তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে আফগানিস্তান ইত্যাদি নিয়ে একটি লেখা লিখেছেন। তার সারকথা মোটামুটি এইঃ
১। আমেরিকা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র গড়ে দিতে গিয়ে অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে।
২। সাধারণ মুসলমানরা এখন আফগানিস্তান থেকে পালাচ্ছেন, বা পালাতে চাইছেন, কারণ মুসলমানরাই সপ্তম শতাব্দীর ধর্মীয় আইনকে খুব ভয় পায়।
৩। তালিবানি আইন চূড়ান্ত নারীবিরোধী। সামান্য স্বাধীনতা উপভোগ করতে গেলেই মেয়েদের তারা পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলে। এবারও ফেলবে। বিয়ের নামে যৌনদাসী বানাবে।
৪। এই তালিবানি আইন এক দেশের ব্যাপার না। সিরিয়া এখন এসে গেছে আফগানিস্তানে, আফগানিস্তান বাংলাদেশে। এ হল প্যান ইসলামিজম। গোটা উপমহাদেশকে তার ফল ভুগতে হবে।
৫। বর্বর এই জঙ্গীরা নারীর সর্বনাশ করবে। তাদের মদত দেবার দায় পাকিস্তান, চিন, রাশিয়ার।
৬। দুনিয়ার মুসলমানরা নারীর এই অবমাননার বিরুদ্ধে তেমন প্রতিবাদ করছেনা, যেমন তারা করে থাকে পালেস্তাইনের ক্ষেত্রে। মুসলমান মৌলবাদীরা তো জায়গায় জায়গায় তালিবানের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
৭। নারীর পরনে যে দাসত্বের শৃঙ্খল, তা ভেঙে ফেলতে কয়েক শতাব্দী লেগেছে। এখন দুদিনেই আবার পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধর্মের আরেক নাম পুরুষতন্ত্র। কিন্তু ধর্মন্ধতা, মৌলবাদ, নারীবিদ্বেষ পুরুষকে রক্ষা করবেনা।
এই সারসংক্ষেপ আমার তৈরি (শুধু পরের মুখে ঝাল না খেয়ে আসল লেখাটি অবশ্যই পড়ুন --
https://www.bd-pratidin.com/editorial/2021/08/19/681973 ) । আলোচনার জন্য। না, তসলিমাকে নিয়ে কিছু বলার নেই, বরং ধন্যবাদই দেবার আছে। এই ধরণের একটি ন্যারেটিভ আভাসে ইঙ্গিতে টুকরো-টাকরায় পশ্চিমী এবং প্রাচ্যের মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে, সেটাকে গুছিয়ে স্পষ্ট করে লিখে ফেলার জন্য। না লিখলে আলোচনাটাই করা যেতনা।
তা, এই ন্যারেটিভের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট লক্ষণ নিয়ে কথা বলা যাক। এই ন্যারেটিভের প্রথম লক্ষণ হল, আফগানিস্তানকে আফগানিস্তান বানানোর জন্য পাকিস্তান, চিন এবং কখনও সখনও দুষ্টু রাশিয়াকে দায়ী করা। আর আমেরিকাকে স্রেফ একটু ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করা। আমেরিকা আফগানিস্তানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাট করেছে, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু উদ্দেশ্য তো ভালোই ছিল, গণতন্ত্রই তো গড়তে গিয়েছিল। মানুষকে ধর্মান্ধতা থেকে স্বাধীনতা দিয়েছিল, মেয়েদের দিয়েছিল ওড়ার আকাশ। কাইট রানার সেই পশ্চিমী স্বাধীনতার প্রতীক, মালালা হল মুখ। এখন আমেরিকার পিছিয়ে আসায় সে আকাশ ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, এবার অ্যাসিড বৃষ্টি আসন্ন -- এরকম একটা ভাব।
তো, এ ন্যারেটিভ এতই মোটাদাগের, এবং এতটাই অলীক, যে, আলাদা করে সমালোচনা করার এমনি কোনো কারণই নেই। তবু লেখা যখন হচ্ছে, তখন সংক্ষেপে, স্পষ্ট করেই বলা যাক, বাস্তবতা থেকে এসব অনেক দূরে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে আরব পর্যন্ত মৌলবাদীদের উত্থানে সক্রিয় ভূমিকা, মদৎ ছিল কাদের তা কোনো গোপন তথ্য নয়। আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ, সৌদি আরবের অগাধ কনট্র্যাক্ট, এবং তালিবানদের সঙ্গে চলমান আলোচনা, এসব নিশ্চয়ই গণতন্ত্র এবং নারীর অধিকারের স্বার্থে করা হয়নি। বস্তুত জঙ্গী ইসলাম, মূলত প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমের তৈরি।
এই ন্যারেটিভের দ্বিতীয় লক্ষণটি আরও কৌতুহলোদ্দীপক। লেখাটিতে, এই ধরণের লেখাগুলির সবকটিতেই, দুইটি বর্গের রমরমা। নারী এবং ইসলাম। এই দুটিকে ঘিরেই চর্চা চলে অবিরত। তা, এই নারী বর্গটি নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। গোটা পশ্চিমী মিডিয়াতেই এখন তথাকথিত 'অপর'দের প্রাধান্য। নারী হোক বা কালো রঙের লোক। এও এক নির্মিতি। কিন্তু তার গতিবিধি আলোচনা এখানে করা হচ্ছেনা। যেটা আকর্ষণীয়, সেটা হল, অন্য এক 'অপর'এর ক্ষেত্রে এই অপরবান্ধবতা একেবারেই ভেঙে পড়ছে। সেই অপর হল 'ইসলামিজম'। ইসলামও পশ্চিমের এক 'অপর'। পশ্চিমী সভ্যতার আলোর উল্টোপিঠ। কিন্তু এই 'অপর'কে গৌরবান্বিত করার ব্যাপার তো নেইই, বরং পুরোটাই ভিলেনের রঙে আঁকা। প্যান ইসলামিজম এখানে ভিলেন। দুষ্টু লোক।
এটা একটু কঠিন করে বলা হয়ে গেল। সোজা করে বললেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। ধরুন, হিলারি ক্লিন্টন ছিলেন যুদ্ধবাজ। বা মার্গারেট থ্যাচার উজিয়ে ফকল্যান্ডে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এঁদের জন্য নারীবাদকে বা নারীকে পশ্চিমী মিডিয়ায় কেউ ভিলেন ঠাওরায়না। যদি আদৌ কথাটা ওঠে, তখন বলা হয়, ওগুলো ব্যক্তির লক্ষণ, নারী নামক বর্গের নয়। কথাটা অবশ্য ওঠেইনা, বস্তুত এঁদের গৌরবের প্রশ্নে এই লক্ষণগুলোকে সযত্নে আড়াল করা হয়। যেমন হিলারি ক্লিন্টনের পক্ষের মিডিয়া ন্যারেটিভ ছিল 'গ্লাস সিলিং ভাঙা'। যুদ্ধ টুদ্ধ তার অনেক পিছনে। এই সমর্থন বা সহমর্মিতা কিন্তু ইসলামিজম পায়না। আড়াল করার তো প্রশ্নই নেই, বরং হিলারির সম্পূর্ণ উল্টোদিকে গিয়ে লাদেন একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ নন, একটি প্রতীক হয়ে যান, যদিও হিসেব করলে দেখা যাবে, লাদেনের আদেশে একটি শহরের একটি বহুতল ভেঙেছে, হিলারির আদেশে হয়তো একশটি। মুসলমানরা সদলবলে তালিবানদের নিন্দে না করে ভিলেন হয়ে যান, কিন্তু দুনিয়ার পশ্চিমীরা, মিডিয়া সহ, বুশ নামক এক রাষ্ট্রনায়কের স্রেফ গুলবাজি করে ইরাক নামক একটি গোটা দেশকে ধ্বংস করে দেবার নিন্দে সজোরে কখনই করে উঠতে পারলনা, তাই তারা গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক। এই অন্তর্নিহিত দ্বিচারিতা, আলোকজ্জ্বল পশ্চিমে আছে। ফলে লিঙ্গ বা গাত্রবর্ণ নিয়ে যতই ঢক্কানিনাদ চলুক, আদতে অপরবান্ধবতা, বোঝা যায়, পশ্চিমের আর পাঁচটি গিমিকের মধ্যে একটি।
তৃতীয় এবং সর্বশেষ লক্ষণটি এখানে লক্ষ্যণীয়, যে, শুধু ইসলামিজম-বনাম-নারী দ্বৈত নয়, আরও একটি দ্বৈতও এখানে প্রকট। সেটি হল নারী বনাম পুরুষ। নারীকে শুধু জঙ্গী ইসলামই পীড়ন করছে তা নয়, সামগ্রিক ভাবে পুরুষও একই দোষে দুষ্ট। অর্থাৎ শুধু 'ঐস্লামিক' পুরুষ নয়, এই ক্ষেত্রে বৃহত্তর ভিলেনটি হল পুরুষ। এর জন্য নির্মান করা হয়েছে একটি নতুনতর বর্গ, পুরুষতন্ত্র। ইংরিজিতে যে কথাটি ব্যবহৃত হত, বা এখনও হয়, তার বাংলা হল পিতৃতন্ত্র। সেটা ব্যবহার করা হত, বা হয়, একটি নির্দিষ্ট কারণে। পিতৃতন্ত্র একটি ব্যবস্থা, যা পুরুষ এবং নারীর জন্য অসমঞ্জস অবস্থান নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, পুরুষ যুদ্ধ করবে, দেশনেতা হবে, নারী বাড়ির কাজ করবে, নার্স ও শিক্ষিকা হবে -- মোটাদাগে বললে, এইরকম। নারীর স্বার্থে এই ব্যবস্থাটা বদলানো দরকার, বিংশ শতকের নানা ঢেউএর নারীবাদ, সেই কথাই বলত, আভ্যন্তরীন নানা বিতর্ক এবং মতভেদ সত্ত্বেও। এখানে কাঠামোগতভাবে কোনো ভিলেন ছিলনা। কিছু পুরুষ নিশ্চয়ই বদ, পুংরা জাতিগতভাবেই ভিলেন না, ভিলেন হল কাঠামোটা। একবিংশ শতকে জনপ্রিয় আখ্যানে বিষয়টা বদলাতে শুরু করে। ব্যবস্থা নয়, সরসরি 'ম্যান'কে ভিলেন তৈরি করা হয়। পুরুষের বৈশিষ্ট্য আলাদা করে চিহ্নিত করে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। তৈরি হয় 'টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি' বা 'ম্যানসপ্লেনিং' এর মতো বর্গ। বিংশ শতকের 'এমসিপি' জাতীয় বর্গের সঙ্গে এর তফাত হল, এমসিপি বা মেল-শভিনিস্ট-পিগ বলা হত কিছু ব্যক্তিকে। কিন্তু 'বিষাক্ত পৌরুষ' জাতীয় বর্গ সামগ্রিকভাবে পুরুষের লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে তৈরি। ইংরিজিতে পিতৃতন্ত্র বর্গটি এইভাবেই তার পুরোনো অর্থ থেকে নড়েচড়ে গেছে। শব্দটি যদিও বদলায়নি। বাংলায় সোজাসাপ্টা ভাবে শব্দটিই বদলে পিতৃতন্ত্রের জায়গায় পুরুষতন্ত্র করে ফেলা হয়েছে। এই বর্গের ব্যবহার একটুও আপতিক না, কারণ তসলিমার আখ্যানও এই একই লক্ষ্যে ধাবিত।
এটাও একটু কঠিন করে বলা হয়ে গেল। সোজা করে বললে, ধরুন, আপনার চারদিকে 'প্রগতিশীল' মনে করেন এমন একজন মানুষকেও দেখেছেন, যিনি তালিবানদের সমর্থক? লিঙ্গ বা ধর্ম নির্বিশেষে? খবরের কাগজে এরকম লোকেদের কথা নিশ্চয়ই পড়েছেন, কিন্তু কাছে পিঠে? সম্ভবত দেখেননি। কারণ তালিবানি কথাটিই প্রায় সর্বজনস্বীকৃত নিন্দাসূচক শব্দ। খোদ আফগানিস্তানেও পুরুষরা কি খুন হচ্ছেন না, না লড়ছেন না? নিশ্চয়ই তালিবানরা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু উল্টোদিকটাও, কম হলেও তো আছে। তার মরছে টরছেও। তাহলে ধর্ম পুরুষদের রক্ষা করছে, বা চিরকাল করবেনা, এই কথাটার মানে কী?
মানে একটাই। এই কথাটা শুধু নয়, সামগ্রিক ভাবে তিনটি লক্ষণেরই। একবিংশ শতকে রাজনীতির নতুন বয়ান তৈরি হচ্ছে। এগুলো তার অংশ। সেখানে আমেরিকা বা সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ আর ভিলেন নয়। মূল ভিলেন সন্ত্রাসবাদ, বা পড়ুন প্যান ইসলামিজম। খুচরো ভিলেন সামগ্রিকভাবে পুরুষরা। এবং সহমর্মিতা ধাবিত হবে, নারী, কালো, নিচু জাত এই বর্গগুলির দিকে। বিংশ শতকের রাজনীতির থেকে যা অনেকটাই আলাদা।
বিংশ শতকের রাজনীতির এরকম নির্দিষ্ট কেন্দ্রিকতা ছিলনা। পশ্চিমী দুনিয়ায় মূল শত্রু ছিল কমিউনিজম। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। তৃতীয় বিশ্বে পরিস্থিতি ঠিক উল্টো ছিল। সেখানে চিরশত্রু ছিল পুঁজিপতিরা এবং আমেরিকা। দুই জায়গাতেই এই রাজনীতিই মূল প্রাধান্য পেত। নারী বা কৃষ্ণাঙ্গ বা সমকামীদের ইস্যু ছিল পিছনের সারিতে। তারা মাঝেমাঝে উপচে পড়ত মূল ধারায়। চলত বিতর্ক। এখন হয়েছে ঠিক উল্টো। লিঙ্গ-বর্ণ-জাত -- শুধু উপচে পড়েছে নয়, নির্ণায়ক জায়গা নিয়ে নিয়েছে রাজনীতিতে। অবাস্তবরকম চরম জায়গায়ও চলে যাচ্ছে থেকেথেকেই। উল্টোদিকে পুঁজিবাদ আর ভিলেন নয়, নতুন ভিলেন হয়েছে, আগেই যা বলা হল, সন্ত্রাসবাদ, পুং ইত্যাদি।
রাজনীতি এভাবেই বদলায়। বিতর্ক হয়। আবার বদলায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একবিংশ শতকের রাজনীতির একটা জায়গাই খুবই বিপজ্জনক। তার রাজনীতির এককেন্দ্রিকতা। বিতর্কের অভাব। বিংশ শতকের রাজনীতি, তার সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বিতর্কের অভাবে কখনও ভোগেনি। বিতর্কের অভাব, পৃথিবীর ইতিহাসে, বরাবরই টোটালিটারিয়ান বা প্রায়-টোটালিটারিয়ান ব্যবস্থা ডেকে এনেছে। সে ম্যাকার্থির আমেরিকাই হোক, বা হিটলারের জার্মানি। শুধু তসলিমা তো নন, তাঁর লেখায় যে তিনটি লক্ষণের কথা বলা হয়, বাম-দক্ষিণ নির্বিশেষে সেগুলি সকলেরই গ্যান্ড ন্যারেটিভ হয়ে উঠছে। ভয়টা সেখানেই। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের ভয়। দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ এর ভয়। যে ভয়, বিংশ শতকে কেউ কখনও পায়নি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।