শ্রীমতী শুক্লা রায়ের জীবনের একটি পর্যায় অবধি লেখা আত্মজীবনী এই জীবনের তিনকাহন। খুব সহজ ভাবে বলা নিজের জীবন কাহিনি। “… the frankness, freedom and openness that leads one to say what one has to say, as one wishes to say it, when one wishes to say it and in the form one thinks is necessary for saying it.” — এই ভাবে জীবনের ‘সবকিছু’ বলাকে মিশেল ফুকো বলেছেন ‘Parrhesia’। ব্যক্তি তখন নিজেই নিজের ‘সাবজেক্ট’। নিজের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে, নিজের মতো করে প্রকাশ করেন জীবনের ‘সত্য’-গুলি। আত্মজীবনী এই ‘Parrhesia’ ব্যক্ত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম। অবশ্যই সফল ‘Parrhesia’ হয়ে ওঠার কিছু শর্ত আছে। ভাষা হবে সহজ-সরল। জবানি খোলামেলা। বলার আনন্দে বলে চলা। এ যেন শিল্পীর নিজের মর্জিমাফিক ছবি আঁকা। মন্টেনিয়া, যাঁকে প্রথম আধুনিক আত্মজীবনীর জনক মনে করা হয়, তিনি আত্মজীবনী প্রসঙ্গে লিখেছেন, “I do not paint the self. I paint the step.” রবীন্দ্রনাথও তাঁর জীবনস্মৃতি-তে লিখেছেন “জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে— তাহা কোন্ এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তে রচনা। তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রঙ পড়িয়াছে তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে— সে-রঙ তাহার নিজের ভাণ্ডারের, সে-রঙ তাহাকে নিজের রসে গুলিয়া লইতে হইয়াছে।”
শুক্লা রায়-এর এই জীবনের তিনকাহন সফল আত্মজীবনী হয়ে ওঠার সমস্ত সম্পদে ভরপুর। জীবনের তিন পর্যায় লেখিকা ব্যক্ত করেছেন বইটিতে। প্রথম কাহিনি বাপের বাড়ি, দ্বিতীয় কাহিনি সংসার পাতা, তৃতীয় কাহিনি প্রবাসপর্ব (স্বামীর কর্ম এবং শিক্ষাসূত্রে)। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্বের প্রায় সমস্ত মধ্যবিত্ত/উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের সঞ্চারপথ এই রকমই (প্রবাসপর্বের কিছু দিন বাদ দিলে)। বিংশ শতকের শেষ ভাগ বা একবিংশ শতকেও এই মডেলকে খানিকটা সম্প্রসারিত করলে ভুল হয় না। সুতরাং, ব্যতিক্রম নয়, সমাজের বৃহত্তর অংশের মেয়েদের জীবনযাত্রার ধরনের একটি প্রতিচ্ছবি বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে। এই রকম সার্বিক সাধারণীকরণ অবশ্য সর্বতোভাবে ঠিক নয়। লেখিকার জীবনচর্যার স্বকীয়তা-সততা এবং জীবনশৈলীর কাব্যময়তায় অবশ্যই তিনি অনন্যা। তবে লেখিকা নিজেকে সেই ‘সাধারণ মেয়ে’-র পর্যায়ভুক্ত করেছেন, “মন দিয়ে সংসার করা ছাড়া যে জীবনে আর তেমন কিছুই করেনি।” সেই জন্যই হয়তো নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে আমিত্বের আত্মঘোষণা নেই বইটির কোনও ছত্রে। সফল আত্মজীবনীর ‘Parrhesia’- র শর্ত তাই একেবারেই বিঘ্নিত হয়নি। প্রসঙ্গত, মন্টেনিয়া, যাঁরা আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে ‘আমি’-র মহত্বের আত্মঘোষক হয়ে ওঠেন, তাদেরকে সোজাসুজি ‘rhetoricians’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন “they either make up the whole story or else disguise and pollute some source of truth.”
এই জীবনের তিনকাহন-এর প্রথমপর্ব, ‘বাপের বাড়ি’। লেখিকার জন্ম ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এ বাড়ি। ঠাকুরদা, ঠাকুমা, বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসি সকলে মিলে বিশাল এক যৌথ পরিবার। চন্দননগরে সংস্কৃত টোল পণ্ডিতের বংশগত জীবিকা ছেড়ে শিক্ষা-চাকরির জন্য ঠাকুরদার কলকাতায়ন। তারপরে কলকাতায় বাড়ি বানিয়ে পাকাপাকি ভাবে বসবাস। বাবা-কাকা-জ্যাঠারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা আইনজীবী। বাড়ি ভর্তি ভাই-বোনেরা, আর আছেন গোপালজিউ। সেইজন্য বাড়িতে আমিষ খাবারের প্রচলন নেই। ভাই-বোনেরা মিলে বাড়িটাকে পুরো মাতিয়ে রাখে। কখনও থিয়েটার, কখনও হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ, আবার কখনও বা নিখাদ দুষ্টুমি। সঙ্গে বিজয়া, দোল, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার মতো চিরাচরিত উৎসব পালন তো লেগেই আছে। সেখানেও অবশ্য পারিবারিক বৈশিষ্ট্যের বিশেষ কিছু স্বাক্ষর আছে। অন্দরের অন্তর লেখিকার লেখায় এক নিরবচ্ছিন্ন চিত্রপটে ধরা দিয়েছে। কত রকমের মানুষজন, কত নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচয়, কত রকম খাওয়াদাওয়া... বাঙালির রান্নার স্বাদ আর ধরন বদলের বেশ কিছু উদাহরণ আছে এই পর্বে। যেমন:- প্রবাসী মেজো পিসিমার সূত্রে রান্নায় প্রথম ধনেপাতার ব্যবহার। শুরুতে যে স্বাদ মোটেও ভাল লাগেনি। তারপর ধনেপাতা ক্রমশ অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে শীতকালীন রান্নায়। আবার বাড়িতে সাবেকি নানা রকম পদ, বিশেষ করে মিষ্টির পাশাপাশি আইসক্রিম তৈরির এক বিচিত্র পদ্ধতির সূচনা। আসলে সময়টাই তো রূপান্তরের। অন্দরে তো তার ছাপ পড়বেই। লেখিকা সময়ের এই রূপান্তরের সাক্ষী। স্বাধীনতা আন্দোলন, গান্ধীর মিটিং, যুদ্ধ, স্বাধীনতা, সাহেবদের চলে যাওয়া, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা... ক্রান্তিকালকে অন্দরে থাকা বালিকা বুঝেছে নিজের মতো করে।
ডায়াসেশন স্কুল, তারপর কমলা গার্লসে পড়াশোনা। এর পাশাপাশি নাচ আর গানের শিক্ষা। গানের শিক্ষা তো বেশ বিস্তারিত। ছোট থেকে মাঝেমধ্যেই নাচের অনুষ্ঠান করতেন অভিভাবকদের সম্মতিতে। গানের শিক্ষা ‘গীতবিতান’-এ বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে। মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত। দক্ষিণ কলকাতায় মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা কী ভাবে নাচ-গানের মতো ‘পারফর্মিং আর্টস’ সর্বসমক্ষে প্রদর্শন ও চর্চা করার অধিকার পেতে শুরু করেছিলেন, শুক্লা দেবীর লেখা পড়লে সেই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এই পর্বেই লেখিকা তাঁর উত্তর কলকাতায় মামাবাড়িরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মামাবাড়ি বাগবাজারের এক জমিদার পরিবার। তার সঙ্গে লেখিকার বাপের বাড়ি দক্ষিণ কলকাতার চাকুরিজীবী পরিবারের আচার-বিচার, ভাবনার তফাত নেহাত কম ছিল না।
প্রথম পর্বটিতে লেখার ধরন বেশ এলোমেলো। গল্প বলার নেশায় সময়ের পথে বহুদূর এগিয়ে গেছেন, আবার পিছন ফিরে এসেছেন। আবার নতুন করে শুরু করেছেন। তবে সফল আত্মজীবনী হয়ে ওঠার এটিও অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনও পূর্বপরিকল্পিত কাঠামো থাকবে না। মন্টেনিয়ার ভাষায় বললে সফল আত্মজীবনী লেখার প্রধান কথাই নিজের জীবন বর্ণনায় দায়িত্ব সহকারে নিয়মনিষ্ঠ থাকা। কাউকে খতিয়ান দেওয়ার জন্য নয়, বরং বলার স্রোতে বলে চলা নিজের কাহিনি। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর জীবনস্মৃতি-তে বলেই দিয়েছেন, “স্মৃতির ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথরূপে ইতিহাসসংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ...” শুক্লা দেবীর এই জীবনের তিনকাহন-ও তাই জীবনের ছবি দেখার নেশায় ছবি দেখে চলা।
দ্বিতীয় পর্ব সংসার পাতা। বড় একান্নবর্তী পরিবারের পরিচিত ঘেরাটোপ ছেড়ে সতেরো বছর বয়সি একটি মেয়ে সংসার পাতল তেইশ বছর বয়সি আর.জি.কর হাসপাতালের হাউস সার্জেন ডাঃ শ্রীকুমার রায়ের সঙ্গে। এই বিবাহ বৃত্তান্তও বড় মধুর। দক্ষিণ কলকাতা ছেড়ে উত্তর কলকাতায় সপ্তদশী শুক্লা দেবী। শ্যামপুকুর স্ট্রিটে বাড়ি। সংসারে দু’টি মানুষ আর বাপের বাড়ি থেকে আসা একজন সর্বক্ষণের কাজের মহিলা। সব মিলিয়ে তিন জন। এরপর লেখার ছত্রে ছত্রে উত্তর কলকাতার সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার রীতিনীতির পার্থক্য ধরা দিয়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের বিভিন্ন কাজে বাইরে বেরোনোর ক্ষেত্রে এই পার্থক্য বেশ ভালই চোখে পড়ার মতো। একই সময় দাঁড়িয়ে থেকে একই কলকাতার মধ্যে পরতে পরতে কত অসংখ্য কলকাতা লুকিয়ে আছে তার খানিক হদিস মিলতে পারে বইটি থেকে।
সংসার পাতা পর্বে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে স্বামী ডাঃ শ্রীকুমার রায়ের প্রসঙ্গ। একদিকে স্বামীর একজন সফল, দরদি, প্রকৃত সেবার মনোভাবাপন্ন ডাক্তার হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। হাউস সার্জেন থেকে এফ.আর.সি.এস হয়ে ওঠার অদম্য লড়াই। অন্য দিকে, স্বামীর সঙ্গে সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করে তিল তিল করে সংসার গড়ে তোলার ‘কাহিনি’। স্বামীকে নিজের আদর্শ বজায় রেখে সততার সঙ্গে সাফল্যের পথে এগিয়ে দেওয়ার কাজ নেহাত সহজ ছিল না। প্রথম দিকের পথ চলা মোটেই মসৃণ নয়। কারণ, সৎপথে চলা স্বামীর সীমিত উপার্জন। তার থেকে সংসার চালিয়ে স্বামীর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রার ব্যবস্থা। অঙ্ক কষে হিসেব-নিকেশ করে চলতে হত। স্বামীর এবং তাঁর পেশার প্রতি ছিল শুক্লাদেবীর সীমাহীন শ্রদ্ধা। আবার, বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থানের পার্থক্য, সম্পর্কের টানাপড়েনও আলোচনা করেছেন অকপটে। এই বইটি চিকিৎসক পেশাটিকেও নতুন করে চিনতে শেখায়। বিশেষ করে আজকের দিনে, যেখানে চিকিৎসা শুধুই পরিষেবা। সেবার প্রসঙ্গ নেহাতই গৌণ।
আবার ফিরে যাই জীবনকাহিনিতে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন। কন্যাসন্তান, নাম অনুরাধা। তাকে নিয়ে আবার নতুন রকমের লড়াই শুরু। শিশুটি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রোগে ভোগে। বিশেষ করে টনসিলের সমস্যায়। ডাক্তারের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে সময়োপযোগী চিকিৎসা এবং বাঙালি মায়ের শুশ্রূষার বিশদ বিবরণ আছে বইটিতে। শুধু শারীরিক বিকাশ নয়, আত্মিক-বৌদ্ধিক সমস্ত রকম বিকাশের দিকে মায়ের ছিল কড়া নজর। বেঞ্জামিন স্পোকের লেখা Dr. Spock’s Baby And Child Care বইটির কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে বাঙালি মায়ের বিধানগুলিও যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য।
এই পর্বেই আরও এক জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন লেখিকা। এরপর জীবনকাহিনির বাকি অংশেও ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর প্রসঙ্গ। তিনি হলেন রাধারানি। শ্বশুরমশাই ডাঃ জ্যোতিষচন্দ্র রায়কে এক সন্ন্যাসী অষ্টধাতুর অপূর্ব সুন্দর রাধারানির মূর্তি দিয়েছিলেন। শুক্লাদেবীর ‘নিভৃত যতনে’ রাধারানি পরম নিশ্চিন্তে স্বমহিমায় বিরাজমান। সর্বক্ষণের সখী। ধর্মের সঙ্গে এমন সহজ বোঝাপড়া জীবনকাহিনিকে এক অন্যমাত্রা দিয়েছে।
এরপর দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়ে ডাঃ শ্রীকুমার রায় পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। সময়টা ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস। প্রথমে গিয়েই চাকরিতে যোগ দেন, সঙ্গে চলে এফ.আর.সি.এস-এর প্রস্তুতি। এক চাকরির মেয়াদ শেষ হলে আরেক চাকরি। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ বলতে প্রতি মাসে একটি নীল এয়ার লেটার। স্বামী একটু থিতু হওয়ার পর BOAC-র প্লেনে করে তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে বিলেত যাত্রা। সময়টা একটু স্মরণে রাখা দরকার। ছয়ের দশকে বিদেশযাত্রা আজকের মতো এত সহজ ব্যাপার ছিল না। যাই হোক, লন্ডন থেকে ট্রেনে বার্মিংহ্যাম, তারপর সেখান থেকে ওয়ালসের কোয়ার্টার্স। অপরিচিত জায়গা, মানুষজন, অনভ্যস্ত আবহাওয়া, শুরুর দিকে ভাষাতে খানিক জড়তা— এই সব কিছুর সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়া। অন্যদিকে, হাসপাতালে স্বামীর অত্যন্ত কর্মব্যস্ত জীবন সঙ্গে এফ.আর.সি.এস পরীক্ষার প্রস্তুতি। আস্তে আস্তে ওই দেশের বিভিন্ন মানুষ এবং বিদেশে বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। বঙ্গতনয়ার বয়ানে বিদেশি বন্ধুদের থেকে শেখা রান্না এবং ওদেশের রীতিনীতি বিষয়ে আলোচনা বেশ আকর্ষণীয়। ওদেশেই কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করে দেন মেয়েকে। বাড়িতে চলতে থাকে বাংলা শিক্ষার পাঠ। যাতে ভারতে ফিরে মানিয়ে নিতে অসুবিধা না হয়। এর মধ্যেই ঐকান্তিক পরিশ্রমের ফসল, ডাঃ রায়ের এফ.আর.সি.এস পরীক্ষায় সাফল্য। এরপর সপরিবারে দেশে ফেরার পালা। জাহাজে। জাহাজের নাম ‘দ্য চুসান’। সৈয়দ মুজতবা আলির জাহাজযাত্রার কথা আমরা পড়েছি। এই বাঙালি পরিবারটির চোদ্দ-পনেরো দিনের সমুদ্রযাত্রার বিবরণও নেহাত কম রঙিন নয়। দেশে জাহাজ ফিরে আসে, লেখাও শেষ হয়।
লেখা শেষ হয়, কিন্তু লেখার রেশ শেষ হয় না। মনে হয় এত ক্ষণ কেউ যেন পাশে বসে গল্প শোনাচ্ছিল। এমন ভাবে বইটি লেখা, সেখানে ভাষা কোন এক অলীক জাদুগরিতে জীবনের গল্পগুলিকে অক্লেশে স্বতোৎসারিত ভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে। অহেতুক জটিলতা, শব্দের মারপ্যাঁচ ছাড়াই যে ভাষা সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই জীবনের তিনকাহন। অনেক সময় কথ্য শব্দই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন লেখিকা। যা লেখক আর পাঠকের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। যেমন: কখনও কখনও ‘বেরোলাম’-কে ‘বেরুলাম’, “বিজয়া নামের একটি তুখোড় মেয়ে লেকেতে চারটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে” এখানে ‘লেকে’ না বলে ‘লেকেতে’ বলা , এই রকম আরও উদাহরণ আছে। আবার সব সময়ই এই রকম কথ্য শব্দের ব্যবহার নেই।
প্রাচীন গ্রিস, রোমে পণ্ডিতদের মধ্যে ‘Parrhesia’ নিয়ে নিজেদের মতো করে সচেতনতা তৈরি হচ্ছিল। ফুকো অবশ্য পরে ‘Parrhesia’-কে একটু তাত্ত্বিক ভাবে ব্যবহার করেছেন। প্রাচীন রোমে সেনেকা নামে এক স্টোয়িক দার্শনিক এই বিষয়ে বেশ খানিক আলোচনা করেন। সেনেকার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রুশো তাঁর The Confession-এর অপ্রকাশিত এক প্রস্তাবনায় লেখেন, “So I take my sides with style, as with things. I will not endeavour to make it uniform; I will have the style that comes to me, I will change styles according to my mood without qualms, I will say everything as I feel it, as I see it, without searching, without embarrassment, without bothering about the muddle. (…) my uneven and natural style, sometimes fast and sometimes diffuse, sometimes wise and sometimes crazy, sometimes serious and sometimes cheerful, will be part of my story.’’ এই জীবনের তিনকাহন-এর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
লেখিকার বিরুদ্ধে একটি-ই অভিযোগ। বড় তাড়াতাড়ি এই বই যেন শেষ হয়ে গেল। আরও একটু প্রলম্বিত হলে পাঠকের চাহিদা মিটতে পারত।
তবে সার্বিক ভাবে আত্মজীবনীটি পাঠ করে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এটি সর্বতো ভাবে সফল। ‘Parrhesia’–র শর্ত পূরণ হয়েছে অজান্তেই। তত্ত্বকে অতিক্রম করে, মন্দ-ভালো-দুঃখ-সুখ-এর পথ পাড়ি দিয়ে এই জীবনের তিনকাহন হয়ে উঠেছে জীবনের আনন্দগান।