

বাংলা নাকি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। নিউ-ইয়র্ক সিটিতে গত নির্বাচনে কিছু জায়গায় ভোটে বাংলা ব্যালট হয়েছে। বার্নি স্যান্ডার্স অনলাইন প্রচার করেছেন বাংলায়। লন্ডনে হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশনের নাম লেখা হচ্ছে বাংলায়। রোম শহরে নাকি ইংরিজির চেয়ে বাংলা বেশি লোকে বলে। চারদিকে তাকালেই এইসব বিশ্বজয়ের খবর-টবর পাওয়া যায়। আরও হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে, যা আমি জানিনা। এর সবই ঠিক। কিন্তু কথা হল, ভালো হোক বা মন্দ, এর সব দায়ই বস্তুত বাংলাদেশের। ভারতীয় বাঙালির নয়, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের তো নয় বটেই। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র একটিমাত্র ভাষাকে ভারতীয় ভাষা হিসেবে বহির্বিশ্বে তুলে ধরে, তার নাম হিন্দি। ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট কেবলমাত্র দুটি ভাষায়, ইংরিজি এবং হিন্দি। ভারতীয় বিমানসংস্থা এয়ার-ইন্ডিয়া বিদেশে (এবং দেশেও) ঘোষণা করে কেবলমাত্র হিন্দি এবং ইংরিজিতে। বহির্বিশ্বে ভারতের পরিচয় হিন্দিভাষী দেশ হিসেবে। আর বাংলার যেটুকু পরিচিতি, সেটা বাংলাদেশের ভাষা হিসেবে। সঙ্গে ফুটনোটে খুব ছোটো-ছোটো করে লেখা থাকে, "ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলেও এই ভাষাটি বলা হয়ে থাকে"। বাংলার পরিচিতি বলতে ওইটুকুই।
ভারতীয় বাঙালিও এ নিয়ে বিশেষ চিন্তিত না। একরকম ভাবে স্বীকৃতই হয়ে গেছে, যে, ব্যাপারটা এরকমই হবে। এরকমই হবার কথা। ইংরিজিতে আছে ঘ্যাম, হিন্দি হল রাজভাষা -- এখন সেটাকে ওই নামেই ডাকা হচ্ছে, আর বাংলার কী আছে? কিস্যু না। বাঙালি যদিও হিন্দি সিনেমা গুছিয়ে দেখে, কিন্তু "মেরে পাস মা হ্যায়" -- এই ডায়লগ যে নেহাৎই ফালতু, এর যে কোনো বৌদ্ধিক বা আবেগগত আবেদন নেই, সেটা সে নিজেও বিলক্ষণ বোঝে। হ্যাঁ, দুর্গাপুজো, পয়লা বৈশাখ, আর বঙ্গোৎসব-টব হয়, যেমন গ্রামে-গঞ্জে হয় চড়ক আর গাজন, কিন্তু সেসব নেহাৎই স্থানীয় কারবার। তার বাইরে, ভারতীয় বাঙালি অন্য ভারতীয়ের সঙ্গে স্বেচ্ছায় এগিয়ে গিয়ে কথা বলে হিন্দিতে। বাঙালির দ্বিতীয় প্রজন্ম ক্রমশ বাংলাটা ভুলে যাচ্ছে। শুধু বিদেশে বা ভিন রাজ্যেই না, খোদ কলকাতা শহরেও। কিন্তু এসব নিয়ে বলতে গেলে বাঙালি নিজেই হাঁ হাঁ করে উঠবে। তারা সর্বভারতীয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক হচ্ছে। আরও কী-কী হচ্ছে, ঈশ্বরই জানেন। সেখানে এসব ছোটো মনের পরিচয় দেওয়াটা ঠিক না।
যদিও, যুক্তি দিয়ে জিনিসটা বোঝা দুষ্কর। বাঙালি যদি দিল্লি কিংবা নিউ-ইয়র্কে গিয়ে হিন্দি কিংবা ইংরিজি ভাষী হয়ে ওঠে, সেটাই যদি দস্তুর হয়, তবে বাংলায় এসে অন্যভাষীদের বঙ্গভাষী হয়ে ওঠারই কথা। আবার অন্যভাষীরা বাংলায় এসে যদি নিজের ভাষা বজায় রাখে, বা রাখতে পারে, অন্যত্র বাঙালিদেরও তেমনই হবার কথা। এর কোনোটাই হয়না। ভারতীয় বাঙালির কাছে এর কোনো ব্যাখ্যাও নেই। সম্ভবত অস্বস্তিকর বলেই। আর সেই জন্য প্রশ্নটা তোলাই ট্যাবু। তুললে কঠিন-কঠিন ইংরিজি গালি বর্ষিত হতে পারে।
আর এটা ট্যাবু বলেই বাকি প্রশ্নগুলোও ওঠেনা। ভারতবর্ষের বাইরে ছাড়ুন, আপনি যদি দিল্লি থেকে অন্তর্দেশীয় উড়ানে কলকাতা যান, সেখানে ঘোষণা শুনবেন হিন্দি এবং ইংরিজিতে। তারপর যদি ট্যাক্সিতে ওঠেন, এবং ট্যাক্সিওয়ালা এফএম চালায়, শুনবেন, সব গানই হিন্দি গান। যদি বিনোদনের জন্য সিনেমা দেখতে যান, তো দেখবেন, বেশিরভাগ সময়েই মাল্টিপ্লেক্সে একটিও বাংলা সিনেমা নেই। যদি বাংলার গর্ব বইমেলায় যান, শুনবেন, সব ঘোষণা হচ্ছে তিনটি ভাষায়, ইংরিজি, হিন্দি এবং বাংলা। একে ইংরিজিতে বলে ইনক্লুসিভনেস, বাংলায় বলে সকলকে আপন করে নেওয়া। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু আপন যদি করতেই হয়, তো স্রেফ হিন্দি কেন। পাশের পাড়ার ভোজপুরি, অসমীয়া, উড়িয়া, তেলুগু কী দোষ করল? প্রশ্ন করলে, আবারও কোনো উত্তর পাবেননা। কারণ এটাও ট্যাবুরই অংশ।
যেটা ট্যাবু নয়, সেটা হল সংবাদ চ্যানেল। দিনের যেকোনো সময় যেকোনো সংবাদ চ্যানেল খুলুন, দেখবেন, চাট্টি লোক, পুরুষ বা মহিলা, একত্রে বিশুদ্ধ বাংলায় তারস্বরে চিৎকার করছে। সেটাকে আমজনতা বলে ঝগড়া, ওঁরা বলেন রাজনৈতিক বিতর্ক। তা,গোলাপকে যে নামেই ডাকুন, বার্তাটা পরিষ্কার। বাংলায় কাজ হয়না, সিনেমা হয়না, গান হয়না, শিল্প-সংস্কৃতি কিস্যু হয়না। ভাষাটা কেবলমাত্র একটা জিনিসের জন্যই উপযুক্ত, তা হল ঝগড়া। ওইটুকুই করা যায়। সেইজন্যই বাংলা সিরিয়ালে দেখবেন, তেড়ে ষড়যন্ত্র। সবাই সবার সঙ্গে ঝগড়া করে চলেছে। বাংলা ভাষায়। ওইটাই যাবতীয় সিরিয়ালের থিম। কিন্তু যেই গান চালাতে হল, হিন্দি গান চালিয়ে দিল। কারণ ঝগড়া ব্যতীত বাংলায় হয়টা কী।
বাংলা লেখালিখির বাজারও তথৈবচ। ঝগড়ার বদলে 'জনপ্রিয়' লেখালিখি বেছে নিয়েছে এমন বিষয়কে, যা, ওইরকমই উচ্চমার্গীয়। স্বপনকুমার একটা সময় কচি বাচ্চারা পড়ত, বড়রা তা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করত। ফেলুদার গোটা উপাখ্যানই তো বাংলা রহস্যরোমাঞ্চকে খিল্লি করে লেখা। আর এখন থ্রিলার নাম দিয়ে বড়দের জন্য প্রথমসারির সাময়িকীতে ছাপা হয় সেইসব গপ্পো বা উপন্যাস, যেখানে অনায়াসে অ্যাটম বোমা পিঠে নিয়ে সীমানা টপকিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে চলে যায় ভিলেন। গল্পের গরু ইনস্যাটে ওঠে, যমালয়ে চলে যায় জীবন্ত মানুষ। সে নিয়ে ঠাট্টা করলে গণপিটুনি খেতে হতে পারে। একটা সময় যেসব ইতিহাসনির্ভর লেখা, বা ধরুন রহস্যভেদী উপন্যাস স্রেফ কিশোরপাঠ্য পদবাচ্য ছিল, সেসবই এখন চশমা এঁটে পড়ছেন বিদগ্ধরা। সেখানে শাড়ি-ব্লাউজ পরে ঘুরছেন অষ্টাদশ শতকের মহিলা, সম্রাট আকবরের গাড়োয়ান দেশলাই জ্বেলে বিড়ি ধরাচ্ছেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলার উপায় নেই। তার উপর আছে ভূতপ্রেত আর তন্ত্রমন্ত্র। এর সবই আগে হত। যেমন ঝগড়াও হত আগে, কিন্তু টিভি চ্যানেলে সেটাকে বিতর্ক বলে চালানো হতনা। সেরকম এগুলোকেও সিরিয়াস সাহিত্য হিসেবে কখনও চালানো হয়নি। এখন হয়। বাংলা ভাষায় ঝগড়া ছাড়াও তৃতীয় শ্রেণীর নভেলও লেখা হয় বটে।
এ সবই একটা ভাষার অনাড়ম্বরে চুপচাপ উঠে যাবার প্রাথমিক লক্ষণ। তাতে কোনো সমস্যা নেই। পৃথিবীতে কত ভাষাই উঠে গেছে। ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বাংলা ভাষাটা উঠে গেলেই বা কী। কিন্তু সমস্যা হল, এসবের পরে, বাঙালি আবার নিজেই নাক কুঁচকে বলে, বাংলায় ভালো সিনেমা হচ্ছেনা। ভালো লেখা হচ্ছেনা। আগে কত ভালো হত। আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য কত সুমহান, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, ইত্যাদি। খুব ভুল কিছু বলে তা নয়। টালিগঞ্জে এখন যাঁরা রাজত্ব করছেন, যাঁরা নাগাড়ে স্ক্রিপ্ট লিখে চলেছেন, যাঁরা প্রসব করে চলেছেন গপ্পো-উপন্যাস-কবিতা, তাঁরা এমনিতে, কে জানে, হয়তো শক্তিমান মানুষ, কিন্তু কর্মকান্ড দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। সর্বত্র, নিচু থেকে নিচুতর স্তরে যাবার প্রতিযোগিতা। কিন্তু কথা হল, একটা ভাষা এবং তৎসংলগ্ন সংস্কৃতি উঠে যাবার উপক্রম হলে, এরকমই হবে। যে পারবে নৌকো ছেড়ে বোম্বে পালাবে। বাদবাকি সবকিছু তলানিতে এসে ঠেকবে। এর সবটাই কিছু লোকের দায় নয়। তাঁরা একার উদ্যোগে ভাষাটা তুলে দেবার উপক্রম করেননি। করেছি আমরা সবাই মিলে। আমরা পরের প্রজন্মকে ভাষা শেখাইনি। আমরা শহরের রেডিও থেকে বাংলা গান উঠে যাওয়ায়, পলকটিও ফেলিনি। আমরা মাল্টিপ্লেক্স থেকে বাংলা সিনেমা উঠে যাবার পরে, লাইন দিয়েছি হিন্দি সিনেমা দেখতে। আমরা বহুভাষিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে বাকস্তব্ধ থেকেছি। আমরা বাংলা ভাষাকে সামাজিক অথবা রাজনৈতিক কার্যক্রমের অংশ করে তো তুলিইনি, বরং তুলতে চাওয়াকে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছি। এর দায় স্রেফ সিনেমাওয়ালাদের নয়, গদ্যলিখিয়েদের নয়, আমাদের সব্বার। আমরা সব্বাই ফেল করেছি। আজ থেকে দুশো বছর পরে, ভারত ভূখণ্ডে মরে যাওয়া বাংলা ভাষার ইতিহাস লিখতে হলে, আমাদের প্রজন্ম সম্পর্কে একটা কথাই লেখা থাকবে -- "রেকর্ড নম্বর সহ অকৃতকার্য"। চতুর্দিকে আঙুল তোলার আগে, বিশ্বের অন্যতম চিন্তাশীল জাতি হিসেবে, এইটা আমাদের মেনে নেওয়াই ভালো।
lcm | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২২:৩৮506572
এলেবেলে | 2402:3a80:1153:66d3:815:5a74:705:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২২:৩৯506573
S | 2405:8100:8000:5ca1::324:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২২:৪১506574
S | 2405:8100:8000:5ca1::298:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২২:৪৪506575
Abhyu | 47.39.***.*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২২:৫৭506576
Abhyu | 47.39.***.*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:০১506577
S | 2405:8100:8000:5ca1::4c1:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:০৮506580
r2h | 2405:201:8005:9947:e92b:3c3:afba:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:১৬506581
এলেবেলে | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:২০506582
lcm | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:২১506583
lcm | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:২৩506585

এলেবেলে | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:২৭506588
S | 2405:8100:8000:5ca1::e8:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৩১506591
r2h | 2405:201:8005:9947:e92b:3c3:afba:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৩৪506592
এলেবেলে | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৩৫506593
এলেবেলে | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৩৮506594
S | 2405:8100:8000:5ca1::326:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৪০506596
r2h | 2405:201:8005:9947:e92b:3c3:afba:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৪৬506601
এলেবেলে | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৪৬506602
dc | 2401:4900:2328:c9e4:906c:87d9:547f:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৪৬506603
r2h | 2405:201:8005:9947:e92b:3c3:afba:***:*** | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৪৬506604