্চিন্ত হয়ে প্রায় ছ’সাত গ্লাস খেয়ে নিলেন তিনি। তারপরই ঘটল বিপত্তি! কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হতে লাগল শরীরটা খারাপ লাগছে! ঘাম হচ্ছে, গরম লাগছে ভীষণ! গা বমি বমি করছে। কোনমতে বললেন—‘রাজা, ফের কি মিশিয়েছ আমার ড্রিঙ্কে! আমার শরীর খারাপ লাগছে কেন?’
    --‘কি খেলেন বলুন তো? ঐ যে!’ অধিরাজ চোখের ইশারায় ম্যাঙ্গো সিরাপের পাশের বোতলটাকে দেখাল। ডঃ চ্যাটার্জী রাগে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন—‘অ্যালকোহল! ইউ...ইউ...ইউ রাস্কাল!’
    বলতে বলতেই হড়হড় করে বমি করে ফেললেন ভদ্রলোক। হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন—‘ওঃ, আমার মাথা ঘুরছে...পৃথিবী ঘুরছে...আমি...আমি পড়ে যাবো...’।
    সত্যি সত্যিই পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পিছন থেকে অধিরাজ ধরে ফেলেছে তাঁকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার গায়ে নেতিয়ে পড়ে নেশাজড়িত কন্ঠে প্রলাপ বকতে শুরু করলেন ডঃ চ্যাটার্জী।
    --‘হাম দেখ লেঙ্গা! সবক’টাকে দেখ লেঙ্গা!... আমার সাথে বদমায়েশি করতা হায়! সবকো ফাঁসি মে ঝোলায়েঙ্গা!’
    অধিরাজ অদ্ভুত দৃষ্টিতে অর্নবের দিকে তাকায়—‘নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে ভদ্রলোক এরকম ভয়াবহ রাষ্ট্রভাষা বলেন না কি!’
    অর্নব কাঁচুমাচু মুখ করেছে—‘আমি কি করে জানবো স্যার?’
    --‘তাই তো!’ ডঃ চ্যাটার্জী বোধহয় তাকে গাছ ভেবে ঘাড়ে চড়ার উপক্রম করছিলেন। কোনমতে সামলাতে সামলাতে বলল সে—‘সময় নেই অর্নব। সাড়ে ন’টা অলরেডি বাজতে চলেছে। গাড়ি বের করো’।
    কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অর্নব গাড়ি বের করে আনল। আজ সে ড্রাইভ করবে। ডঃ চ্যাটার্জীকে অনায়াসেই ঘাড়ে ফেলে পিছনের সিটে উঠে বসল অধিরাজ। ব্যাপার দেখে মা ছুটে এলেন।
    --‘কোথায় যাচ্ছিস? তোরা খাবি না?’
    অধিরাজ হাসল—‘ফিরে এসেই খাবো মা। আমরাও খাবো। আর টাকলুও খাবে। তবে একটু দেরি হবে। ঘুমিয়ে পড়ো না যেন’।
    মা আর কিছু বলার আগেই ডঃ চ্যাটার্জী খিঁক খিঁক করে অপ্রকৃতিস্থ হাসি হাসলেন—‘হাম তো ন’অশে মে গির গিয়া...’।
    আর নশে মে গির গিয়া! অধিরাজ তার মুখ চেপে ধরেছে। মা বুঝতে পারলেই বিপদ!
    --‘চলো অর্নব, ডাইরেক্ট ডানকুনি’।

    ১০.

    ঘড়িতে তখন রাত সোয়া এগারোটা।
    বেবি সিঙের ধাবা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে এসেছে। দু একজন ট্রাক ড্রাইভার তখনও অবশ্য নৈশ আহার সারছে। বেবি সিং আজ ধাবায় উপস্থিত। তার কেয়ারটেকার চতুর্দিকে তদারকি করছে। আর সে চেয়ারে বসে বিরাট বিরাট হাই তুলছে।
    তপন আচার্য আজ একটা চারপাইয়ের উপরে বসে ডিনার করছেন। তার ডিনারের জন্যই সম্ভবত চারপাইটার ব্যবস্থা। কেয়ারটেকার ছেলেটা রুটি টুকরো টুকরো করে ডালের বাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। চারপাইয়ের উপর বসে, বাটিটাকে কোলের উপরে রেখে অদ্ভুত দক্ষতায় পায়ের সাহায্যে চামচ দিয়ে তুলে তুলে ডাল-রুটি খাচ্ছেন!
    --‘যদি জ-গা-ই-মা-ধা-ই না থাকতো, তবে নি-মা-ই কে কি চিনতো লোকে!’
    একটা নেশাজড়িত স্বরে চমকে উঠলেন তিনি। একটা ট্রাক এসে কিছুক্ষণ আগেই থেমেছে ধাবা থেকে খানিকটা দূরে। সেই ট্রাকের দরজা খুলেই নেমে এল তার ড্রাইভার। মাথায় লাল ফেট্টি। পরণে ময়লা লাল রঙের জামা আর ঢোলা সবুজ পাঞ্জাবী। বেসুরো হেঁড়ে গলায় গাঁকগাঁক করে আপনমনেই উল্টোপাল্টা গান গেয়ে যাচ্ছে—‘সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি, বোম ফেলা হায় জাপানি! উস্কা ভিতরমে সাপ হিন্দুস্তানি, ব্রিটিশকা নাকানি চোবানি...’।
    পাশ দিয়ে চলে যেতেই লোকটার গা থেকে একটা উৎকট গন্ধ পেলেন তিনি! যা ভেবেছেন! নেশায় ঠিকমত হাঁটতেও পারছে না। দস্তুরমতো নেশায় অচেতন লোকটা।
    তপন আচার্যর মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে। আবার একটা দুনিয়ার শত্রু! এই লোকগুলোই নিরীহ পথচারীদের পিষে দেয়! এই লোকগুলোই একটা হাসিখুশি পরিবারের সর্বনাশ করে! এরা বেঁচে থাকলে অনেক মানুষ বিনা কারণে মরবে!
    তার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবু উঠলেন না। স্থির দৃষ্টিতে ট্রাক ড্রাইভারকে দেখছেন। লোকটা কোনমতে টলমলে পায়ে টেবিল পর্যন্ত পৌঁছল।
    --‘একঠো তিকন চন্দুর লাও’।
    বেবি সিং এমন অর্ডারে ঘাবড়ে গেল! সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার ড্রাইভারটিকে দেখল। তারপর তপন আচার্যর দিকে তাকাল।
    --‘সাব, আপনি কি চিকন তন্দুর মাংছেন?’
    --‘হাঁ। ও-হি...ও-হি!’ বলতে বলতেই সে ফের গান জুড়েছে—‘কাউন হায় আগে, কাউন হায় পিছে-মুর্গী না আন্ডা, হাম নাহি জানতে হায় ইস ফিলোজফিকা কা ফান্ডা!’
    তপন আচার্য চুপ করে অপেক্ষা করছিলেন। বেবি সিংকে ডেকে একটা লস্যি দিতে বললেন। তারপর লস্যির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছেন। সে প্রথমে চিকেন তন্দুরটাকে ভালো করে দেখল। তারপর প্রলাপ বকতে শুরু করল।
    --‘ইয়ে কেইসা মুর্গী হায়। ইসকা মাথা নেহি হায়, লেজ নেহি হায়, ডাকতা ভি নেহি—ইয়ে মুর্গী হায় ইয়া অন্য কিছু!’ সে রীতিমত বিরক্ত—‘লেজ কাহা ছুপাকে রাখা হায়। বের করতা হায় ইয়া নেহি!’
    বেবি সিং তাকে কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করল যে, চিকেন তন্দুরের মুর্গীর মাথা বা লেজ কিছুই থাকে না! এবং প্লেটে সাজিয়ে দেওয়ার পর সে ডাকতেও পারে না। কিন্তু লোকটা কিছুতেই বোঝে না! শেষপর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিয়ে কেয়ারটেকারকে বলল—‘তুম দেখো। ম্যায় ঘরসে থোড়া টহলকে আতা হুঁ’।
    কেয়ারটেকার এবার অপ্রকৃতিস্থ লোকটার দায়িত্ব নিল। এক্কেবারে বেহেড নেশাড়ু! খাচ্ছে কম। ছড়াচ্ছে বেশি।
    যতক্ষণ ধরে এই ভোজনপর্ব চলছিল ততক্ষণ অধিরাজ আর অর্নব ট্রাকের ভিতরে ঘাপ্টি মেরে বসে সতর্ক নজর রাখছিল। এই মুহূর্তে এখানে ডঃ চ্যাটার্জী আর তপন আচার্য ছাড়া আর কোনও কাস্টমার নেই। আর কাউকে দেখা না গেলেও ধাবাটাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে সাদা পোষাকের পুলিশের দল। ধাবার পিছনে, পানের দোকানের আড়ালে, জলের ড্রামের পিছনে আর ট্রাকের ভিতরে সশস্ত্র পুলিশ অন্ধকারের সাথে মিশে আছে।
    অধিরাজের কানে ওয়্যারলেস ইয়ারসেট। সে আস্তে আস্তে বলে—‘দেবাশিষ, বি অ্যালার্ট। কোনভাবেই যেন ভদ্রলোক সন্দেহ না করতে পারেন’।
    ও প্রান্ত থেকে দেবাশিষের আওয়াজ ভেসে আসে—‘সন্দেহ করবে না স্যার’।
    --‘কোথায় আছো?’
    --‘ধাবার পিছনে’।
    --‘ডঃ চ্যাটার্জীকে দেখতে পাচ্ছো?’
    --‘হ্যাঁ স্যার’।
    --‘অলরেডি রাস্তায় কিন্তু ধোঁয়াশা পড়তে শুরু করেছে। ডঃ চ্যাটার্জী এদিকে ছড়িয়ে ছিয়াশি করছেন। কতক্ষণ টাইম লাগাবেন বলতে পারছি না’। সে ঘড়ির দিকে তাকায়—‘সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে। বারোটা বাজলে কিন্তু বিপদ’।
    --‘ডঃ চ্যাটার্জীকে বলুন না অ্যাকটিংটা আরেকটু শর্ট করতে’।
    অধিরাজ হেসে ফেলল—‘উনি আদৌ অ্যাকটিং করছেন না। যা ঘটছে গোটাটাই বাস্তব’।
    --‘মা-নে!’ দেবাশিষের প্রায় ভির্মি খাওয়ার দশা—‘উনি কি সত্যিই...!’
    --‘হ্যাঁ। সত্যিই। তুমি এক কাজ করো’। সে বলল—‘ভদ্রলোকের মুখ দেখে যা মনে হচ্ছে তাতে উনি টোপ গিলবেন। অসম্ভব ডেসপারেট লোক। ডঃ চ্যাটার্জীকে কোনভাবে ভজিয়ে ভাজিয়ে মেইন রোডের সামনে আনবেনই। ওটাই হাই টাইম। ঐ সুযোগেই পিছন থেকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসবে তোমরা। মেইন রোড অবধি না আসা অবধি কোনও রিস্ক নেই। কিন্তু তারপরই আসল নাটক। দেখো, ফস্কে না যায়’।
    --‘ওকে স্যার’।
    ওদিকে ট্রাক ড্রাইভারবেশী ডঃ চ্যাটার্জী খাবার ছড়িয়ে টড়িয়ে শেষপর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। উঠে দাঁড়িয়ে ফের গান জুড়েছেন—‘যদি জগাই-মাধাই না থাকত...’।
    --‘স্যার...’। অর্নব ফিসফিস করে বলে—‘জগাই মাধাই বলতে কি উনি আমাদের দুজনকে মিন করছেন?’
    অধিরাজ তার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকায়। অর্নব ঘাবড়ে গেল। কিছু বেফাঁস বলে ফেলেছে নাকি!
    কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকেই ফিক করে হেসে ফেলল সে। অর্নবের পিঠে আস্তে চাপড় মেরে বলে—‘গুড ওয়ান অর্নব। তবে ‘নিমাই’ বলতে দুর্বাসা যদি নিজেকে মিন করে থাকে তবে চৈতন্যদেব সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক কাজই করেছেন!’
    বলতে বলতেই অধিরাজ হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে—‘অর্নব, গেট রেডি’।
    তপন আচার্য হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে ডঃ চ্যাটার্জীর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছেন। কি যেন ফিসফিস করে বলছেন। ভাবটা একটু কুন্ঠিত। ডঃ চ্যাটার্জী সজোরে হেসে বললেন—‘বাইকমে উঠানা হোগা আপকো? খুব পারেগা, বহুৎ পারেগা’।
    --‘বুঝতে পারছ কিসের বিষয়ে কথা হচ্ছে’? অধিরাজ বলল—‘মোস্ট প্রব্যাব্‌লি তপন আচার্য বলছেন, তার কোনও আত্মীয় বাইক নিয়ে আসবে। ওনার হাত নেই। তাই ডঃ চ্যাটার্জীর কাছে হেল্প চাইছেন। রিকোয়েস্ট করছেন, উনি যাতে তপনবাবুকে একটু বাইকে তুলে দেন। এটাই এই মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম পার্ট। চলো’।
    দুজনে ট্রাক থেকে অন্ধকারের মধ্যেই গুঁড়ি মেরে নেমে এল। এখান থেকে মাত্র কুড়ি গজ দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন তপন আচার্য ও ডঃ চ্যাটার্জী। কিন্তু অধিরাজ আর অর্নব দুজনেই কালো রঙের জামা পরে আছে। পায়ে রাবার শু। ট্রাকটা যেখানে দাঁড় করানো সেখানটা বেশ অন্ধকার। দুজনেই সেই অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। সতর্ক ও সজাগ।
    দূরে একটা আলোর বিন্দু দেখা গেল। ততক্ষণে তপন আচার্য ও ডঃ চ্যাটার্জী আস্তে আস্তে মেইনরোডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তপন আচার্য কি যেন ফের বললেন ডক্টরকে। তিনি বেসামাল অবস্থাতেই ভদ্রলোকের পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করে এনেছেন।
    অর্নবের রক্ত হিম হয়ে যায়। সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ওদিকে দূরের আলোর বিন্দুটা এবার স্পষ্ট! ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে এদিকেই। অর্নব আর অধিরাজ দুজনেই দেখল-একটা বাইক ধোঁয়াশা চিরে বিদ্যুৎবেগে এদিকেই আসছে। আরোহীর মাথায় হেলমেট!
    --‘অর্নব, তুমি উল্টোদিকে ঘোরার আগেই ডঃ চ্যাটার্জীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে নেবে। আমি তপন আচার্যকে দেখছি’। উত্তেজিতভাবে কথাগুলো বলেই দৌড়ল অধিরাজ। পিছন পিছন অর্নব! রাতের ধোঁয়াশা গায়ে মেখে অন্ধকারের মধ্যে দুটো লোক প্রাণপণ দৌড়চ্ছে। বাইকটা ডঃ চ্যাটার্জীকে স্পর্শ করার আগেই পৌঁছতে হবে তাদের। একরকম প্রাণ হাতে করেই দৌড়ল ওরা। কিন্তু অদ্ভুত নিঃশব্দ দৌড়!
    দৌড়তে দৌড়তেই অর্নব দেখল তপন আচার্যের মুখে সিগ্রেট গুঁজে দিচ্ছেন ডঃ চ্যাটার্জী। তাঁর ডান হাতে দেশলাই! খচাস্‌ শব্দে দেশলাই জ্বলে উঠল...ওদিকে বাইকটা একদম কাছে... তপন আচার্য চেঁচিয়ে উঠলেন...জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি হাতে নিয়েই সেদিকে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছেন অসীম চ্যাটার্জী...বাইকটা একদম কাছে!...আরোহীর হেলমেটে আলো ঠিকরে পড়ল...প্রায় ডক্টরের গায়ের উপরই...!
    --‘সরুন স্যা-র!’ অর্নব বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় হ্যাঁচকা টান মেরে ডঃ চ্যাটার্জীকে সামনে থেকে সরিয়ে নিয়েছে। আর অধিরাজ আচমকা লাফিয়ে পড়েছে তপন আচার্যর উপরে। তাকে চিৎ করে ফেলেছে রাস্তার উপরেই।
    --‘ই-উ ব্লা-ডি সিভিলিয়ানস্‌...’। ঘটনার আকস্মিকতায় তপন আচার্য অধিরাজকে চিনতে পারেননি। অভ্যাসবশত তাই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন বিপদে পড়েছেন।
    তার মুখ থেকে সিগ্রেটটা কেড়ে নিয়েছে অধিরাজ। হেসে বলল—‘থ্যাঙ্কস’।
    ততক্ষণে দেবাশিষ ও তার দলবল চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে তাদের। সবার হাতে উদ্যত বন্দুক।
    বাইক আরোহী প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই অদ্ভুত দক্ষতায় বাইক ঘুরিয়ে নিয়েছে। বুলেটের গতিতে সে বেরিয়ে যেতে চাইল সেখান থেকে।
    অধিরাজ তার পিছনে দৌড়ল না। বরং অদ্ভুত একটা কৌশলে সে তার শরীরটাকে ছুঁড়ে দিয়েছে শূন্যে! এক মোক্ষম এয়ার সাইড কিকেই কাৎ করে ফেলল বাইক আরোহীকে। জোরালো কিকের ধাক্কায় বাইকার বাইক শুদ্ধই উলটে পড়েছে রাস্তার উপরে।
    --‘এই মুহূর্তে তোমার সাথে চোর পুলিশ খেলার মুডে আমি নেই বেবি সিং, ওরফে গুরুদেব সিং! লম্বা চুল, দাড়ি রেখে হাতে কড়া পরলেই কি সাচ্চা শিখ হওয়া যায়!’
    বেবি সিং! অর্নব হাঁ করে তাকিয়ে আছে! বেবি সিংও আছে এর পিছনে!
    --‘ওর কোনও দোষ নেই’। তপন আচার্য মুখ খুললেন—‘আমিই দুবছর আগে ওকে ধাবার ব্যবসা করার টাকা দিয়েছিলাম। সেই ঋণই ও শোধ করছিল!’
    অধিরাজ তার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসি হাসল—‘মানুষ খুন করে?’
    --‘ও খুন করেনি’।
    --‘ না। প্রমাণ লোপাট করেছে। খুন করতে সাহায্য করেছে। আপনি নিরীহ ট্রাক ড্রাইভারদের ভুলিয়ে ভালিয়ে মেইন রোডের সামনে নিয়ে আসতেন। তাদের সাহায্য চাইতেন। আপনার হাত নেই। তাই সিগ্রেট খেতে পারছেন না। অগত্যা আপনার অনুরোধে দয়াপরবশ হয়ে তারা আপনারই পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে মুখে গুঁজে দিত। কি করে জানবে যে নিজের মারণাস্ত্রই তুলে দিচ্ছে আপনার ঠোঁটে! আসলে সিগ্রেটটাই যে আস্ত একটা ছোট্ট ব্লো পাইপ তা তাদের জানার কথাও নয়’!
    --‘আপনি জানলেন কি করে জানতে পারি?’ তপন আচার্য ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না।
    --‘সিম্প্‌ল্‌’। অধিরাজ বলে—‘যে লোকটা জগিং করে না, তার কাছে জগার্স শু থাকাটা যেমন আশ্চর্যের, তেমনি যে মানুষ সবসময় বর্মী চুরুট খায়, যার অ্যাশট্রেতে চুরুট ছাড়া আর কোন স্মোকিং প্রোডাক্টের ছাইয়ের খোঁজ মেলে না, সেই লোকটার ড্রয়ারে চুরুটের বাক্সের পাশাপাশি ইন্ডিয়া কিং সিগ্রেটের প্যাকেট থাকাটা ঠিক ততটাই আশ্চর্যের। অক্‌ওয়ার্ডও বটে’।
    --‘ব্রিলিয়ান্ট!’
    সে আবার একটা ছোট্ট বাও করে—‘থ্যাঙ্কস্‌। এরপরই বাইকের আবির্ভাব! বাইক দেখেই আপনার চিৎকার ও সামনের মানুষটির পিছনে ঘুরে দাঁড়ানো! এইটাই হচ্ছে আসল সময়। যে মুহূর্তে লোকটা ঘুরে দাঁড়াল, ঠিক তখনই লোকটার মাথার পিছনটা আপনার ঠিক ঠোঁটের সামনে। ব্যস্‌, সিগ্রেট থেকে রাজকাঁকড়ার কাঁটা সোজা মানুষটার মেডালা অবলাঙ্গেটায়! তার মধ্যেই বাইক এসে পড়ল তার উপরে। নিতান্তই লোক দেখানো পড়া। আসলে সে লোকটাকে স্পর্শও করে না। শুধু ঘাড়ে পড়ার ভান করে হাত বাড়িয়ে ঘাড় থেকে ফোটানো কাঁটাটা তুলে নেয়। অস্ত্রটাও রাখতে চাননা আপনি। লোকে ভাবে বাইকের ধাক্কা খেয়ে মানুষটা পড়ে গেল! কিন্তু সে যে আসলে মারা গেছে, সে কথা বুঝতে বুঝতে আপনি সিন থেকে হাওয়া। হাওয়া বাইকারও। শুধু আপনার পকেটের মোমের দেশলাই, যেটা জ্বালিয়ে আপনার শিকার সিগ্রেট ধরাতে যায়, সেটাই ধরা থাকে তার হাতে। মোমের দেশলাই কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় পুরোটা পুড়ে যায়। কাঠিটাও থাকে না। থাকে শুধু মৃতব্যক্তির আঙুলে একটা ছ্যাঁকার দাগ’।
    --‘আমার হাত নেই। থাকলে বোধহয় হাততালিই দিয়ে উঠতাম’। ঠান্ডা স্বরে বলেন তপন আচার্য—‘কিন্তু আমি অ্যানাটমি জানলাম কি করে সেটা তো পরিষ্কার হল না’।
    --‘ঐখানেই তো আসল ট্যুইস্ট’। অধিরাজ বলল—‘একজন সাধারণ মাছের ব্যবসায়ী অ্যানাটমি জানেন না। কিন্তু একটু আগেই আপনি রেগে গিয়ে একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন। রেগে গিয়ে বললেন—‘ইউ ব্লাডি সিভিলিয়ান্‌স্‌’! একজন মাছের ব্যবসায়ী অন্যকে ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ বলে গালাগালি দেবেন না। কারণ তিনিও একজন সিভিলিয়ান। কিন্তু আপনি তো সিভিলিয়ান নন্‌। এবং আর্মির একজন বড় অফিসার, তথা কর্নেলের পক্ষে অ্যানাটমি জানা তো জলভাত! আর্মির লোকেরা, বিশেষত অফিসাররা অ্যানাটমি খুব ভালোভাবেই জানেন। তাই না কর্নেল তড়িৎ আচার্য?’
    কর্নেল তড়িৎ আচার্য! এই লোকটা তপন আচার্য আদৌ নয়! তার দাদা কর্নেল তড়িৎ আচার্য! বিস্ময়ে বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলে অর্নব!
    --‘তপন আচার্য তো ঐ মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টেই মারা গিয়েছিলেন! তুমিই ভেবে দেখো অর্নব, দুটো হাত ভেঙে গেছে, সর্বাঙ্গ আগুনে পুড়ে গেছে, এই অবস্থায় উলটে যাওয়া গাড়ি থেকে শুধু মাত্র বুকে ভর দিয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসা কি কোনও সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব! যা কর্নেল তড়িৎ আচার্যর পারার কথা, তা তার ভাই কিকরে পারবে? সুতরাং সেদিন যে লোকটি বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, সে তপন আচার্য নয়, কর্নেল তড়িৎ আচার্য! তাছাড়া শুরু থেকেই ভদ্রলোকের মেজাজ, বর্মী চুরুট খাওয়ার অভ্যেস, উঁচু স্বরে কম্যান্ডিং টোনে কথা বলা, দুঃসাহস—সর্বোপরি তার ড্রাইভারের বয়ান অনুযায়ী—দুমিনিট দেরি হলেই রাগারাগি করা, তথা পাংচুয়ালিটি—এই লক্ষণগুলো বারবার একজন আর্মি অফিসারের দিকেই ইঙ্গিত করছিল’। অধিরাজ বলল—‘শুধু তাই নয়, ডঃ অসীম চ্যাটার্জী এখানেই কামাল করেছেন। তিনি ইনহেলারের স্যালাইভা বিশ্লেষণ করে ধরে ফেলেছেন যে দুই ভাইয়ের একজনের অ্যাজ্‌মা ছিল। কর্নেল আচার্যর অ্যাজমা থাকতেই পারে না। থাকলে আর্মির অতবড় অফিসার হতেন না তিনি। অন্যদিকে কর্নেল তড়িৎ আচার্যর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে যে, তিনি আগুনে পুড়ে মারা যাননি। বরং তার অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। গাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ার দরুণ ধোঁয়ায়, আর প্রচন্ড শকে তাঁর অ্যাজমার অ্যাটাক হয়েছিল। নিঃশ্বাস নিতে না পারার জন্য দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। যেটা কর্নেল আচার্যর ক্ষেত্রে অসম্ভব! সুতরাং বুঝতে বাকি রইল না, যে মৃত লোকটিকে কর্নেল তড়িৎ আচার্য ভাবা হচ্ছে, তিনি আদতে তপন আচার্য। আর যিনি তপন আচার্যর পরিচয়ে আড়বাঁশি বাজান, বর্মী চুরুট খান—তিনিই আসলে কর্নেল আচার্য। পুড়ে গেলে মানুষকে আলাদা করে চেনা যায় না। কর্নেলের ক্ষেত্রে আরও কিছু সুবিধে হয়েছিল। তাঁর মুখ পুড়ে গিয়েছিল। মুখ দেখে চেনা সম্ভব তো ছিলই না, উপরন্তু হাত দুটোও অ্যাম্পুট করতে হয়েছিল। তাই ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা হস্তাক্ষর দিয়েও শনাক্ত করা ইম্পসিব্‌ল্‌’।
    --‘সুবিধা বলছেন কাকে?’ তপন আচার্য, তথা কর্নেল তড়িৎ আচার্য হিসহিসিয়ে ওঠেন—‘একটা মানুষের মুখ যদি আগুনে পুড়ে যায়, হাত দুটো কাটা পড়ে-তবে তার যন্ত্রণা বোঝেন আপনি?’ তাঁর চোখে জল ছলকে ওঠে—‘সেদিন আমরা পিকনিক করে ফিরছিলাম। গাড়িতে ওঠার সময় দেখি তপন তার ওয়ালেটটা ভুল করে পিকনিক স্পটেই ফেলে এসেছে। আমি ওয়ালেটটা নিজের পকেটেই পুরে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে ওকে দিয়ে দেবো। কিন্তু...’ কর্নেল আচার্যর চোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে—‘একটা জানোয়ারের জন্য সব ওলোট পালোট হয়ে গেল! আমি ঐ জ্বলন্ত গাড়ি থেকে কোনমতে বেরিয়ে এলাম ঠিকই, কিন্তু আর কেউ বেরোতে পারল না। আমার হাতদুটো থাকলে বাকিদেরও বের করে আনতে পারতাম। অথচ যখন গাড়িটা ভল্ট খাচ্ছিল, তখনই প্রচন্ড যন্ত্রণার মধ্যেও শুনতে পাচ্ছিলাম হাতের হাড় ভাঙার মট্‌মট্‌ শব্দ! মনে হচ্ছিল, ব্যথাতেই মরে যাবো। যদিও বা মনের জোরে বাইরে বেরোতে পারলাম, তখন দেখলাম গাড়ির পিছনের সিটে আমার স্ত্রী, আমার মা আগুনে পুড়ছেন! আমি বাবা হতে চলেছিলাম! চোখের সামনে আমার স্ত্রী, মা, ভাই আর অনাগত ছোট্ট সন্তান...সব পুড়ে গেল! তাদের চিৎকার শোনা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, পাগলের মত লাথি মেরে জানলার কাঁচ, দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিলাম! ওরা তখনও চিৎকার করছে! সে কি বীভৎস চিৎকার! আমি আজও ভুলতে পারি না...আজও ভুলতে পারি না...!’
    --‘সেইজন্যই যখন ওয়ালেট দেখে আপনাকে তপন আচার্য বলে পুলিশ শনাক্ত করল, তখন আপনি প্রতিবাদ করেননি। তখন থেকেই প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন-তাই তো? কিন্তু কি উপায়ে কাজটা করবেন সেটা ভাবতেই তিনবছর লেগে গেল’।
    --‘ঠিক তাই। তপনের মাছের ব্যবসা ছিল। সেখান থেকেই রাজকাঁকড়ার কাঁটার কনসেপ্টটা মাথায় এল। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ ছিল না। প্র্যাকটিসের দরকার ছিল। পুরোপুরি রপ্ত করতেই বছর তিনেক লাগল’। তিনি একটু থেমে বললেন—‘মদন আমায় কাঁটার জোগান দিত। কাঁটাগুলো কেটে ছোট করে দিত। কিন্তু পরে সব জেনে ফেলেছিল। ও আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল। আপনারা চলে আসায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই ওকেও...’।
    ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। অধিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দেবাশিষের দিকে তাকিয়ে বলল—‘ওঁর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেটটা বের করে নাও। বাড়িতে টেবিলের ড্রয়ারে ইন্ডিয়া কিঙের আরও কয়েকটা প্যাকেট পাবে। ওগুলোও এভিডেন্স। ওর ভিতরেই রাজকাঁকড়ার কাঁটা আছে। ওগুলোই আসলে ব্লো পাইপ। আর কর্নেল আচার্যকে কাস্টডিতে নিয়ে নাও। আশা করি উনি এবার স্বীকারোক্তি দেবেন’।
    --‘দেব। ভদ্রলোকের এক কথা’। কর্নেল আচার্যর মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি ভেসে ওঠে—‘চার চারটে খুন করেছি। কি মনে হয় আপনার? বিচারে আমার ফাঁসি হবে না? যাবজ্জীবনকে বড্ড ভয় পাই। তাছাড়া বেঁচে থাকার তো আর কোনও কারণ দেখছি না...! ফাঁসিই ভালো’।
    বেবি সিং আর কর্নেল আচার্যকে নিয়ে পুলিশের গাড়ি চলে গেল। অধিরাজ কিছুক্ষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। মন ভারাক্রান্ত হয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে বলল—‘খুনী ঠিকই...কিন্তু লোকটা পারফেক্ট জেন্টল্‌ম্যান!’
    --‘স্যার’।
    অর্নবের ডাকে সম্বিৎ ফিরল তার। অর্নব চোখের ইশারায় ডঃ চ্যাটার্জীকে দেখায়। তিনি তখনও রাস্তার উপর গড়াগড়ি দিচ্ছেন!
    --‘আরে!’ অধিরাজ অবাক হয়ে বলে—‘এ যে পুরো লাশ! ডঃ চ্যা-টা-র্জী!...হ্যালো...ডক্‌’।
    নেশাজড়িত স্খলিত গলায় বললেন তিনি—‘শ্‌শ্‌শ্‌! ন’অশে মে গির গিয়া’।
    --‘ধুর মশাই!’ অধিরাজ সজোরে হেসে ওঠে—‘ম্যাঙ্গো সিরাপের সাথে সামান্য জলজিরা খেয়েই আপনি ন’অশে মে গির গিয়া! আপনার যে কি হবে!’
    ডঃ চ্যাটার্জী তখনও শুয়েছিলেন। তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠে বললেন—‘কি?’
    --‘আপনার ম্যাঙ্গো সিরাপে একটু জলজিরা ছাড়া আর কিছুই ছিল না! জলজিরায় আপনার অ্যালার্জি। আগেই বলেছিলেন। তাই ড্রিঙ্কটা খেয়ে শরীর খারাপ লাগছিল। বমি পাচ্ছিল’।
    --‘কিন্তু তুমি যে বললে...’।
    --‘আমি কি সবসময়ই সত্যি কথা বলি?’ সে হেসে ফেলেছে—‘আর তারপর আপনি যে পরিমাণ ন’অশে মে গিরলেন, তার বর্নণা আর না করাই ভালো!’
    ডঃ চ্যাটার্জী দাঁত কিড়মিড় করছেন—‘রাজা...আই উইল কিল ইউ! কোনওদিন সত্যিই তোমায় আমি খুন করে ফেলবো’।
    --‘যাক্‌, ন’অশে কেটেছে তবে আপনার’! অধিরাজ বলল—‘তাহলে চলুন। বাড়িতে বিরিয়ানি অপেক্ষা করছে। খেতে হবে না?’
    তিনজনেই গাড়িতে চেপে বসলেন। ডঃ চ্যাটার্জী ক্ষেপে গিয়ে গরগর করছেন। তাঁর গজগজানিকে অগ্রাহ্য করেই গাড়িতে স্টার্ট দিল অধিরাজ।
    কেস ক্লোজড হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার বুকের ভিতরে তখনও একটা সূক্ষ্ম ব্যথা খচখচ করছিল।
    অবিকল রাজকাঁকড়ার কাঁটার মতন...।

    (সমাপ্ত)


    পি এম, ২৬-২৭ বছরে আই জি হওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কিন্তু অসম্ভব নয়। আই এ এস পরীক্ষার টপ লিস্টে থাকলে সেক্ষেত্রে যদি কোনও আই এ এস, পুলিস সার্ভিস বেছে নেয়--সেক্ষেত্রে এই জাতীয় পোস্ট পাওয়াটা খুব কষ্টের ব্যাপার নয়। আর ভালো পার্ফর্ম্যান্স দেখালে উন্নতি হতে বাধ্য। শুরুই হয় কমিশনার অব পুলিস দিয়ে। আর যেহেতু এটা ডিটেকটিভ সেল সেহেতু আরও বেশি সম্ভব। তবে জেনারেল পুলিসের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
    তবু প্রশ্নটা তুললেন বলে বলছি---ব্যাপারটা হয় না ঠিকই, কিন্তু একেবারে হতে পারে না তা নয়---নায়কের চরিত্রের ক্ষেত্রে নয় একটু পোয়েটিক লাইসেন্স নিলুম। মুশকিল হ্যায়, পর নামুমকিন নেহি! পঁচিশ বছরেও যদি কেউ নোবেল পেতে পারে, তবে ছাব্বিশ সাতাশে আই জি হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব?
    সত্যি কথা বলতে আমরা যা যা লিখি, তা কি সত্যিই সম্ভব হয়? সুন্দরবনে কি সাবমেরিন ঢোকে? না একটি লোক একাই তিনজনের রোলে পরপর অভিনয় করে যেতে পারে! আমি সন্দিহান!

    দ্বিতীয়ত, উনি ফরেনসিক রিপোর্টে যে লিখেছেন সেকথা বলেইছেন--' ‘আমি এই বুড়ো বয়েসে গোয়েন্দা গিরি করতে পারি না! যেটুকু করার করে দিয়েছি। ফরেনসিক রিপোর্ট তোমাদের হাতে আছে’।
    --‘কিন্তু স্যার...’ দেবাশিষ বলে—‘সেটুকু যথেষ্ট নয়। আপনার রিপোর্টে যা আছে তা দিয়ে তপন আচার্যর বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করা যাবে না! আপনি মৃত্যুর সময়, মৃত্যুর কারণ বলেছেন। কিন্তু মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌? সেটা কি? কি হতে পারে তার কোনও আন্দাজই নেই!’
    এবার উনি মৃত্যুর কারণ তো লিখে দিয়েই খালাস। কিন্তু পাঠক যে রইল অন্ধকারে। তারা তো কিছুই জানে না। মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌ সম্পর্কে ডঃ চ্যাটার্জী বলতেই পারেন। কিন্তু পাঠকের কি হবে? অগত্যা বেচারি শুরু থেকেই সব খুলে বললেন। মানে, বলতেই হল তাকে।

    পাই, খুব ভাল প্রশ্ন। জানলা একটা কারণেই ভাঙতে হল। এর আগেও সার্চ ওয়ারেন্ট কিংবা বিনা সার্চ ওয়ারেন্টে অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রেই কিছু পাওয়া যায়নি। অধিরাজ চেয়েছিল ভদ্রলোকের অনুপস্থিতিতে তার টেবিলটা একবার খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে। সার্চওয়ারেন্ট নিয়ে এলে সার্চ হয়, কিন্তু অত মাইনুটলি সার্চ করা যায় না।
    এখন মিঃ আচার্য বাড়িতে না থাকলে তার জন্য জানলা কে খুলে দেবে? দরজা দিয়েও তো ঢোকা সম্ভব নয়! তাই বেচারি হাত কেটে বসে রইল।

    ধাবার কাছে যে মৃত্যুগুলো ঘটছে সেটা তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত গোয়েন্দাবাহিনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তারা অস্ত্রের অভিনবত্বে এবং পরপর খুনে এতটাই বিব্রত হয়ে পড়েছিল যে খুনীর বেস অব অপারেশন যে ধাবা সেটা মাথাতেই আসেনি। এবং ওখানে একটা নয়, একাধিক ধাবা আছে--'--‘শোনো অর্নব’। অধিরাজ আস্তে আস্তে বলে—‘বেরোবার আগেই জায়গাটার লোকেশনটা দেখে নিয়েছি। এই অঞ্চলের কাছাকাছি মেইন রোডের উপরে গোটা তিনেক ধাবা আছে। আমি গাড়ি থেকে নামব না। তুমি প্রত্যেকটা ধাবায় গিয়ে প্রথমে মৃতব্যক্তিদের ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবে যে, তারা কখনও সেখানে খেয়েছিল কি না। তারপর তপন আচার্যের ফটো দেখিয়ে জানতে চাইবে, এই হাতকাটা সাহেব কখনও এখানে এসেছেন কি না’।
    সচরাচর এসব ক্ষেত্রে ধাবা গুলো কাছাকাছি বা পাশাপাশি থাকে। কেউ যদি একসাইডে গাড়িটা পার্ক করে খেতে নামে তবে পাশাপাশি ধাবাগুলোর মধ্যে কোনটাতে খেয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১২৭৭৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গরল - Sayantani Putatunda
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • PM | ***:*** | ০৭ মে ২০১৪ ১০:৩৭46266
  • পরের লেখা কই?
  • babita | ***:*** | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:০৫46267
  • দারুন। এরকম আরো চাই
  • মধুমিতা | ***:*** | ২৩ এপ্রিল ২০১৮ ০৫:৪২46268
  • বহুদিন বাদে জবরদস্ত লেখা ভালো লাগল ।
    বহুরূপী খুব সুন্দর হয়েছে ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন